ওঁ অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জনশলাকয়া।

চক্ষুরুম্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।

শ্রীচৈতন্যমনোহভীষ্টং স্থাপিতং যেন ভূতলে।

স্বয়ং রূপঃ কদা মহ্যং দদাতি স্বপদান্তিকম।।

অজ্ঞতার গভীরতম অন্ধকারে আমার জন্ম হয়েছিল এবং আমার গুরুদেব জ্ঞানের আলোকবর্তিকা দিয়ে আমার চক্ষু উন্মীলিত করেছেন। তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।

শ্রীল রূপ গোস্বামী প্রভুপাদ, যিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অভিলাষ পূর্ণ করবার জন্য এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, আমি তাঁর শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় লাভ কবে করতে পারব?

বন্দেহহং শ্রীগুরোঃ শ্রীযুতপদকমলং শ্রীগুরূন বৈষ্ণবাংশ্চ

শ্রীরূপ সাগ্রজাতং সহগণরঘুনাথান্বিতং তং সজীবম।

সাদ্বৈত সাবধূতং পরিজনসহিতং কৃষ্ণচৈতন্যদেবং

শ্রীরাধাকৃষ্ণপাদান সহগণললিতা-শ্রীশ্রীশাখান্বিতাংশ্চ।।

আমি আমার গুরুদেবের পাদপদ্মে ও সমস্ত বৈষ্ণববৃন্দের শ্রীচরণে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। আমি শ্রীরূপ গোস্বামী, তাঁর অগ্রজ শ্রীসনাতন গোস্বামী, শ্রীরঘুনাথ দাস, শ্রীরঘুনাথ ভট্ট, শ্রীগোপাল ভট্ট ও শ্রীল জীব গোস্বামীর চরণকমলে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। আমি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, শ্রীনিত্যানন্দ, শ্রীঅদ্বৈত আচার্য, শ্রীগদাধর, শ্রীবাস ও অন্যান্য পার্যদবৃন্দের পাদপদ্মে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। আমি শ্রীমতি ললিতা ও বিশাখা সহ শ্রীমতী রাধারাণী ও শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।

হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধো দীনবন্ধো জগৎপতে।

গোপেশ গোপিকাকান্ত রাধাকান্ত নমোহস্তু তে।।

হে আমার প্রিয় কৃষ্ণ! তুমি করুণাময় সিন্ধু, তুমি দীনের বন্ধু, তুমি সমস্ত জগতের পতি, তুমি গোপীদের ঈশ্বর এবং শ্রীমতী রাধারাণীর প্রেমাস্পদ। আমি তোমার পাদপদ্মে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।

তপ্তকাঞ্চনগৌরাঙ্গি রাধে বৃন্দাবনেশ্বরি।

বৃষভানুসুতে দেবি প্রণমামি হরিপ্রিয়ে।।

শ্রীমতি রাধারাণী, যার অঙ্গকান্তি তপ্তকাঞ্চনের মতো, যিনি বৃন্দাবনের ঈশ্বরী, যিনি মহারাজ বৃষভানুর দুহিতা এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রেয়সী, তাঁর চরণকমলে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।

বাঞ্ছাকল্পতরুভ্যশ্চ কৃপাসিন্ধুভ্য এব চ।

পতিতানাং পাবনেভ্যো বৈষ্ণবেভ্যো নমো নমঃ।।

সমস্ত বৈষ্ণব-ভক্তবৃন্দ, যারা বাঞ্ছাকল্পতরুর মতো সকলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে পারেন, যারা কৃপার সাগর ও পতিতপাবন, তাঁদের চরণকমলে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।

শ্রী কৃষ্ণচৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ।

শ্রীঅদ্বৈত গদাধর শ্রীবাসাদি গৌরভক্তবৃন্দ।।

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, প্রভু নিত্যানন্দ, শ্রীঅদ্বৈত আচার্য, শ্রীগদাধর ও শ্রীবাস আদি গৌরভক্তবৃন্দের চরণকমলে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

ভগবদগীতার আর এক নাম গীতোপনিষোধ। এটি বৈদিক দর্শনের সারমর্ম এবং বৈদিক সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপনিষদ। এই গীতোপনিষোধ বা ভগবদগীতার বেশ কয়েকটি ইংরেজি ভাষ্য ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। তাই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ভগবদগীতার আরো একটি ইংরেজি ভাষ্যের কি দরকার? তাই ভগবদগীতার এই সংস্করণ সম্বন্ধে দুই-একটি কথা আমাকে বলতে হয়। ইদানিং একজন আমেরিকান ভদ্রমহিলা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “ভগবদগীতার কোন ইংরেজি অনুবাদে ভগবদগীতার প্রকৃত ভাবকে যথাযথভাবে প্রকাশ করা হয়েছে?” আমেরিকাতে ভগবদগীতার বহু ইংরেজি সংস্করণ পাওয়া যায়, কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি এমন একটি ভগবদগীতা পেলাম না যাতে ভগবদগীতার যথার্থ ভাবকে বজায় রেখে তাঁর অনুবাদ করা হয়েছে। শুধু আমেরিকাতেই নয়, ভারতবর্ষেও ভগবদগীতার ইংরেজি অনুবাদের সেই একই অবস্থা। তার কারণ হচ্ছে, ভাষ্যকারেরা ভগবদগীতার মূল ভাব বজায় না রেখে তাঁদের নিজেদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে তার ব্যাখ্যা করেছেন।

ভগবদগীতাতেই ভগবদগীতার মূলভাব ব্যক্ত হয়েছে। এটি ঠিক এরকম- আমরা যখন কোন ঔষধ খাই, তখন যেমন আমরা আমাদের ইচ্ছামতো সেই ঔষধ খেতে পারি না, ডাক্তারের নির্দেশ বা ঔষধের শিশিতে দেওয়া নির্দেশ অনুসারে সেই ঔষধ খেতে হয়, তেমনি ভগবদগীতাকে গ্রহণ করতে হবে ঠিক যেভাবে তার বক্তা তাঁকে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। ভগবদগীতার বক্তা হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। ভগবদগীতার প্রতিটি পাতায় বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। ভগবান শব্দটি অবশ্য কখনো কখনো কোন শক্তিমান পুরুষ অথবা দেব-দেবীর ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়। এখানে ভগবান শব্দটি দ্বারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে মহাপুরুষ রুপে বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদের জ্ঞাত হওয়া উচিত যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। ভগবান শ্রীকৃষ্ণই যে পরমেশ্বর তা স্বীকার করেছেন সমস্ত সত্যদ্রষ্টা ওন ভগবৎ-তত্ত্ববেত্তা আচার্যেরা- যেমন শঙ্করাচার্য, রামানুজাচার্য, নিম্বাকাচার্য, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আদি ভারতের প্রতিটি মহাপুরুষ। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই ভগবদগীতাতে বলে গেছেন যে, তিনিই হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান। ব্রক্ষ্মসংহিতা ও সব কয়টি পুরাণে, বিশেষ করে ভগবত-পউরান শ্রীমদ্ভাগতে শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবানরূপে বর্ণনা করা হয়েছে (কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম)। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যেমনভাবে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, ঠিক তেমনিভাবে ভগবদগীতাকে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। ভগবদগীতার চতুর্থ অধ্যায়ে (৪/১-৩) ভগবান বলেছেন –

ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম।

বিবস্বান্মানবে প্রাহ মনুরিক্ষাকবেহব্রবীৎ।।

এবং পরম্পরাপ্রাপ্তমিমং রাজর্ষয়ো বিদুঃ।

স কালেনেহ মহতা যোগো নষ্টঃ পরন্তুপ।।

স এবায়ং ময়া তেহদ্য যোগঃ প্রোক্তঃ পুরাতনঃ।

ভক্তোহসি মে সখা চেতি রহস্যং হ্যেতদুত্তমম।।

এখানে ভগবান অর্জুনকে বলেছেন যে, এই যোগ ভগবদগীতা প্রথমে তিনি সূর্যদেবকে বলেন, সূর্যদেব গুরুদেব থেকে শিষ্যতে এই জ্ঞান ধারাবাহিকভাবে প্রবাহিত হয়ে আসছিল। কিন্তু এক সময় এই পরম্পরা ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে আমরা এই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তাই ভগবান কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে নিজে এসে আবার এই জ্ঞান অর্জুনের মাধ্যমে দান করলেন।

তিনি অর্জুনকে বললেন, “তুমি আমার ভক্ত ও সখা, তাই রহস্যাবৃত এই পরম জ্ঞান আমি তোমাকে দান করছি।“ এই কথার তাৎপর্য হচ্ছে যে, ভগবদগীতার জ্ঞান কেবল ভাগবানের ভক্তই আহরণ করতে পারে। আধ্যাত্মবাদীদের সাধারণত তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, যথা- জ্ঞানী, যোগী ও ভক্ত, অথবা নির্বিশেষবাদী, ধ্যাণী ও ভক্ত। এখানে ভগবান স্পষ্টভাবে অর্জুনকে বলেছেন যে, পূর্বের পরম্পরা নষ্ট হয়ে যাবার ফলে তিনি চেয়েছিলেন যে, অর্জুন এই জ্ঞানকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করে তার প্রচার করবেন। আর এই কাজের জন্য তিনি অর্জুনকেই কেবল মনোনীত করলেন, কারণ অর্জুন ছিলেন তাঁর ভক্ত, তাঁর অন্তরঙ্গ সখা ও তাঁর প্রিয় শিষ্য। তাই ভগবানের ভক্ত না হলে অর্থাৎ ভক্তি ও ভালোবাসার মাধ্যমে তাঁর অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যে না এলে ভগবানের মাহাত্ম উপলব্ধি করতে পারা সম্ভব নয়। তাই অর্জুনের গুণে গুণান্বিত মানুষেরাই কেবল ভগবদগীতাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারে। ভক্তির মাধ্যমে ভক্তের সঙ্গে ভগবানের য প্রেম-মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠে, তারই আলোকে ভগবানের স্বরূপ উপলব্ধি করা সম্ভব হয়। এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা করতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়, তবে সংক্ষেপে বলা যায় যে, ভক্ত ভগবানের সঙ্গে নিম্নলিখিত পাঁচটি সম্পর্কের যে কোন একটির দ্বারা যুক্ত থাকেন –

(১) নিষ্ক্রিয়ভাবে ভক্ত হতে পারেন — (শান্ত)

(২) সক্রিয়ভাবে ভক্ত হতে পারেন — (দাস্য)

(৪) অভিভাবক রূপে ভক্ত হতে পারেন — (বাৎসল্য)

(৫) দাম্পত্য প্রেমিকরূপে ভক্ত হতে পারেন — (মাধুর্য)

অর্জুনের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্কের রূপ ছিল সখ্য। অবশ্য শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অর্জুনের যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তার সঙ্গে পার্থিব জগতের বন্ধুত্বের বিস্তর তফাৎ। এই সম্পর্ক হচ্ছে অপ্রাকৃত এবং জড় অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এর বিচার করা কখনই সম্ভব নয়। যে কোন লোকের পক্ষে এই বন্ধুত্বের আস্বাদন লাভ করা সম্ভব নয়, তবুও প্রত্যেককেই কোন না কোনভাবে ভগবানের সঙ্গে যুক্ত এবং এই সম্পর্কের প্রকাশ হয় ভক্তিযোগের পূর্ণতার মাধ্যমে। তবে আমাদের বর্তমান অবস্থায়, আমরা কেবল ভগবানকেই ম্ভুলে যাইনি, সেই সঙ্গে ভুলে গেছি তাঁর সঙ্গে আমাদের চিরন্তন সম্পর্কের কথা। লক্ষ কোটি জীবের মধ্যে প্রতিটি জীবেরই ভগবানের সঙ্গে কোন না কোন রকমের শাশ্বত সম্পর্ক রয়েছে, এবং সেই সম্পর্ক হচ্ছে জীবের ‘স্বরূপসিদ্ধি’। অর্জুন ছিলেন ভগবানের ভক্ত এবং তাঁর সাথে ভগবানের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক।

ভগবদগীতার মর্মোপলব্ধি করতে হলে প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে অর্জুন কিভাবে তা গ্রহণ করেছিলেন। ভগবদগীতার দশম অধ্যায়ে (১০/১২-১৪) তা বর্ণনা করা হয়েছে –

অর্জুন উবাচ

পরং ব্রক্ষ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান।

পুরুষং শাশ্বতং দিব্যমোদিদেবমজং বিভুম।।

আহুস্তামৃষয়ঃ সর্বে দেবর্ষির্নারদস্তথা।

অসিতো দেবলো ব্যাসঃ স্বয়ং চৈব ব্রবীষি মে।।

সর্বমেতদ ঋতং মন্যে যন্মাং বদসি কেশব।

ন হি তে ভগবান ব্যক্তিং বিদুর্দেবা ন দানবাঃ।।

“অর্জুন বললেন –  তুমিই পরম পুরুষোত্তম ভগবান, পরম ধাম, পরম পবিত্র ও পরব্রক্ষ্ম। তুমিই শাশ্বত, দিব্য, আদি পুরুষ, অজ ও বিভু। নারদ, অসিত, দেবল, ব্যাস আদি সমস্ত মহান ঋষিরাই তোমার এই তত্ত্ব প্রতিপন্ন করে গেছেন, আর এখন তুমি নিজেও তা আমার কাছে ব্যক্ত করছ। হে শ্রীকৃষ্ণ, তুমি আমাকে যা বলেছ তা আমি সম্পূর্ণ সত্য বলে গ্রহণ করেছি। হে ভগবান! দেব অথবা দানব কেউই তোমার তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারে না।“

পরম পুরুষোত্তম ভগবানের কাছে ভগবদগীতা শোনার পর অর্জুন বুঝতে পেরেছিলেন যে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরং ব্রক্ষ্ম অর্থাৎ পরব্রক্ষ্ম। প্রতিটি জীবই ব্রক্ষ্ম, কিন্তু পরম জীব অথবা পরম পুরুষোত্তম ভগবান হচ্ছেন পরব্রক্ষ্ম। পরং ধাম কথাটির অর্থ হচ্ছে তিনি সব কিছুর পরম আশ্রয় অথবা পরম ধাম। পবিত্রম মানে তিনি হচ্ছেন বিশুদ্ধ অর্থাৎ জড় জগতের কোন রকম কলুষ তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। পুরুষম কথাটির অর্থ হচ্ছে, তিনিই পরম ভোক্তা; শাশ্বতম অর্থ সনাতন; দিব্যম অর্থ অপ্রাকৃত; আদিদেবম অর্থ পরম পুরুষ ভগবান; অজম অর্থ জন্মরহিত এবং বিভুম শব্দটির অর্থ সর্বশ্রেষ্ঠ।

কেউ মনে করতে পারেন যে, অর্জুন যেহেতু শ্রীকৃষ্ণের বন্ধু ছিলেন, তাই তিনি ভাবোচ্ছসিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের গুণকীর্তন করেছেন। কিন্তু ভগবদগীতার পাঠকের মন থেকে সেই সন্দেহ দূর করার জন্য অর্জুন পরবর্তী শ্লোকে বলেছেন যে, নারদ, অসিত, দেবল, ব্যাসাদি ভগবৎ-তত্ত্ববিদ মহাজনেরা সকলেই শ্রীকৃষ্ণকে পরম পুরুষোত্তম ভগবান বলে স্বীকার করেছেন। বৈদিক জ্ঞান যথাযথভাবে বিতরণকারী এই সমস্ত মহাপুরুষদের আচার্যেরা স্বীকার করেছেন। তাই অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বলেছেন যে, তাঁর মুখনিঃসৃত প্রতিটি কথাকেই তিনি সম্পূর্ণ নির্ভুল বলে গ্রহণ করেন। সর্বমেতদ ঋতং মন্যে – “তোমার প্রতিটি কথাই আমি পরম সত্য বলে গ্রহণ করি।“ অর্জুন আরো বলেছেন যে, ভগবানের ব্যক্তিত্ব উপলব্ধি করা খুবই দুষ্কর এবং দেবতারাও তাঁর প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারেন না। এর অর্থ হচ্ছে যে, মানুষের চেয়ে উচ্চস্তরে অধিষ্ঠিত যে দেবতা, তারাও ভগবানের স্বরূপ উপলব্ধি করতে অক্ষম। তাই সাধারণ মানুষ ভগবানের ভক্ত না হলে কিভাবে তাঁকে উপলব্ধি করবে?

