১. শারীরিক কারণে মানসিক অসুখ

জন্মের সময় শিশুকে যন্ত্রের সাহায্যে ডেলিভারি করাতে গিয়ে যদি শিশুর মাথায় যন্ত্র আঘাত করে থাকে তবে তার মস্তিষ্কের স্বাভাবিকতা নষ্ট হতে পারে। দুর্ঘটনার কারণে মস্তিষ্কে চোট লাগতে পারে। ব্রেন টিউমার, এনকেফালাইটিস ইত্যাদি কারণে মানসিক রোগ হতে পারে।

কিডনি খারাপ হলে শরীরের দূষিত যেসব পদার্থ কিডনি শোধন করে, তা বন্ধ থাকে। দূষিত পদার্থের মাত্রা বৃদ্ধিতে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে। ফুসফুস ঠিকমতো কাজ না করলে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব ঘটে। ফলে মানসিক রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

মানুষের শরীরে কিছু গ্রন্থি বা gland আছে। যেমন পিটুইটারি, থাইরয়েড ইত্যাদি। এইসব গ্রন্থি থেকে বেরিয়ে আসা রস মস্তিষ্কের কাজে সাহায্য করে। কোনো কারণে গ্রন্থিগুলো থেকে রস কম বা বেশি বের হলে মানসিক রোগ হতে পারে ৷

এইসব কারণে মানসিক রোগ হলে মানসিক রোগের কারণ যে শারীরিক রোগ, তার চিকিৎসা খুবই জরুরি।

 

২. মনের কারণে মানসিক রোগ

ক) নিউরোসিস (Neurosis), স্নায়ুরোগ

খ) সাইকোসিস (Psychosis), উন্মাদ

নিউরোসিস (Neurosis)

প্রধানত পরীক্ষার সময় হঠাৎ করে স্মৃতি হারিয়ে ফেলা। সব পড়া ভুলে যাওয়া (Hysterical neurosis-dissociative type)।

কেস-হিস্ট্রিঃ ১

১৯৯৪ সালের ঘটনা। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু অনুপ সাতসকালে ফোন করলেন ল্যান্ড লাইনে। তখন মোবাইলের জনপ্রিয়তা ছিল না। সমস্যাটা একমাত্র সন্তান মেয়ে অনন্যাকে নিয়ে। ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। আজ থেকে পরীক্ষা শুরু। কাল রাতে ও একটা অঘটন ঘটিয়েছে। হাতের শিরা কেটেছে ব্লেড দিয়ে। ডাক্তার এসেছেন। ব্লাড বন্ধ হয়েছে। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছেন। এখন ও ঘুমোচ্ছে।

-কেন শিরা কাটলো?

–ও মাধ্যমিকে স্টার পেয়েছে। গত বছর উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার কথা ছিল। পরীক্ষা চলাকালীন আমার মা মারা যান। মা এ বাড়িতেই থাকতেন। অনন্যাকে খুব ভালোবাসতেন। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ও পরীক্ষায় ড্রপ দেয়। এবার পরীক্ষা যতই এগিয়েছে, ততই টেনশনে ভুগেছে। কাল সকাল থেকে ওর মনে হল—যা পড়েছে তা সবই ভুলে গেছে। তারপর রাতে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। আমার মিসেসও তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাইছেন। দেবো?

– দাও।

—আমি অনন্যার মা বলছি। মেয়েকে একবার এসে দেখুন। ওকে হিপনোটিক সাজেশন দিয়ে যদি রিল্যাক্স মুডে নিয়ে আসেন তো আপনার উপকার কোনো দিন ভুলবো না । – বললাম, ফোনটা ওর হাতে ধরিয়ে দিতে পারবেন?

-হ্যাঁ দিচ্ছি।

অনন্যাকে নিশ্চিত করলাম, তুমি এক মনে আমার কথা শুনতে থাক। তারপর মিনিট দশেক হিপনোটিক সাজেশন দিয়ে আধাঘুম আধাজাগরণের অবস্থায় এসেছে অনুমান করে রিল্যাকসেশনের সাজেশন দিতে শুরু করলাম। তার মিনিট পাঁচেক পরে টানা টানা সুরে বলতে লাগলাম, তুমি আজ আর পড়বে না। আজ পরীক্ষা দিতে বসবে। কোশ্চেন পেপার হাতে পাওয়ার পর পড়তে শুরু করবে। কোশ্চেন পড়া শেষ হলেই দেখবে আন্সারগুলো সুন্দর মনে পড়ে যাচ্ছে। লিখতে শুরু করবে। খুব ভালো পরীক্ষা হবে।

তারপর পরীক্ষার দিনও সকালে সাজেশন দিলাম ।

রেজাল্ট বের হতে দেখা গেল অনন্যা স্টার পেয়েছে।

১৯৯৪-এর ১ বৈশাখ বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ছিল ত্রিপুরা হিতসাধনী হলে। ব্যবস্থাপক যুক্তিবাদী সমিতি ও হিউম্যানিস্টস্ অ্যাসোসিয়েশন। অনুষ্ঠান ছিল গান, আবৃত্তি, শ্রুতিনাটক ইত্যাদির। অনুষ্ঠানে হাজির হলেন অনুপ, অনন্যা ও অনন্যার মা। পত্রিকায় অনুষ্ঠানসূচি দেখে চলে এসেছেন। অনন্যার মা মাইকে কিছু বলতে চাইলেন। বললেন। প্রবীরবাবুই আমাদের ঈশ্বর। তারপর বললেন সেই পরীক্ষার ঘটনাটা।

 

কেস-হিস্ট্রিঃ ২

স্মৃতি হারাবার আরো একটি ঘটনা

সময়টা ২০০৯ সাল। একটি মেয়ের ফোন পেলাম একদিন। নাম বলল অনিমা। কাজোড়ায় থাকে। বি.এ. অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষার্থী। পরীক্ষা দিন কয়েক পরে। অনিমা সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী দিন কয়েক হল আগুনে পুড়ে মারা গেছে।

“এই ঘটনার পর থেকে পড়তে বসলেই বান্ধবী আগুনে পুড়ছে দেখতে পাই। এখন গত দু-দিন হল বুঝতে পারছি, পড়া বিষয়ও মনে করতে পারছি না। সব ভুলে গেছি। আমাকে বাঁচান।”

—তুমি আমার মোবাইল নম্বর কার কাছ থেকে পেলে?

-রানাদার এক বন্ধু দিয়েছে। আমি কি আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি? –তোমাকে আসতে হবে না। তুমি কি কোনো একটা বেডরুমে কিছুক্ষণের জন্য একা থাকতে পারবে?

