কিছু পার্থক্য ও কিছু সম্পর্ক

মনোবিদের কাজ মনোরোগীর সঙ্গে কথা বলে তার বিশ্বাস অর্জন করে ধৈর্যের সঙ্গে মনোরোগের কারণ খুঁজে বের করা।

মনোরোগ বলতে সাধারণ মানুষ বোঝে ‘পাগল’। মনোরোগ মানেই ‘উন্মাদ’ বা ‘পাগল’ নয়। মনোরোগের পরিধি আরো বিস্তৃত। হতাশা, অবসাদ, উৎকণ্ঠা, শারীরিক কোনো কারণ ছাড়া শুধুমাত্র মানসিক কারণে শ্রবণ ইন্দ্রিয় ও দর্শন ইন্দ্রিয় ঠিকমতো কাজ না করা, বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট, পেটের গোলমাল, পরীক্ষার আগে হঠাৎ সব পড়া ভুলে যাওয়া, পরীক্ষার আগে আঙুলের লেখার ক্ষমতা হারান ইত্যাদি বহু রোগের কারণ হতে পারে মানসিক। এইসব রোগের উৎস খুঁজতে মনোবিজ্ঞানী বা মনোবিদ (সাইকোলজিস্ট)-এর সাহায্য নিলে রোগ মুক্তির সম্ভাবনা বেশি

থাকে।

সাধারণভাবে একজন মনোবিদের ডাক্তারি ডিগ্রি থাকে না। তিনি যখন বোঝেন রোগীর সঙ্গে কিছু সিটিং দেওয়ার প্রয়োজনের পাশাপাশি রোগীর ওষুধ খাওয়ারও প্রয়োজন আছে, তখন তিনি ওষুধ প্রেসক্রাইব না করে কোনো মনোরোগ চিকিৎসকের (Phychiatrist) কাছে পাঠিয়ে থাকেন। কারণ ডাক্তারি ডিগ্রি না থাকলে ওষুধ প্রেসক্রাইব করা যায় না৷

যারা ওষুধের সাহায্যে মানসিক রোগের চিকিৎসা করেন তাদের বলা হয় মনোরোগ চিকিৎসক (সাইকিয়াট্রিস্ট)।

অনেক সময় মনোরোগ চিকিৎসক রোগীকে পাঠান মনোবিদের কাছে মনোবিশ্লেষণের জন্য। সাইকোলজিস্ট রোগীর সঙ্গে কথা বলে, গল্প করে, প্রশ্ন করে রোগীর বিষয়ে তাঁর ফাইনডিংস বা বিশ্লেষণ পাঠান সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। সেই রিপোর্টের সাহায্যে সাইকিয়াট্রিস্ট ওষুধ নির্বাচন করেন।

 

মনোচিকিৎসা (Psychotherapy)

মনের রোগের চিকিৎসাকেই বলে মনোচিকিৎসা বা সাইকোথেরাপি। প্রধানত এই চিকিৎসা করেন মনোবিদ (সাইকোলজিস্ট) এবং মনোরোগ চিকিৎসক (সাইকিয়াট্রিস্ট)। ধর্মগুরুরাও অনেক সময় সাইকোলজিস্টের ভূমিকা পালন করে কিছু কিছু মনের রোগীদের সারিয়ে তোলেন।

মনের রোগ সারাতে গেলে যে চিকিৎসক বা থেরাপিস্ট রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল, ধৈর্যশীল, দ্রুত বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম ও দ্রুত বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারেন তিনিই ভালো থেরাপিস্ট।

থেরাপিস্ট প্রয়োজনে রোগীকে তার সমস্যার কারণগুলো ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারেন। এবং রোগী তা বুঝলে ও বিশ্বাস করলে তার মনের রোগ থেকে মুক্ত হতে পারে। কখনো ‘হিপনোটিক সাজেশন থেরাপি’ ( Hypnotic suggestion therapy)-র সাহায্যে সাইকোথেরাপি করতে পারেন। আবার প্রয়োজনে হিপনোটিক সাজেশন দেওয়ার পাশাপাশি ওষুধ প্রয়োগ করতে পারেন।

