গত ৩ ও ৪ মে ১৯৯২ কলকাতার পত্রিকাগুলোয় ‘মেঠাইবাবা’কে নিয়ে তোলপাড় করা খবর প্রকাশিত হল। খবরটা নানাভাবে প্রকাশিত হলেও মূল কথা ছিল একই। পুণে জেলার বারামতির এক সাধারণ কৃষক ভানুদাস গাইকোয়াড় সাধারণ মানুষ ও বিজ্ঞানীদের চোখে হয়ে উঠেছেন এক বিরাট বিস্ময়। তিনি যা ছুঁচ্ছেন তাই মিষ্টি হয়ে যাচ্ছে। বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা নানাভাবে পরীক্ষা করেও রহস্য উদ্ধার করতে না পেরে হতভম্ব। ব্যাপারটা নেহাতই বুজরুকি কি না তা দেখার জন্য সাবান এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দিয়ে হাত ধুইয়ে বুজরুকি কি না তা দেখার জন্য সাবান এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দিয়ে হাত ধুয়ে দিয়েছেন বিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং সাংবাদিকরা। কিন্তু তারপরও দেখা গেছে ভানুদাসের হাতের ছোঁয়ায় অতি ঝাল কাঁচালঙ্কা ও নিমেষে যেন গুড়! সাবান দিয়ে হাত ধুইয়ে ভানুদাসের হাতে দেওয়া হয়েছিল স্টেনলেস স্টিলের একটি কলম। ভানুদাসের পরশ পাওয়ার পর কলমটিতে জিব ঠেকাতেই দেখা গেল কলমও মিষ্টি । এক গ্লাস জলে হাত ডোবালেই হয়ে যাচ্ছে সরবত।

ভারতবর্ষের বহু পত্র-পত্রিকায় মেঠাইবাবার এই অলৌকিক ক্ষমতার খবর প্রকাশিত হয়েছে। আর সেই সুবাদে তিরিশটির ওপর চিঠি পেয়েছিলাম বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে। এঁদের প্রত্যেকেরই চিঠির মূল সুর ছিল—এই রহস্য ভেদ করুন।

তথাকথিত অলৌকিক রহস্যের উন্মোচনের ক্ষেত্রে আমাদের সমিতির কাছে প্রত্যাশা আকাশছোঁয়া। তখন ‘আজকাল’ পত্রিকার সঙ্গে আমাদের সমিতির যুগলবন্দি দস্তুর মতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল।

‘আজকাল’ পত্রিকার হয়ে সত্যানুসন্ধানে নামলাম। ২১ জুন হাওড়া থেকে গীতাঞ্জলি ধরলাম । ২২ জুন রাত ন’টা পঁয়তাল্লিশের গাড়ি পৌঁছল রাত ঠিক বারোটায়। বোম্বাইয়ের ভি টি স্টেশনে যুক্তিবাদী সমিতির বিধান নিয়োগী ছিলেন। বিধানের বাড়ি রাত্রিবাস করে পরের দিন সকাল বেলায় দাদার থেকে পুনের বাস ধরলাম। পুণে পৌঁছতে লাগল পাক্কা পৌনে পাঁচ ঘণ্টা। সন্ধে ছটার আগে বারামতি যাওয়ার বাস নেই। অতএব তারই টিকিট কেটে হাতের ঘণ্টা দু’য়েক সময় খরচ করলুম একটা অটো রিকশয় শহর চষে। ছ’টার বাস ঠিক ছ’টাতেই ছাড়ল, অর্ধেক সিটের প্যাসেঞ্জার নিয়ে।

সময় নষ্ট না করে বারামতি শহরের ঠিক কোথায় মেঠাইবাবাকে পেতে পারি হদিশ পেতে বাসেই অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে দিলাম। মেঠাইবাবার ঠিকানা জানেন কি না, আমার পাশের সিটের সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করতেই পিছনের সিট থেকে উত্তর পেলাম, ‘গোরবাবার কাছে যাচ্ছেনঃ সরকার ?

বললাম, হ্যাঁ।

সহযাত্রীর পরিচয় পেলাম। বস তুলপুলে। থাকেন ‘গোরবাবা’ অর্থাৎ মেঠাইবাবার ক্ষেতির কাছে অবদূত নগরে।

বাস থেকে নেমে অটোরিকশ নিলাম। মিস্টার তুলপুলেকে তুলে নিলাম অটোতে।

শহরের প্রান্তে একটা ছোট মুদির দোকানের কাছে এসে তুলপুলে ড্রাইভারকে বললেন অটো থামাতে। ‘এখানেই আমার বাড়ি, তাই নামছি। আপনার সঙ্গে লোক দিয়ে দিচ্ছি, পৌঁছে দেবে।’ বলে তুলপুলে দোকানে দাঁড়ানো একটি তরুণকে বলেন, ‘ওঁরা সাংবাদিক। গোড়বাবা ভানুদাসের বাড়িটা ওঁদের দেখিয়ে দে।’

অটো ড্রাইভারের নাম বালু। আমাদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা যা হচ্ছিল তাই শুনেই বালু খুব উৎসাহিত হয়ে গল্প জুড়ে দিলেন। নতুন সঙ্গীটির নাম শরদ গাইকোয়াড়। শরদের মুখে সব সময় কথার খই ফুটছে। কলেজে পড়েন। জানালেন, এক সময় এই এলাকার বহু মানুষই চুরি, ছিনতাই, প্রতারণা এমনি নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল। বর্তমানে অবশ্য অবস্থা অনেক পাল্টেছে। ভানুদাস গাইকোয়াড় হঠাৎ প্রচুর নাম-টাম করেছে, অনেকে এসে ভিড় জমাচ্ছে, এটাতে শরদ উত্তেজনা অনুভব করেন, গর্বও হয়। কিন্তু এই হঠাৎ করে গোড়বাবা হয়ে ওঠার পিছনে ‘চমৎকার’ বা অলৌকিক ক্ষমতার বদলে কোনও গভীর ধান্ধা আছে বলে শরদ সন্দেহ করেন। ভানুদাসের পরিবারের অতীত নিয়ে শরদের শ্রদ্ধার যথেষ্ট অভাব যে আছে, তা ওঁর কথায় স্পষ্ট হয়ে উঠছিল বারবার।

