কিশোর বয়সে সুবোধ ঘোষের একটি উপন্যাস পড়েছিলাম—’শুন বরনারী’! উপন্যাসের মূল চরিত্র একজন হেমিওপ্যাথ ডাক্তার, হিমাদ্রী। অনেকদিন সেই ডাক্তারের ছবি আমার চোখে ভাসতো। মাঝে মাঝে রাস্তায় কাউকে দেখে চমকে উঠে ভাবতাম, আরে, ইনি তো অবিকল হিমাদ্রীর মত। কিশোর বয়সে মাথায় অনেক পাগলামি ভর করে। সেই পাগলামির কারণেই হয়ত এক সন্ধ্যাবেলায় হিমাদ্রী বাবুর কাছে এক পাতার একটা চিঠি লিখে ফেললাম। চিঠিতে অনেক সমবেদনার কথা বলা হল। চিঠি পাঠানো যায় কি করে? হিমাদ্রী বাবুর ঠিকানা আমি জানি না, সুবোধ ঘোষের ঠিকানাও জানা নেই। চিঠিটা অনেক দিন অঙ্ক খাতায় বন্দী হয়ে পড়ে রইল। এক সময় হারিয়েও গেল। একজন মুগ্ধ কিশোরের আবেগ ও ভালবাসা হিমাদ্রী কিংবা সুবোধ ঘোষ জানতে পারলেন না।
চিঠিটি কিন্তু হারায়নি। প্রকৃতি কোন কিছুই হারাতে দেয় না। যত্ন করে তুলে রাখে। কোন এক বিশেষ সময়ে বিশেষ মুহূর্তে সেই হারানো জিনিস বের করে এনে সবাইকে হকচকিত করে দেয়। আমার বেলায় এই ব্যাপারটা ঘটল। লক্ষ্মীপুর থেকে সপ্তম শ্রেণীর জনৈক বালক মিসির আলিকে একটা একপাতার চিঠি লিখল। মিসির আলির প্রতি সমবেদনায় সেই চিঠি পূর্ণ। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, এই চিঠির ভাষা এবং আমার চিঠির ভাষা একই রকম। যেন প্রকৃতি পঁয়ত্রিশ বছর পর আমার চিঠিই আমাকে ফেরত পাঠাল।
আমার উপন্যাসে বারবার ফিরে আসা চরিত্রগুলিকে নিয়ে একটা লেখা তৈরি করতে বলা হয়েছে। লিখতে গিয়ে তাই মিসির আলির কথাই প্রথম মনে পড়ল। তাকে দিয়েই শুরু করি।
মিসির আলি
মিসির আলি মানুষটা দেখতে কেমন? আমি ঠিক জানি না। জানলে বই-এ তাঁর চেহারার বর্ণনা থাকতো। তেমন কোন বর্ণনা নেই। চশমা পরেন এটা বলা হয়েছে। চশমা তো আর চেহারার বর্ণনা হবে না। চশমা অনেকেই পরেন।
বলা হয়েছে, তীক্ষ্ণ চোখে তিনি তাকান। সেই তীক্ষ্ণ চোখও তো কারোর বোঝার উপায় নেই। কারণ চোখ ঢাকা থাকে চশমার মোটা কাঁচের আড়ালে। মানুষটার কি মাথাভর্তি চুল? না-কি টাকমাথা? চুলের কথা কোন উপন্যাসে বলিনি, তবে চুল আছে। চুল যে আছে তা বুঝলাম মিসির আলিকে নিয়ে প্রচারিত দুটা টিভি নাটকে। নাটক দুটিতে মিসির আলির চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেতা আবুল হায়াত। টেকো মিসির আলিকে দেখে চমকে উঠলাম। চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করল, না না, মিসির আলির মাথায় টাক নেই। তাঁর মাথাভর্তি ঘন চুল। এখন বললে তো হবে না, বই-এ কিছু বলিনি।