সাইকিয়াট্রিস্টরা শুধুমাত্র ওষুধ প্রয়োগ করে থাকেন। এই ওষুধের সাহায্যে থেরাপিও সাইকোথেরাপি ।

মনোরোগ চিকিৎসার ওষুধ ফ্রান্সেই প্রথম আসে। সালটা ১৯৫৪। এরপরই সাইকোথেরাপিতে ওষুধের ব্যবহার বাড়তে থাকে। তার আগে সাইকোথেরাপি বলতে ছিল শুধুই হিপনো-থেরাপি। কিন্তু বর্তমানে ‘সভ্য জগৎ’-এর মানুষদের জীবনে কর্মব্যস্ততা অত্যন্ত বেড়েছে। জীবনে জটিলতা বেড়েছে। অনিশ্চয়তা ও টেনশন বেড়েছে। বেড়েছে মনের রোগ এবং সাধারণের মধ্যে মনোরোগ বিষয়ে সচেতনতা।

ইউরোপ, আমেরিকার মতো উন্নত দেশের মানুষ তাদের মানসিক সমস্যা নিয়ে হাজির হন সাইকোলজিস্টের কাছে। থেরাপিস্ট দীর্ঘ সময় ও ধৈর্য দিয়ে সমস্যাকে বিশ্লেষণ করেন। রোগীর কাউনসেলিং করেন বা সাইকোথেরাপি করেন ।

ভারতের মতো মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশের মানুষ নিজের বা পরিবারের মানসিক সমস্যা নিয়ে থেরাপির বা চিকিৎসার প্রয়াজনই মনে করেন না। রোগীর প্রচণ্ড বাড়াবাড়ি হলে গ্রামে-গঞ্জের মানুষ এখনো ওঝা, গুণিন, পীরদের কাছে ছোটে। পায়ে শিকল বেঁধে রাখে। তুক-তাক-ঝাড়ফুঁক করায়।

মধ্যবিত্ত পরিবারে এখনো ‘মানসিক রোগী’ মানে ‘পাগল’ মনে করার মানুষই বেশি। ওরা ভয় পায়—পরিবারের কেউ পাগল শুনলে ওই পরিবারে কেউ বিয়ে দিতে চাইবে না । অতএব মানসিক রোগীকে গোপনে লুকিয়ে রেখে দাও।

এদের মধ্যে কেউ যদি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়, তবে চটজলদি রেজাল্ট পেতে চায়। সাধারণত ওরা রোগীকে নিয়ে যায় সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। সাইকিয়াট্রিস্টরাও দ্রুত রোগী দেখতে ব্যস্ত। দ্রুত রোজগারের জন্যে এই সময়াভাব।

মনের অসুখে ওষুধ খাওয়ার ফল পাওয়া যায় দ্রুত। কিন্তু প্রায়শই এতে ওষুধটির প্রতি মানসিক নির্ভরতা গভীর হয়। এমনকি এইসব ওষুধ কর্মচঞ্চলতা কমিয়ে দেয়, ঘুম-ঘুম অলসতা আসে। ওষুধের অভ্যাস থেকে বেরিয়ে না এসে আরো ওষুধের মাত্রা বাড়াবার প্রবণতা দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ওষুধ খাওয়ার ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

আবার রোগী ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন মতো ওষুধ খান না—এমনটাও হয়। চিকিৎসক বললেন—এই ওষুধটা এক মাস খেয়ে আমার কাছে আসবেন।

অনেক সময় রোগী এক মাস না খেয়েই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন সবজান্তা আত্মীয় বন্ধুদের উপদেশে।

