অষ্টাদশ অধ্যায়

মোক্ষযোগ

শ্লোক ১

অর্জুন উবাচ

সন্ন্যাসস্য মহাবাহো তত্ত্বমিচ্ছামি বেদিতুম্ ।

ত্যাগস্য চ হৃষীকেশ পৃথক্কেশিনিসূদন ॥ ১॥

অর্জুন উবাচ—অর্জুন বললেন; সন্ন্যাসস্য – সন্ন্যাসের; মহাবাহো – হে মহাবাহো তত্ত্বম্—তত্ত্ব; ইচ্ছামি— ইচ্ছা করি; বেদিতুম্—জানতে; ত্যাগস্য — ত্যাগের; চ— ও হৃষীকেশ – হে হৃষীকেশ, পৃথক্ – পৃথকভাবে, কেশিনিসূদন – হে কেশিহস্তা।

গীতার গান

অর্জুন কহিলেনঃ

সন্ন্যাসের তত্ত্ব কিবা ইচ্ছা সে শুনিতে ৷

হৃষীকেশ কহ তাই মোরে বুঝাইতে ॥

কেশিনিসূদন কহ ত্যাগের মহিমা ।

শুনিতে আনন্দ হয় নাহি পরিসীমা ॥

অনুবাদঃ শ্রীমদ্ভগবদগীতা যথাযথ অনুবাদ অর্জুন বললেন— হে মহাবাহো ! হে হৃষীকেশ। হে কেশিনিসূদন ! আমি সন্ন্যাস ও ত্যাগের তত্ত্ব পৃথকভাবে জানতে ইচ্ছা করি।

তাৎপর্যঃ প্রকৃতপক্ষে ভগবদ্গীতা সতেরটি অধ্যায়েই সমাপ্ত। অষ্টাদশ অধ্যায়টি হচ্ছে পূর্ব অধ্যায়গুলিতে আলোচিত বিভিন্ন বিষয়বস্তুর পরিপূরক সারাংশ। ভগবদ্গীতার প্রতিটি অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গুরুত্ব সহকারে উপদেশ দিচ্ছেন যে, পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রতি ভগবদ্ভক্তির অনুশীলনই হচ্ছে জীবনের পরম লক্ষ্য। সেই একই বিষয়বস্তু জ্ঞানের ওহাতম পন্থারূপে অষ্টাদশ অধ্যায়ে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হয়েছে। প্রথম ছয়টি অধ্যায়ে ভক্তিযোগের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে— যোগিনামপি সর্বোচ্….”সমস্ত যোগীদের মধ্যে যিনি সর্বদাই তাঁর অন্তরে আমাকে চিন্তা করেন, তিনি হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ।” পরবর্তী ছয়টি অধ্যায়ে শুদ্ধ ভক্তি, তার প্রকৃতি এবং তার অনুশীলনের বর্ণনা করা হয়েছে। শেষ ছাটি অধ্যায়ে জ্ঞান, বৈরাগ্য, জড়া প্রকৃতির ক্রিয়াকলাপ, অপ্রাকৃত প্রকৃতি ও ভগবৎ সেবার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবানের উদ্দেশ্যে সমস্ত কর্মের অনুষ্ঠান করা উচিত, যিনি ওঁ তৎ সৎ শব্দগুলির দ্বারা প্রকাশিত হয়েছেন, যা পরম পুরুষ শ্রীবিষ্ণুকেই নির্দেশ করে। ভগবদ্গীতার তৃতীয় পর্যায়ে দেখানো হয়েছে যে, ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন ছাড়া আর কিছুই জীবনের চরম লক্ষ্য নয়। পূর্বতন আচার্যগণের দ্বারা এবং ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্ত-সূত্রের উদ্ধৃতি সহকারে তা প্রতিপন্ন হয়েছে। কোন কোন নির্বিশেষবাদীরা মনে করেন যে, বেদান্তসূত্র জ্ঞানের একচেটিয়া অধিকার কেবল তাঁদেরই আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বেদান্ত-সূত্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবন্তুক্তি হৃদয়ঙ্গম করা। কারণ, ভগবান নিজেই হচ্ছেন বেদান্ত-সূত্রের প্রণেতা এবং তিনিই হচ্ছেন বেদান্তবেত্তা। সেই কথা পঞ্চদশ অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রতিটি শাস্ত্রের, প্রতিটি বেদেরই প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ভগবদ্ভক্তি। ভগবদ্‌গীতায় সেই কথা বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

