আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ ورمّل القران ترتيلاً (আর তুমি কুরআন মজীদ মন্থরগতিতে তিলাওয়াত কর।)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ وَقُرانًا فَرَفْنَاهُ لتَقَرَأهُ عَلَى الثّاس على مُكْثْ (আর আমি এইরূপে কুরআন নাযিল করিয়াছি যেন তুমি উহা থামিয়া ধীরে-সুস্থে তিলাওয়াত করিয়া লোকদিগকে শুনাইতে পার।)
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ فر قناه অর্থাৎ ‘আমি উহার বিষয়বস্তুসমূহ বিশদরূপে বর্ণনা করিয়াছি।’ তাই কুরআন মজীদ ছন্দোবদ্ধ বাক্যের ন্যায় আবৃত্তি করা দূষণীয় নহে।
আবূ ওয়ায়েল হইতে ধারাবাহিকভাবে ওয়াসিল, মাহদী ইব্ন মায়মূন, আবূ নু’মান ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেন যে, আবূ ওয়ায়েল বলেন- একদা আমরা সকাল বেলায় হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর নিকট গমন করিলাম। জনৈক ব্যক্তি বলিল, গত রাত্রিতে আমি মুফাস্সাল সূরা তিলাওয়াত করিয়াছি। হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) বলিলেন- তোমার তিলাওয়াত আমি শুনিয়াছি। তুমি কুরআন মজীদকে ছন্দোবদ্ধ বাক্যের ন্যায় আবৃত্তি করিবে। পরস্পর পাশাপাশি সন্নিহিত যে সকল সূরা নবী করীম (সাঃ) তিলাওয়াত করিতেন, উহা আমি নিশ্চয় স্মরণে রাখিয়াছি। সেইগুলি হইতেছে আঠারটি মুফাস্সাল সূরা এবং হা মীম’ শ্রেণীর দুইটি সূরা।(১) ইমাম মুসলিম উপরোক্ত হাদীস ‘হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ওয়ায়েল, শাকীক ইব্ন সালামা, ওয়াসিল ইব্ন হাব্বান, আহদাব, মাহদী ইব্ন মায়মূন ও শায়বান ইব্ন ফাররুখের সনদে বর্ণনা করিয়াছেন।
মুসলিম ইবন মিখরাক হইতে ধারাবাহিকভাবে যিয়াদ ইবন নাঈম, হারিছ ইবন ইয়াযীদ, ইব্ন লাহীআ, কুতায়বা ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করিয়াছেন- একদা হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে জানানো হইল যে, কতেক লোক সম্পূর্ণ কুরআন মজীদ এক রাত্রিতে একবার বা দুইবার তিলাওয়াত করে। ইহাতে তিনি বলিলেন— ‘তাহারা পড়িলেও পড়ে নাই (অর্থাৎ তিলাওয়াত করে নাই)। আমি সারারাত নবী করীম (সাঃ)-এর সহিত নামায আদায় করিতাম । তিনি (কখনও কখনও) সূরা বাকারা, সূরা আলে-ইমরান এবং সূরা নিসা তিলাওয়াত করিতেন। সতর্কীকরণমূলক যে কোন আয়াত তিলাওয়াত করিয়া তিনি অবশ্যই আল্লাহ্ তা’আলার নিকট দোয়া করিতেন এবং তাঁহার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করিতেন। পক্ষান্তরে সুসংবাদমূলক যে কোন আয়াত তিলাওয়াত করিয়া তিনি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট দোয়া করিতেন এবং তাঁহার নৈকট্য কামনা করিতেন।
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে সাঈদ ইব্ন জুবায়র, মূসা ইব্ন আবূ আয়েশা, জারীর, কুতায়বা ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ لاتحرك به لسائك لتمجلبه আয়াতের ব্যাখ্যা প্রদান করিতে গিয়া হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলেন- ‘হযরত জিবরাঈল (আঃ) যখন ওহী লইয়া নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট আগমন করিতেন, নবী করীম (সাঃ) তখন স্বীয় জিহবা ও ওষ্ঠদ্বয় নাড়াইয়া উহা তিলাওয়াত করিতেন। ইহাতে তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িতেন।’ অতঃপর হাদীসের অবশিষ্ট অংশ উল্লেখিত হইয়াছে। শীঘ্রই উহা বর্ণিত হইবে। উক্ত হাদীস ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়েই বর্ণনা করিয়াছেন।
