পোপের পর সবচেয়ে জনপ্রিয়, প্রভাবশালী খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতা মরিস সেরুলো সব দেশ জয় করে শেষ পর্যন্ত কলকাতায় এসে ডুবল ! ভাবা যায় না! এটাই বোধহয় মিরাকল!’
কথাগুলো রবার্ট ঈগলের। রবার্ট ইংলন্ডের চ্যানেল ফোরের জনপ্রিয় ডিরেক্টর প্রডিউসার। রবার্ট আরও বলেছিলেন, “এটা যে কি বিশাল কাজ করেছ, তা তোমরা ভাবতেই পারছ না।”
হয়তো বিশালত্বর পরিমাপটা আমরা ঠিক মত করতে পারিনি, কারণ পরিমাপ করতে বসিনি। দুটি নীতিতে আমি বিশ্বাস করি। (এক) শত্রুকে কোনও কারণেই ছোট ভাববে না। ছোট ভাবলে নিজের কাজে ছোট-খাট ফাঁক-ফোকর থেকে যায়। (দুই) যুদ্ধে নেমে শত্রুকে কোনও কারণেই নিজের চেয়ে বড় ভাববে না। এমন কি নিজের সমকক্ষও ভাববে না।
‘৯২-এর ১৩, ১৪ ও ১৫ অক্টোবরের বিভিন্ন ভাষা-ভাষী দৈনিক পত্রিকায় আমরা মরিস সেরুলোর দেওয়া বিজ্ঞাপন দেখেছি। ১৩ তারিখ বিজ্ঞাপন ছিল সিকি পাতা জুড়ে, ১৪ তারিখ আধ পাতা এবং ১৫ তারিখ পুরো পাতা জুড়ে।
খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন প্রকাশেরও দিন দশেক আগেই কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় এমন কি মহাকরণে মন্ত্রীদের যাতায়াতের সদর ফটকের ডান দিকের দেওয়ালে রঙিন পোস্টার পড়েছিল মরিস সেরুলোর অলৌকিক সমাবেশের। সমাবেশের দিন তিনেক আগে কলকাতা ও শহরতলি জুড়ে পোস্টার পড়েছে, বিলি হয়েছে লিফলেট। বক্তব্য এক–সেরুলোর অলৌকিক সমাবেশে, পার্কসার্কাস ময়দান, ১৫ অক্টোবর ’৯২, সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে। অলৌকিক আরোগ্য সমাবেশ ইতিপূর্বে বধির শোনার শক্তি ফিরে পেয়েছে, অন্ধ ফিরে পেয়েছে দৃষ্টি, প্রতিবন্ধী সুস্থ হয়েছে—বিজ্ঞাপনে এই দাবির সমর্থনে তিনটি ছবিও ব্যবহৃত হয়েছে।
এ-ভাবে ভয়ংকর বিজ্ঞাপন দিয়ে হেঁকে-ডেকে প্রতারণা কলকাতার ইতিহাসে প্রথম। আমাদের দেশে একটি আইন আছে—‘ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস (অবজেকশনাবেল অ্যাডভারটাসজমেন্ট) অ্যাক্ট ১৯৫৪’। সেই অনুসারে এই ধরনের আলৌকিক উপায়ে রোগ আরোগ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়া ও প্রকাশ করা স্পষ্টতই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ছাড়াও এই অদ্ভুতুড়ে দাবির মধ্যে রয়েছে একটি বড়-সড় পরিকল্পিত প্রতারণার গন্ধ। কোনও বিদেশি নাগরিক কোনও জনসভা বা ধর্মীয় সভা করতে গেলেও লাগে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও সিকিউরিটি কন্ট্রোলের রিপোর্ট। এই দুই রিপোর্ট পাবার পরই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সভার অনুমতি দিতে পারে। কলকাতার পুলিশ সূত্রে খবর পেলাম, কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারের স্ত্রী ও এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর প্রভাবশালী পুত্র মরিস সেরুলোর এই অলৌকিক সমাবেশে ‘আগ্রহী’ হওয়ায় স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও সিকিউরিটি কন্ট্রোলের রিপোর্ট ছাড়াই কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার অফ ট্রাফিক তড়িঘড়ি এই অলৌকিক সমাবেশের অনুমতি দিয়েছেন। মরিস সেরুলোর এই অলৌকিক সমাবেশের আবেদন অফিসিয়ালি জানিয়েছিলেন স্যামুয়েল রাজ। স্যামুয়েল রাজ হলেন অ্যাসেমব্লি অফ গড চার্চের প্রিন্সিপাল, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রল চার্চের অন্যতম পুরোহিত এবং ইস্ট ইন্ডিয়া স্কুল অফ মিনিস্ট্রি ইন ইভানজেলিসম-এর চেয়ারম্যান। ১৩ অক্টোবর স্যামুয়েল রাজের গুরুসদয় দত্ত রোডের কুসুম অ্যাপার্টমেন্টের ফ্ল্যাটে ফোন করেছি। দ্বিধাহীন ভাষায় জানলেন, ‘মরিস সেরুলোর প্রার্থনায় সত্যিই বোবা কথা বলে, অন্ধ দেখে। এর মধ্যে কোনও অতিরঞ্জন নেই।’ জানালেন, মরিস সেরুলো ‘ঈশ্বরের শেষ অবতার’, ‘স্বয়ং ঈশ্বর তাঁকে স্বর্গে নিয়ে গিয়েছিলেন’। মরিস সেরুলো ওয়ার্ল্ড ইভানজেলিসমের চেয়ারম্যান। সেরুলোর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই বলে সেরুলোকে কোথায় পাব জানতে চাওয়ায় জানালেন, তিনি কোথায় উঠেছেন কোনও সাংবাদিককেই আমরা জানাচ্ছি না ।