ভগবদ্গীতায় দ্বিতীয় অধ্যায়ে সমগ্র বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্তসার বর্ণনা করা হয়েছে, তেমনই অষ্টাদশ অধ্যায়েও সমস্ত উপদেশের সারমর্ম বর্ণনা করা হয়েছে। বৈরাগ্য ও জড়া প্রকৃতির তিনগুণের ঊর্ধ্বে চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত হওয়াই জীবনের পরম উদ্দেশ্য বলে নির্দেশিত হয়েছে। ভগবদ্গীতার দুটি পৃথক বিষয়বস্তু — ত্যাগ ও সন্ন্যাস সম্বন্ধে অর্জুন স্পষ্টভাবে জানতে চাইছেন। এভাবেই তিনি এই দুটি শব্দের অর্থ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছেন।

ভগবানকে সম্বোধন করে এখানে যে দুটি শব্দ ‘হৃষীকেশ’ ও ‘কেশিনিসূদন’ ব্যবহার করা হয়েছে, তা তাৎপর্যপূর্ণ। হাযীকেশ হচ্ছেন সমস্ত ইন্দ্রিয়ের অধিপতি শ্রীকৃষ্ণ, যিনি আমাদের মানসিক শান্তি লাভের জন্য সব সময় সাহায্য করেন। অর্জুন তাঁকে অনুরোধ করছেন, সব কিছুর সারমর্ম এমনভাবে বর্ণনা করতে যাতে তিনি তাঁর মনের সাম্যভাব বজায় রেখে অবিচলিত চিত্ত হতে পারেন। তবুও তাঁর মনে সন্দেহ রয়েছে এবং সন্দেহকে সব সময় অসুরের সঙ্গে তুলনা করা হয় । তাই শ্রীকৃষ্ণকে তিনি ‘কেশিনিসূদন’ বলে সম্বোধন করছেন। বেশী ছিলেন অভ্যন্ত দুর্ধর্ষ অসুর। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে হত্যা করেছিলেন। এখন অর্জুন প্রত্যাশা করছেন যে, তাঁর মনের সন্দেহরূপী অসুরটিকেও শ্রীকৃষ্ণ নাশ করবেন।

শ্লোকঃ ২

শ্রীভগবানুবাচ

কাম্যানাং কর্মণাং ন্যাসং সন্ন্যাসং কবয়ো বিদুঃ ।

সর্বকর্মফলত্যাগং প্রাহুস্ত্যাগং বিচক্ষণাঃ ।। ২ ।।

শ্রীভগবান্ উবাচ —— পরমেশ্বর ভগবান বললেন; কাম্যানাম্ — কাম্য: কৰ্মনাম — কর্মসমূহের; ন্যাসম্—ত্যাগকে সন্ন্যাস — সন্ন্যাস; কয়ঃ—পণ্ডিতগণ; বিদুঃ— জানেন; সর্ব—সমস্ত; কর্ম-কর্ম, ফল-ফল, ত্যাগ — ত্যাগকে, প্রাহুঃ বলেন; ত্যাগম্—ত্যাগ; বিচক্ষণাঃ—কিঙ্কণ ব্যক্তিগণ।

গীতার গান

শ্রীভগবান কহিলেনঃ

কাম্যকর্ম পরিত্যাগ সন্ন্যাস সে হয় ।

সর্বকর্ম ফলত্যাগ ত্যাগ পরিচয় ।।

বিচক্ষণ করি যত করিল নির্ণয় ।

সেই সে সন্ন্যাস আর ত্যাগ নাম হয় ।।

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন — পণ্ডিতগণ কাম্য কর্মসমূহের ত্যাগকে সন্ন্যাস বলে জানেন এবং বিচক্ষণ ব্যক্তিগণ সমস্ত কর্মফল ত্যাগকে ত্যাগ বলে থাকেন।

