সংস্কৃতি দেশে দেশে ভিন্নতর। আবার একই দেশের ধর্মভিত্তিক, ভাষভিত্তিক, অর্থভিত্তিক, শ্রেণীভিত্তিক, অঞ্চলভিত্তিক আলাদা আলাদা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশের কথা ভাবুন, দেখতে পাবেন বিভিন্ন অঞ্চলের বা প্রদেশের সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে বিভিন্নতা, বৈচিত্রের অভাব নেই। দার্জিলিং জেলার সংস্কৃতির সঙ্গে মালদা জেলার সংস্কৃতির রয়েছে বহু বিভিন্নতা, যদিও দুটিই উত্তরবঙ্গেরই জেলা। মেদিনীপুর ও পুরুলিয়ার সংস্কৃতিতেও রয়েছে অনেক অসাদৃশ্য, যদিও দুটি জেলার অবস্থান পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে। আমাদের দেশের হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খৃষ্টান, বৌদ্ধ ও জৈন সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বৈচিত্র যেমন আছে, তেমনই আছে তামিল, গুজরাতি, ওড়িয়া, বাংলা, বিহারী ইত্যাদি ভাষাভাষীদের, সংস্কৃতির মধ্যে অসাদৃশ্য। ব্রাহ্মণ সংস্কৃতির সঙ্গে শূদ্রের সংস্কৃতির যেমন অসাদৃশ্য আছে, তেমনই অসাদৃশ্য আছে ধনী, মধ্যবিত্ত ও গরিবদের গড়ে ওঠা সংস্কৃতির মধ্যেও।

আবার এই পশ্চিম বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ ভারত এমনকি অন্য রাষ্ট্র বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উপকরণে ও গড়নে বহু সাদৃশ্য রয়েছে। তাই এ-কথাও মনে হয় ভারত সংস্কৃতি ও বাংলাদেশ সংস্কৃতির প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বঙ্গ সংস্কৃতির রূপরেখা তৈরি করা অসম্ভব। বিভিন্ন দেশের মধ্যেও আবার খুঁজলেই সংস্কৃতিগত মিল আমরা অনেক পাব। পাওয়াই স্বাভাবিক, কারণ, আমরা ‘মানব সংস্কৃতির’ই অংশ।

আমাদের বিভিন্ন মানবগোষ্ঠির মধ্যে রয়েছে নিজস্ব স্বতন্ত্র ভাষা, সঙ্গীত, শিল্প-সাহিত্য, নৃত্য, নীতিবোধ, সমাজ ও পরিবার চালাবার রীতিনীতি, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি। সুতরাং একজন মানুষ কোন দেশের কোন গোষ্ঠির, কোন ধর্মের, কোন ভাষার, কোন শ্রেণীর প্রতিনিধি, তার উপরই নির্ভর করবে মানুষটি কোন ভাষায় কথা বলবে, কি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করবে, কোন শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-নৃত্য- ইত্যাদির দ্বারা প্রভাবিত হবে, অংশ নেবে; কোন জাতীয় পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করবে; কোন রীতিনীতির দ্বারা পরিচালিত হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

শিশুকাল থেকে আমরণ আমাদের প্রভাবিত করে আমাদের সমাজ, আমাদের সংস্কৃতি, ফলে আমরা সাধারণভাবেই সেই সমাজ ও সংস্কৃতির অংশীদার হয়ে পড়ি। শিশুকালে ও কৈশোরে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস, শিক্ষা চেতনার স্ফুরন শুরু হয় মা-বাবা, আত্মীয়, গৃহশিক্ষক, স্কুলের শিক্ষক, পাড়া-প্রতিবেশীদের মাধ্যমে। প্রভাব পড়তে থাকে স্কুলের বন্ধু, খেলার সঙ্গী ও সমবয়সী বন্ধুদের আচরণ, ব্যবহার, কথাবার্তা ভালোলাগা, খারাপ লাগার। গড়ে উঠতে থাকে রাজনৈতিক মতবাদ বা রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন করার মানসিকতা। কেউ জেনে বুঝে, কেউ না জেনে তার স্কুলের শিক্ষকের প্রভাবে, পরিবারের গুরুজনদের প্রভাবে অথবা কলেজের নিকটতম বন্ধুদের অথবা কোনও রাজনৈতিক সচেতন কারো প্রভাবে অথবা কলেজের নিকটতম বন্ধুদের অথবা কোনও রাজনৈতিক সচেতন কারো প্রভাবে কোনও রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করতে শুরু করে, অথবা কেউ ব্যক্তিস্বার্থে জড়িয়ে পড়ে কলেজ-রাজনীতিতে। এমন দেখাই যায় বাবা-মা’য়ের রাজনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক-মতাদর্শকে অগ্রহণীয়, ভ্রান্ত মনে করে সন্তান বিপরীত কোনও মতাদর্শকে গ্রহণ করেছে।