একটি বিশেষ সূত্রে খবর পেলাম মরিস সেরুলো তাজ বেঙ্গল হোটেলে উঠেছেন। ১৪ অক্টোবর ফোনে কথা হল। মুখোমুখি সাক্ষাতে রাজি হলেন না। জানালেন, ‘ঈশ্বর দর্শন পনেরো বছর বয়সে স্বর্গে। ঈশ্বরই স্বর্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঈশ্বরের কাছ থেকে সরাসরি অনেক কিছু শিখলাম। ঈশ্বর চাইলেন আমার মধ্য দিয়ে আর্তের সেবা করতে, জনগণকে ঈশ্বর বিশ্বাসী করতে। সেদিন থেকে আমি ঈশ্বরের দূত। পেলাম অলৌকিক ক্ষমতা।’
‘কেউ কেউ বলছেন, গোটা ব্যাপারটাই ভাঁওতাবাজি।’ সেরুলোকে একটু খুঁচিয়ে দিতে কথাটা বললাম।
‘কেউ কেউ মানে তো র্যাশানালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রবীর ঘোষ। জানি ও আমার ‘মিরাকেল ক্রসেইড’-এ আসবে। কিন্তু কিছু বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। ও আর যাই হোক ঈশ্বরের ইচ্ছের চেয়ে বড় নয়।’
১৪ অক্টোবর পার্কসার্কাস ময়দানে স্টেজের ও আশে-পাশের একটা পরিষ্কার চিত্র পেলাম একাধিক সূত্র থেকে। সন্ধ্যায় যুক্তিবাদী সমিতির জন্য পঞ্চাশ ছেলেমেয়েকে নিয়ে বসলাম । কি আমার পরিকল্পনা, স্পষ্ট করে বোঝালাম। জানালাম প্রত্যেকে যেন সারা মাঠের দর্শকদের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। মরিস সেরুলো তাঁর বিজ্ঞাপনে জানিয়েছেন মাদ্রাজে লোক হয়েছিল ন-লক্ষ । ওখানে রোগমুক্তি ঘটাবার জন্য এই ধরনের প্রার্থনা সভার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। আমাদের এখানে অত না হলেও তিরিশ থেকে ষাট হাজার লোক হবে বলে জানালাম। ব্ল্যাক বোর্ডে স্টেজের অবস্থান বুঝিয়ে কে কোথায় থাকবে তার একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে নিলাম। প্রায় সকলেই জনতার ভিড়ে মিশে আশে-পাশের মানুষদের কাছ থেকে জেনে নেবে নাম, ঠিকানা, কি অসুখ ইত্যাদি। জানালাম, খবর পেয়েছি সভায় ইস্ট ইন্ডিয়া স্কুল অফ ইন ইভানজেলিসমের দু-হাজার ট্রেনড্ লাঠিধারী স্বেচ্ছাসেবক মাঠে থাকবে। তাদের জানানো হয়েছে, আমরা যুক্তিবাদীরা গণ্ডগোল করতে পারি। ব্যাপক পুলিশি ব্যবস্থা থাকবে। এমন হতে পারে, আমরা কেউ কোনও ভাবেই যাতে মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোনের দখল না নিতে পারি, তার জন্য স্টেজ ঘিরে ঢালধারী পুলিশবাহিনী মোতায়েন থাকবে। খবর আছে পার্কসার্কাসের কিছু বিখ্যাত সমাজ-বিরোধীদের ভাড়া করা হয়েছে এই দিনটির জন্য। সেরুলো তাঁর প্রার্থনা শেষে আহ্বান জানাবেন—যারা রোগমুক্ত হয়েছ তারা স্টেজে উঠে এসো। মরিসের স্বচ্ছাসেবকরা তখন উঠতে চাওয়া মানুষদের মধ্য থেকে বাছাই করে লোক তুলতে থাকবে।
মরিস সেরুলোর বুজরুকি ফাঁস করতে আমাদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। কেউ কোনও প্ররোচনায় পা দেবে না। কোনও বিজ্ঞান সংগঠন যদি কিছু পোস্টার-টোস্টার নিয়ে স্টেজের দিকে এগুতে থাকে, তাদের সহযোগিতা করা উচিত ভেবে, নিজের ডিউটি ভুলে এগুবে না । আমাদের উদ্দেশ্য খান-কয়েক পোস্টার তুলে ধরা নয়। আমরা চাইছি কাল মরিস সেরুলোর
বুজরুকি ফাঁস করে একটা ইতিহাস তৈরি করতে। আর সবচেয়ে জরুরী কথাটা হলো, আমি স্টেজে উঠবই। আমাকে স্টেজে উঠতে দেখলেই তোমরা তৈরি হবে। আমি মাউথপিস দখলের চেষ্টা করব। করতে পারি বা না পারি, স্টেজের সামনে সাংবাদিকদের অন্তত বোঝাতে পারবই স্টেজে তোলা হয়েছে সাজানো রোগীদের। এই সময় তোমরা আকাশের দিকে ছুড়ে দেবে পাঁজা-পাঁজা লিফলেট। মরিসের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দিতে প্রত্যেকে দৌড়তে থাকবে স্টেজের দিকে। স্টেজ দখল নিতেই হবে। খুব দ্রুততার সঙ্গে ঘটনাটা ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে স্টেজে গোলমাল, সাংবাদিকদের ক্ষোভ, আকাশ জুড়ে লিফলেট ওড়া ও দৌড়ে আসা মানুষ দেখে পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকরা ঘাবড়াতে বাধ্য। আর মাইকে একবার বলার সুযোগ পেলে গণহিস্টিরিয়ার এক দারুণ নিদর্শন কালই দেখতে পাবে। শেষ কথাটি হল—আমাদের এই পরিকল্পনার একটি কথাও তোমার প্রিয় বন্ধু, মা-বোন, বউ—কাউকেই বলবে না। তোমাদের গোপনীয়তা রক্ষার চেষ্টা ও নিষ্ঠাই কাল এক ইতিহাস তৈরি করতে পারে।