মিসির আলিকে নিয়ে যখন কিছু লিখি তখন কি কোন চেহারা আমার মনে ভাসে? সচেতনভাবে কিছু ভাসে না। অবচেতন মনে নিশ্চয়ই ছবি আঁকা থাকে। সেই ছবি সাধারণ মানুষের ছবি। অন্তর্মুখী একজন মানুষ, যিনি বই পড়তে ভালবাসেন। অন্তর্মুখী মানুষরা অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করেন না, কিন্তু মিসির আলি। পছন্দ করেন। প্রায়ই দেখা যায়–আগ্রহ নিয়ে তিনি অনেককে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেন। অন্তর্মুখী মানুষ এই কাজটি কখনো করবে না। এই মানুষটির প্রধান গুণ কি? আমার মতে, কৌতূহল এবং বিস্ময়বোধ করার অসাধারণ ক্ষমতা। কৌতূহল আমাদের সবারই আছে, কিন্তু কৌতূহল মেটানোর জন্যে প্রয়োজনীয় পরিশ্রমটি আমরা করি না। করতে চাই না। অন্তর্মুখী মানুষ হয়েও মিসির আলি কিন্তু এই পরিশ্রমটা করেন। উদাহরণ দেয়া যাক। উদাহরণ থেকে মিসির আলির কৌতূহলের ধরন পরিষ্কার হবে। আমরা প্রায়ই ইউনানী তিব্বিয়া দাওয়াখানা জাতীয় সাইনবোর্ড দেখি। খুব কি। কৌতূহলী হই? মিসির আলি কিন্তু হন। যেমন,
“মুগদাপাড়া থেকে যে রাস্তাটা মান্ডার দিকে গিয়েছে তার প্রথম ডানদিকের বাঁকে বেশ কয়টা দোকান। একটা স্টেশনারী শপ, দু’টা সাইকেল টায়ারের দোকান, একটা সেলুন এবং একটি হেকিমী ঔষধের দোকান। সাইনবোর্ডে লেখা–ইউনানী তিব্বিয়া দাওয়াখানা। হেকিম আবদুর রব।
মিসির আলি ইদানিং এই পথে যাওয়া-আসা করেন, কারণ তিনি বাসা নিয়েছেন মান্ডায়। ঢাকায় আসতে হলে তাকে অতীশ দীপংকর রোড ধরতে হয়। এই পথে আসা ছাড়া উপায় নেই। দোকানগুলির সামনে এসে তিনি থমকে দাঁড়ান। আগ্রহ এবং কৌতূহল নিয়ে ইউনানী তিব্বিয়া দাওয়াখানার দিকে তাকান।
মানুষের কৌতূহল জাগ্রত করার মত তেমন কিছু দোকানে নেই। ভেতরটা অন্ধকার। ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে পুরানো ভারী আলমিরা। আলমিরার পাল্লা কাঠের বলে ভেতরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। দু’পাশে বইয়ের র্যাকের মত বেশ কিছু র্যাক। র্যাক ভর্তি কাঁচের এবং চিনামাটির বৈয়ম। সব দোকানেই টেবিল বা টেবিল জাতীয় কিছু থাকে। এখানে নেই। দুটা বেতের চেয়ার পাশাপাশি বসানো। একটিতে সারাক্ষণ ভয়ংকর রোগা, লম্বা এবং অস্বাভাবিক ফর্সা একজন মানুষ বসে থাকেন। সম্ভবত তিনিই হেকিম আবদুর রব। তার হাতে একটা পত্রিকা থাকে, তবে সব সময় পত্রিকা পড়েন না। বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায়, হাতে পত্রিকা আছে ঠিকই, কিন্তু ভদ্রলোক তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে।
মিসির আলি এখন পর্যন্ত এই দোকানে দ্বিতীয় কোন মানুষ দেখেননি। সঙ্গত কারণেই হেকিমী, আয়ুর্বেদী জাতীয় চিকিৎসার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে আসছে। এই দোকানের সামনে এলেই মিসির আলির জানতে ইচ্ছা করে, এই লোকটির সংসার কি করে চলে? অনেক ব্যাপার আছে জানতে ইচ্ছা করলেও জানা যায় না। মিসির আলির পক্ষে সম্ভব নয় দোকানে ঢুকে হেকিম সাহেবকে জিজ্ঞেস করবেন, আপনার কাছে তো কখনো কাউকে আসতে দেখি না। আপনার সংসার কি করে চলে?
