শহর কলকাতা গত তিন দশকে অনেক পালটে গেছে। এককালের জমজমাট শ্যামবাজার এখন একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে। এক সময় সন্ধে হলে যে উল্টোডাঙায় শেয়ালের ডাক শোনা যেত। সেখানে এখন মাঝরাতেও দিনের আলো, গাড়ির হুল্লোড়। এখন ভীম নাগ বা দ্বারিক ঘোষের দোকানের ‘জলভরা তালশাঁসে’ সেই গোলাপের গন্ধ মেলে না। অনাদি কেবিন, বসন্ত কেবিনের নাম আর মুখেমুখে ঘোরে না। চিনে খাবারের রেস্তোরাঁ ওইসব কেবিনগুলোকে কফিনে পাঠিয়েছে। মিষ্টির দোকান ছাপিয়ে এখন ভুজিয়াওয়ালাদের রাজ। প্যারামাউন্টের আম শরবত থেকে আনারস শরবত সবই পিছু হটেছে পেপসি-কোকের সঙ্গে টাকার টক্করে। এক সময় যে প্রেসিডেন্সির দামাল ছেলে-মেয়েরা প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে শহর-গ্রাম চষে ফেলেছিল, এখন সেই প্রেসিডেন্সির ছেলে-মেয়েরা কেরিয়ার গুছনোকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য করে নিয়েছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সঙ্গে টক্কর দিয়ে লড়া মেয়েদের সাহস অবাক করত, আজও করে আমার মত প্রাচীনকে। বাজারি পত্রিকা উনিশ-কুড়িদের জানাচ্ছে, নগ্নতা ও যৌনতার আর এক নাম ‘সাহসী মেয়ে’ ।

আবার পালটায়নি অনেক কিছুই। একই রকম আছে কালীঘাটের পাণ্ডাদের গুণ্ডামি, ধনীদের গুরু পোষার রেওয়াজ, দক্ষিণের কেপমারিদের পুজোয় কলকাতায় আগমন, রেললাইনের পাশের ঝুপড়িগুলোতে গাঁজার বিকিকিনি, কলকাতার ফুটপাতে পর্ণোবইয়ের ঢালাও বিক্রি, পুলিশের প্রকাশ্যে ঘুষ নেওয়া, মধ্যবিত্তদের বিনেপয়সায় মদ খাওয়ার হ্যাংলামো, দক্ষিণ-ভারতীয়দের বসতি এলাকায় সন্ধে হলে ফুল বিক্রির ধুম, মুসলিম এলাকায় সুরমা, আতর, কান পরিষ্কার ও দাঁতের পোকা বের করার ব্যবসা।

দাঁতের পোকা বের করা যাদের পেশা, তারা সব আসে দক্ষিণ শহরতলি থেকে। কেউ পার্কসার্কাস স্টেশনে নেমে ছড়িয়ে পড়ে, কেউ নামে শিয়ালদহে।

দাঁতের পোকা বের করা এখনও একটা গ্রামের অধিবাসীদের একমাত্র জীবিকা। গ্রামের নাম— মালপাড়া। শিয়ালদহ সাউথ স্টেশন থেকে ট্রেন মিলবে জয়নগর যাওয়ার। জয়নগর স্টেশন থেকে মালপাড়া দু’কিলোমিটারের পথ। অটো ও ভ্যান রিকশা পাওয়া যাবে স্টেশনেই ।

জয়নগর যেমন বাঙালিদের কাছে ‘মোয়া’র জন্য বিখ্যাত, তেমনই কলকাতার অবাঙালি মুসলিমদের কাছে বিখ্যাত মালপাড়ার জন্য। মালপাড়াবাসীরা শুধু দাঁত থেকে পোকা বের করে না, কান থেকেও বের করে। কান কট্‌ট্ করছে? ওদের কাছে বসে পড়লে যত্ন করে কান পরিষ্কার করে, কান থেকে পোকা বের করে দেয়। তারপর বিধান দেবে দু-বেলা দু’ফোঁটা করে সরষের তেল কানে দিতে।

২০০০-এর আগস্টে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ চ্যানেলের হয়ে ডিরেক্টর প্যাট্রিক মার্ক এলেন ‘ইন্ডিয়া’জ ডাইরি’ শিরোনামে একটা সিরিজ তুলতে। ওঁরা ভারতের নানা অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা তুলতে চান। ধরে রাখতে চান বাবাজি-মাতাজিদের তথাকথিত নানা ব্যাপার-স্যাপার। দেখতে চান যুক্তিবাদী সমিতি এসবের কী ব্যাখ্যা দেয়, কীভাবে বুজরুকি ফাঁস করে। তালিকা তৈরির দায়িত্ব আমাদের উপর বর্তালো।

