বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চরিত্র এবং প্রত্যয়

স্বাধীনতা উত্তরকালে জাতি যখন শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের ভারত তোষণ নীতি, ২৫ বছরের গোলামী চুক্তি, সীমাহীন দুর্নীতি, অবাধ চোরাকারবার, রক্ষীবাহিনী এবং ব্যক্তিগত বাহিনী সমূহের ত্রাস, দমন নীতি, দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান উর্দ্ধগতি, অর্থনৈতিক নৈরাজ্য, সমাজতন্ত্রের নামে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাহীনতা এবং আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত; তখন সেনা বাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তারা শাসকদের হাতে শোষণের হাতিয়ার না হয়ে জনগণের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবেন।

এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা মহাদেশের প্রায় সব দেশই ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো অস্ত্রবলে দখল করে নেয়। দখল করে নেবার পর ঔপনিবেশিক প্রভুরা প্রতিটি দেশে জাতীয় শোষক শ্রেণীর যোগসাজসে গড়ে তোলে দু’টো প্রশাসনিক হাতিয়ার, সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্র। নিজেদেরকে জনগণের প্রত্যক্ষ শোষক হিসেবে প্রতিপন্ন না করার এক অপূর্ব ব্যবস্থা। ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা’ তোলার এ কৌশল গ্রহণ করে জাতীয় শোষক শ্রেণীকে যৎসামান্য সুখ-সুবিধা দিয়ে জাতীয় সম্পদের সিংহভাগ তারা নিয়ে যায় নিজেদের দেশে। জাতীয় শোষক শ্রেণীকে বশীভূত করে তাদের বিদেশী ধ্যান-ধারণা ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের আকৃষ্ট করতেও সমর্থ হয় ঔপনিবেশিক প্রভুরা প্রগতি ও মানবতাবাদের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে। বিজাতীয় শোষণের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে জনগণের মাঝে। তারা মনে করে বিদেশী শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হলেই তাদের দাসত্ব ঘুচেঁ যাবে। দেশের উন্নতি হবে এবং জীবনের মান উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। তারই ফলে শুরু হয় জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম। সংগ্রামের প্রচন্ডতার মুখে এক পর্যায়ে প্ৰত্যক্ষ শোষণ টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়লে ঔপনিবেশিক শাসকরা পরোক্ষ শোষণের বন্দোবস্ত করে। জাতীয় উচ্চবিত্ত ও তাদের দোসরদের নেতৃত্বে স্বাধীনতা দান করে প্রতিটি দেশের উপর পরোক্ষভাবে তাদের শোষণ কায়েম রাখে। বিদেশী প্রভুদের জায়গায় নতুন দেশী প্রভুরা ক্ষমতা আসীন হয়ে তাদের প্রভুদের শিক্ষা অনুযায়ী এবং প্রভুদের প্রতিষ্ঠিত সামরিক বাহিনী, শাসন ব্যবস্থা ও আমলাতন্ত্রকে অটুট রেখে নিজেদের স্বার্থে জনগণের বিরুদ্ধে তাদের প্রয়োজনমত ব্যবহার করতে থাকে। জাতীয় শোষক শ্রেণীর এই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় শুরু হয় জাতীয় শোষণ ও শাসন। ফলে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। দেশগুলো আরো দরিদ্র হয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক সূত্রে অর্থনৈতিকভাবে জরাজীর্ণ এসমস্ত দেশগুলোর শাসনভার যারা গ্রহণ করে তাদের অযোগ্যতা, প্রশাসন চালানোর অনভিজ্ঞতা, লোভ-লালসা, কোন্দল এবং ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হওয়ায় পালাক্রমে ক্ষমতা হাতবদল হতে থাকে সামরিক-বেসামরিক আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের দ্বারা গঠিত দলগুলোর মধ্যে। এই ‘মেরি গো রাউন্ড’ এর গোলক ধাধাঁয় আজও তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ঘুরপাক খাচ্ছে।

সামরিক বাহিনীই ক্ষমতায় থাকুক আর বেসামরিক রাজনৈতিক নেতারাই ক্ষমতায় থাকুক তাদের শিকড় একই শ্রেণীতে। তাই তাদের মধ্যে থাকে এক অটুট বন্ধন। তাদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইকে রাজনৈতিক সংগ্রাম হিসেবে জাহির করার প্রচেষ্টা একটা প্রহসন মাত্র। জনগণকে বোকা বানানোর আরেকটি কায়দা। তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব যতই তীব্র হোক না কেন জনগণের বিরুদ্ধে নিজেদের কায়েমী স্বার্থকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা নিজেদের বিবাদ ভুলে সব এক হয়ে যায়। এর ফলেই সম্ভব হয় সমঝোতার মাধ্যমে লোক দেখানো গণতন্ত্রের খেলা, দলবদলের ভেলকিবাজী। এই উদ্দেশ্যেই মুক্তিযুদ্ধের অস্বাভাবিক ইতি টানার সাথে সাথে ঔপনিবেশিক ছাচে গড়া রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো পুরোপুরি অক্ষুন্ন রাখার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছিল।

কিন্তু বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সৃষ্টি, ইতিহাস ও চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। পাকিস্তান স্বাধীন করার সংগ্রামে পূর্ব বাংলার জনগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্রিটিশ সৃষ্ট শাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসন-শোষণের যাতাকলে যাতাকলে পিষতে থাকে। এরই ফলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। স্বৈরতন্ত্র বিরোধী জাতীয়তাবাদী এ সংগ্রামে গণতান্ত্রিক চেতনাও গড়ে উঠতে থাকে। সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল দেশ স্বাধীন করে গণতান্ত্রিক, জনগণের মৌলিক এবং মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে স্বনির্ভর সুষম সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠিদের নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছিল তৎকালীন সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বাঙ্গালী সদস্যদেরও। তাদের উপরও করা হয়েছিল অন্যায়-অবিচার। ফলে গোড়া থেকেই তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছেন জাতীয় সংগ্রামে। জাতীয় মুক্তির রাজনৈতিক সংগ্রামের চরম স্তরই ছিল ‘৭১ এর স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম। হানাদার বাহিনীর আচমকা হামলার মুখে যখন রাজনৈতিক নেতারা জাতিকে লক্ষ্যহীন অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে রেখে পালিয়ে যান তখন ঔপনিবেশিক ছাঁচে গড়া সেনাবাহিনীরই এক জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক সেনা অফিসার মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সেনাবাহিনী, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশ বাহিনীর বাঙ্গালী সদস্যরাই প্রথম বিদ্রোহ করেন এবং কৃষক, শ্রমিক, যুবক, ছাত্র, প্রশাসনিক আমলাদের একাংশ এবং জনগণের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় দেশব্যাপী প্রতিরোধ সংগ্রাম। জনগণের সাথে সৈনিকদের চেতনা, আশা-আকাংখা এক হয়ে মিলে গিয়েছিল বলেই গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম। পরবর্তিকালে নয় মাস জনগণের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন তারা। শ্রেণী বিন্যাসের সব বাধাঁ ভেঙ্গে তারা নিজেদের পরিচয় কায়েম করেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। মুক্তিযোদ্ধারা যখন জনগণের সাথে এক হয়ে গিয়ে যুদ্ধ সংগঠিত করছিলেন তখন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের বেশিরভাগ সদস্য ভারতে পালিয়ে গিয়ে ভারতীয় সরকারের সহায়তায় তথাকথিত মুজিবনগর প্রবাসী সরকার গঠন করে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের একক নেতৃত্বের দাবিদার হয়ে বসেন। যুদ্ধক্ষেত্রে না যেয়ে অবস্থান নেন কোলকাতার ৫৮নং বালিগঞ্জ, ৮নং থিয়েটার রোড এবং ১৯নং সার্কাস এ্যাভেনিউতে। এভাবেই তারা নিজেদের ভারতীয় চক্রান্তের ক্রীড়ানকে পরিণত করেন। মুক্তিযোদ্ধারা চেয়েছিলেন তাদের আত্মত্যাগ, তিতিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাবেন তাদের সংগ্রাম আর তারই ফলে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে পরীক্ষিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব; যারা পরিচালিত করবে মুক্তি সংগ্রাম। স্বাধীনতার পর তারা গড়ে তুলবেন জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। কিন্তু ভারতীয় সেনা বাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলে মুক্তিযুদ্ধ সেই স্বাভাবিক পরিণতি লাভ করতে পারেনি। ফলে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন তাদের বদলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা চলে গেল আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে।

