আচ্ছা শোন, আমার না রোজ বিকেলে গা ম্যাজম্যাজ করে। কী করা যায় বলো তো?
ইমন হতাশ চোখে তাকাল। বিয়ের পর এই সমস্যা হয়েছে। শারমিন অদ্ভুত অদ্ভুত সমস্যা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। সমস্যার সমাধান তার জানা নেই। শারমিনের সমস্যা নিয়ে হাজির হবার সময়টাও খারাপ। অফিসে যাবার আগে আগে। যখন ইমন শার্ট খুঁজে পাচ্ছে না, বেল্ট খুঁজে পাচ্ছে না। মোজা দুটার একটা আছে, অন্যটা নেই।
এই, বলো না কী করি।
সমস্যাটা কি বিয়ের আগে ছিল না বিয়ের পর শুরু হয়েছে।
আগেও ছিল। এখন বেশি হচ্ছে। MMকে খবর দেব?
MMটা কে?
মিস মনোয়ারা। সংক্ষেপে MM.
উনি কী করবেন?
গা ম্যাসাজ করে দেবেন। বাসায় এসে একঘণ্টা ম্যাসাজ দেবেন। ঘণ্টায় পাঁচশ টাকা।
গা টেপাটেপি করে পাঁচশ টাকা?
শারমিন বিরক্ত গলায় বলল, এমন বিশ্রীভাবে কথা বলছ কেন? গা টেপাটেপি হবে কেন? MM প্রফেশনাল মহিলা। ব্যাংকক থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন।
ইমন বলল, গা টেপাটেপিতে PhD করা?
শারমিন বলল, তুমি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছ কেন? আশ্চর্য! পাঁচশ টাকা তোমার কাছে বেশি মনে হচ্ছে? রোজ তো আমি ম্যাসাজ করাব না। সপ্তাহে একদিন। মাসে চারবার–দুহাজার টাকা যাবে। সেই টাকাও তোমাকে দিতে হবে না। আমি দেব।
ইমন চুপ করে গেল। বিয়ের সময় শারমিনের বাবা তাকে পাঁচ লাখ টাকা নগদ দিয়েছেন। টাকাটা FDR করা। প্রতি তিনমাস পর শারমিন ইন্টারেস্ট তোলে এবং মহানন্দে জিনিসপত্র কেনে। পাথরের কানের দুল, হাড়ের তৈরি সাবানদানি, টাওয়েল, স্যান্ডেল।
শারমিন বলল, কথা বলছ না কেন? খবর দেব? তোমার পকেট থেকে তো টাকা যাচ্ছে না।
ইমন বলল, পকেট থেকে টাকা যাওয়া-যাওয়ি না। জিনিসটা আমার পছন্দ না। নেংটা হয়ে পড়ে থাকবে, একজন ঘোড়ার মতো তোমাকে দলাই মলাই করবে।
শারমিন বলল, আমার সঙ্গে সাবধানে কথা বলবে। রিকশাওয়ালাদের মতো কথা বলবে না। আমার মেজখালা উনার কাছে প্রতি সপ্তাহে ম্যাসাজ নেন। মিস। মনোয়ারা ম্যাসাজের আগে কার্বলিক সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নেন। বুঝেছ?
হুঁ। বুঝেছি। মিস মনোয়ারাকে আসতে বলো।
আমি ঠিক করেছি প্রতি বুধবার দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত ম্যাসাজ নেব। ম্যাসাজের পর গোসল করে লাঞ্চ করব, ঠিক আছে?
আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন ঠিক আছে কি-না! আমাকে নিশ্চয় অফিস বাদ দিয়ে সেই সময় উপস্থিত থাকতে হবে না?
তুমি এখনো রেগে রেগে কথা বলছ। রাগ কমিয়ে স্বাভাবিকভাবে এক মিনিট আমার সঙ্গে কথা বলবে, তারপর অফিসে যাবে। তুমি মুখ ভোতা করে থাকলে আজ আমি তোমাকে অফিসেই যেতে দেব না।
ইমন হাসার মতো ভাব করল। শারমিন বলল, চা বানিয়ে আনছি। গল্প করতে করতে চা খাবে, তারপর অফিসে যাবে।
কী গল্প করব?
তোমার যা ইচ্ছা। আগে আমাকে একটা ঠান্ডা চুমু খাও।
ঠান্ডা চুমুটা কী?
শারমিন উৎসাহের সঙ্গে বলল, এক টুকরা বরফ অনেকক্ষণ ঠোঁটে ধরে রাখবে। ঠোঁট ঠান্ডা হয়ে যাবে। সেই ঠোঁটে চুমু।
ইমন বলল, গরম চুমুর সময় কি ঠোঁট তাওয়ায় লাগিয়ে গরম করে নিতে হবে?
