শোকঃ ৫৪

ব্রহ্মভূতঃ প্রসন্নাত্মা ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি ।

সমঃ সর্বেষু ভূতেষু মদ্ভক্তিং লভতে পরাম্ ।। ৫৪ ।।

ব্রহ্মভূতঃ—ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত; প্রসন্নাত্মা-প্রসন্নচিত্ত, ন–না; শোচতি—শোক করেন, ন—না; কাঙ্ক্ষতি—আকাঙ্ক্ষা করেন, সমঃ – সমদর্শী, সর্বেষু — সমস্ত ভূতেষু — প্রাণীর প্রতি; মদ্ভক্তিম্—আমার ভক্তি; লভতে—লাভ করেন; পরাম্পরা।

গীতার গান

ব্রহ্ম অনুভব হলে প্রসন্নাত্মা হয় ।

শোক আর আকাঙ্ক্ষা সে নির্মল নিশ্চয় ৷।

সর্বভূত সমবুদ্ধি তার পরিচয় ৷

নির্গুণ আমার ভক্তি তবে লাভ হয় ।।

অনুবাদঃ ব্ৰহ্মভাব প্রাপ্ত প্রসন্নচিত্ত ব্যক্তি কোন কিছুর জন্য শোক করেন না বা আকাঙ্ক্ষা করেন না। তিনি সমস্ত প্রাণীর প্রতি সমদর্শী হয়ে আমার পরা ভক্তি লাভ করেন।

তাৎপর্যঃ নির্বিশেষবাদীর কাছে ব্রহ্মভূত অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া বা ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়াটা হচ্ছে শেষ কথা। কিন্তু সবিশেষবাদী বা শুদ্ধ ভক্তদের শুদ্ধ ভক্তিতে যুক্ত হবার জন্য আরও অগ্রসর হতে হয়। এর অর্থ হচ্ছে যে, শুদ্ধ ভক্তিযোগে যিনি ভগবানের সেবায় যুক্ত, তিনি ইতিমধ্যেই মুক্ত হয়ে ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মভূত হয়ে ব্রহ্মভূত স্তরে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মভূত না হলে তাঁর সেবা করা যায় না। ব্রহ্ম-অনুভূতিতে সেবা ও সেবকের মধ্যে কোন ভেদ নেই, তবুও উচ্চতর চেতনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের মধ্যে ভেদ রয়েছে।

জড় জীবনের ধারণা নিয়ে কেউ যখন ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য কর্ম করেন, তাতে দুর্ভোগ থাকে। কিন্তু চিৎ-জগতে যখন কেউ শুদ্ধ ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করেন, সেই সেবায় কোন দুর্ভোগ নেই। অনুশোচনা অথবা আকাঙ্ক্ষা করেন না। ভক্তিযোগে ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হন, তখন তিনিও পূর্ণতা প্রাপ্ত হন। তিনি তখন সমস্ত পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত নির্মল নদীর মতো। কৃষ্ণভক্ত যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর কোন কিছুরই চিন্তা করেন না, তাই তিনি স্বাভাবিকভাবে সর্বদাই উৎফুল্ল। ভগবানের সেবায় সম্যকভাবে নিযুক্ত থাকার ফলে তিনি জাগতিক লাভ অথবা ক্ষতির জন্য কখনই অনুশোচনা করেন না। জড় সুখভোগের প্রতি তাঁর আর কোন আসক্তি থাকে না। কারণ তিনি জানেন যে, প্রতিটি জীবই হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ-বিশেষ এবং তাই তারা তাঁর নিত্য দাস। তিনি জড় জগতে কাউকেই উচ্চ অথবা নীচ বলে গণ্য করেন না। উচ্চ-নীচবোধ ক্ষণস্থায়ী এবং এই ক্ষণস্থায়ী অনিত্য জগতের সঙ্গে ভক্তের কোন সম্পর্ক থাকে না। তাঁর কাছে পাথর আর সোনার একই দাম। এটিই হচ্ছে ব্রহ্মভূত স্তর এবং শুদ্ধ ভক্ত অনায়াসে এই স্তরে উন্নীত হতে পারেন। ভগবদ্ভক্তির এই পরম পবিত্র স্তরে পৌঁছলে, পরব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া বা ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য নাশ করার ধারণা অত্যন্ত ঘৃণ্য বলে মনে হয় এবং স্বর্গ লাভের আকাঙ্ক্ষাকে আকাশকুসুম বলে মনে হয়। তখন ইন্দ্রিয়গুলিকে বিষদাঁত ভাঙা সাপের মতোই প্রতিভাত হয়। বিষদাঁত ভাঙা সাপের কাছ থেকে যেমন কোন রকম ভয় থাকে না, তেমনই ইন্দ্রিয়গুলি থেকে আর কোন ভয়ের আশঙ্কা থাকে না, যখন তারা আপনা থেকেই সংযত হয়। জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যারা ভবরোগে ভুগছে, তাদের পক্ষে এই জগৎ দুঃখময়। কিন্তু ভগবদ্ভক্তের কাছে সমগ্র জগৎটি বেকুণ্ঠ বা চিৎ-জগতের মতো। এই জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষও ভক্তের কাছে একটি পিপীলিকার থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়। শ্রীচেতন্য মহাপ্রভু, যিনি এই যুগে শুদ্ধ ভক্তি প্রচার করেছেন, তাঁর কৃপায় ভগবদ্ভক্তির এই পরম নির্মল স্তরে অধিষ্ঠিত হওয়া যায়।

