সাধারণ মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে রামায়ণ মহাভারতের মতো মহাকাব্যে ঢুকে পড়েছে অনেক কাহিনী, অনেক নীতিকথা। রামায়নের অযোধ্যা-কান্ডের দিকে তাকান। রামচন্দ্র তখন চিত্রকুটে। ভারত এলেন। রামচন্দ্র ভরতকে রাজ্য-পরিচালন বিষয়ে উপদেশ দিতে গিয়ে একসময় বলেছেন,
ক্কচিন লোকায়তিকান ব্রক্ষ্মণাংস্তাত সেবসে।
অনর্থকুশলা হ্যেতে বালাঃ পণ্ডিতমানিনঃ।।
অর্থাৎ, “আশা করি তুমি লোকায়িত (যুক্তিবাদী) ব্রাক্ষ্মণদের সেবা করছ না। ওরা অনর্থ ঘটাতে খুবই পটু।“
মহাভারতের শান্তিপর্ব। এক ধনী বণিক রথে যাওয়ার সময় এক ব্রাক্ষ্মণকে ধাক্কা মারে। ক্ষুব্ধ ব্রাক্ষ্মণ অপমান জ্বালা তুলতে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করে। দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাক্ষ্মণের আত্মহত্যার মধ্যে সর্বনাশের সঙ্কেত দেখতে পেয়ে শেয়াল সেজে হাজির হলেন। ব্রাক্ষ্মণকে পশুজীবনের বহু কষ্টের কথা বলে মানব জীবনের জয়গান গাইলেন। জানালেন, অনেক জন্মের পূণ্যের ফল সঞ্চয় করে এই মানবজন্ম পাওয়া। এমন মহার্ঘতম মানবজীবন, বিশেষত শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে ব্রাক্ষ্মণ হয়ে জন্মলাভের পরেও কেউ কি পারে সে-জীবনকে ধ্বংস করতে? অভিমানে আত্মহত্যা করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। শেয়াল আরও জানালেন, নিজেও আগের জন্মে ব্রাক্ষ্মণ হয়েই জন্মেছিলেন। কিন্তু সে-জন্মে চূড়ান্ত মূর্খের মতো এক মহাপাতকের কাজ করেছিলেন বলেই আজ এই শিয়াল-জন্ম।
চূড়ান্ত মূর্খের মতো মহাপাতকের কাজটা কি? এ-বারই বেরিয়ে এলো নীতিকথা-
অহমাসং পণ্ডিতকো হৈতুকো বেদনিন্দকঃ।
আন্নীক্ষিকীং তর্কবিদ্যাম অনুরক্তো নিরর্থিকাম।।
হেতুবাদান প্রবদিতা বক্তা সংসৎসু হেতুমৎ।
আক্রোষ্টা চ অভিবক্তা চ ভ্রক্ষ্মবাক্যেষু চ দ্বিজান।
নাস্তিকঃ সর্বশঙ্কী চ মূর্খঃ পণ্ডিতমানিকঃ।
তস্য ইয়ং ফলনিবৃত্তিঃ শৃগালত্বং মম দ্বিজ।।
(শান্তিপর্ব ১৮০/৪৭-৪৯)
অর্থাৎ, আমি ছিলাম বেদ-সমালোচক যুক্তিবাদী পণ্ডিত। নিরর্থক তর্কবিদ্যায় ছিলাম অনুরক্ত। বিচারসভায় ছিলাম যুক্তিবাদের প্রবক্তা। যুক্তির সাহায্যে দ্বিজদের ব্রক্ষ্মবিদ্যার বিরুদ্ধে আক্রোশ মেটাতাম। ছিলাম জিজ্ঞাসু মনের নাস্তিক, অর্থাৎ কি না পণ্ডিত্যাভিমানী মূর্খ। হে ব্রাক্ষ্মন, তারই ফলস্বরূপ আমার এই শিয়ালজন্ম।
মুক্তমণের বিওরোধী তর্কবিদ্যা কেন ভাববাদী দর্শনের গৌরব
অনেকের মতেই এই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক ভাববাদ যদি যুক্তিবাদের অর্থাৎ জিজ্ঞাসু মনের বিরোধীই হবে, তবে কেন তর্কবিদ্যা অর্থাৎ ন্যায়দর্শন ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে প্রধান গৌরব বলে স্বীকৃতি পেল? দেশের শাসকশ্রেণী বা আইনকর্তারা যদি যুক্তি-তর্কের এত তীব্র বিরোধীরই হবেন তবে তর্কবিদ্যা এতদূর এগোলে কি করে?
