শ্লোকঃ ৪৬
যতঃ প্রবৃত্তির্ভূতানাং যেন সর্বমিদং ততম্ ।
স্বকর্মণা তমভ্যর্চ্য সিদ্ধিং বিন্দতি মানবঃ ।। ৪৬ ।।
যতঃ—যাঁর থেকে; প্রবৃত্তিঃ – প্রবৃত্তি; ভূতানাম্ — সমস্ত জীবের; যেন—যাঁর দ্বারা, সর্বস্—সমস্ত; ইদম্—এই; ততম্—ব্যাণ্ড; স্বকর্মণা— তার নিজের কর্মের দ্বারা; তম্—তাঁকে; অভ্যর্চ্য—অর্জন করে। সিদ্ধিম্ — সিদ্ধি : বিন্দতি – লাভ করে; মানবঃ —মানুষ।
গীতার গান
যিনি ব্যষ্টি সমষ্টি বা জগৎ কারণ ।
যাঁহা হতে ভূতগণের বাসনা জীবন ।।
স্বকর্ম করিয়া যদি সেই প্রভু ভজে ৷
সিদ্ধিলাভ হয় তার সংসারে না মজে ।।
অনুবাদঃ যাঁর থেকে সমস্ত জীবের পূর্ব বাসনারূপ প্রবৃত্তি হয়, যিনি এই সমগ্র বিশ্বে ব্যাপ্ত আছেন, তাঁকে মানুষ তার নিজের কর্মের দ্বারা অর্জন করে সিদ্ধি লাভ করে।
তাৎপর্যঃ পঞ্চদশ অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে যে, সমস্ত জীবই পরমেশ্বর ভগবানের অণুসদৃশ অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ। এভাবেই পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের আদি উৎস। বেদান্তসূত্রে তার সত্যতা প্রতিপন্ন হয়েছে জন্মাদাস্য যতঃ । সুতরাং, পরমেশ্বর ভগবান প্রত্যেকটি জীবের প্রাণের উৎস। ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবান তাঁর দুটি শক্তি-অন্তরঙ্গা শক্তি ও বহিরঙ্গা শক্তির দ্বারা সর্বব্যাপ্ত। তাই, সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানকে তাঁর শক্তিসহ আরাধনা করা। সাধারণত বৈষ্ণব ভক্তেরা ভগবানকে তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তি সহ উপাসনা করেন। তাঁর বহিরঙ্গা শক্তি হচ্ছে তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির বিকৃত প্রতিবিম্ব। বহিরঙ্গা শক্তিটি হচ্ছে পটভূমি, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান পরমাত্মা রূপে নিজেকে বিস্তার করে সর্বত্র বিরাজমান। তিনি সমস্ত দেব-দেবী, সমস্ত মানুষ, সমস্ত পশু— সকলেরই পরমাত্মা এবং সর্বত্র বিরাজ করছেন। তাই সকলেরই এটি জানা উচিত যে, পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে তাদের সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে ভগবানের সেবা করা। সকলেরই উচিত সর্বতোভাবে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্তিযুক্ত সেবায় নিযুক্ত হওয়া। এই শ্লোকে সেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সকলেরই মনে রাখা উচিত যে, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের ঈশ্বর স্থাযীকেশের দ্বারা তারা ভিন্ন ভিন্ন বিশেষ ধরনের কর্মে নিযুক্ত রয়েছে এবং সেই সকল কর্মের ফলের দ্বারা পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপাসনা করা কর্তব্য। কেউ যদি সর্বদাই পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে এভাবেই চিন্তা করেন, তা হলে ভগবানের কৃপার ফলে তিনি অচিরেই পূর্ণজ্ঞান লাভ করবেন। সেটিই হচ্ছে জীবনের পরম সিদ্ধি । ভগবদ্গীতায় (১২/৭) ভগবান বলেছেন— তেষামহং সমুদ্ধর্তা। এই প্রকার ভক্তকে উদ্ধার করার ভার পরমেশ্বর ভগবান নিজেই গ্রহণ করেন। সেটিই হচ্ছে জীবনের পরম সিদ্ধি। যে কোন রকম কর্মেই নিযুক্ত থাকুন না কেন, যদি তিনি পরমেশ্বর ভগবানের সেবা করেন, তা হলে তিনি পরম সিদ্ধি লাভ করতে পারবেন।
শ্লোকঃ ৪৭
শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ ।
স্বজ্ঞাবনিয়তং কর্ম কুর্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্ ॥
শ্রেয়ান্—শ্রেয়; স্বধর্মঃ — স্বধর্ম, বিগুণঃ – অসম্যক রূপে অনুষ্ঠিত; পরধর্মাৎ— পরধর্ম অপেক্ষা; স্বনুষ্ঠিতাৎ— উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত, স্বভাবনিয়তম্—স্বভাব-বিহিত; কর্ম—কর্ম; কুর্বন—করে, নানা, আপ্নোতিপ্রাপ্ত হয়, কিষি – পাপ।
