শ্লোকঃ ৪৯

অসক্তবুদ্ধিঃ সর্বত্র জিতাত্মা বিগতস্পৃহঃ ।

নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধিং পরমাং সন্ন্যাসেনাধিগচ্ছতি ।। ৪৯ ।।

অসক্তবুদ্ধিঃ—আসক্তিশূন্য বৃদ্ধি; সর্বত্র — সর্বত্র; জিতাত্মা-সংযতচিত্ত; বিগতস্পৃহঃ —স্পৃহাশূন্য ব্যক্তি; নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধিম্ — নৈষ্কর্মরূপ সিন্ধি; পরমাম্ — পরম; সন্ন্যাসেন — স্বরূপত কর্মত্যাগ দ্বারা; অধিগচ্ছতি লাভ করেন।

গীতার গান

দোষাংশ ত্যাগেতে যথা গুণাংশ গ্রহণ ।

নিজ সত্তা শুদ্ধ করি স্বধর্ম সাধন ॥

অনাসক্ত বুদ্ধি জিত ‘আত্মা স্পৃহাহীন ।

নৈষ্কর্ম সিদ্ধি সে হয় সন্ন্যাস প্রবীণ ॥

অনুবাদঃ জড় বিষয়ে আসক্তিশূন্য বুদ্ধি, সংযতচিত্ত ও ভোগস্পৃহাশূন্য ব্যক্তি স্বরূপত কর্ম ত্যাগপূর্বক নৈষ্কর্মরূপ পরম সিদ্ধি লাভ করেন।

তাৎপর্যঃ যথার্থ ত্যাগের অর্থ হচ্ছে নিজেকে সর্বদা পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করা। তাই মনে করা উচিত যে, কর্মফল ভোগ করার কোন অধিকার আমাদের নেই। আমরা যেহেতু পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ বিশেষ, তাই আমাদের সমস্ত কর্মের প্রকৃত ভোক্তা হলে ভগবান। সেটিই যথার্থ কৃষ্ণভাবনা। কৃষ্ণভাবনায় নিয়োজিত মানুষই হচ্ছেন যথার্থ সন্ন্যাসী। এই মনোভাব অবলম্বন করার ফলে মানুষ যথার্থ শান্তি লাভ করতে পারেন। কারণ, তিনি তখন যথার্থভাবে পরমেশ্বর ভগবানের জন্য কাজ করেন। এভাবেই তিনি আর কোন রকম বিষয়ের প্রতি আসক্ত হন না। তিনি তখন ভগবৎ সেবালব্ধ দিব্য আনন্দ ব্যতীত আর কোন রকম সুখভোগের প্রতি অনুরক্ত হন না। বলা হয় যে, সন্ন্যাসী তাঁর পূর্বকৃত সমস্ত কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত। কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত তথাকথিত সন্ন্যাস গ্রহণ না করেই, আপনা থেকেই এই মুক্ত স্তরে অধিষ্ঠিত হন। চিত্তবৃত্তির এই অবস্থাকে বলা হয় যোগারূঢ় বা যোগের সিদ্ধ অবস্থা। এই সম্বন্ধে তৃতীয় অধ্যায়ে প্রতিপন্ন হয়েছে, যত্ত্বাত্মরতিরের স্যাৎ- যিনি আত্মাতেই তৃপ্ত, তাঁর কর্মফল ভোগের আর কোন ভয় থাকে না।

শ্লোকঃ ৫০

সিদ্ধিং প্রাপ্তো যথা ব্রহ্ম তথাপ্নোতি নিবোধ মে ।

সমাসেনৈব কৌন্তেয় নিষ্ঠা জ্ঞানস্য যা পরা ॥ ৫০॥

সিদ্ধি — সিদ্ধি; প্রাপ্তঃ – লাভ করে। যথা— যেভাবে: ব্রহ্ম ব্রহ্মকে, তথা—তা ; আপ্নোতি লাভ করেন; নিবোধ — শ্রবণ কর; মে – আমার কাছে; সমাসেন— সংক্ষেপে; এব—অবশ্যই, কৌন্তেয় – হে কুন্তীপুত্র, নিষ্ঠা – স্তর, জ্ঞানস্য – ডানের, যাযা; পরা—অপ্রাকৃত।

