উন্নততর দেশগুলির মনোবিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মানবজীবনের ওপর দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে বর্তমানে এই সিদ্ধান্তে পৌঁচেছেন— মানুষের বংশগত সূত্রে প্রাপ্ত অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত।

আমবা যে দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াই, হাঁটি, পানীয় পশুর মত জিব দিয়ে গ্রহণ না কবে পান করি, কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করি-এ-সবের কোনটাই জন্মগত নয়। এইসব অতি সাধারণ মানব-ধর্মগুলো আমরা শিখেছি, অনুশীলন দ্বারা অর্জন করেছি। শিখিয়েছে আমাদের আশেপাশের মানুষগুলোই, অর্থাৎ আমাদের সামাজিক পরিবেশ।

মানবশিশু প্রজাতিসুলভ জিনের প্রভাবে মানবধর্ম বিকশিত হবার পরিপূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে অবশ্যই জন্মায়। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দেয় মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-বন্ধু, সহপাঠী, খেলার সঙ্গী, শিক্ষক, অধ্যাপক, প্রতিবেশী, পরিচিত ও আশেপাশের মানুষরা, অর্থাৎ আমাদের সামাজিক পরিবেশ।

আপনার আমার পরিবারের কোনও শিশু সভ্যতার আলো
না দেখা আন্দামানের আদিবাসী জাড়োয়াদের মধ্যে বেড়ে
উঠলে তার আচার-আচরণে, মেধায় জাড়োয়াদেরই গড়
প্রতিফলন দেখতে পাব ৷

আবার একটি জাড়োয়া শিশুকে শিশুকাল থেকে আমাদের সামাজিক পরিবেশে মানুষ করলে দেখতে পাব শিশুটি বড় হয়ে আমাদের সমাজের আর দশটা ছেলে-মেয়ের গড় বিদ্যে- বুদ্ধি ও মেধার পরিচয় দিচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা বর্তমানে সিন্ধান্তে পৌঁচেছেন, বিগত বহু বছরের মধ্যে মানুষের শারীরবৃত্তির কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। এই কম্পিউটার যুগের আধুনিক সমাজের মানব শিশুর সঙ্গে বিশ হাজার বছর আগের ভাষাহীন, কাচামাংসভোজী সমাজের মানব শিশুর মধ্যে জিনগত বিশেষ কোনও পার্থক্য ছিল না। সেই আদিম যুগের শিশুকে এ-যুগের অতি উন্নততর বিজ্ঞানে অগ্রবর্তী কোনও সমাজের পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে পারলে ওই আদিম যুগের শিশুটি আধুনিকতম উন্নত সমাজের গড় মানুষদের মতই বিদ্যে-বুদ্ধির অধিকারী হতো।

একই সঙ্গে বিজ্ঞান এ-কথাও অবশ্যই স্বীকার করে, কোনও অনুকূল পরিবেশে শিশুকাল থেকে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেলে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকান দেশের নিবন্ধ, হতদরিদ্র মূর্খ মানুষগুলোও হতে পারত ইউরোপ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বা জাপানের উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার মধ্যে গড়ে ওঠা মানুষগুলোর সমকক্ষ। অবশ্য ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের জন্য স্বাতন্ত্র্যতা নিশ্চয়ই থাকতো যেমনটি এখনও আছে একই দেশের একই পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষদের মধ্যে।

কিন্তু এই কথার অর্থ এই নয় যে—বংশগতি সূত্রে প্রাপ্ত সমস্ত বৈশিষ্ট্যই পরিবেশ প্রভাবিত। আর তাই মানুষের পরিবর্তে একটি বনমানুষ বা শিম্পাঞ্জিকে শিশুকাল থেকে আমাদের সামাজিক পরিবেশে মানুষ করলেও এবং আমাদের পরিবাবের শিশুর মতই তাকেও লেখাপড়া শেখাবার সর্বাত্মক চেষ্টা চালালেও তাকে আমাদের সমাজের স্বাভাবিক শিশুদের বিদ্যে, বুদ্ধি, মেধার অধিকারী করতে পারব না। কারণ ওই বনমানুষ বা শিম্পাঞ্জির ভেতর বংশগতির ধারায় বংশানুক্রমিক গুণ না থাকায় তা অনুকূল পরিবেশ পেলেও বিকশিত হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার সূত্র থেকে আমরা দু’টি সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারলাম, এক : মানবগুণ-বিকাশে জিনের প্রভাব বিদ্যমান। দুই : মানুষের জিনের অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত।