যেসব বাঙ্গালী সৈনিকরা ঔপনিবেশিক ধাচেঁ গড়া সেনা বাহিনীর কাঠামো ভেঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাদের আবার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হল। গড়ে তোলা হল পুরনো ধাচেঁর সশস্ত্র বাহিনী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সদস্যদের বেশিরভাগই তখন হয়ে উঠেছিলেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন। এই সচেনতার বিকাশ ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। তাই বিশ্বের অন্যান্য গতানুগতিকভাবে সৃষ্ট সেনা বাহিনীগুলোর ধাঁচে তাদের আবার সংগঠিত করলেও চারিত্রিকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। মুক্তিযোদ্ধাদের বৃহৎ অংশই ছিলেন নিঃস্বার্থ অকুতোভয়, দেশপ্রেমিক। কর্তব্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ, স্পষ্ট বক্তা মুক্তিযোদ্ধারা কোন অন্যায়কে মেনে নেননি যুদ্ধের সময় থেকেই। সীমিত গন্ডির ভেতরে থেকেও তারা সব অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন; সুযোগ মত অন্যায়কে প্রতিহত করার চেষ্টাও করেছেন সাধ্যমত। তাই ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণায় এ ধরণের চরিত্রের সেনাবাহিনীকে জাতির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ব্যারাকে আবদ্ধ রাখার চিন্তা-ভাবনা ছিল নেহায়েতই অবাস্তব। সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা সমাজ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন ছিলেন না৷ দেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের প্রতি জনগণের মত তারাও স্বাভাবিকভাবে ছিলেন সদা সচেতন। সেই কারণেই ঔপনিবেশিক ধ্যান ধারণায় সেনা সদস্যদের জাতির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ব্যারাকে আবদ্ধ করে রাখার সরকারি প্রচেষ্টা ফলদায়ক হয়নি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে। জনগণ ও সেনা সদস্যদের মাঝে গড়ে উঠা দেশপ্রেমের অটুট বন্ধনের গভীরতা অনুধাবন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন আওয়ামী-বাকশালী শাসকগোষ্ঠি। সৈনিকদের ব্যারাকে আবদ্ধ করে রাখলেও তাদের সিংহভাগই দেশের রাজনৈতিক গতিধারার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখে চলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কারণেই। শুধু বাইরেই তার প্রকাশ ছিল না। এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করে পুরনো ধাঁচের রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে পশ্চিমা শাসকদের স্থলাভিষিক্ত আওয়ামী লীগ সরকার দেশ শাসন করতে গিয়েও চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। আওয়ামী-বাকশালী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সেনা বাহিনীর মধ্যেও বিক্ষোভ ধুঁমায়িত হয়ে উঠতে থাকে।

 

বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভাগ্যে জোটে ‘বিড়ম্বনা’

শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগ কখনোই একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতে চায়নি। উপরক্ত সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে রাখার জন্য তারা সেখানেও ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতি প্ৰবৰ্তন করে। বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রতিও ছিল তাদের অবিশ্বাস।

ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে চলে যাবার পর আমাদের তরফ থেকে জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠনের জোর দাবি জানানো হয়েছিল সরকারের কাছে। এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সরকারি মহল থেকে জোর প্রচারণা চালানো হয়, “বাংলাদেশের মত শান্তিপ্রিয় দরিদ্র একটি দেশের জন্য সেনাবাহিনীর কি প্রয়োজন? বাংলাদেশের তিন দিক ঘিরে রয়েছে ভারত। বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সাথে রয়েছে মৈত্রী চুক্তি। সেখানে যুদ্ধ হবে কার সাথে? অন্য কোন তৃতীয় শক্তির পক্ষ থেকে আমাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের উপর কোন হুমকি এলে চুক্তি অনুযায়ী বন্ধুরাষ্ট্রই আমাদের রক্ষা করবে।” কি উদ্ভট যুক্তি!! আর্ন্তজাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী মিত্র বা শত্রু বলে কিছু নেই। সব সম্পর্কই পরিবর্তনশীল। তাছাড়া জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী যে কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সুস্পষ্ট জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতির অধিনে সম্পদের সংকুলান অনুযায়ী ধাপে ধাপে একটি সুসংগঠিত সামরিক বাহিনী আমাদের গড়ে তুলতে হবে নিজেদের স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যই। সেই বাহিনীর দায়িত্ব হবে সমর্থ ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলা। অনেক দর কষাকষির পর সরকার অনুমতি দিল সেনা বাহিনী গঠন করার। সিদ্ধান্ত নেয়া হল- মুক্তি বাহিনীর নিয়মিত বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হবে ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রংপুর এবং যশোর সেনা নিবাসের পাচঁটি ব্রিগেড। এই ব্রিগেডগুলোকে পর্যায়ক্রমে গড়ে তোলা হবে পূর্ণাঙ্গ ডিভিশন রূপে। একই সাথে নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর অবকাঠামোও গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

প্রশ্ন দেখা দিল পাকিস্তানে আটক অবস্থায় থাকা ৩০,০০০ বাঙ্গালী সৈনিকদের কি করা হবে। যদিও তারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি তবুও তাদের বেশিরভাগই ছিলেন দেশপ্রেমিক এবং বাংলাদেশের প্রতি অনুগত এবং সমর্থক। তাই তাদের দেশে ফিরে আসার পর পূর্ণমর্যাদায় নিয়োগ করাই যুক্তিসঙ্গত হবে ফলে অনেকেই অভিমত প্রকাশ করেন। কেউ কেউ বললেন, “স্বাধীন বাংলাদেশের সেনা বাহিনীতে থাকবে শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই। যুদ্ধবন্দীরা দেশে ফিরে এলে সামরিক বাহিনীর বিধান অনুযায়ী তাদের সামরিক বাহিনী থেকে অব্যাহতি দিয়ে বেসামরিক ক্ষেত্রে নিয়োগ করা উচিত।” সরকার সিদ্ধান্ত নিল, “পাকিস্তান প্রত্যাগতদের সামরিক বাহিনীতেই নিয়োগ করা হবে।” একই সাথে সরকারি সিদ্ধান্তে বলা হল, “মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছরের সিনিয়রিটি দেয়া হবে পাকিস্তান প্রত্যাগতদের উপর।” এভাবেই সেনাবাহিনীর মধ্যে সুস্পষ্ট ফাটল সৃষ্টি করল আওয়ামী লীগ সরকার। তাদের এ সুদূরপ্রসারী চক্রান্তে সমর্থন জানিয়েছিলেন মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক উচ্চাভিলাষী এবং সুযোগ সন্ধানী সিনিয়র অফিসার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতির প্রয়োগ করে যে চরম সর্বনাশা খেলা শুরু করেছিলেন শেখ মুজিবর রহমান তার খেসারত জাতি এবং সেনাবাহিনীকে চরমভাবে দিতে হয়েছে পরবর্তিকালে।

এছাড়া অন্যায়ভাবে কোন কারণ ছাড়াই মেজর জিয়াউর রহমানকে সুপারসিড করে মেজর শফিউল্লাহকে সেনাবাহিনীর প্রধান নিয়োগ করে শেখ মুজিব সেনা বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেন। এভাবেই সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে জাতির মেরুদন্ড সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন শেখ মুজিব। সামরিক বাহিনীতে বিভেদ নীতি প্রণয়ন করার সাথে সাথে বিএলএফ পরবর্তিকালে মুজিব বাহিনী এবং অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে সেনাবাহিনীর মোকাবেলায় তৈরি করা হয় জাতীয় রক্ষীবাহিনী। সেনা বাহিনী গঠন করার অনুমতি সরকার দিলেও সেনাবাহিনীকে গড়ে তোলার তেমন কোন উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা সরকারিভাবে নেয়া হয়নি মুজিব আমলে। পক্ষান্তরে রক্ষীবাহিনীকে সামরিক বাহিনীর চেয়ে বেশি শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ভারতীয় সহযোগিতায়। রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছিল ভারতীয় সেনা বাহিনীর উপর। তাদের পোষাকও ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর পোষাকের মতো। ভারত সরবরাহ করে তাদের গাড়ি, অস্ত্র-শস্ত্র, সাজ-সরঞ্জাম, রসদপত্র এবং আনুসাঙ্গিক সমস্ত কিছু। এদের অফিসারদের প্রশিক্ষণ হত দেড়াদুনের ভারতীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সৈনিকদের ভারতীয় বাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষণ দিত ঢাকার অদূরে সাভারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সম্পাদক জনাব তোফায়েল আহমদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হত রক্ষীবাহিনী। সামরিক অধিনায়ক ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত প্রাক্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য কর্নেল নূরুজ্জামান। রক্ষীবাহিনী সাধারণ মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার করত। জনসাধারণ ক্রমশঃ রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি বিরূপ হয়ে পড়ে। রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের যে কাউকে বিনা বিচারে বন্দী এবং হত্যা করার ক্ষমতা প্রদান; অপরাধীদের দেশের প্রচলিত আইনে বিচার না করে গোপনে হত্যা করার প্রচলন এবং আওয়ামী লীগ বিরোধীদের নির্বিচারে অত্যাচার নিপীড়নের ফলে আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবের ভাবমুর্তি দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। তাছাড়া ভারতীয় বাহিনীর অনূরূপ জলপাই রং-এর পোষাক জনগণের মনে অবিশ্বাস ও সন্দেহের সৃষ্টি করে। তাদের মনে ধারণা জন্মে প্রয়োজনে মৈত্রী চুক্তির আওতায় আওয়ামী সরকার মতলব হাসিল করার জন্য যে কোন সময় রক্ষীবাহিনীর আবরণে ভারতীয় বাহিনীকে দেশের অভ্যন্তরেও ডেকে নিয়ে আসতে পারে। উপযুক্ত কোন এক সময় বাংলাদেশ সেনা বাহিনীকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে সরকার রক্ষীবাহিনীকেই সেনাবাহিনী হিসেবে অধিষ্ঠিত করবে; এ ধরণের কথাও শোনা যাচ্ছিল সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এ ধরণের বৈরী মনোভাবে এবং অবহেলায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা মনঃক্ষুন্ন হন।