১৪ তারিখ সারা দিন রাতই ফোন এসেছে বিভিন্ন পত্রিকা দপ্তর থেকে। জানতে চেয়েছেন, মরিসের অলৌকিক সমাবেশে যাচ্ছি কি না। প্রত্যেককেই জানিয়েছি, যাচ্ছি। বিশেষ কোনও পরিকল্পনা ছাকছেন? উত্তরে জানিয়েছি, না না। যাচ্ছি, এটুকু বলতে পারি। তারপর দেখি । ফোন পেয়েছি কলকাতা পুলিশের এক ডেপুটি কমিশনারের কাছ থেকে। জানতে চেয়েছেন আমরা যাচ্ছি কি না। যাচ্ছি জেনে শুভার্থী হিসেবে অনুরোধ করেছেন যেন না যাই। ফোন পেয়েছি রাজ্য পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মচারীর কাছ থেকে। একই প্রথা। একই অনুরোপ ।
১৫ অক্টোবর সকাল থেকেই অনেক ফোন পেয়েছি আমাদের বিভিন্ন শাখা থেকে। তাদের প্রাতাকাকে দুপুরের মধ্যে আমার ফ্ল্যাটে আসতে বলেছি। হালিশহর শাখাকে বলেছি ‘গো ব্যাক মরিস সেরুলো ‘ ইত্যাদি কয়েকটা পোস্টার করে আনতে। হালিশহর শাখাদের বোঝালাম, তারা থাকবে স্টেজের বায়ো রাস্তার কাছে। কোনও বিজ্ঞাপন সংগঠন বিক্ষোভ জানাতে চাইলে স্টেজের বাঁয়ের রাস্তার দিক দিয়ে মঞ্চের দিকে এগুতে চাইবে। সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলে এটাও ওরা করবে। তেমনটা ঘটলে তোমরা চার-পাঁচজন ওদের সঙ্গে মিশে হাতের পোস্টার তুলে বিক্ষোভে শামিল হবে। পুলিশ বাধা দেবেই। পড়ে পড়ে লাঠি খেতে হবে না। পুলিশ তাড়া করলে পালাবে।
প্রাণনাশের হুম্কি দিয়ে বেশ কয়েকটা ফোন এসেছে। ফোন এসেছে পুলিশ দপ্তর থেকে—সেই একই অনুরোধ। ফোন এসেছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে।
আজ এমন পরিস্থিতি ঘটতে পারে ‘আজকাল’ পত্রিকার হয়ে লেখার মত সময় ও সুযোগই মিলবে না। সম্পাদক অশোক দাশগুপ্তকে বিষয়টা জানালাম। তখনই জানলাম আজকাল-এর চারজন সাংবাদিক ও তিনজন চিত্র-সাংবাদিক যাচ্ছেন। জানালেন তিনি নিজেও যাবেন ভাবছেন । ভিডিও ক্যামেরা থাকবে।
ইতিমধ্যে বিশেষ সূত্র থেকে খবর পেলাম পেশাদার খুনি লাগানো হয়েছে আমার পিছনে । দুপুরের আগেই আমার পাড়ায় সশস্ত্র রাজ্য পুলিশ বাহিনী টহল দেওয়া শুরু করলেন। আমার ফ্ল্যাট আক্রান্ত হতে পারে শঙ্কা থেকেই বোধহয় এই মোতায়েন।
পাঁচটা তিরিশ নাগাদ পার্কসার্কাস ময়দানে পৌঁছলাম। ইতিমধ্যেই কুড়ি পঁচিশ হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছেন। এদের মধ্যে বহু মানুষ অসুস্থ, বিকলাঙ্গ, জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। দ্রুত মাঠে একটা চক্কর দিলাম। যুক্তিবাদী সমিতির ছেলে-মেয়েরা লোকেদের সঙ্গে কথা বলে নোট নিচ্ছে। মরিসের বেশ কয়েকজন ব্যাজধারী স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কথা হলো। এদের অনেকেই এসেছেন বিভিন্ন প্রদেশ থেকে। না, সমিতির কারও সঙ্গেই আমার কথা হয়নি। আমার সামনেই মেটাডোর ভ্যান, টেম্পো, অ্যাম্বুল্যান্স থেকে রোগী নামানো হয়েছে। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলেছি। নোটবুকে নোট নিয়েছি। আমার ছায়াসঙ্গী শুধু একজন – সুব্রত। ওর কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ। ঝলমলে স্টেজে জোরাল বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে কোট-টাই পরা একগাদা দেশি সাহেব কোরাসে গাইছেন যিশু
ছ’টা দশ। সাংবাদিকদের জন্য সংরক্ষিত স্টেজের সামনেই ঘেরা জায়গায় ঢুকলাম। আমি ঢুকতেই একজন পুলিশ অফিসার আমার গায়ে সেঁটে গেলেন। মঞ্চ ঘিরে বিশাল পুলিশ বাহিনী, বেতের ঢাল নিয়ে তৈরি। রয়েছে কাঁদুনে গ্যাস নিয়ে তৈরি পুলিশ। মঞ্চের কাছেই কলকাতা পুলিশের দু-জন ডেপুটি কমিশনার, চয়ন মুখার্জি ও কে. আর সেনগুপ্ত। সাংবাদিকদের কেউ কেউ জানতে চাইলেন—কখন অ্যাকশনে নামছি। জানালাম, ‘তেমন সুনির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা বা হোমওয়ার্ক করে আসিনি। আগে ব্যাপারটা দেখি, তারপর সেটা বোঝার চেষ্টা করি, তারপর তো—কিন্তু আপনারা কি একটা জিনিস লক্ষ্য করছেন, পুলিশের ইউনিফর্ম পরেই কিছু পুলিশ সেরুলোর লিফলেট বিলোচ্ছে। পুলিশের অ্যাসিটেন্ট কমিশনার আর মুখার্জি স্টেজে দৌড় ঝাঁপ করে একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করে চলেছেন। একজন আই. পি. এস-এর স্ত্রী অন্যতম ব্যবস্থাপক হিসেবে মঞ্চ আলো করে বসে আছেন! অলৌকিক চিকিৎসা বে-আইনি হওয়া সত্ত্বেও সেরুলোর অলৌকিক চিকিৎসার এই সমাবেশকে প্রোটেকশন দিতে হাজির দুজন ডেপুটি কমিশনার, দু-জন অ্যাসিটেন্ট কমিশনার ও পার্কসার্কাস ও তার আশে-পাশের তিনটি থানার ও.সি. আর বিশাল পুলিশ বাহিনী! সত্যি বিচিত্র !’