ভগবদগীতাকে তাই ভক্তির মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয়। শ্রীকৃষ্ণকে কখনোই আমাদের সমকক্ষ বলে মনে করা উচিত নয়। শ্রীকৃষ্ণকে একজন সাধারণ ব্যক্তি বলে মনে করা উচিত নয়, এমনকি তাঁকে একজন মহাপুরুষ বলেও মনে করা উচিত নয়। ভগবদগীতার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে হলে শ্রীকৃষ্ণকে পরম পুরুষোত্তম ভগবান বলে স্বীকার করে নিতেই হবে। সুতরাং ভগবদগীতার বিবৃতি অনুসারে কিংবা অর্জুনের অভিব্যক্তি অনুসরণে যিনি ভগবদগীতা বুঝতে চেষ্টা করেছেন, তাঁকে শ্রীকৃষ্ণ যে পরম পুরুষোত্তম ভগবান, তা অন্তত তত্ত্বগত ভাবে মেনে নিতে হবে এবং সেই রকম বিনম্র মনোভাব নিয়ে ভগবদগীতা উপলব্ধি করা সম্ভব। শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ভগবদগীতা না পড়লে, তা বুঝতে পারা খুবই কঠিন, কারণ এই শাস্ত্রটি চিরকালই বিপুল রহস্যাবৃত।

ভগবদগীতা আসলে কি? ভগবদগীতার উদ্দেশ্য হচ্ছে অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন এই জড়জগতের বন্ধন থেকে মানুষকে উদ্ধার করা। প্রতিটি মানুষই নানাভাবে দুঃখ কষ্ট পাচ্ছে, যেমন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় অর্জুনও এক মহা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। অর্জুন ভগবানের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন এবং তার ফলে তখন ভগবান তাঁকে গীতার তত্ত্বজ্ঞান দান করে মোহমুক্ত করলেন। এই জড় জগতে কেবল অর্জুনই নয়, আমরা প্রত্যেকেই সর্বদাই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় জর্জরিত। এই জড় জগতের অনিত্য পরিবেশে আমাদের যে অস্তিত্ব, তা অস্তিত্বহীনের মতো। এই জড় অস্তিত্বের অনিত্যতা আমাদের ভীতি প্রদর্শন করে, কিন্তু তাতে ভীত হওয়ার কোন কারণ নেই। আমাদের অস্তিত্ব হচ্ছে নিত্য। কিন্তু যে-কোন কারণবশত আমরা অসৎ সত্তায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছি, অসৎ বলতে বোঝায় যার অস্তিত্ব নেই।

এই অনিত্য অস্তিত্বের ফলে মানুষ প্রতিনিয়ত দুঃখকষ্ট ভ ভোগ করছে। কিন্তু সে এতোই মোহাচ্ছন্ন যে, তাঁর দুঃখকষ্ট সম্পর্কে সে মোটেই অবগত নয়। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কেবল দুই-একজন কেবল তাদের ক্লেশ জর্জরিত অনিত্য অবস্থাকে উপলব্ধি করতে পেরে অনুসন্ধান করতে শুরু করে, “আমি কে?” “আমি কোথা থেকে এলাম?” “কেন আমি এই জটিল অবস্থায় পতিত হয়েছি?” মানুষ যতক্ষন পর্যন্ত না তাঁর মোহাচ্ছন্ন অবস্থা কাটিয়ে উঠে তাঁর দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে সচেতন হয়ে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য অনুসন্ধান করছে, যতক্ষন পর্যন্ত না সে বুঝতে পারছে যে, সে দুঃখ-দুর্দশা চায় না, ততক্ষণ তাকে যথার্থ মানুষ বলে গণ্য করা চলে না। মানুষের মনুষ্যত্বের সূচনা তখনি হয়, যখন তাঁর মনে এই সমস্ত প্রশ্নের উদয় হতে শুরু করে। ব্রক্ষ্মসূত্রে এই অনুসন্ধানকে বলা হয় ব্রক্ষ্মজিজ্ঞাসা। অথাতো ব্রক্ষ্মজিজ্ঞাসা। মানব-জীবনে এই ব্রক্ষ্মজিজ্ঞাসা ব্যতীত আর সমস্ত কর্মকেই ব্যর্থ বা অর্থহীন বলে গণ্য করা হয়। তাই যারা ইতিমধ্যেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন, “আমি কে?” “আমি কোথা থেকে এলাম?” “আমি কেন কষ্ট পাচ্ছি?” “মৃত্যুর পরে আমি কোথায় যাবো?” তারাই ভগবদগীতার প্রকৃত শিক্ষার্থী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। এই তত্ত্ব যিনি আন্তরিকভাবে অনুসন্ধান করেন, তিনিই ভগবানের প্রতি অকৃত্রিম ভক্তি অর্জন করেন। অর্জুন ছিলেন এমনই একজন অনুসন্ধানী শিক্ষার্থী।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মানব-জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করে দেবার জন্যই এই পৃথিবীতে অবতরণ করেন। তা সত্ত্বেও হাজার হাজার তত্ত্বানুসন্ধানী মানুষের মধ্যে কোন ভাগ্যবান ব্যক্তি কেবল ভগবৎ-তত্ত্ব পূর্ণরূপে উপলব্ধি করে নিজের প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত হন, এবং এমন মানুষের জন্যই ভগবান ভগবদগীতা শুনিয়েছেন। অজ্ঞতারূপ হিংস্র জন্তুটি আমাদের প্রতিনিয়ত গ্রাস করে চলেছে, কিন্তু ভগবান করুণাময়, বিশেষ করে মানুষের প্রতি তাঁর করুণা অপার। তাই তিনি তাঁর বন্ধু অর্জুনকে শিক্ষার্থীরূপে গ্রহণ করে ভগবদগীতার মাধ্যমে মানুষকে ভগবৎ-তত্ত্ব দান করে গেছেন।

অর্জুন ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের সহচর, তাই জড় জগতের অজ্ঞতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারত না, কিন্তু ভগবানের ইচ্ছানুসারে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় তিনি সাময়িকভাবে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন যাতে তিনি তাঁর সেই সঙ্কটময় অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য শ্রীকৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেন, এবং তাঁর মাধ্যমে ভগবান আগামী দিনের মানুষের উদ্ধারের উপায়-স্বরূপ ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান সমন্বিত ভগবদগীতা বর্ণনা করলেন। অপার করুণাময় ভগবান মানব-জীবনকে সার্থক করে তুলবার জন্য মানুষকে তাঁর স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত করলেন, আর তাদের নির্দেশ দিলেন কিভাবে জীবন অতিবাহিত করা উচিত।

ভগবদগীতার বিষয়বস্তুতে আমরা পাঁচটি মূল তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারি। সর্বপ্রথমে ভগবানের স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে এবং তাঁর পরিপ্রেক্ষিতে জীবের স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। ঈশ্বর আছেন এবং তিনিই সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ করছেন, আর জীব প্রতিনিয়তই তাঁর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যদি কেউ বলে যে, সে কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না, সে মুক্ত, তা হলে বুঝতে হবে সে উন্মাদ। জীব সর্বদাই, বিশেষ করে বদ্ধ অবস্থায় সর্বতোভাবে নিয়ন্ত্রিত। তাই ভগবদগীতায় পরম নিয়ন্তা ঈশ্বর ও সর্বদা নিয়ন্ত্রিত জীবের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচিত হয়েছে। তা ছাড়া প্রকৃতি (জড়া প্রকৃতি), কাল (সমগ্র ব্রক্ষ্মান্ডের অস্তিত্ব ও জড়া প্রকৃতির অভিব্যক্তির অস্তিত্বের স্থিতিকাল) এবং কর্মও (কার্যকলাপ) আলোচনা করা হয়েছে। ভৌতিক জগতের প্রকাশ বিভিন্ন কার্যকলাপে পরিপূর্ণ। সমস্ত জীবেরা বিভিন্ন কার্যকলাপে লিপ্ত। তাই ভগবদগীতা থেকে আমাদের জানতে হবে ভগবান কে? জীব কি? প্রকৃতি কি? ভৌতিক জগত কি? আর কিভাবে তা মহাকালের দ্বারা পরিচালিত হয় এবং জীবের কার্যকলাপ কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।

ভগবদগীতায় এই পাঁচটি বিষয়বস্তু আলোচনা করার মাধ্যমে সুদৃঢ় ভাবে প্রমান করা হয়েছে যে, ভগবান বা শ্রীকৃষ্ণ বা পরব্রক্ষ্ম বা পরম নিয়ন্তা বা পরমাত্মা – যে নামেই তাঁকে সম্বোধন করা হোক, তিনিই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ। সকল জীবই পরম নিয়ন্তার মতোই গুণগতভাবে সমান। যেমন, জড়া প্রকৃতিজাত এই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের সব কিছু ভগবান নিয়ন্ত্রণ করছেন, যা ভগবদগীতার শেষ অধ্যায়গুলিতে বর্ণনা করা হয়েছে। জড়া প্রকৃতি স্বাধীন নয়। পরমেশ্বরের নির্দেশে তাঁকে কাজ করতে হচ্ছে। শ্রীকৃষ্ণ তাই বলেছেন, ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম – “এই জড়া প্রকৃতি আমার নির্দেশনায় ক্রিয়াশীল।“ আমরা যখন ভৌতিক জগতে বিস্ময়কর কোন কিছু ঘটতে দেখি, তখন আমাদের বোঝা উচিত যে, এর পেছনে একজন নিয়ন্তা রয়েছেন। নিয়ন্ত্রিত না হলে কোন কিছুরই প্রকাশ হতে পারে না। যদি কেউ মনে করে যে, কোন পরিচালক ব্যতীতই প্রকৃতি পরিচালিত হচ্ছে, তবে তা শিশুসুলভ নির্বুদ্ধিতা। একটি শিশু যেমন একটি মোটর গাড়ি চলতে দেখে মনে করতে পারে যে, কোন ঘোড়া বা পশুর দ্বারা পরিচালিত না হয়ে মোটর গাড়িটি নিজে নিজে চলছে, কিন্তু পরিণত বুদ্ধিসম্পন্ন যে কোন মানুষই মোটর গাড়ির কারিগরি ব্যবস্থার ব্যাপারটি জানে। সে জানে যে, একজন চালক কলকব্জা নাড়িয়ে সেই গাড়িটিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তেমনই, পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন এই ভৌতিক জগতের সমস্ত কিছুর পরিচালক। তাঁরই তত্ত্বাবধানে সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে। জীব হচ্ছে ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং ভগবদগীতাতে তার বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এক বিন্দু সমুদ্রের জল যেমন গুণগতভাবে সমস্ত সমুদ্রের জল থেকে অভিন্ন, এক কণা সোনাও যেমন সোনা, ঠিক তেমনই জীব পরম নিয়ন্তা বা ঈশ্বর বা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপরিহার্য অংশ হবার ফলে, ভগবানের সমস্ত গুণই তার মধ্যে অনু পরিমাণে বিদ্যমান, কেন না প্রতিটি জীব ক্ষুদ্র ঈশ্বর, নিয়ন্ত্রণাধীন ঈশ্বর। আমরা প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব করবার চেষ্টা করছি, যেমন এখন আমরা অন্তরিক্ষ অথবা অন্যান্য গ্রহ নিয়ন্ত্রিত করবার চেষ্টা করছি। এই প্রচেষ্টা স্বাভাবিক, কারণ কর্তৃত্ব করার এই গুণ শ্রীকৃষ্ণের মধ্যেই বিদ্যমান। কিন্তু প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব করার বাসনা আমাদের মনে থাকলেও আমাদের বোঝা উচিত যে, আমরা পরম নিয়ন্তা নই। ভগবদগীতাতে এর বিশদ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

জড়া প্রকৃতি কি? গীতায় তাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, তা হচ্ছে নিকৃষ্টা প্রকৃতি আর জীবকে বলা হয়েছে উৎকৃষ্টা প্রকৃতি। উৎকৃষ্টই হোক আর নিকৃষ্টই হোক, প্রকৃতি সব সময় নিয়ন্ত্রণাধীন। স্ত্রী যেমন স্বামীর দ্বারা পরিচালিত হয়, নারীস্বরূপা প্রকৃতিও তেমনই ঈশ্বরের দ্বারা পরিচালিত হয়। জীব ও জড়া প্রকৃতি উভয়কে পরমেশ্বর পরিচালিত করেন। গীতাতে বলা হয়েছে, জীব যদিও ভগবানের অপরিহার্য অংশ, তবুও তাকে প্রকৃতি বলেই স্বীকার করতে হবে। ভগবদগীতার সপ্তম অধ্যায়ে তা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। অপরেয়মিতস্তন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম/জীবভূতাম – “এই জড়া প্রকৃতি আমার নিম্নতর প্রকৃতি, এই নিম্নতর প্রকৃতির অতীত আর একটি প্রকৃতি আছে – জীবভূতাম অর্থাৎ জীবসত্তা।

জড়া প্রকৃতি গঠিত হয়েছে সত্ত্ব, রজ ও তম – এই তিনটি গুণের সমন্বয়ে। এই গুণত্রয়ের ঊর্ধ্বে আছে অনন্ত কাল এবং অনন্ত কালের প্রভাবে ও পরিচালনায় এই গুণগুলির সমন্বয় ঘটে এবং তার ফলে প্রকৃতি সক্রিয় হয়ে ওঠে – একে বলা হয় কর্ম। অনন্ত কাল ধরে এই কর্ম প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে। আমরা আমাদের কর্মের ফলস্বরূপ সুখ অথবা দুঃখ ভোগ করি। যেমন, মনে করা যাক যে, আমি একজন ব্যবসায়ী, তখন আমি যদি বুদ্ধি খাটিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করি, তবে আমি সেই অর্থ উপভোগ করতে পারি। কিন্তু আমি যদি আমার সমস্ত অপচয় করে ফেলি, তবে আমাকে ক্লেশ স্বীকার করতেই হবে। সেই রকম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা আমাদের কর্মের ফলস্বরূপ সুখ অথবা দুঃখ পেয়ে থাকি।

ভগবদগীতায় ঈশ্বর, জীব, প্রকৃতি, কাল ও কর্ম – এই সব কিছুরই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই পাঁচটির মধ্যে ঈশ্বর, জীব, জড়া প্রকৃতি ও কাল হচ্ছে নিত্য। প্রকৃতির অভিপ্রকাশ অনিত্য হতে পারে, কিন্তু তা মিথ্যা নয়। কোন কোন দার্শনিক বলে থাকেন যে, জড়া প্রকৃতির প্রকাশ মিথ্যা, কিন্তু ভগবদগীতার দর্শন বা বৈষ্ণব দর্শন তা স্বীকার করে না। প্রকৃতির প্রকাশ যদিও সাময়িক, তবুও তা সত্য। তাকে আকাশে ভাসমান মেঘ অথবা শস্যের পুষ্টি সাধনকারী বর্ষা ঋতুর সঙ্গে তুলনা করা চলে। যখন বর্ষা ঋতু শেষ হয়ে যায় এবং মেঘ ভেসে চলে যায়, তখন সমস্ত শস্যকণা যা বৃষ্টির ফলে পুষ্ট হয়েছিল, তা শুকিয়ে যায়। তেমনই কোন এক সময়ে এই জড়া জগতের প্রকাশ হয়, কিছুকালের জন্য তার স্থিতি হয় এবং তারপর তা অন্তর্হিত হয়ে যায়। প্রকৃতি এভাবে কাজ করে চলে। এভাবে অনন্তকাল ধরে প্রকৃতির প্রকাশ, স্থিতি ও অন্তর্ধান হয়ে চলেছে। তাই প্রকৃতি নিত্য, প্রকৃতি মিথ্যা নয়। ভগবান তাই একে বলেছেন, “আমরা প্রকৃতি”। এই জড়া প্রকৃতি হচ্ছে পরমেশ্বরের ভগবানের ভিন্না প্রকৃতি। তেমনই জীবও হচ্ছে ভগবানের শক্তি, তবে তারা বিচ্ছিন্ন নয়, ভগবানের সঙ্গে নিত্য সম্পর্কযুক্ত। তাই ঈশ্বর, জীব, জড়া প্রকৃতি ও কাল একে অপরের সঙ্গে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং সকলেই নিত্য। কিন্তু অন্য বিষয় কর্ম নিত্য নয়। বস্তুত কর্মের ফল অতি প্রাচীন হতে  পারে। স্মরণাতীত কাল থেকে কর্মের ফলস্বরূপ আমরা সুখ অথবা দুঃখ ভোগ করছি। কিন্তু আমরা আমাদের কর্মফলকে পরিবর্তিত করতে পারি এবং এই পরিবর্তন নির্ভর করে আমাদের জ্ঞানের পূর্ণতার উপর। আমরা নানা রকমের কর্ম সম্পাদন করি। নিঃসন্দেহে আমরা জানি না, কোন কর্ম আমাদের করা উচিত এবং কোন কর্ম করা উচিত নয়। বিশেষ করে আমরা জানি না, কোন কর্ম করলে কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়। ভগবদগীতায় ভগবান তার ব্যাখ্যা করে আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন কোন কর্ম করা আমাদের কর্তব্য।