অথবা আর ডাক্তার না দেখিয়ে ওষুধটা মাসের পর মাস খেয়ে বিপদ ডেকে আনেন।

হাইস্কুলের টিচার দীপ তার মানসিক সমস্যা নিয়ে একের পর এক সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়ে যাচ্ছে বছর দুই ধরে। ওর সমস্যা হল, যে ওষুধ ডাক্তার প্রেসক্রাইব করেন, ইন্টারনেটে সেই ওষুধের সম্বন্ধে সার্চ করে এবং ধরে নেয়, এটা ঘুমের ওষুধ, স্মৃতি দুর্বল করার ওষুধ ইত্যাদি। দীপ এমন চালালে ‘লস্ট-কেস’ ।

 

ভালো থেরাপিস্ট হতে

ভালো থেরাপিস্ট হতে গেলে জানতেই হবে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্য, ধৰ্ম-ভাষা- শ্রোণিগত বৈশিষ্ট্য, নারী-পুরুষ সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য, পেশাগত বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বহু কিছু। এইসব বিষয়ে যত বেশি স্পষ্ট ধারণা থাকবে, ততই সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে সার্থক হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।

কলকাতার রাজাবাজার, খিদিরপুর, কসবা অঞ্চলের অবাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে বঙ্গবাসী কৃষক পরিবারের মুসলমানদের একটা মূলগত চারিত্রিক পার্থক্য থাকে। এই বঙ্গের অবাঙালি মুসলমানেরা যতটা উগ্র, যতটা সমাজবিরোধী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত, বঙ্গবাসী কৃষক পরিবারের মুসলমানেরা ততটাই সুশীল, অতিথিবৎসল ।

বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের হিন্দিভাষী জোতদার বা ধনী কৃষকরা চরিত্রগতভাবে কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। যেমন তাদের পরিবারের বিয়ে-উৎসবে নাচনেওয়ালী আনবে। সদ্য-কিশোরও নাচনেওয়ালীর স্তন সবার সামনে টিপে দেবে নির্দ্বিধায়। পুরুষরা হৈ হৈ করে হাসবে ঘটনা দেখে, নারীদের প্রবেশ এখানে নিষিদ্ধ ।

এইসব ধনী পুরুষরা কথা কথায় হরিজন স্বস্তিত্বে হামলা চালায়, হরিজন মহিলাদের ধর্ষণ করে। গ্রামে ফিরে পুরুষরা এইসব ‘পৌরুষের’ গল্প বলে। ধর্ষকদের বউরাও তার মরদের এমন কাজে ক্রুদ্ধ বা লজ্জিত না হয়ে গর্ব অনুভব করে।

পাঞ্জাব-হরিয়ানার একটি ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে বহুগামিতা বেশ জনপ্রিয়। এইডস রোগীর সংখ্যাও খুব বেশি।

ভারতের কিছু পার্বত্য অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে মদ-জুয়া-বহুগামিতার প্রচলন রয়েছে।

মডেল, সিনেমা স্টার, ক্রিকেট স্টার, পাইলট ও এয়ারহোস্টেসার সাধারণভাবে দেহশুচিতাহীন।

লং-রুটের ড্রাইভার ও লরির ড্রাইভাররা বেশ্যালয়ে যাবে। পুলিশ ঘুষ খাবে। ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কারবারিরা কাস্টমারদের খুশি করতে কলগার্ল পাঠিয়ে থাকে। মাঝে- মধ্যে নিজেরাও মুখ পাল্টায়—এটাই স্বাভাবিক ।

সেনাদের বড়কর্তারা লম্পট হবে। মন্ত্রীরা সমাজবিরোধী হবে—এটাই স্বাভাবিক।

কোলিয়ারি এলাকার সর্বত্র কয়লা মাফিয়া ও রেলের বিশাল সাম্রাজ্য জুড়ে ওয়াগেন মাফিয়ারা রাজত্ব চালাচ্ছে। সমুদ্র উপকূল ও দেশের বর্ডারে স্মাগলার, সুপারি কিলার ও বেশ্যালয় থাকবে—এটাই স্বাভাবিক ।