ঠিক সাড়ে ছ’টায় মরিস সেরুলো মঞ্চে এলেন। প্রবল হাততালি। পরনে কালো কোট প্যান্ট, লাল টাই। বুক পকেটে লাল রুমাল। হাতে বাইবেল। সেরুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর অনুবাদক। সেরুলো চেঁচালেন, ‘হালে লুইয়া’ অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রশংসা করুন। অনুবাদক বাংলা করে বললেন। অনুবাদের অনুরোধে হাজার পঞ্চাশেক মানুষ চেঁচালেন, ‘হালে লুইয়া’।
সেরুলো গোটা মঞ্চ জুড়ে প্রায় নেচে নেচে পা ঠুকে ঠুকে একটু লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরতে ঘুরতে তার হাতে ধরা মাউথ-পিসটিকে একবার ডানহাতে একবার বাঁ হাতে নিয়ে যাত্রার অভিনেতার মত চড়া ঢঙে বলে চলেছেন, কে বলেছে আমরা বাঁদরের বংশধর? আমাদের প্রাচীনতম পূর্বপুরুষটিও মানুষই ছিল। কারণ ঈশ্বর আমাদের মানুষ করেই সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর সৃষ্ট প্রথম মানব-মানবী আদম ও ঈভ গড়েছিলেন নিজের আদলে। তখন মানুষের অসুস্থতা ছিল না, মৃত্যু ছিল না। ঈশ্বর বলেছিল নিষিদ্ধ ফল যদি কখনও খায় তবে পাপের ফল হিসেবে মানুষের জীবনে আসবে অসুস্থতা, মৃত্যু। শয়তানের প্ররোচনায় আদমের পাপ- আর তারই ফল ভোগ করে চলেছি আমরা বংশপরম্পরায়।
ইতিমধ্যে মঞ্চের বাঁ পাশে রাস্তার দিক থেকে একটা গুঞ্জন। হাতে পোস্টার নিয়ে জনা পনেরো ছেলে-মেয়ে। ওদের মধ্যে আমাদের হালিশহর শাখার কয়েকজনকে দেখতে পেলাম। ওরা স্লোগান দিচ্ছিলেন মাইকের আওয়াজ ভেদ করে স্লোগান আমাদের কানে গুঞ্জন ঠেকেছে। এ-বার ওঁরা একটু কাছে এসেছেন। চিনলাম—ওঁরা গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্রের ছেলে-মেয়ে। মুহূর্তে লাঠি নিয়ে তেড়ে গেল কয়েকজন পুলিশ। লাঠি-চার্জে শুরু হতেই ওঁরা মাঠ ছেড়ে পালালেন। পোস্টার হাতে ছেলে-মেয়েদের এগোতে দেখে আমার পাশে দু-জন বাড়তি পুলিশ অফিসার হাজির হয়েছিলেন। পোস্টারওয়ালার বিদায় নিতে বাড়তি দু-জন বিদায় নিলেন।
আমাদের এই অবস্থান থেকে ঘটনাটা দেখা গেলেও সভার অন্য প্রান্তগুলো ঘটনার টেরই পেল না।
মরিসের বক্তব্য এতে বিন্দুমাত্র বিঘ্নিত হয়নি। তিনি তাঁর নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে চলেছেন, ‘ঈশ্বর প্রেরিত দূত আসে মানুষের পাপ দূর করতে। শয়তানের পরাজয়, ঈশ্বরের জয় প্রতিষ্ঠা করতে। এ ভাবেই যিশু এসেছিলেন, আমি এসেছি।’
‘আজ কলকাতা শহরের এই ময়দানের ওপর ঈশ্বরের আত্মা নেমে আসবেন। প্র আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন? দুহাত তুলে সমস্ত আবেগ দিয়ো তাঁকে আহ্বান করুন। ওই তো তিনি আসছেন… তিনি এসে পড়েছেন, আপনারা প্রত্যেকে ভাল সম্মানে উঠে দাঁড়ান।
কান্নায় ভেঙে পড়ে মরিস সেরুলো বললেন, ‘হা-লে-লু-ই-য়া’। হাজার পঞ্চাশেক মানুষ উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের কান্না ভেজা কাঁপা-কাঁপা গলায় ধ্বনিত হল ‘হা-লে-লু-ই-য়া।’ সে এক ভয়ংকর গণ-উন্মাদনা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে চোখ বুজে দু-হাত ওপরে তুলে কাঁদছেন আর বলছেন, ‘হা-লে-লু-ই-য়া’।
কয়েকজন সাংবাদিক তাঁদের ক্ষোভ চেপে না রেখে তাঁদের সময়ের অপচয়ের জন্য আমাকে দুষলেন। জানালেন—এরপর সেরুলোর বিরুদ্ধে আমি কিছু করতে গেলে পাবলিকই আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। জনা কয়েকের পোস্টার দেখানোর মধ্যে দিয়েই আমার খেলা শেষ হয়ে গেছে—এমনও কেউ কেউ ভাবলেন। কি আর করি। আমার তখন শুধু শোনার পালা।
