দক্ষিণ লামচরি নিবাসী পূর্বোক্ত কাজেম আলী সরদার সাব (তাঁর জামাতা) মুন্সি আপছার উদ্দিন নামক এক জন আলেম এনে তাঁর বাড়ীতে পুনঃ মক্তব খোল্লেন। মুন্সি সাব বাংলা ভাষা ভাল জানতেন না, তবে আরবী, ফারসী ও উর্দুতে ছিলেন সুপণ্ডিত এবং সুফিও। তার মত নিষ্ঠাবান নিষ্কাম সাধু পুরুষ আলেম সমাজে অল্পই আছেন। আমি তার মক্তবে ভর্তি হলাম না, তবে সকাল-সন্ধ্যায় তার কাছে গিয়ে আরবী ও উর্দু পড়তে শুরু করলাম (১৩২৫ সালের বৈশাখ মাসের শেষ ভাগ হতে) এবং পড়লাম-পবিত্র কোরান, রাহে নাজাত ও মেফ তাহুল জান্নাত নামক দুখানা কেতাব। নামাজদি দীনিয়াতের অত্যাবশ্যকীয় বিষয় সমূহ তার কাছেই শিক্ষা করলাম।
আমার ভাগ্যবিপর্যয় ঘটেছিল পিতার মৃত্যুর পর হতেই। কিন্তু উহা চরমে পুছেছিল ১৩১৭ সালে, বিত্ত নীলামের পর। রায় বাবুরা আমার চাষের জমিটুকু সবই নীলামে খরিদ করে দখলে নিয়েছিলেন। কিন্তু ভিটি-বাড়ীটুকু দখল করে নিচ্ছিলেন না। আর আমাদের সম্বলও ছিল উহাই। ওর মধ্যে বেড়-পুকুর ও ঘরভিটি বাদ গিয়ে . . . কাঠার বেশী জমি ছিল না। ওতে কয়েকটি ফলবান নারিকেল ও সুপার গাছ ছিল, যার ফল বিক্রি করা যেত। এ ছাড়া বাড়ীতে মা – লাউ, কুমড়া, চিচিঙ্গা ইত্যাদি তরিতরকারী ও মরিচ রোপন করে ও সব বিক্রি করে কিছু পয়সা পেতেন। এতদ্ভিন্ন মাও ধাত্রী কাজে কিছু পেতেন। এছাড়া হাস-মোরগ পালন ছিল আর একটি আয়ের পথ। আর এর দ্বারা নির্বাহ করতে হত দুটি প্রাণীর বারো মাসের খোরাক, পোষাক ও অন্যান্য খরচ পত্র।
আত্নীয় কুটুম্বরা কেহ কোনরূপ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন নি। দেখেছি অভাব গ্রস্ত ব্যক্তির নিকট হতে –
“আত্মীয় কুটুম্ব সব দূরে সরে যায় কেননা নিকটে পেলে যদি কিছু চায়?” কিন্তু আমাদের তুচ্ছ করে সরে যায়নি মাত্র দুজন, তারা হ’ল – “উপবাস” ও “ছিন্নবাস”।
বই ও পুথি প্রাপ্তি
আমাকে পড়া-লেখা শেখায়ে মানুষ করবার আন্তরিক ইচ্ছা মা’র ছিল, কিন্তু তার সামর্থেও কুলোয়নি।
আমার মনে বড় রকমের একটা আফসোস ছিল এই যে, তখনো আমি বাংলাভাষা স্বচ্ছন্দে পড়তে পারতাম না, অনেক শব্দই বর্ণবিন্যাস করে পড়তে হত। এতে যে কোন একটি বাক্য অবিরাম না পড়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়বার ফলে ওর অর্থ দুর্বোধ্য হত। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলাম বাংলা ভাষা স্বচ্ছন্দে পড়বার জন্য।
বই কেনার সম্বল নেই বলে এপাড়া ওপাড়ার ছেলেদের পরিত্যক্ত ছেড়া বই সংগ্রহ করে পড়তে লাগলাম, পড়তে লাগলাম – পথে পড়ে থাকা টুকরো কাগজ কুড়িয়ে, এমন কি লবণ বাধা ঠোঙ্গার কাগজও। কোন রূপ লেখা থাকলেই তা হ’ত আমার পাঠ্য। ওতে কি লেখা, কোন বিষয় লেখা, উহা পাঠে কোন জ্ঞানলাভ হ’ল কি-না ইত্যাদি প্রশ্ন ছিল আমার অনাবশ্যক। তখনকার আমার পড়ার উদ্দেশ্য ছিল শুধু – স্বচ্ছন্দে পড়বার ক্ষমতা অর্জন করা।
