মানুষের পক্ষে
ঊনিশ শোঁ চুয়াত্তর। নতুন স্বাধীন দেশে আপাতঅপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাধরদের উল্লাস তখনো ফুরিয়ে যায় নি, বরং তা এগিয়ে চলেছে পরবর্তী বছরে কেটে যাওয়া ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে। একই সাথে এ ছিল সমান্তরাল শক্তির গণযুদ্ধের প্রস্তুতির, নব্য ধনীদের অসংযত স্ফূর্তিবিলাসের আর বেশব্যাপী দুর্ভিক্ষের বছর। একাত্তরের ডিসেম্বরে স্বাধীনতা থেকে পচাত্তরের আগস্টে রক্তাক্ত প্রাসাদ নিয়ে দানবীয় লোফালুফি খেলার শুরু পর্যন্ত এই মাটিতে ধর্মীয় মৌলবাদের ভারবাহী ও সওয়ারদের ছিল ঘোর দুর্দিন।
তবু এই চুয়াত্তরের এক দিনে বরিশাল শহরের এক খোলা শহরের ওপর জনসমক্ষে অপরাধে তৎপর হয়ে উঠল একদল মাদ্রাসাকেন্দ্রিক মৌলবাদের ভারবাহী। সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ আরজ আলী মাতুব্বরকে অপহরণ করে নিতে চাইল। অনুমেয় উদ্দেশ্য – নির্যাতন করে তাদের মতে চলতে বাধ্য করা, অথবা তাতে ব্যর্থ হলে লোকটিকে সম্পূর্ণ নিখোঁজ করে ফেলা।
কোন আঘাতের যন্ত্রনায় দারূন শীতের মাঝেও কুন্ডলী ছেড়ে ফনা তুলে দাঁড়ালো এই ঘৃণিত সরীসৃপেরা?
মানবসন্তানটির অপরাধ – গেঁয়ো কৃষক হয়েও তিনি এক সুশিক্ষিত দার্শনিক। স্পর্ধা করেছেন ধর্মধ্বজীদের কুসংস্কারের বেসাতিকে চ্যালেঞ্জ করার। চ্যালেঞ্জ করেছেন ধর্মের নামে মূর্খতার প্রচারণাকে, তাঁর ‘সত্যের সন্ধান’ গ্রন্থ প্রকাশ আর তার ব্যাপক প্রচারের চেষ্টা করে। অসাধারণ পর্যবেক্ষণ, বিস্ময়কর যুক্তির নৈপুণ্য আর খাঁটি দার্শনিকের অটল সত্যনিষ্ঠায় সমৃদ্ধ এই বই।
লেবাসধারীদের প্রিয় পাকিস্থানী ইসলামী সরকার বইটি প্রকাশের আগেই নিষিদ্ধ করে রেখেছিল দীর্ঘ বিশ বছর। দেশ স্বাধীন হওয়াতে সেই নিষেধাজ্ঞা আর কার্যকর নেই। কিন্তু বিশ বছরের ব্যবধানে সদ্যোজাত শিশুও হয়ে ওঠে পূর্ণ যুবা, টববগে যুবক হারায় যৌবনের সমস্ত সম্পদ। প্রৌঢ় আরজ আলী রূপান্তরিত হয়েছেন সত্তরোর্ধ বৃদ্ধে।
কিন্তু প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তায় ফিরে গেছেন যৌবনের প্রথম দিনে। বইটি প্রকাশ করেছেন লেবাসী ভন্ডদের সব ফতোয়া-নির্দেশ আর হুমকি উপেক্ষা করে। হয়তো এমন বই আরো লিখছেন।
অপহরণচেষ্টার পর আরজ আলী মাতুব্বরের একা চলাফেরা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সীমিত হয়ে আসে নিজ এলাকার শহরে যাওয়া আসা। এর পরে প্রকাশিত বই ‘সৃষ্টি রহস্য’তে ধর্মীয় কুসংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে তিনি আলোচনা রেখেছেন নিজ সম্প্রদায়ের মৌল্বাদী গোষ্ঠীর বিদ্বেষের সম্ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে। এক্ষেত্রে কোন ধর্ম, সম্প্রদায় বা ধর্মগ্রন্থের প্রতি অনুরাগ-বিরাগ কাজ করেনি, বিবেচক পাঠক মাত্রই তা বুঝতে পারবেন। বরং এ থেকে উপলব্ধি করা যায়, আপন পরিপার্শ্বের কতখানি প্রতিকূলতার শিকার ছিলেন তিনি।
দুর্বলদেহ বিনীত এক বৃদ্ধের শরীর ও সম্মানের উপর সরাসরি আক্রমণের হুমকি বজায় ছিল আরও এক যুগ। তাঁর মৃত্যু শেষ পর্যন্ত।
আরো অনেক আরজ আলী আসবেন। তাঁরাও কি একই ভাবে বাধ্য হবেন নিঃসঙ্গ যোদ্ধার জীবন যাপন ও মৃত্যু বরণে?
মানুষ সহায় হোক মানুষের। মানুষ মানুষ হয়ে উঠতে পারে শুধু এই পথে।
রাকি ইউসুফ
১-১-১৯৯৫
“আরজ আলী মাতুব্বর” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