গীতার গান
অসম্যক অনুষ্ঠিত নিজ ধর্ম শ্রেয় ।
সুষ্ঠু আচরণ করে পরধর্মে ভয় ৷।
নিজ স্বভাব নিয়ত যেই কর্ম অনুষ্ঠান ।
নিষ্পাপ হইৰে তাহে শাস্ত্রের বিধান ।।
অনুবাদঃ উত্তম রূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা অসম্যক রূপে অনুষ্ঠিত স্বধর্মই শ্রেয়। মানুষ স্বভাব-বিহিত কর্ম করে কোন পাপ প্রাপ্ত হয় না।
তাৎপর্যঃ মানুষের স্বধর্ম ভগবদ্গীতায় নির্দিষ্ট হয়েছে। পূর্ববর্তী শ্লোকগুলিতে ইতিমধ্যেই আলোচনা করা হয়েছে যে, বিশেষ বিশেষ প্রকৃতির গুণ অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের কর্তব্যকর্ম নির্ধারিত হয়েছে। অপরের ধর্মকর্ম অনুকরণ করা কারও পক্ষে উচিত নয়। যে মানুষ, স্বাভাবিকভাবে শূদ্রের কাজকর্ম করার প্রতি আকৃষ্ট, তার পক্ষে কৃত্রিমভাবে নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে জাহির করা উচিত নয়। তার জন্ম যদি ব্রাহ্মণ পরিবারেও হয়ে থাকে, তা হলেও নয়। এভাবেই স্বভাব অনুসারে তার কর্ম করা উচিত। কোন কাজই ঘৃণ্য নয়, যদি তা পরমেশ্বর ভগবানের সেবার জন্য অনুষ্ঠিত হয়। ব্রাহ্মণের বৃত্তিমূলক কর্তব্য অবশ্যই সাত্ত্বিক। কিন্তু কেউ যদি স্বভাবগতভাবে সত্ত্বগুণ সম্পন্ন না হয়, তা হলে তার ব্রাহ্মণের বৃত্তি অনুসরণ করা উচিত নয়। ক্ষত্রিয় বা শাসককে কত রকমের ভয়ানক কাজ করতে হয়। তাকে হিংসার আশ্রয় নিয়ে শত্রু হত্যা করতে হয় এবং কূটনীতির খাতিরে কখনও কখনও তাকে মিথ্যা কথা বলতে হয়। এই ধরনের হিংসা ও ছলনা রাজনীতির মধ্যে থাকেই। কিন্তু তা বলে ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম পরিত্যাগ করে ব্রাহ্মাণের ধর্ম আচরণ করা উচিত নয়।
পরমেশ্বর ভগবানের প্রীতি সাধনের জন্য কর্ম করা উচিত। যেমন, অর্জুন ছিলেন ক্ষত্রিয়। তিনি তাঁর বিরোধী পক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করতে দ্বিধা করছিলেন। কিন্তু সেই যুদ্ধ যদি পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় অনুষ্ঠিত হয়, তা হলে অধঃপতনের ভয় থাকে না। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও লাভ করবার জন্য ব্যবসায়ীকে কত মিথ্যা কথা বলতে হয়। সে যদি তা না করেন, তা হলে ব্যবসায়ে তার কোন লাভ হবে না। ব্যবসায়ী কখনও বলে, “ও বাবু! আপনার জন্য আমি কোন লাভ করছি না,” কিন্তু সকলেরই জানা উচিত যে, লাভ না করে ব্যবসায়ী বাঁচতে পারে না। সুতরাং ব্যাপারী যখন বলে যে, সে লাভ করছে না, তখন সেটিকে এক নিছক মিথ্যা কথা বলেই ধরে নিতে হবে। কিন্তু তা বলে ব্যাপারীর মনে করা উচিত নয় যে, যেহেতু সে এমন একটি বৃত্তিতে নিযুক্ত রয়েছে, যেখানে মিথ্যা কথা বলতে হয়, তাই সেই বৃত্তি সে ছেড়ে দেবে আর ব্রাহ্মণের বৃত্তি অবলম্বন করবে। সেই রকম নির্দেশ শাস্ত্রে দেওয়া হয়নি। কেউ ক্ষত্রিয় হন, বৈশ্য হন বা শূদ্রই হন না কেন, যদি তিনি তাঁর বৃত্তি অনুসারে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সেবা করেন, তা হলে কিছুই আসে যায় না। এমন কি ব্রাহ্মণদেরও নানা রকমের যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে হলে কখন কখন পশুহত্যা করতে হয়, কারণ যজ্ঞে পশু বলি দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। তেমনই, ক্ষত্রিয় যদি স্বধর্মে নিরত হয়ে শত্রুকে হত্যা করে, তাতে কোন পাপ হয় না। তৃতীয় অধ্যায়ে এই সমস্ত বিষয়গুলি স্পষ্টভাবে ও বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যজ্ঞের উদ্দেশ্যে অথবা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণুর উদ্দেশ্যে প্রত্যেক মানুষের কাজ করা উচিত। আত্মেন্দ্রিয় তৃপ্তি সাধনের জন্য যা কিছু করা হয়, তা হচ্ছে বন্ধনের কারণ। সিদ্ধান্ত-স্বরূপ এখানে বলা যায় যে, প্রত্যেকের উচিত তার স্বাভাবিক গুণ অনুসারে নিয়োজিত থাকা এবং সমস্ত কাজকর্মের পরম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত পরমেশ্বর ভগবানের সেবা।