মানুষটা দিনের পর দিন খবরের কাগজ হাতে নিয়ে কি ভাবেন, তাও মিসির আলির জানতে ইচ্ছে করে। নিজে নিঃসঙ্গ বলেই বোধহয় আরেকজন নিঃসঙ্গ মানুষের। প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। এবং প্রায়ই ভাবেন কোন একদিন দোকানটির সামনে। রিকশা থেকে নেমে পড়বেন। কৌতূহল মিটিয়ে নেবেন। সেই কোন একদিন এখনো। আসছে না। কেন আসছে না এই নিয়েও মিসির আলি ভেবেছেন। তার ধারণা, মানুষের কৌতূহলের একটি থ্রেসহোল্ড লিমিট আছে। কৌতূহল সেই লিমিটের নিচে হলে মানুষ কখনো তা মেটাতে চেষ্টা করে না। যখন লিমিট অতিক্রম করে কেবল তখনি কৌতূহল মেটানোর জন্যে প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড শুরু করে। রাস্তায় কোন ভিখিরী শিশুকে একা একা কাঁদতে দেখলে আমাদের কৌতূহল হয়। জানতে ইচ্ছে করে কেন সে কাঁদছে। কিন্তু সেই কৌতূহল থ্রেসহোল্ড লিমিটের নিচে বলে কখনো জিজ্ঞেস করা হয় না–এই মেয়ে কাঁদছ কেন?
পৌষ মাসের এক বিকেলে মিসির আলির কৌতূহল থ্রেসহোল্ড লিমিট অতিক্রম করল। তিনি দাওয়াখানার সামনে রিকশা থেকে নামলেন। এম্নিতেই হেকিম সাহেবের ঘর থাকে অন্ধকার। আজ আরো অন্ধকার লাগছে, কারণ সন্ধ্যা হয় হয় করছে, আকাশ মেঘলা। ঘরে এখনো বাতি জ্বালানো হয়নি।
খবরের কাগজ হাতে চেয়ারে বসে থাকা ভদ্রলোক চোখ তুলে মিসির আলির দিকে তাকালেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি নিস্পৃহ। সেখানে আগ্রহ বা অনাগ্রহ কোন কিছুরই ছোঁয়া নেই। দূর থেকে ভদ্রলোকের বয়স বোঝা যাচ্ছিল না। এখন বোঝা যাচ্ছে। বয়স ষাট ছাড়িয়ে গেছে, তবে হালকা পাতলা গড়ন বলে বোঝা যাচ্ছে না। এই বয়সে মানুষের মাথার চুল কমে যায়, তবে ভদ্রলোকের বেলায় তা হয়নি। তাঁর মাথা ভর্তি ধবধবে শাদা চুল।
মিসির আলি অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, আমি একটা সামান্য জিনিস আপনার কাছে জানতে এসেছি। আমি আপনার কাছেই থাকি, মান্ডার নয়াবাজারে।
‘বসুন।‘
মিসির আলি বসলেন। ভদ্রলোক খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, কি জানতে চান বলুন?
ভদ্রলোকের গলার আওয়াজ পরিষ্কার। মানুষের গলার শব্দেও বয়সের ছাপ পড়ে। এই ভদ্রলোকের তা পড়েনি। ভদ্রলোক তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। মনে। হচ্ছে খানিকটা বিরক্ত হচ্ছেন। মিসির আলির অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল।
‘কি জানার জন্য এসেছেন বলুন?’
‘আপনার দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা–ইউনানী তিব্বিয়া দাওয়াখানা। ইউনানী তিব্বিয়া–শব্দ দুটার মানে কি?’
‘এটা জানার জন্যে এসেছেন?”
‘কেন জানতে চান?’
‘কৌতূহল, আর কিছু না।‘
‘আপনি কি করেন?’
‘তেমন কিছু করি না। এক সময় অধ্যাপনা করতাম। এখন সাইকোলজির উপর একটা বই লেখার চেষ্টা করছি। আপনিই কি হেকিম আবদুর রব?’
‘না। হেকিম আবদুর রব আমার দাদা। আমরা চার পুরুষের হেকিম। আমি হচ্ছি শেষ পুরুষ। আপনি শুধুমাত্র ইউনানী এবং তিব্বিয়া এই শব্দ দুটির অর্থের জন্যে আমার কাছে এসেছেন দেখে বিস্ময় বোধ করছি। অর্থ বলছি। আপনি কি চা খাবেন? সন্ধ্যাবেলা আমি এক কাপ চা খাই।‘
‘চা কি দোকান থেকে আনাবেন?’
‘না, আমি নিজেই বানাব। ভাল কথা, আপনার নাম জানা হয়নি।‘
‘আমার নাম মিসির আলি।‘
‘মিসির আলি সাহেব, আপনি কি ধূমপান করেন?’