একইভাবে দেশের বেসামরিক প্রশাসনিক অবকাঠামোকে দুর্বল করে তোলার জন্য সেখানেও বিভেদ নীতির প্রবর্তন করা হয়। তাজুদ্দিন সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল সদ্যমুক্ত বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো ভারতীয় আমলাদের সাহায্যে ঢেলে সাজাতে। কিন্তু তার সে প্রচেষ্টা বাঙ্গালী আমলাদের তীব্র বিরোধিতার ফলে কার্যকরী করা সম্ভব হয়নি। পরিণামে বাংলাদেশের বেসামরিক আমলারাও মুজিব সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাননি। সেনাবাহিনীর সদস্যদের মত তাদেরও সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে মুজিব সরকার। এভাবে জাতীয় জীবন ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় দু’টো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের দেশপ্রেমের যথার্থ মূল্যায়ন না করে তাদের প্রতি চরম অবহেলা প্রদর্শন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। বেসামরিক প্রশাসনকে সম্পূর্নরূপে দলীয় নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য আওয়ামী সরকার অভিজ্ঞ আমলাদের বাদ দিয়ে সে সমস্ত পদে দলীয় লোক নিয়োগের এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের দলীয় সমর্থকদের মাঝ থেকে প্রায় ৩০০ তরুণ যুবককে পাঠানো হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রশিক্ষণের জন্য। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরার পর তাদের প্রশাসনের বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ করা হয়। এদের বলা হয় ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস (আইএমস) ক্যাডার। এছাড়া পুরো বেসামরিক প্রশাসনের সর্বময় কর্তা হয়ে উঠেন শেখ মুজিবের বোনের জামাই জনাব সাইদ হোসেন। জনাব হোসেন ছিলেন একজন সেকশন অফিসার। রাতারাতি পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসন পরিচালনার সব ক্ষমতাই অলিখিতভাবে তার হাতে সঁপে দেন শেখ মুজিব। শেখ মুজিবের সমর্থনপুষ্ট জনাব সাইদ হোসেন সমস্ত বেসমারিক প্রশাসন চালাতে থাকেন অঙ্গুলী হেলনে। ফলে আমলাতন্ত্রের মধ্যেও অবক্ষয় শুরু হয়ে যায়। এটাও ছিল নীল নকশা বাস্তবায়নেরই একটি সূক্ষ্ম চাল।

 

ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান সুপারসিড (Supersede) হলেন

ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানকে সুপারসিড করে ব্রিগেডিয়ার শফিউল্লাহকে চীফ অব ষ্টাফ বানালেন শেখ মুজিব।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠন পর্বের শুরুতে আমি কুমিল্লাতে পোষ্টেড হই। কর্নেল জিয়াউর রহমান ছিলেন আমাদের প্রথম ব্রিগেড কমান্ডার। কুমিল্লাতে থাকাকালীন অবস্থায় তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নতি লাভ করেন। জেনারেল ওসমানী তখনো আমাদের কমান্ডার-ইন-চীফ। তার হেডকোয়টার্স তখন ২৭নং মিন্টু রোডে। অল্প কিছুদিন পর সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করে তিনি মন্ত্রীসভায় যোগদান করেন। সাধারণ নিয়মে জেনারেল ওসমানীর পর ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানকেই আর্মির সিনিয়র মোষ্ট অফিসার হিসেবে চীফ অব আর্মি ষ্টাফ বানানো উচিত ছিল। কিন্তু অত্যান্ত অন্যায়ভাবে জিয়াউর রহমানকে তার ন্যায্য পদ থেকে বঞ্চিত করা হল। স্বাধীনতার ঘোষক হওয়ার ফলেই আওয়ামী লীগ সরকার তার প্রতি এ ধরণের অবমাননাকর আচরণ করে তার জুনিয়র ব্রিগেডিয়ার শফিউল্লাহকে আর্মি চীফ অব ষ্টাফ পদে নিযুক্ত করে। অস্বাভাবিক এ পদোন্নতির ফলে শফিউল্লাহ শেখ মুজিব ও তার সরকারের একান্ত বিশ্বস্ত এবং অনুগত তাবেদার হয়ে তাদের খেদমত করতে শুরু করে। আর্মির স্বার্থ ও নিয়ম জলাঞ্জলী দিয়ে শফিউল্লাহ শেখ মুজিব ও তার সরকারের ইচ্ছা ও স্বার্থকেই প্রাধান্য দিতে থাকে। এর ফলেই মুজিব ভক্ত কয়েকজন অফিসারকে উত্তরোত্তর পদোন্নতি দিয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পূরণ করা হল নিয়ম বর্হিভূতভাবে। মুজিব সরকারের এ সমস্ত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আর্মির তরুণ দেশপ্রেমিক অংশ সোচ্চার হয়ে উঠেন।

 

আর্মিতে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়

ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানকে সুপারসিড করে ব্রিগেডিয়ার শফিউল্লাহকে চীফ অব ষ্টাফ পদে নিয়োগ করায় আর্মিতে আশংকাজনক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। শেখ মুজিবর রহমান সেটা জানতে পেরে আমায় ডেকে পাঠান; ঘনিষ্টতার সুবাদে তিনি আমাকে প্রায়ই ডেকে পাঠাতেন খবরা-খবর নিতে। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর ভেতরের খবর জানতে চাইতেন তিনি।

৩২নং ধানমন্ডিতে গিয়েই তার সাথে দেখা করলাম। তিনি জানতে চাইলেন শফিউল্লাহকে সেনা প্রধান বানানোর সিদ্ধান্তের ফলে সেনাবাহিনীতে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছে? আমি পরিষ্কারভাবে তাকে জানালাম- তার এ সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীতে অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। আমি তাকে বলেছিলাম অন্যায়ভাবে ব্রিগেডিয়ার জিয়াকে তার ন্যায্য পদে নিয়োগ না করে শেখ মুজিব অত্যন্ত ভুল করেছেন। কারণ এ সিদ্ধান্তে শুধু যে প্রচন্ড ক্ষোভই সেনাবাহিনীতে সৃষ্টি হয়েছে তা নয়; সরকার এবং সেনাবাহিনীর মাঝে ভুল বুঝাবুঝিরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সবাই তাকেই একান্তভাবে দায়ী করেছে জিয়াউর রহমানের প্রতি এ অবিচার করার জন্য। ফলে তারই ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে সেনাবাহিনীর সর্বস্তরের সদস্যদের কাছে। অবিলম্বে এ ভুলের সংশোধন হওয়া উচিত। আমার বক্তব্য শুনে শেখ মুজিব সেদিন বলেছিলেন, কর্নেল ওসমানীর পরামর্শ অনুযায়ীই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তিনি। সিদ্ধান্ত বদলিয়ে এই মূহুর্তে শফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াউর রহমানকে চীফ বানানো তার জন্য বিব্রতকর হয়ে দাড়াবে। তিনি এ জবাব দিয়েছিলেন তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে। তবে তিনি কথা দিয়েছিলেন কিছুদিন পর জিয়াউর রহমানকে চীফ অব ষ্টাফ বানানোর কথা তিনি পুর্নবিবেচনা করবেন। তার এ বক্তব্য অনেক কারণেই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তবুও আমি তার প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করে তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম যতদিন শফিউল্লাহ চীফ থাকেন ততদিন ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানকে সাধারণ ব্রিগেড কমান্ডার কিংবা চীফ অব ষ্টাফের পিএসও হিসাবে না রেখে উপপ্রধান হিসাবে নিয়োগ করলে সেনাবাহিনীতে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে সেটা অনেকাংশে কমে যাবে। জনাব মুজিব আমাকে কথা দিয়েছিলেন এ ব্যাপারে তিনি চিন্তা-ভাবনা করে দেখবেন। তিনি আমাকে একইসাথে অনুরোধ করেছিলেন, তার এই অভিমত ব্যক্তিগতভাবে ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানকে জানাতে এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রচার করতে। পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবের নির্দেশে আর্মিতে উঈঙঝ (ডেপুটি চীফ অব ষ্টাফ) পদ সৃষ্টি করা হয় এবং মেজর জেনারেল হিসাবে পদোন্নতি দিয়ে জিয়াউর রহমানকে সে পদে নিয়োগ করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, যোগ্য চীফ অব ষ্টাফ হিসাবে জনাব শফিউল্লাহর পদমর্যাদাও ছিল মেজর জেনারেল। আমাদের সবার প্রিয় জেনারেল জিয়াউর রহমানের চীফ অব ষ্টাফ পদে উন্নতির যে প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন তার বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রইলাম আমরা।

