মেহেরুন্নেছা মিরা (বাগেরহাট)

পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানার ষোলসাত রঘুনাথপুর গ্রামের দফাদার বাড়ির একটি দরিদ্র মুসলিম পরিবারে মেহেরুন্নেছা মিরা জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তাছেনউদ্দিন শেখ এবং মা হাজেরা বেগম। কবে কখন তাঁর জন্ম তা তিনি বা তাঁর আত্মীয়স্বজন সঠিকভাবে বলতে পারেন নি। তিনি জানান ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল ২০-২১ বছর। দুই বোনের মধ্যে তিনি বড়। বাবার আর্থিক দীনতা এবং পারিপার্শ্বিকতার অসহযোগিতার কারণে তিনি খুব একটা লেখাপড়া করতে পারেন নি। ছেলেবেলা থেকেই দু’মুঠো ভাতের জন্য বাবার সাথে সংসারের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করতে হয়েছে তাঁকে। জীবিকার প্রয়োজনে একসময়ে তিনি বাগেরহাটে চলে যান। মিরা ছোটবেলা থেকেই ভালো গান গাইতে পারতেন। তাই যাত্রাদলে কাজ করার সুযোগ পান। বিভিন্ন যাত্রাদল বদলের পর একসময় জয়দুর্গা অপেরায় যোগ দেন। যাত্রাদলে অভিনয় ও গান করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়ে জয়দুর্গা অপেরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরে কর্মরত ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি আবার বাগেরহাটে ফিরে আসেন। পাকবাহিনীর অত্যাচারে শরণার্থী হিসেবে ভারতে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। এদিকে পাকবাহিনী ও তাদের এদেশের দোসর রাজাকার আলবদররা নির্বিচারে খুন, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার উন্মাদনায় মত্ত। একদিকে লাশের গন্ধ অন্যদিকে লুটপাট ধর্ষণের হোলি খেলা যুবতী মিরাকে ভাবিয়ে তোলে। শিল্পীর কোমল মন একসময় প্রতিশোধের নেশায় বারুদে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকেন তিনি।

বিশ্বস্তসূত্রে খবর পেয়ে যাত্রাদলের এক সহকর্মীকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে বাগেরহাট থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে দেপাড়া গ্রামে যান মিরা। তখন সেখানে অবস্থান করছিলেন ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলাম। মিরা ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলামের কাছে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। মিরার কথাবার্তা শুনে ও আগ্রহে মুগ্ধ হয়ে ক্যাপ্টেন তাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের অনুমতি দেন। ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলামের অনুমতি পেয়ে মিরা ৯ নং সেক্টরের আওতায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

রাইফেল, মেশিনগান চালানো, গ্রেনেড ছোড়া সহ বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহারের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। প্রথমে ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলামের নিকট সমরাস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন মিরা। একাত্তরের জুলাই মাসে রফিকুল ইসলাম খোকনের দলে যোগ দেন এবং বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন।

যুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করে তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি কখনো কুলবধূ, কখনো ভিখারিনী, কখনোবা সরাসরি যোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রফিকুল ইসলাম খোকনের নেতৃত্বে ৯নং সেক্টরের আওতায় বাগেরহাট জেলার পার্শ্ববর্তী এলাকা তালেশ্বর, ভাষার হাট, বয়াসিং ও নাজীরপুর থানার রঘুনাথপুরের যুদ্ধসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য কমান্ডারের নিকট অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন মিরা। বিশ্বস্ততার জন্য ক্যাম্পের গোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাঁকে দেয়া হতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি দক্ষতার সাথে তাঁর স্বীয় দায়িত্ব পালন করেন এবং প্রশংসিত হন।

দেশ স্বাধীন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরেছে। তাঁরা সোনার ছেলে; দেশের সম্পদ কিন্তু দেশ স্বাধীনের পরে ? মিরা মেয়ে মানুষ, গরিব, তাঁর বাবার অর্থকড়ি নেই। তারপরে গেছে মুক্তিযুদ্ধে। সমাজ নারী মুক্তিযোদ্ধা বলতে বোঝে বীরাঙ্গনাদের। এক শ্রেণীর সমাজপতির এ রকম দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজের বোঝায় পরিণত হয় মিরা । দেশ স্বাধীন পর্যন্ত মিরাও ছিল দেশের সম্পদ। একদিকে সমাজের তিরস্কার অন্যদিকে দারিদ্র্য সব মিলে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে মিরার জীবন।

১৯৭৩ সালের ১০ জুলাই বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ থানা সদরে আব্দুল হাইকে বিয়ে করেন মুক্তিযোদ্ধা মিরা। বিয়ের পরে বিভিন্ন সময়ে কথোপকথনে তাঁর স্বামী তাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিত। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, পুরুষ মানুষের সাথে ক্যাম্পে থেকেছে— এটাই মিরার বড় অপরাধ! সময় গড়িয়ে যায়, মিরার কোল জুড়ে আসে দুই ছেলে দুই মেয়ে। এক সময় তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। পরমুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে মিরা।

পাকিস্তানিদের আগ্রাসন থেকে মুক্তি পেলেও দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি পান নি মিরা। এখনো তাঁকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে দারিদ্র্যের সাথে। সময় গড়িয়ে স্বাধীনতা বত্রিশে পা রেখেছে; সেই সাথে তাঁর দুই ছেলে দুই মেয়ে বড় হয়েছে, তাদের বিয়ে দিয়েছে। অর্থাভাবে ছেলেমেয়েদের খুব একটা লেখাপড়া শিখাতে পারেন নি। ছেলে-মেয়েরা যার যার সংসার করে। মিরার একটি ছোট চায়ের দোকান আছে; এরই সাথে আছে একটি লাকড়ির ব্যবসা। সেখান থেকে যে সামান্য আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে। এক মাস চললে পরের মাসে দেনা করতে হয়।

চাপাকান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘যুদ্ধ করেছি কিন্তু কিছু পাই নি। অর্ধাহারে- অনাহারে থাকি, আফসোস নেই। খারাপ লাগে নারী মুক্তিযোদ্ধা বলতে অনেকে খারাপ মেয়েমানুষ হিসেবে মনে করে। পুরুষের পাশাপাশি আমরাও যে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছি, অবদান রেখেছি স্বাধীনতার জন্য কিন্তু তার যথাযথ স্বীকৃতি নেই। সকলের নিকট আবেদন— নারী মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ করে যারা গ্রামে অবহেলা আর অনাদরে পড়ে আছে তাঁরা যেন যথাযথ মর্যাদা, স্বীকৃতি ও সম্মান পায়।

error: Content is protected !!