বাঙালি নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারে অজাচার প্রায় শূন্য। যা অজাচার তা মধ্যবিত্ত পরিবারেই বাসা বাঁধে। যেসব মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্বাভাবিক বন্ধু হতে পারে না, সেই পরিবারেই অজাচার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ছোট পরিবার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিঃসঙ্গতা বেড়েছে, বিষণ্নতা বেড়েছে। বেড়েছে মানসিক রোগ ।

একজন থেরাপিস্ট যত বেশি সমাজ সচেতন হবেন, যত বেশি বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম, জাতপাত, অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যগুলো জানবেন, ততই তাঁর কৃতকার্য হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।

 

কেস হিস্ট্রিঃ ১

এক উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত বাঙালি ছাত্রী শান্তিনিকেতনের কলাভবনে পড়তে পড়তে কলাভবনের এক সাঁওতাল ছাত্রের প্রেমে পড়ে ও দুজনে বিয়েও করে। সাঁওতাল পরিবারে থাকতে গিয়ে মেঠো ইঁদুর পুড়িয়ে খাওয়ার সঙ্গে নিজের খাদ্যাভ্যাসকে মেলাতে পারেনি। খেয়ে বমি-টমি করে একশা। তারপর মেয়েটি দ্রুত অবদমিত বিষণ্ণতার শিকার হয়ে পড়ে। তার থেকেই গলায় ব্যথা। কোনো কিছু গিলতে না পারার সমস্যা তৈরি হয়। বোলপুর ও কলকাতায় গলা পরীক্ষা করান হয়। ডাক্তাররা সমস্যার কোনো কারণ খুঁজে পাননি। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি আমার কাছে আসায়, তাকে কারণ বিশ্লেষণ করে বোঝাই, বিবাহ বিচ্ছেদই ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

মেয়েটি বিবাহ বিচ্ছেদের পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়।

 

কেস-হিস্ট্রিঃ ২

১৯৮৭-র ঘটনা। নাম পাল্টে ধরে নিলাম ও টিংকু। বর চন্দন। থাকে দমদম জংশনের কাছে রেললাইনের পাশে গজিয়ে ওঠা ঝুপড়িতে।

চন্দন এসে আমার সঙ্গে দেখা করল। বলল, ওর বউ টিংকুকে ভূতে ধরেছে। সকলের সামনে আপনা-আপনি শাড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছে। গায়ের গয়না অদৃশ্য হয়েছে। টিংকু জল খেতে গেলেই গ্লাসে চুল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

টিংকু ও চন্দনের সঙ্গে আলাদা-আলাদা করে কথা বললাম। বছর চারেক আগে দুজনের আলাপ। চন্দন তখন পাড়ায় পাড়ায় আবৃত্তি করে বেড়ায়। টিংকু ওর আবৃত্তি, কথাবার্তায় আকর্ষিত হয়েছিল। চন্দন একটা ছোট্ট কারখানার লেবার

টিংকুর বাবা ব্যবসায়ী। গাড়ি বাড়ি সবই আছে। বাড়ির তীব্র অমতে বিয়ে করল টিংকু। বাবা গয়না, খাট ও কিছু নগদ অর্থ দিয়েছিলেন।

চন্দনের কারখানা বন্ধ হল একদিন। আর্থিক সমস্যা মেটাতে নগদ টাকায় হাত দিল। পুঁজি শেষ হতে টিংকুর গয়নায় হাত দিতে হয়েছে। ইতোমধ্যে ভূতের সমস্যা। ভূত তাড়াতে তান্ত্রিকের পিছনে খরচ হয়ে গেছে হাজার সাতেক টাকা। গত বছর টিংকুর গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। টিংকু আবার গর্ভবতী। চার মাস চলছে। ভূতের উপদ্রবের গুরু দ্বিতীয়বার গর্ভবতী হওয়ার পর।