সেরুলো শুরু করলেন দ্বিতীয় পর্ব। বললেন, এক এক করে বিভিন্ন রোগীকে আরোগ্য করবেন। প্রথমে বধিরদের পালা। নির্দেশ দিলেন এক কানে না শুনলে সেই কানে আঙুল দিতে হবে, দু-কানে না শুনলে দু-কানে নিজের আঙুল দিতে হবে। জন্ম কালারাই জন্ম বোবা। বোবা কালাদেরও দু-কানে নিজের আঙুল দিতে হবে। যাঁরা রোগী এনেছেন, তাঁরা তো শুনতে পাচ্ছেন, তাঁদের এবং স্বেচ্ছাসেবকদের অনুরোধ করছি, বোবা-কালাদের সাহায্য করতে। এবার বাকি প্রত্যেকে দু-হাত সামনে বাড়িয়ে দিন। যাঁরা শুনতে পাচ্ছেন, তাঁরা বলুন—ইন দি নেম অফ যেসাস, কাম আউট…। অনুবাদক হিন্দি ও বাংলাতে অনুবাদ করে যাচ্ছেন চিৎকার করে।
প্রার্থনা শেষে সেরুলো বললেন, ‘শোনা যাচ্ছে? কি আগের চেয়ে ভাল মত শোনা যাচ্ছে? বলুন? মঞ্চে এগিয়ে এসে প্রমাণ দিন, নাম বলুন, উত্তর দিন। যারা বধিরতা মুক্ত হয়েছে তাদের মঞ্চে নিতে আসতে ভলেন্টিয়ারদের বলছি।’ ঘড়িতে রাত সাতটা পঁয়তাল্লিশ। সেরুলো দাবি করলেন, ‘ময়দানের প্রতিটি বোবা-কালা সুস্থ হয়ে গেছে। এখন আপনাদের সামনে ভলেন্টিয়াররা হাজির করছে প্রমাণ ।’
ভলেন্টিয়াররা একে একে বেছে বেছে রোগী তুলে আনতে লাগলো স্টেজে। একে একে নাম-ঠিকানা বলে তারা জানাচ্ছে প্রার্থনার পরই প্রথম শুনতে পাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে স্টেজ আলো করে রাখা সরকারি অফিসার, তাঁদের বউ আর সাদা চামড়ার একগাদা নারী-পুরুষ তুমুল হাততালি দিয়ে উঠছেন। অভিনন্দনের ঢেউ মাইক থেকে পৌঁছে যাচ্ছে ময়দানের হাজার পঞ্চাশেক মানুষের মস্তিষ্ক-কোষে।
সাদা চামড়ার খাঁটি আমেরিকান চেহারার সুট-টাই পরিহিত সেরুলোকে অন্যান্য দেশি গুরুজিদের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। তাই মনে সন্দেহ অবিশ্বাস থাকলেও শহরের মানুষ বিদেশি সাদা চামড়ার প্রতি অযৌক্তিক সমীহ বশতই প্রতিবাদে সোচ্চার হ’তে পারবে না জানতাম । এই জড়তা কাটাতে, নিজেদের যুক্তি-বুদ্ধির প্রতি আস্থা রেখে প্রতিবাদে যোগ দিতে সাহায্য করেছিল মাঠে ছড়িয়ে থাকা যুক্তিবাদী সদস্য সদস্যারা।
তারা নিজেরা সঙ্গে করে মূক বধির ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সত্যি সত্যিই চেষ্টা করছিল মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে—কিন্তু কেউই কাছে এগোতে পারেনি —সরাসরি বাধা পেয়েছিল ভলান্টিয়ারদের কাছ থেকে। তাছাড়া প্রথম প্রার্থনাপর্বের শেষে যখন সেরুলো জিজ্ঞেস করছিলেন দর্শকদের ‘শুনতে পাচ্ছেন? বলতে পারছেন?’ ইত্যাদি। তখন এই যুক্তিবাদী ভলান্টিয়াররা ঘুরে ঘুরে জিজ্ঞেস করছিলেন দর্শকদের তাদের সঙ্গের রোগীদের। কারুর কাছে ইতিবাচক উত্তর পাওয়া যাচ্ছি না। তখন তারা নিজেদের সঙ্গের রোগীদের দেখিয়ে জোরের সঙ্গেই বলছিলেন ‘কই সারেনি তো? যেমন ছিল তেমনি আছে।’ যারা জোরে বলছে, ‘হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি’ যেটা মাইকে শোনা যাচ্ছে। তারা তো মঞ্চের সামনে আলাদা বাঁশ দিয়ে ঘেরা জায়গায় বসা উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সঙ্গে । চার্চের প্রধান অতিথিরা আর কিছু সাদা চামড়াধারী। ‘কই আমাদের উত্তর তো শোনাই যাচ্ছে না—আমাদের এগোতে দিল না কেন?’ প্রশ্ন বহুর।