পোকা তুলছে মালপাড়ার এক বৃদ্ধা

আমরা ঠিক করলাম তালিকায় মালপাড়া রাখব। টিভি টিম নিয়ে হাজির ইসলাম মালপাড়া গ্রামে। ছোট্ট গ্রাম। গোটা পনেরো পরিবারের বাস। ধর্মে ইসলাম। পারিবারিক সূত্রে এরা নাকি পেয়েছে ‘দোয়া-কমা’র বিশেষ পদ্ধতি। এই দোয়ার শক্তিতে আল্লার দয়ায় দাঁতে বা কানে পোকা থাকলে ঝুরঝুরিয়ে বেরিয়ে আসে। নগদ দামে ‘দোয়া-কমা’ শিখতে চাইলাম। জানলাম— এ বিদ্যে টাকা দিলেই শেখা যায় না। আমাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এই গ্রামের কোনও পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করে এই গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে হবে। তবেই শেখানো হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। দাঁত ও কানের পোকা বের করে মানবসেবায় আমি নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করলে আল্লা নিশ্চয়ই দানা-পানির ব্যবস্থা করে দেবেন। কারণ এ হল চরম সত্য যে, প্রতিটি খাবারের দানায় আল্লা লিখে নেন খানেওয়ালার নাম। অর্থাৎ পোকা বের করে মানবসেবাই হবে আমার একমাত্র জীবিকা। অন্য কোনও জীবিকা রাখতে পারব না।

বেলা গড়ালেই সকালে পাত্তা পেটে দিয়ে সমর্থ পুরুষরা বেরিয়ে পড়ে সেবা ও রোজগারের ধান্ধায়। পাড়ায় থাকে নারী ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। দূর দূর গ্রাম থেকে বেশ কিছু রোগী হাজির হয় মালপাড়ায়। বাড়িতে বসেই নারী-বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অলৌকিক-চিকিৎসা করেন।

আয়নাল মাল, বয়স পঞ্চান্ন। বাড়িতে বসেই চিকিৎসা করেন। আয়নালের বাড়ির সামনে প্রশস্ত উঠোন। একপাশে টিউবওয়েল। উঠোনে বসে আয়নাল। তাঁর সামনে একটা বছর দশেকের বাচ্চা বসে। ওর দাঁতে ব্যথা। ছেলেটির নাম হারু মণ্ডল। বাবা তারাপদ মণ্ডল। থাকেন ধামুয়ায় । মুদির দোকান আছে। এসেছেন ছেলের দাঁতের ব্যথা সারাতে। তারাপদ জানালেন, “ডাক্তার দেখাতে গেলে এককাড়ি খরচা। এখানে পনেরো টাকাতেই চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে। এখুনি দেখবেন, দাঁত থেকে কেমন ঝুপঝুপ্ করে পোকা পড়বে।”

বললাম, “দাঁতে তো পোকা হয় না। দাঁতের ফাঁকে বা মুখে জীবাণু থাকলেও তা তো আপনি খালি চোখে ঝুপঝুপ্ করে পড়তে দেখবেন না।”

“পড়ে কি না, এ নিয়ে তত্ত্বের দরকার নেই। এখুনি দেখতে পাবেন।” এ’কথা যিনি বললেন, তিনিও এসেছেন বালিকা কন্যাকে নিয়ে। এসেছেন ডায়মন্ডহারবার থেকে। নাম হরিপদ হালদার। মেয়ে লক্ষ্মীর কানে ব্যথা কয়েক দিন ধরে।

তর্কে গেলে যে জন্যে আসা তা-ই পণ্ড হতে পারে। অতএব বে-ফাঁস কথা শুধরে বললাম, “সত্যি, কত কম-ই না জানি আমরা।”