শ্লোকঃ ৪৮
সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোযমপি ন ত্যজেৎ ।
সর্বারম্ভা হি দোষেণ ধূমেনাগ্নিরিবাবৃতাঃ ।। ৪৮ ।।
সহজম্—সহজাত, কর্ম—কর্ম; কৌন্তেয় — হে কুন্তীপুত্র; সদোষম্ — দোষযুক্ত; অপি – হলেও; ন–নয়, ত্যজেৎ— ত্যাগ করা উচিত, সর্বারম্ভা— সমস্ত কর্ম: হি- যেহেতু দোষেণ— দোষের দ্বারা; ধুমেন — ধূমের দ্বারা; অগ্নিঃ— অগ্নি; ইব—যেমন; আবৃতাঃ—আবৃত।
গীতার গান
সদোষ সহজ কর্ম কভু নহে আজ ৷
তাহাতেই সিদ্ধিলাভ হৃদি সদা ভজ ।।
জগতের সব কাজ দোষ বিনা নয়।
অগ্রেতে যথা কদা ধূম দেখা যায় ৷।
অনুবাদঃ হে কৌন্তেয় ! সহজাত কর্ম দোষযুক্ত হলেও ত্যাগ করা উচিত নয়। যেহেতু অগ্নি যেমন ধূমের দ্বারা আবৃত থাকে, তেমনই সমস্ত কমই দোষের দ্বারা আবৃত থাকে।
তাৎপর্যঃ মায়াবদ্ধ জীবনে সব কাজই জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা কলুষিত। এমন কি কেউ যদি ব্রাহ্মণও হন, তা হলেও তাঁকে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে হয় যাতে পশু বলি দিতে হয়। তেমনই, ক্ষত্রিয় যতই পুণ্যবান হোন না কেন, তাঁকে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। তিনি তা পরিহার করতে পারেন না। তেমনই, একজন বৈশ্য, তা তিনি যতই পুণ্যবান হোন না কেন, ব্যবসায়ে টিকে থাকতে হলে তাঁর লাভের অঙ্কটি তাকে কখনও লুকিয়ে রাখতে হয় অথবা কখনও তাঁকে কালোবাজারি করতে হয়। এগুলি অবশ্যম্ভাবী। এগুলিকে পরিহার করা যায় না। তেমনই, কোন শূদ্রকে যখন কোন অসৎ মনিবের দাসত্ব করতে হয়, তখন তাকে তার মনিবের আজ্ঞা পালন করতেই হয়, যদিও তা করা উচিত নয়। এই সমস্ত ত্রুটি সত্ত্বেও, মানুষকে তার স্বধর্ম করে যেতে হয়, কেন না সেগুলি তার নিজেরই স্বভাবজাত।
এখানে একটি খুব সুন্দর উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। আগুন যদিও পবিত্র, তবুও তাতে ধোঁয়া থাকে। কিন্তু সেই ধোঁয়া আগুনকে অপবিত্র করে না। আগুনে যদিও ধোঁয়া আছে, তবুও আগুনকে সবচেয়ে পবিত্র বস্তু বলে গণ্য করা হয়। কেউ যদি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পরিত্যাগ করে ব্রাহ্মণের ধর্ম গ্রহণ করতে চায়, তা হলে তার পক্ষে কোনও নিশ্চয়তা নেই যে, ব্রাহ্মণের বৃত্তিতে কোন অপ্রিয় কৰ্ত্তব্য থাকবে না। সুতরাং সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, এই জড় জগতে কেউই জড়া প্রকৃতির কলুষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে পারে না। এই প্রসঙ্গে আগুন ও ধোঁয়ার দৃষ্টান্তটি খুবই সঙ্গত। শীতের সময় কেউ যখন আগুন পোহায়, কখনও কখনও ধোঁয়া তার চোখ ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গগুলিকে বিব্রত করে, কিন্তু এই সব বিরক্তিকর অবস্থা সত্ত্বেও তাকে আগুনের সদ্ব্যবহার করতেই হয়। তেমনই, কয়েকটি বিরক্তিকর ব্যাপার আছে বলেই স্বভাবজাত বৃত্তি পরিত্যাগ করা উচিত নয়। বরং, নিজের বৃত্তিমূলক কর্ম অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে পরমেশ্বর ভগবানের সেবা করতে দৃঢ়সফল হওয়া উচিত। সেটিই হচ্ছে সিদ্ধি লাভের আলোচ্য বিষয়। পরমেশ্বর ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য যখন কোন বিশেষ বৃত্তিমূলক কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তখন সেই বিশেষ কর্মের সমস্ত ত্রুটিগুলি পবিত্র হয়ে যায়। ভগবানের সেবায় যুক্ত হওয়ার ফলে কর্মফল যখন পবিত্র হয়ে যায়, তখন মানুষ অন্তরে আত্মাকে দর্শন করে এবং সেটিই হচ্ছে আত্ম-উপলব্ধি।