ভানুদাস গাইকোয়াড়ের খেতের সামনে যখন পৌঁছলাম, তখন রাত সাড়ে ন’টা। শক্ত পাথুরে রাস্তায় অটো রেখে আমরা এগোলাম। চষে ফেলা বিশাল খেতের মাঝখানে একটা ছোট বাড়ি। ঘরে ও ঘরের বাইরে ইলেকট্রিকের আলো। বাইরের আলোটা জ্বলছে একটা ন-দশ ফুট উঁচু বাঁশের মাথায়। একটা খাটিয়ায় দু-একটি মানুষের ছায়া, দু-একজন আলোর সামনে ঘোরাঘুরি করছেন। এতদূর থেকে ঠিক দৃষ্টি চলে না। যে রাস্তায় অটোরিকশ দাঁড় করিয়েছি, তার আশেপাশে কোন আলোর পোস্ট নেই। শরদ বললেন, ‘ভানুদাস আছে কি না জিজ্ঞেস করছি হাঁক পেড়ে ।

বললাম, আপনাকে হাঁকা-হাঁকি করতে হবে না। এতদূর যখন এসেছি তখন ভানুদাসকে না পেলেও ওঁর বাড়ি না দেখে, ওঁর পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা না বলে আমরা যাচ্ছি না।’ তবু হাঁক পাড়লেন শরদ, ‘ভানুদাস বাড়ি আছে? আমরা খেত ভেঙে এগোচ্ছিলুম। তারই মাঝে উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছিলেন শারদ। এক সময় সাড়া পাওয়া গেল, ‘আছি। তোমরা কে?” ‘আমি শরদ। কলকাতা থেকে সাংবাদিকরা এসেছেন তোমার অলৌকিক ক্ষমতা দেখতে।’ আমরা খেত ভেঙে এগোচ্ছি। ছায়া-ছায়া মানুষগুলো নড়া-চড়া করছে, ঘরে ঢুকল কেউ কেউ । বেরিয়েও এল এক সময়। শরদ যাঁকে ভানুদাস বলে পরিচয় করালেন, তাঁর শরীর ও পোশাকের ওপর একবার চোখ বোলালুম। সদ্য পাট ভাঙা দুধ-সাদা টেরিনের প্যান্ট ও ধবদবে সাদা স্যন্ডো গেঞ্জি। গায়ের রঙ কালো। সুঠাম মতোই চেহারা। ঘন কালো তৈল চিক্কন চুল। খুদে খুদে চোখ দুটোর তীক্ষ্ণতা ও সতর্কতা আমাকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য করল—ভানুদাসকে ‘ভোলা ভালা আনপড়’ কিষান ভাবলে এক ফুৎকারে উড়ে যাব। টেপরেকর্ডার চালু করে ভানুদাসের মুখের সামনে ধরে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার নাম?’

—ভানুদাস মারুতি গাইকোয়াড়, গোড়বাবা।

-বয়স ?

—একত্রিশ বছর। হিন্দি বলতে আমার একটু অসুবিধে হয়। মারাঠি ভাষায় বললে চলবে ? বিধানের মারাঠি ভাষায় জ্ঞান বাংলার মতই সাবলীল। বললাম, হ্যাঁ চলবে।

এমন একটা ভাষাগত সমস্যা হতে পারে অনুমান করে বিধানের হাতে একটা প্রশ্ন তালিকা ধরিয়ে দিয়েছিলাম পুণে থেকে বারামতি আসার পথেই ।

প্রশ্ন শুরু করলেন বিধান, বাবার নাম?

—মারুতি সমঝ গাইকোয়াড়।

—মায়ের নাম ?

—সত্যভামা মারুতি গাইকোয়াড়।

—আপনার পোস্টাল অ্যাড্রেস ?

—ফল্টন রোড, কাসবা, পোস্ট – বারামতি, জেলা –

পুণে।

–আপনি যে কোনও জিনিসে হাত লাগালে তা মিষ্টি হয়?

—হ্যাঁ, তা হয়।

–এই সময় আমি কিছু ছবি তুলে নিলাম মেঠাইাবাবা, তাঁর স্ত্রী, ছেলে মেয়ে এবং মায়ের। বিধান আবার প্রশ্ন শুরু করলেন, আপনার কাছে রোগীরা রোগ সারাতে আসে? —হ্যাঁ, অনেকেই আসে।

রোগীদের আপনি নিরোগ করতে পারেন ?

—কেউ যদি মনে আশা নিয়ে আসে, তবে আমি রোগীর শরীরে হাত বুলিয়ে দিলে ভাল হয়ে যায়।

–কবে থেকে আপনি এমন ক্ষমতা পেলেন?

—১৯৮১ সাল থেকে এই অবস্থা হচ্ছে।

—বিয়ে করেছেন কত বছর?

—দশ বছর।

-ছেলে-মেয়ে ক’টি?

–এক মেয়ে, দুই ছেলে।

—সংসার চলে কিভাবে?

—ক্ষেতি আছে। চাষ-বাস করি। তাতেই সংসার চলে।

—যারা রোগ সারাতে আসে, তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা কিছু নেন?

—কোনও লোকের কাছ থেকেই পয়সা নিই না।

–পত্রিকার লোকেরা এই নিয়ে কতবার এলেন?

–অত মনে নেই। তবে, পত্রিকার লোকেরা বেশ কয়েকবার এসেছে। ‘চিত্রলেখা’ গুজরাটি ও মারাঠি দুটো ভাষায় বের হয়। দু’ভাষাতেই আমার সম্বন্ধে লিখেছে। এছাড়া ‘ইন্ডিয়া টু ডে’ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ ও আমার সম্বন্ধে লিখছে। বালা-সাহেব ঠাকরের (শিবসেনা প্রধান) সঙ্গে আমার ছবিও বেরিয়েছে ‘চিত্রলেখা’র মারাঠি সংস্করণে।

পত্রিকাগুলো দেখতে চাইলাম আমি। ওঁর বউ ঘর থেকে সেগুলো এনে দেখালেন। বিধান আবার প্রশ্ন শুরু করলেন, আপনার জন্মস্থান কোথায় ?

পুণে জেলার কারোটিতে।

দূরদর্শনের অনুষ্ঠানে কখনও অংশ নিয়েছেন?

