ভাষণ সংকলন
১.১০.১৩৮৪ – ৩.৯.১৩৯২
জানুয়ারী ১৯৭৮ – ডিসেম্বর ১৯৮৫
মুসলিম সাহিত্য সমাজের ৫২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আয়োজিত আবুল হোসেন স্মরণ সভায় প্রদত্ত বক্তৃতা
মাননীয় সভাপতি সাহেব ও উপস্থিত সুধীবৃন্দ! পরলোকগত শ্রদ্ধেয় মৌলবী আবুল হোসেন সাহেব তাঁর স্বল্পপরিসর জীবনে বুদ্ধির মুক্তি সম্বন্ধে যে বিরাট অবদান রেখে গেছেন, তা আপনাদের কারো অজানা নেই। কিন্তু তাঁর বিরাট প্রতিভা ও বহু মুখী অবদানের বিশেষ কিছু আমি অবগত নই। কেননা নিবাস আমার বরিশাল জেলার লামচরি নামের এক গণ্ডগ্রামের কৃষক পরিবারে, যেখানে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের তথা মুসলিম সাহিত্য সমাজের দীপশিখার আলো পৌঁছে নাই এখনো। তবুও নানা সূত্র তাঁর অবদান সম্পর্কে সামান্য কিছু জানতে পেরেছি এবং তাতেই তাঁর বিদেহী আত্মা ও নামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েছি ও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। কিন্তু কোনো মহাপুরুষের নামের মালা গলায় ঝুলিয়ে রাখলে অথবা তাঁর নাম জপ করলেই শ্রদ্ধা দেখানো হয় না। তার জন্য আবশ্যক তাঁর জীবনাদর্শের শুধু অনুকরণ নয়, অনুশীলন। জানিনা তা কতটুকু পারছি বা পারবো।
নিতান্ত দুঃখের সাথে আমার বলতে ইচ্ছে হয় যে, আবুল হোসেন সাহেবের অকালমৃত্যুর মূল কারণ রোগ নয়, মানুষের আঘাত। তবে সে আঘাত ছিলো দেহে নয়, তাঁর মনে। মনের আঘাতে যে দেহে রোগ জন্মাতে পারে, তা চিকিৎসাবিজ্ঞান স্বীকার করে। হয়তো কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, মনে আঘাত অনেকেই পেয়ে থাকে, ভগ্নমনোরথ অনেকেই হয়, তারা রোগাক্রান্ত হয় না কেন? এতে আমার আর একটা পালটা প্রশ্ন করতে হয় যে, কামপ্রবণ শক্তি অনেকেরই থাকে, কিন্তু তারা সকলেই কামোম্মাদ রোগগ্রস্থ হয় না কেন? মনের অদম্য স্পৃহায় বাধা পেলে যখন তা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়, তখনই মানসিক রোগ দেখা দেয়, নচেৎ নয়। আমরা অনেক কাজ করি হলে হোক, না হলে না হোক গোছের মনোভাব নিয়ে। কিন্তু আবুল হোসেন সাহেবের মনোবল ছিলো অত্যন্ত প্রবল। তাই তাঁর ইচ্ছা ও স্পৃহা ছিলো অদম্য, অনন্য। আমার মনে হয়, তারই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর অকালমৃত্যু। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে পৌরাহিত্য করেছেন তিনি। নিজের জন্য নয়, করেছেন আত্মনিয়োগ, আত্মসমর্পণ ও জীবনদান।
মরহুম আবুল হোসেন সাহেব মুসলমান ছিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠানপ্রিয় ধ্বজাধারী মুসলমান ছিলেন না। ছিলেন মানবদরদী মুসলমান, মানবতাবাঁদি মুসলমান তিনি ছিলেন। তা-ই কতিপয় অনুষ্ঠানপ্রিয় মুসলমানের গাত্রদাহের কারণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, শুধু অনুষ্ঠান পালনই প্রকৃত ইসলাম নয়, আল্লাহে বিশ্বাস রেখে মানবকল্যাণে বর্তী হওয়াই