 

আমি এবং ৩২নং ধানমন্ডি

ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে ৩২নং ধানমন্ডির বাসভবন আমার জন্য ছিল অবারিত দ্বার। যখন ইচ্ছে তখনই আমি সেখানে যেতে পারতাম।

যখনই আমি ৩২নং এ গিয়েছি, সবসময় দেখেছি লোকের ভীড়; সবাই শেখ মুজিবকে ঘিরে রাখছে। কিন্তু কম লোকজনকেই দেখেছি তার সামনে কোন প্রশ্নের সঠিক এবং সত্য জবাব দিতে। বেশিরভাগ লোকই তোষামোদ করে যা বললে তিনি খুশি হন সেটাই বলত। আশ্চর্য হতাম তাদের চাটুকারিতা এবং মোশায়েবীপনায়। দর্শনার্থীরা একথা সেকথার পর সুবিধামত নিজের ব্যক্তিগত কাজটি বাগিয়ে নিয়ে কেটে পড়তেন। এটাই ছিল নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। তিনি আমাকে বিশেষভাবে স্নেহ করতেন। মুজিব পরিবারের অন্য সবাইও আমাকে এবং আমার স্ত্রী নিম্মীকে খুবই ভালোবাসতো। পাকিস্তান থেকে ফেরার পর ১৯৭২ সালে আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে তিনি স্বপরিবারে উপস্থিত হয়ে আমাদের আর্শীবাদ করেছিলেন। সে অনুষ্ঠানই ছিল তার বাংলাদেশে আসার পর প্রথম কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে উপস্থিতি। পুরো মন্ত্রী পরিষদও উপস্থিত ছিলেন সে অনুষ্ঠানে। আমি ও আমার পরিবারবর্গ রাজনৈতিকভাবে তার দল ও রাষ্ট্র পরিচালনা করার নীতিকে সমর্থন না করলেও তাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। নিজের কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য আমি তার কাছে কখনোই যাইনি। যেতাম সত্যকে তার কাছে তুলে ধরার জন্য। ভাবতাম, সবাই যেখানে চাচাগিরী করছে সেখানে সাহস করে সত্যকে তার সামনে তুলে ধরলে তিনি নিশ্চয়ই তা অনুধাবন করতে পারবেন এবং এতে করে তার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে তার সুবিধা হবে। তার রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের আশা-আকাংখার প্রতিফলন ঘটবে। একদিন বেশ রাত করে ধানমন্ডির এক বন্ধুর বাসার পার্টি থেকে ফিরছিলাম আমি ও নিম্মী। মশুলধারে বৃষ্টি পড়ছে। অল্পদূরেও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ইন্টারকন ছেড়ে পুরনো গণভবন মানে বর্তমানের সুগন্ধার কাছাকাছি এসেছি; হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে একটি গাড়ি অতি দ্রুতগতিতে আসছে দেখলাম। দূর থেকেই গাড়ির ভিতর থেকে হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। কিছু উশৃঙ্খল তরুন বেসামাল অবস্থায় হৈ-হুল্লোড় করছিল। গাড়িটিও এগিয়ে আসছিল ঠিক একই অবস্থায় একেবেকে। নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য গাড়ি একটু সাইড করতেই গাড়ি স্কিড় করে গিয়ে জোরে মুখোমুখি ধাক্কা খেল সামনের ল্যাম্পপোষ্টের সাথে। জোরে ধাক্কা লাগায় ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। সামনের বনেটটাও দুমড়ে-মুচড়ে ভিতরে ঢুকে গেছে। গাড়ি কিছুতেই আর স্টার্ট নিচ্ছে না। অন্য গাড়িটি আমাদের অবস্থা দেখে না থেমে আরো দ্রুতবেগে দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। বৃষ্টির প্রচন্ডতা ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। রাত অনেক হয়েছে তার উপর এমন বৃষ্টি তাই রাস্তাও একদম ফাঁকা। ষ্টিয়ারিং এর সাথে মাথা লেগে মাথা ফেটে রক্ত ঝরে পরছে আমার কপাল বেয়ে। নিম্মীর অবশ্য কিছুই হয়নি। আমার রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেছে বেচারী। কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ইঞ্জিনটা একটু নেড়েচেড়ে দেখছিলাম যদি কোনমতে গাড়িটা স্টার্ট নেয়। না; কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। হঠাৎ সাইরেন বাজিয়ে রাষ্ট্রপতির কাফেলা এগিয়ে আসছে দেখতে পেলাম। আমি তখন অসহায় অবস্থায় দাড়িয়ে আছি গাড়ির পাশে। কাফেলা কাছে আসতেই রাষ্ট্রপতির গাড়ি দাড়িয়ে পড়ল। গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি মুখ বের করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কি ব্যাপার? কপালের রক্তক্ষরণ দেখে বুঝতে পারলেন গাড়ির এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। মুহুর্তে তিনি তার একজন সহযোগীকে নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে গাড়িতে করে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তার হুকুমে আমি ও নিম্মী তার কাফেলারই একটি গাড়িতে করে সিএমএইচ-এ পৌঁছালাম। চিকিৎসার পর তার গাড়িতেই বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফিরে দেখি বাসার সবাই উৎকন্ঠিত অবস্থায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমার মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে সবাই ভড়কে গিয়েছিল। রাষ্ট্রপতি বাড়ি ফিরেই মালিবাগে আমাদের দুর্ঘটনার খবরটা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ফোনে অবশ্য জানানো হয়েছিল অ্যাকসিডেন্ট তেমন একটা সিরিয়াস নয়; তাই ঘাবড়াবার কোন কারণ নেই। আব্বাকে আস্বস্ত করার জন্য বলা হয়েছিল দুর্ঘটনাস্থলের কাছ দিয়ে যাবার সময় আমাদের দেখতে পেয়ে স্বয়ং রাষ্ট্রপতিই আমাদের গাড়ি করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবার বন্দোবস্ত করেছেন। সবাইকে দুঃশ্চিন্তামুক্ত করার জন্য বলেছিলাম, “Injury is not serious at all only three stitches that’s all. So nothing to worry about and Nimmi is absolutely unhurt.”

এ ঘটনার অবতারনা এখানে এর জন্য করা হল যা থেকে পাঠক বুঝতে পারবেন ব্যক্তি এবং পারিবারিক পর্যায়ে মুজিব পরিবারের সাথে আমাদের কি ধরণের ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু কোন সম্পর্কই নীতি-আদর্শের উর্ধ্বে নয়। তাই আমিও পারিনি আপোষ করতে। ব্যক্তি মুজিব নয়; গণবিরোধী পুতুল সরকার প্রধান, গণতন্ত্রের হত্যাকারী, বাকশালী স্বৈরশাসনের প্রবর্তক শেখ মুজিবর রহমানের সাথে।

 

কর্নেল তাহের ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক কমান্ডার

কুমিল্লা ব্রিগেড জনহিতকর কাজে লিপ্ত হয়। আওয়ামী লীগ সেটা অপছন্দ করে। কর্নেল তাহেরকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

জিয়াউর রহমানের জায়গায় ব্রিগেড কমান্ডার হিসাবে পোষ্টেড হলেন আমার পূর্ব পরিচিত এবং সুহৃদ কর্নেল তাহের। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা সর্বদাই যোগাযোগ রাখতাম ঘনিষ্ঠভাবে। তরুণ কর্নেল তাহের ছিলেন অসীম সাহসী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

সদ্য প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনীতে অবকাঠামো গড়ে তোলা ছিল অত্যন্ত দূরূহ কাজ। আমাদের প্রয়োজনীয় প্রায় কিছুই নেই তখন। নেই পর্যাপ্ত হাতিয়ার, ইকুইপ্টমেন্ট, পোশাক-পরিচ্ছদ, নেই টুপি, বুট, প্রয়োজনীয় রশদপত্র এবং প্রশিক্ষণের সরঞ্জাম। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে কুমিল্লায় সিদ্ধান্ত নিলাম যুদ্ধ বিধ্বস্ত ক্যান্টনমেন্টকে বাসপযোগী করে গড়ে তোলার সাথে সাথে আমাদের অপারেশন এরিয়াতে গিয়ে পুর্নঃগঠন কাজে জনগণকে আমরা সাধ্যানুযায়ী সাহায্য করব। রাস্তাঘাট মেরামত, ব্রিজ কালভার্ট ঠিক করা, বাড়ি-ঘর তৈরির কাজে সাহায্য করা হবে। হেলথ সার্ভিস, ধ্বংসপ্রাপ্ত স্কুল কলেজগুলোকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা প্রভৃতি কাজে আমরা স্থানীয় জনগণের প্রচেষ্টায় সাহায্য করব কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের উদ্ধুদ্ধ করেছিল এ ধরণের উদ্যোগ নিতে। আমাদের এ উদ্যোগকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানিয়েছিল জনগণ। এই ধরণের কর্মতৎপরতা আমরা জনগণের মনে এই ধারণা জন্মাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে, শোষণমূলক পাক বাহিনী এবং বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে মূল্যবোধ ও চারিত্রিক ব্যাতিক্রম রয়েছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী জনগণের সেবায় নিবেদিত প্রাণ এবং দেশপ্রেমিক। জনগণকে শোষণ এবং নির্যাতন করার জন্য এ সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা যাবে না।