না।

বললাম, জলে হাত ধুয়ে মিষ্টি করে দেখাবেন? ঘরের বাইরের উঠোনে একটা চৌবাচ্চার ভেতর মগ ডুবিয়ে জল তুললেন মেঠাইবাবা। মগের জল থেকে কয়েক ফোঁটা তুলে জিভে ঠেকালাম। সাদা জল। মেঠাইবাবা মর্গের জলে বার কয়েক হাত ঘষলেন। তারপর বললেন, ‘এই জল নিয়ে জিভে রাখ।’ রাখলাম। আমরা অনেকেই রাখলাম, আমি, বিধান। জল মিষ্টি হয়ে গেছে। আমরা বোম্বাই থেকেই লঙ্কা নিয়ে গিয়েছিলাম। লঙ্কাগুলো কলকাতার লঙ্কার তুলনায় খুবই নরম-ঝালের। একটা লঙ্কা মেঠাইবাবার হাতে তুলে দিলাম। মেঠাইবাবা লঙ্কায় বারকয়েক হাতের আঙুল ঘষলেন। তারপর আমার হাতে ফেরত দিয়ে বলেন, ‘দেখুন, মিষ্টি হয়ে গেছে। লঙ্কা চেটে দেখলাম, কড়া মিষ্টি, লঙ্কায় কামড় বসাতেই বুঝলাম লঙ্কা যেমন ঝাল ছিল, তেমনই আছে।

কয়েকজনকে লঙ্কায় কামড় বসিয়ে পরীক্ষা করতে বললাম। প্রত্যেকেই সহমত হলেন—লঙ্কা ঝালই রয়েছে। এবার মেঠাইবাবা আর একটা লঙ্কা চেয়ে নিয়ে সেটা ভেঙে তার শাঁসের ওপর হাতের আঙুল ঘষলেন বার কয়েক। তারপর লঙ্কাটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন, ‘এটা আগে মিষ্টি ও পরে ঝাল লাগবে।’ আমি ও বিধান দুজনে লঙ্কাটি ছিঁড়ে স্বাদ পরীক্ষায় রত হলাম। ও হরি, এ যে সামান্যক্ষণ মিষ্টি লাগার পরে, জিভের জলের ধাক্কাতেই মিষ্টত্ব বিদায় নিয়ে আবার ঝাল হয়ে গেল। মেঠাইবাবার শরীরের বিভিন্ন অংশে জিভ ঠেকালাম। কিন্তু প্রতিটি প্রতিবেদনে যা পড়েছি, তেমনটি তো নয়! মিষ্টি শুধু দু’হাতের আঙুল থেকে কনুই পর্যন্ত। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার সারা শরীরই মিষ্টি থাকে বলে পত্রিকাগুলোয় পড়েছি, তাই তো? মেঠাই বাবা বললেন, ‘হ্যাঁ’।

—তবে এখন কেন শুধু আঙুল থেকে কনুই পর্যন্ত মিষ্টি?

–সে আমি বলতে পারব না। মেঠাইবাবার জবাব।

একটা নিম সাবান নিয়ে গিয়েছিলাম। মেঠাইবাবার হাত ধোয়ার জন্যেই। সেটা বার করে বললাম, এটা দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন। মেঠাইবাবা দু’পা ফাঁক করে দাঁড়ালেন। হাতে নিম সাবান আমি জল ঢেলে দিতে লাগলাম। মেঠাইবাবা দু’হাত কচলে সাবান মাখলেন হাতে। সাবানটা ছুড়ে ফেললেন মাটিতে। তারপর আমার ঢালা শেষ জলটুকুতে হাতের তালু দুটি ধুয়ে দু-হাতের তালুই টেনে নিয়ে গেলেন দুই কনুই অবধি। ভেজা হাতের তালুতে কনুইতে লাগিয়ে রাখা মিষ্টি ছড়িয়ে পড়েছে বুঝতে পেরে আবার সাবানটা এগিয়ে দিয়ে হাতের তালুতে ঘষতে বললাম, মেঠাইবাবা আবার একইভাবে সাবান ঘষলেন। সাবান ছুড়লেন এবং জল দিয়ে হাতে ধোয়ার পর আবার দু’হাতের তালুই টেনে নিয়ে গেলেন প্রায় কনুই পর্যন্ত। ব্যাপারটা এমন সহজ সরল ও স্বাভাবিকভাবে ঘটাচ্ছিলেন যে, অন্য কারোরই একবারের জন্যেও মনে কোনও রকম সন্দেহের রেখা দেখা যাচ্ছিল না। আবারও সাবানে হাত ধুতে বললাম। এবং বললাম, আপনি হাত ধুয়ে কখনই হাতের তালু দুটো ওপরে তুলবেন না। আমার নির্দেশমতোই হাত ধুলেন এবার। এগিয়ে দিলাম একটা লঙ্কা । লঙ্কাটা ভেঙে ভিতরের শাঁসে বার দশেক ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা ঘষলেন ৷ লঙ্কাটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘এবার খেয়ে দেখ।’ লঙ্কার শাঁস চাটলাম। মিষ্টি নেই। উপস্থিত আরও কয়েকজনকে লঙ্কার স্বাদ গ্রহণ করে মতামত দিতে বললাম। তাঁরাও মতামত জানালেন—মিষ্টি লাগছে না। তাঁদের মতামতের সঙ্গে নাম, ঠিকানা ও পেশা জেনে নিয়ে ক্যাসেটবন্দি করলাম। মেঠাইবাবার মা অবশ্য মত প্রকাশ করলেন, ‘মিষ্টি আছে।’ ওঁর মত জানার সঙ্গে সঙ্গে আবার এই বিষয়ে কয়েকজনের মতামত গ্রহণ করি। তাঁরা আবারও জানালেন, ‘একটুও মিষ্টি লাগছে না। মেঠাইবাবার কাছে এগিয়ে দিলাম একটা স্টিলের ঘটি। মিষ্টি বাবা হাতে তালুতে বার বার ঘটি ঘষলেন কিন্তু মিষ্টি হল না। মেঠাইবাবাকে কেমন একটু অসহায় লাগছিল। মেঠাইবাবা বললেন, ‘জল দাও, দেখ এক্ষুনি মিষ্টি করে দিচ্ছি। এক ঘটি জল দিলাম। মেঠাইবাবা ঘটির জলে আঙুল ডুবিয়ে কিছুক্ষণ কচলালেন। তারপর বললেন, ‘এবার দেখ’। আমরা জনে জনে জল তুলে মুখে দিলাম। মিষ্টি নেই। মেঠাইবাবা দক্ষ জাদুকরের মতই অস্বস্তিকর অবস্থাটাকে সামাল দিতে চাইলেন। বলেন, ‘আমার মিষ্টি করার ক্ষমতা থাকে সকাল থেকে সন্ধে ছ’টা পর্যন্ত। তাই এখন মিষ্টি হচ্ছে না।’ মেঠাইবাবার মা সত্যভামা ছেলেকে এমনভাবে নাস্তানাবুদ হতে দেখে আমাদের ওপর রেগে আগুন হলেন। যথেষ্ট চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন ‘সন্ধে ছ’টার পর আমার ছেলের মিষ্টি করার ক্ষমতা থাকে না। তোমরা গোলমাল পাকাতে এসেছ কেন?” বললাম, ‘তাহলে আপনার ছেলে এতক্ষণ জল থেকে লঙ্কা হাতের ছোঁয়ায় মিষ্টি করল কি করে ?