গীতার গান

সিদ্ধিলাভ করি যথা ব্রহ্ম প্রাপ্তি হয় ।

সংক্ষেপেতে কহি শুন তার পরিচয় ৷।

অনুবাদঃ হে কৌন্তেয় ! নৈষ্কর্ম সিদ্ধি লাভ করে জীব যেভাবে জ্ঞানের পরা নিষ্ঠারূপ ব্রহ্মকে লাভ করেন, তা আমার কাছে সংক্ষেপে শ্রবণ কর।

তাৎপর্যঃ ভগবান অর্জুনের কাছে বর্ণনা করেছেন কিভাবে মানুষ পরম পুরুষোত্তম ভগবানের জন্য সমস্ত কাজ করার মাধ্যমে কেবল তার বৃত্তিমূলক কর্মে যুক্ত থেকে অনায়াসে পরম সিদ্ধির স্তর লাভ করতে পারে। শুধুমাত্র পরমেশ্বর ভগবানের তৃপ্তি সাধনের জন্য কর্মফল ত্যাগ করার মাধ্যমে অনায়াসে ব্রহ্ম-উপলব্ধির পরম স্তর লাভ করা যায়। সেটিই হচ্ছে আত্ম-উপলব্ধির পন্থা। জ্ঞানের যথার্থ সিদ্ধি হচ্ছে শুদ্ধ কৃষ্ণভাবনা লাভ করা, যা পরবর্তী শ্লোকগুলিতে বর্ণনা করা হয়েছে।

শ্লোকঃ ৫১-৫৩

বুদ্ধ্যা বিশুদ্ধয়া যুক্তো ধৃত্যাত্মানং নিয়ম্য চ ।

শব্দাদীন্ বিষয়াংত্ত্যক্ত্বা রাগদ্বেষৌ ব্যুদস্য চ ।। ৫১ ।।

বিবিক্তসেবী লম্বাশী যতবাক্কায়মানসঃ ।

ধ্যানযোগপরো নিত্যং বৈরাগ্যং সমুপাশ্রিতঃ ।। ৫২ ।।

অহঙ্কারং বলং দর্পং কামং ক্রোধং পরিগ্রহম্ ।

বিমুচ্য নির্মমঃ শান্তো ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে ।। ৫৩ ৷।

বুদ্ধ্যা-বুদ্ধির দ্বারা, বিশুদ্ধয়া — বিশুদ্ধ, যুক্তঃ—যুক্ত হয়ে মৃত্যা—ধৃতির দ্বারা: আত্মানম্ — মনকে; নিয়মা— নিয়ন্ত্রিত করে; চ–ও; শব্দাদীন—শব্দ আদি; বিষয়ান—ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ; ত্যক্ত্বা — পরিত্যাগ করে; রাগ — আসছি; দ্বেযৌ— স্নেব; বাদস্য— বর্জন করে; চ–ও; বিবিক্তসেবী — নির্জন স্থানে বাস করে, লঘুাশী- —অল্প আহার করে, যতবাক্ বাক্ সংযত করে; কায়— দেহ: মানসঃ- মন; ধ্যানযোগপরঃ–ধ্যানযোগে যুক্ত হয়ে; নিত্যম্—সর্বদা; বৈরাগ্যম্-বৈরাগ্য; সমুপাশ্রিতঃ–আশ্রয় গ্রহণ করে; অহঙ্কারম্—অহঙ্কার, বলম্বল, দর্প- দর্প; কামম্ –কাম, ক্রোধম্ — ক্রোধ; পরিগ্রহম্ — জড় বিষয় গ্রহণ; বিমুচা — মুক্ত হয়ে; নির্মমঃ-মমতাশূন্য: শান্তঃ – শান্ত ; ব্রহ্মভূয়ায় — ব্রহ্ম-অনুভবে; কল্পতে— সমর্থ হন।