হ্যাঁ, পারবো।

—মিনিট পাঁচেকের মধ্যে খুব হালকা পোশাক পরে ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে একটা পরিষ্কার বিছানায় আরাম করে শুয়ে পড়। শুয়ে আমার মোবাইলে একটা কল দেবে। মোবাইলেই তোমাকে হিপনোটিক সাজেশন দেব। তাতেই একদম ঠিক হয়ে যাবে।

অনন্যার মতোই ওকে সাজেশন দিলাম। অনিমা এখন ২০১১-তে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম-এ ফাইনাল দেবে।

 

কেস-হিস্ট্রিঃ ৩

Hysterical neurosis dissociative type-এর আর একটি উদাহরণ রানা হাজরা । কাজোড়ারই ছেলে।

রানার সমস্যা ও উত্তরণের ঘটনা রানার লেখা থেকেই তুলে দিচ্ছি (প্রসঙ্গ : প্রবীর ঘোষ, প্রকাশক দে’জ পাবলিশিং)।

“২০০৩, জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ। ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা ছ’দিন দেরি। বাড়ি থেকে ফোনে খবর এল, মা মারা গেছেন। মা আমার সবচেয়ে প্রিয়। এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলাম না। যাদবপুর থেকে কাজোড়ায় ফিরলাম। বাড়ি গিয়ে মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিলাম। আত্মীয়-পড়শিদের সহানুভূতির বান ডেকেছিল আমাকে ঘিরে। তাই তো কেমন যেন ভ্যাবলা হয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তারের দেওয়া দুটো ঘুমের ওষুধ খেয়েও আমি নাকি ঘুমোইনি, তবে মনে মনে ভেবেছিলাম যে পরীক্ষা দেব-ই। বাড়ির সবার পরামর্শ ছিল পরীক্ষা না দেওয়ার। ফলে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম। মাথাও কাজ করছিল না ঠিকমতো। পুরোনো পড়া মনে করতে গেলে পারছি না। সব ভুলে গেছি। কোনো এক সময়ে প্রবীরদার ফোন এল ।

কয়েকটি কথা, ‘শুনেছি। কলকাতা আয়, পরীক্ষা দিতে হবে। ভালো থাক।’

প্রবীরদার একটা ফোন মনের জোর কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। দু’দিন পর সুবীরের সাথে কলকাতার মেসে ফিরলাম। আমি সাল, তারিখ, ফোন নম্বর অনেককিছু স্মৃতিতে রাখতে পারি। কিন্তু মানসিকভাবে বিধ্বস্ত আমি সেই সময়কার কথা মনে রাখতে পারিনি, পরে আমার কথা জেনেছি বন্ধুদের থেকে। মেসে ফিরে ঘুমোইনি। শুধু চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। বই খুললেও, পড়িনি। এই অবস্থায় মেসের ছেলেরা সিদ্ধান্ত নেয়, প্রণবকে (দত্ত) দিয়ে প্রবীরদাকে ফোন করার। প্রণবের সাথে প্রবীরদার কাছে যাই। প্রণবের কথা অনুযায়ী দিনটা ছিল রবিবার। পরদিন পরীক্ষা ছিল।

কোনো সমস্যার কথা না বলে প্রবীরদা আমার সঙ্গে স্রেফ আড্ডা দিলেন, একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট নিলাম। একসময় প্রবীরদা বললেন, ‘আয় তোকে একটু রিলাকসেশন দিই।’ আমাকে বিছানায় শুইয়ে হিপনোটিক সাজেশন দিলেন। সাজেশন ছিল রিলাকসেশনের। আধঘণ্টা পরে প্রবীরদা যখন আমার হিপনোটিক ঘুম ভাঙালেন, তখন মনে হয়েছিল এই কয়েক দিনের জট পাকানো মাথাটা হালকা লাগছে, রিল্যাক্সড্ লাগছে। তারপর আমরা দু’জনে আড্ডা দিতে দিতে ক্রিকেট খেলা দেখলাম টিভিতে। দুপুরে আমি, বউদি ও প্রবীরদা একসঙ্গে খেলাম। তারপর হঠাৎই বললেন, ‘চল আমরা একটা অ্যাকশন করে আসি।’

মহাজাতি সদনে জ্যোতিষ সম্মেলন হচ্ছিল। সমিতির অনেক সদস্য-সদস্যাদের দেখলাম আসন দখল করে জ্যোতিষীদের বকবক শুনছে। প্রবীরদা আমাকে বললেন, ‘তুই আজ আমার বডিগার্ড। নে তোর কাজ শুরু হল। আয় আমার সঙ্গে। ‘

প্রবীরদা ঝট্ করে মঞ্চে উঠে জ্যোতিষীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনারা এতজন বড় বড় জ্যোতিষী হাজির রয়েছেন, আর আমি এতোদিন ধরে উত্তর খুঁজছি—জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান কিনা? চারজন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম বলছি। আপনারা গণনা করে জানাবেন, তাঁদের মৃত্যু কবে হবে।’

‘তারা নিউজ’ চ্যানেল ছবি তুলছে। প্রবীরদা বললেন, ‘আজ না বলতে পারলে আর একদিন না হয় উত্তর দেবেন। কবে উত্তর দেবেন টিভি ক্যামেরার সামনে জানিয়ে দিন।”

জ্যোতিষীরা সদলবলে ঝাঁপালো প্রবীরদার উপর। রোগা-পটকা আমার গায়ে তখন অদ্ভুত শক্তি এসে গেছে। একটু পরে দেখি আরো অনেকেই প্রবীরদাকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন। পুলিশও ইতোমধ্যে হাজির। জ্যোতিষ সম্মেলন ভণ্ডুল। প্রবীরদার সঙ্গে দৌড়লাম জোড়াসাঁকো থানায়, জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে, সঙ্গে তারা টিভির গাড়ি।

রাতে ফিরে প্রবীরদার ফ্ল্যাটে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা। সোমবার সকালে প্রবীরদা বললেন, ‘যা, মেসে যা। আজ তো পরীক্ষা। একটু বইয়ে চোখ বুলিয়ে নিস। নো টেনশন। পরীক্ষা দিয়ে আমাকে একটা ফোন করিস।’

মেসে ফিরলাম। দু-ঘণ্টার মতো বই খুলে চোখ বুলালাম। কলেজে গেলাম। পরীক্ষা ভালো হল। পরপর পরীক্ষা দিতে থাকি। রেজাল্ট ছিল আশি শতাংশের কাছাকাছি। না, কোনো অসদুপায় গ্রহণ করিনি। আমার ক্যারিয়ারকে পাল্টে দিয়েছিলেন প্রবীরদা।”

 

কেস-হিস্ট্রিঃ ৪

১৯৮৭-র ১ জুলাই, প্রচণ্ড গরমে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে সন্ধে সাতটা নাগাদ বাড়ি ফিরে দেখি লোডশেডিংয়ের মধ্যে বৈঠকখানায় চার তরুণ আমারই অপেক্ষায় বসে। দুজন এসেছেন একটি সাইন্স ক্লাব থেকে, ওঁদের একটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে। তৃতীয় তরুণ রবীন্দ্রনাথ পাইন জানালেন, তিনি এসেছেন একটা ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে। চতুর্থজন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী। দুই তরুণের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথা সেরে বিদায় দেওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের দিকে মন দিলাম। রবীন্দ্রনাথের ডাক-নাম রবি। বয়েস জানাল একুশ। অনুমান করলাম লম্বায় পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির মধ্যে, ওজন পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন কেজি। পরনে সাদা টেরিকটনের ট্রাউজার ও কালো গেঞ্জি। ট্রাউজারের ফ্যাসানে আধুনিকতার ছোঁয়া ; ঊরুর পাশে কালো সুতোয় মোটা করে লেখা Ashihara Kal – Kan (Karate)। হাফ-হাতা গেঞ্জির জন্য বাহুর যতটা দেখা যাচ্ছে তাতে হাউন্ডের মতো পেশির আভাস। রবির চোখের দৃষ্টি ও ফাঁক হয়ে থাকা এক জোড়া ঠোট স্পষ্টতই ওর মানসিক ভারসাম্যের অভাবের ইঙ্গিত বহন করছিল।

রবি কথা শুরু করল এইভাবে, “আপনি আমাকে বাঁচান, নইলে মরে যাব। আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই ৷ ”

বললাম, “আমার দ্বারা তোমাকে যদি বাঁচান সম্ভব হয়, নিশ্চয়ই বাঁচাব। তোমার সব কথাই শুনব, তার আগে বলতো, আমার ঠিকানা কোথা থেকে পেলে? কেউ তোমাকে পাঠিয়েছেন?”