উত্তর দেওয়ার কিছুই ছিল না। সুতরাং আমার উদ্দেশে প্রবল বেগে প্রচুর গালি পাড়তে লাগলেন সত্যভামা।

সত্যানুসন্ধানে কৃতকার্য হতে গেলে সেন্টিমেন্টাল হলে চলে না। অতএব ওইসব গালাগাল আমার মস্তিষ্ককোষে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছিল না।

এইসব গোলমালের মধ্যে ভানুদাস হঠাৎই গর্জন করে আমার দিকে তেড়ে এলেন। বললেন, ‘এই দেখ, আবার আমার মধ্যে মিষ্টি করার ক্ষমতা ফিরে এসেছে।’

আমার ঘড়ির কাচে ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা ঘষে দিয়ে বললেন, ‘চেটে দেখো।’ দেখলাম। সত্যিই মিষ্টি হয়ে গেছে। বললাম, ‘সত্যিই মিষ্টি হয়ে গেছে। তাতে এটাই কিন্তু প্রমাণ হলো তোমরা মিথ্যে কথা বলো, এবং তা একটু বেশি মাত্রাতেই। সন্ধে ছ’টার পর তোমার মিষ্টি করার ক্ষমতা থাকে না বলে জানালে। তবে এত রাতে তুমি মিষ্টি করলে কি করে ?

গোড়বাবা মস্তানের মত তেরিয়া গলায় বললেন, ‘তোমার ফালতু কথার জবাব দিতে চাই না। তোমার সন্দেহের জবাবে আবার প্রমাণ করলাম আমার মিষ্টি করার অলৌকিক ক্ষমতা আছে । তোমার বিজ্ঞান কোনওভাবেই আমার ক্ষমতাকে অস্বীকার করতে পারবে না।’

তারপরই নাটকীয়ভাবে আমাদের আশেপাশের শ্রোতা ও দর্শকদের কলম, ঘড়ি, চশমা হাতের পরশে মিষ্টি করতে শুরু করল। জনতা গোড়বাবার ক্ষমতায় হতচকিত। একটু আগে আমার হাজির করা যুক্তি ম্যাজিক-আবেগের চোরাবালুতে ডুবতে শুরু করেছে। আর সময় দিলে গোটা ব্যাপারটাই নাগালের বাইরে চলে যাবে। পকেট থেকে বের করলাম অ্যাবসিলিউট আলকহলের শিশি। অ্যালকহলে ওর আঙুলগুলো ভাল করে ধুইয়ে দিলাম। সঙ্গে ধুয়ে গেল ওঁর আঙুলে লেগে থাকা মিষ্টি করার রাসায়নিক পদার্থ। তুলোয় অ্যালকহল ঢেলে সেই তুলো দিয়ে ঘসে ঘসে মুছলাম ওর আঙুলগুলো। এবার উপস্থিত সকলের উদ্দেশে বললাম, ‘আপনারা একে একে আসুন। ওর আঙুলে জিব ঠেকিয়ে দেখুন, মিষ্টি লাগছে কি না?

আমি মিঠেবাবার ডান হাতের কব্জিটা ধরে আছি। বিভিন্ন মানুষ এগিয়ে এসে আঙুলে জিব ঠেকিয়ে জানিয়ে যাচ্ছেন, মিষ্টি নেই। আমি তাঁদের মতামত নাম ঠিকানাসহ জানতে চাইছি। আমাদের কথোপকথন ক্যাসেট বন্দি করে রাখছিলেন বিধান। মেঠাইবাবার মধ্যে আবার আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখতে পেলাম।

‘এমন ধরনের হঠাৎ হঠাৎ হাত মিষ্টি হচ্ছে আবার হচ্ছে না কেন বলুন তো?’

‘তার আমি কি জানি।’ আমার প্রশ্নের উত্তরে মিঠেবাবার তেড়িয়া জবাব।

‘আগে কোনও সাংবাদিকদের সামনে আপনার শরীর এমন অদ্ভুত ব্যবহার করেছে।’ ‘না।’

‘আজই প্রথম করল?’

‘সবটাই কেমন রহস্য তাই না? শরীরের কিছুটা অংশ মিষ্টি তাও আবার মাঝে মাঝে থাকছে না কেন বলুন না ভাই?’

খেপে উঠলেন মেঠাইবাবা, ‘আমি জানি না। অনেক ডাক্তার দেখেছে, তারাও কারণ বের করতে পারছে না।’

‘কোন কারণটা বের করতে পারছেন না? আপনার শরীর কেন মিষ্টি? নাকি, আপনার গোটা শরীরের মধ্যে দুই কনুই থেকে হাতের আঙুল পর্যন্ত শুধু মিষ্টি কেন? নাকি, হাত ঠিক-ঠিক ধুয়ে-মুছে দিলে মিষ্টি কেন পালিয়ে যায় ?”

আমার কথায় মজা পাচ্ছেন জনা পনেরো মানুষ, যারা মিঠেবাবার পরিবারের কেউ নয়। ওরা হাসছে, টিপ্পনি কাটছে। ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘গোড়বাবার ভাণ্ডা ফোড় ।’ আমার ওপরই খেপে উঠলেন মেঠাইবাবা, ‘সমস্ত পত্রকাররা আমার চমৎকারকে সম্মান জানিয়েছেন। শুধুমাত্র তুমি আমাকে অসম্মান করলে। এর পরিণাম খুব খারাপ হবে।’

মেঠাইবাবার মেজাজ ঠাণ্ডা করতে বিধান কথা ঘোরালেন।

–কবে থেকে আপনি জানতে পারলেন, আপনার ছোঁয়া পেলেই সব মিষ্টি হয়ে যাচ্ছে? —’৮১ সালের ঘটনা। দিনের বেলায় শুয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে যেখানেই হাত দিতে শুরু করলাম, মিষ্টি লাগতে লাগল। জল খাচ্ছি, সবই মিষ্টি লাগছে, রুটি খাচ্ছি, তাও মিষ্টি। —সেদিন দুপুর বেলায় যখন ঘুমিয়ে ছিলেন, তখন কোনও স্বপ্ন দেখেছিলেন কী? জিজ্ঞেস করলাম।

—না স্বপ্ন কিছু দেখিনি।

—আপনার হাতই শুধু মিষ্টি ?