তাৎপর্যঃ কর্মফলের আকাঙ্ক্ষাযুক্ত যে কর্ম, তা ত্যাগ করতে হবে। সেটিই হচ্ছে ভগবদ্‌গীতার নির্দেশ। কিন্তু পারমার্থিক জ্ঞান লাভের জন্য যে কর্ম, তা পরিত্যাগ করা উচিত নয়। পরবর্তী শ্লোকগুলিতে তা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হবে। কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যজ্ঞ সম্পাদনের বিভিন্ন বিধি-বিধান বৈদিক শাস্ত্রে আছে। পুত্র লাভের জন্য অথবা স্বর্গ লাভের জন্য বিশেষ বিশেষ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে হয়, কিন্তু কামনার বশবর্তী হয়ে যজ্ঞ করা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু তা বলে, নিজের অন্তর পরিশুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ অনুষ্ঠান অথবা পারমার্থিক বিজ্ঞানে উন্নতি লাভের জন্য যে সমস্ত যজ্ঞ, তা পরিত্যাগ করা উচিত নয়।

শ্লোকঃ ৩

ত্যাজ্যং দোষবদিত্যেকে কর্ম প্রাহুর্মনীষিণঃ ।

যজ্ঞদানতপঃকর্ম ন ত্যাজ্যমিতি চাপরে ॥৩॥

ত্যাজ্যন্—ত্যাজ্য; দোষবৎ — দোষযুক্ত; ইতি – সেই হেতু; একে এক শ্রেণীর, কর্ম-কর্ম, প্রাহুঃ বলেন; মনীষিণঃ – মনীষীগণ; যজ্ঞ — যজ্ঞ দান—দান, তপঃ — তপস্যা; কর্ম-কর্ম, ন–নয়; ত্যাজ্যম্— ত্যাজ্য; ইতি—এভাবে; চ—এবং; অপরে—অন্যেরা।

গীতার গান

মনীষীগণ সর্ব কর্ম ত্যাগ করে ।

যজ্ঞ দান তপক্রিয়া নহে, কহয়ে অপরে ॥

অনুবাদঃ এক শ্রেণীর মনীষীগণ বলেন যে, কর্ম দোষযুক্ত, সেই হেতু তা পরিত্যজ্য। অপর এক শ্রেণীর পণ্ডিত যজ্ঞ, দান, তপস্যা প্রভৃতি কর্মকে অত্যাজ্য বলে সিদ্ধান্ত করেছেন।

তাৎপর্যঃ বৈদিক শাস্ত্রে এমন অনেক কার্যকলাপের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা তর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, যজ্ঞে পশুবলি দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। আবার সেই সঙ্গে এটিও বলা হয়েছে যে, পশুহত্যা করা অত্যন্ত ঘৃণ্য কর্ম। যদিও যজ্ঞে পশুবলির নির্দেশ বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পশু হত্যা করার কোন নির্দেশ দেওয়া হয়নি। যজ্ঞে বলি দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে পশুটিকে নবজীবন দান করা। কখনও কখনও যজ্ঞে বলি দেওয়ার মাধ্যমে পশুটিকে নতুন পণ্ডর জীবন দেওয়া হত এবং কখনও কখনও পশুটিকে তৎক্ষণাৎ মনুষ্য জীবনে উন্নীত করা হত। কিন্তু এই সম্বন্ধে নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ বলেন যে, পশুহত্যা সর্বতোভাবে বর্জন করা উচিত, আবার কেউ বলেন যে, কোন বিশেষ যজ্ঞে পশুবলি দেওয়া যজ্ঞ সম্বন্ধে এই সমস্ত সন্দেহের নিরসন ভগবান নিজেই এখন করছেন।

error: Content is protected !!