পরিবেশকে আমরা অবশ্যই দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। এক : প্রাকৃতিক পরিবেশ । দুই : সামাজিক পরিবেশ ।

সামাজিক পরিবেশকে আবার দু-ভাগে ভাগ করা যায। এক : আর্থ-সামাজিক (Socio- economic) এবং দুই : সমাজ-সাংস্কৃতিক (Socio-cultural) ।

প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব

প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব আমাদের বিভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্যতা দিয়েছে। আমরা যে অঞ্চলে বাস করি তার উচ্চতা, তাপাঙ্ক, বৃষ্টিপাত, নদী, সমুদ্র, পাহাড় বা মরুভূমি ইত্যাদির প্রভাব কম-বেশি পড়েই থাকে ।

সমুদ্রকূলের মানুষেরা নৌ-চালনা, মাছ ধরা, মুক্তোর চাষ, সমুদ্র থেকে আহরণ করা নানা জিনিস ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং এইসব সমুদ্র ছেঁকে তুলে আনতে যে শ্রম ও ঝুঁকির মুখোমুখি হয় তাই মানুষগুলোকে সাহসী করে তোলে। পলিতে গড়া জমির কৃষকদের চেয়ে রুখো জমির কৃষকেরা অনেক বেশি পরিশ্রমী। গ্রীষ্মপ্রধান আর্দ্র অঞ্চলের মানুষদের পরিশ্রম করার ক্ষমতা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মানুষদের তুলনায় কম । বেঁচে থাকার সংগ্রাম মরু এবং মেরু অঞ্চলের মানুষদের করেছে কঠোর সংগ্রামী। চরম প্রাকৃতিক পরিবেশের মানুষদের বেঁচে থাকার সংগ্রামেই দিন-রাতের প্রায় পুরোটা সময়ই ব্যথিত হয়। ফলে তাদের পক্ষে বুদ্ধি ও মেধাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিনিয়োগ করার মত সময়টুকু থাকে না ।

আবার যে অঞ্চল পেট্রলের ওপর ভাসছে, সে অঞ্চলের মানুষদের পায়ের তলাতেই গলানো সোনা। আয়াসহীনভাবে কিছু মানুষ এত প্রাচুর্যের অধিকারী যে, ফেলে ছড়িয়েও শেষ করতে পারে না তাদের সুবিশাল আয়ের ভগ্নাংশটুকুও। ওরা শ্রম কেনে বিপুল অর্থের বিনিময়ে। ফলে এই অঞ্চলের মানুষগুলো প্রকৃতির অপার দাক্ষিণ্যে ধনুকুবের বনে গিয়ে ভোগসর্বস্ব হয়ে পড়ে। ফলে মানসিক প্রগতি এই অঞ্চলের মানুষদের অধরাই থেকে যায়।

প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষদের যে কোনও প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকে। আবার খরা, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদির মত প্রাকৃতিক বিপর্যয় দীর্ঘস্থায়ী হলে বিপর্যয়ে বিপন্ন মানুষদের অনেকেই কষ্টকর এই চাপের মুখে মানসিক রোগের শিকার হয়ে পড়েন। অথবা মানসিক কারণেই রক্তচাপ বৃদ্ধি, বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, আন্ত্রিক ক্ষত ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হন ।

আর্থসামাজিক পরিবেশ

আমাদের মত দরিদ্র ও উন্নতশীল দেশে সাধারণ মানুষের জীবনধারণের প্রতিটি পদক্ষেপে যেখানে রয়েছে অনিশ্চয়তা, বঞ্চনা, শোষণ, দুনীর্তি, স্বজনপোষণ ও অত্যাচার, সেখানে মানুষের জীবনে আর্থসামাজিক পরিবেশের প্রভাব যথেষ্ট শক্তিশালী, এটা সমাজবিজ্ঞানী মাত্রেই স্বীকার করেন। এখানে স্রেফ বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষকে নানা অসামাজিক ও অপরাধমূলক কাজে নামতে হয়। মেয়েদের নিজেকে বাঁচাতে, সংসারকে বাঁচাতে ইজ্জত বেচতে হয়। এদেশের বহু মানুষের কাছে বিশুদ্ধ জল পান চরম বিলাসিতা। এ-দেশে এখনও অদ্ভুত বা বর্ণহিন্দুদের কুঁয়ো ছোঁয়ার দুঃসাহস দেখালে ধড় থেকে মাথা যায় কাটা। হরিজন নারীকে জীবনসঙ্গিনী করার অপরাধে বর্ণহিন্দুর চাকরি যায়, বেঁচে থাকার অধিকারটুকু পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়। রাজনীতিকের জাদুকাঠির ছোঁয়া না পেলে ঋণ-মেলায় ঋণ মেলে না, সরকারী চাকরি অধরাই থেকে যায়। চাকরির সুযোগ সীমিত, বেকার অসীম। ফলে কাজ পেতে খুঁটি ধরাই সেরা যোগ্যতা বলে বিবেচিত হয়। তবুও এরপরও চাকরি পাওয়া ছেলেটি ও তাদের পরিবারের সকলেই মনে করে— কাজ পাওয়াটাই বিশাল ভাগ্য, মানতের ফল, অবতারের আশীর্বাদের কেরামতি, গ্রহরত্নের ভেল্কি ।