সেনা বাহিনীর জনপ্রিয়তাই শুধু যে বেড়ে গিয়েছিল আমাদের তৎপরতায় তাই নয়; আমাদের সর্ম্পকে জনগণের মধ্যে গড়ে উঠেছিল একটা বিশ্বাসযোগ্য নির্ভরশীলতা। আমাদের ধরণের গঠনমূলক তৎপরতার সাফল্যের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের সর্বত্র। আমাদের সাফল্য এবং ইতিবাচক দিকগুলো অন্যান্য ফরমেশনের দেশপ্রেমিক সচেতন অংশের মাঝে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল। যার ফলে অন্যান্য জায়গায় বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরাও এ ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এ ধরণের গণমুখী ভূমিকা পালনের জন্য অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শাসকমহল এমনকি সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠিও আতংকিত হয়ে উঠে। জনগণের সাথে সেনাবাহিনীর এ ধরণের সুসম্পর্ক এবং বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে উঠাকে তারা তাদের স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ জুড়ে তখন ব্যাপক রিলিফ তৎপরতা চলছিল। রিলিফ বিতরণের ক্ষেত্রে স্থানীয় এবং কেন্দ্রিয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের অসাধুতার কারণে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনেরা রিলিফ পাচ্ছিলেন না। আমরা আমাদের অধিনস্ত এলাকায় রিলিফ বিতরণের ব্যাপারে সবরকম দুর্নীতির বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার ফলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা ঠিকমত রিলিফ সামগ্রী পান৷ এতে বিশেষভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের স্বার্থে আঘাত লাগে ফলে তারা আমাদের বিরুদ্ধে ভীষণভাবে চটে যান। এরই ফলে পার্টি প্রধান শেখ মুজিব জেনারেল শফিউল্লাহর মাধ্যমে এক আদেশ জারি করে আমাদের গণমুখী সমস্ত তৎপরতা বন্ধ করে দেন। আদেশের স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে প্রচার চালানো হয়- সেনাবাহিনী সেবামূলক প্রতিষ্ঠান নয়।

 

কুখ্যাত আত্রাই অপারেশন

শেখ মুজিব তার অনুগত আস্থাভাজন কর্নেল সাফায়াত জামিলকে আত্রাই ও পাবনা অঞ্চলে সরকার বিরোধী আন্দোলন নির্মূল করার জন্য নিয়োগ করার জন্য নিয়োগ করেন।

১৯৭২ সালের মাঝামাঝি জনাব ওহিদুর রহমান ও টিপু বিশ্বাসের নেতৃত্বে বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীরা আত্রাই, পাবনা, রাজবাড়ি জেলার কিছু কিছু জায়গায় বেশ তৎপর হয়ে উঠে। শেখ মুজিব তাদের দমন করার জন্য তার বিশেষ প্রিয়ভাজন কর্নেল সাফায়াত জামিলকে (তৎকালীন রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার) হুকুম দিলেন তাদের নির্মূল করার জন্য। ব্যক্তিগত অনুকম্পা লাভের জন্য কর্নেল সাফায়াত জামিল অন্ধের মত আত্রাই অপারেশনে ঝাপিয়ে পড়লেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পরামর্শে ঐ সমস্ত এলাকা থেকে সমর্থ ছেলে মেয়েদের ধরে এনে কোন রকম তদন্ত এবং বিচার ছাড়াই তাদের মেরে ফেলার এক জঘণ্য খেলায় মেতে উঠলেন তিনি। তার এই অন্যায় তৎপরতার বিরোধিতা করে তারই ব্রিগেড মেজর ক্যাপ্টেন নূর চৌধুরী। সাফায়াত জামিলকে ষ্টাফ অফিসার হিসাবে নূর বোঝাতে চেষ্টা করেছিল যে, শেখ সাহেবের প্রতি তার অন্ধ আনুগত্য থাকলেও এভাবে ব্যক্তি স্বার্থে নিষ্ঠুরের মত ছেলে মেয়েদের মেরে ফেলা অন্যায় এবং অযৌক্তিক। এ ধরণের পাশবিকতার জন্য নিজের বিবেকের কাছেই তিনি একদিন দায়ী হয়ে পড়বেন। অযুক্তিক এই হত্যাযজ্ঞের ভাগীদার হওয়া ক্যাপ্টেন নূরের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ক্যাপ্টেন নূরের এ পরামর্শ সেদিন কর্নেল সাফায়াত জামিল গ্রহণ করেননি। ফলে ক্যাপ্টেন নূর বাধ্য হয়ে নিজের উদ্যোগেই হেডকোয়াটার্সে পোষ্টিং নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। আত্রাই অপারেশনের সাফল্যের জন্য শেখ মুজিব পুরষ্কার স্বরূপ কর্নেল সাফায়াতকে পরে ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করেন। সামরিক বাহিনীর অফিসার ও সদস্যদের বদলি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজেদের অনুগত রাখার নীতি গ্রহণ করে মুজিব সরকার। এমনকি কৃতি ও জনপ্রিয় অনেক সামরিক অফিসারকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান এবং বিদেশের দূতাবাসে নিয়োগ করার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছিল আওয়ামী সরকার।

 

সেনা পরিষদ

সেনা বাহিনীর কিছু সমমনা সদস্য সেনা পরিষদ গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত সব অফিসারদের ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীতে পুনর্বাসন করা হয়। শেখ মুজিবর রহমানের বিশেষ আস্থাভাজন এ সমস্ত অফিসারদের একটি অংশ শেখ সাহেবের চোখ ও কান হিসাবে সেনাবাহিনীর উপর নজর রাখছিল। প্রভাবশালী এই মহলটির করুণা পেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ এগিয়ে নেবার জন্য তাদের দালালি করতে তখন অনেকেই নীতি বিসর্জন দিয়ে তাদের এজেন্ট হয়ে যান। এদের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর সব খবরা-খবর শেখ মুজিবের কান অব্দি পৌঁছে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হল।

সেই সময় এদের চোখে ধুলো দিয়ে আমরা কিছু তরুণ অফিসার উদ্যোগ নেই ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং মত বিনিময়ের মাধ্যমে সচেতন দেশপ্রেমিক ও সমমনা ব্যক্তিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি অঘোষিত সংগঠন গড়ে তোলার। প্রতিষ্ঠিত হয় সেনা পরিষদ। সেনা পরিষদ সরকারের প্রতিটি নীতিও পদক্ষেপ সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ থাকত। প্রতিটি পদক্ষেপ এবং ইস্যুর চুলচেরা বিশ্লেষন করে জাতীয় পরিসরে এবং সামরিক বাহিনীর উপর এসমস্ত নীতি পদক্ষেপের প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়া কি হবে অথবা হতে পারে সে বিষয়ে অধিনস্ত সৈনিকদের বুঝিয়ে বলা হত সেনা পরিষদের তরফ থেকে। সৈনিকদের সচেতনতার মান বাড়িয়ে তোলার জন্যই এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম আমরা। সরকারি নীতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে দৃষ্টি রাখা ছাড়া দেশ ও জাতির ভবিষ্যত নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করত সেনা পরিষদ। কি হচ্ছে, কি হওয়া উচিত, কি উচিত নয় বিভিন্ন জাতীয় সমস্যা এবং সম্ভাব্য সমাধান প্রভৃতি বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা করা হত সেনা পরিষদের ষ্টাডি সার্কেলগুলোতে। সবকিছুই করা হত অতি সর্তকতার সাথে, গোপনে বেসামরিক আমলা, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি মহলের দেশপ্রেমিক সচেতন সদস্যদের সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিভিন্ন সূত্রে যোগাযোগ রক্ষা করে মত বিনিময় করতেন সেনা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সদস্যরা। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিভিন্ন স্তরের অনেকের সাথে যোগাযোগ ছিল সেনা পরিষদের। আন্তরিকভাবে নিয়মিতভাবে খবরা-খবর আদান-প্রদান এবং খোলামেলা মত বিনিময়ের ফলে ক্ষেত্র বিশেষে অনেকের সাথে সেনা পরিষদের সদস্যদের সম্পর্ক নিবিড় হয়ে উঠে। সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সেনা পরিষদের সদস্যরা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হন। অনেকের সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও গড়ে উঠে। আলোচনাকালে অনেকেই মত পোষণ করেন- জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে জনগণকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে বাচাঁবার সংগ্রামে সেনা বাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশকে অগ্রণী হয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার দায়িত্ব নিতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই।