“জুন সংখ্যা ‘অপরাধ’ পত্রিকায় আপনার একটা ইন্টারভিউ পড়ি গতকাল। লেখাটা পড়ে আমার মনে হয়, কেউ যদি আমাকে এই অবস্থা থেকে বাঁচাতে পারেন, তবে সে আপনি। আমি অপরাধ পত্রিকার অফিস থেকেই আপনার ঠিকানা সংগ্রহ করেছি।”

ইতোমধ্যে আমাদের জন্য লেবু-চা এসে গেল। দুটো কাপ রবি ও রবির বন্ধুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, “বাঃ, তুমি তো খুব তৎপর ছেলে।”

রবি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “না, না, তা নয়, আপনি যদি আমার বর্তমান মানসিক অবস্থাটা বুঝতেন, মানে আমি যদি আমার মানসিক অবস্থা আপনার সামনে খুলে দেখাতে পারতাম, তা হলে বুঝতেন একান্ত বাঁচার তাগিদেই আমি আপনার ঠিকানার জন্য কালই লেখাটা পড়ে পত্রিকার অফিসে দৌড়েছি।”

“যাই হোক তুমি যখন আমার কাছে এসেছ তোমার সব কথাই শুনবো এবং সাধ্যমতো সমস্ত রকমের সাহায্য করব। ততক্ষণ বরং আমরা চা খেতে খেতে তোমাদের বাড়ির কথা শুনি।”

একটু একটু করে ওর সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানলাম। মা, বাবা, সাড়ে চার বছরের ভাই পুকাই ও রবিকে নিয়ে ছোট সংসার। বাবা ঘনশ্যাম পাইন আপনভোলো মানুষ, গুণী যন্ত্রসংগীত শিল্পী। বহু ধরনের বাদ্য-যন্ত্র বাজিয়েছেন বাংলা ও বোম্বাইয়ের বহু জনপ্রিয় লঘু- সংগীত শিল্পীর সঙ্গে। অনেক সিনেমা এবং নাটকেও যন্ত্রসংগীত শিল্পী হিসেবে অংশ নিয়েছেন। স্থায়ী আবাস তৈরি করে উঠতে পারেননি। থাকেন কলকাতার বেলেঘাটা অঞ্চলে ‘আলোছায়া’ সিনেমা হলের কাছে ভাড়া বাড়িতে।

রবি ‘আসিহারা কাইকান ক্যারাটে অরগানাইজেশন’-এর ফুলবাগান ব্রাঞ্জের নিষ্ঠাবান প্রশিক্ষক। পার্ক সার্কাসে অরগানাইজেশনের প্রধান কার্যালয়। প্রধান পরিচালক ভারতীয় ক্যারাটের জীবন্ত প্রবাদ পুরুষ দাদি বালসারা। ফুলবাগান ব্রাঞ্চটা এল পার্কে। এখানে রবি ক্যারাটে শেখায় সপ্তাহে তিন দিন, রবি, বুধ ও শুক্র, সকাল ৬টা থেকে ৮-৩০। নিজে সিনিয়ার ব্রাউন বেন্ট। এবারই ব্ল্যাকে বেন্ট পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। বর্তমান অসুস্থতার জন্য পরীক্ষা দিতে পারেনি।

কলকাতা এবং কলকাতার বাইরে এমনকি বাংলার বাইরেও বহু ক্যারাটে প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছে রবি। কখনো দাদি বালসারার সঙ্গে, কখনো ব্যক্তিগতভাবে। শেষ প্রদর্শনী ‘৮৬-র সরস্বতী পুজোর দিন বেলেঘাটা কর্মী সংঘের মাঠে। সেদিন কনুইয়ের আঘাতে রবি আটটা বরফের স্ল্যাব ভেঙে দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল, ভালবাসা আদায় করেছিল। দুটো বিশাল বরফের চাঁই কেটে তৈরি হয়েছিল ওই আটটা স্ল্যাব।

রবি এবার আসল ঘটনায় ফিরল। বলতে শুরু করল, মাস দুয়েক আগের ঘটনা, সে দিনটা ছিল এপ্রিলের ২৫, শনিবার। খবর পেলাম রবি নামে একটা ছেলে ট্রেনের তলায় মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। খবরটা পেয়ে যখন দেখতে হাজির হলাম তখন দেরি হয়ে গেছে, পুলিশ লাশ নিয়ে চলে গেছে।

“পরদিন রবিবার, সকলে ক্লাবে ক্যারাটে ট্রেনিং দিয়ে বাড়ি এলাম ন’টা নাগাদ। আমাদের বাড়িতে এক উঠোন ঘিরে কয়েক ঘর ভাড়াটে। ক্যারাটের ব্যাগ নিয়ে ঢুকলাম পাশের কার্তিক কাকুর ঘরে। এটা-সেটা নিয়ে গল্প করতে করতে এক বাটি মুড়ি এসে গেল। হঠাৎ গতকালের রেলে কাটা পড়ার কথা উঠল। কাকুকে বললাম, গতকাল যে ছেলেটা কাটা পড়েছে সে নাকি আত্মহত্যা করেছে, নাম ছিল রবি। ওই রবির বদলে আমি রবি গেলেই ভালো হত।

“ওই রবির বদলে আমি রবি মরলে ভালো হত, এই কথাটা ঘুরে ফিরে বার কয়েক প্রকাশ করতে হঠাৎই কাকু আমার চোখের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, খুব মরার শখ হয়েছে, নারে?

“কাকুর ওই কথাটা কেমন একটা অদ্ভুত শিহরণ জাগিয়ে কেটে কেটে আমার মাথায় ঢুকে গেল। মাথার সমস্ত চিন্তাগুলো তালগোল পাকিয়ে গেল। কাকুর চোখের দিকে তাকিয়ে গা শিরশির করে উঠল। মুহূর্তে আমার সমস্ত শক্তি কে যেন শুষে নিল। থরথর করে কাঁপছিলাম। দু-পায়ের উপর নিজের শরীরকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। একসময় দেখলাম হাতের বাটি থেকে মুড়িগুলো ঝরঝর করে পড়ে যাচ্ছে। গা গুলিয়ে উঠল। ঘরের চৌকাঠ পেরুলেই এক চিলতে বারান্দা। কোনো মতে বারান্দায় গিয়ে হাজির হতেই হড় হড় করে বমি করে ফেললাম। আমার চোখের সামনে ছয়-সাত বছর আগে দেখা একটা দৃশ্য ছায়াছবির মতো ভেসে উঠল ।

“আশি বা একাশি সালের বর্ষাকালের সকাল। আনন্দ পালিত রোডের ব্রিজটার ওপর দিয়ে আসছিলাম বাজার করে। অনেক তলায় রেল লাইনের মিছিল, যথেষ্ট ন্যস্ত লাইন। দু- পাঁচ মিনিট পরপরই ট্রেন চলাচল করে, একটু দূরে লাইনের ধারে একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। লোকটা আত্মহত্যা করবে না তো?