যে দেশের পঙ্গু অর্থনীতি গ্রামে গ্রামে চিকিৎসার সুযোগ সুবিধে পৌঁছে দিতে পারে না, সে দেশের গ্রামবাসীরা রোগ ও মৃত্যুকে অদৃষ্টের লিখন বলে মেনে নিক–এটাই চাইবে রাষ্ট্রক্ষমতা, সরকার। আর তেমনটাই মেনে নিচ্ছে অসহায় গ্রামের মানুষরা। গরীব ঘরের মানুষদের বিনে মাইনের স্কুলে সন্তান পড়াবার সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলোয় না। ঘরের ছেলে কাজে না গিয়ে স্কুলে গেলে রোজগার করবে কে? শিশু-শ্রমের ওপরও প্রায় সমস্ত দরিদ্র পরিবারকেই কিছুটা নির্ভর করতে হয়। আবার পাশাপাশি এও সত্য—আব্রু রক্ষা করে স্কুলে যাওয়ার মত সাধারণ পোশাকটুকুও অনেকের জোটে না। পড়াশুনো ও বাইরের খবরা- খবর রাখতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পড়ার সুযোগ যেহেতু দরিদ্রদের ক্ষেত্রে খুবই কম, তাই শুধুমাত্র এই আর্থ-সামাজিক কারণেই দরিদ্র গ্রামবাসী ও শহরের বস্তিবাসীদের মধ্যে মেধা, বুদ্ধি, মননশীলতা খুবই কম। গ্রামের কিশোরীদের চেয়ে শহরের গরীব কিশোরীদের অবস্থা অনেক বেশি খারাপ। এখানে একটা ঘর নামক নরকে বহু মানুষকে গাদাগাদি হয়ে ভোরের সূর্যের প্রতিক্ষা করতে হয। ফলে অনেক সময় এরা নারী-পুরুষের গোপন ক্রিয়াকলাপ দেখে কৈশোরেই যৌন আবেগ দ্বারা চালিত হয়। আবার অনেক সময় ইচ্ছে না থাকলেও আর্থিক নিরাপত্তা, জীবন ধারণের নিরাপত্তার জন্য পাড়ার মস্তান, কাজে নিয়োগকারী বা আত্মীয়দের লালসার শিকার হতে হয়। কৈশোরে পা দিয়েই অনেককে বেঁচে থাকার জন্যই যোগ দিতে হয় নানা অবৈধ কাজে। এইসব পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো এমনতর জীবনযাত্রা ইচ্ছে করে

বেছে নেয়নি, সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোই তাদের এমনতর জীবনযাত্রা গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে ।

আর্থসামাজিক পরিবেশ যে সাধারণ মানুষকে কী
বিপুলভাবে প্রভাবিত করে, সে বিষয়ে সাধারণত
মনোবিজ্ঞানীরা মুখ খুলতে চাননি। যখন খুলেছেন, তখন
মানবজীবনে আর্থসামাজিক পরিবেশের প্রভাবকে লঘু করে
দেখাতে প্রয়াসী হয়েছেন ।

রাষ্ট্র ও শোষকশ্রেণী দ্বারা সম্মানীত এইসব মনোবিজ্ঞানীরা তাঁদের শ্রেণীস্বার্থেই চান না, অথবা সরকার ও শোষকশ্রেণীকে তুষ্ট করার স্বার্থেই চান না, বঞ্চিত মানুষগুলো তাদের বঞ্চনার কারণ হিসেবে আর্থসামাজিক পরিবেশ, রাষ্ট্র কাঠামোকেই দায়ী করুক।

সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ

প্রতিটি সমাজ ও তার সংস্কৃতি জন্ম থেকেই শিশুর উপর প্রভাব বিস্তার করে। সমাজ- সংস্কৃতির প্রভাবেই মানবিক আচার-আচরণ, মানবিক হৃদয়বৃত্তি বিকশিত হতে থাকে ৷ শিশুকে হাঁটতে শেখান হয়, শিশু হাঁটতে দেখে, তাই হাঁটে। শিশু কি ভাবে হাতকে ব্যবহার করে খাদ্য গ্রহণ করবে, কি ভাষায় কথা বলবে, সবই নির্ভর করে মা-বাবা ও তার আশেপাশের আপনজনদের উপর। শিশু যদি কোন কারণে মানবসমাজে প্রতিপালিত না হয়ে পশুসমাজে বেড়ে ওঠে, তাহলে দেখা যাবে সে পশুর মতই হামা দিয়ে হাঁটবে। হাতকে ব্যবহার না করে পাত্র থেকে সরাসরি মুখ দিয়ে খাদ্য গ্রহণ করবে। জলপানের জন্য জিবকে কাজে লাগাবে ।

শিশু বয়সে বা কৈশোরে মানুষ তার মা-বাবার ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হয। মা-বাবার ধর্মী বিশ্বাস, আঞ্চলিকতা, গোষ্ঠিপ্রীতি, শ্রেণী-চেতনা, প্রাদেশিকতা, যুক্তিবাদী চেতনা, মূল্যবোধ, নীতিবোধ, সাহিত্য-প্রীতি, সংগীত-প্রীতি, অঙ্কন-প্রীতি, অভিনয় প্রীতি, দফা, নিষ্ঠুরতা, ঘরকুনো মানসিকতা, সমাজসেবায় আগ্রহ, নেশা-প্রীতি, অসামাজিক কাজকর্মের প্রতি আগ্রহ, ভীরুতা, সাহসিকতা, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তা, রাজনৈতিক সচেতনতা, সমাজ সচেতনতা, মিথ্যে বলার প্রবণতা ইত্যাদি সন্তানকে প্রভাবিত করে ।

শিশু বড় হতে থাকে। পাঠাভ্যাস গড়ে উঠলে বিদ্যালযের শিক্ষক, সহপাঠীদের চিন্তা- ভাবনা, আচার-ব্যবহার, ভাললাগা না লাগা প্রভাবিত করতে থাকে। বেড়ে ওঠা শিশুটির ওপর অনবরত প্রভাব ফেলতে থাকে পরিবারের লোকজন, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশি, বন্ধু, পাঠ্য-বই, পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন, সিনেমা, যাত্রা, থিয়েটার, ক্লাব, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ইত্যাদি। কিশোর বয়েসে সে তার ঘনিষ্ঠ মানুষজনের চোখ ও কান দিয়ে দেখে ও শোনে। তার পরিচিত গোষ্ঠির মূল্যবোধের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের সংঘাত হলে সে নিজের গোষ্ঠিস্বার্থে জাতীয় স্বার্থের বিরোধীতা করতে পারে। ধর্মীয় উন্মত্ততা, জাত-পাতের সঙ্কীর্ণতা, অতীন্দ্রতার প্রতি বিশ্বাস, ঈশ্বরজাতীয় কোনও কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস, জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস, মন্ত্র-তন্ত্রের ক্ষমতায় বিশ্বাস, ভূত নামক কোনও কিছুর অদ্ভুত সব কাজকর্মের প্রতি বিশ্বাস, তাবিজ-কবজে বিশ্বাস ইত্যাদি প্রধানত গড়ে ওঠে আশেপাশের সামাজিক পরিবেশ থেকে, পারিপার্শ্বিক মানুষগুলোর বিশ্বাসের পরিমণ্ডল থেকে।

শিশুকাল থেকে আমরণ আমাদের প্রভাবিত করে আমাদের সমাজ, আমাদের সংস্কৃতি ; ফলে আমরা সাধারণভাবেই সেই সমাজ ও সংস্কৃতির অংশীদার হয়ে পড়ি ।

আমাদের খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস, শিক্ষা-চেতনার স্ফুরণ,
রাজনৈতিক মতবাদ—কোনও কিছুই শূন্য থেকে আসে না।
এর প্রত্যেকটি গড়ে ওঠে সমাজ-সাংস্কৃতিক প্রভাবের
ফলেই ।