–না, না, আমার সারা শরীরই মিষ্টি। অনেকেই পরীক্ষা করে দেখেছে। —গোড়বাবা (গুড়বাবা) নামটা কে দিল?

-পেপারওয়ালারা ।

মেঠাইবাবার মা তখনও গজগজ করছিলেন, ‘তোমরা ঝামেলা পাকাতে এসেছ। মনে রেখ, ও অলৌকিক শক্তির অধিকারী। ওকে মারবে এমন শক্তি কারও নেই। ওর ক্ষতির চেষ্টা করলে..।’ কথা শেষ করতে পারলেন না। ক্ষেত ভেঙে দু’টো বিশাল মোটরবাহক গুরুগম্ভীর আওয়াজ তুলে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল। সত্যভামা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ওর ডাক্তার আসছে। ছবি তুলতে যেতেই তীব্রভাবে বাধা দিলেন দু’জনেই। মোটরবাহক আরোহী দু’জনই বয়সে তরুণ। বয়স বছর পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি হবে। প্রথমেই যিনি আমার মুখোমুখি হলেন, তাঁর উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির মত। তিনি কিছু প্রশ্ন করার আগেই টেপ রেকর্ডারটা তাঁর মুখের কাছে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার নাম?’

—ডাক্তার আটোডে কে. বি। বারামতিতে এগার বছর ধরে প্র্যাকটিস করছি অ্যালোপ্যাথি ও আয়ুর্বেদ।

–মেঠাইবাবা কি আপনার অধীনে চিকিৎসাধীন আছেন ?

—এগার বছর ধরেই ভানুদাসজি আমার চিকিৎসায় আছেন। কিন্তু আমি কিছুতেই সমতায় আনতে পারছি না। আমার দৃঢ় ধারণা এটা ‘মিরাকেল’।

—এমনটা কেন মনে হল আপনার ?

—আমরা এটাকে বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারছি না। যার জন্যেই মনে হচ্ছে এটা একটা স্পিরিচুয়াল ব্যাপার।

–আপনার ক্লিনিকের ঠিকানা?

—ডাক্তার আটোডে কে. বি. করলা ক্লিনিক, ইন্দাপুর চক, বারামতি। জেলা-পুণে। পিন-৪১৩১০২

এবার অন্য মোটরবাহক-আরোহীর কাছে এগিয়ে দিলাম টেপরেকর্ডার। আপনার নাম? —ডাক্তার সোনে জাক্‌তা।

—মেঠাইবাবার এই অদ্ভুত ক্ষমতা সম্বন্ধে আপনর কী ধারণা ?

–যা ডাক্তার আটোডে বললেন, তার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ সহমত । —আপনার নগর, পোস্ট-বারামতি, জেলা- পুণে।

—আপনি কি আয়ুর্বেদ কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করেছেন ?

—হ্যাঁ। আমি ও ডাক্তার আটোডে দু’জনেই আয়ুর্বেদ কলেজ থেকে বি এম এস পাস করেছি।

—আপনি তো তবে গাছ-গাছড়ার নানা চরিত্র, নানা গুণ এবং অদ্ভুত সব ফলাফল সম্পর্কে ভালমতই ওয়াকিবহাল। আপনার কি একবারের জন্যেও মনে হয়নি কোনও গাছ-গাছড়ার সাহায্যে ভানুদাস মেঠাইবাবা সেজে বসতে পারেন ?

—দশ বছর ধরে আমি ডাক্তার আটোডের সঙ্গে ওকে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে আসছি। আমার একবারের জন্যেও তা মনে হয়নি। আমিও এর পেছনে বিজ্ঞানসম্মত কোনও কারণ খুঁজে পাইনি। আমার মনে হয় ও একজন সিদ্ধপুরুষ। মনে রাখবেন, অনেক রোগীও কিন্তু বিশ্বাস নিয়ে মেঠাইবাবার কাছে এলে মেঠাইবাবার হাতের ছোঁয়ায় রোগমুক্তও হন।

মেঠাইবাবা লঙ্কা ভেঙে শেষবারের মত লড়াই জেতার জন্য লঙ্কায় অনেকক্ষণ হাত ঘষলেন। লঙ্কাটা আমার হাতে দিতে সেটা আটোডের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘এখন লঙ্কা মিষ্টি লাগছে কি?”

——না মিষ্টি লাগছে না।’ ডাক্তার আটোডের এই উত্তর শুনে তাঁর কাছে অভিযোগ করার মত করে মেঠাইবাবা বললেন, ‘ওরা কি দিয়ে আমার হাত ধুইয়ে দিল। তার পরই আর কিছু মিষ্টি করতে পারছি না।’ মেঠাইবাবার কথা শুনে ডাক্তার আটোডে প্রচণ্ডরকম ঘাবড়ে গেলেন। অনেক আন্তা করে বললেন, ‘এর আগে আমরা এবং অনেক সাংবাদিকরাই বারবার ওর হাত সাবান দিয়ে ধুইয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি। ওর শরীরের মিষ্টি কিছু মাখানো থাকলে ধরা পড়তই । কিন্তু এখন কেন এমনটা হচ্ছে? ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে এগারো বছরে এই প্রথম দেখলাম ওর শরীরের স্বাভাবিক মিষ্টত্ব চলে গেছে। ঠিক এই অবস্থায় ওর শারীরিক অবস্থার একটা ‘থরো চেক-আপ’-এর প্রয়োজন ছিল।’ ডাক্তার আটোডে এবার মেঠাইবাবাকে বললেন, ‘আপনি একবার ঘরে চলুন। এই অবস্থায় আপনার হার্ট নর্মাল বিহেভ করছে কি না একবার দেখা খুবই জরুরি।’

দু’মিনিটের মধ্যেই মেঠাইবাবা ও ডাক্তার আটোডে বেরিয়ে এলেন। আমি ডাক্তার আটোডেকে বললাম, ‘মেঠাইবাবার নাড়ি-নক্ষত্র তো আপনার জানা। আপনি কি এমন কখনও দেখেছেন দিনবা রাতের কোনও বিশেষ সময়ে ওঁর শরীর মিষ্টত্ব হারায়?’