শ্লোকঃ ৫৫

ভক্ত্যা মামজিানাতি যাবান যশ্চাম্মি তত্ত্বতঃ ।

ততো মাং তত্ত্বতো জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম্ ॥ ৫৫ ॥

ভক্ত্যা—শুদ্ধ ভক্তির দ্বারা; মাম্—আমাকে; অভিজানাতি — জানতে পারেন; যাবান—যে রকন; যঃ চ অগ্নি—স্বরাপত আমি হই; তত্ত্বতঃ — যথার্থরূপে; ততঃ —তারপর; মাস্‌—আমাকে; তত্ত্বতঃ যথার্থরূপে, জ্ঞাত্বা – জেনে, বিশতে প্রবেশ করতে পারেন; তদনন্তরম্—তার পরে।

গীতার গান

নির্গুণ ভক্তিতে জানে আমার স্বরূপ ।

সবিশেষ নির্বিশেষ তত্ত্বত যে রূপ ৷।

সেই তত্ত্বজ্ঞান লাভে প্রবেশে আমাতে ।

আমি ব্রহ্ম পরমাত্মা ভগবান্ যাতে ৷।

অনুবাদঃ ভক্তির দ্বারা কেবল স্বরূপত আমি যে রকম হই, সেরূপে আমাকে কেউ তত্ত্বত জানতে পারেন। এই প্রকার ভক্তির দ্বারা আমাকে তত্ত্বত জেনে, তার পরে তিনি আমার ধামে প্রবেশ করতে পারেন।

তাৎপর্যঃ অভক্তেরা পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কখনই জানতে পারে না। মনোধর্ম- প্রসূত জল্পনা-কল্পনার দ্বারাও তাঁকে জানতে পারা যায় না। কেউ যদি পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে জানতে চায়, তা হলে তাকে শুদ্ধ ভক্তের তত্ত্বাবধানে শুদ্ধ ভক্তিযোগের পন্থা অবলম্বন করতে হবে। তা না হলে, পরম পুরুষোত্তম ভগবান সম্বন্ধীয় তত্ত্বজ্ঞান তার কাছে সর্বদাই আচ্ছাদিত থেকে যাবে। ভগবদ্গীতায় (৭/২৫) আগেই বলা হয়েছে, নাহং প্রকাশঃ সর্বসা— তিনি সকলের কাছে প্রকাশিত হন না। কেবল পাণ্ডিত্যের দ্বারা অথবা মনোধর্ম-প্রসূত জল্পনা-কল্পনার দ্বারা কেউ ভগবানকে জানতে পারে না। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিযোগে যিনি ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হয়েছেন, তিনিই কেবল শ্রীকৃষ্ণকে তত্ত্বত জানতে পারেন। এই জ্ঞান লাভে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী কোন সাহায্য করতে পারে না।