বিষয়টা পরিষ্কার না করলে বিভ্রান্তি থাকাই স্বাভাবিক। ভাববাদীরা যুক্তি-তর্কের লড়াইকে পরিষ্কার দুটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। (১) বেদ ও ধর্মশাস্ত্রের অভ্রান্ততায় পরিপূর্ণ বিশ্বাস রেখেও যেখানে যুক্তি-তর্কের কূট কচকচালি চালিয়ে যাওয়া যায়। (২) যুক্তি-তর্ক যেখানে প্রমাণ ছাড়া কোনও কিছুকেই অভ্রান্ত বলে মানতে নারাজ-এমনকি তা বেদ এবং ধর্মশাস্ত্র হলেও।
ধর্মশাস্ত্রকার তর্কশাস্ত্রকে প্রশংসা করেছেন। তবে সে তর্ককে এগোতে হবে অবশ্যই বেদের অভ্রান্ততাকে মেনে নিয়ে। বেদের প্রামাণ্যকে শিরোধার্য করে নানা জটিল প্রশ্ন তুলে তর্ক চালিয়ে গেলে সাধারণের মধ্যে বেদভক্তি ও ধর্মবিশ্বাস আরও প্রবল হবে- মনু যারা বেদের অভ্রান্ততাকে অস্বীকার করে, প্রমাণ ছাড় কিছু জানতে নারাজ- তাদের সমাজ থেকে বহিষ্কার করবে।
ভারতবর্ষে ভাববাদী দর্শনের প্রথম সুস্পষ্ট স্বাক্ষর দেখতে পাই আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ‘উপনিষদ’ সাহিত্যে।
চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন বা বস্তুবাদী দর্শনের সূচনা কবে হয়েছিল সঠিক বলা সম্ভব নয়। আনুমানিক অষ্টম শতকে রচিত বৌদ্ধ দার্শনিক কমল শীলের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘পঞ্জিকা’তে বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের উল্লেখ রয়েছে দেখতে পাই।
কমল শীলের গুরু শান্ত রক্ষিত নিজের মতে সমর্থনে ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ নামে একটি দর্শনগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচনায় দেখতে পাই বস্তুবাদী দর্শনটিকে তিনি ‘চার্বাক’ না বলে ‘লোকায়ত’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।
শান্ত রক্ষিত থেকে শঙ্করাচার্য পর্যন্ত বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ভাববাদী দার্শনিকের রচনায় লোকায়ত বা চার্বাক নামের বস্তুবাদী দর্শনের উল্লেখ দেখতে পাই। সে-সময় ভারতীয় দর্শনের প্রথা অনুসারে পরমত খন্ডন করে নিজের মত স্থাপন করা হতো। পরমত হিসেবেই এইসব ভাববাদী দার্শনিকেরা চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের বিভিন্ন মতের উল্লেখ করেছেন। আর সেই উল্লেখ থেকেই আমরা চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের বিভিন্ন মতের উল্লেখ করেছেন। আর সেই উল্লেখ থেকেই আমরা চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের বিভিন্ন মতের উল্লেখ করেছেন। আর সেই উল্লেখ থেকেই আমরা চার্বাক দর্শন বিষয়ে কিছু তথ্য জানতে পারি। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দর্শন যা ছড়া হিসেবে প্রচলিত ছিল মানুষের মুখে মুখে। অলিখিত এই ছড়াই লোকগাথার রূপ পেয়েছিল।
ভারতের ভাববাদ ও বস্তুবাদ দর্শনে ইতিহাস স্পষ্টতই এ-কথাই বলে- দুই দর্শনের মধ্যে বিতর্কটা প্রধানত ‘আত্মা’কে নিয়ে।