‘জি করি।‘
‘আমার নাম আবদুল গনি। হেকিম আবদুল গনি। আপনি বসুন, আমি চা বানাচ্ছি।‘
মিসির আলি বসে রইলেন। আবদুল গনি সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। দোকানের পেছনে, র্যাকগুলির ওপাশে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। চায়ের সরঞ্জাম সেখানেই রাখা। মিসির আলি লক্ষ করলেন, বেশ দামী একটি ইলেকট্রিক কেতলিতে চায়ের পানি গরম হচ্ছে। চা দেওয়াও হল দামী কাপে। ভদ্রলোক সিগারেটের টিন বের করলেন। আবদুল্লাহ নামের মিশরীয় সিগারেট। ড্যাম্প যাতে না হয় তার জন্যে বাজারজাত করা হয় টিনের কৌটায়। বাংলাদেশে এই বস্তু সচরাচর চোখে পড়ে না।
আবদুল গনি সাহেব চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, আমার বড় মেয়ে কায়রোতে থাকে। সে মাঝে-মধ্যে উপহার হিসেবে এটা-সেটা পাঠায়। চায়ে চিনি হয়েছে?
‘জি।‘
‘এখন আপনার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। ইউনানী শব্দটা এসেছে খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীর ইউনান থেকে। ইউনান হল–গ্রীস দেশ। খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীর ইউনান বা গ্রীস ছিল চিকিৎসা শাস্ত্রের লীলাভূমি। হিপোক্রেটিসের মত পণ্ডিত এবং গ্যালেনের মত চিকিৎসকের কারণে চিকিৎসা শাস্ত্রের চরম উন্নতি হয়। গ্রীস থেকে এই বিদ্যা মুসলিম চিকিৎসকদের হাতে আসে। যেহেতু ইউনান হচ্ছে এই শাস্ত্রের কেন্দ্রভূমি, কাজেই তাঁরা এর নাম দেন ইউনানী।‘
‘আর তিব্বিয়া? তিব্বিয়াটা কি?’
‘তিব্বিয়া এসেছে ‘তিব্ব’ থেকে। আরবিতে ‘তিব্ব’ মানে চিকিৎসা সম্পর্কিত। আপনার কৌতূহল কি মিটেছে?’
‘জি।‘
‘আরো কিছু জানতে চাইলে আসবেন। এই বিষয়ে আমার কিছু পড়াশোনা আছে। আজ তাহলে উঠুন। সন্ধ্যার পর আমি দোকান বন্ধ করে দি। আমার চোখের অসুবিধা আছে। রাতে আমি ভাল দেখি না।‘
মিসির আলি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, রোগী আপনার কাছে কেমন আসে?
‘আসে না। আসার কথাও না। বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা অনেক দূর এগিয়েছে। এদের হাতে আছে শক্তিশালী এন্টিবায়োটিক, সালফা ড্রাগ। চিকিৎসা পদ্ধতি সহজ হয়েছে, দ্রুত হয়েছে। হেকিমী বিদ্যা আগে যেখানে ছিল এখনো সেখানেই আছে।
‘আপনার কথা থেকে তো মনে হচ্ছে বর্তমান আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার শুরুটা হচ্ছে ইউনানী।‘
‘হ্যাঁ তাই। বর্তমান কালের ডাক্তাররা হিপোক্রেটিস শপথ নেন। ইউনানী শাস্ত্রের উন্নতি হয় হিপোক্রেটিসের পৃষ্ঠপোষকতায়। মিসির আলি সাহেব, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আজ তাহলে আপনি আসুন। রাতে আমি একেবারেই চোখে দেখি না। রিকশা এসে আমাকে বাড়িতে নিয়ে যায়।‘
মিসির আলি ঘর থেকে বের হয়ে এলেন।
তাঁর কৌতূহল শুধু ইউনানী তিব্বিয়া দাওয়াখানায় নয়–তাঁর কৌতূহল পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনেও। তিনি এই সব বিজ্ঞাপন গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়েন। শুধু পড়েই ভুলে যান না। ভাবেন। আবারো উদাহরণ–