মাঠের পঞ্চাশ হাজারের মত আমজনতার ভিড়ে এমন একজনও প্রতিবন্ধীকে খুঁজে পাওয়া গেল না—যিশুর কৃপায় যার জন্মগত রোগ সেরে গেছে এইমাত্র। অনেকেই গলা মেলালো—‘সত্যিই তো—আমাদের কথা শুনছেন না কেউ। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল—মজা দেখতে আসা বাদামওয়ালা থেকে শুরু করে চন্দননগরের বিকলাঙ্গ মেয়েটির হতাশ মা-বাবা পর্যন্ত সবাই নিজের চোখে দেখতে পেল এই প্রার্থনাসভার অসারতা, সাজানো আসরের ভয়ঙ্কর অমানবিক প্রতারণা। পরে এ-সবই জেনেছি সমিতির সভ্য-সভ্যাদের কাছ থেকে। কিন্তু প্রতিবাদ করবে কে? কী ভাবে? তারা কি হতাশায় ভেঙে পড়ে বাড়ি ফিরে যাবে নিজেদের ভাগ্যকে দুষতে দুষতে? অন্ধ শিশুকে কোলে নিয়ে তার দিদিমা ভিড়ের চাপ থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথ ধরতে পারলে বাঁচেন।
এই দোদুল্যমান বিস্ফোরক সম্ভাবনার মুহূর্তে আমি এগোলাম স্টেজের দিকে। সবকিছু প্ল্যানমফিকই এগোচ্ছে। সিঁড়ির কাছে বাধা পেলাম। পুলিশ ও সেরুলোর ‘মাসলম্যান’-দের কাছ থেকে প্রত্যাশিত বাধা। সাংবাদিকদের নজর ও সমর্থন আমাকে মঞ্চে উঠতে সাহায্য করল। একাধিক ভিডিও ক্যামেরা এখন আমাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু মঞ্চে উঠতেই পরিস্থিতি একটু অন্যরকম হল। সেরুলোর ব্যক্তিগত দেহরক্ষীরা আমাকে টানতে লাগলেন মঞ্চের পিছন দিকে নিয়ে যেতে। মঞ্চ আট ফুটের মত উঁচু। সামনে থেকে পিছন পর্যন্ত বিস্তার প্রায় তিরিশ ফুট। পিছনে টেনে নিয়ে গিয়ে একটা ছুরি বসিয়ে দিলেও সামনের সারির সাংবাদিকদের নজর পড়ার কথা নয়। মঞ্চের সামনের বাঁশ ধরে রইলাম শক্ত হাতে। রানাঘাটের ফুল বিক্রেতা পরিচয়ে জয়ন্তী দে তখন নাইকে দাবি জানাচ্ছেন—বেশ কিছুদিন বধির ছিলেন। আজ সন্ধ্যা থেকে আবার শুনতে পাচ্ছেন। উল্টোডাঙার কল্যাণকুমার নাথ সদ্য কিশোর। সঙ্গে অভিভাবক। কল্যাণ জন্ম থেকেই বোবা-কালা। সেরুলো ছেলেটির পিছনে হাত নিয়ে হাত তালি দিলেন তিনবার। কল্যাণ শুনে থাকলে ততবার হাত তালি দিক, ঈশারায় বোঝালেন কল্যাণের অভিভাবক। কল্যাণ তিনবার হাত তালি দিল। কল্যাণের পিছনে এবার চারবার হাততালি দিলেন সেরুলো। কল্যাণ চারবার হাততালি দিল। মাউথপিস এখন স্বেচ্ছাসেবকের হাতে। সেটা হাত বদল করে সেরুলোর হাতে যাওয়ার আগেই আমি মুঠো বন্দি করে ঘোষণা করলাম, ‘এখনও পর্যন্ত যারা মঞ্চে উঠে সেরে গেছে বলে গল্প শোনাল, তারা প্রত্যেকেই সেরুলোর সাজানো লোক। আমি ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির তরফ থেকে মরিস সেরুলোকে চ্যালেঞ্জ করছি। এতক্ষণ পর্যন্ত যাদের স্টেজে তুলেছে, তারা এখনও স্টেজের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। ওরা আবার এক এক করে ওদের ডিটেল ঠিকানা ও নাম বলুন। তারপর আপনারা, সাংবাদিক বন্ধুরা খোঁজ নিলেই দেখতে পাবেন, হয় ঠিকানা মিথ্যে, নতুবা পড়শীরাই জানিয়ে দেবেন—ওরা বধির ছিল না।
চ্যালেঞ্জ জানাবার সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকরা এক সঙ্গে দাবি করলেন, সেরে যাওয়া রোগীদের তাদের সামনে হাজির করতে হবে। তাঁরা প্রশ্ন করতে চান। ওদিকে সারা মাঠ জুড়ে তখন রাশি বাশি আগত উড়ছে । চিৎকার উঠছে, ‘গো ব্যাক, মরিস সেরুলো, গো ব্যাক, গো ব্যাক।’ কল্যাণ যথেষ্ট মানতে গেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সেরুলো ও তার স্টেজের সঙ্গীরাও কিছুটা বিহুল।
আমার হাত থেকে মাউথপিসটা কেড়ে নেবার অক্ষম চেষ্টা আপা দেখলাম দুই ডেপুটি পুলিশ কমিশনারকে ।
মঞ্চের সামনে থেকে আজকাল পত্রিকার সাংবাদিক দেবাশিস ভট্টাচার্য চিৎকাল পরে কল্যাণকে প্রশ্ন করলেন, ‘দুর্গার কটা হাত?’