এখানে আসার আগেই আমরা একটা হোমওয়ার্ক করে নিয়েছিলাম। জয়নগরের শম্ভু দাশ ও সমীর হালদার এই অঞ্চলে যুক্তিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। ওঁরা দু’জনই আমাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন একটা বিষয়ে –এলাকা ধর্মান্ধ মুসলিমদের। আশেপাশের গাঁয়ের মুসলিমরাও মালপাড়ার গ্রামবাসীদের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করে। ওদের বিশ্বাসে আঘাত লাগলে বা কোনও ভাবে গোলমালে জড়িয়ে পড়লে এই অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ’সব শোনার পর আমরা আলোচনা করে ঠিক করেছিলাম, যদি পোকা বের করার কৌশল ধরতেও পারি, তবু পরিস্থিতি প্রতিকূল মনে হলে ওখানেই রহস্য বে-আব্রু করার ঝুঁকি নেব না। কাছাকাছি অন্য কোথাও ক্যামেরার সামনে রহস্য উন্মোচন করে দেখাব। অবশ্য কোটি টাকার প্রশ্ন হল এটাই যে—রহস্যের গোপন কারণটা ধরতে পারব তো? বাস্তবে না নেমে ‘পারব’ বলা যতটা সোজা, বাস্তবে নেমে ধরা ততটাই কঠিন। এবং এটাই কঠিন বাস্তব।

শম্ভু ও সমীর ছাড়া আমার সঙ্গী ছিলেন সৌরভ দাশগুপ্ত ও গোপাল রায়। সৌরভের ভূমিকা দোভাষীর। গোপালের দায়িত্ব ম্যানেজারের। বলতে পারেন প্রোডাকশন ম্যানেজারের। সব কিছুর ওপর নজর রাখার।

‘দাঁতে পোকা হয় না’—আমাদের এমন নিশ্চিত বক্তব্যে অনেকেই বিরক্ত হতে পারেন। কারণ ছোটোবেলা থেকেই আমরা ‘দাঁতে পোকার গল্প’ শুনে আসছি। টিভির বিজ্ঞাপনে দেখছি। আজ হঠাৎ উল্টো কথা শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন হতে-ই পারে। আর দাঁতের পোকা তোলা নিজের চোখে দেখলে তো কথাই নেই। দাঁতের যন্ত্রণা, দাঁতের গভীর ক্ষয়—এ’সব হলে এখনও বেশিরভাগ ভারতীয় বলেন, “দাঁতে পোকা ধরেছে”।

আসলে দাঁতে পোকা ধরে না। দাঁতের ক্ষয় হয়। একেই চলতি কথায় বা ভুল ভাবনা থেকে আমরা ‘পোকায় ধরা’ বলি। দাঁত এই যে ঝকঝকে সাদা, এর কারণ দাঁতে রয়েছে ‘এনামেল’ (enamel) ‘কোটিং’। দাঁতের ভিতরে সুক্ষ্ম স্নায়ু রয়েছে। দাঁতের বাইরের অংশে কোনও স্নায়ু বা রক্তবাহী শিরা নেই। ফলে দাঁতের নিজস্ব কোনও ব্যথা অনুভবের ব্যাপার নেই ।

আমরা যখন খাবার খাই, তখন দাঁতের ফাঁকে খাদ্যকণা ঢুকে থাকে। এই খাদ্যকণায় পচন ধরে, জীবাণু দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। চিনি, চকোলেট, লজেন্স, মিষ্টি এ’সব বেশি খেলে এবং খাবার পর ঠিক মতো দাঁত পরিষ্কার না করলে জীবাণু শর্করা খাদ্যকণার সাহায্যে দ্রুত নানা ধরনের অ্যাসিড তৈরি করে। যেমন, ল্যাকটিক অ্যাসিড, বুটারিক অ্যাসিড, পাইরুভিক অ্যাসিড ইত্যাদি। এই অ্যাসিডের সংস্পর্শে দাঁতের এনামেল ক্ষয়ে যেতে থাকে। দাঁতের ক্ষয় ঘটলে দাঁতে ছিদ্র তৈরি হয়। ছিদ্র পথ দিয়ে ঠান্ডা জল বা মিষ্টির রস ইত্যাদি দাঁতের ভিতরের স্নায়ুকে স্পর্শ করে। স্নায়ু উত্তেজিত হয়। যন্ত্রণা হতে থাকে। মনে রাখতে হবে, দাঁতের জীবাণু আকারে এতই ছোট্ট যে, অনুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা সম্ভব নয়। সুতরাং খালি চোখে ঝুপঝুপ্প করে দাঁতের পোকা বেরুতে থাকলে বুঝতেই হবে, দাঁতের ক্ষয় নিয়ে সাধারণের অজ্ঞতাকে মূলধন করে লোক-ঠকানোর ব্যবসা চলছে। দাঁতে পোকা হয় না—এই মূল বিষয়টা বুঝে নিলে প্রত্যয়ের সঙ্গে বুজরুকি ধরার চেষ্টায় নামা যায়। সব জায়গায় একই নিয়ম।