“পত্রিকায় ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপন বের হয়েছে। সব পত্রিকায় নয়, একটি মাত্র পত্রিকায়। হারানো বিজ্ঞপ্তি, বাড়ি ভাড়া, ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে নতুন ধরনের একটি বিজ্ঞাপন। শিরোনাম–পুরস্কৃত করা হবে। পুরস্কার শব্দটির আলাদা একটি মোহ আছে। বিজ্ঞাপনটা অনেকেই পড়ল। কেউ মাথা ঘামাল না। কারণ একটা অংকের ধাঁধা দেয়া। বলা হয়েছে, কেউ এটা পারলে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। কোন ঠিকানা নেই, বক্স নম্বর দেয়া। অল্প বয়েসী কিছু উৎসাহী ছেলেপুলে ধাঁধাটি নিয়ে কিছু চিন্তা-ভাবনা করল। কেউ মনে হয় সমাধান করতে পারল না। কারণ পরের সপ্তাহে আবার বিজ্ঞাপনটি বেরুল। তার পরের সপ্তাহে আবার। পরপর চার সপ্তাহ ছাপা হবার পর বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু না, অন্য একটি পত্রিকায় আবার ছাপা হল। সেই পত্রিকায় পরপর চার সপ্তাহ ছাপা হবার পর অন্য একটি পত্রিকায়। বিজ্ঞাপনটি এ রকম–
পুরস্কৃত করা হবে।
নীচে একটি অংকের সমস্যা দেয়া হল।
এর সমাধান কেউ করতে পারলে তাঁকে
পুরস্কৃত করা হবে। সমাধান ও পূর্ণ।
নাম-ঠিকানাসহ যোগাযোগ করুন।
জিপিও পোস্ট বক্স নং ৩১১
ছ’মাস ধরে বিজ্ঞাপন ঘুরে ঘুরে সব কটি বড় বড় পত্রিকায় ছাপা হল। তারপর বন্ধ হয়ে গেল। কেউ এটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। পত্র-পত্রিকায় বিচিত্র সব জিনিস ছাপা হয়। দেশে বাতিকগ্রস্তের পরিমাণ আশংকাজনকভাবে বাড়ছে। বাতিকগ্রস্তরা নিজেদের বাতিক অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায়। এ জন্যে পয়সা খরচ করতে তাদের বাধে না। অংকের বিজ্ঞাপনটি নিশ্চয়ই এ রকম অংকের বাতিকওয়ালা কেউ দিয়েছে। কিছুদিন পর আবার নতুন কোন ধাঁধা তার মাথায় আসবে। আবার পয়সা খরচ করে বিজ্ঞাপন দেবে।”
মিসির আলি এক সকালে বিজ্ঞাপনটা পড়লেন। কাগজ কলম নিয়ে বসলেন, যদি অঙ্ক সমস্যার কোন সমাধান করা যায়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, মিসির আলি সব সমস্যার সমাধান করতে পারেন না। কারণ তিনি অতিমানব নন। সাধারণ একজন মানুষ। সুন্দর যুক্তি উঁড়া করাতে পারেন। সর্বপ্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে চিন্তা করতে পারেন। তিনি বিশ্বাস করেন, এ জগতে কোন রহস্য নেই। কারণ প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে না। তারপরেও বারবার প্রকৃতির রহস্যের কাছে তিনি পরাজিত হন। এই পরাজয়ে আনন্দ আছে। সে আনন্দ মিসির আলি পান না। পাঠক হিসেবে আমরা পাই। মিসির আলি চরিত্রটির ধারণা কোত্থেকে পেলাম, কিভাবে পেলাম সেই প্রসঙ্গে একটি গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছি। নতুন করে সেই প্রসঙ্গে লিখতে ইচ্ছা করছে না বরং ভূমিকার অংশবিশেষ তুলে দি–