আমি আদেশের সুরে কল্যাণকে বললাম, ‘বল দুটো হাত।’ কল্যাণ বলল, ‘দুটো চাও।’ ‘জন্ম বোবা-কালা কল্যাণ, যে কোনও ভাষাই জানে না, সে আমার বাংল। গুনে কতটুকু বলতে হবে বুঝে পরিষ্কার বাংলায় দিব্বি কথা বলে বুঝিয়ে দিল, ওকেও সাজিয়ে হাজির করা হয়েছে। সাংবাদিক কল্যাণকে নিয়ে ওর ঠিকানায় গেলেই বুঝতে পারবেন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কত বড় প্রভারণা এখানে হচ্ছে।’ মাঠ জুড়ে মাইকে আমার কথাগুলো ছড়িয়ে পড়ল।
মরিস সেরুলোর স্বেচ্ছাসেবকরা কল্যাণকে দ্রুত সরিয়ে নিল। আমাকে ধরে টানছে সেরুলোর কয়েকজন দেহরক্ষী।
সাংবাদিকরা তখন ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। তাঁরা সেরুলোকে সরাসরি বললেন, আপনি ভাঁওতা দিচ্ছেন। কলকাতার বুকে আমরা বুজরুকি চলতে দেব না। সেরুলো হাত-পা ছুড়ে চেঁচাতে লাগলেন, ‘ভগবান তোমাদের ওপর অভিশাপ দেবেন।’ সেরুলোর সঙ্গীরাও গাল পাড়ছেন সাংবাদিকদের। আমি তখন আক্রান্ত সেরুলো বাহিনীর হাতে। ক্রুদ্ধ সাংবাদিকরা আমাকে আক্রমণের তীব্র প্রতিবাদ করলেন। সেরুলোর সাঙ্গোপাঙ্গোরা তখন পুলিশ ডাকছেন উদ্ধার পেতে । যুক্তিবাদী সমিতির ছেলে-মেয়েরা পুলিশ ও সেরুলো বাহিনীর ব্যারিকেড ভেঙে মঞ্চ দখল করতে উঠে আসছে। আকাশে উড়ছে যুক্তিবাদী সমিতির প্রচারপত্র। অবস্থা পুলিশ ও সেরুলোর আয়ত্তের বাইরে। ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে আমজনতা। ডেপুটি কমিশনার চয়ন মুখার্জি আমার হাত থেকে মাউথপিস কেড়ে নিয়ে আমাকে স্টেজ থেকে নেমে যেতে বললেন। পুলিশ তখন লাঠি চালাচ্ছে। আবার এক গণহিস্টিরিয়া দেখলাম। ময়দানের পঞ্চাশ হাজার মানুষ ধিক্কার দিচ্ছেন সেরুলোর নামে। সেরুলোকে গ্রেপ্তারের দাবি জানালেন। দাবি জানালেন সাংবাদিক বন্ধুরা, সাধারণ মানুষ। পুলিশ ও সেরুলো বাহিনীর প্রতিরোধ অগ্রাহ্য করে যুক্তিবাদী সমিতির ছেলে-মেয়েরা মঞ্চ দখল করেছে। সেরুলো ও তার কয়েকজন সাথীকে পুলিশ লালবাজারে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় সেরুলোকে লক্ষ্য করে উড়ে এলো অনেক জুতো।
এই বুজরুকদের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসন নীরব থাকলে আমরা পরবর্তী কী কী পদক্ষেপ নেব, সে বিষয়ে সমিতির ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে জরুরী আলোচনা সেরে যখন ‘আজকাল’ পত্রিকা দপ্তরে পৌঁছলাম, তখন রাত এগারোটা পঞ্চাশ। সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত খবর দিলেন, লালবাজার থেকে আমার খোঁজ করা হচ্ছে। দৌড়লাম লালবাজার। ওখানে দেখা পেলাম সেরুলো ও তিন ব্যবস্থাপকের। ব্যবস্থাপকরা হলেন স্যামুয়েল রাজ, ইস্ট ইন্ডিয়া স্কুল অফ মিনিস্ট্রির অন্যতম প্রশাসক নির্মল বারুই ও স্বেচ্ছাসেবকদের অন্যতম প্রশাসক কে. ই. জেকভ। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার দীনেশ বাজপেয়ী ও পাঁচজন ডেপুটি কমিশনারের একটি দল আমার সঙ্গে আলোচনায় বসলেন।
সেরুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অভিযোগে দায়ের করলাম ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির প্যাডে। জমা দিলাম একাধিক প্রতিবন্ধীর অভিযোগপত্র । জানালাম, বোনেপুকুর থানাতেও এক প্রতিবন্ধীর অভিযোগপত্র ইতিমধ্যে জমা পড়েছে।
অলৌকিক উপায়ে রোগ সারাবার বিজ্ঞাপন দেওয়াটাই বে-আইনি। এই বে-আইনি বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর পুলিশ তো বে-আইনি সমাবেশ বন্ধ করতে উদ্যোগ নেয়নি, বরং ব্যবস্থাপকদের সমস্ত রকম সহযোগিতা সহ বে-আইনি লিফলেট পর্যন্ত বিলি করেছে। আমাদের এই সমিতির তরফ থেকে আমার এই বক্তব্য রাখার পরও পুলিশ অবশ্য তাঁদের ত্রুটি স্বীকার করেননি। ‘উদ্যোক্তারা একটি চিঠিতে ধর্মীয় প্রার্থনা সভার অনুমতি চেয়েছিল, কোথাও ‘অলৌকিক সমাবেশ বা ‘অলৌকিক আরোগ্যদান’-এর কথা ছিল না। বিষয়টি পরে সেদিনই বিজ্ঞাপনে আমরা দেখি।’ ডেপুটি কমিশনার দেবেনবাবু এ-কথা জানান। দিন দশেক আগেই সারা কলকাতা জুড়ে এমনকি মহাকরণে সেরুলোর ছবিসহ বড় বড় রঙিন পোস্টারে ‘অলৌকিক সমাবেশ’-এর কথা জানানো সত্ত্বেও এ বিষয়ে তারা কিছু জানতেন না, এটা মেনে নেওয়া যে সম্ভব নয় তাও জানাই। এটা মেনে নিলে আরও মানতে হয়—পুলিশ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মাইনে নেয়।