উক্ত হাদীস এবং উহার পূর্বে বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরআন মজীদ আস্তে- আস্তে তিলাওয়াত করা শরীআতের দৃষ্টিতে পছন্দনীয়। উহা অত্যন্ত দ্রুত তিলাওয়াত করা শরীআতের নিকট কাম্য ও অভিপ্রেত নহে। বরং শরীআত উহা ধীরগতিতে তিলাওয়াত করিতে এবং উহা সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করিতে ও উহা হইতে উপদেশ গ্রহণ করিতে আদেশ করিয়াছেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
كِتَابُ أَنْزَلْتُهُ إِلَيْكَ مُبَارَكَ لِيَدَّبَّرُوا أَيْتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُوا الْأَلْبَابِ
(উহা হইতেছে এইরূপ বরকতময় কিতাব যাহা আমি এই উদ্দেশ্যে নাযিল করিয়াছি যে, তাহারা উহার আয়াত লইয়া গভীরভাবে চিন্তা করিবে, আর প্রজ্ঞার অধিকারী ব্যক্তিগণ উহা হইতে উপদেশ গ্রহণ করিবে।)
হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমর (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে যর, আসিম, সুফিয়ান, আবদুর রহমান ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- কুরআন তিলাওয়াতকারী ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন বলা হইবে, ‘তুমি তিলাওয়াত করিতে থাক আর উপরে উঠিতে থাক। তুমি দুনিয়াতে যেরূপ ধীরগতিতে তিলাওয়াত করিতে, সেইরূপ ধীরগতিতে তিলাওয়াত করিও। তুমি যেই স্তরে পৌঁছিয়া সর্বশেষ আয়াত তিলাওয়াত করিবে, তাহাই হইবে তোমার বাসস্থান।’
ইবরাহীম হইতে ধারাবাহিকভাবে মুগীরা, জারীর ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেন যে, রাবী ইবরাহীম বলেন- একদা আলকামা হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-কে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিয়া শুনাইলেন। তিনি উহা দ্রুতগতিতে তিলাওয়াত করিয়াছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ্ বলিলেন- ‘আমার মা-বাপ তোমার জন্যে কুরবান হউন! তুমি কুরআন মজীদ মন্থর গতিতে পড়িবে। কারণ, কুরআন মজীদ সৌন্দর্যময়, শ্রুতি মাধুর্যময় ও আকর্ষণীয় করিয়া নাযিল করা হইয়াছে।’ রাবী বলেন- ‘আলকামা ছিলেন আকর্ষণীয় সুমধুর সূরে কুরআন মজীদ তিলাওয়াতকারী।’
আবূ হামযা হইতে ধারাবাহিকভাবে আইউব, ইসমাঈল ইব্ন ইবরাহীম ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেন যে, আবূ হামযা বলেনঃ একদা আমি হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-কে বলিলাম- ‘আমি কুরআন মজীদ দ্রুতগতিতে তিলাওয়াত করিয়া থাকি। আমি তিন দিনে সমগ্ৰ কুরআন মজীদ একবার তিলাওয়াত করিয়া থাকি।’ ইহাতে হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলিলেন— ‘তুমি যেরূপে তিলাওয়াত করিয়া থাক বলিয়া দাবী করিতেছ, সেইরূপে তিলাওয়াত করা অপেক্ষা ধীরগতিতে এক রাত্রিতে মাত্র সূরা বাকারা তিলাওয়াত করা এবং উহার আয়াতসমূহ সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করা আমার নিকট নিশ্চয় অধিকতর প্রিয় ও পছন্দনীয়।
ইমাম আবূ উবায়দ আবার উহা হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ হামযা, হাম্মাদ ইবন সালামা, শু’বা ও হাজ্জাজের সনদে বর্ণনা করিয়াছেন। অবশ্য উক্ত রিওয়ায়েতে ‘তুমি যেরূপে তিলাওয়াত করিয়া থাক বলিয়া দাবী করিতেছ, সেইরূপে তিলাওয়াত করা অপেক্ষা’ এই কথাটির স্থলে ‘কুরআন মজীদ দ্রুত পড়িয়া যাওয়া অপেক্ষা’ এই কথাটি উল্লেখিত হইয়াছে।