“মিনিট খানেক অপেক্ষা করতেই একটা ট্রেন আসতে দেখলাম। লোকটা চঞ্চল হল। ট্রেনটা কাছাকাছি হতেই লোকটা লাইনের উপর গলা দিয়ে দু’হাত দিয়ে লাইন আঁকড়ে রইল ।

“তীব্র সিটি বাজিয়ে ব্রেক কষল ট্রেনটা। দু-পাশের চাকা থেকে আগুনের ফুলকি ছিটোতে ছিটোতে ট্রেনটা লোকটার উপর দিয়ে চলে গেল। গলাহীন শরীরটা পাথরের টুকরোর ঢাল বেয়ে নেমে এল। গার্ড নেমে দেহটা দেখে খাতায় কী নোট করে সিটি বাজিয়ে দিল। বিভিন্ন কম্পার্টমেন্টের দরজা জানলা দিয়ে উকি মারা অনেক উৎকণ্ঠিত মাথা নিয়ে ট্রেনটা চলে গেল। এবার আমি কাটা মুণ্ডুটাকে দেখতে পেলাম। দু-পাশের রেললাইনের মাঝামাঝি পড়ে রয়েছে।

“আনন্দ পালিত রোডের আত্মহত্যার এই দৃশ্যটা সেইদিনে সেই রাতে বহুবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সারাটা রাত প্রচণ্ড আতঙ্কে জেগে কাটালাম ।

“সকালে সকলের যখন ঘুম ভাঙল তখন আমি এক অন্য মানুষ। ক্যারাটে ইনস্ট্রাক্টর রবিন পাইন তখন ভয়ে জবুথুবু একটা নব্বই বছরের বুড়ো।

আমার অবস্থা দেখে বাড়িওয়ালা কৃষ্ণগোপাল দেবনাথ আমাকে নিয়ে গেলেন কাঁকুড়গাছিতে তাঁর পরিচিত এক তান্ত্রিকের কাছে। প্রণামী হিসেবে দিতে হল এক কেজি চিনি, একটা মোমবাতি, একপ্যাকেট ধূপকাঠি ও একশো টাকা। তান্ত্রিকের নাম ধীরেন্দ্রনাথ গোস্বামী। ঠিকানা ৬৮ মানিকতলা মেন রোড।

“তান্ত্রিকবাবা ধূপ মোমবাতি জ্বালিয়ে মড়ার খুলি নিয়ে কী সব মন্ত্র পড়লেন, ওটা নাকি ‘খুলি চালান’ বলে। তারপর জানালেন-আনন্দ পালিত রোডের ওই ট্রেনে কাটা পড়া লোকটার আত্মাই আমার এই বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি করেছে। অতৃপ্ত আত্মা তিনজনকে রেল লাইনে টেনে নিয়ে আত্মহত্যা করাবে। তৃতীয় যে ব্যক্তিকে মারবে সে হল আমি।

“এই কথাগুলো শোনার পর আমার জিব শুকিয়ে গেল। কিছু বলতে পারছিলাম না। মাথায় যেন কেমন একটা অদ্ভুত শূন্যতা। শিরশিরে ভয়টা আরো বেশি করে মাথাচাড়া দিল। এরই মধ্যে শুনতে পেলাম ট্রেনের আওয়াজ। দেখতে পেলাম আনন্দ পালিত রোডের লোকটাকে। লোকটা লাইনে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। বাঁ হাতটায় ধরে রাখল লাইন। ডান হাতটা তুলে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। আমি প্রচণ্ড আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম—না, যাব না ।

“তান্ত্রিকবাবার ছেলে আমার চোখে-মুখে জলের ছিটে দিচ্ছিল। শুনতে পেলাম তান্ত্রিকবাবার গলা—‘আত্মাটা ওকে ডাকছে। ব্যাটা একে ছাড়বে না।’

“কৃষ্ণগোপালবাবু বললেন, ‘একটা ব্যবস্থা করে দিতেই হবে বাবা। কী করতে হবে বলুন।’

“একটা যজ্ঞ করতে হবে। তবে, ভূত ব্যাটা বড় সহজ পাত্র নয়।”

“বাড়ি এলাম আরো খারাপ অবস্থা নিয়ে। এসেই বিছানা নিলাম। ওই ২৬ এপ্রিলই ছিল শেষ ক্লাবে যাওয়া। শেখাবার মতো শারীরিক ও মানসিক জোর সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছি। মাঝে মধ্যে বন্ধুরা জোর করে বাইরে নিয়ে যায়, চুপ-চাপ বসে থাকি। গলায় হাতে কয়েকটা তাবিজ কবজ চেপেছে। কাজ হয়নি কিছুই। প্রচণ্ড ভয়ের শিরশিরানি নিয়ে প্রতিদিনই আনন্দ পালিত রোডের আত্মহত্যার ঘটনাটা ছায়াছবির মতোই আমার চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। ট্রেনের প্রচণ্ড ব্রেক কষার আওয়াজ, আগুনের ফুলকি আর রেললাইনে গলা দেওয়া লোকটার হাতছানি আমাকে ভয়ে পাগল করে তুলেছে।

“একদিনের কথা, আমার এক ছাত্রের বাড়িতে গেছি। আমাদের দু-চারটে বাড়ির পরেই থাকে। বাড়িতে একনাগাড়ে শুয়ে-বসে অস্থির হয়ে পড়ছিলাম বলেই যাওয়া। এটা- ওটা নিয়ে কথা বলছিলাম। ছাত্রের ছোট ভাই খাতাতে একটা কী আঁকছিল। ঝুঁকলাম দেখতে। একটা ট্রেনের ছবি। মুহূর্তে আমার কানে ভেসে এল ট্রেনের প্রচণ্ড আওয়াজ। চোখের সামনে দেখতে পেলাম একটা ট্রেন প্রচণ্ড শব্দে ব্রেক কষল। চাকা আর লাইনের তীব্র ঘষটানির আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলাম দু-পাশে আগুনের ফুলকি। ভয়ে শরীরের প্রতিটি লোম খাড়া হয়ে উঠল। মাথাটা কেমন চিন্তাশূন্য হয়ে গেল, চিৎকার করে উঠলাম। পরে শুনেছি, আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম।

“আমি বুঝতে পারছিলাম, একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছি। এমনিভাবে বেশিদিন বাঁচা যাবে না। আত্মার ভয়ের হাত থেকে বাঁচতে মৃত্যুই সবচেয়ে সুন্দর পথ বলে একসময় ভাবতে শুরু করলাম। এই সময় এক প্রতিবেশীর উপদেশে কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মানসিক চিকিৎসার জন্য হাজির হলাম। দিনটা ছিল ৪ জুন।