ঈশ্বর হচ্ছেন পরম চেতনার উৎস। জীব ঈশ্বরের অপরিহার্য অংশ, তাই সেও চেতন। জীব ও জড়া প্রকৃতি উভয়কেই প্রকৃতি বা ভগবানের শক্তি বলা হয়। কিন্তু তার মধ্যে জীবই কেবল চেতন – জড়া প্রকৃতি অচেতন। সেটিই হচ্ছে পার্থক্য। তাই জীব-প্রকৃতিকে উৎকৃষ্টতর প্রকৃতি বলা হয়, কেননা জীব ভগবানের মতো চৈতন্যময়। ঈশ্বর কিন্তু পরম চৈতন্যময়, কেউ যদি বলে যে, জীবও পরম চৈতন্যময়, তবে তা ভুল হবে। জীব কোন অবস্থাতেই সমস্ত চেতনার উৎস হতে পারে না। জীব তার সিদ্ধি লাভের কোন অবস্থাতেই পরম চৈতন্যময় হতে পারে না, এবং জীব তা হতে পারে কোন মতবাদে বলি, তবে সেটি বিভ্রান্তিকর মতবাদ। সে চৈতন্যময় বটে, কিন্তু পরম চৈতন্যময় নয়।

জীব ও ঈশ্বরের পার্থক্য গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, জীবের মতো ভগবানও ক্ষেত্রজ্ঞ অর্থাৎ চেতন, তবে জীব কেবল তার নিজের দেহটি সম্বন্ধে সচেতন, কিন্তু ভগবান সমস্ত দেহ সম্বন্ধেই সচেতন। যেহেতু তিনি সকলের হৃদয়ে অবস্থান করেন, তাই তিনি সকলের অন্তরতম প্রদেশের কথা জানেন। এই কথা আমাদের ভুললে চলবে না। এই সম্বন্ধে আরো ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, পরম পুরুষোত্তম ভগবান পরমাত্মারূপেম সর্বজীবের অন্তরে অধিষ্ঠিত এবং জীবের বাসনা অনুসারে তিনিই তাদের পরিচালিত করেন। মোহাচ্ছন্ন হয়ে জীব তার কর্তব্যকর্ম ভুলে যায়। প্রথমত তার স্বাধীন ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে সে কোন কিছু করার সংকল্প করে, এবং তারপর সে নিজের কর্মের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সে এক দেহ পরিত্যাগ করে আরেক দেহ ধারণ করে – যেমন আমরা পুরাতন কাপড় ফেলে দিয়ে নতুন কাপড় পরি। এভাবে পূর্বকৃত কর্মের ফলস্বরূপ আত্মা এক দেহ থেকে আরেক দেহে দেহান্তরিত হয় এবং তার বিগত কর্ম অনুসারে সে নানা রকম কষ্ট পায়। কিন্তু জীব যখন সত্ত্ব গুণে অধিষ্ঠিত হয়ে প্রকৃতিস্থ হয় এবং তার কর্তব্যকর্ম সম্বন্ধে সচেতন হয়, তখনই সে তার পূর্বকৃত কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। তখন আর তাকে তার পূর্বকৃত কর্মের ফল ভোগ করতে হয় না। এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, কর্ম নিত্য নয়। তাই ভগবদগীতায় বলা হয়েছে ঈশ্বর, জীব, প্রকৃতি ও কাল হচ্ছে নিত্য, কিন্তু কর্ম অনিত্য।

পরম চৈতন্যময় ঈশ্বর ও জীব গুণগতভাবে এক। ঈশ্বরের পরম চৈতন্য ও জীবের অনুচেতনা, উভয়েই অপ্রাকৃত। এমন নয় যে, জড় বস্তুর সংস্পর্শে আসার ফলে জীবের চেতনার বিকাশ হয়। এই ধারণাটি ভ্রান্ত। কোন বিশেষ প্রাকৃতিক পরিবেশে জড়ের মধ্য থেকে চেতনের উদ্ভব হয়, সেই কথা গীতায় স্বীকার করা হয়নি। জড়া প্রকৃতির প্রভাবে চেতনার বিকৃত প্রতিফলন হতে পারে এবং তা হচ্ছে রঙ্গিন কাচের মাধ্যমে প্রতিফলিত রঙ্গিন আলোর মতো। কিন্তু পরমেশ্বরের চেতনা কখনোই জড়া প্রকৃতির দ্বারা প্রভাবিত বা কলুষিত হয় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ময়াধ্যক্ষ্যেণ প্রকৃতিঃ- “আমার দ্বারা পরিচালিত প্রকৃতি।“ তিনি যখন এই জড় জগতে অবতরণ করেন, তখন তাঁর চেতনা জড়া প্রকৃতির দ্বারা প্রভাবান্বিত হয় না। তাই যদি হতো, তবে তিনি পরম তত্ত্বজ্ঞান সমন্বিত ভগবদগীতার জ্ঞান দান করতে পারতেন না। জড়া প্রকৃতির দ্বারা চেতনা যতক্ষণ কলুষিত থাকে, ততক্ষণ অপ্রাকৃত জগৎ সম্বন্ধে কোন জ্ঞান ব্যক্ত করা যায় না। ভগবান চরম চৈতন্যময় এবং তিনি জড়া প্রকৃতির কলুষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। তাই, অপ্রাকৃত জগতের পূর্ণ জ্ঞান কেবল তিনিই দান করতে পারেন। আমাদের চেতনা এখন জড়া প্রকৃতির প্রভাবে কলুষিত হয়ে আছে। তাই, ভগবদগীতার মাধ্যমে ভগবান আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, কিভাবে আমাদের চেতনা কলুষমুক্ত হয়ে পবিত্র হলে আমাদের অন্তর ভগন্মুখী হয়ে ওঠে এবং তখন আমাদের সমস্ত কর্তব্যকর্মই ভগবানের ইচ্ছানুসারে সাধিত হয়, ফলে আমরা সুখী হতে পারি। এমন নয় যে, কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে হলে আমাদের সমস্ত কর্তব্যকর্ম ত্যাগ করতে হবে। কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হবার উপায় হচ্ছে কর্তব্যকর্মকে পবিত্র করা। এই পবিত্র কর্মেরই নাম ভক্তি। ভক্তির বশবর্তী হয়ে যে কর্ম করা হয়, আপাতদৃষ্টিতে তাকে সাধারণ কর্ম বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এই কর্মকে কোন রকম কলুষতা কখনো স্পর্শ করতে পারে না। ভগবানের ভক্তকে দেখে একজন মূর্খ লোক মনে করতে পারে যে, তিনি সাধারণ মানুষের মতোই কাজ করে চলেছে, কিন্তু সেটি তার নির্বুদ্ধিতা। সে বুঝতে পারে যে, ভগবদ্ভক্ত অথবা ভগবানের কার্যকলাপ অপবিত্র চেতনা বা জড়ের দ্বারা কলুষিত হয়না, সেই সমস্ত ত্রিগুণাতীত। তবে আমাদের মনে রাখা উচিত যে, আমাদের চেতনা এখন কলুষিত এবং তাই ভক্তিযোগ সাধন করার মাধ্যমে আমাদের চেতনাকে কলুষমুক্ত করতে হবে।

আমরা যখন জড়ের প্রভাবে কলুষিত থাকি, তখন আমাদের সেই অবস্থাকে বলা হয় বদ্ধ অবস্থা। এই বদ্ধ অবস্থায় আমাদের চেতনা বিকৃত হয়ে থাকে এবং তার ফলে আমরা মনে করি যে, জড় পদার্থ থেকে আমরা উদ্ভূত হয়েছি। এরই নাম অহংকার। যে মানুষ তার দেহগত চিন্তায় মগ্ন, সে কখনো তার স্বরূপ জানতে পারে না। ভগবান ভগবদগীতায় বলেছিলেন, যাতে মানুষ তার দেহগত ভাবনাকে অতিক্রম করে তার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে। ভগবানের কাছ থেকে এই জ্ঞান লাভ করার জন্যই অর্জুন নিজেকে সেই অবস্থায় উপস্থাপিত করেছিলেন। দেহাত্মবুদ্ধি থেকে অবশ্যই মুক্তি লাভ করতে হবে; আধ্যাত্মবাদীদের সেটিই প্রাথমিক কর্তব্য। এই জড় বন্ধন হতে যে মুক্ত হতে চায়, তাকে প্রথমে জানতে হবে যে, তার প্রকৃত স্বরূপ তার জড় দেহটি নয়। মুক্তির অর্থই হচ্ছে জড় চেতনা থেকে মুক্ত হওয়া। শ্রীমদ্ভগবতেও মুক্তির অর্থ ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, মুক্তিরহিত্বান্যথারূপং স্বরূপেণ ব্যবস্থিতিঃ – মুক্তির অর্থ হচ্ছে এই জড় জগতের কলুষিত চেতনা থেকে মুক্ত হয়ে শুদ্ধ চেতনার স্তরে অবস্থিত হওয়া। ভগবদগীতার প্রতিটি নির্দেশই এই পবিত্র শুদ্ধ চেতনার স্তরে অবস্থিত হওয়ার কথা বলেছে এবং তাই আমরা দেখতে পাই যে, ভগবদগীতার শেষ পর্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জিজ্ঞেস করছেন যে, তাঁর চেতনা কলুষমুক্ত হয়ে পবিত্র হয়েছে কি না। পবিত্র বা বিশুদ্ধ চেতনা বলতে বোঝায় ভগবানের নির্দেশ অনুসারে কর্ম করা। এই হচ্ছে বিশুদ্ধ চেতনার মর্মার্থ। আমরা যেহেতু ভগবানের অপরিহার্য অংশ, তাই আমরা চেতন, কিন্তু জড়া প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসার ফলে প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা আমাদের চেতনা প্রভাবান্বিত হয়ে পড়ে। কিন্তু ভগবান যেহেতু পরমেশ্বর, তাই তিনি কখনোই এর দ্বারা প্রভাবান্বিত হন না। ক্ষুদ্র স্বতন্ত্র জীব ও ভগবানের মধ্যে এটিই হচ্ছে পার্থক্য।

এই চেতনা বলতে কি বোঝায়? এই চেতনা হচ্ছে “আমি আছি” তারপর আমি কি? কলুষিত চেতনায় এই আমি মানে, “আমি হচ্ছি সমস্ত জগতের অধীশ্বর। আমি হচ্ছি ভোক্তা।“ এই জগৎ প্রতিনিয়তই আবর্তিত হচ্ছে, কারণ প্রত্যেকটি জীবসত্তা মনে করে যে, সেই হচ্ছে এই জড় জগতের স্রষ্টা ও অধীশ্বর। জড় চেতনার দুটি প্রকাশ হয়। তার একটির প্রভাবে জীব মনে করে সে হচ্ছে স্রষ্টা এবং অন্যটির প্রভাবে সে মনে করে সে হচ্ছে ভোক্তা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পরমেশ্বর ভগবানই হচ্ছেন সব কিছুর স্রষ্টা ও ভোক্তা, আর জীব ভগবানের অপরিহার্য অংশ হবার ফলে সে স্রষ্টাও নয়, ভোক্তাও নয়, সে হচ্ছে সহায়ক। সে হচ্ছে সৃষ্ট ও ভোগ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ঠিক তেমনই ভগবানের অংশ হবার ফলে জীবের একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে ভগবানের কাজে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করা। হাত, পা, চোখ, মুখ আদি হচ্ছে দেহের অংশ, কিন্তু তারা কখনোই ভোক্তা নয়। ভোক্তা হচ্ছে উদর, এগুলি সমষ্টিগতভাবে কাজ করে উদরকে ভোগ করতে সাহায্য করে। যেমন পা দেহকে বহন করে নিয়ে চলে, হাত খাদ্য সংগ্রহ করে, দাঁত চর্বণ করে। এভাবে সমস্ত দেহই উদরকে ভোগ করতে সহযোগিতা করে, কারণ উদর তুষ্ট হলে সমস্ত দেহ পুষ্ট হয়। তাই সব কিছু উদরকে দেওয়া হয় এবং তার ফলে সমস্ত দেহ বলিষ্ঠ ও সক্রিয় হয়। গাছের গোড়ায় জল দিলে যেমন সমস্ত গাছটিকে জল দেওয়া হয়, উদরকে খাদ্য দিলে যেমন দেহতে খাদ্য দেওয়া হয়, ঠিক তেমনই পরম স্রষ্টা ও পরম ভোক্তা ভগবানের সৃষ্টি কার্যে ও ভোগের কার্যে সহযোগিতা করাই আমাদের কর্তব্য। এভাবে তাঁকে তুষ্ট করার ফলেই আমাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য সফল হয়। যদি হাতের আংগুল মনে করে, উদরকে না দিয়ে সে নিজেই সব কিছু খাবে, তা হলে তাকে নিরাশ হতে হবে। ঠিক তেমনই জীব যদি মনে করে, ভগবানকে বাদ দিয়ে সে নিজেই সুখী হবে, তবে তাকে নিরাশ হতে হবে। ভগবান সৃষ্টিকর্তা এবং তিনিই হচ্ছেন একমাত্র ভোক্তা, আর সমস্ত জীব হচ্ছে তাঁর সহায়ক। ভগবানের সহায়তা করার মাধ্যমে জীব তার অস্তিত্বের সার্থকতা উপলব্ধি করতে পারে এবং তার ফলেই সে আনন্দ উপভোগ করতে পারে। ভগবানের সঙ্গে জীবের সম্পর্ক হচ্ছে প্রভু ও ভৃত্যের সম্পর্ক। প্রভু যদি সম্পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট হয়, তবে ভৃত্যও সন্তুষ্ট হয়। সেই রকম, পরমেশ্বর ভগবানকে সন্তুষ্ট করা উচিত। যদিও সৃষ্টিকর্তা হওয়ার প্রবণতা এবং জড় জগত উপভোগের প্রবণতা জীবদের মধ্যেও রয়েছে, কেননা প্রকাশমান জগতের সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বর ভগবানের মধ্যে সেই একই প্রবণতা বিদ্যমান।

সুতরাং ভগবদগীতাতে আমরা দেখতে পাব যে,  পরম নিয়ন্তা, নিয়ন্ত্রণাধীন জীবসকল, নিখিল জগৎ, মহাকাল ও কর্ম – এই সব নিয়েই পূর্ণ সত্তা বিরাজিত, এবং সব কিছুরই আলোচনা এখানে ব্যাখ্যা করা আছে। এগুলি এক সাথে নিয়েই পূর্ণ পরম সত্তা গঠিত হয়। এই পূর্ণ সত্তাকে বলা হয় পরমতত্ত্ব। এই পূর্ণ সত্তা ও পূর্ণ পরমতত্ত্ব হচ্ছেন পূর্ণ পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁরই বিভিন্ন শাক্তির ফলে সমস্ত কিছুরই অভিপ্রকাশ ঘটে থাকে। তিনিই হচ্ছেন সম্যকভাবে পূর্ণ।