আমাদের এবং অন্যান্য বহু সমাজেই শিশু, কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীদের কি পড়াশোনায়, কি জীবনে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সন্তানের মা-বাবারাও ভীষণ ভাবেই চাইতে শুরু করেছে, এই তীব্র প্রতিযোগিতার যুগে আমার সন্তানকে টিকে থাকতে হলে, ভাল হতে হবে, দারুণ কিছু ফল করতে হবে। সন্তান স্কুলে প্রথম দু-চারজনের মধ্যে না থাকলে মা-বাবারা শঙ্কিত হন। সন্তানের ওপর প্রচণ্ড চাপ দিতে থাকেন তাঁরা। এর ফল অনেক সময়ই প্রীতিপ্রদ হয় না। অনেক মনোরোগ চিকিৎসকইএর জন্য সাধারণত অভিভাবকদের সরাসরি অভিযুক্ত করেন, অথবা পত্র-পত্রিকা ও বেতার মারফৎ মা-বাবাদের দোষারোপ করেন। কিন্তু তাঁরা সাধাণত কেউই বলেন না এই সামাজিক পরিবেশের জন্য আমাদের সমাজের চূড়ান্ত অনিশ্চয়তাই দায়ী। অর্থাৎ এ সবই আর্থ-সামাজিক অবস্থারই ফল।

মানুষ যে ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে বেড়ে ওঠে, যে গোষ্ঠির সঙ্গে একাত্ম, সেই গোষ্ঠীর চোখ দিয়েই দেখে, কান দিয়ে শোনে। এ কথা যেমন সত্য, তেমনই সত্যি, অন্য গোষ্ঠির অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাদের সঙ্গেও একাত্মতা অনুভব করে, তাদের আচার-ব্যবহার, ভালো লাগার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। যে পূর্ববঙ্গীয় বালক উদ্বাস্তু হয়ে এপার বাংলায় এসে ‘জবরদখল’ কলোনির বাসিন্দা, তার ক্লাসের প্রিয় বন্ধুটিই হয়তো কলকাতার কোনও বনেদি পরিবারের ছেলে। বইয়ের অভাব মেটাতে, একসঙ্গে পড়াশুনা করতে, কলের গান শুনতে, রেডিও শুনতে ‘বাঙ্গাল’ ছেলেটি অনেকটা সময়ই কাটায় বনেদি ‘ঘটি’র বাড়িতে। বনেদি বাড়ির অনেক কিছুই একটু একটু করে ভালো লাগতে থাকে। ভালো লাগে বনেদি সংস্কৃতি, আচার ব্যবহার, মহিলাদের অন্দরমহলের আড়ালকে মনে হয় আভিজাত্যের লক্ষণ। ‘বাঙ্গাল’দের প্রাণখোলা উচ্চস্বরে খুঁজে পায় রুচির অভাকা ইস্টবেঙ্গলের চেয়ে মোহনবাগানের জয় রক্তে বেশি তুফান তোলে।

একই ঘটনা ঘটে প্রবাসীদের ক্ষেত্রেও। তাঁরা প্রবাসভূমির মানুষদের সংস্কৃতির অনেক কিছুই গ্রহণ করেন পরম সমাদরে।