“ডাক্তারবাবু সব শুনে বোঝালেন—আত্মা-টাত্মা কিছু নেই, এটা মনের ভয়। ওষুধ লিখে দিলেন। মানসিক রোগের চিকিৎসা শুরু হল। ওষুধ খেয়ে ঘুমোই খুব কিন্তু জাগলেই সেই প্রচণ্ড ভয়ের মুহূর্তগুলো হাজির হতে থাকে। প্রচণ্ড পিপাসায় গলা কাঠ হয়ে যায়। মনে হয় জিবটা কে যেন পেছন দিকে টানছে। আত্মহত্যার দৃশ্যটা আমাকে মুক্তি দেয়নি একটি দিনের জন্যেও। দিন দিন শক্তি কমেছে, কমেছে স্মরণশক্তিও। আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করলাম চিকিৎসা-বিজ্ঞান আমাকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। প্রতিটি দিনের অসহ্য যন্ত্রণার থেকে নিজেকে মুক্ত করার পথ নিজেই বেছে নিলাম। তিরিশে জুন সকালে সিদ্ধান্ত নিলাম আত্মহত্যা করব। সেদিন দুপুরে আমার এক বন্ধু হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আমার হাতে তুলে দিল জুন সংখ্যা ‘অপরাধ’ পত্রিকায় প্রকাশিত আপনার একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। বলল, পড়ে দেখ ভূত-প্রেত, আত্মা কিছুই নেই, বলে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন প্রবীর ঘোষ। লেখাটা পড়লে আমাদের পুরোনো ধ্যান-ধারণাগুলো বড় বেশি মিথ্যে মনে হয় ।

“লেখাটা পড়ে ফেললাম। বারবার পড়লাম। কেমন যেন একটা আশার আলো দেখতে পেলাম। মনে হল, আপনি আমাকে ঠিক করতে পারবেন। আপনার ঠিকানা চাই। বন্ধুকে নিয়ে কাল বিকেলেই গেলাম ‘অপরাধ’ পত্রিকার অফিসে। ঠিকানাটা পেয়ে আজ আপনার কাছে এসেছি। আজকাল আমি পথে বেরুতে ভয় পাই। একটা মোটরের হর্ন বা সাইকেলের ঘণ্টা শুনলেই আতঙ্কে লাফিয়ে উঠি।”

“হাসপাতালের প্রেসক্রিপশন সঙ্গে এনেছো?” জিজ্ঞেস করলাম।

“প্রেসক্রিপশনটা আপনার কাজে লাগাতে পারে ভেবে নিয়ে এসেছি। এই যে—” দেখলাম। ৪/৬/৮৭ লেখা আছে—

Tryptanol 25 mg.

1 tab at noon

2 tabs at evening

for 3 days.

পরবর্তী এক তারিখে লেখা—

Tryptanol 25 mg.

1 tab at noon

3 tabs at evening পরবর্তী এক তারিখে লেখা আছে—

Tab tryptanol 25 mg. 1 tab 3 times daily Tab Eskazine 1 mg.

1 tab 3 times daily

রবির সঙ্গে গল্প-গল্প করতে করতে খোলা-মেলা একটা সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুললাম। কথাবার্তার মধ্য দিয়েই ওদের পারিবারিক জীবনের অনেক খুঁটিনাটি কথা জানতে পারলাম।

রবির কথামতো—জ্ঞান হয়ে অবধি বাবার কাছ থেকে শুনে আসছে, তার দ্বারা কিছু হবে না। বাবা ছেলেকে যতটা না মানুষ হওয়ায় সুযোগ দিয়েছিলেন, যতটা না পড়াশুনার সুযোগ দিয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি ভর্ৎসনাই করেছেন। যত্ন করে বাজনার তালিম না দিয়েই বারবার ঘোষণা করেছেন, বাজনা বাজানো তোর কর্ম নয়, আমার ঘাড়ে বসে না থেকে এখন থেকে চরে খাওয়া চেষ্টা কর। রবি তার শিল্পী-বাবাকে ভালোবাসে কিন্তু তার শাসক বাবাকে একটুও শ্রদ্ধা করতে পারে না। রবি চরে খাওয়ারই চেষ্টা করেছে। বেছে নিয়েছে বেপরোয়া জীবন। খেলা হিসেবে নিয়েছে ক্যারাটেকে। জীবনচর্চাতেও প্ৰতি পদে পদে পেশিশক্তিকে কাজে লাগাতে চেয়েছে। একসময় পড়াশুনোয় আকর্ষণ হারিয়েছে। রবির ষোল-সতের বছর বয়সে পৃথিবীর আলো দেখেছে রবির ভাই। রবিকে বাবার কাছে শুনতে হয়েছে, দুনিয়ার ছেলেরা টুকে পাস করছে, তুই এমনই অপদার্থ যে টোকার ক্ষমতাটুকুও নেই। স্কুলের গণ্ডি পেরুতে না পারলে কোনো কাজই জুটবে না। তখন হয় ভিক্ষে করে খেতে হবে না হয় চুরি ডাকাতি করে।

রবির জীবনে একমাত্র প্রেরণা ছিলেন দাদি বালসারা। খুব উৎসাহ দিলেন। বালসারা ইতোমধ্যে হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রীকে হারালেন। স্ত্রী ছিলেন দাদি বালসারার জীবনের অনেকটা জুড়ে। বালসারার ক্যারাটের প্রতি উৎসাহ ছাত্রদের প্রতি উৎসাহ হঠাৎ কেমন যেন নিভে গেল। রবির জীবনের প্রেরণার আলোটুকুও নিভে গেল। নেমে এলো অন্ধকার। বাবার অনিয়মিত আয়, আর্থিক অনটন, দীর্ঘদিনের বাকি পড়া ভাড়ার জন্য বাড়িওয়ালার বাড়ি ছাড়ার নোটিশ। সকালে ঘুম থেকে উঠে গঞ্জনা, দুপুরে বাড়ি ফিরে ভাইয়ের দেশাশুনো করা, স্নান করান, খাওয়ান। নিজে আধপেটা খাওয়া অথবা একেবারেই না খেয়ে থাকা, বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বাউণ্ডুলের মতো উদ্দেশ্যহীন ঘোরা, রাতে ফিরে আবার সেই অনটনের সংসারে গাল-মন্দ শোনা এটাই প্রতিদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রবির নিজের চোখে নিজেকে ছোট করে ফেলেছিল।

রবির সঙ্গে অনেক কথা হল, অনেক গল্প। ভূত প্রসঙ্গে ‘অপরাধ’-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটির কথাও এলো। বুঝতে অসুবিধে হল না, সাক্ষাৎকারটি রবিকে জোর নাড়া দিয়েছে। ভূতের বাস্তব অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহ চেপে বসেছে ওর মনে। ভূত ভর, আত্মা নিয়ে নানা প্রসঙ্গ টেনে আলোচনায় মেতে উঠলাম, ভূতে ভরের কিছু কিছু নেপথ্য কাহিনী শোনালাম। ওসব নিয়ে ওর মনে জেগে থাকা প্রশ্নগুলো একে একে বেড়িয়ে এলো। ওর যুক্তির কাছে যাতে গ্রহণযোগ্য মনে হয় সে কথা মাথায় রেখেই উত্তর দিলাম। একসময় জিজ্ঞেস করলাম, “২৬ এপ্রিলের পর কোনোদিন ট্রেনে উঠেছ?” রবি উত্তর দিল, “না। ট্রেনকে এখন আমি এড়িয়ে চলি। মনে হয় ট্রেনে চড়লে আমি বোধহয় চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ব।” রবিকে বললাম, “তুমি কি এই ঘটনার পর কখনো রেল লাইনের ধারে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছ?”