“তখন থাকি নর্থ ডাকোটার ফার্গো শহরে। এক রাতে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি মন্টানায়। গাড়ি চালাচ্ছে আমার স্ত্রী গুলতেকিন। পেছনের সীটে আমি আমার বড় মেয়েকে নিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। গুলতেকিন তখন নতুন ড্রাইভিং শিখেছে। হাইওয়েতে এই প্রথম বের হওয়া। কাজেই কথাবার্তা বলে তাকে বিরক্ত করছি না। চুপ করে বসে আছি এবং খানিকটা আতঙ্কিত বোধ করছি। শুধু মনে হচ্ছে, অ্যাকসিডেন্ট হবে না তো! গাড়ির রেডিও অন করা। কান্ট্রি মিউজিক হচ্ছে। ইংরেজি গানের কথা মন দিয়ে শুনতে ইচ্ছে করে না। কিছু শুনছি, কিছু শুনছি না এই অবস্থা। হঠাৎ গানের একটা কলি শুনে চমকে উঠলাম–
Close your eyes and try to see
বাহ, মজার কথা তো! আমি নিশ্চিত, মিসির আলি চরিত্রের ধারণা সেই রাতেই আমি পেয়ে যাই। মিসির আলি এমন একজন মানুষ যিনি দেখার চেষ্টা করেন চোখ বন্ধ করে। চোখ খুলেই যেখানে কেউ দেখে না সেখানে চোখ বন্ধ করে পৃথিবী দেখার এক আশ্চর্য ফলবতী চেষ্টা।
মিসির আলিকে নিয়ে লিখলাম অবশ্যি তারো অনেক পরে। প্রথম লেখা উপন্যাস ‘দেবী’। মিসির আলি নামের অতি সাধারণ মোড়কে একজন অসাধারণ মানুষ তৈরির। চেষ্টা ‘দেবী’তে প্রথম করা হয়। মিসির আলি এমন একজন মানুষ যাঁর কাছে প্রকৃতির নিয়ম-শৃঙ্খলাই একমাত্র সত্য। রহস্যময়তায় অস্পষ্ট জগৎ ইনি স্বীকার করেন না। সাধারণত যুক্তিবাদী মানুষ আবেগবর্জিত হন। যুক্তি এবং আবেগ পাশাপাশি চলতে পারে না। মিসির আলির ব্যাপারে একটু ব্যতিক্রমের চেষ্টা করা হল। যুক্তি ও আবেগকে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে দিলাম।…”
মিসির আলিকে নিয়ে আর কি লিখি! সবই তো মনে হয় লেখা হয়ে গেছে। একটা কথা না বললে প্রসঙ্গ অপূর্ণ থাকবে। কথাটা হল–মিসির আলি আমার প্রিয় চরিত্রের একটি। তাঁকে নিয়ে লিখতে আমার সব সময়ই ভাল লাগে। এই নিঃসঙ্গ, হৃদয়বান, তীক্ষ্ণ ধীশক্তির মানুষটি আমাকে সব সময় অভিভূত করেন। যতক্ষণ লিখি, ততক্ষণ তাঁর সঙ্গ পাই। বড় ভাল লাগে।
হিমু
হিমুর ভাল নাম হিমালয়।
বাবা খুব আদর করে ছেলের নাম হিমালয় রাখলেন, যাতে ছেলের হৃদয় হিমালয়ের মত বড় হয়। আকাশ রাখতে পারতেন। আকাশ হিমালয়ের চেয়েও বড়, বিস্তৃত। আকাশ রাখলেন না, কারণ আকাশ স্পর্শ করা যায় না। হিমালয় স্পর্শ করা যায়।
বাবা হিমালয়কে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন। তার ধারণা, বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা করে যদি ডাক্তার, ইজিনীয়ার বানানো যায়, তাহলে মহাপুরুষ বানানো যাবে না কেন? ট্রেনিং-এ মহাপুরুষ কেন হবে না? তিনি ছেলেকে মহাপুরুষ বানানোর বিশেষ ট্রেনিং দেয়া শুরু করলেন। হিমালয় কি মহাপুরুষ হল? না হয়নি। সে যা হয়েছে তা হচ্ছে—‘হিমু’।
হিমুকে নিয়ে প্রথম লিখি ময়ূরাক্ষী। ময়ূরাক্ষীর পর, দরজার ওপাশে–সর্বশেষ গ্রন্থের নাম –‘হিমু’।
আসলে হিমু কে? খুব সচেতন পাঠক চট করে হিমুকে চিনে ফেলবেন, কারণ হিমু হল মিসির আলির উল্টো পিঠ। বিজ্ঞানের ভাষায় এন্টি-মিসির আলি।
হিমুর কাজকর্ম রহস্যময় জগৎ নিয়ে। সে চলে এন্টিলজিকে। সে বেশির ভাগ সময়ই বাইরে বাইরে ঘুরে। রাত জেগে পথে পথে হাঁটে কিন্তু সেই সবচে’ বেশি। অন্তর্মুখী। মিসির আলি চোখ বন্ধ করে পৃথিবী দেখেন। সে চোখ খোলা রাখে কিন্তু কিছুই দেখে না।