গীতাতে এই কথাও বলা হয়েছে যে, নির্বিশেষ ব্রক্ষ্মও হচ্ছে পূর্ণ পরম পুরুষের অধীন (ব্রক্ষ্মণো হি প্রতিষ্ঠাহম)। নির্বিশেষ ব্রক্ষ্মের আরো বিশদ ব্যাখ্যা করে ব্রক্ষ্মসূত্রতে বলা হয়েছে যে, নির্বিশেষ ব্রক্ষ্ম হচ্ছে সূর্যরশ্মির মতো। নির্বিশেষ ব্রক্ষ্ম হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের রশ্মিচ্ছটা। তাই, নির্বিশেষ ব্রক্ষ্ম হচ্ছে পূর্ণ পরম তত্ত্বের অসম্পূর্ণ উপলব্ধি এবং পরমাত্মার ধারণাও সেই রকম। ভগবদগীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ে দেখা যাবে যে, পরমাত্মা উপলব্ধিও ভগবানের পূর্ণ উপলব্ধি নয়। কারণ পরমাত্মা হচ্ছে ভগবানের আংশিক প্রকাশ। ভগবদগীতাতে আমরা জানতে পারি যে, পুরুষোত্তম ভগবান হচ্ছেন নির্বিশেষ ব্রক্ষ্ম ও পরমাত্মা উভয়েরই ঊর্ধ্বে পরমতত্ত্ব। ভগবান হচ্ছেন সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ। ব্রক্ষ্মসংহিতার শুরুতেই বলা হয়েছে – ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ/অনাদিরাগিদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম। “পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বা গোবিন্দ হচ্ছেন সর্বকারণের কারণ, অনাদির আদি গোবিন্দ এবং সৎ (শাশ্বত সনাতন) বৈশিষ্ট্যের উপলব্ধি। পরমাত্মা-উপলব্ধি হচ্ছে সৎ-চিৎ (অনন্ত জ্ঞান) রূপের উপলব্ধি। কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করা হচ্ছে তাঁর সৎ, চিৎ ও আনন্দের অপ্রাকৃত রূপকে পূর্ণভাবে অনুভব করা।

অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা মনে করে যে, পরমতত্ত্ব হচ্ছেন নির্বিশেষ, তাঁর কোন রূপ নেই, কোন আকার নেই, কিন্তু তাদের এই ধারণাটি ভুল। তিনি হচ্ছেন অপ্রাকৃত চিন্ময় পুরুষ; সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রে এই কথা দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাম। (কঠ উপনিষদ ২/২/১৩) যেমন আমরা সকলে স্বতন্ত্র জীব এবং আমাদের ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য আছে, তেমনই প্রম তত্ত্বের সর্বোচ্চ স্তরে যিনি সর্বকারণের কারণ, তাঁরো রূপ আছে। তিনি পুরুষ, তিনি ভগবান এবং প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত সমস্ত কিছুরই উৎস হচ্ছেন তিনিই। তাঁকে উপলব্ধি করা হলে তাঁর অপ্রাকৃত রূপের সব কিছুই উপলব্ধি করা হয়ে যায়। যিনি স্বয়ং পূর্ণ, তিনি কখনোই নির্বিশেষ হতে পারেন না। যদি তিনি নির্বিশেষ হন, যদি তিনি কোন কিছু থেকে ন্যূন হন, তবে তিনি পূর্ণ হবেন কেমন করে? আমাদের অভিজ্ঞতায় যা আছে এবং যা আমাদের অভিজ্ঞতার অতীত, তা সবই ভগবানের মধ্যে বিদ্যমান। নতুবা তা পুরণতত্ত্ব হতে পারে না।

সম্যক সম্পূর্ণ পুরুষোত্তম ভগবানের মধ্যে রয়েছে বিপুল শক্তিরাজি (পরাস্য শক্তিবিবিধৈব শ্রূয়তে)। শ্রীকৃষ্ণের শক্তির বিভিন্ন প্রকাশ কিভাবে হয়, তাও ভগবদগীতাতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই যে পরিদৃশ্যমান জগৎ অথবা অনিত্য জড় জগৎ, যাতে আমরা অধিষ্ঠিত হয়েছি, এটিও স্বয়ং পূর্ণ, কারণ যে চব্বিশটি উপাদান দ্বারা এই জড় জগৎ অনিত্যরূপে অভিব্যক্ত হয়েছে, সাংখ্য দর্শন অনুযায়ী, তাদের সম্যকরূপে সমন্বয়ের ফলে উদ্ভূত হয়েছে পূর্ণ সম্পদ, যা এই ব্রক্ষ্মন্ডের অস্তিত্ব ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অপরিহার্য। এর মধ্যে কোন কিছুই অতিরিক্ত নেই, আবার অন্য কিছুর দরকারও নেই। এই অভিপ্রকাশের স্থায়িত্ব প্রম পূর্ণের শক্তির দ্বারা নির্ধারিত নিজস্ব সময়ের উপর নির্ভরশীল। সেই সময় শেষ হয়ে গেলে, পরম পূর্ণের পূর্ণ ব্যবস্থার নির্দেশে এই অস্থায়ী অভিব্যক্তির লয় হয়ে যায়। এখানে জীবও তার ক্ষুদ্র সত্তা নিয়ে পূর্ণ এবং পরম পূর্ণ ভগবানকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করবার সমস্ত সুযোগ-সুবিধা সমস্ত জীবেরই আছে। স্বয়ংসম্পূর্ণ ভগবানের সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান অপূর্ণ, তাই আমরা সব রকমের অপূর্ণতা অনুভব করি। ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞানের পূর্ণ প্রকাশ হয়েছে বেদে এবং বৈদিক জ্ঞান পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়েছে ভগবদগীতাতে।

বেদের সমস্ত জ্ঞানই অভ্রান্ত। হিন্দুরা জানে যে, বেদ পূর্ণ ও অভ্রান্ত। যেমন স্মৃতি, অর্থাৎ বৈদিক অনুশাসন অনুযায়ী পশুর মল অপবিত্র এবং তা স্পর্শ করলে স্নান করে পবিত্র হতে হয়। আবার বৈদিক শাস্ত্রেই বলা হচ্ছে যে, গোময় পশুর মল হলেও তা পবিত্র, এমনকি কণ স্থান যদি অপবিত্র হয়ে থাকে, তবে সেখানে গোময় লেপন করলে তা পবিত্র হয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে এটি পরস্পরবিরোধী উক্তি বলে মনে হতে পারে, কিন্তু বৈদিক অনুশাসন বলেই এটি গ্রহণ করা হয়েছে এবং এটি গ্রহণ করে কেউ ভুল করেছে, তা বলা হয় না। পরবর্তীতে আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়েছে যে, গোময়ে সব কয়টি জীবাণুনাশক গুণ বর্তমান রয়েছে। সুতরাং বৈদিক জ্ঞান সম্পূর্ণরূপে অভ্রান্ত এবং তাই বেদকে নিঃশঙ্কচিত্তে অনুসরণ করা যায়। বৈদিক জ্ঞান সব রকম সন্দেহ ও ভ্রান্তির অতীত, এবং ভগবদগীতা হচ্ছে সমস্ত বৈদিক জ্ঞানের সারাংশ।

বৈদিক জ্ঞান নিয়ে গবেষণা চলে না। গবেষণা বলতে সাধারণত যা বোঝায়, তা ত্রুটিপূর্ণ, কারণ ত্রুটিপূর্ণ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে ঐ সব গবেষণা হয়ে থাকে। ত্রুটিহীন, অভ্রান্ত জ্ঞান আমাদের ভগবদগীতা থেকে গ্রহণ করতে হবে, যার উৎস হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান এবং যা গুরু-শিষ্য পরম্পরাক্রমে সম্পূর্ণ অপরিবর্তিতভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। অর্জুন যখন শিষ্যরূপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে গীতার জ্ঞান আহরণ করেন, তখন তিনি কোন রকম বাদানুবাদ না করে, ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণীকে পরম সত্য বলে গ্রহণ করেছিলেন। ভগবদগীতাকে আংশিকভাবে গ্রহণ করা চলে না। আমরা বলতে পারি না যে, ভগবদগীতার একটি অংশ আমরা গ্রহণ করব, আর বাঁকিটা গ্রহণ করব না। ভগবদগীতার বাণী সম্পূর্ণ অপরিবর্তিতভাবে খেয়ালখুশি মতো বাদ না দিয়ে কিংবা মনগড়া ব্যাখ্যা না করেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যেভাবে তা বলেছিলেন, ঠিক সেভাবেই ভগবদগীতার যথাযথ নির্দেশ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, গীতা হচ্ছে বৈদিক জ্ঞানের পূর্ণ প্রকাশ। বৈদিক জ্ঞান এই জড় জগতের জ্ঞান নয়, এর প্রবর্তক হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান, তাই বেদের জ্ঞান হচ্ছে দিব্যজ্ঞান। অপ্রাকৃত উৎস থেকে বৈদিক জ্ঞান গ্রহণ করতে হয় এবং এর বাণী প্রথম নিঃসৃত হয়েছিল স্বয়ং ভগবানের কাছ থেকেই। ভগবানের মুখ নিঃসৃত বাণীকে বলা হয় অপৌরুষেয়, অর্থাৎ ভগবানের কথা সাধারণ মানুষের কথার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ, সাধারণ মানুষ চারটি ত্রুটির দ্বারা কলুষিত – (১) ভ্রম, (২) প্রমাদ, (৩) বিপ্রলিস্পা, (৪) করণাপাটব। ভ্রম – সাধারণ মানুষ অবধারিতভাবে ভুল করে; প্রমাদ – সে মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন; বিপ্রলিস্পা – সে অন্যকে প্রতারণা করতে চেষ্টা করে এবং করণাপাটব – সে তার ত্রুটিপূর্ণ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সীমিত। এই সমস্ত ত্রুটি থাকার ফলে মানুষ সর্বপরিব্যপ্ত পরম জ্ঞান গ্রহণ করতে ও প্রদান করতে অক্ষম।

বৈদিক জ্ঞান এই ধরণের ত্রুটিপূর্ণ জীবদের দ্বারা প্রদত্ত হয়নি। প্রথম সৃষ্ট জীব ব্রক্ষ্মার হৃদয়ে ভগবান সর্বপ্রথমে এই জ্ঞান প্রদান করেন, তারপর ব্রক্ষ্মা যেভাবে পরমেশ্বরের কাছ থেকে সেই জ্ঞান পেয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই তাঁর সন্তান ও শিষ্যদের মধ্যে তা বিতরণ করেন। ভগবান হছেন পূর্ণ, জড়া প্রকৃতির নিয়মের দ্বারা তাঁর কখনোই প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই যারা যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন তাঁরা বুঝতে পারেন, ভগবানই হচ্ছেন আদি স্রষ্টা – ব্রক্ষ্মাকে তিনিই সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই হচ্ছেন এই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের সমস্ত কিছুর ভোক্তা। ভগবদগীতার একাদশ অধ্যায়ে ভগবানকে প্রপিতামহ বলে বর্ণনা করা হয়েছে, কারণ তিনি পিতামহ ব্রক্ষ্মারও পিতা। এভাবে সর্বত্রই আমরা দেখতে পাই যে, ভগবানই হচ্ছেন সব কিছুর স্রষ্টা। তাই আমাদের কখনোই মনে করা উচিত নয়, আমরা কোন কিছুর মালিক। মালিক কেবল তিনিই, যিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। জীবন ধারণ করার জন্য যেটুকু প্রয়োজন এবং ভগবান আমাদের জন্য যতটুকু নির্ধারিত করে রেখেছেন, ঠিক ততটুকুই আমাদের গ্রহণ করা উচিত।

আমাদের জন্য ভগবান যতটুকু নির্ধারিত করে রেখেছেন, তা কিভাবে সদ্ব্যবহার করতে হবে তার অনেক সুন্দর সুন্দর উদাহরণ আছে। ভগবদগীতাতেও এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রারম্ভে অর্জুন ঠিক করেন তিনি যুদ্ধ করবেন না। এটি ছিল তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত। অর্জুন পরমেশ্বর ভগবানকে বলেন যে, সেই যুদ্ধে নিজের আত্মীয়-পরিজনদের হত্যা করে রাজভোগ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। দেহাত্মবুদ্ধির ফলে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন যে, তাঁর প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে তাঁর দেহ, এবং তাঁর দেহজাত আত্মীয়-পরিজন, ভাই, ভাইপো, ভগ্নীপতি, পিতামহ প্রভৃতিকে তিনি তাঁর আপনজন বলে মনে করেছিলেন। তাই তিনি তাঁর দেহের দাবীগুলি মেটাতে চেয়েছিলেন। তাঁর ঐ ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার জন্যই ভগবান ভগবদগীতার দিব্যজ্ঞান তাঁকে দান করেন। এই জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে তার প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারার ফলেই অর্জুন ভগবানের পরিচালনায় যুদ্ধ করতে ব্রতী হন। তখন তিনি বলেন, করিষ্যে বচনং তব – “তুমি যা বলবে আমি তাই করব।“

এই পৃথিবীতে মানুষ কুকুর-বেড়ালের মতো ঝগড়া করে দিন কাটাবার জন্য আসেনি। তাকে তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মানব-জীবনের যথার্থ উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে এবং একটি পশুর মতো জীবন যাপন করা বর্জন করতে হবে। সমস্ত বৈদিক শাস্ত্র মানব-জীবনের যথার্থ উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নির্দেশ দিচ্ছে, এবং সমস্ত বৈদিক জ্ঞানের সারাংশ ব্যক্ত হয়েছে ভগবদগীতাতে। বৈদিক সাহিত্য মানুষের জন্য, পশুদের জন্য নয়। তাই প্রতিটি মানুষের কর্তব্য হচ্ছে বৈদিক জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করে মানব জীবন সার্থক করে তোলা। কোন পশু যখন অন্য পশুকে হত্যা করে, তাতে তার পাপ হয় না, কিন্তু মানুষ যদি তার বিকৃত রুচির তৃপ্তি সাধনের জন্য কোন পশুকে হত্যা করে, তখন সে প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করার অপরাধে অপরাধী হয়। ভগবদগীতাতে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে যে, প্রকৃতির বিভিন্ন গুণ অনুসারে তিন রকমের কর্ম সাধিত হয়, যথা – সত্ত্বগুণের প্রভাবে কর্ম, রজোগুণের প্রভাবে কর্ম এবং তমোগুণের প্রভাবে কর্ম। তেমনই আহার্য বস্তুও আছে তিন ধরণের – সত্ত্বগুণের আহার, রজোগুণের আহার, আর তমোগুণের আহার। এই সবই পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা আছে এবং যদি আমরা ভগবদগীতার এই সব নির্দেশ যথার্থভাবে কাজে লাগাই, তা হলে আমাদের সারা জীবন পবিত্র হয়ে উঠবে এবং পরিণামে আমরা এই জড় জগতের আকাশের ঊর্ধ্বে আমাদের পরম লক্ষ্যে উপণীত হতে পারব (যদ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম)।

এই পরম গন্তব্যস্থলের নাম ‘সনাতন ধাম’। সেই নিত্য শাশ্বত অপ্রাকৃত জগৎই হচ্ছে আমাদের প্রকৃত আলয়। এই জড় জগতে আমরা দেখতে পাই সব কিছু অস্থায়ী। তাদের প্রকাশ হয়, কিছুকালের জন্য তারা অবস্থান করে, কিছু ফল প্রসব করে, ক্ষয় প্রাপ্ত হয় এবং তারপর এক সময় তারা অদৃশ্য হয়ে যায়। এটিই হচ্ছে এই জড় জগতের ধর্ম, আমাদের এই দেহ, অথবা এক টুকরো ফল অথবা অন্য যে-কোন কিছুরই দৃষ্টান্ত আমরা দিই না কেন। কিন্তু এই অস্থায়ী জগতের অতীত আর একটি জগৎ আছে, যার কথা আমরা জানতে পারি বৈদিক শাস্ত্রের মাধ্যমে। সেই জগৎ শাশ্বত, সনাতন। বৈদিক শাস্ত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি জীবও শাশ্বত, সনাতন। ভগবদগীতার একাদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ভগবান সনাতন এবং সনাতন ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হবার ফলে জীবাত্মাও সনাতন। ভগবানের সঙ্গে আমাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রয়েছে, এবং যেহেতু গুণগতভাবে সনাতন ধাম, সনাতন ভগবান ও সনাতন জীব – সবই এক, তাই ভগবদগীতার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের সনাতন বৃত্তি অথবা আমাদের সনাতন ধর্মকে পুনর্জাগরিত করা। অস্থায়ীভাবে আমরা নানা ধরণের কর্মে নিয়োজিত হয়ে রয়েছি, কিন্তু এই সমস্ত কর্ম পবিত্রতা অর্জন করতে পারে, যদি আমরা এই সমস্ত অস্থায়ী কর্ম বর্জন করি আর পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ মতো কর্মভার গ্রহণ করি। এরই নাম পবিত্র জীবন।