যে বিষয় নিয়ে সত্যানুসন্ধানে নামা, সে বিষয়ে পরিষ্কার একটা ধারণা

গড়ে তোলা জরুরি। নতুবা ‘হতেও পারে, নাও হতে পারে’–

এই ধরনের দ্বিধা থেকেই যাবে। প্রত্যয় থাকাটা জরুরি।

কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। এরপর

লাগে প্রতারণা ধরার মেধা।

দাঁত থেকে পোকা বের হতে পারে না’—এই প্রত্যয় থাকলে কীভাবে পোকাগুলো বের করা হচ্ছে, ধরতে পারব—এমনটা নয়। কোনও আপাত-ব্যাখ্যাতীত ঘটনার কারণ খুঁজে বের করাটা অনেক সময় খুবই কঠিন কাজ হতে পারে। আমরা কেউ-ই সব কিছু জেনে বসে নেই। প্রয়োজনে কোনো বিষয়ের বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হয়। নিইও। এই বিশেষজ্ঞ পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, উদ্ভিদ-বিজ্ঞানী, শরীর-বিজ্ঞানী, পরিবেশ-বিজ্ঞানী, মনোবিদ, জাদুকর বা অন্য কেউ হতে পারেন। এ ভাবেই ধাপে ধাপে আমরা এগোই। আমাদের বোধ, আমাদের অভিজ্ঞতা, বুজরুকি ফাঁস করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নেয়।

আয়নাল ও হারু মুখোমুখি উবু হয়ে বসে। দু-জনের মাঝখানে রয়েছে একটা স্টিলের বাটিতে টিউবকলের পরিষ্কার টলটলে জল। আয়নালের হাতে একটা ছোট মেডিকেটেড তুলোর প্যাকেট । ওষুধের দোকান থেকে কেনা। নীল রং-এর শক্ত কাগজে মোড়া প্যাকেটটার মাথার দিকটা আমাদের সামনেই ছিঁড়লেন আয়নাল। প্যাকেটে জড়ানো তুলো থেকে একটু ছিঁড়ে হারুর পাতে চেপে ধরলেন। বিড়বিড় করে যাচ্ছিলেন আয়নাল। বোধহয় ‘দোয়া পড়ছিলেন। মিনিট দু তিন পরে দাঁতে চেপে রাখা তুলোটা বের করলেন। বাটির পরিষ্কার জলে তুলোটা ডুবিয়ে নাড়তে লাগলেন। অবাক হয়ে দেখলাম, আধ সেন্টিমিটারের মতো লম্বা সাদা রং-এর চার-পাঁচটা পোকা জলে নড়ে-চড়ে বেড়োচ্ছে। পোকাগুলো দেখতে অনেকটা পুরনো চালের পোকার মতো ।

আয়নাল তারাপদ’র দিকে ফিরে বললেন, “যান, আপনার ছেলেকে নিশ্চিন্তে নিয়ে যান। সব পোকা বেরিয়ে গেছে।”

আয়নালের ছবি তোলা হচ্ছে। ওঁকে টিভি’তে দেখা যাবে, এটা আয়নাল এবং তাঁর পরিবারের লোকদের বোধহয় ভালোই লাগছিল। আয়নালের ছবি তোলা হচ্ছে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে। আমি- ই ওঁকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বসাচ্ছি। বাটির পোকার ছবি উঠছে। ওঁর বাঁ-হাতে ধরা তুলোর প্যাকেটটা ডান হাতে ধরিয়ে দিলাম। বাঁ হাতে ধরালাম জলের বাটি। ছবি উঠছে। এ’সব করতে করতে আয়নালের হাতের তুলোর একটু অংশ যে আমার হাতে এসে গেছে, সেটা আয়নালের জানা ছিল না।

আপাতত ছবি তোলায় সাময়িক বিরতি। লাঞ্চ ব্রেক। কাছেই শম্ভু মাস্টারের বাড়ি। ওখানেই লাঞ্চ প্যাকেট রয়েছে। তারাপদ মণ্ডল আর হারুকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সবাই এলাম শম্ভুর বাড়ি। এক বাটি জল এলো। আয়নালের কাছ থেকে লুকিয়ে আনা টুকরোটা জলে নাড়তে লাগলাম । কোথায় কী? শুধু জল আর ভেজা তুলো। তুলোটা এবার টেনে কিছুটা ছড়িয়ে দিয়ে নাড়তেই গোটা তিনেক সেই বিশেষ সাদা পোকা কিলবিল করতে লাগল। শম্ভুর স্ত্রী রানু চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওমা? এ তো দেখছি সজনে ডালের পোকা। দাঁড়ান এক্ষুনি এনে দেখাচ্ছি।”

