শ্লোকঃ ৪

নিশ্চয়ং শৃণু মে তত্র ত্যাগে ভরতসত্তম

ত্যাগো হি পুরুষব্যাঘ্র ত্রিবিধঃ সংপ্রকীর্তিতঃ ॥ ৪॥

নিশ্চয়ম্ — নিশ্চয় সিদ্ধান্ত, শৃণু — শ্রবণ কর; মে – আমার; তত্র — সেই ত্যাগে- ত্যাগ সম্বন্ধে ভরতসত্তম – হে ভারতশ্রেষ্ঠ; ত্যাগঃ — ত্যাগ; হি— অবশ্যই; পুরুষব্যাঘ্র— হে পুরুষব্যাঘ্র; ত্রিবিধঃ—তিন প্রকার, সংপ্রকীর্তিতঃ—কীর্তিত হয়েছে।

গীতার গান

তার মধ্যে যে সিদ্ধান্ত কহি তাহা শুন ৷

ত্রিবিধ সে ত্যাগ হয় ভরতসত্তম ৷৷

অনুবাদঃ হে ভরতসত্তম ! ত্যাগ সম্বন্ধে আমার নিশ্চয় সিদ্ধান্ত শ্রবণ কর। হে পুরুষব্যাঘ্র ! শাস্ত্রে ত্যাগও তিন প্রকার বলে কীর্তিত হয়েছে।

তাৎপর্যঃ ত্যাগ সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ থাকলেও, এখানে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর রায় দিচ্ছেন, যা চরম সিদ্ধান্ত বলে গ্রহণ করা উচিত। যে যাই বলুন, বেদ হচ্ছে ভগবান প্রদত্ত নীতিবিশেষ। এখানে ভগবান নিজেই উপস্থিত থেকে যা বলছেন, তাঁর নির্দেশকে চরম বলে গ্রহণ করা উচিত। ভগবান বলেছেন যে, প্রকৃতির যে গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কর্ম ত্যাগ করা হয়, তারই পরিপ্রেক্ষিতে সব কিছু বিবেচনা করা উচিত।

শ্লোকঃ ৫

যজ্ঞদানতপঃকর্ম ন ত্যাজ্যং কার্যমেব ত‍ৎ ৷

যজ্ঞো দানং তপশ্চৈব পাবনানি মনীষিণাম্ ।। ৫ ।।

যজ্ঞ-যজ্ঞ, দান—দান, তপঃ—তপস্যা; কর্ম—কর্ম; ন–নয়, ত্যাজ্যম্— ত্যাজ্য; কার্যম্—করা কর্তব্য; এব— অবশ্যই; তৎ—তা; যজ্ঞঃ— যজ্ঞ, দানম্—দান, তপঃ —তপস্যা; চ—ও; এব—অবশ্যই; পাবনানি – পবিত্র করে; মনীষীণাম্—মনীষীদের পর্যন্ত।

গীতার গান

স্বরূপত যজ্ঞদান কভু ত্যাজ্য নয় ।

সকল সময়ে তাহা কার্য যোগ্য হয় ॥

বদ্ধজীব আছে যত তাদের কর্তব্য।

মনীষী পাবন সেই যজ্ঞ দান কাৰ্য ৷৷

অনুবাদঃ যজ্ঞ, দান ও তপস্যা ত্যাজ্য নয়, তা অবশ্যই করা কর্তব্য। যজ্ঞ, দান ও তপস্যা মনীষীদের পর্যন্ত পবিত্র করে।