ভগবান ও তাঁর দিব্যধাম উভয়ই সনাতন। জীবও সনাতন। জীব যখন তার সনাতন প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলে সনাতন ধামে ভগবানের সান্নিধ্যে আসে, তখনই তার জীবন সার্থক হয়ে ওঠে। যেহেতু সমস্ত জীব পরমেশ্বরেরই সন্তান, সেই কারণে তাদের সকলেরই প্রতি তিনি পরম করুণাময়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদগীতাতে (১৪/৪) বলেছেন, সর্বযোনিষু কৌন্তেয় মূর্তয়ঃ সম্ভবন্তি যাঃ/তাসাং ব্রক্ষ্ম মহদযোনিরহং বীজপ্রদঃ পিতা – “হে কৌন্তেয়! সমস্ত যোনিতে যে সমস্ত দেহ উৎপন্ন হয়, ব্রক্ষ্মরূপা প্রকৃতিই তাদের জননী এবং আমিই বীজ প্রদানকারী পিতা।“ অবশ্যই বিভিন্ন কর্ম অনুসারে সব রকমের জীব রয়েছে, কিন্তু এখানে ভগবান বলেছেন যে, তিনি সকলেরই পিতা। তাই এই পৃথিবীতে ভগবান অবতরণ করেন এই সমস্ত পতিত, বদ্ধ জীবাত্মাদের উদ্ধার করবার জন্য, যাতে তারা তাদের শাশ্বত সনাতন অবস্থা ফিরে পেয়ে ভগবানের সঙ্গে চিরন্তন সঙ্গ লাভ করে এবং সনাতন শাশ্বত চিদাকাশে আবার অধিষ্ঠিত হতে পারে। ভগবান স্বয়ং বিভিন্ন অবতাররূপে অবতরণ করেন, কখনো বা তিনি তাঁর বিশ্বস্ত অনুচরকে অথবা তাঁর প্রিয় সন্তানকে পাঠান, কখনো বা তাঁর অনুগামী ভৃত্যকে বা আচার্যকে পাঠান বদ্ধ জীবাত্মাদের উদ্ধার করবার জন্য।

তাই সনাতন ধর্ম বলতে কোন সাম্প্রদায়িক ধর্মপদ্ধতিকে বোঝায় না। এটি হচ্ছে পরম শাশ্বত ভগবানের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত নিত্য শাশ্বত জীবসকলের নিত্য ধর্ম। আগেই বলা হয়েছে, সনাতন ধর্ম হচ্ছে জীবের নিত্য ধর্ম। শ্রীপাদ রামানুজাচার্য সনাতন শব্দটির ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “যার কোন শুরু নেই এবং শেষ নেই।“ তাই যখন আমরা সনাতন ধর্মের কথা ব্লি, শ্রীপাদ রামানুজাচার্যের নির্দেশানুসারে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই ধর্মের আদি নেই এবং অন্ত নেই।

বর্তমান জগতে ধর্ম বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি, সনাতন ধর্ম ঠিক তা নয়। ধর্ম বলতে সাধারণত কোন বিশ্বাসকে বোঝায়, এবং এই বিশ্বাসের পরিবর্তন হতে পারে। কোন বিশেষ পন্থার প্রতি কারও বিশ্বাস থাকতে পারে, এবং সে এই বিশ্বাসের পরিবর্তন করে অন্য কিছু গ্রহণ করতেও পারে। কিন্তু সনাতন ধর্ম বলতে সেই সব কার্যকলাপকে বোঝায়, যা পরিবর্তন হতে পারে না। যেমন, জল থেকে তার তরলতা কখনোই বাদ দেওয়া যায় না, আগুন থেকে যেমন তাপ ও আলোককে বাদ দেওয়া যায় না, তেমনই সনাতন জীবের সনাতন বৃত্তি জীবের থেকে আলাদা করা যায় না। জীবের সঙ্গে তার সনাতন ধর্ম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সুতরাং যখন আমরা সনাতন ধর্মের কথা বলি, তখন শ্রীপাদ রামানুজাচার্যের প্রামাণ্য ভাষ্য মেনে নিতে হবে যে, এর কোন আদি-অন্ত নেই। যার কোন আদি নেই, অন্ত নেই, সেই ধর্ম কখনোই সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। এই ধর্ম সমস্ত জীবের ধর্ম, তাই তাকে কখনোই কোন   সীমার মধ্যে সীমিত রাখা যায় না। একে কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে বদ্ধ রাখাও চলে না। কিন্তু তবুও কিছু সাম্প্রাদায়িক লোক মনে করে যে, ‘সনাতন ধর্মও’ একটি সাম্প্রদায়িক ধর্ম, কিন্তু এটি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্কীর্ণতা ও বিকৃত বুদ্ধিজাত অন্ধতার প্রকাশ। আমরা যখন আধুনিক বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে সনাতন ধর্মের যথার্থতা বিশ্লেষণ করি, তখন দেখি যে এই ধর্ম পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ধর্ম – শুধু তাই নয়, এই ধর্ম সমগ্র বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের প্রতিটি জীবের ধর্ম।

অসনাতন ধর্ম বিশ্বাসের সূত্রপাতের ইতিহাস পৃথিবীর ইতিহাসের বর্ষপঞ্জিতে লেখা থাকতে পারে, কিন্তু সনাতন ধর্মের সূত্রপাতের কোন ইতিহাস নেই, কারণ সনাতন ধর্ম সনাতন জীবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত থেকে চিরকালই বর্তমান। জীব সম্বন্ধেও শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, সে জন্ম-মৃত্যুর অতীত। ভগবদগীতাতে বলা হয়েছে যে, জীবের জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। সে শাশ্বত ও অবিনশ্বর এবং তার দেহের মৃত্যু হলেও তার কখনোই মৃত্যু হয় না। সনাতন ধর্ম বলতে যে ধর্ম বোঝায়, তা আমাদের বুঝতে হবে ধর্ম কথাটির সংস্কৃত অর্থের মাধ্যমে। ধর্ম বলতে বোঝায় যা অপরিহার্য অঙ্গরূপে কোন কিছুর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাপ ও আলোক ছাড়া আগুনের কোন রকম প্রকাশ হতে পারে না। তেমনই, জীবের অপরিহার্য অঙ্গ কি? জীবের অস্তিত্বের প্রকাশ কিভাবে হয়? তার নিত্য সঙ্গীরূপে যা তার সঙ্গে চিরকাল বিদ্যমান তা কি? তার এই নিত্য সঙ্গী হচ্ছে তার শাশ্বত গুণবৈশিষ্ট্য, এবং এই শাশ্বত গুণবৈশিষ্ট্যই হচ্ছে তার সনাতন ধর্ম।

সনাতন গোস্বামী যখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে জীবের স্বরূপ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেন, তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেন, “জীবের ‘স্বরূপ’ হয় – কৃষ্ণের নিত্যদাস।“ পরম পুরুষোত্তম ভগবানের নিত্যদাসত্বই হচ্ছে জীবের স্বরূপ-বৈশিষ্ট্য। শ্রীমন্মহাপ্রভুর এই উক্তির বিশ্লেষণ যদি আমরা করি, তা হলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, প্রতিটি জীবই সর্বক্ষণ কারও সেবায় ব্যস্ত। এভাবে অপরের সেবা করার মাধ্যমেই জীব জীবনকে উপভোগ করে। নীচুস্তরের পশুরা ভৃত্য যেভাবে প্রভুর সেবা করে, ঠিক সেভাবে মানুষের সেবা করে। মানুষের ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই যে, ‘খ’ প্রভুকে ‘ক’ দেবা করে, ‘গ’ প্রভুকে ‘খ’ সেবা করে, আর ‘গ’ সেবা করে ‘ঘ’ প্রভুকে। এভাবে সকলেই কারও না কারও দাসত্ব করে চলেছে। এই পরিবেশে আমরা দেখতে পাই, বন্ধু বন্ধুর সেবা করে, মা সন্তানের সেবা করে, স্ত্রী স্বামীর সেবা করে, স্বামী স্ত্রীর সেবা করে ইত্যাদি। এভাবে খোঁজ করলে দেখা যাবে যে, জীবকুলের সমাজে সেবামূলক কাজের কোন অন্যথা নেই।রাজনীতিবিদেরা জনগণের কাছে তাদের নানা প্রতিশ্রুতি শুনিয়ে তাদের সেবার ক্ষমতা বোঝাবার চেষ্টা করে থাকে। ভোটদাতারা তাই মনে করে যে, রাজনীতিবিদেরা সমাজের খুব ভাল সেবা করতে পারবে, তাই তারা তাদের মূল্যবান ভোট তাদের দিয়ে দেয়। দোকানদার খরিদ্দারের সেবা করে এবং শিল্পী ধনিক সম্প্রদায়ের সেবা করে। ধনিক সম্প্রদায় তাদের পরিবারের সেবা করে এবং পরিবারের প্রতিটি সদস্য নিত্য জীবের নিত্য সামর্থ্য অনুযায়ী রাষ্ট্র ও সমাজের সেবা করে। এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, কোন জীবই অপ্র কোন জীবের সেবা না করে থাকতে পারে না। এর ফলে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে, সেবা হচ্ছে জীবের সর্বকালীন সাথী এবং সেবাকার্যই হচ্ছে জীবের শাশ্বত ধর্ম।

তবুও মানুষ দেশ-কাল-পাত্র অনুসারে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদির ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করার ফলে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়ে পড়ে। এই ধরণের ধর্মবিশ্বাস কখনোই সনাতন ধর্ম নয়। কোন হিন্দু তার বিশ্বাস পরিবর্তন করে মুসলমান হতে পারে অথবা কোন মুসলমান তার ধর্ম পরিবর্তন করে হিন্দু হতে পারে, কিংবা কোন খৃষ্টান তার বিশ্বাস বদলাতে পারে। কিন্তু এই ধর্ম-বিশ্বাসের পরিবর্তন হলেও, অপরকে সেবা করার যে শাশ্বত প্রবৃত্তি মানুষের আছে, তার কোন পরিবর্তন হয় না। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান যে কোন ধর্মাবলম্বীই হোক না কেন, মানুষ প্রতিনিয়তই অপরের সেবা করে চলেছে। তাই যে কোন ধর্ম-বিশ্বাসকে অবলম্বন করা এবং সনাতন ধর্মাচরণ করার অর্থ এক নয়। সেবা করাই হচ্ছে সনাতন ধর্ম।

বাস্তবিকই ভগবানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হচ্ছে সেবা করার সম্পর্ক। পরমেশ্বর হচ্ছেন পরম ভোক্তা এবং আমরা, জীবেরা হচ্ছি তাঁর সেবক। তাঁরই সন্তোষ বিধানের জন্য আমাদের সৃষ্টি হয়েছে এবং ভগবানকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমরা যদি সর্বদাই তাঁর সেবা করে চলি, তবেই আমরা সুখী হতে পারি। এ ছাড়া আর কোনভাবেই সুখী হওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। উদরকে বাদ দিয়ে শরীরের কোন অঙ্গ যেমন স্বতন্ত্রভাবে সুখী হতে পারে না, আমরাও তেমন ভগবানের সেবা না করে সুখী হতে পারি না।

বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করা বা তাঁদের সেবা করা ভগবদগীতাতে অনুমোদন করা হয়নি। সপ্তম অধ্যায়ের বিংশতি শ্লোকে বলা হয়েছে –

কামৈস্তৈস্তৈরহৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ।

তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।।

“জড়-জাগতিক কামনা-বাসনা দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে, তারা তাঁদের স্বীয় স্বভাব অনুযায়ী এবং পূজার বিশেষ নিয়মবিধি পালন করে বিভিন্ন দেব-দেবীদের শরণাগত হয়।“ এখানে পরিষ্কার ভাবেই বলা হয়েছে যে, যারা কামনা-বাসনা দ্বারা পরিচালিত হয়, তারা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা না করেই বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করে। শ্রীকৃষ্ণ বলতে কোন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি-বিশেষের নাম বোঝায় না। শ্রীকৃষ্ণ নামের অর্থ হচ্ছে পরম আনন্দ। পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন সমস্ত আনন্দের উৎস, সমস্ত আনন্দের আধার। আমরা সকলেই আনন্দের অভিলাষী। আনন্দময়োহভ্যাসাৎ (বেয়ান্তসূত্র ১/১/১২)। ভগবানের অংশ হবার ফলে জীব চৈতন্যময় এবং তাই সে সর্বদাই আনন্দের অনুসন্ধান করে। ভগবান সদানন্দময়, তিনি সমস্ত আনন্দের আধার, তাই জীব যখন ভগবন্মুখী হয়ে সর্বতোভাবে ভগবানের সেবাপরায়ণ হয়ে তাঁর সান্নিধ্যে আসে, তখন তার চিরবাঞ্ছিত দিব্য আনন্দ সে অনুভব করতে পারে।

ভগবান এই মর্ত্যলোকে অবতরণ করেন তাঁর আনন্দময় বৃন্দাবন-লীলা প্রদর্শন করার জন্য। এই বৃন্দাবন-লীলা হচ্ছে আনন্দের চরম প্রকাশ। শ্রীকৃষ্ণ যখন বৃন্দাবনে থাকেন, তখন সেখানে রাখাল বালকদের সঙ্গে, গোপ-বালিকাদের সঙ্গে, বৃন্দাবনবাসীদের সঙ্গে এবং গাভীদের সঙ্গে তাঁর সমস্ত লীলা হচ্ছে দিব্য আনন্দে পরিপূর্ণ। বৃন্দাবনের প্রতিটি জীবই কৃষ্ণগত প্রাণ, শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর কিছুই তাঁরা জানেন না। তিনি যে সব কিছুর পরম ভোক্তা, তাঁর পাদপদ্মে আত্মসমর্পণই যে শ্রেষ্ঠ সমর্পণ এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করাটা যে নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন, তা প্রতিপন্ন করবার জন্য তিনি তাঁর পিতা নন্দ মহারাজকেও ইন্দ্রের পূজা করা থেকে নিরস্ত করেন। কারণ তিনি প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলেন যে, অন্য কোন দেব-দেবীর পূজা করবার কোন দরকার নেই মানুষের। পরমেশ্বর ভগবানের সেবা করাই প্রতিটি মানুষের একমাত্র কর্তব্য, কারণ মানব-জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবৎ-ধামে ফিরে যাওয়া।

ভগবদগীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ের ষষ্ঠ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আলয় ভগবৎ-ধামের বর্ণনা করে বলা হয়েছে –

ন তদ ভাসয়তে সূর্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ।

যদ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।।

“আমার পরম ধাম সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি অথবা বৈদ্যুতিক আলোকের দ্বারা আলোকিত নয়। সেখানে একবার পৌঁছলে আর এই জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না।“

