শ্লোকঃ ৩৪
যয়া তু ধর্মকামার্থান ধৃত্যা ধারয়তেহর্জুন।
প্রসঙ্গেন ফলাকাঙ্ক্ষী ধৃতিঃ সা পার্থ রাজসী ॥ ৩৪ ॥
খয়া যে; তু—কিন্তু; ধর্মকামার্থান্—ধর্ম, অর্থ ও কামকে মৃত্যাধৃতির দ্বারা: ধারয়তে—ধারণ করে; অর্জুন – হে অর্জুন; প্রসঙ্গেন — সঙ্গবশত; ফলাকাঙ্ক্ষী — ফলের আকাঙ্ক্ষী; ধৃতিঃ – বৃতি; সা— সেই পার্থ-হে পৃথাপুত্র; রাজসী- রাজসিক।
গীতার গান
যে ধৃতির দ্বারা ধরে ধর্ম, অর্থ, কাম ।
ফলাকাঙ্ক্ষী রাজসিক হয় তার নাম ৷৷
অনুবাদঃ হে অর্জুন ! হে পার্থ। যে ধৃতি ফলাকাঙ্ক্ষার সহিত ধর্ম, অর্থ ও কামকে ধারণ করে, সেই ধৃতি রাজসী।
তাৎপর্যঃ যে মানুষ সব রকম ধর্ম অনুষ্ঠান বা অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে সর্বদাই ফলের আকাঙ্ক্ষা করে, যার একমাত্র বাসনা হচ্ছে ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করা এবং যার মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়গুলি এভাবেই নিযুক্ত হয়েছে, সে রজোগুণাশ্রিত।
শ্লোকঃ ৩৫
যয়া স্বপ্নং ভয়ং শোকং বিষাদং মদমেব চ ।
ন বিমুঞ্চতি দুর্মেধা ধৃতিঃ সা পার্থ তামসী ।। ৩৫ ।।
যয়া—যার দ্বারা; স্বপ্নম্—স্বপ্ন; ভয়ম্—ভয়, শোকম্—শোক, বিষাদ — বিষাদ; মদম্—মদ; এর— অবশ্যই, চ-ও ননা; বিমুঞ্চতি — ত্যাগ করে; দুর্মেধা বুদ্ধিহীনা; ধৃতিঃ ধৃতি; সা—সেই; পার্থ- হে পৃথাপুত্র; তামসী — তামসী।
গীতার গান
যে ধৃতি দ্বারা নহে স্বপ্ন ভয় ত্যাগ ৷
তামসী সে ধৃতি দুর্মেধা আর মদ ॥
অনুবাদঃ হে পার্থ। যে ধৃতি স্বপ্ন, ভয়, শোক, বিষাদ, মদ আদিকে ত্যাগ করে না, সেই বুদ্ধিহীনা ধৃতিই তামসী ।
তাৎপর্যঃ এমন সিদ্ধান্ত করা উচিত নয় যে, সাত্ত্বিক মানুষেরা স্বপ্ন দেখে না। এখানে ‘স্বপ্ন’ বলতে বোঝাচ্ছে অত্যধিক নিদ্রা। সত্ত্ব, রজ বা তম যে গুণই হোক না কেন, স্বপ্ন সর্বদাই থাকে। স্বপ্ন দেখাটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু যারা বেশি না ঘুমিয়ে পারে না, যারা জড় জগৎকে ভোগ করার গর্বে গর্বিত না হয়ে পারে না, যারা জড় জগতে কর্তৃত্ব করার স্বপ্ন দেখছে এবং যাদের প্রাণ, মন, ইন্দ্রিয় আদি সেভাবেই নিযুক্ত, তারা তমোগুণের বৃতি দ্বারা আচ্ছন্ন বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
শ্লোকঃ ৩৬
সুখং ত্বিদানীং ত্রিবিধং শৃণু যে ভরতর্ষভ ৷
অভ্যাসাদ রমতে যত্র দুঃখান্তং চ নিগচ্ছতি ॥ ৩৬ ॥
সুখম্—সুখ; তু—কিন্তু; ইদানীম্ — এখন; ত্রিবিধম্—তিন প্রকার; শ—শ্রবণ কর; মে—আমার কাছে; ভরতর্ষন্ত – হে ভরতশ্রেষ্ঠ; অভ্যাসাৎ-অভ্যাসের দ্বারা; রমতে—রমণ করে; যত্র— যেখানে; দুঃখ-দুঃখের, অস্তম্—অন্ত; চ–ও; নিগচ্ছতি লাভ করে।
গীতার গান
ত্রিবিধ সে সুখ শুন ভারত ঋষভ ।
জড় সুখে মজে জীব কিন্তু দুঃখ সব ॥
সে সুখ সে উপরতি দুঃখ অন্ত হয় ৷
সংসারের মায়াসুখ তবে হয় ক্ষয় ॥
অনুবাদঃ হে ভরতর্ষভ। এখন তুমি আমার কাছে ত্রিবিধ সুখের বিষয় শ্রবণ কর। বদ্ধ জীব পুনঃ পুনঃ অভ্যাসের দ্বারা সেই সুখে রমণ করে এবং যার দ্বারা সমস্ত দুঃখের অন্তলাভ করে থাকে।
তাৎপর্যঃ বন্ধ জীব বারবার জড় সুখ উপভোগ করতে চেষ্টা করে। এভাবেই সে চর্বিত বস্তু চর্বণ করে। কিন্তু কখন কখন এই ধরনের সুখ উপভোগ করতে করতে কোন মহাত্মার সঙ্গ লাভ করার ফলে সে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। পক্ষান্তরে বলা যায়, বদ্ধ জীব সর্বদাই কোন না কোন রকমের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধনের চেষ্টায় রত থাকে। কিন্তু সাধুসঙ্গের প্রভাবে সে যখন বুঝতে পারে যে, তা কেবল একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি, তখন সে তার যথার্থ কৃষ্ণভাবনায় জাগরিত হয়ে ওঠে। তখন সে এভাবেই আবর্তনশীল তথাকথিত সুখের কবল থেকে মুক্ত হয়।