এ-যুগের অনেকেই প্রথাগত উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। এদের অনেকে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা ইত্যাদি করেছেন, ডক্টরেট নামক ডিগ্রি পেয়ে বিজ্ঞানী হয়েছেন, চিকিৎসক পেশায় সফল হয়ে চিকিৎসা-বিজ্ঞানী নামে প্রচারিত হচ্ছেন, সফল বিভিন্ন শাখার ইঞ্জিনিয়াররা, প্রযুক্তিবিদরাও বিজ্ঞানী বলে পরিচিত হচ্ছেন। এরা অনেকেই বিজ্ঞানের কোনও বিভাগকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও মনে-প্রাণে বিজ্ঞানী হতে পারেননি, পারেননি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীকে গ্রহণ করতে—পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের পরই কোনও মনতে গ্রহণ বা বর্জন করতে। এঁরা আমাদের সমাজের আপনার আমারই বাড়ির ছেলে। শিশুকালে হাতেখড়ি হয়েছে সরস্বতীকে আরাধণা করে। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, পরিচিতদের দেখেছে ঈশ্বরজাতীয় কারো কাছে পরম ভক্তিতে আভূমি নত হতে। পড়ার বইয়ে বার বার ঘুরেফিরে এসেছে নানা পুরাণের গল্পের মধ্যে কাল্পনিক অলৌকিক কাহিনী। দেখেছে জ্যোতিষ-কোষ্ঠি-হাতের রেখার প্রতি পরিচিত মানুষদের পরম বিশ্বাস। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে ঈশ্বর, আল্লা ও পরম পিতার প্রতি প্রার্থনা । এমনি আরো বহুতর অন্ধ-বিশ্বাস ও সংস্কারের মধ্যে বেড়ে ওঠার সূত্রে বিশ্বাস করেছে বহু অলীকে। কিন্তু লেখাপড়ায় ভালো হওয়ার সুবাদে আপনি আমি ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, ছেলের পেশাগত সুবিধার কথা ভেবে তাকে বিজ্ঞান শাখায় পড়তে উৎসাহিত করেছি। সন্তান আমাদের বিজ্ঞান শাখায় পড়াশুনা করেছে। পড়াশুনায় সফল হয়ে বিজ্ঞানকে পেশা হিসেবে গ্রহণও করেছে; যেমনভাবে পেশা হিসেবে কেউ গ্রহণ করে আলু-পটলের ব্যবসাকে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীকে তারা কখনই নিজেদের জীবনে গ্রহণ করেনি। আর্থ-সামাজিক পরিবেশই এমন সব অনেক বড় বড় বিজ্ঞান পেশার কিন্তু বিজ্ঞানে অবিশ্বাসী মানুষ বা অমানুষ তৈরি করেছে। ‘অমানুষ’ কথাটা একটু কড়া হলেও সুচিন্তিতভাবেই লিখতে হলো। যে নিজেকে বিজ্ঞানীর পূজারী বলে জাহির করে এবং একই সঙ্গে পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের পথ পরিত্যাগ করে অন্ধ-বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে, তাকে ‘অমানুষ’ নিশ্চয়ই বলা চলে। কারণ তার গায়ে ‘বিজ্ঞানী’ তকমা আঁটা থাকায় তার ব্যক্তি-বিশ্বাস সাধারণ মানুষের ব্যক্তি-বিশ্বাসের চেযে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক ভূমিকা নেয়, মানুষের প্রগতির পক্ষে, বিকাশের পক্ষে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জনগণ স্বভাবতই যা ভাবে তা হলো এতো বড় বিজ্ঞানী কি আর ভুল কথা বলছেন ?

ঠিক এই সময় ভ্রান্ত চিন্তার পরিমন্ডল থেকে সাধারণ মানুষদের বের করে আনতেই প্রয়োজন নতুন বলিষ্ঠ যুক্তিযুক্ত চিন্তার পরিমন্ডল সৃষ্টি করা। এই সময়ই প্রয়োজন বিভ্রান্তিকর কুযুক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত করতে সুযুক্তির সঙ্গে সাধারণ মানুষদের পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়া মানুষ সাধারণভাবে যুক্তির দিকেই ধাবিত হয। সুযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হলে কুযুক্তি তারা বর্জন করেই। দীর্ঘদিনের প্রচলিত বহু ভ্রান্ত চিন্তা ও ধারণাকেই বর্তমান শোষক ও শাসকশ্রেণী বজায় রাখতে সচেতন ।

যে ভ্রান্ত চিন্তা প্রতিটি বঞ্চনার জন্য অদৃষ্টকে দোষারোপ
করে, সে ভ্রান্ত চিন্তা মানুষের মধ্যে থাকলে লাভ তো
বঞ্চনাকারীদেরই ।