এই শ্লোকে সেই চিরশাশ্বত অপ্রাকৃত আকাশের কথা বলা হয়েছে। আকাশ সম্বন্ধে আমাদের একটি জড়-জাগতিক ধারণা আছে। এই জড় আকাশের কথা যখনই আমরা ভাবি, তখন সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র আদির কথা আপনা থেকেই মনে আসে। কিন্তু এই শ্লোকে ভগবান বলেছেন যে, দিব্য আকাশকে আলোকিত করার জন্য সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি অথবা কোন বৈদ্যুতিক আলোর প্রয়োজন হয় না, কারণ সেই আকাশ দিব্য ব্রক্ষ্মজ্যোতির দ্বারা আলোকিত। এই ব্রক্ষ্মজ্যোতি হচ্ছে ভগবানের দেহনির্গত রশ্মিচ্ছটা। অন্যান্য গ্রহাদিতে পৌঁছানোর জন্য আমরা কঠিন পরিশ্রম করছি, কিন্তু পরমেশ্বর আলয় সম্বন্ধে ধারণা করা কিছুই কঠিন পরিশ্রম করছি, কিন্তু পরমেশ্বরের আলয় সম্বন্ধে ধারণা করা কিছুই কঠিন নয়। ভগবানের দিব্য ধামের নাম গোলোক। ব্রক্ষ্মসংহিতায় (৫/৩৭) এই গোলোকের খুব সুন্দর বিবরণ আছে – গোলোক এব নিবসত্যখিলাত্মভূতঃ। ভগবান চিরকালই তাঁর আলয় গোলোকে অবস্থান করেন, তবু এই জগতে থেকেও তাঁর সমীপবর্তী হওয়া যায় এবং এই জগতে ভগবান তাঁর প্রকৃত সচ্চিদানন্দময় রূপ নিয়ে আবির্ভূত হন। তিনি যখন তাঁর এই রূপ নিয়ে প্রকাশিত হন, তখন তাঁর রূপ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করার কোন প্রয়োজনীয়তা আমাদের থাকে না। এই ধরনের জল্পনা-কল্পনা থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করবার জন্য তিনি তাঁর স্বরূপে অবতীর্ণ হন এবং তাঁর শ্যামসুন্দর রূপ প্রদর্শন করেন। দুর্ভাগ্যবশত অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা তাঁকে চিনতে পারে না এবং তাঁকে সাধারণ মানুষ বলে মনে করে উপহাস করে। ভগবান আমাদের কাছে আমাদেরই মতো একজনের রূপ নিয়ে আসেন এবং আমাদের সঙ্গে লীলাখেলা করেন, কিন্তু তাই বলে তাঁকে আমাদের মতো একজন বলে মনে করা উচিত নয়। তাঁর অনন্ত শক্তির প্রভাবে তিনি তাঁর অপ্রাকৃত রূপ নিয়ে আমাদের সামনে আসেন এবং তাঁর লীলা প্রদর্শন করেন। তাঁর আপন আলয় গোলোক বৃন্দাবনে তাঁর যে লীলা, এই লীলা তাঁরই প্রতিরূপ।

চিন্ময় আকাশের ব্রক্ষ্মজ্যোতিতে অসংখ্য গ্রহ ভাসছে। এই ব্রক্ষ্মজ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে পরম ধাম কৃষ্ণলোক থেকে এবং জড় পদার্থ দ্বারা গঠিত নয় সেই রকম অসংখ্য আনন্দময় চিন্ময় গ্রহ সেই ব্রক্ষ্মজ্যোতিতেই ভাসছে। ভগবান বলেছেন – ন তদ ভাসয়তে সূর্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ / যদ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম। যে একবার সেই অপ্রাকৃত আকাশে যায়, তাকে আর এই জড় আকাশে নেমে আসতে হয় না। এই জড়-জাগতিক আকাশে, চাঁদের কথা ছেড়েই দিলাম, যদি মানুষ সবচেয়ে ঊর্ধ্বে যে ব্রক্ষ্মলোক আছে সেখানেও যায়, তবে দেখবে যে, সেখানেও এখানকার মতো জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধির হাত থেকে নিস্তার নেই। এই জড় জগতের কোন গ্রহলোকের পক্ষেই এই চারটি জড় নিয়মের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব নয়।

জীবসকল এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে ভ্রমণ করছে, কিন্তু যে-কোন গ্রহেই আমরা ইচ্ছা করলে যান্ত্রিক উপায়ে যেতে পারি না। অন্যান্য গ্রহে যেতে হলে তার জন্য একটি পদ্ধতি আছে। সেই সম্বন্ধে উল্লেখ আছে যে – যান্তি দেবব্রতা দেবান পিতৃন যান্তি পিতৃব্রতাঃ। আমাদের গ্রহান্তরে ভ্রমণের জন্য কোন যান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না। গীতাতে ভগবান বলেছেন – যান্তি দেবব্রতা দেবান। চন্দ্র, সূর্য আদি উচ্চস্তরের গ্রহদের বলা হয় স্বর্গলোক। গ্রহমণ্ডলীকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে – স্বর্গলোক (উচ্চ), ভূলোক (মধ্য) ও পাতাললোক (নিম্ন)। পৃথিবী ভূলোকের অন্তর্গত। ভগবদগীতা থেকে আমরা জানতে পারি, কিভাবে আমরা দেবলোক বা স্বর্গলোক অতি সহজ প্রক্রিয়ায় যেতে পারি – যান্তি দেবব্রতা দেবান। কোন বিশেষ পূজা গ্রহের বিশেষ দেবতাকে পূজা করলেই সেই গ্রহে যাওয়া যায়। যেমন সূর্যদেবকে পূজা করলে সূর্যলোকে যাওয়ায যায়। চন্দ্রদেবকে পূজা করলে চন্দ্রলোকে যাওয়া যায়। এভাবে যে-কোন উচ্চতর গ্রহলোকেই যাওয়া যায়।

কিন্তু ভগবদগীতা এই জড় জগতের কোন গ্রহলোকে যেতে উপদেশ দিচ্ছে না, কারণ জড় জগতের সর্বোচ্চলোক ব্রক্ষ্মলোকে কোন ধরণের যান্ত্রিক কৌশলে হয়ত চল্লিশ হাজার বছর ভ্রমণ করে (আর ততদিন কেই বা বাঁচবে) গেলেও জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধির জড়-জাগতিক ক্লেশ থেকে সেখানেও নিস্তার পাওয়া যাবে না। কিন্তু যদি কেউ পরম লোক কৃষ্ণলোকে কিংবা চিন্ময় আকাশের অন্য কোন গ্রহে যেতে চায়, তা হলে তাকে সেখানে এই সব জড়-জাগতিক দুর্দশা ভোগ করতে হবে না। চিন্ময় আকাশে যে সমস্ত গ্রহলোক আছে, তার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট হচ্ছে গোলোক বৃন্দাবন, যেখানে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ থাকেন। ভগবদগীতায় এই সব কিছুই বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে এবং জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে কিভাবে সেই চিন্ময় আকাশে ফিরে গিয়ে প্রকৃতই আনন্দময় জীবন শুরু করা যায়, তার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

ভগবদগীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ে এই জড় জগতের প্রকৃত রূপের বর্ণনা করে বলা হয়েছে –

ঊর্ধ্বমূলমধঃশাখমশ্বত্থং প্রাহুরব্যয়ম।

ছন্দাংসি যস্য পর্ণানি যস্তং বেদ স বেদবিৎ।।

“ঊর্ধ্বমূল ও অধঃশাখাবিশিষ্ট একটি অশ্বত্থ গাছ রয়েছে। বৈদিক মন্ত্রগুলিই হচ্ছে  এর পাতা। যে এই গাছটিকে জানে, সে বেদকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করেছে।“ এখানে জড় জগৎকে বলা হয়েছে ঊর্ধ্বমূল ও অধঃশাখাবিশিষ্ট একটি অশ্বত্থ গাছের মতো। সাধারণত গাছের শাখা থাকে ঊর্ধ্বমুখী এবং তার মূল থাকে নিম্নমুখী। কিন্তু আমরা যখন জলাশয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সেই জালে গাছের প্রতিবিম্ব দেখি, তখন দেখতে পাই তার মূল ঊর্ধ্বমুখী এবং তার শাখা অধোমুখী। সেই রকম, এই জড় জগৎ হচ্ছে অপ্রাকৃত জগতের প্রতিবিম্ব। প্রতিবিম্বের কোন স্থায়িত্ব নেই, সে শুধু একটি ছায়া মাত্র। কিন্তু এই ছায়া থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রকৃত বস্তু রয়েছে। মরুভূমিতে জল নেই, কিন্তু মরীচিকার মাধ্যমে আমরা ইঙ্গিত পাই যে, জল বলে একটি পদার্থ আছে। জড় জগতে তেমনই জল নেই, আনন্দ নেই, কিন্তু প্রকৃত আনন্দের, বাস্তবিক জলের সন্ধান রয়েছে অপ্রাকৃত জগতে।

ভগবান ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, নিম্নলিখিত উপায়ে আমরা চিন্ময় জগৎ লাভ করতে পারি (ভঃ গীঃ ১৫/৫)-

নির্মানমোহা জিতসঙ্গদোষা

অধ্যাত্মনিত্যা বিনিবৃত্তকামাঃ।

দ্বন্দ্বৈর্বিমুক্তাঃ সুখদুঃখসংজ্ঞৈ-

গচ্ছন্ত্যমূঢ়াঃ পদমব্যয়ং তৎ।।

সেই পদম অব্যয়ম বা নিত্য জগতে সে-ই যেতে পারে, যে নির্মানমোহ অর্থাৎ যে মোহমুক্ত হতে পেরেছে। এর অর্থ কি? এই জড় জগতে সকলেই কিছু না কিছু হতে চায়। কেউ চায় রাজা হতে, কেউ চায় প্রধানমন্ত্রী হতে, কেউ চায় ঐশ্চর্যশালী হতে, এভাবে সকলেই কিছু না কিছু হতে চায়। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এই অভিলাষগুলির প্রতি আসক্ত থাকি, ততক্ষণ আমরা আমাদের দেহকে আমাদের স্বরূপ বলে মনে করি, কারণ দেহকে কেন্দ্র করেই এই সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলি জন্ম নেয়। আমরা যে আমাদের দেহ নই, এই উপলব্ধিটাই হচ্ছে আধ্যাত্ম-উপলব্ধির প্রথম সোপান। জড় জগতের যে তিনটি গুণের দ্বারা আমরা আবদ্ধ হয়ে পড়ি, তার থেকে মুক্ত হওয়াটাই হচ্ছে আমাদের প্রথম কর্তব্য এবং তার উপায় হচ্ছে ভগবদ্ভক্তি। ভক্তির মাধ্যমে ভগবানের সেবা করলে এই বন্ধন আপনা থেকেই খসে পড়ে। কামনা-বাসনার বশবর্তী হবার ফলে আমরা জড়া প্রকৃতির উপরে আধিপত্য করতে চাই এবং তার ফলে জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ি। যতক্ষণ না আমরা জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবানের আলয় সনাতন ধামে ফিরে যেতে পারব না। সেই ভগবৎ-ধাম, যা সনাতন, সেখানে কেবল তাঁরাই যেতে পারেন, যারা জড় জগতের ভোগ-বাসনার দ্বারা লালায়িত নন, যারা ভগবানের সেবায় নিজেদের সর্বতোভাবে নিয়োজিত করেছেন। কেউ এভাবে অধিষ্ঠিত হলে তিনি অনায়াসে পরম ধামে উপনীত হন।

ভগবদগীতায় অন্যত্র (৮/২১) বলা হয়েছে –

অব্যক্তোহক্ষর ইত্যুক্তস্তমাহুঃ পরমাং গতিম।

যং প্রাপ্য ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।।

অব্যক্ত মানে অপ্রকাশিত। এমন কি এই জড় জগতের সব কিছু আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়নি। আমাদের জড় ইন্দ্রিয় এতই সীমিত যে, জড় আকাশে যে সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্রাদি আছে, তাও আমাদের গোচরীভূত হয় না। বৈদিক সাহিত্যে সমস্ত উল্লেখযোগ্য গ্রহ-নক্ষত্রের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা সেই সব বিশ্বাস করতে পারি অথবা বিশ্বাস নাও করতে পারি। বিশেষ করে শ্রীমদ্ভগবতে এর বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়। এই জড় আকাশের ঊর্ধ্বে যে অপ্রাকৃত লোক আছে, শ্রীমদ্ভগতে তাকে অব্যক্ত অর্থাৎ অপ্রকাশিত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই যে অপ্রাকৃত লোক যা নিত্য, সনাতন, যেখানে প্রতিনিয়ত দিব্য আনন্দের আস্বাদন পাওয়া যায়, যেখানে প্রতিনিয়ত ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করা যায়, সেই যে দিব্য জগৎ, তাই হচ্ছে মানব-জীবনের পরম লক্ষ্য-মানব-জীবনের পরম গন্তব্যস্থল। সেখানে একবার উত্তীর্ণ হলে আর এই জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না। সেই পরম রাজ্যের জন্যই মানুষের বাসনা ও আগ্রহ থাকা উচিত।

এখানে প্রশ্ন হতে পারে – কিভাবে সেই অপ্রাকৃত জগতে যাওয়া যায়? ভগবদগীতার অষ্টম অধ্যায়ে এই বিষয়ে তথ্য দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে –

অন্তকালে চ মামেব স্মরন্মুক্তা কলেবরম।

যঃ প্রয়াতি স সদ্ভাবং যাতি নাস্ত্যত্র সংশয়ঃ।।

“মৃত্যুকালে যিনি আমাকে স্মরণ করে শরীর ত্যাগ করেন, তিনি তৎক্ষণাৎ আমার ভাব প্রাপ্ত হন। এই বিষয়ে কোন সংশয় নেই।“ (ভঃ গীঃ ৮/৫) মৃত্যুকালে শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করতে পারলেই শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে যাওয়া যায়। শ্রীকৃষ্ণের দিব্য রূপ স্মরণ করতে পারলেই শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে যাওয়া যায়। শ্রীকৃষ্ণের দিব্য রূপ স্মরণ করতে হবে; এই রূপ স্মরণ করতে করতে যদি কেউ দেহত্যাগ করে, তা হলে সে অবশ্যই দিব্য ধামে চলে যায়। এখানে মদ্ভাবম বলতে পরমেশ্বর ভগবানের পরম ভাবের কথা বলা হয়েছে। পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন সৎ-চিৎ-আনন্দময় নয়। এই দেহ অসৎ, এই দেহের কোন স্থায়িত্ব নেই। এই দেহ বিনাশ হয়ে যাবে। এই দেহ চিৎ বা জ্ঞানময় নয়, পক্ষান্তরে এই দেহ অজ্ঞানতায় পরিপূর্ণ। অপ্রাকৃত জগৎ সম্বন্ধে আমাদের কোন জ্ঞান নেই, এমন কি এই জড় জগৎ সম্বন্ধেও আমাদের যে জ্ঞান আছে, তা ভ্রান্ত ও সীমিত। এই দেহ নিরানন্দ; আনন্দময় হবার পরিবর্তে এই দেহ দুঃখ-দুর্দশায় পরিপূর্ণ। এই জগতে যত রকমের দুঃখ-দুর্দশা আমরা পেয়ে থাকি, তা সবই এই দেহটির জন্যই। কিন্তু যখন আমরা এই দেহটিকে ত্যাগ করবার সময় পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্য রূপটি স্মরণ করি, তখন আমরা জড় জগতের কলুষমুক্ত সৎ-চিৎ-আনন্দময় দিব্য দেহ প্রাপ্ত হই।

এই জগতে দেহত্যাগ করা এবং অন্য একটি দেহ লাভ করা প্রকৃতির নিয়মের দ্বারা সুচারুভাবে পরিচালিত হয়। পরবর্তী জীবনে কে কি রকম দেহ প্রাপ্ত হবে, তা নির্ধারিত হবার পরেই মানুষ মৃত্যুবরণ করে। জীব নিজে নয়, তার থেকে উচ্চস্তরে যে-সমস্ত নির্ভরযোগ্য অধিকারীরা রয়েছেন, যারা ভগবানের আদেশ অনুসারে এই জড় জগতের পরিচালনা করেন, তাঁরাই জীবের কর্ম অনুসারে তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেন। আমাদের কর্ম অনুসারে আমরা ঊর্ধ্বলোকে উত্তীর্ণ হই অথবা নিম্নলোকে পতিত হই। এভাবেই প্রতিটি জীবন তার পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতির কর্মক্ষেত্র। এই জীবনে যদি আমরা জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবত-ধামে উত্তীর্ণ হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারি, তবে এই দেহত্যাগ করবার পর আমরা অবশ্যই ভগবানের মতো সৎ-চিৎ-আনন্দময় দেহ প্রাপ্ত হয়ে ভগবৎ-ধামে ফিরেও যেতে পারব।