চন্দনের এখনো কোনো স্থায়ী রোজগার নেই। টিংকু মাঝে-মধ্যে বাপের বাড়ি গিয়ে থাকে। তখন ভূতের উপদ্রব বন্ধ থাকে।

বুঝলাম, ন্যূনতম প্রয়োজন না মেটায় অবদমিত বিষণ্ণতা থেকে ওর এই ভূতের উপদ্রব সৃষ্টি করা। চেতনে বা অবচেতনে এইসব ভূতুড়ে কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে টিংকু। শুধু মানসিক চিকিৎসার সাহায্যে রোগীকে সুস্থ করে তোলা অসম্ভব।

আমাদের যুক্তিবাদী সমিতির এক সভ্যের সহৃদয় সাহায্যে চন্দনকে একটা কাজে লাগাবার পর টিংকু আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছিল।

 

কেস-হিস্ট্রিঃ ৩

কলকাতার একটি উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ভালোবেসে বিয়ে করে তার ইউনিভার্সিটির এক সহপাঠী বিহারের উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেকে। ছেলের প্রচুর জমিজমা ।

ছেলেরা বিয়ে করতে এলো ব্যান্ডপার্টি আর হিজড়ে নাচের মিছিল নিয়ে। নতুন বউ দেখল বউভাতে নাচনেওয়ালীদের আগমন। সেই নাচ নাকি মেয়েদের দেখতে নেই। কারণ নাচনেওয়ালীদের সঙ্গে শ্বশুর থেকে ভাসুর সব্বাই একটু-আদটু ফস্টি নস্টি করবে।

বিয়ের ছ’মাসের মধ্যে দলিত সম্প্রদায়ের উপর হামলা করল শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। ফিরে এসে বাড়ির পুরুষদের বুক চিতিয়ে আস্ফালন কতজন মেয়েকে কীভাবে ধর্ষণ করেছে—এসবই শুনে সিঁটিয়ে গেল বাঙালি বাড়ির মেয়ে।

তারপর বিশাল রুচির পার্থক্যে অবদমিত বিষণ্ণতা থেকে মেয়েটি মানসিক রোগে পড়ল ৷

এইক্ষেত্রে সাইকোথেরাপির সাহায্যে মেয়েটিকে সুস্থ করে তোলা কখনই সম্ভব নয়। রোগমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা ডিভোর্স না করলে শূন্য।

 

কেস হিস্ট্রিঃ ৪

আমি তখন স্টেট ব্যাঙ্কে কাজ করি। আমাদের অফিসেরই এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর বাড়ি উড়িষ্যার এক গ্রামে। একদিন সে আমাকে এসে জানাল, কিছুদিন হল ওর স্ত্রীকে ভূতে পেয়েছে। অনেক ওঝা, তান্ত্রিক, গুণিন দেখিয়েছে। প্রতিক্ষেত্রেই এরা দেখার পর খুব সামান্য সময়ের জন্য ভালো থাকে অর্থাৎ বাঞ্ছিত ফল হয়নি। সহকর্মীটিকে বললাম, স্ত্রীকে দেশ থেকে নিয়ে আসতে। নিয়েও এলো।

ওর স্ত্রীকে দেখে মনে হল, স্বামীর সঙ্গে বয়সের পার্থক্য কুড়ি বছরের কম নয়। বউটির বয়স বছর পঁচিশ। ফর্সা রঙ, দেখতে স্বামীর তুলনায় অনেক ভালো। দেশের বাড়িতে আর থাকে ওর দুই ভাসুর, এক দেওর, তাদের তিন বউ, তাদের ছেলেমেয়ে ও নিজের দুই মেয়ে, এক ননদ ও শাশুড়ি। বিরাট সংসারে প্রধান আয় ক্ষেতের চাষ-বাস। স্বামী বছরে দুবার ফসল তোলার সময় যায়। তখন যা স্বামীর সঙ্গ পায়। হাত খরচ হিসেবে স্বামী কিছু দেয় না। টাকার প্রয়োজন হলে যৌথ-পরিবারের কর্ত্রী মা অথবা বড় জায়েদের কাছে হাত পাততে হয়।