-না, তেমন কখনও ঘটেনি।

কিন্তু আজই তেমনটা ঘটেছে। সাক্ষী এখানে হাজির সকলেই। ও হাতের ছোঁয়ায় এখন কোনও কিছুই মিষ্টি করতে পারছেন না। এমনটা না পারার কারণ হিসেব ভানুদাস বললেন—সন্ধের পর নাকি ওঁর মিষ্টি করার ক্ষমতা থাকে না। আর আপনি বলছেন রাতেও মিষ্টি করার ক্ষমতা ওঁর আছে। আপনার এই সুচিন্তিত মতামত নিশ্চয়ই ভানুদাসের ওপর দীর্ঘ পরীক্ষার পরই দিয়েছেন। আজ ভানুদাস আমাদের কাছে পরীক্ষায় কেন বারবার ফেল করছেন?

–এই তো প্রথম ফেল করল। কেন ফেল করল, পরীক্ষা না করে জানাই কি করে?

—আপনি ওঁর শরীর পরীক্ষা করে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করলেন?

—হার্ট-বিট একটু বেশি হচ্ছে। সম্ভবত আপনাদের উল্টোপাল্টা প্রশ্নে নার্ভাস হয়ে এমনটা হয়েছে।

মেঠাইবাবা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আরে দেখ, দেখ আমার আঙুলে জিভ ঠেকিয়ে দেখ, দারুণ মিষ্টি হয়ে গেছে।’

ডাক্তার আটোডে মেঠাইবাবার আঙুলে জিভ ঠেকিয়ে আমাকে বললেন, ‘দেখুন চেটে।’ দেখার বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে ধীর, গম্ভীর, শীতল গলায় বললাম, এখন যে মিষ্টি হবে এ আমি জানি। একটু আগেই মেঠাইবাবা বলেছেন—সন্ধে ছ’টার পর নাকি ওঁর শরীর মিষ্টি থাকে না । তাহলে এখন আবার মিষ্টি হচ্ছে কেন?’ ডাক্তর আটোডে আমার কথায় প্রচণ্ড রকম খেপে গিয়ে বললেন, ‘আপনাদের কোনও কথার উত্তর দেওয়ার আগে জানতে চাই আপনি কে?’ আমার একটা ভিজিটিং কার্ড ওঁর হাতে দিলাম। বার কয়েক মনোযোগ দিয়ে কার্ডে চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘ও আপনিই র‍্যাশনলিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রবীর ঘোষ? কিন্তু আমি যে শুনলাম সাংবাদিকরা এসেছেন ইন্টারভিউ নিতে! আপনি প্লিজ টেপটা বন্ধ করুন।’ আমাদের অবস্থাটা তখন সপ্তরথী ঘেরা অভিমন্যুর মতই। উপস্থিত কারও হাবভাবই তেমন সুবিধের ঠেকছে না। আটোডের ‘প্লিজ’ কথাটাও বেরিয়ে এসেছে তীব্র ধমক হয়ে। টেপ বন্ধ করলাম। ‘আপনি পরিচয় গোপন করেছেন কেন?” আটোডে ‘চার্জ’ করলেন। আমি বললাম, পরিচয় তো গোপন করিনি। কলকাতার ‘আজকাল’ পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবেই এসেছি। এরপর আরও এমন অনেক কথাই তিনি বলেছেন যা ক্যাসেটবন্দি নেই বলে এখানে হাজির করলাম না। তবে এটুকু বলতেই পারি, কথাগুলোর মধ্যে ছিল প্রচ্ছন্ন হুমকি, ভীতি প্রদর্শনের সুর। এর পরই আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তীব্র মিষ্টি সৃষ্টি করার মত গাছের খবর আমার জানা আছে কি না। এবার টেপরেকর্ডার চালু করেই বলেছিলাম, ‘গত সপ্তাহেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম হদিস করতে। ভারতের বিশিষ্ট রসায়ন বিজ্ঞানী ডঃ অসীমা চ্যাটার্জি বেশ কয়েক ঘণ্টা ব্যয় করে এই বিষয়ে বহু তথ্য হাজির করেছিলেন। ডালসিটল (Dulcitol) স্টেভিওসাই (Stevioside) এর মত অনেক ‘প্ল্যান্ট প্রোডাক্ট’-এর খবর পেয়েছি মার্ক ইনডেক্স-এর টেনথ এডিশন থেকে। এ-সবেরই মিষ্টত্ব চিনির থেকে ৩০০ গুণ বেশি। এই গাছের সাক্ষাৎ কলকাতায় কোথায় পাওয়া যাবে, তার হদিসও উনিই দিয়েছিলেন।’

‘আপনি যে সব গাছের কথা বলেন, সেসব গাছের কথা ওঁর মত আনপড় জানবে কী করে?” ডাক্তার আটোডে প্রতিপ্রশ্ন ছুড়লেন। ‘কী করে জানবে, সেটা কোনও প্রশ্নই এখানে হতে পারে না। এ-ধরনের বহু গাছের বাস্তব অস্তিত্ব যখন আছে, আমাদের দেশেই আছে এবং তার খোঁজ অনেক রসায়ন বিজ্ঞানী, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসকদের অজানা নয়, তখন এই গাছে খোঁজ পাওয়ার সম্ভাবনা মেঠাইবাবার ক্ষেত্রে থেকেই যাচ্ছে। হয় কেউ জানিয়েছে, অথবা হঠাৎই জেনে ফেলেছেন ‘

ডাক্তার আটোডে বললেন, ‘কিন্তু ওঁর ক্ষেত্রে এর কোনওটাই হয়নি।’ বললাম, ‘আপনি আগেই জানিয়েছেন ভানুদাসের এমন অদ্ভুত ক্ষমতার রহস্য জানতে, সত্য জানতে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘ বছর ধরে। সত্য জানতে গেলে খোলা মনের হতে হয়। আগের থেকেই যদি সিদ্ধান্তে পৌঁছেই থাকেন, তবে সত্য কোনওদিনই ধরা দেবে না। ওর শরীর স্বয়ং মিষ্টির আধার নয়। ও শরীরে তীব্র মিষ্টি মেখে রাখে বলেই সেই তীব্র মিষ্টির সংস্পর্শে এসে বিভিন্ন বস্তু মিষ্টি হয়ে যায়। আর তাই মিষ্টির শত্রু তেতো সাবান দিয়ে হাত ধোয়ালেই মিষ্টি করার ক্ষমতা বিদায় নিচ্ছে। শরীরে তাও যেটুকু মিষ্টি থাকে, তাও দূর করা যায় অ্যাবসলিউট অ্যালকহল, স্পিরিট জাতীয় কোনও কিছু দিয়ে ভাল মত ঘষে। এখন ও যে আবার মিষ্টি করার ক্ষমতা ফিরে পেল, এই ক্ষমতা এক্ষুনি বন্ধ করে দিতে পারি ওই একই পদ্ধতিতে। বাস্তবিকই আপনাদের সত্য জানার আগ্রহ থাকলে আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন।’