তাদের এ ধরণের বক্তব্যের জবাবে সেনা পরিষদের তরফ থেকে বলা হত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জনগণের মুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে নেবার জন্য কিছু করণীয় থাকলে সে দায়িত্ব যেকোন ত্যাগের বিনিময়ে পালন করতে প্রস্তুত রয়েছে সেনা পরিষদ তবে সেনা পরিষদের যে কোন ভূমিকাই হবে সহায়ক শক্তি হিসেবে সংগ্রামকে এগিয়ে নেবার লক্ষ্যে; নিজেদের ক্ষমতা দখলের জন্য নয়। তৃতীয় বিশ্বে রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা কিংবা সামাজিক অস্থিরতার সুযোগে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ার ফলে কোন দেশেই গণতান্ত্রিক সুষম সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি; প্রতিষ্ঠিত হয়নি মানবিক অধিকার। একমাত্র সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্ভব সার্বিক আর্থ-সামাজিক মুক্তি অর্জন আর এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্বের দায়িত্ব অবশ্যই নিতে হবে পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের। এটাই ছিল সেনা পরিষদের দৃঢ় বিশ্বাস।

এ সম্পর্কে মেজর রফিক পিএসসি তার বই ‘বাংলাদেশ সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সংকট’ এ লিখেছেন, “সমসাময়িক ইতিহাসে কম্বোডিয়া, গণচীন, কিউবা, ভিয়েতনাম তথা সর্বত্রই মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন হবার পর ক্ষমতা দখল করেছে। শুধু বাংলাদেশেই ঘটেছে এর ব্যতিক্রম। মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার পর অস্ত্র সমর্পন করেছে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে; দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন বাধার সৃষ্টি করেনি। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী অফিসার- সৈনিকেরা স্বাভাবিকভাবেই দেশের দারিদ্রতা, অর্থনৈতিক অবক্ষয় ও দুর্নীতি দেখে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকরা সরকার পরিচালনার মত একটি দূরহ রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে থাকে। মেজর ডালিম, মেজর পাশা, মেজর বজলুল হুদা, মেজর শাহরিয়ার তখন কুমিল্লা সেনানিবাসে চাকুরিরত ছিলেন। এরা প্রায়ই অবসর সময়ে মিলিত হতেন এবং দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজ লোকদের নিয়ে সরকার পরিচালনা এবং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা সর্ম্পকে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন। এভাবে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৭২ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্নেল তাহের ও ঢাকা সেনানিবাসে কর্নেল জিয়াউদ্দিন প্রতি সপ্তাহে ষ্টাডি পিরিয়ডের নামে অফিসারদের সমবেত করে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা এবং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে তরুণ অফিসারদের সঙ্গে সমালোচনায় লিপ্ত হতেন।”

 

কর্নেল জিয়াউদ্দিন তার সাড়া জাগানো নিবন্ধ সাপ্তাহিক হলিডেতে ছাপিয়ে পদত্যাগ করেন। কর্নেল তাহেরকেও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।

“এ্যান্টি স্মাগলিং” এবং “অপারেশন ফুড” থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয় সেনা সদস্যদের মাঝে। সবাই এই সিদ্ধান্তে হতাশ এবং ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন।

এই পরিস্থিতিতে কর্নেল জিয়াউদ্দিন (ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার) অভিমত প্রকাশ করেন, “বর্তমান সরকারের অধিনে সামরিক বাহিনীতে থেকে জনগণের স্বার্থে কাজ করা সম্ভব নয়। সরাসরিভাবে সরকারের বিরোধিতা করাও সম্ভব নয়। তাই সরকারি অপশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের মাঝ থেকেই গড়ে তুলতে হবে দুর্বার প্রতিরোধ সংগ্রাম।” তার অভিব্যক্তিতে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পেলাম। তিনি সক্রিয় রাজনীতির কথা ভাবছেন। তার অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে সেনা পরিষদের মনোভাব ছিল তার বক্তব্য অবশ্যই যুক্তিসম্পন্ন। সরকার বিরোধী আন্দোলনকে বিজয়ের চুড়ান্ত পর্যায়ে এগিয়ে নেয়া সম্ভব জনগণের রাজনৈতিক আন্দোলনে গতিশীলতা সৃষ্টি করেই। মূলতঃ এ দায়িত্ব পালনের ভার দেশপ্রেমিক এবং জাতীয়তাবাদী দল ও নেতৃত্বের উপর। তবে আমরাও সেনাবাহিনীর ভেতরে অবস্থান করেও জনগণের আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারব যদি নিজেদের সংগঠিত করতে পারি।

১৯৭২ সালের গ্রীষ্মকালে সাপ্তাহিক হলিডে-তে কর্নেল জিয়াউদ্দিন তার সাড়া জাগানো নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এ নিবন্ধের মাধ্যমে তিনি সরাসরি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতি ক্ষমতাসীনদের বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনেন। তিনি তার নিবন্ধে লেখেন, “Independence has become an agony for the people of this country. Stand on the street and you see purposeless, spiritless, lifeless faces going through the mechanics of life. Generally, after a liberation war, the new spirit carries through and the country builds itself out of nothing. In Bangladesh, the story is simply other way round. The whole of Bangladesh is either begging or singing sad songs or shouting without awareness. The hungry and poor are totally lost. The country is on the verge of falling into the abyss.”

নির্ভিক এই মুক্তিযোদ্ধা এই নিবন্ধে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পচিঁশ বছরের গোপন চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি সর্বপ্রথম তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের উল্লেখ করে তিনি বলেন, “We fought without him and won. If need be we will fight again without him.”

শেখ মুজিবর রহমান সে সময় লন্ডনে গলব্লাডার অপারেশনের গলব্লাডার অপারেশনের পর সুইজ্যারল্যান্ডের এক স্বাস্থ্যনিবাসে অবস্থান করছিলেন। কর্নেল জিয়াউদ্দিনের লেখা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে জানতে পেরে তড়িঘড়ি করে তিনি দেশে ফিরে এলেন। কর্নেল জিয়াউদ্দিনের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক কষ্টের এবং ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা নিয়ে যে কোন ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা করতে আবার প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে দ্বিধাবোধ করবেন না তারা। তার এই লেখা থেকে দেশবাসী প্রথম পরিষ্কারভাবে জানতে পারেন, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্ৰ চলছে। প্রমাদ গুনলেন আর্মি চীফ শফিউল্লাহ। তিনি জিয়াউদ্দিনকে হাতে পায়ে ধরে অনেক মিনতি করেছিলেন যেন শেখ সাহেব ফিরে এলে ছাপানো নিবন্ধের জন্য তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। কারণ শফিউল্লাহ বুঝতে পেরেছিলেন কর্নেল জিয়াউদ্দিনের লেখা রাজনৈতিক মহলে বিশেষ করে তরুণ ও ছাত্রসমাজ এবং সেনাবাহিনীতে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সেনাবাহিনীতে কোন প্রকার বিষ্ফোরন যাতে না ঘটে তার জন্যই মিনতি জানিয়েছিলেন তিনি। শেখ মুজিব দেশে ফিরে বিষ্ফোরম্মুখ অবস্থার গুরুত্ব উপলব্দি করতে পেরে জেনারেল শফিউল্লাহকে জিজ্ঞেস করেন কি করে অবস্থার সামাল দেয়া যায়? শফিউল্লাহ শেখ সাহেবকে জানালেন, নিবন্ধ ছাপানোর পর কর্নেল জিয়াউদ্দিনের ভাবমুর্তি তরুণ অফিসার এবং জোয়ানদের মধ্যে আরো বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় কর্নেল জিয়াউদ্দিনের প্রতি কোন কঠিন ব্যবস্থা নেয়া হলে আর্মির মধ্যে আকষ্মিক বিষ্ফোরন ঘটে যেতে পারে। শেখ মুজিব তার মোড়লী বুদ্ধি দিয়ে ঠিক করলেন কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে ডেকে কিছু বকাবকি করে তাকে দিয়ে কৌশলে মাফ চাইয়ে নেবেন। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে বলা হল জেনারেল সফিউল্লাহকে। গণভবনে জিয়াউদ্দিনকে নিয়ে এলেন শফিউল্লাহ। প্রধানমন্ত্রীর ঘরে ঢুকে স্যালুট করে দাড়াতেই গর্জে উঠলেন শেখ মুজিব, “তুমি কোন সাহসে এ ধরণের নিবন্ধ ছাপালে? জানো, তোমার অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান? সামরিক বাহিনীতে চাকুরীরত অবস্থায় এ ধরণের লেখা ছাপানো বেআইনী। আমি তোমাকে এ ধরণের গুরুতর অপরাধের জন্য কঠিন শাস্তি দিতে পারি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তোমার বিশেষ অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে এবারের মত তোমাকে আমি মাফ করব যদি তুমি শফিউল্লাহকে লিখিতভাবে দাও যে, তুমি অন্যায় করেছ।” একনাগাড়ে বলে গেলেন শেখ মুজিব। সবকিছুই চুপ করে শুনলেন কর্নেল জিয়াউদ্দিন।