প্রথম ভূত দেখার ঘটনাটা এইরকম। একদিন সন্ধ্যার সময় ননদের সঙ্গে মাঠ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ একটা পচা দুর্গন্ধ নাকে এল। অথচ আশপাশে দুর্গন্ধ ছড়াবার মতো কিছুই চোখে পড়েনি। সেই রাতে খেতে বসে রুটিতে গরুর মাংসের গন্ধ পায় বউটি। খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়তে হল। গা-গুলিয়ে বমি। সেই রাতেই একসময় ঘুম ভেঙে গেল । জানলার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে। বীভৎস একটা প্রেতমূর্তি জানলা দিয়ে উকি মেরে ওকেই দেখছিল। পরের দিনই ওঝা আসে। মন্ত্র-টন্ত্র পড়ে। কিন্তু কাজ হয় না। এখন সব সময় একটা পচা দুর্গন্ধ পাচ্ছে। খেতে বসলেই পাচ্ছে গরুর মাংসের গন্ধ। আর মাঝে মাঝে প্রেতমূর্তিটি দর্শন নিয়ে যাচ্ছে।

বউটির মুখ থেকেই জানতে পারি তার মা ও বোনকেও একসময় ভূতে ধরেছিল। ওঝারাই সারিয়েছে। বউটির অক্ষর জ্ঞান নেই। গরুর মাংসের গন্ধ কোনো দিনও শুঁকে দেখেনি। প্রতিদিন অন্য তিন বউয়ের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয় ওকে। তাদের স্বামীরাও দেশেই থাকে, দেখাশুনা করে পরিবারের। অথচ বেচারি বউটিকে কোনো সাহায্য করারই কেউ নেই। বরং মাঝে মধ্যে অন্য কোনো বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হলে কর্তামাও আমার সহকর্মীর বউটির বিরুদ্ধপক্ষে যোগ দেন।

সব মিলিয়ে বউটির কথার বাংলা করলে এইরকম দাঁড়ায় : অন্য জায়ের স্বামীরা যে চাষ করে ঘরে ফসল তোলে। আমার বর কী করে? টাকা না ঢাললে সবাই পর হয়। তা আমার উনি একটি টাকাও কস্মিনকালে উপুড়হস্ত করেন না। কিছু বললেই বলেন, দুই মেয়ের বিয়ের জন্য জমাচ্ছি।

বুঝলাম, অবদমিত বিষণ্নতাই মহিলাটির মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে, যার ফলে মহিলাটি অলীক বীভৎস মূর্তি দেখছেন, পাচ্ছেন অলীক গন্ধ। মহিলাটি গরুর মাংসের গন্ধের সঙ্গে পরিচিত না হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বাস করে নিয়েছেন তাঁর নাকে আসা গন্ধটি গরুরই।

সহকর্মীটিকে তাঁর স্ত্রীর এই অবস্থার কারণগুলো বোঝালাম। জানালাম চিরকালের জন্য স্ত্রীকে স্বাভাবিক ও সুস্থ রাখতে চাইলে স্ত্রী-কন্যাদের কাছে এনে রাখতে হবে, তাদের দেখাশুনো করতে হবে, স্ত্রীর সুবিধে-অসুবিধেয় তার পাশে দাঁড়াতে হবে।