শারমিন জবাব দিল না।
ইমনের বিয়ে হয়েছে পনেরো মাস আগে। ভালোবাসাবাসির বিয়ে না, মুরুব্বিদের আলাপ-আলোচনার বিয়ে। বিয়ের মূল ঘটক ইমনের বড় চাচা আফতাব উদ্দিন। উনি বলেছিলেন, এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের সবচেয়ে রূপবতী। মেয়ের নাম–ঐশ্বরিয়া রায়। ঐশ্বরিয়ার রূপকে আড়াই দিয়ে গুণ দিলে যে জিনিস হয় তার নাম শারমিন। বুঝেছিসরে গাধা!
ইমন বলেছিল, এত রূপবতী মেয়ে বিয়ে করা ঠিক হবে না মামা।
ঠিক হবে না কেন?
রূপবতীদের মধ্যে নার্সিসাস কমপ্লেক্স দেখা যায়। তারা নিজের রূপের প্রেমে পড়ে, অন্য কারো প্রেমে পড়তে পারে না।
গাধার মতো কথা বলবি না। বিয়ে ঠিক করেছি বিয়ে কর। মেয়ে নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানে বই কিনতে যাবে। তুইও যাবি। টুকটাক কথা বলে দেখবি দুজনের দুজনকে পছন্দ হয় কি-না।
নিউমার্কেটে বিশেষ বইয়ের দোকানে ঢুকে ইমন হতভম্ব। জলপরী ধরনের এক মেয়ে (চোখে সানগ্লাস) একগাদা বই কিনে ফেলেছে এবং আরো কিনছে। ইমনকে ঢুকতে দেখে সে চোখ থেকে সানগ্লাস নামিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, আপনার নাম ইমন?
ইমন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। জলপরী বলল, আমার নাম শারমিন। বইগুলি ধরুন তো।
ইমন বই ধরল। মেয়েটি দোকানের লোকজন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল, আমি বাসা থেকে বের হবার সময় ঠিক করে বের হয়েছিলাম যদি ইমন সাহেব হালকা গ্রিন কালারের শার্ট পরে আসে তাহলে আমি বর্ণব ইয়েস। অন্য যে কোনো কালারের শার্ট পরে এলে বলব নো।
ইমনের শার্টটার রঙ ছিল হালকা সবুজ।
তারা বই নিয়ে এক চায়নিজ রেস্টুরেন্টে খেতে গেল। ইমন বলল, বিয়ের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত কি শার্টের রঙ দেখে নেয়া ঠিক?
শারমিন বলল, অবশ্যই ঠিক। আমার মেজখালী এইভাবে সিদ্ধান্ত নেন এবং তার সব সিদ্ধান্ত ঠিক হয়।
শারমিন এবং ইমন নিউ ইস্কাটনে একটা ফ্ল্যাটে বাস করে। তাদের সংসার গুলশান থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন শারমিনের মেজখলা, নাম রুবি।
শারমিনের ফ্ল্যাটের দেয়ালের রঙ, ফার্নিচার, জানালার পর্দা সবই রুবি খালা ঠিক করে দিয়েছেন। কখন কী রান্না হবে এইটিও রুবি খালা ঠিক করে দেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে শারমিন টেলিফোন করে, রুবি খালা, আজ দুপুরে কী রান্না করা যায় বলো তো?
ফ্রিজে কী আছে?
মাংস মাছ দুটাই আছে।
ঘনঘন মাংস খাওয়া ঠিক না। কাল রাতে মাংস খেয়েছিস। আজ মাছ কর। কী মাছ আছে?
ইলিশ মাছ আছে, এক প্যাকেট কাতল আছে। ছোটমাছ আছে। মলামাছ।
কাঁচা টমেটো দিয়ে ছোটমাছ কর। তোর কাজের মেয়েটাকে টেলিফোন ধরতে বল, আমি রেসিপি বলে দিচ্ছি।
যে মেজখালার এতটাই প্রভাব তিনি ম্যাসাজ করাবেন আর শারমিন করাবে তা কী করে হয়!
বুধবারে MM অর্থাৎ মিস মনোয়ারা চলে এলেন। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বোরকায় ঢাকা। বিশাল বলশালী মহিলা। কুস্তিগিরের মতো লোমশ হাত। লম্বা লম্বা আঙুল। জর্দা দিয়ে পান খাওয়ার অভ্যাস আছে। গা দিয়ে জর্দার মিষ্টি গন্ধ আসছে। মিস মনোয়ারা বোরকা খুলতে খুলতে বললেন, ঠিকমতো ম্যাসাজ করাতে হলে লজ্জা দূর করতে হবে। লজ্জা নিয়ে ম্যাসাজ হবে না। মানুষের শরীরে দুইশ আঠারোটা নার্ভ এন্ডিং আছে। প্রতিটা নার্ভ সেন্টারে ম্যাসাজ হলে তবে শরীরের Balance ঠিক হবে। আমার কিছু জিনিস লাগবে। এক গামলা গরম পানি, অলিভ ওয়েল আর একটা পাতলা কাপড়ের টুকরা। যদি না থাকে পুরনো গামছা হলেও চলবে।
যোগাড়যন্ত্রের পর ম্যাসাজ শুরু হলো। কাজের মেয়ে ফুলির খুব উৎসাহ কর্মকাণ্ড কী হচ্ছে দেখবে। সেই সুযোগ হলো না। কারণ দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
মিস মনোয়ারা ম্যাসাজ শুরু করেই বলল, লজ্জা লাগলে চোখ বন্ধ করে ফেলবেন। প্রথম দিনে একটু লজ্জা লাগবে, তারপর আর লাগবে না। স্বামীর সঙ্গে প্রথম রাত কাটানোর সময় লজ্জা থাকে। তারপর আর থাকে না।
ম্যাসাজের পুরো সময়টা শারমিন চোখ বন্ধ করে থাকল। এবং তার বুক সারাক্ষণই ধড়ফড় করতে থাকল। এ-কী কাণ্ড!