মিসির আলি দেখতে কেমন আমি যেমন জানি না, হিমু দেখতে কেমন তাও জানি না। কোন বই-এ হিমুর চেহারার বর্ণনা নেই। যা আছে তাও খুব সামান্য। সে বর্ণনা থেকে চরিত্রের ছবি আঁকা যায় না। আমার নিজের মনে যে ছবিটি ভাসে তা হল–হাসি-খুশি ধরনের একজন যুবকের ছবি। যে যুবকের মুখে আছে কিশোরের সারল্য। শুধু চোখ দুটি মিসির আলির চোখের মতই তীক্ষ্ণ। তবে এই দুটি তীক্ষ্ণ চোখে কৌতুক ঝিকমিক করে। যেন সে সবকিছুতেই মজা পায়।
হিমুকে আনতে হয়েছে একটি বিশেষ কারণে। মিসির আলির জগৎ যে একমাত্র জগৎ নয় তা দেখানোর জন্যেই হিমুর প্রয়োজন হল। লজিক খুব ভাল কথা, সেই সঙ্গে এন্টিলজিকও যে লজিক এই তথ্যটিও মনে রাখা দরকার। ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রনে এসে পৃথিবী থেমে যায়নি। বস্তুজগতের মূল অনুসন্ধান করতে করতে এখন বিজ্ঞানীরা পাচ্ছেন–আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক, চার্ম, স্ট্রেঞ্জ … হচ্ছে কি
এসব!–কোথায় যাচ্ছি আমরা? আমরা কি খুব ধীরে ধীরে লজিকের জগতের। বাইরে পা বাড়াচ্ছি না? এই জগতের কথা তো মিসির আলিকে দিয়ে বলানো যাবে না। আমাদের দরকার একজন হিমু।
সম্প্রতি এক ইন্টারভ্যুতে আমাকে জিজ্ঞেস করা হল–কার প্রভাব আপনার। উপর বেশি–হিমুর, না মিসির আলির? আমি একটু থমকে গেলাম। দুটি চরিত্রই আমার তৈরি। প্রশ্নকর্তার কি উচিত ছিল না জিজ্ঞেস করা–আপনার প্রভাব এই দুটি চরিত্রের উপর কেমন পড়েছে?
পরক্ষণেই মনে হল প্রশ্নকর্তা ঠিক প্রশ্নই করেছেন–এক সময় আমি এদের সৃষ্টি করেছিলাম কিন্তু এরা এখন আমার পুরো নিয়ন্ত্রণে নেই। এদের ভেতর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এরাই বরং এখন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমার নিজের সত্তার ৩০% হিমু, ৩০ মিসির আলি। বাকি চল্লিশ কি আমি জানি না। জানতে চাইও না।
মহামতি ফিহা
আমার লেখা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে ফিহা ঘুরেফিরে আসেন। হিমু এবং মিসির আলির মত তিনি কিন্তু এক ব্যক্তি নন। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি। কোনটাতে তিনি মহাগণিতজ্ঞ। কোনটাতে পদার্থবিদ। যিনি চতুর্মাত্রিক জগতের সন্ধান দিয়েছেন। আমি নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র। বিজ্ঞান আমার অতিপ্রিয় বিষয়ের একটি। মহাপুরুষদের জীবনী। আমি যতটুক আগ্রহ নিয়ে পড়ি, মহান বিজ্ঞানীদের জীবনীও ঠিক ততটুক আগ্রহ নিয়েই পড়ি। সৃষ্টির রহস্য জানার জন্যে যে ব্যাকুলতা বিজ্ঞানীদের মধ্যে কাজ করে সেই ব্যাকুলতা মহাপুরুষদের ব্যাকুলতার চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। আমি আমার। লেখায় ঠিক এই কারণেই মহান বিজ্ঞানীদের ছবি এঁকেছি গভীর মমতায়। যেমন–ফিহা। ইনি দেখতে কেমন? চোখ বন্ধ করলে যে ছবিটি ভেসে উঠে তা অনেকটা আইনস্টাইনের ছবির মত। তবে মাথার সব চুল ধবধবে শাদা। চোখে-মুখে একটু রাগী ভঙ্গি আছে। এই রাগী ভঙ্গিটি কেন আছে আমি ঠিক জানি না। ইনি বাস করেন। শিশুদের জগতে। কেউ কখনো সেই জগৎ থেকে মহামতি ফিহাকে বের করতে পারে না। মজাটা এখানেই। মিসির আলি, হিমু এবং ফিহাদের একটা জায়গায় মিল–এরা সবাই নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন। সচেতন পাঠকরা এর থেকে কিছু বের করতে পারেন?