গীতার গান

বিশুদ্ধ সে বুদ্ধিযুক্ত ধৃতি নিয়মিত ।

শব্দাদি বিষয় ত্যাগ রাগ দ্বেষজিত ।।

বিবিক্ত যে লঘুভোজী যত বাক্ মন ।

ধ্যানযোগ পরা নিত্য বৈরাগ্য সাধন।।

অহঙ্কার বল দর্প কাম পরিগ্রহ ।

ক্রোধ আর যত আছে অসৎ আগ্রহ ।।

নির্মম যে শান্ত যেই ব্ৰহ্মা অনুভবে ।

নিশ্চিত সমর্থ হয় তাহাতে সম্ভবে ৷।

অনুবাদঃ বিশুদ্ধ বুদ্ধিযুক্ত হয়ে মনকে ধৃতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করে, শব্দ আদি ইন্দ্রিয় বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করে, রাগ ও দ্বেষ বর্জন করে, নির্জন স্থানে বাস করে, অল্প আহার করে, দেহ, মন ও বাক্ সংযত করে, সর্বদা ধ্যানযোগে যুক্ত হয়ে বৈরাগ্য আশ্রয় করে, অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম, ক্রোধ, পরিগ্রহ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে, মমত্ব বোধশূন্য শান্ত পুরুষ ব্রহ্ম-অনুভবে সমর্থ হন।

তাৎপর্যঃ বুদ্ধির সাহায্যে নির্মল হলে মানুষ সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হন। এভাবেই মানুষ চিত্তবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে সদা সর্বদাই সমাধিস্থ থাকেন। তখন আর তিনি ইন্দ্রিয়- তর্পণের বিষয়ের প্রতি আসক্ত হন না এবং তখন তিনি তাঁর কাজকর্মে রাগ ও দ্বেষ থেকে মুক্ত হন। এই ধরনের নিরাসক্ত মানুষ স্বভাবতই নিরিবিলি জায়গায় থাকতে ভালবাসেন। তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার করেন না এবং তিনি তাঁর দেহ ও মনের সমস্ত কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে রাখেন। তখন আর তাঁর মিথ্যা অহঙ্কার থাকে না, কারণ তিনি তখন তাঁর দেহকে তাঁর স্বরূপ বলে মনে করেন না। নানা রকম জড় পদার্থ আহরণ করে তাঁর দেহটিকে স্থূল ও শক্তিশালী করে তোলার কোন বাসনাও তখন আর থাকে না। যেহেতু তখন আর তাঁর দেহাত্মবুদ্ধি থাকে না, তাই মিথ্যা দর্পও থাকে না। পরমেশ্বর ভগবানের কৃপায় মানুষ তখন যা পায়, তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন এবং ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের অভাব হলে ক্রুদ্ধ হন না। ইন্দ্রিয়ের বিষয় আহরণ করার কোনও রকম প্রচেষ্টা তিনি তখন করেন না। এভাবেই মানুষ যখন সর্বতোভাবে অহঙ্কারমুক্ত হন, তখন তিনি সমস্ত জড় বিষয়ের প্রতি অনাসক্ত হন এবং সেটিই হচ্ছে ব্রহ্ম-অনুভবের স্তর। সেই তরকে বলা হয় ব্রহ্মভূত স্তর। মানুষ যখন জড় জীবনের বন্ধন থেকে মুক্ত হন, তখন তিনি শান্ত হন এবং কোন কিছুতেই আর ক্ষুব্ধ হন না। ভগবদ্গীতায় (২/৭০) সেই কথা ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে

আপূর্যমাণমচলপ্রতিষ্ঠং

সমুদ্রমাণঃ প্রবিশস্তি যন্ত্র‍ ।

তদ্বৎ কামা যং প্রবিশতি সর্বে

স শান্তিমাপ্পোতি ন কামকামী ।।

“বিষয়কামী ব্যক্তি কখনও শান্তি লাভ করে না। জলরাশি যেমন সদা পরিপূর্ণ এবং স্থির সমুদ্রে প্রবেশ করেও তাকে ক্ষোভিত করতে পারে না, কামসমূহও তেমন কোন স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তিতে প্রবিষ্ট হয়েও তাকে বিক্ষুব্ধ করতে পারে না। অতএব তিনিই শান্তি লাভ করেন।”

error: Content is protected !!