“না। অসম্ভব! ও আমি কিছুতেই পারব না। ওই সময় লাইনে ট্রেন এসে পড়লে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারবো না। ট্রেনের তলায় কাঁপিয়ে পড়বই।” বলল, রবি।

বললাম, “তোমার সঙ্গে যদি আমি থাকি এবং তোমার দু-হাত দূর দিয়ে একটা ট্রেন ঝড়ের গতিতে চলে যাওয়া সত্ত্বেও ভয় না পাও বা ট্রেনের তলায় ঝাঁপিয়ে না পড়, তা হলে তোমার ভয় কাটবে তো?”

রবির চোখে উচ্ছলতা লক্ষ্য করলাম, “আপনি পারবেন আমার সামনে দিয়ে চলন্ত ট্রেন পাস করিয়ে দিতে? যদি পারেন তবে নিশ্চয়ই আমি নিজের উপর বিশ্বাস ফিরে পাব, ভয় কেটে যাবে।”

“ঠিক আছে, আগামী রবিবার সকাল ৯টার মধ্যে এখানে চলে এস। তুমি আর আমি যাব এমন কোনো একটা স্পটে, যেখানে দিয়ে তীব্র গতিতে ট্রেন চলাচল করে। দু-তিনটে ট্রেন তোমার সামনে দিয়ে চলে যাওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব। আমরা অপেক্ষা করব ট্রেনের হাত দুয়েক দূরে। প্রতিবারই ট্রেন চলে যাওয়ার পর দেখতে পাবে তুমি যেখানে ছিলে সেখানেই আছ, ঝাঁপিয়ে পড়নি।”

“আঙ্কল, আপনি যদি সত্যিই এমনি করতে পারেন তবে আশা করি আমার ভয়টা কেটে যাবে। আর ভালো হয় যদি আপনি আমাকে আনন্দ পালিত রোডের আত্মহত্যার স্পটে দাঁড় করিয়ে ট্রেন পাস করিয়ে দিতে পারেন। এমনটা পারলে আমি নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাব, আত্মবিশ্বাস ফিরে পাব।”

বললাম, “বেশ তাই হবে, তবে ওই কথাই রইল, তুমি আগামী রবিবার সকাল ৯টার মধ্যে এখানে চলে এস।”

কলকাতার বাইরে না থাকলে রবিবার সকাল থেকেই বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত, অপরিচিতদের ভিড় হয় আমার ফ্ল্যাটে। সেই রবিবারেও সকাল থেকে বন্ধুদের আসা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ঘড়ির কাঁটা যখন সাড়ে ৯টায় তখনো রবি এলো না। ঠিক করলাম আমিই ওর বাড়ি যাব। ঠিকানা জানি, অতএব সমস্যা নেই ।

“আমাকে এখনই একবার বের করতে হবে।” এ কথা বলে আসরের ছন্দপতন ঘাটালাম। দু-একজন কারণ জানতে চাওয়ায় সংক্ষেপে রবির ঘটনা জানালাম। বেশ কয়েকজন আমার সঙ্গী হতে চাইলেন, এঁদের মধ্যে একজন হলেন ক্যারাটের ব্ল্যাক বেল্ট লোলিত সাউ।

লোলিত বলল, “দাদা, আমি আপনার সঙ্গে যাই। রবি যাতে ঝাঁপিয়ে না পড়ে সে আমি দেখব। এমনভাবে ধরে রাখব যে ও লাফাবার সুযোগই পাবে না।”

বললাম, “লোলিত, তোমার ধারণাই নেই এই ধরনের মানসিক রোগীরা কী অসম্ভব ধরনের শক্তি বিশেষ মুহূর্তে প্রয়োগ করতে পারে। এই ধরনের একজন মানসিক রোগগ্রস্ত দুর্বল শরীরের মহিলাও বিশেষ মানসিক অবস্থায় যেমন ভূতে পেয়েছে ভাবলে, এতই সবল হয়ে ওঠে যে পাঁচজন সবল পুরুষও তাকে শক্তি প্রয়োগে সামাল দিতে পারে না।”

“সবচেয়ে বড় কথা হল, এমনি করে ওকে ধরে-বেঁধে ট্রেনের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখলে ওর মনের ভয় দূর হবে না।

“তা ছাড়া যেভাবে ওর মানসিক চিকিৎসা করতে চাই, তাতে বহুর উপস্থিতি মোটেই কাম্য নয়। এতে ও আপনাদের দিকে, আপনাদের কথার দিকেও আকর্ষিত হবে। ফলে আমার কথাগুলোকে ওর চিন্তায় গভীরভাবে ঢোকাতে ব্যর্থ হব। আর এই ব্যর্থতা মানেই, ট্রেন আসবে, রবি আতঙ্কিত হবে, আত্মার আহ্বান শুনতে পাবে, ঝাঁপাবে এবং মরবে। পরিণতিটা আমার এবং সমিতির পক্ষেও ভালো হবে না। ”

শেষ পর্যন্ত সঙ্গী হিসেবে বেছে নিলাম মধুসূদন রায় ও চিত্র-সাংবাদিক কুমার রায়কে । রবি বাড়িতেই ছিল। বাবা সকালেই বেরিয়েছেন রিহারসাল দিতে। মা যোগমায়া দেবীকে পরিচয় দিতে ঘরে নিয়ে বসালেন। রবি চৌকিতে জবুথবু হয়ে বসেছিল। যোগমায়া জানালেন, “কাল সারা দিনরাত রবি শুধু কেঁদেছে। ওর মতো একটা জোয়ান ছেলে বাচ্চাদের মতো কাঁদছে এ এক অস্বস্তিকর অবস্থা। আজ ওর যা শরীর ও মনের অবস্থা তাতে ওর পক্ষে একা আপনার বাড়ি যাওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। ওর বাবার আজ রিহারসালে যাওয়া একান্তই প্রয়োজন ছিল। যাওয়ার সময় বলে গেছেন, ফিরে এসে রবিকে নিয়ে আপনাদের বাড়ি যাবেন। সাড়ে আটটার সময় আমি রবিকে বললাম, চল আমি তোকে প্রবীরবাবুর বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। রবি কিছুতেই রাজি হল না। কাল থেকে রবি বারবার বলছে, “আমি আর বাঁচব না, মরবই। এই কষ্ট সহ্য করার চেয়ে আত্মহত্যা করা অনেক ভালো।”

ইতোমধ্যে কয়েকজন প্রতিবেশী এলেন আমার আসার খবর পেয়ে। আমি আর সময় নষ্ট করতে রাজি ছিলাম না। রবির সঙ্গে দু-একটা কথা বলে বললাম, “চল, আনন্দ পালিত রোড থেকে ঘুরে আসি।”

রবিকে নিয়ে আমি, কুমার আর মধুদা (মধুসূদন রায়) এলাম আনন্দ পালিত রোডে। চার দিন আগে রবির মানসিক অবস্থা যেমন দেখেছিলাম, আজকের অবস্থা তার চেয়ে অনেক খারাপ বলে মনে হল ।

একসময় সেই ব্রিজের উপর উঠলাম, যে ব্রিজ থেকে রবি আত্মহত্যা করতে দেখেছিল। ব্রিজের একটু দূরে বাঁদিকের একটা জায়গা দেখিয়ে রবি বলল, “ওইখানে লোকটা দাঁড়িয়েছিল। ট্রেনটা আসতেই লোকটাকে চঞ্চল হতে দেখেছিলাম। তারপর…।”

তারপরের কথাগুলো না শুনে ব্রিজের দু-পাশে আনাজপাতি, শাকসবজি নিয়ে বসা লোকগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে বললাম, “এখানে আনাজপাতির দাম কেমন?” রবি বলল, “অ্যাঁ, কী?”