এ সময় বই ছিল আমার নিত্য সহচর। ঘরে বসে পড়তাম, শুয়ে পড়তাম, খাবার সময় পাশে বই মেলে রেখে খেতাম ও পড়তাম। কোথায়ও ভ্রমনে বের হলে সঙ্গে বই নিয়ে যেতাম এবং কোন আত্মীয়ের বাড়ীতে বেড়াতে গেলেও কোনও না কোন বই সঙ্গে নিয়ে যেতাম আর সুযোগ মত পড়তাম। অনেক সময় “স্বচ্ছন্দে বই পড়ছি”, ইহা স্বপ্নে দেখতাম।
একদিন আমাদের ঘরের মাচানের ওপর কাপড়ে বাধা একটা কাগজের বস্তা দেখতে পেলাম। ওটা-কবে, কোথা থেকে কে এনেছে- তা জানি না; তবে ওখানে রেখেছেন মোল্লা সাব। বস্তাটি নামিয়ে খুলে দেখতে পেলাম যে, ওর ভেতর আছে – কতগুলো বই, পুথি ও হাতের লেখা খাতা। বই গুলোর মধ্যে আছে – একখানা “গণিত পাঠ” একখানা “ভূগোল শিক্ষা প্রণালী”, একখানা “ভারত বর্ষের ইতিহাস”, একখানা “সরল বাংলা ব্যাকরণ” ও একখানা গল্পগ্রন্থ “গোপাল ভাড়” । পুথি গুলোর মধ্যে আছে সোনাভান, জঙ্গনামা, মোক্তল হোসেন, আছরাচ্ছালাত, গাজী কালু, রসনেছা মালু খাঁ ইত্যাদি এবং খাতাগুলোর মধ্যে আছে কতগুলো তন্ত্ৰ-মন্ত্র ও তাবীজ-কবজের নমুনা। বই-পুথি গুলো পেয়ে তখন আমি যে আনন্দ লাভ করেছিলাম, তা আজও ফুরোয় নি। ওগুলোর জন্যে মোল্লা সাবকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করব আজীবন। তখন মনে মনে ভাবলাম যে, পেটের খোরাক পাই আর না পাই মনের খোরাক পেলাম বহুদিনের। আপাততঃ আমার বই-পুস্তকের অভাব দূর হল, এখন অপেক্ষা শুধু পড়বার। দেখা যাক।
পাঠ্য সহচর
আমাদের গ্রামের মক্তব গুলোতে শিক্ষার বিভাগ ছিল মাত্র দুটি – সাহিত্য ও অঙ্ক। এছাড়া শিক্ষার অন্যান্য বিভাগগুলো আমার ছিল অজানা। ভূগোল, ইতিহাস ও ব্যাকরণ এ নামগুলো সবে মাত্র জানলাম ।
সদ্য প্রাপ্ত বই-পুথি গুলো নাড়াচাড়া করে দেখলাম এবং ধীরে ধীরে কিছু পড়লাম। পুথিগুলো নিয়ে বেশী ঘাটাঘাটি করলাম না। কারণ আমার প্রতিবেশী আঃ রহিম ফরাজী ছিলেন ভাল একজন পুথি পাঠক। ভাবলাম যে, পুথি গুলো তাকে দিয়া পড়াব ও তার সঙ্গে পড়বার চেষ্টা করব। বইগুলো পড়ে – গল্প ও ইতিহাস কিছু বোঝতে পারলাম, ভূগোল বোঝলাম যৎসামান্য কিন্তু ব্যাকরণ “না” বল্লেই চলে। ব্যাকরণ বাদ রেখে আমি – গল্প, ইতিহাস ও ভূগোল পড়তে লাগলাম। আমার পড়ার কোন রুটিন ছিল না; সকাল-বিকাল, সন্ধ্যা-দুপুরও ছিল না; ছিল – যখন যা ইচ্ছা, তখন তা পড়া। শুধুই পড়া।
বার বার বই গুলো পড়ে একটা ফল পেতে লাগলাম। দেখা গেল যে, যে কোনও বই পড়ে প্রথম বার যা বোধগম্য হচ্ছিল, দ্বিতীয় বারে হচ্ছে তার চেয়ে বেশী, তৃতীয়বারে তার চেয়ে বেশী এবং চতুর্থ বারে আরো বেশী। শেষমেশ প্রায় বারো-চৌদ্দ আনাই হয়ে ওঠে বোধ্য, অবোধ্য থাকে মাত্র দু-চার আনা; তা শব্দার্থ জানার অভাবে। পড়া চালাতে লাগলাম। ভাবলাম – থাক না কিছু অবোধ্য, যেটুকু বুঝি সেটুকুই লাভ।
ভূগোলে