তিনি জবাব দিলেন, “শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী। আপনার দয়া-দাক্ষিণ্য আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কারণ আমি কোন অন্যায় করিনি। আমি যা লিখেছি সেটা আমার বিশ্বাস। অতএব, ক্ষমা চাওয়ার কিংবা ক্ষমা পাওয়ার কোন অবকাশ নেই এখানে। আপনি ঠিকই বলেছেন যে, চাকুরীতে থাকাকালীন অবস্থায় এ ধরণের লেখা ছাপানো অন্যায়। তাই আমি আমার কমিশনে ইস্তফা দিয়েই আমার নিবন্ধ ছেপেছি।” এভাবেই সেদিন শার্দুল সন্তান কর্নেল জিয়াউদ্দিন শেখ মুজিবকে স্তম্ভিত করে দিয়ে গণভবন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তার বেরিয়ে আসার পর শফিউল্লাহকে শেখ মুজিব অনুরোধ করেছিলেন জিয়াউদ্দিনকে বোঝাবার জন্য। হেডকোয়াটার্সে ফিরে এসে জেনারেল শফিউল্লাহ, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ প্রমুখ অনেকেই কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। জিয়াউদ্দিন তাদের চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন তার শাণিত জবাব দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, নিজের আত্মার সাথে বেঈমানী করতে পারবেন না সামান্য চাকুরীর লোভে। তাছাড়া তাদের মত মেরুদন্ডহীন কমান্ডারদের অধিনে একই সংগঠনে তাদের অধিনস্ত হয়ে চাকুরী করে তিনি তার আত্মসম্মান খোয়াতে রাজি নন। এভাবেই সেনাবাহিনীতে ইস্তফা দিয়ে তিনি পরে সর্বহারা পার্টিতে যোগদান করেন । এ ঘটনার কিছুদিন পর অন্যায়ভাবে কর্নেল তাহেরকে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাকে ড্রেজার অর্গানাইজেশনের পরিচালক পদে নিয়োগ করা হয়। এই নতুন পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর কর্নেল তাহের জাসদের সশন্ত্র গোপন সংগঠন ‘গণবাহিনী’ গড়ে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনী থেকে তাকে বের করে দেবার পরও আমাদের যোগসূত্র ছিন্ন হয়নি কখনো। আমরা আমাদের স্ব স্ব অবস্থানে থেকে একই লক্ষ্যে কাজ করে যেতে থাকি। লক্ষ্য একটাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন। গণতান্ত্রিক সুষম সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধশালী এবং মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে সাহায্য করা। আমাদের মাঝে আদর্শগত বন্ধন এত সুদৃঢ় ছিল যে, আমরা বিশ্বাস করতাম জাতীয় মুক্তির বৃহৎ স্বার্থে যেকোন ক্রান্তিলগ্নে আমরা সবাই এক হয়ে লড়তে পারব নির্দ্বিধায়।

 

অসাংবিধানিক গোপন রাজনীতি অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠে

শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী দলগুলোকে আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে বাধ্য করে ফলে গোপন রাজনীতি একমাত্র বিকল্প হয়ে উঠে।

১৯৭৩ সালে জাতীয় নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হল আওয়ামী লীগ। কিন্তু দেশের অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না। সার্বিক অবস্থার অবনতির গতি দ্রুততর হল মাত্র। মরিয়া হয়ে উঠলেন সরকার; রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার প্রচেষ্টায়। সরকারি দলের লক্ষ্যহীনতা ও নৈরাজ্যিক কার্যকলাপের মুখে বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষ করে বিরোধী দলগুলি এবং সামগ্রিকভাবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি নিক্ষিপ্ত হল এক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি শাসিত যে কোন দেশেই কোন বিশেষ একটি দল দেশের শাসনতন্ত্রকে দলীয় সম্পদ মনে করে না৷ সেখানে শাসনতন্ত্রের প্রতি অনুগত দুই বা ততোধিক রাজনৈতিক দল থাকে। ক্ষমতার হাত বদল হয় সে সমস্ত দলগুলোর মধ্যেই। জাতীয় স্বার্থের মৌলিক বিষয়ের প্রশ্নে তারা একে অপরের সহযোগিতা করে থাকে। এই সহযোগিতার ভিত্তিতেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে যেখানে সরকার নিজের স্বার্থের সাথে রাষ্ট্রের স্বার্থকে এক করে দেখেছে সেখানে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ মোটেই সম্ভব নয়। বিরোধী দলগুলো অনৈক্য এবং অন্যান্য কারণে আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারছে না। তাদের উপর নিষ্পেষন চালিয়ে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে সেখানে বিরোধী দলগুলো ভবিষ্যতে কখনো পর্যাপ্ত শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে কিনা সে বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এই প্রক্রিয়া আওয়ামী লীগকেও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেবে না। যেভাবে সরকারি দল আইনের শাসনের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সব নীতি বিসর্জন দিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে উঠে- পড়ে লেগেছে তাতে অদূর ভবিষ্যতেই দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে স্বৈরাচার। স্বৈরাচার যখন খোলা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশের সব দরজা বন্ধ করে দেয় তখনই স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দানা বেঁধে উঠে রাজনৈতিক গোপন তৎপরতা। রাজনীতিতে বেজে উঠে অস্ত্রের ঝনঝনানি। রাজনৈতিক বিরোধিতা রূপ নেয় সশস্ত্র সংগ্রামের।

১৯৭৩ সালের ১১ই নভেম্বর বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলনে শেখ মুজিবের ভাষণই এর বড় প্রমাণ। তিনি ঐ ভাষণে বলেন, “যারা রাতের বেলায় গোপনে রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, সাধারণ মানুষকে হত্যা করে তাদের সঙ্গে ডাকাতদের কোন পার্থক্য নেই। কেউ যদি নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করতে পারে তাহলে আমাদেরও তাদের গুলি করে হত্যা করার অধিকার আছে।” (বঙ্গবার্তা ১২ই নভেম্বর ১৯৭৩) ইতিহাসের লিখন যে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান অস্ত্রের জোরে বিরোধীদের শায়েস্তা করার চেষ্টা করেছেন তার পতনও ঘটেছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অস্ত্রের মুখেই।

ঐ একই দিন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মাওলানা ভাসানী রাজশাহীর এক জনসভায় বলেন, “সরকার যেভাবে বিরোধী দলীয় কর্মী হত্যা করা শুরু করেছে তার ফলে এ দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ বন্ধ হতে চলেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কোন সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করা যাবে না। দমন নীতি এবং মানুষকে হত্যা করে দেশ শাসন করা যায় না৷ আইয়ূব খান-ইয়াহিয়া খানের পতন হয়েছে অতীতে; এ ধরণের দমন নীতি চলতে থাকলে এ সরকারের পতনও অবশ্যম্ভাবী। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নাও। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি এবং বিরোধী দল ছাড়া কোন গণতান্ত্রিক সরকার বেচে থাকতে পারে না।” (১২ই নভেম্বর ১৯৭৩) রাজনৈতিক কর্মী নিধনের ব্যাপারে জাসদের বক্তব্য ছিল একই রকম। সরকার এবং বিরোধী পক্ষের বক্তব্য থেকে যে জিনিষটা স্পষ্ট হয় তাহল আজকের বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পরিবেশ আছে সেটা কেউই স্বীকার করছেন না। উভয় পক্ষই একমত যে, দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক অসি’রতা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে।

বাংলাদেশের শান্তি-শৃংখলা ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকে রক্ষা ও পরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর বক্ত্যবের দু’টি বিষয় এখানে বিশেষভাবে প্রাণিধানযোগ্য। প্রথমত : তিনি বিরোধী দলীয় কর্মীদের ‘ডাকাত’ বলে অভিহিত করছেন। দ্বিতীয়ত: সে সমস্ত ডাকাতদের গুলি করে হত্যা করার অধিকারও তার রয়েছে বলে দাবি করছেন। বিরোধী কর্মীদের চোর, ডাকাত, দেশদ্রোহী, ক্রিমিনাল আখ্যা দেয়ার রেওয়াজ সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল। ১৯৫০ সালে নূরুল আমিন বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দকে ‘ডাকাত দলের সরদার’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। রাজশাহীর ‘ছাপড়া-ওয়ার্ডে’ নাচোল বিদ্রোহের রাজবন্দীদের গুলি করে মারা এবং ইলা মিত্ৰকে পুলিশ কর্তৃক ধর্ষণকেও সরকার তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দাবি করেছিলেন। ১৯৭০ সালে যখন রাজবন্দীদের মুক্তির জোর দাবি উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তানে তখন স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খানও পূর্ব পাকিস্তানের সব রাজনীতিবিদদের ‘ক্রিমিনাল’ আখ্যায়িত করেছিলেন এবং তাদের মুক্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করেছিল নূরুল আমীন এবং ইয়াহিয়া খানের দোসররাই ছিল প্রকৃত ক্রিমিনাল। বিরোধী পক্ষকে চোর, ডাকাত ইত্যাদি বলে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টার ফল কি দাড়ায় সেটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়৷ পাকিস্তানের রাজনীতিতে এ বিষয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও রয়েছে প্রচুর। কিন্তু দীর্ঘদিনের সেই শিক্ষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব শেখ মুজিবর রহমানের দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে চোর-ডাকাত আখ্যা দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ যে সুগম করছেন না সেটা বলাই বাহুল্য। বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতি বিরাজমান সে অবস্থায় সরকার এবং বিরোধী দলসমূহ যে দাবি করছে তাতে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অবক্ষয় অবধারিত।