আমি একটা দোকানির সামনে দাঁড়িয়ে পেঁপে আর থোড়ের দাম করতে শুরু করলাম, কিনলাম পাকা কলা ৷

একসময় আমরা কলা খেতে খেতে হাঁটতে শুরু করলাম। কথা বলছিলাম সেই সঙ্গে, “এখানে জিনিসপত্তর তো খুব সস্তা। তোমরা আগে এখানে কোথায় থাকতে?” ইত্যাদি ইত্যাদি ৷

দূরে দৃশ্যমান একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, “ওই বাড়িটার দুটো বাড়ি পরেই।”

ব্রিজ পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে রেল-লাইনের ওপর এসে পড়লাম। আমি ওকে শোনাচ্ছিলাম, আমার একটা কাহিনির ওপর ফিল্ম তোলার ইচ্ছের কথা। কাহিনিটার একটু একটু অংশ ওকে শোনাচ্ছিলাম।

লাইনের পাশ দিয়ে আমরা হাঁটছিলাম। আমি বলে চলেছিলাম আমার কাহিনির কথা সেখানেও ফিল্মে রেললাইন ও ট্রেনকে কীভাবে ব্যবহার করবো, ট্রেনের চলার গতির সঙ্গে কী ধরনের আবহ সঙ্গীত প্রয়োগ করবো বলে ভেবে রেখেছি, তাও শোনাতে লাগলাম ।

রবি সিনেমা, শুটিং, আবহ সঙ্গীত এসবের মধ্যেই বড় হয়ে উঠেছে। এসবের সঙ্গে ওর একটা গোপন ও গভীর সখ্যতা আছে। রবি শুনছিল, মতামত জানাচ্ছিল। আমি কথার মাঝেই হালকাভাবেই ছ-সাত বছর আগের আত্মহত্যার স্পটটা জানতে চাইলাম।

স্পটে এসে আমি ও রবি দাঁড়ালাম। মধুদা ও কুমার দাঁড়ালেন কিছুটা দূরে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি রেল লাইনের হাত দেড়েক দূরে। এখান থেকে পাথরের টুকরোগুলো ঢিবির আকারে রেল লাইন পর্যন্ত উঠে গেছে।

ব্যস্ত লাইন। মিনিট তিনেকের মধ্যে আমাদের লাইনে গাড়ি আসতে দেখলাম। আমার কাহিনি ঘিরে সিনেমা তোলার গল্প কিন্তু চালুই ছিল। রবিকে ট্রেনটা দেখিয়ে বোঝাতে লাগলাম, ঠিক কীভাবে ক্যামেরা প্ল্যান করার কথা ভেবেছি। নিজের একটা চোখ বন্ধ করে খোলা চোখের সামনে আমার একটা হাতকে দূরবিনের মতো করে দেখতে লাগলাম। রবিকেও দৃশ্যটি বোঝার স্বার্থে আমার মতো করে ট্রেনের দিকে দৃষ্টি দিতে বললাম। বলে চললাম, “এবার লাইনের ওপর দিয়ে চাকাগুলো গড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা লক্ষ্য কর। এমন দৃশ্যই তুলব।”

ট্রেন ইতোমধ্যে অনেকটাই এগিয়ে এসেছিল। রবিকে বললাম, “লক্ষ্য কর, ট্রেনের চাকা যতই আমাদের কাছে এগিয়ে আসছে ততই দেখতে পাচ্ছি ছন্দোবদ্ধভাবে লাইনগুলো মাটিতে বসে যাচ্ছে এবং উঠে আসছে। এই যে এখন চাকাগুলো আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। দেখ, প্রতিটি চাকা আমাদের কাছে যখনই আসছে তখনই লাইনটা মাটিতে চেপে বসছে। চাকাটা চলে যেতেই কেমন সুন্দর ট্রেনের ও লাইনের আওয়াজ হচ্ছে। এর সঙ্গে একটু মজার এফেক্ট মিউজিক কম্পোজ করলে দৃশ্যটা দারুণ উতরোবে।” ট্রেনের শব্দের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটা সুর কণ্ঠ থেকে বের করছিলাম। ট্রেনটা যতক্ষণ না আমাদের অতিক্রম করে গেল ততক্ষণই আমি গলা থেকে আবহ সঙ্গীত বের করে গেলাম। ট্রেনটা আমাদের অতিক্রম করে যেতে রবিকে বললাম, “রবি, ট্রেন কিন্তু আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেছে।”

আমার কথায় রবির ঘোর কাটলো। অদ্ভুত উচ্ছ্বলতার সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “আঙ্কল, আমার কিছু হয়নি। ট্রেনে ঝাঁপাইনি। আমি ভালো হয়ে গেছি।”

ডান হাতটা বাড়িয়ে আমার সঙ্গে দৃঢ় করমর্দন করল। মধুদা ও কুমার এগিয়ে এলেন। ঘটনার পরিণতিতে ওঁরাও খুশি। মধুদা রবিকে বললেন, “কী হল, ভয় কেটেছে?”

আমার কাছের একটা গাছের তলায় বাঁধান বেদীর ওপর বসলাম। কিছুক্ষণ চারজন হালকা মেজাজে গল্প করলাম। একসময় রবি বলল, “আঙ্কল, আর একটা ট্রেন পাশ করিয়ে দেবেন?”

বুঝলাম, রবি তার আত্মবিশ্বাসকে আরো একটু বাড়িতে নিতে চায়। উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, “বেশ তো চলো।”

আমরা দুজনে আবার লাইনের সামনে দাঁড়ালাম। এবারো হাঁটতে হাঁটতে সেই ফিলোর কাহিনিতে রবিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। লাইন দিয়ে চাকা গড়িয়ে যাওয়া, সেই সঙ্গে লাইনের ওঠা-নামা এবং ঘটাং ঘট্ ঘট্ একটানা শব্দ, এরই সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম আমার গলার সুরকে। এবারো ট্রেন চলে গেল রবির কোনো বিপদ না ঘটিয়ে।

ট্রেন চলে যেতে রবি উল্লাসে লাফিয়ে উঠল, “ওঃ, এবারো আমার কিছু হয়নি। অর্থাৎ আমার আর কিছু হবে না।”

তারপর সে এক অন্য রবি। শিথিল ঠোঁট, ঝুলে পড়া চোয়াল ও ফ্যালফ্যালে দৃষ্টির রবি পাল্টে গেছে। হৈ-চৈ তুলে আমাদের একটা চায়ের দোকানে নিয়ে গেল। ওই চা খাওয়ালো । ট্যাক্সি ডাকতেই হাত নেড়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বিদায় করে বলল, “বাসেই ফিরবো।’

রবিদের স্ট্যান্ডে বাস দাঁড়াতে রবি নেমে গিয়ে কৃতজ্ঞতা জানাতে শুরু করলো প্রবল শব্দে। বাস চলতে শুরু করতেই চলন্ত বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে পড়ে চেঁচালো, “আঙ্কল, মাঝে মধ্যে আপনার বাড়িতে গিয়ে একটু জ্বালিয়ে আসবো।”