এ সময় আমি আর ছবি অঙ্কন করি না। কিন্তু অঙ্কনের প্রবণতা ছাড়াতে পারিনি। এরই ফলে ভূগোল পড়তে গিয়ে মানচিত্র আঁকতে শুরু করে দিলাম। এ সময় একটা ঘটনা আমার মানচিত্র অঙ্কনের সুযোগ এনে দিল। ঘটনাটি এই-একদা রাত্রে পড়বার সময় আমার হাত থেকে “কুপী” বাতিটা বইয়ের উপর পড়ে গিয়ে কেরাসিন পড়ে বইয়ের কাগজ ভিজে গেল। এতে করে ভিজা কাগজের অপর পৃষ্ঠা বা তার নীচেকার কাগজের লেখাগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। আমি পরীক্ষা করে দেখলাম যে, কটু তেল বা নারিকেল তেলেও অনুরূপ ফল পাওয়া যায়। আমি নারিকেল তেল মাখানো কাগজ (শুকিয়ে) মানচিত্রের উপর রেখে নকল মানচিত্র আঁকতে শুরু করলাম।
কিছু দিন ভূগোল পাঠের সাথে সাথে মানচিত্র অঙ্কন করে আমি বোঝতে পারলাম যে, ভৌগলিক বিবরণ পড়ার সাথে সাথে মানচিত্র দেখার চেয়ে (মানচিত্র) অঙ্কনের গুরুত্ব বেশী। যেহেতু মানচিত্র – দর্শনের চেয়ে অঙ্কনে স্মৃতিপটে দাগ কাটে ভাল। আর কোন দেশ, প্রদেশ, শহর-বন্দর ইত্যাদি “স্থান” এর অবস্থান সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার ধারনা না থাকলে ভূগোলের শুধু বিবরণ পড়ার কোন মূল্য থাকে না।
আমার অঙ্কিত মানচিত্রে কোন দেশ, প্রদেশ বা মহাদেশের সমস্ত শহর বন্দর চিহ্নিত করতাম না, করতাম প্রধান ও প্রসিদ্ধ গুলি। কেননা মূল মানচিত্রের সকল লেখা এক সময়ে নকল করতে গেলে আমার মানচিত্র হয়ে যেত একটা হিজি-বিজি ও মসিময়। বিশেষতঃ চিহ্নিত “স্থান” এর সংখ্যাধিক্যের দরুন উহা পঠনে ঘটত বিস্মৃতি। মানচিত্র আঁকবার অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তেলাকাগজের ব্যবহার ত্যাগ করলাম। কিন্তু ওর দ্বারা আমি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, তার সুফল ভোগ করছি আজও (জরিপ কাজে)।
গণিত শিক্ষা
“গণিত পাঠ” বইখানা ধরে কয়েকদিন পাতা উল্টালাম। কিন্তু বেশী দূর এগুতে পারলাম না। কেননা বইখানা ছিল তখনকার “ছাত্রবৃত্তি” (ষষ্ঠ শ্রেণী) পড়ার পাঠ্য। আমার পক্ষে উহা ছিল সমুদ্র বিশেষ। সাতার দিলাম।
সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, বইখানায়ে অঙ্কের প্রত্যেকটি প্রক্রিয়ার প্রথমদিকে উহা কৰ্ষবার “নিয়ম” ও “উদাহরণ” দেয়া ছিল। আমি ধারাবাহিকভাবে নিবিষ্ট চিত্তে প্রত্যেকটি প্রক্রিয়ার “নিয়ম” পড়ে ও উদাহরণ” অনুসরণ করে অঙ্ক কষতে লাগলাম।
গণিত খানার “নিয়ম” ও “উদাহরণ” গুলো পেয়ে আমার শিক্ষকের আবশ্যকতা কমে গেল। কিন্তু বেড়ে গেল চিন্তার বহর। আবার সংসারের (বাড়ীর) নানা রূপ কর্ম-কোলাহল ও হৈহল্লাপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে একনিষ্ঠ চিন্তা-ভাবনা করাও অসম্ভব। তাই আমি অঙ্ক কষতে আরম্ভ করলাম গভীর রাতে, যখন থাকত না আমার নিবিষ্ট-চিন্তা-ভঙ্গকারী কোন শব্দ। মিশ্রামিশ্র চার নিয়ম হতে শুরু করে ভগ্নাংশ, দশমিক, সমানুপাত, ত্রৈরশিক, বর্গ ও ঘন ইত্যাদি যাবতীয় অঙ্ক ক’ষে বইখানা শেষ করতে আমার প্রায় দুবছর কেটে গেল।