আমেরিকানরা রসিকতা করতে পছন্দ করে। তাদের রসিকতার বিষয় শাশুড়ি, মা না। আমাদের দেশে ব্যক্তি নিয়ে রসিকতা শালা-দুলাভাই, দাদা-নাতিতে সীমাবদ্ধ। মা-শাশুড়ি কিংবা বাবা-শুশুর কখনো না।
আমার মা রসিক মানুষ। তিনি তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে রসিকতা করেন। কাজেই তাঁকে নিয়ে তার ছেলেমেয়েদেরও রসিকতা করার অধিকার আছে। মার রসিকতার নমুনা দেই।
একবার এক অপরিচিত মহিলা মাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনা ছেলে কয়টি?
মা বললেন, তিনটি।
বড় ছেলে কী করে?
মা বললেন, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার পিএইচডি ডিগ্রি আছে কেমিষ্ট্রিতে।
ভদ্রমহিলা : মাশাল্লাহু। মেজোটি কী করে?
মা : সে সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার একটা পিএইচডি ডিগ্রি আছে ফিজিক্সে।
ভদ্রমহিলা : মাশাল্লাহ। তিন নম্বর ছেলেটি কী করে।
মা : সে উন্মাদ।
ভদ্রমহিলা : আহারে, কী সর্বনাশ! সবচেয়ে ছোট টা উন্মাদ।
মা : সে উন্মাদ না। সে উন্মাদ নামে একটা পত্রিকা বের করে।
ভদ্রমহিলা হতভম্ব। তার সঙ্গে রসিকতা করায় খানিকটা রাগ। মা নির্বিকার।
আমি তখন অচিন রাগিনী নামের তিন খণ্ডের একটা নাটক বানিয়েছি। মা আমার বাসায় বেড়াতে এসেছেন। নাটক আমার সঙ্গে দেখবেন। তিনি আগ্রহ নিয়ে নাটক দেখলেন। আমি বললাম, কেমন লাগল?
মা বললেন, তোর নাটক দেখতে দেখতে একটা কথা মনে হলো। তোর বাবা আগেভাগে মারা গিয়ে তোর জন্যে সুবিধা করে দিয়েছে।
আমি বললাম, কী রকম?
মা বললেন, সে ছিল নাটকপাগল। তোর নাটকে আসাদুজ্জামান নূর যে পার্টটা করেছে, এটা সে করার জন্যে তোকে বলত। তুই পার্ট তাকে দিতি না। এই নিয়ে পিতাপুত্রের মন কষাকষি। সমস্যা না? আগেভাগে মারা যাওয়ায় তুই বিরাট বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছিস।
এইবার মাকে নিয়ে আমার রসিকতার গল্প। বাবার পোস্টিং তখন কুমিল্লায়। পুলিশের ডিএসপি। আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। ছুটিতে কুমিল্লায় গিয়ে দেখি মা মুরগি পুষছেন। তিনটা মুরগি। মুরগি ডিম পাড়বে। ঐ ডিম খাওয়া হবে। প্রতিদিন সকালে মা খাঁচা খুলে আগ্রহ নিয়ে দেখেন মুরগি ডিম পাড়ল কি না। প্রতিদিন তাকে হতাশ হতে হয়। আমি গোপনে ডিম কিনে এনে রাতে খাঁচায় রেখে দিলাম। সকালে ঘুম ভাঙল মার আনন্দ চিৎকারে। তিনটা মুরলি একসঙ্গে ডিম দিয়েছে। এরপর থেকে প্রতিদিনই খাঁচায় তিনটা করে ডিম পাওয়া যেতে লসগল। সবাই খুশি। একদিন মার আনন্দ-ধ্বনি শোনা গেল না। অথচ আমি রাতে তিনটা ডিমই রেখেছি। তিনি ডিম হাতে আমার কাছে এসে বললেন, এইসব কী! মার সঙ্গে ফাজলামি?
আমি বললাম, কী করেছি?
মা বললেন, এই তিনটা তো হাঁসের ডিম। মুরগি তো হাঁসের ডিম পাড়বে না।
আমি বললাম, মা ভুল হয়েছে। এরকম আর করব না।
মা এই ঘটনায় খুবই আহত হলেন। বাবার কাছে নালিশ করলেন। বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাকে যমের মতো ভয় পাই। ভয়ে অস্থির হয়ে তার কাছে গেলাম। বাবা বললেন, মুরগির ডিমের বদলে তুই হাঁসের ডিম কিনলি কী মনে করে?
