দেশের বাইরে যাবার সুযোগে আনন্দিত হন না এমন মানুষের সংখ্যা খুবই অল্প। আমি সেই খুব অল্পদের একজন। বাইরে যাবার সামান্য সম্ভাবনাতেই আমি আতঙ্কগ্রস্থ হই। আতঙ্কগ্রস্থ হবার কারণ আছে – এখন পর্যন্ত আমি কোন বিদেশযাত্রা নির্বিঘ্নে শেষ করতে পারিনি।
একবার কিছু লোকের সঙ্গে চীন গিয়েছিলাম। আমাদের দলনেতা ফয়েজ ভাই। যিনি সারাক্ষণ আমাক্র গার্ড দিয়ে রাখছেন যাতে হারিয়ে না যাই। তাঁর ধারণা, প্রথম সুযোগেরি আমি হারিয়ে যাব। হারালাম না, তবে চোখে খোঁচা লাগিয়ে মহাবিপদ ঘটালাম। ডাক্তার দুটি চোখ ব্যান্ডেজ করে বন্ধ করে দিলেন। পুরো অন্ধ। লেখকরা মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমি তাদের পেছনে তাদের হাত ধরে ধরে হাঁটছি। এই হচ্ছে আমার চীন দেখা।
পাশের দেশ ইন্ডিয়াতে গিয়ে কি ঝামেলায় পড়েছিলাম একটু বলে নেই। সাতদিনের জন্যে গিয়েছি মোম্বে। এলিফেন্ট গুহা, অজন্তা ইলোর সব দেখা হল। কোন কাম ঝামেলা ছাড়াই হল। এখন দেশে ফিরব। রাত তিনটায় প্লেন। বাংলাদেশ বিমান। বলা তো যায় না, আমার যা কপাল, প্লেন যদি আগেভাগে চলে আসে। এই ভয়ে ন’টা থেকে এয়ারপোর্টে বসে আছি। সঙ্গে টাকা-পয়সা যা ছিল সব শেষ মুহূর্তের বাজারে শেষ করা গেল। এখন বিমানের জন্যে অপেক্ষা। যথাসময়ে ইংল্যাণ্ড থেকে বিমান এল। বোর্ডিং পাস নিতে গেছি, বাংলাদেশ বিমানের লোকজন বলল, এথেন্স থেকে প্লেন ওভারবুকিং হয়ে এসেছে, আপনাকে নেয়া যাবে না। আমি আঁতকে উঠে বললাম, সে কি! চব্বিশ ঘণ্টা আগেই তো টিকিট ওকে করানো।
‘বললাম তো, যাত্রী বোঝাই। কিছু করা যাবে না।’
প্লেন আমাকে রেখে চলে গেল। শীতের রাত। সঙ্গে একটা পয়সা নেই। এখানে কাউকে চিনিও না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে,
এইসব তো ছোটখাট বিপদ। ইংল্যাণ্ডের হিথ্রো বিমান বন্দরে একবার মহাবিপদে পড়েছিলাম। দুই কন্যা এবং স্ত্রীকে নিয়ে আমেরিকা থেকে দেশে ফিরছি। পাসপোর্ট যাতে নিরাপদে থাকে সেইজন্যে গুলতেকিনের হ্যান্ডব্যাগে রাখা আছে। গুলতেকিন আমার স্ত্রীর নাম। এই ভয়াবহ নাম তার দাদা রেখে গেছেন। বিয়ের পর বদলাতে চেয়েছিলাম, পারিনি।
‘চাঁদের মাটি দেখেছেন?’
‘চাঁদের মাটি তো বাংলাদেশেই দেখেছি। উনিশশো সত্তর সনে আমেরিকান অ্যাম্পেসী চন্দ্রশিলা নিয়ে এসেছিল।’
‘চাঁদের মাটি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছেন।?’
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘চাঁদের মাটি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা যায়?’
‘হ্যাঁ যায়। মিউজিমিয়ামে সেই ব্যবস্থা আছে। যাবেন?’
‘অবশ্যই যাব। চাঁদের মাটি স্পর্শ করা তো চাঁদকে স্পর্শ করা। এই সুযোগ পাওয়া যাবে তা তো কখনো কল্পনা করিনি।’
আনন্দে আমার চোখ ঝলমল করতে লাগল। ইয়াসমিন হাঁসতে হাঁসতে বলল, আমি জানতাম চন্দ্রশিলা হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় শুনে আপনি খুব এক্সসাইটেড ফিল করবেন। এই কারণেই সবার শেষে আপনার জন্যে এই প্রোগ্রাম রেখে দিয়েছি।
সারাদিন গাড়ি চালিয়ে বিকেলে পৌঁছলাম মিউজিয়ামে। অনেক কিছুই দেখার আছে সেখানে – রাইট ব্রাদার্সের তৈরি প্রথম বিমান, যে লুনার মডিউলে চাঁদে নেমেছিল – সেই লুনার মডিউল, আরো কত কি …!
কিছুই দেখলাম না, এগিয়ে গেলাম চন্দ্রশিলার দিকে।
উঁচু একটি আসনে চাঁদের মাটি সাজানো। উপরে লেখা – এই চন্দ্রশিলা হাত দিয়ে স্পর্শ করা যাবে।
আমি এবং গুলতেকিন একসঙ্গে চাঁদের পাথরে হাত রাখলাম। আমার রোমাঞ্চ বোধ হল। গভীর আবেগে চোখে পানি এসে গেল। কত-না পূর্ণিমার রাত মুগ্ধ চোখে এই চাঁদের দিকে তাকিয়ে বিস্ময় ও আবেগে অভিভূত হয়েছি। সেই চাঁদ আজ স্পর্শ করলাম। আমার এই মানবজীবন ধন্য।
আমেরিকার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতাবোধে মন দ্রবীভূত হল। আমেরিকানদের অনেক দোষ ত্রুটি, তবুও তো এরা আমাকে এবং আমার মত আরো অসংখ্য মানুষকে রোমাঞ্চ ও আবেগে অভিভূত হবার সুযোগ করে দিয়েছে। ধরাছোঁয়ার বাইরের যে চাঁদ, তাকে নিয়ে এসেছে মাটির পৃথিবীতে। এই শতক শেষ হবার আগেই তারা যাত্রা করবে মঙ্গলগ্রহের দিকে। সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে আবারও অভিভূত করবে। আমেরিকা আমি পছন্দ করি না, তবু চন্দ্রশিলায় হাত রেখে মনে মনে বললাম – তোমাদের জয় হোক।
ইয়াসমিন ক্যামেরা হাতে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল। কোমল গলায় বলল, দাদাভাই হাসুন, আপনাদের ছবি তুলে রাখি, আপনি চাঁদের মাটিতে হাত দিয়ে এমন মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
“আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