আমাদের সঙ্গীত, সাহিত্য, নাটক চলচ্চিত্র, পত্র-পত্রিকা, দূরদর্শন আমাদের সমাজ সংস্কৃতিকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। নারী-পুরুষদের ‘ফ্রি-মিকসিং’ যখন সাহিত্যে-চলচ্চিত্রে বিপুলভাবে বিরাজ করে তখন সমাজে যৌন উচ্ছৃঙ্খলার সঙ্কট সংযোজিত হয়। ছাপার অক্ষর বা সেলুলয়েডের বুকে অপরাধ যখন অ্যাডভেঞ্চারের রূপ পায় তখন অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় তরুণ-তরুণীরা অপরাধ প্রবণতার মধ্যে উত্তেজনার আগুন পোহাতে চায়। পত্র-পত্রিকা ও প্রচার মাধ্যমগুলো যখন শোভরাজের মত ঘৃণ্য অপরাধীদের ‘সুপার হিরো’ করার তীব্র প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন, তখন বহু কিশোর-কিশোরী ও যুবক যুবতীরাই যে তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে চাইবে- এটাই স্বাভাবিক। দূরদর্শনে রামায়ণ, মহাভারত যেমন অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, তেমনই অসাধারণ দক্ষতায় চতুর সারল্যে মানুষকে আবার ভাববাদী, অদৃষ্টবাদী খাঁচায় পুড়তে চাইছে, ঘড়ির কাঁটাকে প্রগতির বিপরীতে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে। ভক্তির প্লাবন এনে ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টি করে মৌলবাদী শক্তিগুলোকেই উৎসাহিত করছে, শক্তিশালী করছে। প্রচার মাধ্যমগুলো নানা আজগুবি অলৌকিক ঘটনার গালগপ্পো ছেপে এক তরফাভাবে সমাজ ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। লটারি কালচার আজ সর্বক্লাবগ্রাসী হতে চলেছে। পুজোর আড়ম্বর ও পুজো কালচার যতই বাড়ছে ততই দেখতে পাচ্ছি যে স্বঘোষিত বস্তুবাদীরা জনগণকে সঙ্গে পেতে পুজো কালচারের সঙ্গী হয়েছিলেন, তাঁরাই স্বয়ং ঘোর আস্তিক হয়ে উঠেছেন- একটু চোখ কান খোলা রাখলে দৃষ্টান্ত মিলবে হাজার নয়, লাখে লাখে। সংস্কৃতির নানা ‘উৎসব’-এ হাজির হয়েছে নানা ঝাঁ-চকচক আড়ম্বর ও হুল্লোর। চাটার্ড প্লেন, ফাইভ স্টার হোটেল, গ্ল্যামার ও কুইনদের গা থেকে ঠিকরে পড়া আলো, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, কি নেই? -সুস্থ সংস্কৃতি ছাড়া অনেক কিছুই উপস্থিত।

এরই মাঝে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ পাল্টাতে তৎপর একদল। পাল্টে যাচ্ছেও। এরই পাশাপাশি সাধারণের সাংস্কৃতিক চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গ্রামে-শহরে হাজির হয়েছেন আর একদল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সংগ্রামী মানুষ। মানুষ পাল্টে যাচ্ছেও। এরই নাম ইতিহাস।

আমরা সমাজবদ্ধ জীব
সমাজের বিভিন্ন ঘটনার প্রতিফলন
তাই আমাদের জীবনে দেখতে পাই। আমরা
কিভাবে বিকশিত হবো, তার অনেকটাই
তাই আমাদের সমাজ-সাংস্কৃতিক
পরিবেশের ওপরও নির্ভর করে।

অবাক মেয়ে মৌসুমী ও বিস্ময়কর প্রতিভা বা Prodigy নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এতক্ষণ খুবই সংক্ষেপে যেটুকু আলোচনা করলাম তাতে অনেকে হয়তো ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ -এর উদাহরণ খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু আমার কাছে এ সবই অতি প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। কারণ আমি চাই, ভবিষ্যতে আবার কোনও বিস্ময়কর প্রতিভার খবর প্রচারিত হলে পাঠক-পাঠিকারা বিভ্রান্ত বোধ না করেন, নিজেরাই সঠিক অনুসন্ধানে নামতে পারেন, অথবা এমন বিস্ময়কর প্রতিভার পিছনে জাগতিক কারণগুলোর হদিশ অপরকেও দিতে পারেন।

error: Content is protected !!