তাৎপর্যঃ যোগীদের উচিত মানব-সমাজের উন্নতি সাধনের জন্য কর্ম সম্পাদন করা। মানুষকে পরমার্থের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপযোগী অনেক শুদ্ধিকরণের প্রক্রিয়া আছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বিবাহ অনুষ্ঠানকেও এই রকম একটি পবিত্র কর্ম বলে গণ্য করা হয়। তাকে বলা হয় ‘বিবাহ- যজ্ঞ’। একজন সন্ন্যাসী, যিনি সব কিছু ত্যগ করেছেন এবং পারিবারিক সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন, তাঁর পক্ষে কি বিবাহ অনুষ্ঠানে উৎসাহ দান করা উচিত? ভগবান এখানে বলেছেন যে, মানব সমাজের মঙ্গলের জন্য যে যজ্ঞ, তা কখনই ত্যাগ করা উচিত নয়। বিবাহ যজ্ঞের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মনকে সংযত করে শান্ত করা, যাতে সে পরমার্থ সাধনের পথে এগিয়ে যেতে পারে। অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই ‘বিবাহ-যজ্ঞ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ দাম্পত্য জীবন যাপন করা উচিত এবং তাদের এভাবেই অনুপ্রাণিত করা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের কর্তব্য। সন্ন্যাসীর কখনই স্ত্রীসঙ্গ করা উচিত নয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, যারা জীবনের নিম্নস্তরে রয়েছে, যারা যুবক, তারা বিবাহ করে সহধর্মিণী গ্রহণ করা থেকে নিরস্ত থাকবে। শাস্ত্রে নির্দেশিত সব কয়টি যজ্ঞই পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে আশ্রয় লাভ করার জন্যই সাধিত হয়। তাই, নিম্নতর স্তরে সেগুলি বর্জন করা উচিত নয়। তেমনই, হৃদয়কে নির্মল করার উদ্দেশ্যে দান করা হয়। পূর্বের বর্ণনা অনুযায়ী, যোগ্য পাত্রে যদি দান করা হয়, তা হলে তা পারমার্থিক উন্নতির সহায়ক।

শ্লোকঃ ৬

এতান্যপি তু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ফলানি চ ।

কর্তব্যানীতি যে পার্থ নিশ্চিতং মতমুত্তমম্ ।। ৬ ।।

এতানি—এই সমস্ত; অপি – অবশ্যই; তু—কিন্তু; কর্মাণি – কর্ম; সঙ্গম্ — আসক্তি; ত্যক্ত্বা — পরিত্যাগ করে; ফলানি — ফলসমূহ: চ—ও; কর্তব্যানি— কর্তব্যবোধে অনুষ্ঠান করা উচিত; ইতি—ইহাই; মে— আমার, পার্থ – হে পৃথাপুত্র, নিশ্চিতম্ — নিশ্চিত, মহম্—অভিমত, উত্তমম্ — উত্তম ।

গীতার গান

যে কার্যের অনুষ্ঠান ফলসঙ্গ ত্যাগ।

কর্তব্যের অনুরোধে শুধু তাহে রাগ ॥

অনুবাদঃ হে পার্থ। এই সমস্ত কর্ম আসত্তি ও ফলের আশা পরিত্যাগ করে কর্তব্যবোধে অনুষ্ঠান করা উচিত। ইহাই আমার নিশ্চিত উত্তম অভিমত।

তাৎপর্যঃ যদিও সব কয়টি যজ্ঞই পবিত্র, তবুও তা অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে কোন রকম ফলের আশা করা উচিত নয়। পক্ষান্তরে বলা যায়, জাগতিক উন্নতি সাধনের জন্য যে সমস্ত যজ্ঞ, তা বর্জন করতে হবে। কিন্তু যে সমস্ত যজ্ঞ মানুষের অস্তিত্বকে পবিত্র করে এবং তাদের পারমার্থিক স্তরে উন্নীত করে, তা কখনই ত্যাগ করা উচিত নয়। কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তি লাভের সহায়ক সব কিছুকে সর্বতোভাবে গ্রহণ করা উচিত। শ্রীমদ্ভাগবতেও বলা হয়েছে, যে সমস্ত কার্যকলাপ ভগবদ্ভক্তি লাভের সহায়ক তা গ্রহণ করা উচিত। সেটিই হচ্ছে ধর্মের সর্বোচ্চ নীতি। ভগবদ্ভক্তি সাধনের সহায়ক যে কোন রকমের কার্য, যজ্ঞ বা দান ভগবদ্ভক্তের গ্রহণ করা উচিত।

error: Content is protected !!