জরী, পরী, তিলু, বিলু, নীলু ও রানু
নারী চরিত্রে এই নামগুলি আমি বারবার ব্যবহার করেছি। এবং এখনো করছি। বারবার ব্যবহার করা হলেও এরা একই চরিত্র নয়। আলাদা চরিত্র। উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এইসব দিনরাত্রির নীলু হল বড় ভাবী। আর নীল হাতীর নীলুর বয়স হল সাত।
সে যাই হোক, আমার নায়িকারা সবাই অসম্ভব ‘রূপবতী’। ওরকম কেন? রূপ দেয়ার ক্ষমতা যখন আমার হাতে তখন কেন জানি কার্পণ্য করতে ইচ্ছে করে না।
আমার ছাব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত যত লেখালেখি তার বেশির ভাগ নায়িকা পরী, তিলু, বিলু, নীলু, রানু। নামগুলি সহজ এবং ঘরোয়া। ব্যবহার করতে ভাল লাগে। খুব পরিচিত মনে হয়।
ছাব্বিশ বছর বয়সে একটি বালিকার সঙ্গে পরিচয় হবার পর নতুন একজন নায়িকা লেখায় উঠে আসে। তার নাম জরী। বলাই বাহুল্য, সেও অসম্ভব রূপবতী। এই নায়িকা আমার পরবর্তী সব লেখাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতে শুরু করে। কারণ যে বালিকার ছায়া দিয়ে জরী নামক চরিত্রের সৃষ্টি, সেই বালিকাটি আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। সাতাশ বছর বয়সে তাকে আমি বিয়ে করি। তখন তার বয়স মাত্র পনেরো। এই মেয়েটি আমার লেখালেখিতে খুব কাজে আসে। না, রাত জেগে চা বানানোর কথা বলছি না। আমি তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই। বলেই কিশোরীর বিচিত্র মনোজগৎ সম্পর্কে জানতে পারি। একজন কিশোরীর। তরুণীতে রূপান্তরের সেই বিস্ময়কর প্রক্রিয়াটিও দেখা হয়। সবই উঠে আসে লেখায়।
আমার প্রথম দিকের লেখায় নায়িকাদের বয়স খুব কম–কারণ আমার স্ত্রী, তার বয়স কম। আস্তে আস্তে আমার নায়িকাদের বয়স বাড়ে, কারণ আমার স্ত্রীর বয়স বাড়ছে। ইদানিংকালের উপন্যাসে আমার নায়িকারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। কারণ গুলতেকিন (আমার স্ত্রীর কথা বলছি) বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তাহলে কি এই দাঁড়াবে যে সে যখন বৃদ্ধা হয়ে যাবে তখন আমার নায়ক-নায়িকারা হবে বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা?
নিজেকে এই ভেবে সান্ত্বনা দেই–না তা কেন হবে? আমার মেয়েরা এখন বড় হচ্ছে। আবারো খুব কাছ থেকে তাদের দেখছি। এরা হবে আমার ভবিষ্যৎ উপন্যাসের নায়িকা।
এখনো আমার কত কথা জমা হয়ে আছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, কিছুই তো বলা হয়নি, অথচ সময় কত দ্রুত চলে যাচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের ছুটি নিয়েছিলাম। সেই ছুটিও ফুরিয়ে যাচ্ছে, অথচ একটি পৃষ্ঠাও লেখা হয়নি। মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়। বুকের ভেতর ধক করে উঠে। মনে হয়–
“ফুরায় বেলা, ফুরায় খেলা, সন্ধ্যা হয়ে আসে।”
আমি প্রার্থনা করি–হে মঙ্গলময়, তুমি আমাকে শক্তি দাও। ক্ষমতা দাও যেন আমি আমার কাজ শেষ করতে পারি। তুমি আমাকে পথ দেখাও। আমি পথ দেখতে পাচ্ছি না।
গুলতেকিন একসময় জেগে উঠে বলে, কি হয়েছে?
আমি হেসে তাকে আশ্বস্ত করি। সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। আমি জেগে থাকি। আমার ঘুম আসে না।
“এই আমি” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