বললাম, “বেশ তো, যখন ইচ্ছে চলে এসো।”

চলন্ত বাস থেকে টুক করে নেমে পড়ে রবি জানিয়ে দিয়ে গেল ও সম্পূর্ণ সুস্থ ।

একে কী বলবো? সম্মোহন, একটু অন্যভাবে।

২১ জুলাই মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রবি আবার এলো। বসার ঘরে তখন মেলা ভিড়। পাক্কা তিন ঘণ্টা সকলকে না ধরনের ক্যারাটে আর আইকিদো দেখিয়ে জমিয়ে রেখে বিদায় নিল। যাওয়ার আগে দুটো কথা জানিয়ে গেল, এক, আগামী ব্ল্যাক বেল্টের পরীক্ষায় রবি নামছে, প্র্যাকটিসও শুরু করেছে। দুই, ৬ জুলাই তারিখেই কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হসপিটালে মনোরোগ বিভাগে গিয়েছিল। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কেমন আছ?”

“কেমন দেখছেন?”

“ভালোই তো দেখছি।”

“সত্যিই ভালো আছি, একদম ভালো।”

“দিনে দিনে তো তোমার অবস্থা অবনতিই হচ্ছিল, হঠাৎ এমন আশ্চর্যজনক পরিবর্তন?”

আমার সঙ্গে যোগাযোগ এবং আমার মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতির পুরোটাই ডাক্তারবাবুকে জানিয়েছে রবি।

প্রেসক্রিপসনে ডাক্তারবাবু লিখেছেন, “stop medicine”.

ইতোমধ্যে রবির কাজের একটা সুরাহা হয়েছে। রবি মাঝে মধ্যে আমার কাছে আসে। আমার সঙ্গে, আমার স্ত্রী সীমা ও আমার ছেলে পিনাকীর সঙ্গে গল্প করে। লক্ষ্য করেছি, রবি আত্মবিশ্বাসী হয়েছে। বিশ্বাস করে ও আর অপদার্থ নয়। সমাজে ওরও কিছু দেওয়ার আছে। ও কারো বোঝা নয়, বরং সংসারকে সাহায্য করবে।

রবির মুখ থেকে যেদিন ওর ব্ল্যাক বেন্ট পাওয়ার খবরটা পেলাম সেদিন সম্ভবত রবির চেয়ে কম আনন্দ আমি পাইনি ।

মনোরোগ তৈরির ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব আমরা অস্বীকার করতে পারি না। ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, হিংসাত্মক ঘটনাবলি, বেকারত্বের ও দারিদ্র্যের বিভীষিকা, জীবন নির্বাহে প্রতিনিয়ত ব্যয় বৃদ্ধি, ধর্ম-বর্ণ বা রাজনৈতিক অত্যাচার, ভয়, শোষণ, প্রতিবাদহীনভাবে অন্যায়কে মেনে নিতে বাধ্য হওয়া অনিশ্চয়তা, ভয় এসব থেকেও আসে মনের রোগ। আমরা মনোরোগীর আশপাশের সুস্থ মানুষরা রোগীদের প্রতি মানবিক হয়ে তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার মতো পরিবেশ সৃষ্টিতে কিছুটা সাহায্য করতে পারি। 

কি না—নিশ্চয়ই দেখতে পারি। আমরা মানবিক হবার শিক্ষা দিতে পারি ঘরে, শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে, খেলার মাঠে, জীবনের চলাফেরার প্রতিটি ক্ষেত্রে, ‘মূল্যবোধ’ ‘শিক্ষার সার্থকতা’ মানবিকতার বিকাশে প্রাচীন সংস্কৃতির গালভরা দৃষ্টান্ত টেনে নয়।

চিকিৎসার কথা এলেই চিকিৎসকের কথাও এসে যায়, এসে যায় তাঁদের অনেকেরই পেশাগত অসাধুতার কথা। এঁরা অনেকেই মানসিক রোগীদের সঙ্গে বক্‌বক্ করে অর্থ প্রসবকারী সময় নষ্ট করতে অনিচ্ছুক। অথচ মানসিক রোগীদের কথা বিস্তৃতভাবে না শুনে বিধান দেওয়া অসম্ভব। বিধান ঠিক কি ভুল, বিধানে রোগীর ক্ষতি হবে কি অক্ষতি, সে প্রশ্ন অর্থলোলুপ চিকিৎসকদের কাছে একান্তই গৌণ ।

এ বিষয়ে আমার-আপনার সচেতনতা, প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধই পারে অর্থলোভী চিকিৎসকদের কাজে মনোযোগী হতে বাধ্য করতে।

পর্ব- একঃ উঠে আসা নানা প্রশ্ন

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহন

অধ্যায়ঃ দুই

♦ জন্তুদের সম্মোহন করা ব্যাপারটা কি?

অধ্যায়ঃ তিন

♦ ফোটো-সম্মোহন কি সম্ভব?

অধ্যায়ঃ চার

♦ গণ-সম্মোহনের সাহায্যে কি ট্রেন ভ্যানিশ করা যায়?

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ সম্মোহন করে পূর্বজন্মে নিয়ে যাওয়া যায়?

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ জন্মান্তর ও সম্মোহন

অধ্যায়ঃ সাত

♦ সম্মোহন ও নার্কো টেস্ট

অধ্যায়ঃ আট

♦ সম্মোহন করে কথা বলানো যায় ?

অধ্যায়ঃ নয়

♦ প্ল্যানচেটে যে আত্মা আনা হয়, তা কি স্বসম্মোহন বা সম্মোহনের প্রতিক্রিয়া ?

পর্ব- দুইঃ সম্মোহনের ইতিহাস ও নানা মানসিক রোগ

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহনের বিজ্ঞান হয়ে ওঠার ইতিহাস

অধ্যায়ঃ দুই

♦ মনোরোগ, সম্মোহন জানতে মগজের কাজ জানা জরুরি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ মানসিক রোগের রকমফের

অধ্যায়ঃ চার

♦ Hysterical neurosis – Conversion type

অধ্যায়ঃ চার

♦ সাইকোসিস (Psychosis) উন্মাদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ দেহ-মনজনিত অসুখ (Psycho-somatic disorder)

পর্ব- তিনঃ মনোবিদ ও মনোরোগ চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ এক

♦ মনোবিদ (Psychologist) ) মনোরোগ চিকিৎসক (Phychiatrist)

অধ্যায়ঃ দুই

♦ প্রধান কয়েকটি সাইকোথেরাপি নিয়ে আলোচনায় যাব

অধ্যায়ঃ তিন

♦ টেনশন

অধ্যায়ঃ চার

♦ রিল্যাকসেশান পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ যৌনতা এবং যৌন-সমস্যা

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব

পর্ব- চারঃ বিভিন্ন রোগের সম্মোহনের সাজেশন পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহন চিকিৎসা এবং…

অধ্যায়ঃ দুই

♦ রোগীকে সাজেশন দেওয়ার পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ রকমারি রোগ, রকমারি সাজেশন

অধ্যায়ঃ চার

♦ প্রাচীন আমল থেকেই মানসিক রোগ মানেই অশুভ শক্তির কালো হাত

“সম্মোহনের A to Z” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!