 

সেনাবাহিনীকে “এ্যান্টি স্মাগলিং অপারেশন” এর জন্য তলব করা হয়

১৯৭৩ এর নির্বাচনের প্রাক্কালে চরম দুর্নীতি এবং ব্যাপক চোরাচালানের ফলে রিলিফ অপারেশনে বিপর্যয় দেখা দেয়। ফলে সরকার অবস্থা সামাল দিতে সেনাবাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যে তলব করতে বাধ্য হয়।

সেনাবাহিনীর তরুণ মুক্তিযোদ্ধা অফিসার এবং সদস্যরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে চোরাচালান বন্ধ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাদের আন্তরিকতা অল্পসময়ের মধ্যেই জনগণের মনে আশার সঞ্চার করে। এই অপারেশনের নাম ছিল ‘অ্যান্টি স্ম্যাগলিং অপারেশন’। আমরা সমমনা সবাই সিদ্ধান্ত নেই যদিও তখনো আমরা সুগঠিত নই তবুও যেকোন ত্যাগের বিনিময়েই আমাদের দায়িত্ব পালন করে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটাব। এ সুযোগের পূর্ণ সদ্বব্যবহার করতে হবে আমাদের। এই অপারেশন করার সময়ই তরুণ অফিসার এবং সৈনিকগণ ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ও টাউট বাটপারদের অসৎ চরিত্র এবং সম্পদ গড়ে তোলার লোভ-লালসার অভিলাষ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করতে সমর্থ হন। রাজনৈতিক নেতাও টাউটদের সঙ্গে তারা মুখোমুখি দ্বন্দ্বে আসার সুযোগ পান। আমরা অপারেশন কমান্ডার হিসাবে প্রতিজ্ঞা করি পেটের ক্ষুধার তাড়নায় যে ট্রাক ড্রাইভার কিংবা পোর্টার বোঝা বয়ে চোরাচালানের সামগ্রী বর্ডারের ওপারে নিয়ে যাচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের ধরেই ক্ষান্ত হব না, আমাদের প্রচেষ্টা হবে চোরাচালানের মূল ব্যক্তিদের জনসম্মুখে প্রকাশ করা। ক্ষমতাবলয়ের ঐ সমস্ত অসাধু রুই- কাতলাদের উম্মোচন করা; যারা পর্দার অন্তরালে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জাতীয় সম্পদের চোরাচালানের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে জনগণের লাশের উপরে। অল্প সময়েই জানা গেল সব সীমান্তে চোরাচালানের মূলে রয়েছে ভারতের একটি প্রভাবশালী মারোয়াড়ী গোষ্ঠি এবং সরকারি দলের ক্ষমতাশালী মন্ত্রী ও নেতারা। শেখ মুজিবের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ আবু নাসের, স্বরাষ্টমন্ত্রী মনসুর আলী তদীয় পুত্র নাসিম, বন ও মৎস্য মন্ত্রী সেরনিয়াবাত তদীয় পুত্র হাসনাত। গাজী গোলাম মোস্তফা সরাসরিভাবে ঐ মারোয়াড়ী চক্রের সাথে জড়িত বলেও তথ্য পাওয়া যায় বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে এবং সরেজমিনে তদন্তের ফলে। সব ঝুঁকি কাঁধে নিয়ে আমরা তাদের চরিত্র এবং দুঃষ্কর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরতে থাকি জনগণের কাছে। অফিসার এবং সৈনিকরা পরিষ্কার বুঝতে পারেন দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল এবং নেতারাই হচ্ছে দেশের দুর্গতির মূল উৎস। তাদেরই যোগসাজসে লুটেরারা দেশ ও জাতিকে দেউলিয়া করে তুলছে। সেনা পরিষদের প্রচারণা এবং সরকার সম্পর্কে সংগঠনের মূল্যায়নের সত্যতা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে যাচাই করার সুযোগ পান সেনা সদস্যরা। তারা বুঝতে পারেন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়েই চাকুরী ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনা পরিষদের নেতৃত্ব এবং সদস্যরা তাদের সচেতনতা বাড়াবার জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়েই সবকিছু করছিলেন। এর ফলে সেনা পরিষদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাও বেড়ে গিয়েছিল। এভাবেই সেনাবাহিনীতে সেনা পরিষদের ভাবমুর্তি এবং জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। অ্যান্টি স্ম্যাগলিং অপারেশন সম্পর্কে একটা ঘটনার কথা পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি। এ থেকেই তৎকালীন সরকারের চরিত্র সম্পর্কে তারা ধারণা করতে পারবেন। দিনাজপুরের অপারেশন কমান্ডার একদিন ঢাকায় কন্ট্রোল রুমে খবর পাঠাল, চারজন মারোয়াড়ী স্মাগলার আর্মির ভয়ে ঢাকায় গিয়ে জনাব মনসুর আলীর ছেলে নাসিমের সাহচর্যে তার বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে আত্মগোপন করে আছে। ঢাকায় সিদ্ধান্ত নেয়া হল, জনাব মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাও করে মারোয়াড়ীদের গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু আর্মি হেডকোয়াটার্সের হস্তক্ষেপে ঢাকার এরিয়া কমান্ডার জনাব মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাও করার সিদ্ধান্ত বাদ দিতে বাধ্য হন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চাপের মুখেই আর্মি হেডকোয়াটার্স থেকে এ ধরণের হস্তক্ষেপ হয়েছিল। ঐ ঘটনার পর সরকার আর্মির তৎপরতা সম্পর্কে উদ্বিঘ্ন হয়ে উঠে। অপারেশনের ফলে একদিকে সেনাবাহিনীর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে সরকার ও তার দলের মুখোশ উম্মোচিত হয়ে পড়ায় ক্ষমতাসীনরা বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এই অবস্থায় কি করা উচিত সেটা ভেবে উভয় সংকটে পড়ল সরকার ও সরকারি দল। এই অবস্থাতেও দাতাগোষ্ঠির চাপে সরকার বাধ্য হয়ে সামরিক বাহিনীকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিল খাদ্যসামগ্রী দেশের সকল অঞ্চলে সময়মত পৌঁছে দেবার। সেনাবাহিনী শুরু করল ‘অপারেশন ফুড’। এই অপারেশনেও অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করে সেনাবাহিনী তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগের মাধ্যমে। এই অপারেশন আর্মির হাতে দেয়া ভীষণ অসন্তোষ দেখা দেয় সরকারি দলের মাঝে। কারণ তাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছিল প্রতিক্ষেত্রে। সব পর্যায়ে দলীয় স্বার্থের পরিপন্থী এই সমস্ত অপারেশন বন্ধের জন্য প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করা হল প্রধানমন্ত্রীর উপর। তিনি দলীয় স্বার্থের খাতিরে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে অবিলম্বে সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যাবার নির্দেশ দেন। এতে জনগণের মনে দারুণ ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। সরকার প্রধানের এ ধরণের পক্ষপাতিত্বের ফলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা হতাশ হয়ে পড়েন।

♦ পাকিস্তানের রাজনীতির পরিণাম – স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং আমাদের সিদ্ধান্ত

♦ কোলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ

♦ ভারতীয় নীলনকশা এবং মুজিব নগর সরকার

♦ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হল ; আদর্শিক দেউলিয়াপনা, কোন্দল ও ভাঙ্গন

♦ ৭১ এর চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আওয়ামী কুশাসন এবং প্রতিরোধ

♦ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী এবং মুজিব সরকার

♦ আওয়ামী দুঃশাসন এবং দুর্নীতির মুখোমুখি সামরিক বাহিনী

♦ বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে বাকশালী স্বৈরশাসন কায়েম

♦ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ১৫ই আগষ্টের মহান বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান

♦ প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত, মোশতাক সরকার এবং সেনা পরিষদ

♦ ৩রা নভেম্বরের ব্যর্থ ক্যু’দাতা এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার সফল বিপ্লব

♦ রাষ্ট্রদূত লেঃ কর্নেল (অবঃ) শরিফুল হক ডালিম বীর উত্তম

“আমি মেজর ডালিম বলছি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒অভিযোগ বা মন্তব্য⇐

error: Content is protected !!