এই জগতে দেহত্যাগ করা এবং অন্য একটি দেহ লাভ করা প্রকৃতির নিয়মের দ্বারা সুচারুভাবে পরিচালিত হয়। পরবর্তী জীবনে কে কি রকম দেহ প্রাপ্ত হবে, তা নির্ধারিত হবার পরেই মানুষ মৃত্যুবরণ করে। জীব নিজে নয়, তার থেকে উচ্চস্তরে যে-সমস্ত নির্ভরযোগ্য অধিকারীরা রয়েছেন, যারা ভগবানের আদেশ অনুসারে এই জড় জগতের পরিচালনা করেন, তাঁরাই জীবের কর্ম অনুসারে তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেন। আমাদের কর্ম অনুসারে আমরা ঊর্ধ্বলোকে উত্তীর্ণ হই অথবা নিম্নলোকে পতিত হই। এভাবেই প্রতিটি জীবন তার পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতির কর্মক্ষেত্র। এই জীবনে যদি আমরা জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবত-ধামে উত্তীর্ণ হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারি, তবে এই দেহত্যাগ করবার পর আমরা অবশ্যই ভগবানের মতো সৎ-চিৎ-আনন্দময় দেহ প্রাপ্ত হয়ে ভগবৎ-ধামে ফিরেও যেতে পারব।

পূর্বে আমরা আলোচনা করেছি, বিভিন্ন ধরনের পরমার্থবাদী আছেন – ব্রক্ষ্মবাদী, পরমাত্মবাদী ও ভক্ত। আর এই কথাও বলা হয়েছে যে, ব্রক্ষ্মজ্যোতিতে বা চিন্ময় আকাশে অগণিত চিন্ময় গ্রহাদি ভাসছে। এই সব গ্রহের সংখ্যা সমস্ত জড় জগতের গ্রহের থেকে অনেক বেশি। এই জড় জগতের আয়তন সৃষ্টির এক চতুর্থাংশের সমান বলে অনুমিত হয়েছে (একাংশেন স্থিতো জগৎ)। এই জড় জগতের অংশে অগণিত সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র সমন্বিত কোটি কোটি ব্রক্ষ্মান্ড রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই সমস্ত জড় সৃষ্টি হচ্ছে সমগ্র সৃষ্টির এক অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। সৃষ্টির অধিকাংশই রয়েছে চিন্ময় আকাশে। পরমার্থবাদীদের মধ্যে যারা নির্বিশেষবাদী, যারা ভগবানের নিরাকার রূপকে উপলব্ধি করতে চান, তাঁরা ভগবানের দেহনির্গত ব্রক্ষ্মজ্যোতিতে বিলীন হয়ে যান। এভাবে তাঁরা চিদাকাশ প্রাপ্ত হন। কিন্তু ভগবানের ভক্ত ভগবানের দিব্য সান্নিধ্য লাভ করতে চান, তাই তিনি বৈকুন্ঠলোকে উন্নীত হয়ে ভগবানের নিত্য সাহচর্য লাভ করেন। অসংখ্য বৈকুন্ঠলোকে ভগবান তাঁর অংশ-প্রকাশ – চতুর্ভুজ বিষ্ণু এবং প্রদ্যুম্ন, অনিরুদ্ধ, গোবিন্দ আদি রূপে তাঁর ভক্তদের সঙ্গদান করেন। তাই জীবনের শেষে পরমার্থবাদীরা ব্রক্ষ্মজ্যোতি, পরমাত্মা কিংবা পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করে থাকেন। সকলের ক্ষেত্রেই তাঁরা চিদাকাশে উত্তীর্ণ হন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেবল ভগবানের ভক্তেরাই বৈকুন্ঠলোকে অথবা গোলোক বৃন্দাবনে ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ভগবান এই বিষয়ে বলেছেন, “এতে কোন সন্দেহ নেই।“ এটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেই হবে। আমাদের কল্পনার অতীত বলে এই কথা অবিশ্বাস করা উচিত নয়। আমাদের মনোভাব অর্জুনের মতো হওয়া উচিত – “তুমি যা বলেছ, তা আমি সমস্তই বিশ্বাস করি।“ তাই ভগবান যখন বলেছেন যে, মৃত্যুর সময় ব্রক্ষ্ম, পরমাত্মা কিংবা পুরুষ পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্য রূপের ধ্যান করলেই তাঁর আলয় অপ্রাকৃত জগতে উত্তীর্ণ হওয়া যায়, এই কথা ধ্রুব সত্য বলে গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

মৃত্যুর সময়ে ভগবানের রূপের চিন্তা করে চিন্ময় জগতে প্রবেশ করা যে সম্ভব, তা ভগবদগীতায় (৮/৬) বর্ণিত হয়েছে –

যং যং বাপি স্মরন ভাবং ত্যজত্যন্তে কলেবরম,

তং তমেবৈতি কৌন্তেয় সদা তদ্ভাবভাবিতঃ।।

“যে যেভাবে ভাবিত হয়ে শরীর ত্যাগ করে, সে নিঃসন্দেহে সেই রকম ভাবযুক্ত শরীর প্রাপ্ত হয়।“ এখন, আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে, জড়া প্রকৃতি হচ্ছে ভগবানে বহু শক্তির মধ্যে একটি শক্তির প্রকাশ। বিষ্ণুপুরাণে (৬/৭/৬১) ভগবানের শক্তির বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে –

বিষ্ণুশক্তিঃ পরা প্রোক্তা ক্ষেত্রজ্ঞাখ্যা তথাপরা।

অবিদ্যা কর্মসংজ্ঞান্যা তৃতীয়া শক্তিরিষ্যতে।।

ভগবানের শক্তি বিচিত্র ও অনন্ত রূপে প্রকাশিত। আমাদের সীমিত অনুভুতি দিয়ে তাঁর সেই শক্তি আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। কিন্তু মহাজ্ঞানী মুনি-ঋষিরা, যারা মুক্ত পুরুষ, যারা সত্যদ্রষ্টা, তাঁরা ভগবানের শক্তিকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং এই শক্তিকে তাঁরা তিনটি ভাগে বিভক্ত করে তাঁর বিশ্লেষণ করেছেন। এই সমস্ত শক্তিই হচ্ছে বিষ্ণুশক্তির প্রকাশ, অর্থাৎ তাঁরা ভগবান শ্রীবিষ্ণুর বিভিন্ন শক্তি। সেই প্রথম শক্তিকে বলা হয় পরা শক্তি বা চিৎ-শক্তি।  জীবও এই উৎকৃষ্ট শক্তি থেকে উদ্ভুত, সেই কথা ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে। ভগবানের এই অন্তরঙ্গা শক্তি ব্যতীত আর যে সমস্ত শক্তি, তাকে বলা হয় জড়া শক্তি। এই সমস্ত নিম্নতর শক্তি এবং সেগুলি তামসিক গুণের দ্বারা প্রভাবিত। মৃত্যুর সময় আমরা এই জড় জগতের তামসিক গুণের দ্বারা আচ্ছাদিত নিম্নতর শক্তিতে থাকতে পারি অথবা চিন্ময় জগতের চিৎ-শক্তিতে উত্তীর্ণ হতে পারি। তাই ভগবদগীতায় (৮/৬) বলা হয়েছে –

যং যং বাপি স্মরন ভাবং ত্যজত্যন্তে কলেবরম।

তং তমেবৈতি কৌন্তেয় সদা তদ্ভাবভাবিতঃ।।

“যে যেভাবে ভাবিত হয়ে শরীর ত্যাগ করে, সে নিঃসন্দেহে সেই রকম ভাবযুক্ত শরীর প্রাপ্ত হয়।“

আমাদের জীবনে আমরা হয় জড়া শক্তি অথবা চিৎ-শক্তির সম্বন্ধে ভাবতে অভ্যস্ত। এখন, আমদের চিন্তা-ভাবনাকে জড়া শক্তি থেকে চিৎ-শক্তিতে কিভাবে রূপান্তরিত করতে পারি? খবরের কাগজ, উপন্যাস আদি নানা রকম বই আমাদের মনকে জড়া শক্তির ভাবনার যোগান দেয়। আমাদের চিন্তাধারা এই ধরণের সাহিত্যের দ্বারা আবিষ্ট হয়ে আছে বলেই আমরা উচ্চতর চিৎ-শক্তিকে উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়ে পড়েছি। আমরা যদি এই চিৎ শক্তিকে জানতে চাই, বা ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে চাই, তবে আমাদের বৈদিক সাহিত্যের স্মরণ নিতে হবে। মানুষকে অপ্রাকৃত জগতের সন্ধান দেবার জন্যই ভারতের মুনি-ঋষিদের মাধ্যমে ভগবান বেদ, পুরাণ আদি বৈদিক শাস্ত্র প্রণয়ণ করিয়েছেন। এই সমস্ত সাহিত্য মানুষের কল্পনাপ্রসূত নয়; এগুলি হচ্ছে সত্য দর্শনের বিশদ ঐতিহাসিক বিবরণ। শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃতে (মধ্য ২০/১২২) বলা হয়েছে –

মায়ামুগ্ধ জীবের নাহি স্বতঃ কৃষ্ণজ্ঞান।

জীবেরে কৃপায় কৈলা কৃষ্ণ বেদ-পুরাণ।।

স্মৃতিভ্রষ্ট জীবেরা ভগবানের সঙ্গে তাদের শাশ্বত সম্পর্কের কথা ভুলে গেছে এবং তাই তাঁরা জড়-জাগতিক কার্যকলাপে মগ্ন হয়ে আছে। তাদের চিন্তাধারাকে অপ্রাকৃত স্তরে উন্নীত করবার জন্য শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস বহু বৈদিক শাস্ত্র প্রদান করেছেন। প্রথমে তিনি বেদকে চার ভাবে ভাগ করেন। তারপর পুরাণে তিনি তাদের ব্যাখ্যা করেন এবং অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের জন্য তিনি মহাভারত রচনা করেন। এই মহাভারতে তিনি ভগবদগীতার বাণী প্রদান করেন। তারপর সমস্ত বৈদিক সাহিত্যের সংক্ষিপ্তসার বেদান্তসূত্র প্রণয়ন করেন। বেদান্তসূত্রজে সহজবোধ্য করে তিনি তার ভাষ্য শ্রীমদ্ভগবত রচনা করেন। মনোনিবেশ সহকারে এই সমস্ত বৈদিক সাহিত্য অধ্যয়ন করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। জড় জগতে আবদ্ধ সাংসারিক লোকেরা যেমন খবরের কাগজ, নানা রকম পত্রিকা, নাটক, নভেল আদি পড়ে থাকে এবং এর ফলে জড় জগতের প্রতি তাদের মোহমুগ্ধ অনুরাগ গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে, তেমনই যারা ভগবানের স্বরূপশক্তিকে উপলব্ধি করে ভগবৎ-ধামে ফিরে যেতে চায়, তাদের কর্তব্য হচ্ছে মহামুনি ব্যাসদেবের রচিত বৈদিক সাহিত্য অধ্যয়ন করার ফলে মনে ভগবন্মুখী হয়ে ওঠে এবং তার ফলে অন্তকালে ভগবানের সচ্চিতানন্দময় রূপের ধ্যান করতে করতে আমরা দেহত্যাগ করতে পারি। ভগবদগীতাতে ভগবান বারবার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, এটিই হচ্ছে তাঁর কাছে ফিরে যাবার একমাত্র পথ এবং তিনি বলেছেন যে, “এতে কোন সন্দেহ নেই।“

তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু মামনুস্মর যুধ্য চ।

ময্যর্পিতনোবুদ্ধির্মামেবৈষ্যসাসংশয়ঃ।।

“অতএব অর্জুন! সর্বক্ষণ আমাকে স্মরণ করে তোমার স্বভাব বিহিত যুদ্ধ করা উচিত। তোমার মন ও বুদ্ধি আমাতে অর্পণ করে কার্য করলে নিঃসন্দেহে তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে।“ (ভঃ গীঃ ৮/৭)

তিনি অর্জুনকে তাঁর কর্তব্যকর্ম থেকে বিরত হয়ে তাঁর ধ্যান করতে আদেশ দেননি। ভগবান কোন অবাস্তব পরামর্শ দেন না। পক্ষান্তরে, তিনি বলেছেন, “আমাকে স্মরণ করে তুমি তোমার কর্তব্যকর্ম করে যাও।“ এই জড় জগতে দেহ ধারণ করতে হলে কাজ করতেই হবে। কর্ম অনুসারে মানব-সমাজকে ব্রাক্ষণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র – এই চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এতে ব্রাক্ষণেরা বা সমাজের বুদ্ধিমান লোকেরা এক ধরনের কাজ করছে, ক্ষত্রিয়েরা বা পরিচালক সম্প্রদায় কাজ করছে। মানব-সমাজে প্রত্যেকেই সে শ্রমিকই হোক, ব্যবসায়ী হোক, যোদ্ধা হোক, চাষী হোক অথবা এমন কি সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, বৈজ্ঞানিক কিংবা ধর্মতত্ত্ববিদই হোক না কেন, এদের সকলকেই জীবন ধারণ করবার জন্য তাদের নির্ধারিত কর্ম করতেই হয়। তাই ভগবান অর্জুনকে তাঁর কর্তব্যকর্ম থেকে বিরত থাকতে নিষেধ করেছেন। পক্ষান্তরে তিনি বলেছেন যে, সব সময় সকল কর্মের মাঝে তাঁকে স্মরণ করে, (মামনুস্মর) তাঁর পাদপদ্মে মন ও বুদ্ধি অর্পণ করে কর্তব্যকর্ম করে যেতে। দৈনন্দিন জীবনে জীবন-সংগ্রামের সময় যদি শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ না করা যায়, তবে মৃত্যুর মুহূর্তে তাঁকে স্মরণ করা সম্ভব হবে না। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও এই উপদেশ দিয়ে গেছেন। তিনি বলে গেছেওন যে, কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ – সর্বক্ষণ ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তনের অভ্যাস করা উচিত। ভগবানের নাম তাঁর রূপের থেকে ভিন্ন নয়; তাই যখন আমরা তাঁর নাম কীর্তন করি, তখন আমরা তাঁর পবিত্র সান্নিধ্য লাভ করে থাকি। তাই অর্জুনের প্রতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ, “সব সময় আমাকে স্মরণ কর” এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ “সর্বদাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম কীর্তন কর” – এই দুটি একই উপদেশ। ভগবানের দিব্য রূপকে স্মরণ করা এবং তাঁর দিব্য নামের কীর্তন করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অপ্রাকৃত স্তরে নাম ও রূপ অভিন্ন। তাই আমাদের সর্বক্ষণ চব্বিশ ঘণ্টাই ভগবানকে স্মরণ করার অভ্যাস করতে হবে। তাঁর পবিত্র নাম কীর্তন করে আমাদের জীবনের কার্যকলাপ এমনভাবে চালিত করতে হবে যাতে আমরা সর্বদাই তাঁকে স্মরণ করতে পারি।