তাই তো বঞ্চনাকারী শোষক ও তাদের তরিবাহক রাষ্ট্রক্ষমতা মুখে যত লক্ষবারই সাধারণ মানুষদের কুসংস্কার মুক্ত করার আহ্বান জানাক না কেন, কাজে বঞ্চিত মানুষদের কুসংস্কারে আবদ্ধ রাখতেই চাইবে। তাদের সমস্ত ক্ষমতা ও প্রচারের সাহায্যে সব সময়ই জনসাধারণের মগজ ধোলাই করে ভ্রান্ত চিন্তার পরিমন্ডল গড়ে তোলার চেষ্টা কর চলেছে, চলবেও।

কুসংস্কার-মুক্তির আন্দোলনের চরম সাফল্য কখনই সরকারী সহযোগিতায় আসবে না। আসবে শোষক-শ্রেণীর অর্থে নির্বাচনে জিতে গদিতে বসা, শোষক শেণীর স্বার্থরক্ষাকারী সরকারের তীব্র প্রতিরোধ ও বিরোধীতাকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়ে। আর এরই জন্য চাই যুক্তিবাদী পরিমন্ডলকে প্রতিনিয়ত বিস্তৃত করা। সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশকে দূষণমুক্ত করা ।

পারিপার্শ্বিক মানুষজনের প্রভাবে আমাদের দেশের শিশু যখন যুবক ও পৌঢ়ত্বে পা রাখে তাদের মধ্যে ধর্মীয় ধারণা ও অন্ধবিশ্বাসগুলো একইভাবে অনড় থাকে, যদিও এঁদের কেউ কেউ ব্যবহারিক জীবনে বা পেশাগতভাবে ‘বিজ্ঞানী’, ‘বুদ্ধিজীবী’, ইত্যাদি বিশেষণে পরিচিত হতে থাকেন। তাই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও বিজ্ঞান-পেশার মানুষদের মধ্যেও দেখা যায় যুক্তির শিথিলতা অথবা যুক্তিহীনতা। এঁদের মধ্যে একই সঙ্গে অবস্থান করে পড়ার বইয়ের কিছু কিছু জ্ঞান ও আশৈশব গড়ে ওঠা অন্ধবিশ্বাস। এঁদের অনেকেরই আঙুলে, গলায়, বাজুতে, শোভা পায় গ্রহরত্ন, ধাতুর বালা বা আংটি, শিকড় বা তাবিজ কবচ। ধারণ করার কারণ জিজ্ঞেস করলে এঁদের অনেকেই লজ্জায় স্বীকার করতে চান না—ভাগ্য ফেরাতে পরেছেন। জেল্লা বজায় রাখতে সকলেই হাত বাড়ায় অজুহাতের ‘ব্রাসো’র দিকে। এঁরা নিজেদের ‘প্রেজেন্ট’ করেন বিদ্যাসাগরের সুবোধ বালক হিসেবে—’যাহা দেখ, তাহাই পরে’। এ-সব হাবি-জাবি জিনিস পরতে এঁদের নাকি অনুরোধ জানিয়েছিলেন মাতা, মাতামহী, পিতা, পিতমহ, আত্মীয়, বন্ধু, প্রেমিক, পত্নী ইত্যাদিরা। আর স্রেফ ওদের দুঃখ দিতে না চাওয়ার জন্যই পরা। এঁরা এতই কোমল হৃদয় প্রাণী যে ভয় হয়, কেউ জুতোর মালা পরাতে চাইলে প্রার্থীব হৃদয় রাখতে টপ করে না জুতোর মালাই গলায় গলিয়ে ফেলেন। কেউ কেউ আবার এই যুক্তিই দেন—“বলল, তাই পরে ফেললাম। দেখিই না, যদি কাজ হয ভাল, না হলেও ক্ষতি তো নেই।” এই স্বচ্ছতাহীন দ্বিধাগ্রস্ত মানুষগুলো এটা বোঝে না যে, এতেও ক্ষতি হয়। প্রথমেই অর্থ ক্ষতি তো অবশ্যই। তারপর যে ক্ষতি তা সমাজের ক্ষতি। মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব তাই এই দ্বিধাগ্রস্ততা, অস্বচ্ছতা যা অদৃষ্টবাদকে সমর্থনেরই নামান্তর, তা প্রভাবিত করবে তাঁরই পরিবারের শিশুটিকে, আশেপাশের মানুষজনকে

error: Content is protected !!