একমাস পার হয়েছে। শারমিন এখন সপ্তাহে একদিনের জায়গায় দুদিন ম্যাসাজ করাচ্ছে। বুধবার এবং সোমবার। এই দুটো দিনের জন্যে সে মনে মনে অপেক্ষা করে থাকে। মিস মনোয়ারা ম্যাসাজের ফাঁকে নানান গল্পও করেন। গল্পগুলি শুনতে ভালো লাগে। কিছু কিছু গল্প খুবই অশ্লীল। শুনলে গা শিউরে ওঠে। শারমিন ঠিক করে রেখেছে–একদিন বলবে যেন এ ধরনের গল্প আর না করা হয়। এখনো বলা হয় নি।
এক শুক্রবারের কথা। ইমনের অফিস নেই। সে চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ছে। শারমিন সাজগোজ করছে। শুক্রবারে সে মেজখালার বাসায় যায়। সারাদিন থেকে সন্ধ্যায় ফেরে। ইমন যায় না। এই নিয়ে প্রতি শুক্রবারেই দুজনের কথা কাটাকাটি হয়। আজও যে হবে এই বিষয়ে শারমিন নিশ্চিত। কারণ ইমনের মুখ গম্ভীর। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে সে রাগে ফুঁসছে।
ইমন ভাঁজ করে খবরের কাগজ রাখতে রাখতে চাপা গলায় ডাকল, শারমিন, শুনে যাও।
শারমিন পাশে এসে দাঁড়াল।
ইমন বলল, তুমি খবরের কাগজ পড় না। তাই না?
শারমিন বলল, পড়ি না। টিভি চ্যানেলে খবরও দেখি না। তাতে সমস্যা কী?
কোনো সমস্যা নেই, তবে আজ কাগজে একটা মজার খবর ছিল।
শারমিন বলল, মজার খবর তুমি পড়ে মজা পাও। আমার মজার দরকার নেই।
ইমন বলল, আবদুল মজিদ নামে এক লোককে নিয়ে একটা স্টোরি করেছে। সে মিস মনোয়ারা নাম নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে মেয়েদের ম্যাসাজ করে বেড়াত। তার একটা ছবিও ছাপা হয়েছে। ছবিটা দেখ।
শারমিন অনেকক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। তার হাত-পা কাঁপছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি সে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে যাবে।
ইমন বলল, পুলিশ এই লোককে ছেড়ে দিয়েছে, কারণটা কী জানো? কোনো মেয়ে এই লোকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি না। তুমি কি সাক্ষ্য দেবে?
শারমিন বলল, না।
সে মেজখালার বাড়িতে গেল না। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করল না। বাথটাবে শরীর ডুবিয়ে সারাদিন শুয়ে রইল এবং মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদল।
ইমন সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করল। কোমল গলায় বলল, যা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে মাথা গরম করার কিছু নেই। তুমি তো জেনেশুনে কিছু কর নি। মনটা ঠিক কর, চল দুজনে মিলে কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করি। যাবে? শারমিন ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, না।
আজ সোমবার। ম্যাসাজের দিন।
সকাল থেকেই শারমিনের অস্থির লাগছে। অনেক চেষ্টা করেও সে অস্থিরতা দূর করতে পারল না। একসময় সে টেলিফোন করল।
হ্যালো! মিস মনোয়ারা?
ওপাশ থেকে কেউ কিছু বলল না।
মিস মনোয়ারা?
হুঁ।
আমি শারমিন। আজ ম্যাসাজের দিন। আপনি আসবেন না?
আসতে বলছেন?
হুঁ।
আচ্ছা, চলে আসছি।
শারমিন অপেক্ষা করছে। তার শরীরের দুশ আঠারোটা নার্ভ এন্ডিং ছটফট করছে। শরীর জ্বলে যাচ্ছে।
এত দেরি হচ্ছে কেন? কখন আসবে মিস মনোয়ারা?
“আজ দুপুরে তোমার নিমন্ত্রণ” সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