এটি কিভাবে সম্ভব? এই প্রসঙ্গে উদাহরণস্বরূপ আচার্যরা বলেন যে, যখন কোন বিবাহিতা স্ত্রীলোক পর-পুরুষে আসক্ত হয় কিংবা কোন পুরুষ পরস্ত্রীতে আকৃষ্ট হয়, তখন সেই আসক্তি অত্যন্ত প্রবল হয়। তখন সে সারাক্ষণ উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকে কিভাবে, কখন সে তার প্রেমিকের সাথে মিলিত হবে, এমন কি যখন তার গৃহকর্মে সে ব্যস্ত থাকে, তখনও তার মন প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হবার আশায় আকুল হয়ে থাকে। সে তখন অতি নিপুণতার সঙ্গে তার গৃহকর্ম সমাধা করে, যাতে তার স্বামী তাকে তার আসক্তির জন্য কোন রকম সন্দেহ না করে। ঠিক তেমনই, আমাদের সমস্ত কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করতে হবে। এই জন্য ভগবানের প্রতি গভীর অনুরাগের একান্ত প্রয়োজন। ভগবানের প্রতি গভীর ভালবাসা থাকলেই মানুষ জাগতিক কর্তব্যগুলি সম্পাদন করার সময়েও তাঁকে বিস্মৃত হয় না। তাই আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে ভগবানের প্রতি এই গভীর ভালবাসা আমাদের অন্তরে জাগিয়ে তুলতে পারি। অর্জুন যেমন সব সময়ই ভগবানের কথা চিন্তা করতেন, আমাদেরও তেমন ভগবানের চিন্তায় মগ্ন থাকা উচিত। অর্জুন ছিলেন ভগবানের নিত্যসঙ্গী এবং তিনি ছিলেন যোদ্ধা। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে যুদ্ধ করা থেকে বিরত হয়ে বনে গিয়ে ধ্যান করতে উপদেশ দেননি। যোগ সম্বন্ধে যখন তিনি বিশদ ব্যাখ্যা করে অর্জুনকে শোনান, তখন অর্জুন তাঁকে স্পষ্ট বলেন যে, তা অনুশীলন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। অর্জুন বলেছিলেন –

যোহয়ং যোগস্তয়া প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসুদন।

এতস্যাহং ন পশ্যামি চঞ্চলত্বাৎ স্থিতিং স্থিরাম।।

“হে মধুসুদন! যোগ সম্বন্ধে তুমি আমাকে যা বললে তা থেকে আমি বুঝতে পারছি যে, এর অনুশীলন করা আমার পক্ষে অসম্ভব ও অসহনীয়, কারণ আমার মন অত্যন্ত চঞ্চল ও অস্থির।“ (ভঃ গীঃ ৬/৩৩)

কিন্তু ভগবান তখন তাঁকে বলেছিলেন –

যোগিনামপি সর্বোষাং মদগতেনান্তারাত্মনা।

শ্রদ্ধাবান ভজতে যো মাং স মে যুক্ততমো মতঃ।।

“যোগীদের মধ্যে যে গভীর শ্রদ্ধা সহকারে মদগতচিত্তে নিজের অন্তরাত্মায় আমাকে চিন্তা করে এবং আমার অপ্রাকৃত সেবায় নিয়োজিত থাকে, সে-ই যোগসাধনায় অন্তরঙ্গভাবে আমার সঙ্গে যুক্ত এবং সেই হচ্ছে যোগীশ্রেষ্ঠ এবং সেটিই আমার অভিমত।“ (ভঃগীঃ ৬/৪৭) সুতরাং যিনি সব সময় ভগবদ্ভাবনায় মগ্ন, তিনিই হচ্ছেন যোগীশ্রেষ্ঠ, তিনি হচ্ছেন পরম জ্ঞানী এবং তিনিই হচ্ছেন শুদ্ধ ভক্ত। ভগবান অর্জুনকে আরো বলেছেন যে, ক্ষত্রিয় হবার ফলে তাঁকে যুদ্ধ করতেই হবে, কিন্তু তিনি যদি শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করে যুদ্ধ করেন, তবে সেই যুদ্ধে জয়লাভ তো হবেই, উপরন্তু অন্তকালে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করতে সমর্থ হবেন। এভাবে আমরা দেখতে পাই, যিনি ভগবানের কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেছেন, তিনিই পারেন ভগবানের কৃপা লাভ করতে।

আমরা সাধারণত আমাদের দেহ দিয়ে কাজ করি না, মন ও বুদ্ধি দিয়ে কাজ করি। তাই, যদি মন ও বুদ্ধি ভগবানের ভাবনায় মগ্ন থাকে, তা হলে ইন্দ্রিয়গুলি আপনা থেকে ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হয়ে যায়। তখন আপাতদৃষ্টিতে ইন্দ্রিয়ের কর্মগুলি অপরিবর্তিত থেকে যায়, কিন্তু মনোবৃত্তির আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। ভগবদগীতা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে, কিভাবে মন ও বুদ্ধিকে ভগবানের ভাবনায় মগ্ন করতে হয়। এভাবে সর্বতোভাবে ভগবানের ভাবনায় মগ্ন হবার ফলেই আমরা ভগবানের আলয়ে প্রবেশ কারবার যোগ্যতা অর্জন করি। মন যদি কৃষ্ণসেবায় নিযুক্ত হয়, তা হলে ইন্দ্রিয়গুলি আপনা থেকেই তাঁর সেবায় নিয়োজিত থাকে। এটিই হচ্ছে কৌশল এবং এটি ভগবদগীতার রহস্যও – শ্রীকৃষ্ণের চিন্তায় সর্বতোভাবে নিমগ্ন থাকা।

আধুনিক মানুষ চাঁদে পৌঁছানোর জন্য অনেক পরিশ্রম করে চলেছে, কিন্তু তার পারমার্থিক উন্নতির জন্য সে কোন রকম চেষ্টাই করেনি। পঞ্চাশ-ষাট বছরের অল্প আয়ু নিয়ে আমরা এখানে এসেছি, তাই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে ভগবানকে স্মরণ করবার জন্য এই সময়টি পুরোপুরিভাবে ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করা এবং তার পদ্ধতি হচ্ছে –

শ্রবণং কীর্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং পাদসেবনম।

অর্চন বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম।।

(শ্রীমদ্ভাগবত ৭/৫/২৩)

ভক্তিযোগ সাধনের নয়টি প্রণালীর মধ্যে সবচেয়ে সহজ হচ্ছে শ্রবণম অর্থাৎ আত্মতত্ত্বজ্ঞ পুরুষের কাছে ভগবদগীতা শ্রবণ করা এবং এর ফলে মন ভগবন্মুখী হয়ে উঠবে। তখন পরমেশ্বর ভগবানকে স্মরণ করা সহজ হবে এবং এই জড় দেহ ত্যাগ করার পর চিন্ময় দেহ লাভ করে ভগবানের আলয়ে উন্নীত হয়ে আমরা ভগবানের সাহচর্য লাভ করতে সক্ষম হব।

ভগবান আরও বলেছেন –

অভ্যাসযোগযুক্তেন চেতসা নান্যগামিনা।

পরমং পুরুষং দিব্যং যাতি পার্থানুচিন্তয়ন।।

“অভ্যাসের দ্বারা যে সর্বদা ভগবানরূপে আমার ধ্যানে মগ্ন, বিপথগামী না হয়ে যার মন সর্বদা আমাকে স্মরণ করে, হে পার্থ! সে নিঃসন্দেহে আমার কাছে দিরে আসবে।“ (গীঃ ৮/৮)

এই পদ্ধতি মোটেই কঠিন নয়। তবে আসল কথা হচ্ছে, এর অনুশীলনের শিক্ষা তাঁর কাছ থেকেই নিতে হবে, যিনি অভিজ্ঞ ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞ। তদ্বিজ্ঞানার্থং স গুরুমেবাভিগচ্ছেং – যিনি ইতিমধ্যেই অনুশীলনে প্রবৃত্ত হয়েছেন, তাঁর সমীপবর্তী হতে হবে। মনের কাজই হচ্ছে সর্বদা এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ানো, তাই অভ্যাস করতে হবে মনকে একাগ্র করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম ও রূপে নিবদ্ধ করতে। মন স্বভাবতই চঞ্চল, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের নামের শব্দতরঙ্গে একে স্ত্রীর করা যায়। এভাবে পরব্যোমে চিন্ময় জগতে পরম পুরুষ ভগবানের ধ্যান করে তাঁর করুণা লাভ করা সম্ভব। ভগবদগীতায় চরম উপলব্ধির পন্থা ও উপায় বা পরম প্রাপ্তির কথা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এবং এই জ্ঞান-ভান্ডারের দ্বার সকলেই জন্যই উন্মুক্ত হয়ে আছে। কাউকেই নিষিদ্ধ করা হয়নি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করে সকল শ্রেণীর মানুষই তাঁর সমীপবর্তী হতে পারে, কেন না শ্রীকৃষ্ণের নাম শ্রবণ ও স্মরণ সকলের পক্ষেই সম্ভব।

ভগবান আরও বলেছেন (ভঃ গীঃ ৯/৩২-৩৩) –

মাং হি পার্থ ব্যপশ্রিত্য যেহপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ।

স্ত্রিয়ো বৈশ্যস্তথা শুদ্রাস্তেহপি যান্তি পরাং গতিম।।

কিং পুনর্বাক্ষ্মণাঃ পুণ্যা ভক্তা রাজর্ষয়স্তথা।

অনিত্যমসুখং লোকমিমং প্রাপ্য ভজস্ব মাম।।

এভাবে ভগবান বলেছেন যে, এমন কি বৈশ্য, পতিতা স্ত্রীলোক অথবা শূদ্র কিংবা নিম্নস্তরের মানুষেরাও পরম গতি লাভ করতে পারে। ভগবানের কৃপা লাভ করতে হলে যে উচ্চমানের বুদ্ধিমত্তা-সম্পন্ন হতে হবে, এমন কোন কথা নেই। আসল কথা হচ্ছে, যদি কেউ ভক্তিযোগের দ্বারা ভগবানের সেবায় ব্রতী হন এবং ভগবানকে জীবনের পরম আশ্রয় বলে মনে করেন, তবে তিনি অপ্রাকৃত জগতে উত্তীর্ণ হয়ে ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করতে সক্ষম হন। কেউ যদি ভগবদগীতার উপদেশবাণীকে সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করে তার অনুশীলন করেন, তবে তিনি তাঁর জীবনকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলতে পারেন এবং এই জড়া প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসার ফলে যে সমস্ত জাগতিক সমস্যার উদ্ভব হয়, তার সম্পূর্ণ সমাধান করতে পারেন। এই হচ্ছে ভগবদগীতার মূল কথা।

উপসংহারে বলা যায়, ভগবদগীতা হচ্ছে এক অপ্রাকৃত সাহিত্য, যা অতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অধ্যয়ন করা উচিত। গীতাশাস্ত্রমিদং পুণ্যং যঃ পঠেৎ প্রযতঃ পুমান – ভগবদগীতার নির্দেশকে যথাযথভাবে অনুসরণ করতে পারলে, অতি সহজেই সমস্ত ভয় ও উদ্বেগ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। এই জীবনে ভয় ও শোকাদি বর্জিত হয়ে পরবর্তী জীবনে চিন্ময় সত্তা অর্জন করা যায়। (গীতা-মাহাত্ম্য ১)

আরও একটি সুবিধা হচ্ছে –

গিটাধ্যায়নশীলস্য প্রাণায়মপরস্য চ।

নৈব সন্তি হি পাপানি পূর্বজন্মকৃতানি চ।।

“কেউ যদি আন্তরিকভাবে এবং অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ভগবদগীতা পাঠ করে, তা হলে ভগবানের করুণায় তার অতীতের সমস্ত পাপকর্মের ফল তাকে প্রভাবিত করে না।“ (গীতা-মাহাত্ম্য ২) ভগবদগীতার শেষ্য পর্যায়ে (১৮/৬৬) অতি উচ্চস্বরে ভগবান বলেছেন –

সর্বধর্মান পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।

অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।

“সব রকমের ধর্মানুষ্ঠান পরিত্যাগ করে আমার শরণ নাও। তাহলে আমি সমস্ত পাপ থেকে তোমাকে মুক্ত করব। তুমি কর ভয় কর না।“ এভাবে ভগবানের পাদপদ্মে যিনি সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেন, ভগবান তাঁর সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সেই মানুষের সকল পাপকর্মের প্রতিক্রিয়া থেকে তাঁকে রক্ষা করেন।

মলিনে মোচং পুংসাং জলস্নানং দিনে দিনে।

সকৃদ গীতামৃতস্নানং সংসারমলনাশনম।।

“প্রতিদিন জলে স্নান করে মানুষ নিজেকে পরিচ্ছন্ন করতে পারে, কিন্তু কেউ যি ভগবদগীতার গঙ্গাজলে একটি বারও স্নান করে, তা হলে তার জড় জীবনের মলিনতা একেবারেই বিনষ্ট হয়ে যায়।“ (গীতা-মাহাত্ম ৩)

গীতা সুগীতা কর্তব্য কিমন্যৈঃ শাস্ত্রবিস্তরৈঃ।

যা স্বয়ং পদ্মানাভস্য মুখপদ্মাদ বিনিঃসৃতা।।

যেহেতু ভগবদগীতার বাণী স্বয়ং পরম পুরুষোত্তম ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী, তাই এই গ্রন্থ পাঠ করলে আর অন্য কোন বৈদিক সাহিত্য পড়বার দরকার হয় না। গভীর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে নিয়মিতভাবে ভগবদগীতা শ্রবণ ও কীর্তন করলে আমাদের অন্তনির্হিত ভগবদ্ভক্তির স্বাভাবিক বিকাশ হয়। বর্তমান জগতে মানুষেরা নানা রকম কাজে এতই ব্যস্ত থাকে যে, তাদের পক্ষে সমস্ত বৈদিক সাহিত্য পাঠ করা সম্ভব নয়। সমস্ত বৈদিক সাহিত্য পড়বার প্রয়োজনও নেই। এই একটি গ্রন্থ ভগবদগীতা পাঠ করলেই মানুষ সমস্ত বৈদিক জ্ঞানের সারমর্ম উপলব্ধি করতে পারবে, কারণ ভগবদগীতা হচ্ছে বেদের সার এবং এই গীতা স্বয়ং ভগবানের মুখ নিঃসৃত উপদেশ বাণী। (গীতা-মাহাত্ম্য ৪)

আরও বলা হয়েছে –

ভারতামৃতসর্বস্বং বিষ্ণুবক্ত্রাদ বিনিঃসৃতম।

গীতাগঙ্গোদকং পীত্বা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।।

“গঙ্গাজল পান করলে অবধারিতভাবে মুক্তি পাওয়া যায়, আর যিনি ভগবদগীতার পুণ্য পীযুষ পান করেছেন, তাঁর কথা আর কি বলবার আছে? ভগবদগীতা হচ্ছে মহাভারতের অমৃতরস, যা আদি বিষ্ণু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলে গেছেন।“ (গীতা মাহাত্ম্য ৫) ভগবদগীতা পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত, আর গঙ্গা ভগবানের চরণপদ্ম থেকে উদ্ভূত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ভগবানের মুখ ও পায়ের মধ্যে অবশ্য কোন পার্থক্য নেই। তবে আমাদের এটি বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ভগবদগীতার গুরুত্ব গঙ্গার চেয়েও বেশি।

সর্বোপনিষ দো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ।

পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ।।

“এই গীতোপনিষোদ ভগবদগীতা সমস্ত উপনিষদের সারাতিসার এবং তা ঠিক একটি গাভীর মতো, এবং রাখাল বালকরূপে প্রসিদ্ধ ভগবান শ্রীকৃষ্ণই এই গাভীকে দোহন করেছেন। অর্জুন যেন গোবৎসের মতো এবং জ্ঞানীগুণী ও শুদ্ধ ভক্তেরাই ভগবদগীতার সেই অমৃতময় দুগ্ধ পান করে থাকেন।“ (গীতা-মাহাত্ম্য ৬)

একং শাস্ত্রং দেবকীপুত্রগীতম

একো দেবো দেবকীপুত্র এব।

একো মন্ত্রস্তস্য নামানি যানি

কর্মাপ্যেকং তস্য দেবস্য সেবা।।

(গীতা-মাহাত্ম্য ৭)

বর্তমান জগতে মানুষ আকুলভাবে আকাঙ্ক্ষা করছে একটি শাস্ত্রের, একক ভগবানের, একটি ধর্মের এবং একটি বৃত্তির। তাই, একং শাস্ত্রং দেবকীপুত্রগীতম – সারা পৃথিবীর  মানুষের জন্য সেই একক শাস্ত্র হোক ভগবদগীতা। একো দেবো দেবকীপুত্র এব – সমগ্র বিশ্বচরাচরের একক ভগবান হোন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। একো মন্ত্রস্তস্য নামানি – একক মন্ত্র, একক প্রার্থনা, একক স্ত্রোত্র হোক তাঁর নাম কীর্তন –

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

এবং কর্মাপ্যেকং তস্য দেবস্য সেবা – সমস্ত মানুষের একটিই বৃত্তি হোক – পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করা।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x