সহকর্মীটির টাকার প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণ। মধ্য কলকাতার নিষিদ্ধ এলাকা সোনাগাছিতে ওড়িশা থেকে আসা কিছু লোকেদের নিয়ে সামান্য টাকায় মেস করে থাকে। চড়া সুদে সহকর্মী ও পরিচিতদের টাকা ধার দেয়। দেশের সংসারে সাধারণত টাকা পাঠায় না। কারণ হিসেবে আমাকে বলেছিল, দেশের চাষের জমিতে আমারও ভাগ আছে। চাষ করে যা আসে তাতেই আমার পরিবারের তিনটি প্রাণীর ভালো মতোই চলে যাওয়া উচিত। মেয়েমানুষের হাতে কাঁচা টাকা থাকা ভালো নয়, আর দরকারই বা কী? শাশুড়ি, ননদ, জায়েদের সঙ্গে থাকতে গেলে একটু ঠোকাঠুকি হবেই। ওসব কিছু নয়। মেয়েদের ও-সব কথায় কান দিতে নেই।

হয়তো সহকর্মীটি এই মানসিকতার মধ্যেই মানুষ হয়েছে, অথবা অর্থ জমানোর নেশাতেই আমার যুক্তিগুলো ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইছে। জানে আমার যুক্তিকে মেনে নেওয়ার অর্থই খরচ বাড়ানো ।

তবু শেষ পর্যন্ত আমার অনুরোধে বউকে কলকাতায় মাস চারেকের জন্য এনে রেখেছিল। বউটিকে সম্মোহিত করে তার মস্তিষ্ক কোষে ধারণা সঞ্চারের মাধ্যমে অলীক গন্ধ ও অলীক দর্শনের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিলাম দু-মাসে, দুটি সিটিং-এ। স্ত্রী ভালো হতেই সহকর্মী তাকে গ্রামে পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। বউটি আমাকেও অনুরোধ করেছিল, আমি যেন ওর স্বামীকে বলে অন্য পাড়ায় বাড়ি ভাড়া নিতে বলি। পাড়াটা বড় খারাপ। নষ্ট মেয়েরা খিস্তি-খেউড় করে, ওদের এড়াতে দিন-রাত ঘরেই বন্দি থাকতে হয়।

অনুরোধ করেছিলাম। খরচের কথা বলে সহকর্মীটি এক ফুঁয়ে আমার অনুরোধ উড়িয়ে দিল। পরিণতিতে বউটিকে গ্রামে পাঠাবার দেড় মাসের মধ্যেই বউটি আবার অবদমিত বিষণ্নতার শিকার হয়েছিল। সহকর্মীটিই আমাকে খবর দেয়, বউকে আবার ভূতে ধরেছে চিঠি এসেছে। কবে আপনি ওকে দেখতে পারবেন জানালে, বউকে সেই সময় নিয়ে আসবো।

বলেছিলাম, ‘আমাকে মাপ করতে হবে ভাই। আমার অত নষ্ট করার মতো সময় নেই যে, তুমি দফায় দফায় বউকে অসুস্থ করাবে, আর আমি ঠিক করব। তুমি যদি তোমার বউ ও মেয়েদের এখানে এনে স্থায়ীভাবে রাখ, তবে ওকে স্থায়ীভাবে সুস্থ করা সম্ভব এবং তা করবও। ‘

সহকর্মীটি আমার কথায় অর্থ-খরচের গন্ধ পেয়েছিল, কলকাতায় আলাদা সংসার পাতা মানেই খরচ।

 

কেস-হিস্ট্রিঃ ৫

ছেলেটি ব্যাঙ্গালোরের একটি কর্পোরেট হাউজে কাজ করেন। মাস মাইনে দু’লাখ টাকার মতো। ইয়ং সুদর্শন। মাস পাঁচেক আগে বিয়ে হয়েছিল টালিক্লাবে। সে এলাহি বিয়ে।

বাবা ছিলেন বড় টি কোম্পানির গার্ডেন ম্যানেজার। এখন থাকেন লেকটাউনে পাত্রী বনেদি পরিবারের মেয়ে।