কৃষ্ণতত্ত্বের বিজ্ঞান সম্বন্ধে যিনি পূর্ণরূপে অবগত হয়েছেন, তিনিই শ্রীকৃষ্ণের আলয় চিন্ময় ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করার যোগ্য হন। ব্রহ্মভূত অবস্থা প্রাপ্ত হওয়ার অর্থ স্বাতন্ত্র্যহীন হওয়া নয়। সেই স্তরেও ভগবৎ-সেবা রয়েছে এবং যেখানে ভক্তিযুক্ত ভগবৎ-সেবা রয়েছে, সেখানে অবশ্যই ভগবান, ভক্ত ও ভক্তিযোগের পন্থা রয়েছে। এই প্রকার জ্ঞানের কখনও বিনাশ হয় না, এমন কি মুক্তির পরেও বিনাশ হয় না। মুক্তির অর্থ হচ্ছে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্তি। চিন্ময় জীবনেও সেই একই স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকে, একই ব্যক্তিত্ব বজায় থাকে, তবে সেই স্বাতন্ত্র, সেই ব্যক্তিত্ব হচ্ছে শুদ্ধ কৃষ্ণভাবনাময়। এখানে বিশ্বতে আমাতে প্রবেশ করেন’, কথাটির ভ্রান্ত অর্থ করা উচিত নয়, যা অদ্বৈতবাদীরা করে থাকেন। তাঁরা বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছে জীব নির্বিশেষ ব্রহ্মে লীন হয়ে এক হয়ে যায়। না। বিশতে কথাটির অর্থ হচ্ছে যে, জীব তার ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য নিয়ে পরমেশ্বর ভগবানের ধামে প্রবেশ করে এবং ভগবানের সঙ্গ লাভ করে তাঁর সেবা করতে পারে। যেমন, একটি সবুজ পাখি একটি সবুজ গাছে প্রবেশ করে সেই গাছটির সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ার জন্য নয়, সেই গাছটির ফল উপভোগ করবার জন্য। নির্বিশেষবাদীরা সাধারণত সমুদ্রে নদীর মিশে যাওয়ার দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকেন। সেটি নির্বিশেষবাদীদের আনন্দের উৎস হতে পারে, কিন্তু সবিশেষবাদীরা সমুদ্রস্থিত জলচর প্রাণীর মতো তাঁদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখেন। সমুদ্রের গভীরে গেলে দেখা যায়। সেখানে কত অসংখ্য প্রাণী রয়েছে। কেবল সমুদ্রের উপরটি দেখে সমুদ্র সম্বন্ধে জানা যায় না। সমুদ্রের গভীরে যে সমস্ত প্রাণী রয়েছে, তাদের সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে হবে।

শুদ্ধ ভগবৎ-সেবার প্রভাবে ভক্ত তত্ত্বগতভাবে ভগবানের অপ্রাকৃত গুণ ও ঐশ্বর্য সম্বন্ধে অবগত হতে পারেন। একাদশ অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে, কেবলমাত্র ভগবৎ সেবার মাধ্যমেই ভগবানকে জানা যায়। এখানেও সেই কথা সত্য বলে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ভক্তির মাধ্যমেই কেবল পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে জানা যায় এবং তাঁর ধামে প্রবেশ করা যায়।

জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মভূত স্তরে অধিষ্ঠিত হলে ভগবানের কথা শোনার মাধ্যমে ভক্তিযোগ শুরু হয়। কেউ যখন ভগবানের কথা শ্রবণ করেন, তখন আপনা থেকেই ব্রহ্মাভূত অবস্থার বিকাশ হয় এবং জড় কলুষ— ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য কাম ও লোভ বিদুরিত হয়। ভক্তের হৃদয় থেকে কাম ও বাসনা যতই বিদূরিত হয়, ততই তিনি ভক্তিযুক্ত ভগবৎ সেবার প্রতি আসক্ত হন এবং সেই আসক্তির ফলে তিনি তখন জড় জগতের কলুষ থেকে মুক্ত হন। জীবনের সেই অবস্থায় তিনি পরমেশ্বর ভগবানকে উপলব্ধি করতে পারেন। শ্রীমদ্ভাগবতেও সেই কথা বলা হয়েছে। মুক্তির পরেও ভক্তির অনুশীলন বা দিব্য ভগবৎ সেবা বর্তমান থাকে। সেই সম্বন্ধে বেদান্তসূত্রে ( ৪/১/১২) বলা হয়েছে— আপ্রায়ণাৎ তত্রাপি হি দুষ্টম্। অর্থাৎ মুক্তির পরেও ভক্তিযুক্ত ভগবৎ সেবা বর্তমান থাকে। শ্রীমদ্ভাগবতে ভক্তিযুক্ত যথার্থ মুক্তির বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, জীবের যথার্থ স্বরূপে অবস্থিত হওয়ার নামই হচ্ছে মুক্তি। জীবের স্বরূপের ব্যাখ্যা পূর্বেই করা হয়েছে—প্রতিটি জীবই হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অণুসদৃশ অংশ। তাই জীবের স্বরূপ হচ্ছে ভগবানের সেবা করা। মুক্তির পরে এই সেবা কখনও বন্ধ হয়ে যায় না। যথার্থ মুক্তি হচ্ছে জীবনের ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্ত হওয়া।

শ্লোকঃ ৫৬

সর্বকৰ্মাণ্যপি সদা কুর্বাণো মদব্যপাশ্রয়ঃ ।

মদপ্রসাদাদবাপ্নোতি শাশ্বতং পদমব্যয়ম্ ॥ ৫৬ ॥

সর্ব—সমস্ত; কর্মাণি—কর্ম; অপি—ও; সদা-সর্বদা; কুর্বাণ:–অনুষ্ঠান করে; মৎ— আমার; ব্যপাশ্রয়ঃ— আশ্রয়ে, মং – আমার, প্রসাদাৎ-প্রসাদে; অবাপ্নোতি – লাভ করেন, শাশ্বতম্—নিতা; পদম্—ধাম: অব্যয়ম্ – অব্যয়।

গীতার গান

ভক্তিতে প্রাপ্তি সে হয় ভগবদ স্বরূপ ।

প্রেমাপুমার্থ মহান নাম যার রূপ ।।

সেই প্রেমাশ্রয়ে যেই সর্ব কর্ম করে ।

আমার প্রসাদে পরব্যোম লাভ করে ৷।

অনুবাদঃ আমার শুদ্ধ ভক্ত সর্বদা সমস্ত কর্ম করেও আমার প্রসাদে নিত্য অব্যয় ধাম লাভ করেন।

তাৎপর্যঃ মব্যপাশ্রয়ঃ কথাটির অর্থ হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের আশ্রয়ে। জড় কলুষমুক্ত হবার জন্য শুদ্ধ ভক্ত পরমেশ্বর ভগবান বা তাঁর প্রতিনিধি গুরুদেবের নির্দেশ অনুসারে কর্ম করেন। শুদ্ধ ভক্তের ভগবৎ সেবার কোন সময়সীমা নেই। তিনি সর্বদাই চব্বিশ ঘণ্টা পূর্ণরূপে ভগবানের নির্দেশ অনুসারে ভগবানের সেবায় যুক্ত। যে ভক্ত এভাবেই কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ভগবানের সেবায় যুক্ত হয়েছেন, ভগবান তাঁর প্রতি অত্যন্ত সদয়। সমস্ত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও পরিণামে তিনি ভগবৎ-গ্রামে বা কৃষ্ণলোকে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর ভগবৎ-ধাম প্রাপ্তি সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। সেই পরম ধামে কোন পরিবর্তন নেই। সেখানে সব কিছুই নিত্য, অবিনশ্বর ও পূর্ণ জ্ঞানময়।

error: Content is protected !!