প্রকৃত ইসলাম। তাঁর মতে, মানবকল্যাণে আগে, পরে অনুষ্ঠান। জলমগ্ন শিশুকে উদ্ধারের কাজে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি নামাজ পড়তে যাওয়া ইসলামের বিধান নয়। যে দেশে লক্ষ লক্ষ নর-নারী ও শিশু অনাহারে অস্থিকঙ্কালসার হয়ে সমস্ত দিন ঘুরে ঘুরে একমুঠো অন্ন পাচ্ছে না, সে দেশের বিমানবিহারী হাজীদের নিজে উড়ে, টাকা উড়িয়ে হজব্রত পালনের কোনো সার্থকতা নাই। যে দেশের হাজার হাজার গৃহহীন মানুষ মুক্তাকাশের তলে পথে-প্রান্তরে রাত কাটাচ্ছে, সে দেশে উপাসনামন্দিরে সাততলা মিনার তৈয়ারে কোনো সার্থকতা নাই। যে দেশের এতিমরা বস্ত্রাভাবে উলঙ্গ থাকছে আর শীতে কাঁপছে, সে দেশের মানুষের ২২ হাত কাপড়ে দিস্তার বাঁধা সুন্নত হয় কিরূপে? আমাদের দেশের এ দৃশ্য অনেকেই দেখেন এবং মর্মে মর্মে অনুভবও করেন, তবে মুখ ফুটে বলবার সাহস পান না। মরহুম আবুল হোসেন সাহেবও এ দৃশ্য দেখেছেন, অনুভব করেছেন, অন্তর্দাহে অতিষ্ট হয়ে উচ্চকন্ঠে দু’-চার কথা বলতে ভয় পাননই। তাই তিনি ছিলেন আড়ম্বরপ্রিয় ধার্মিকদের বিরাগভাজন।
মরহুম আবুল হোসেন সাহেব শুধু মানবতাবাদীই ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিবর্তনবাদীও এবং তা শুধু জীবের বিবর্তন নয়, ধর্মীয় বিবর্তনবাদীও। তিনি বিশ্বাস করতেন, পরিবর্তনশীল জগতে কোনো ধর্ম ও ধর্মবিধান অপরিবর্তনীয় থাকতে পারে না, ইসলামও না। কিন্তু গোঁড়া ধার্মিকগণ বলেন, ধর্মবিধি অপরিবর্তনীয়, ধর্মগ্রন্থ সনাতন। এ বিষয়েও সনাতনীদের সাথে মরহুমের দ্বন্দ্ব ছিলো আমরণ।
মরহুম আবুল হোসেন সাহেব বলতেন, তাঁর প্রত্যেকটি বাক্য বর্ণে বর্ণে সত্য এবং মুসলিম সমাজ তাঁর অনেক কথা মেনেও নিচ্ছে, তবে কাগজে নয়, কাজে। তিনি বলেছেন যে, যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে ধর্মের বিধি-নিষেধগুলোর কিছু কিছু পরিবর্তন আবশ্যক। আজ ধর্মীয় নেতাগণ তা নীরবতার মাধ্যমে মেনে নিচ্ছেন বা নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
সুদ নেওয়া-দেওয়া নিষিদ্ধ হলেও তা এখন সর্বত্র চলছে। অবরোধ প্রথা এখন রোধ হতে চলেছে। ছবি আঁকা, রাখা, দেখা নিষিদ্ধ হলেও তা এখন মাছ-ভাতের মতোই চলছে। এরূপ ধর্মের অনেক বিধি-নিষেধ আজ সামাজিক বা আন্তর্জাতিকভাবে লঙ্ঘিত হয়ে চলেছে। কিন্তু এর কোনোটিকে নিয়ে ধর্মীয় নেতারা এখন আর উচ্চবাক্য করেন না। বিশেষত খোয়াজ-খেজেরের কেচ্ছা, হারূৎ-মারুৎ ফেরেশতার উপাখ্যান, এয়াজুজ-মাজুজের কাহিনীও আজকাল আর কোনোও ওয়াজের মজলিসে শোনা যায় না।
আমি আমার মামুলি ধরণের কথা বাড়িয়ে আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাই না। মরহুম আবুল হোসেন সাহেবের বিদেহী আত্মার আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আজকের সভার উদ্দেশ্য সফল হোক, এই কামনা করে বিদায় নিচ্ছি।
১.১০.১৩৮৪
“আরজ আলী মাতুব্বর” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