শ্লোকঃ ৫৭

চেতসা সর্বকর্মাণি ময়ি সংন্যস্য মৎপরঃ ।

বুদ্ধিযোগমুপাশ্রিত্য মচ্চিত্তঃ সততং ভব ৷। ৫৭ ।।

চেতসা—বুদ্ধির দ্বারা; সর্বকর্মাণি-সমস্ত কর্ম, মমি —আমাতে, সংন্যস্য— অর্পণ করে; মংপরঃ–মৎপরায়ণ হয়ে; বুদ্ধিযোগম্—ভগবস্তুক্তি; উপাশ্রিত্য — আশ্রয় গ্রহণ পূর্বক, মচ্চিত্তঃ – মদ্‌গতচিত্ত, সততম সর্বদাই; ভব— হও।

গীতার গান

সেই প্রেমাশ্রয়ে হও মচ্চিত্ত সতত ৷

আমার লাগিয়া সর্ব কার্যে হও রত ।।

সেই বুদ্ধিযোগ নাম আমার আশ্রয় ৷

যাহার প্রভাবে কার্য সর্বসিদ্ধি হয় ।।

অনুবাদঃ তুমি বুদ্ধির দ্বারা সমস্ত কর্ম আমাতে অর্পণ করে, মৎপরায়ণ হয়ে, বুদ্ধিযোগের আশ্রয় গ্রহণপূর্বক সর্বদাই মদ্‌গতচিত্ত হও।

তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে কেউ যখন কর্ম করেন, তখন তিনি নিজেকে সমস্ত জগতের প্রভু বলে মনে করে কাজ করেন না। তিনি কাজ করেন সর্বতোভাবে পরমেশ্বর ভগবানের দ্বারা পরিচালিত, তাঁর একান্ত অনুগত দাসরূপে। দাসের কোনও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থাকে না। তিনি কাজ করেন কেবল তাঁর প্রভুর আদেশ অনুসারে। পরম প্রভুর দাসরূপে যিনি কর্ম করছেন, তাঁর লাভ অথবা ক্ষতির প্রতি কোন রকম আসক্তি থাকে না। তিনি কেবল তাঁর প্রভুর আদেশ অনুসারে বিশ্বক্ত ভৃত্যের মতো তাঁর কর্তব্য করে চলেন। এখন, কেউ তর্ক করতে পারেন যে, শ্রীকৃষ্ণের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে অর্জুন কর্ম করছিলেন, কিন্তু এখন শ্রীকৃষ্ণ এখানে নেই, তখন কিভাবে কর্ম করা উচিত? কেউ যদি এই গ্রন্থে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে অথবা শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধির নির্দেশ অনুসারে কর্ম করে, তা হলে তার ফল একই। এই শ্লোকে মৎপরঃ সংস্কৃত শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে, শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ভক্তিযুক্ত ভগবৎ সেবা ছাড়া জীবনের আর কোন উদ্দেশ্য নেই এবং এভাবেই কর্ম করার সময় একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করা উচিত—“এই বিশেষ কাজটি করবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ আমাকে নিযুক্ত করেছেন।” এভাবেই কাজ করলে স্বাভাবিকভাবেই শ্রীকৃষ্ণের কথা মনে হবে। এটিই হচ্ছে যথার্থ কৃষ্ণভাবনা। এখানে আমাদের মনে রাখা উচিত যে, খামখেয়ালীর বশে যা ইচ্ছা তাই করে ফলটি শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করা উচিত নয়। সেই ধরনের কাজকর্ম কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিযুক্ত ভগবৎ সেবা নয়। শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে কর্ম করা উচিত। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শ্রীকৃষ্ণের সেই নির্দেশ গুরু- পারম্পর্যে সদগুরুর মাধ্যমে পাওয়া যায়। তাই গুরুর আদেশ পালন করাটাই জীবনের মুখ্য কর্তব্য বলে গ্রহণ করা উচিত। কেউ যদি সদ্গুরুর আশ্রয় প্রাপ্ত হন এবং তাঁর নির্দেশ অনুসারে কর্ম করে চলেন, তা হলে কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তজীবনে তাঁর সিদ্ধি অনিবার্য ।

শ্লোকঃ ৫৮

মচ্চিত্তঃ সর্বদুর্গাণি মৎপ্রসাদাত্তরিষ্যসি ।

অথ চেত্রমহঙ্কারার শ্রোষ্যসি বিনঙ্ক্ষ্যসি ॥ ৫৮ ॥

মচ্চিত্তঃ—মদ্‌গতচিত্ত হয়ে, সর্ব— সমস্ত, দুর্গাণি – প্রতিবন্ধক, মৎ— আমার, প্রসাদাৎ—প্রসাদে, তরিষ্যসি — উত্তীর্ণ হবে; অথ— কিন্তু; চেৎ — যদি; ত্বম্—তুমি; অহঙ্কারাৎ—অহঙ্কার-বশত; ন–না; শ্রোয্যসি – শোন; বিনক্ষ্যসি — বিনষ্ট হবে।

গীতার গান

মচ্চিত্ত যেই সে তরে আমার প্রসাদে ।

সর্বদুঃখ সংসারে দুঃখ বা বিষাদে ।।

আমার সে উপদেশ যেবা নাহি মানে ।

অহঙ্কারে মত্ত হয়ে বিনাশে আপনে ।।

অনুবাদঃ এভাবেই মদ্‌গতচিত্ত হলে তুমি আমার প্রসাদে সমস্ত প্রতিবন্ধক থেকে উত্তীর্ণ হবে। কিন্তু তুমি যদি অহঙ্কার বশত আমার কথা না শোন, তা হলে বিনষ্ট হবে।

তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনায় ভগবদ্ভক্ত তার জীবন ধারণের জন্য যে সমস্ত কর্তব্যকর্ম, তা সম্পন্ন করবার জন্য অনর্থক উদ্বিগ্ন হন না। সব রকমের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা থেকে এই মহা মুক্তির কথা মূর্খ লোকেরা বুঝতে পারে না। কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে যিনি কর্ম করেন, শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অতি অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হন। তাঁর যে বন্ধু তাঁর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ঐকান্তিক ভক্তি সহকারে সর্বক্ষণ তাঁর সেবা করে চলেছেন, তাঁর সমস্ত সুখ-সুবিধার দিকে তিনি তখন দৃষ্টি রাখেন এবং নিজেকে তাঁর কাছে সমর্পণ করেন। তাই, কারও পক্ষেই দেহাত্ম বুদ্ধিজাত অহঙ্কারের দ্বারা পরিচালিত হয়ে বিপথগামী হওয়া উচিত নয়। কখনই নিজেকে জড়া প্রকৃতির নিয়মের বন্ধন থেকে মুক্ত বলে মনে করা উচিত নয়, অথবা আমাদের নিজেদের ইচ্ছামতো কাজকর্ম করবার স্বাধীনতা আমাদের আছে বলে মনে করা উচিত নয়। প্রত্যেকেই জড় জগতের কঠোর আইনের নিয়ন্ত্রণাধীন। কিন্তু যখনই তিনি কৃষ্ণভাবনাময় কাজকর্ম করতে শুরু করেন, তখনই তিনি জড় জগতের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হন। খুব সতর্কতার সঙ্গে আমাদের মনে রাখা উচিত, কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ভগবানের সেবা যে করছে না, সে এই জড় জগতের ঘূর্ণিপাকে, জন্ম-মৃত্যুর সমুদ্রে নিমজ্জিত হচ্ছে। কোন বদ্ধ জীবই জানে না কি করা তাঁর উচিত এবং কি করা তাঁর উচিত নয়। কিন্তু যিনি কৃষ্ণভাবনাময় কৃষ্ণভক্ত, তিনি কোন কিছুর পরোয়া না করে তাঁর কাজকর্ম করে চলেন। কারণ তাঁর অন্তর থেকে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে প্রতিটি কাজকর্মে উদ্বুদ্ধ করেন এবং তাঁর গুরুদেব তা অনুমোদন করেন।

শ্লোকঃ ৫৯

যদহঙ্কারমাশ্রিত্য ন যোৎস্য ইতি মন্যসে ৷

মিথ্যৈষ ব্যবসায়স্তে প্রকৃতিস্তাং নিযোক্ষ্যতি ॥ ৫৯ ॥

যৎ—যদি; অহঙ্কারম্—অহঙ্কারকে; আশ্রিতা — আশ্রয় করে ন যোৎস্যে — যুদ্ধ করব না; ইতি-এরূপ, মন্যসে—মনে কর; মিথ্যা এষঃ – মিথ্যা হবে; ব্যবসায়ঃ-সংকল্প; তে— তোমার, প্রকৃতিঃ – প্রকৃতি, জ্বাম্ – তোমাকে, নিযোক্ষ্যতি – নিযুক্ত করবে।

গীতার গান

অহঙ্কার করি বল যুদ্ধ না করিবে ।

মিথ্যা সে প্রতিজ্ঞা ভুমি করিবে স্বভাবে ৷।

অনুবাদঃ যদি অহঙ্কারকে আশ্রয় করে ‘যুদ্ধ করব না’ এরূপ মনে কর, তা হলে তোমার সংকল্প মিথ্যাই হবে। কারণ, তোমার প্রকৃতি তোমাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করবে।

তাৎপর্যঃ অর্জুন ছিলেন যুদ্ধবিশারদ এবং ক্ষত্রিয়ের প্রকৃতি নিয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই যুদ্ধ করাটাই ছিল তাঁর কর্তব্য। কিন্তু মিথ্যা অহঙ্কারের ফলে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, তাঁর গুরু, পিতামহ ও বন্ধুদের হত্যা করলে তাঁর পাপ হবে। প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজেকে তাঁর সমস্ত কর্মের কর্তা বলে মনে করেছিলেন, যেন এই সমস্ত কর্মের শুভ ও অশুভ ফলগুলি তিনিই পরিচালনা করেছিলেন। পরম পুরুষোত্তম ভগবান যে সেখানে উপস্থিত থেকে তাঁকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন, সেটি তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। সেটিই হচ্ছে বদ্ধ জীবের বিস্মৃতি। কোনটি ভাল, কোনটি মন্দ——সেই অনুসারে পরমেশ্বর ভগবান নির্দেশ দেন এবং মানুষের কর্তব্য হচ্ছে, তার জীবনকে সার্থক করে তোলার জন্য ভক্তিযোগে ভগবানের সেই নির্দেশগুলি গালন করা। ভগবান যেভাবে মানুষের ভবিতব্য নিরূপণ করতে পারেন, সেই রকম আর কেউই পারে না। তাই, পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে কর্ম করাটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পন্থা। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের নির্দেশ বা তাঁর প্রতিনিধি শ্রীগুরুদেবের নির্দেশ কখনই অবহেলা করা উচিত নয়। কোন রকম ইতস্তত না করে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের আদেশ পালন করা উচিত। তা হলে সর্ব অবস্থাতেই নিরাপদে থাকা যায়।

error: Content is protected !!