ডাক্তার আটোডে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমার বক্তব্যকে এড়িয়ে গিয়ে বললেন, ‘এখন যদি ও জল মিষ্টি করে দেয়, কি বলবেন?’ বললাম, ‘ঠিক মত হাত ধুইয়ে দিলেই ও কোনও ভাবেই মিষ্টি করতে পারবে না। ঠিক আছে আপনি জল আনুন, মার্গো সোপ ও অ্যালকহল দিয়ে আমি ওর হাত সাফ্ করে দিচ্ছি। এরপর আপনারা প্রত্যেকেই দেখুন কী হয় ?

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনার ও-সব পরীক্ষা দেখতে চাই না। টেপ্‌টা বন্ধ করুন।’ বললেন ডাক্তার আটোডে। টেপ বন্ধ হল। জল এল ঘটিতে। মেঠাইবাবা জলে হাত ডোবালেন। তারপর নিজের মুখে কিছুটা জল ঢেলে মেঠাইবাবা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এখন মিষ্টি হয়ে গেছে।’ বললাম, ‘দেখার কিছু প্রয়োজন নেই। আমি জানি কী করে এটা হচ্ছে।’ দুই ডাক্তার, মেঠাইবাবা ও কয়েকজন দাবি জানালেন, ‘আপনাদের জল খেলেই হবে এবং জানাতে হবে মিষ্টি লাগছে কী না। যতক্ষণ না জানাচ্ছেন, আপনাদের ছাড়াই হবে না।’

বললাম, ‘খুব ভুল করছেন। আমাদের আজ এখানে আসার খবর পত্রিকা ও আপনাদের বারামতি থানার জানা আছে।’ আমরা রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যে বারামতি থানায় হাজির না হলে ওঁরাই এখানে এসে হাজির হবেন, এমনটাই কথা আছে। এখন সাড়ে দশটা বাজে। আজকের মত বরং বিদায় নিই। কাল দশ-এগারটা নাগাদ আমরা আসব, আবার পরীক্ষা নেব।’

ডাক্তার আটোডে আমাদের অটোরিকশর ড্রাইভার বালুকে বললেন, ‘তুমি ওঁদের হোটেলে ঢুকিয়ে আমাকে খবর দিও, কোন হোটেলে আছেন। সকালে আমরাই ওঁদের হোটেল থেকে তুলে নেব।’ এবার অটোয় ফিরে চললাম। আমাদের সঙ্গী হলেন শরদ গাইকোয়ড়।

শরদ শঙ্কা প্রকাশ করলেন, ওঁদের ওপর হামলা হবে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কারা হামলা করবে?’ শরদ হঠাৎই মুখ বন্ধ করলেন।

ভোর হওয়ার আগেই আমরা থানায় হাজির হয়েছি। ওরা হোটেল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার আগেই থানায় গিয়ে সাহায্য চেয়েছি। বলেছি, ‘আপনাদের সামনেই প্রমাণ করে দেব ভানুদাস স্রেফ একজন প্রতারক। তাকে প্রতারণায় সক্রিয়ভাবে সাহায্য করছে ডাক্তার আটোডে ও ডাক্তার সোনি জাক্তা। কাল ওরা আমাদের জোর খাটিয়ে ভানুদাসকে অলৌকিক ক্ষমতাধর বলে সার্টিফাই করাতে চাইছিলেন। আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকুন একটি প্রতারণা ধরতে। আপনাদের সাহায্য ছাড়া বুজরুকি ধরতে গেলে প্রাণহানির আশঙ্কা আছে। কাল রাতেই একবার বুজরুকি ধরেছি। এখন ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে আপনাদের সামনে ওদের প্রতারণা হাতে-নাতে প্রমাণ করতে চাই।’

ডিউটি অফিসার হাই তুলতে তুলতে আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দিয়ে বললেন, ‘ভানুদাসজি আমাদের বারামতির গর্ব। ওর বিরুদ্ধে কিছু করা মানে পাবলিক সেন্টিমেন্টে আঘাত করা। তাছাড়া ভানুদাসজির পেছনে বড় রাজনীতিকদের সাপোর্ট আছে। আপনারা পত্রকার বাঙাল মুল্লুক থেকে এসেছেন, আপনাদের ভালোর জন্যেই বলছি, ভোরের বাস ধরে পুণে চলে যান।’ যুক্তির মুখে হেরে যাওয়ার মুহূর্তে প্রতিটি অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারকেই দেখেছি গায়ের

জোর ও ভীতিপ্রদর্শনের পথ বেছে নিতে। এদের সঙ্গে পুলিশ ও রাজনৈতিক আঁতাত এক অনিবার্য অনুযঙ্গ। ফর্মুলাটা প্রায় একই রকম সব সময়ে।

১২ জুলাই ১৯৯২ আজকাল পত্রিকার ‘রবিবাসর’ পাতায় দু-পৃষ্ঠা জুড়ে প্রকাশিত হল ‘মেঠাইবাবার রহস্যভেদ’।

১৯৯৬-এর গোড়ায় গোড়বাবা আবার সংবাদপত্রের শিরোনামে এলেন। মহারাষ্ট্রের ‘অন্ধ বিশ্বাস নির্মূলন সমিতি’ নাকি পাঁচ লক্ষ টাকা চ্যালেঞ্জ করে চ্যালেঞ্জ হেরেছে। খবরটা কলকাতার ‘Asian Age’-এর প্রথম পৃষ্ঠাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। সঙ্গে ছিল গোড়বাবা ভানুদাসের ছবি।