দৌড়ে একটা সজনে ডাল নিয়ে এলেন উঠোনের কোনের স্যাতস্যাতে জায়গা থেকে। দিন কয়েক আগে সজনে ডাল কাটা হয়েছিল। ভেজা জায়গায় থাকার জন্য ডালের ছালগুলো ফুলে উঠেছে। শম্ভু ছালের একটা অংশ টানতেই হাতে উঠে এলো। ডালের সাদা অংশটা দৃশ্যমান হল। সাদা ডালে কিলবিল করছে একগাদা সাদা পোকা, যে ধরনের পোকা দাঁত থেকে বেরিয়েছিল। রানু জানালেন, তেপোলতে গাছের ডাল কেটে ভিজে জায়গায় ফেলে রাখলেও এই পোকা হয় ।

লাঞ্চ ব্রেকের পর আবার আমরা মালপাড়ায় হাজির হলাম। এবার আমাদের ক্যামেরা ধরল ময়না মাল ও তাঁর মেয়ে জেসমিন মালকে। দু’জনেই দাঁতের ও কানের পোকা তোলেন। পদ্ধতি আয়নালের মতই। ময়নার বয়স পঞ্চান্ন-ষাট। জেসমিন পঁয়তিরিশ-চল্লিশ। এখানেও বাটিতে জল, দাঁতে তুলো চেপে ধরা, জলে পোকা বেরিয়ে আসা—সব একই ছবি। ছবিটা এ’বার একটু পাল্টাল। জেসমিনের হাতের তুলোর প্যাকেট থেকে একটু তুলো ছিঁড়ে নিয়ে জলে নাড়তেই পোকা বেরিয়ে এলো।

শুটিং দেখতে ভিড় বেড়েছে। দর্শকদের অনেকেই জয়নগরের মানুষ। ভিড় করছে যুক্তিবাদী সমিতির ছেলে-মেয়েরাও। সব্বার সামনে এমন ভাণ্ডাফোড় হতে দেখে ময়না ও জেসমিন যদিও বা ফুঁসে উঠেছিলেন, কিন্তু জনগণে তীব্র ক্ষোভ দেখে তাঁরা গুটিয়ে গেলেন।

প্যাট্রিক মার্কের একটা প্রশ্ন ছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “প্যাক করা কটনের ভিতর ওরা পোকা ঢোকাচ্ছে কী করে? এটা তুমি ব্যাখ্যা করতে না পারলে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না যে, ওরা প্রতারণা করছে।”

ময়নার কাছে আরও একটি তুলোর প্যাকেট ছিল। সেটা ঝট্ করে তুলে নিলাম। ক্যামেরার সামনে দেখালাম, আপাতভাবে মনে হচ্ছে নিখুঁত প্যাকেট করাই রয়েছে। কিন্তু এই প্যাকেটের দু’প্রান্তের আঠায় জোড়া অংশই প্রথমে খোলা হয়েছে, তুলোয় পোকা ঢুকিয়ে ডেনড্রাইট, কুইকফিক্স ইত্যাদি জাতীয় কোনও আঠা দিয়ে আবার জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর প্যাকেট খুলে তুলো বের করে দাঁতে চেপে পোকা বের করার কেরামতি দেখিয়ে চলেছে মালপাড়া ।

ইতিমধ্যে অন্তত বার পনেরো মালপাড়ার বুজরুকি ফাঁসের কাহিনি দেখিয়েছে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ চ্যানেল। কিন্তু দাঁতে যে পোকা হয় না, এ’বিষয়ে আমরা কি সচেতন হয়েছি। আমরা ‘শিক্ষিতরা?

♦ কিছু কথা

প্রথম খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ মার্কিন গডম্যান মরিস সেরুলোঃ একটি ইতিহাস

অধ্যায়ঃ দুই

♦ যোগী-জ্যোতিষী হরেকৃষ্ণবাবা !