আমি বললাম, মুরগির ডিমই চেয়েছি। ডিমওয়ালা হাঁসের ডিম দিয়েছে।
বাবা বললেন, সবচেয়ে ভালো হতো পচা ডিম রাখলে। তোর মা ডিম ভাঙত, বিকট গন্ধে বাড়ি ভরে যেত। তিনটা মুরগি একসঙ্গে পচা ডিম কেন পড়ল এই নিয়ে আমরা তখন গবেষণায় বসতাম।
পাঠক, আমার বাবার রসবোধ কি ধরতে পারছেন?
মানুষ যেমন রসিকতা করে প্রকৃতিও কিন্তু করে। সেই রকম একটা গল্প বলি। মার প্রতি প্রকৃতির রসিকতা।
মা তখন খুবই অসুস্থ। কিডনি প্রায় অকেজো। বিছানায় বসে থেকেই ঘুমিয়ে পড়েন। ডাকলে সাড়া পাওয়া যায় না। একদিন হঠাৎ অচেতন হয়ে গেলেন।
অ্যাম্বুলেন্স এনে তাঁকে ল্যাব এইড হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। তাকে CCU-তে রাখা হলো। ডাক্তার বরেন চক্রবর্তীর রোগী। তার জ্ঞান ফিরল রাত তিনটায়। তিনি দেখলেন, সবুজ পর্দা ঘেরা একটা ঘরে তিনি শুয়ে আছেন। আরামদায়ক আবহাওয়া। তাঁর সামনে সবুজ পোশাক পরা দুটি রূপবতী (এবং বেঁটে) তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। [এরা নার্স। মার খোঁজ নিতে এসেছিল।]
মার ধারণা হলো তিনি মারা গেছেন। মৃত্যুর পর তার বেহশত নসিব হয়েছে। কারণ বেহেশত সবুজ, এই খবর তিনি জানেন। মেয়ে দুটি যে হুর এটাও বুঝা যাচ্ছে। নিশ্চিত হবার জন্যে তিনি হুরদের জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি বেহেশত?
হুর দুজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে রোগীকে সন্তুষ্ট করার জন্যে বলল, জি খালাম্মা।
মা বললেন, তোমরা আমাকে বেহেশতের আঙ্গুর এনে দাও তো। খেয়ে দেখি কী অবস্থা।
হুর দুজন আঙ্গুর নিয়ে এলে কী হতো আমি জানি না। তার আগেই ডিউটি ভাক্তার ঢুকলেন এবং বললেন, খালাম্মার জ্ঞান ফিরেছে। আপনার ছেলেমেয়েরা সবাই বাইরে আছে। ডেকে দেই কথা বলেন।
এই ঘটনার পর একদিন মাকে বললাম, আপনার কি খুব বেহেশতে যাবার ইচ্ছা?
মা বললেন, হ্যাঁ।
আমি বললাম, আপনি তো লোভী মহিলা না। বেহেশতের লোভ কেন করছেন?
মা বললেন, বেহেশতে না পেলে তার বাবার সঙ্গে তো দেখা হবে না। তোর বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্যেই বেহেশতে যেতে চাই।
আমি বললাম, প্রথম দেখাতে তাঁকে কী বলবেন?
বলব, ছয়টা ছেলেমেয়ে আমার ঘাড়ে ফেলে তুমি চলে গিয়েছিলে। আমি দায়িত্ব পালন করেছি। এদের পড়াশোনা করিয়েছি। বিয়ে দিয়েছি। এখন তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করবে। বেহেশতের সুন্দর সুন্দর জায়গুলি আমাকে দেখাবে। শুধু আমরা দুজন ঘুরব। তুমি তোমার সঙ্গের হুরগুলিকে বিদায় কর।
মৃত্যু একটি ভয়াবহ ব্যাপার। যখন মাকে দেখি সেই ভয়াবহ ব্যাপারটির জন্যে তিনি আনন্দ নিয়ে অপেক্ষা করছেন, তখন অবাক লাগে।
“কাঠপেন্সিল” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