পাঁচ মাস পরে মেয়ে ব্যাঙ্গালোর ছেড়ে কলকাতায় বাপের বাড়ি ফিরে এলেন। মেয়েটির অভিযোগের ভিত্তিতে ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হল ।

ছেলেরা বড় ল-ইয়ার দিলেন। জামিন পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। ছেলেটির বিরুদ্ধে অভিযোগ—ছেলেটি সমকামী। বউকে পায়ু মৈথুনে বাধ্য করতো। সোজা কথায় ধর্ষণ ।

বহু লক্ষ টাকা খেসারত দিয়ে মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স হয়েছিল।

আমার রোলটা ছিল কিছুটা মধ্যস্থতাকারীর। কারণ—এ ছাড়া অন্য কোনো পথ আমার জানা ছিল না। দুজনের ভালোর জন্য ডিভোর্সই ছিল সেরা পথ।

সমাজের এইসব বিভিন্ন শ্রেণি বিন্যাসের বিচিত্র সব জীবনযাপন পদ্ধতি জানা থাকলে তবে তো থেরাপিস্ট সঠিক পথ দেখাতে পারবেন।

পর্ব- একঃ উঠে আসা নানা প্রশ্ন

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহন

অধ্যায়ঃ দুই

♦ জন্তুদের সম্মোহন করা ব্যাপারটা কি?

অধ্যায়ঃ তিন

♦ ফোটো-সম্মোহন কি সম্ভব?

অধ্যায়ঃ চার

♦ গণ-সম্মোহনের সাহায্যে কি ট্রেন ভ্যানিশ করা যায়?

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ সম্মোহন করে পূর্বজন্মে নিয়ে যাওয়া যায়?

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ জন্মান্তর ও সম্মোহন

অধ্যায়ঃ সাত

♦ সম্মোহন ও নার্কো টেস্ট

অধ্যায়ঃ আট

♦ সম্মোহন করে কথা বলানো যায় ?

অধ্যায়ঃ নয়

♦ প্ল্যানচেটে যে আত্মা আনা হয়, তা কি স্বসম্মোহন বা সম্মোহনের প্রতিক্রিয়া ?

পর্ব- দুইঃ সম্মোহনের ইতিহাস ও নানা মানসিক রোগ

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহনের বিজ্ঞান হয়ে ওঠার ইতিহাস

অধ্যায়ঃ দুই

♦ মনোরোগ, সম্মোহন জানতে মগজের কাজ জানা জরুরি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ মানসিক রোগের রকমফের

অধ্যায়ঃ চার

♦ Hysterical neurosis – Conversion type

অধ্যায়ঃ চার

♦ সাইকোসিস (Psychosis) উন্মাদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ দেহ-মনজনিত অসুখ (Psycho-somatic disorder)

পর্ব- তিনঃ মনোবিদ ও মনোরোগ চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ এক

♦ মনোবিদ (Psychologist) ) মনোরোগ চিকিৎসক (Phychiatrist)

অধ্যায়ঃ দুই

♦ প্রধান কয়েকটি সাইকোথেরাপি নিয়ে আলোচনায় যাব

অধ্যায়ঃ তিন

♦ টেনশন

অধ্যায়ঃ চার

♦ রিল্যাকসেশান পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ যৌনতা এবং যৌন-সমস্যা

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব

পর্ব- চারঃ বিভিন্ন রোগের সম্মোহনের সাজেশন পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহন চিকিৎসা এবং…

অধ্যায়ঃ দুই

♦ রোগীকে সাজেশন দেওয়ার পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ রকমারি রোগ, রকমারি সাজেশন

অধ্যায়ঃ চার

♦ প্রাচীন আমল থেকেই মানসিক রোগ মানেই অশুভ শক্তির কালো হাত

“সম্মোহনের A to Z” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!