অধ্যায়ঃ তিন

♦ পঞ্চাশ বছর আগের বালক ব্রহ্মচারী এবং…

অধ্যায়ঃ চার

♦ মেঠাইবাবার রহস্যভেদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ হাড় ভাঙ্গার দৈব-চিকিৎসা

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ কাকদ্বীপের দৈব-পুকুর

অধ্যায়ঃ সাত

♦ আগরপাড়ায় ‘ভূতুরে’ আগুন

অধ্যায়ঃ আট

♦ প্রদীপ আগরওয়ালের সম্মোহনে ‘পূর্বজন্মে’ যাত্রা

অধ্যায়ঃ নয়

♦ কামধেনু নিয়ে ধর্মব্যবসা

অধ্যায়ঃ দশ

♦ বরানগরের হানাবাড়িঃ গ্রেপ্তার মানুষ- ভূত

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ এফিডেভিট করে ডাক্তারের প্রশংসাপত্র নিয়ে ওঝাগিরি !

অধ্যায়ঃ বারো

♦ ‘গ্যারান্টি চিকিৎসা’র নামে হত্যাকারীর ভূমিকায় সর্পবিদ হীরেন রায়

অধ্যায়ঃ তেরো

♦ চলো যাই ফকিরবাড়ি

অধ্যায়ঃ চোদ্দ

♦ সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জঃ পেটে হবে মোহর !

অধ্যায়ঃ পনেরো

♦ হুজুর সাইদাবাদীঃ মন্তরে সন্তান লাভ !

অধ্যায়ঃ ষোলো

♦ জলাতঙ্ক ও দৈব-চিকিৎসা

অধ্যায়ঃ সতেরো

♦ বিশ্বাসের ব্যবসায়ীরা ও নপুংসক আইন

দ্বিতীয় খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ খেজুর তলার মাটি সারায় সব রোগ

অধ্যায়ঃ দুই

♦ পক্ষিতীর্থমের অমর পাখি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !

অধ্যায়ঃ চার

♦ নাকালের দৈব-পুকুরঃ হুজুগের সুনামী

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ সায়েব যখন রেইকি করে রাঘব বোয়াল চামচা ঘোরে

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ লক্ষ্মীমূর্তি কালি হলেন আপন খেয়ালে

অধ্যায়ঃ সাত

♦ পাথর যখন কথা বলে

অধ্যায়ঃ আট

♦ ফাঁদে পড়ে জ্যোতিষী শ্রীঘরে

অধ্যায়ঃ নয়

♦ বিশ্বের বিস্ময় অলৌকিক মাতা জয়া গাংগুলী’র বিস্ময়কর পরাজয় এবং…

অধ্যায়ঃ দশ

♦ আই আই টিতে টেলিপ্যাথি দেখালেন দীপক রাও

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ জন্ডিস সারাবার পীঠস্থান ইছাপুর

অধ্যায়ঃ বারো

♦ মালপাড়ার পেশা দাঁতের পোকা বের করা

অধ্যায়ঃ তেরো

♦ নিমপীঠের গুগি মা

তৃতীয় খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ ওঝার ঝাড়ফুঁক আর টেরিজার লকেটে মণিহার রোগমুক্তিঃ কুসংস্কারের দু’পিঠ

অধ্যায়ঃ দুই

♦ ‘মেমারিম্যান’ বিশ্বরূপ-এর একটি বিশুদ্ধ প্রতারণা

অধ্যায়ঃ তিন

♦ কোটিপতি জ্যোতিষী গ্রেপ্তার হলেন

চতুর্থ খন্ড

অধ্যায়ঃ এক

♦ কিস্যা অক্টোপাস পল বিশ্বকাপ ফুটবলের ভবিষ্যৎ বক্তা

অধ্যায়ঃ দুই

♦ কিস্যা জ্যোতিষী বেজান দারওয়ালা

অধ্যায়ঃ তিন

♦ সাধারণ নির্বাচন ২০০৯ নিয়ে সব জ্যোতিষী ফেল

অধ্যায়ঃ চার

♦ মা শীতলার পায়ের ছাপ পুকুরঘাটেঃ রহস্যভেদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ যিশুর মূর্তি থেকে রক্তপাত

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ সত্য সাঁই-এর সত্যি-মিথ্যে

অধ্যায়ঃ সাত

♦ অলৌকিক উপায়ে সন্তান দেন ডা. বারসি

অধ্যায়ঃ আট

♦ জ্যোতিষীর বাড়িতে অলৌকিক আগুন

অধ্যায়ঃ নয়

♦ সম্মিলিত দুর্নীতির ফসল ‘মোবাইলবাবা’

অধ্যায়ঃ দশ

♦ জাতিস্মরঃ রাজেশ কুমার

♦ অলৌকিক শক্তিধরদের প্রতি চ্যালেঞ্জ

“যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!