আমাদের আলোচনার গতি-প্রকৃতি মাঝে মাঝেই জানিয়ে দেওয়া হচ্ছিল পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার ও মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে।
মরিস সেরুলো একে বিশাল মাপের ধর্মগুরু, তায় আবার আমেরিকান। তাই সেরুলোকে আদালতে পাঠালে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে ভেবেই কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কাছে সেরুলোকে আদালতে পাঠানোর ব্যাপারটা খুবই স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিল। শেষপর্যন্ত সেরুলোকে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি ঘোষণা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রিপোর্ট পাঠিয়ে ভোর না হতেই ব্যাঙ্ককে বিমানে সেরুলোকে চাপিয়ে দিয়ে এলো পুলিশ।
পশ্চিমবাংলার সাংবাদিকরা ও যুক্তিবাদী মানুষরা সে-দিন এমন একটা ঘটনা ঘটিয়েছেন, যা ইতিহাস হয়ে থাকবেই। ঘটনার আগের পরের কয়েকটি দিনের প্রতিটি ভাষা-ভাষী দৈনিক পত্রিকা ভবিষ্যতের গবেষকদের কাজে লাগবেই। ইতিহাসকে খুঁজে পেতেই কাজে লাগবে ।
প্রথম খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ মার্কিন গডম্যান মরিস সেরুলোঃ একটি ইতিহাস
অধ্যায়ঃ দুই
♦ যোগী-জ্যোতিষী হরেকৃষ্ণবাবা !
অধ্যায়ঃ তিন
♦ পঞ্চাশ বছর আগের বালক ব্রহ্মচারী এবং…
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
♦ প্রদীপ আগরওয়ালের সম্মোহনে ‘পূর্বজন্মে’ যাত্রা
অধ্যায়ঃ নয়
অধ্যায়ঃ দশ
♦ বরানগরের হানাবাড়িঃ গ্রেপ্তার মানুষ- ভূত
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ এফিডেভিট করে ডাক্তারের প্রশংসাপত্র নিয়ে ওঝাগিরি !
অধ্যায়ঃ বারো
♦ ‘গ্যারান্টি চিকিৎসা’র নামে হত্যাকারীর ভূমিকায় সর্পবিদ হীরেন রায়
অধ্যায়ঃ তেরো
অধ্যায়ঃ চোদ্দ
♦ সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জঃ পেটে হবে মোহর !
অধ্যায়ঃ পনেরো
♦ হুজুর সাইদাবাদীঃ মন্তরে সন্তান লাভ !
অধ্যায়ঃ ষোলো
অধ্যায়ঃ সতেরো
♦ বিশ্বাসের ব্যবসায়ীরা ও নপুংসক আইন
দ্বিতীয় খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ খেজুর তলার মাটি সারায় সব রোগ
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !
অধ্যায়ঃ চার
♦ নাকালের দৈব-পুকুরঃ হুজুগের সুনামী
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ সায়েব যখন রেইকি করে রাঘব বোয়াল চামচা ঘোরে
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ লক্ষ্মীমূর্তি কালি হলেন আপন খেয়ালে
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
অধ্যায়ঃ নয়
♦ বিশ্বের বিস্ময় অলৌকিক মাতা জয়া গাংগুলী’র বিস্ময়কর পরাজয় এবং…
অধ্যায়ঃ দশ
♦ আই আই টিতে টেলিপ্যাথি দেখালেন দীপক রাও
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ জন্ডিস সারাবার পীঠস্থান ইছাপুর
অধ্যায়ঃ বারো
♦ মালপাড়ার পেশা দাঁতের পোকা বের করা
অধ্যায়ঃ তেরো
তৃতীয় খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ ওঝার ঝাড়ফুঁক আর টেরিজার লকেটে মণিহার রোগমুক্তিঃ কুসংস্কারের দু’পিঠ
অধ্যায়ঃ দুই
♦ ‘মেমারিম্যান’ বিশ্বরূপ-এর একটি বিশুদ্ধ প্রতারণা
অধ্যায়ঃ তিন
♦ কোটিপতি জ্যোতিষী গ্রেপ্তার হলেন
চতুর্থ খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ কিস্যা অক্টোপাস পল বিশ্বকাপ ফুটবলের ভবিষ্যৎ বক্তা
অধ্যায়ঃ দুই
♦ কিস্যা জ্যোতিষী বেজান দারওয়ালা
অধ্যায়ঃ তিন
♦ সাধারণ নির্বাচন ২০০৯ নিয়ে সব জ্যোতিষী ফেল
অধ্যায়ঃ চার
♦ মা শীতলার পায়ের ছাপ পুকুরঘাটেঃ রহস্যভেদ
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
♦ অলৌকিক উপায়ে সন্তান দেন ডা. বারসি
অধ্যায়ঃ আট
♦ জ্যোতিষীর বাড়িতে অলৌকিক আগুন
অধ্যায়ঃ নয়
♦ সম্মিলিত দুর্নীতির ফসল ‘মোবাইলবাবা’
অধ্যায়ঃ দশ
“যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