ফোন পেলাম দুই সাংবাদিক অদিতি রায়ঘটক ও অভিজিৎ দাশগুপ্তের। তাঁরা জানতে চাইলেন, গোড়বাবার চ্যালেঞ্জ নিতে রাজি আকি কি না। থাকলে লিখে জানাতে। লিখেই-দু-জনকে জানালাম, বাড়তি জানালাম Asian Age-এর নিউজ এডিটর দিব্যজ্যেতি বসু’কে। জানালাম বোম্বাই বা দিল্লিতে ‘প্রেস কনফারেন্স’ ডেকে সাংবাদিকদের সামনে গোড়বাবার মুখোমুখি হতে চাই। হারলে দেব দেড় লক্ষ টাকা। প্রেস কনফারেন্স এবং দুই সঙ্গীসহ গোড়বাবার যাতায়াত ও হোটেল খরচ বহন করব। গোড়বাবা হারলে তাঁকে শুধু প্রেস কনফারেন্স এবং তাঁদের যাতায়াত ও থাকা খাওয়াবাবদ খরচগুলো ‘অন স্পট’ ফেরত দিতে হবে। এখন গোড়বাবা আমার মুখোমুখি হতে চাইলেই হয়।

গোড়বাবা আমার মুখোমুখি হওয়ার সাহস দেখাতে চাননি। আর একবার সাংবাদিকদের সামনে পরাজিত হওয়ার মতো বোকা নন বলেই মুখোমুখি হননি। তবে ওঁর জন্য পূর্ব শর্ত খোলা রাখলাম।

♦ কিছু কথা

প্রথম খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ মার্কিন গডম্যান মরিস সেরুলোঃ একটি ইতিহাস

অধ্যায়ঃ দুই

♦ যোগী-জ্যোতিষী হরেকৃষ্ণবাবা !

অধ্যায়ঃ তিন

♦ পঞ্চাশ বছর আগের বালক ব্রহ্মচারী এবং…

অধ্যায়ঃ চার

♦ মেঠাইবাবার রহস্যভেদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ হাড় ভাঙ্গার দৈব-চিকিৎসা

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ কাকদ্বীপের দৈব-পুকুর

অধ্যায়ঃ সাত

♦ আগরপাড়ায় ‘ভূতুরে’ আগুন

অধ্যায়ঃ আট

♦ প্রদীপ আগরওয়ালের সম্মোহনে ‘পূর্বজন্মে’ যাত্রা

অধ্যায়ঃ নয়

♦ কামধেনু নিয়ে ধর্মব্যবসা

অধ্যায়ঃ দশ

♦ বরানগরের হানাবাড়িঃ গ্রেপ্তার মানুষ- ভূত

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ এফিডেভিট করে ডাক্তারের প্রশংসাপত্র নিয়ে ওঝাগিরি !

অধ্যায়ঃ বারো

♦ ‘গ্যারান্টি চিকিৎসা’র নামে হত্যাকারীর ভূমিকায় সর্পবিদ হীরেন রায়

অধ্যায়ঃ তেরো

♦ চলো যাই ফকিরবাড়ি

অধ্যায়ঃ চোদ্দ

♦ সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জঃ পেটে হবে মোহর !

অধ্যায়ঃ পনেরো

♦ হুজুর সাইদাবাদীঃ মন্তরে সন্তান লাভ !

অধ্যায়ঃ ষোলো

♦ জলাতঙ্ক ও দৈব-চিকিৎসা

অধ্যায়ঃ সতেরো

♦ বিশ্বাসের ব্যবসায়ীরা ও নপুংসক আইন

দ্বিতীয় খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ খেজুর তলার মাটি সারায় সব রোগ

অধ্যায়ঃ দুই

♦ পক্ষিতীর্থমের অমর পাখি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !

অধ্যায়ঃ চার

♦ নাকালের দৈব-পুকুরঃ হুজুগের সুনামী

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ সায়েব যখন রেইকি করে রাঘব বোয়াল চামচা ঘোরে

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ লক্ষ্মীমূর্তি কালি হলেন আপন খেয়ালে

অধ্যায়ঃ সাত

♦ পাথর যখন কথা বলে

অধ্যায়ঃ আট

♦ ফাঁদে পড়ে জ্যোতিষী শ্রীঘরে

অধ্যায়ঃ নয়

♦ বিশ্বের বিস্ময় অলৌকিক মাতা জয়া গাংগুলী’র বিস্ময়কর পরাজয় এবং…

অধ্যায়ঃ দশ

♦ আই আই টিতে টেলিপ্যাথি দেখালেন দীপক রাও

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ জন্ডিস সারাবার পীঠস্থান ইছাপুর

অধ্যায়ঃ বারো

♦ মালপাড়ার পেশা দাঁতের পোকা বের করা

অধ্যায়ঃ তেরো

♦ নিমপীঠের গুগি মা

তৃতীয় খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ ওঝার ঝাড়ফুঁক আর টেরিজার লকেটে মণিহার রোগমুক্তিঃ কুসংস্কারের দু’পিঠ

অধ্যায়ঃ দুই

♦ ‘মেমারিম্যান’ বিশ্বরূপ-এর একটি বিশুদ্ধ প্রতারণা

অধ্যায়ঃ তিন

♦ কোটিপতি জ্যোতিষী গ্রেপ্তার হলেন

চতুর্থ খন্ড

অধ্যায়ঃ এক

♦ কিস্যা অক্টোপাস পল বিশ্বকাপ ফুটবলের ভবিষ্যৎ বক্তা

অধ্যায়ঃ দুই

♦ কিস্যা জ্যোতিষী বেজান দারওয়ালা

অধ্যায়ঃ তিন

♦ সাধারণ নির্বাচন ২০০৯ নিয়ে সব জ্যোতিষী ফেল

অধ্যায়ঃ চার

♦ মা শীতলার পায়ের ছাপ পুকুরঘাটেঃ রহস্যভেদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ যিশুর মূর্তি থেকে রক্তপাত

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ সত্য সাঁই-এর সত্যি-মিথ্যে

অধ্যায়ঃ সাত

♦ অলৌকিক উপায়ে সন্তান দেন ডা. বারসি

অধ্যায়ঃ আট

♦ জ্যোতিষীর বাড়িতে অলৌকিক আগুন

অধ্যায়ঃ নয়

♦ সম্মিলিত দুর্নীতির ফসল ‘মোবাইলবাবা’

অধ্যায়ঃ দশ

♦ জাতিস্মরঃ রাজেশ কুমার

♦ অলৌকিক শক্তিধরদের প্রতি চ্যালেঞ্জ

“যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!