তাবৎ ভারতবাসীদের চেতনাকে প্রভাবিত করার মত একটি ঘটনা ঘটল ২১ জুন ৯১। ভারতের নবম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরসিমহা রাও ওই দিন শপথ নিলেন পাঁজিপুঁথি দেখে রাহুর অশুভ দৃষ্টি এড়াতে ১২টা ৫৩ মিনিটে।
পি. ভি নরসিমহা রাও সুপণ্ডিত, দার্শনিক, সাহিত্যিক, বহুভাষাবিদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের সর্বোচ্চ পদাধিকারী, রাষ্ট্রের কান্ডারী। এমন একজন বিশাল মাপের মানুষ জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি যখন অগাধ আস্থা পোষণ করেন, তখন সাধারণ মানুষেরো জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি আস্থা বাড়ে। জ্যোতিষশাস্ত্রের অভ্রান্ততা বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্থ বহু মানুষই এরপর শাস্ত্রটিকে অস্বীকার করাটা কিঞ্চিৎ মূঢ়তা বলেই মনে করতেই পারেন। অসাধারণ মানুষের বিশ্বাস সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রভাবিত হলে সাধারণ মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে জন্মকালেই তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। জীবনের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত আগে থেকেই ঠিক হয়ে রয়েছে। এ অমোঘ, অব্যর্থ।
নির্ধারিত কথার অর্থ- যা ঠিক হয়েই রয়েছে; যার পরিবর্তন সম্ভব নয়। জ্যোতিষীরা দাবি করেন, জ্যোতিষশাস্ত্র এমন একটি শাস্ত্র যে শাস্ত্র নির্ধারিত পথে বিচার করে একজন মানুষের পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য গণনা করা যায়।
মজাটা হল এই, সাধারণ মানুষ যখন শ্রীনরসিমহা রাওয়ের জ্যোতিষ পরামর্শ মেনে শপথ গ্রহণ করার ঘোষণায় শ্রীরাওকে জ্যোতিষশাস্ত্রে পরম শ্রদ্ধাবান ও বিশ্বাসী বলে মনে করছেন, তখন শ্রীনরসিমহা রাও কিন্তু জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর সামান্যতম আস্থা প্রকাশ করে ভাগ্যের দোহাই দিয়ে বসে থাকেননি। শ্রীশরদ পাওয়ারকে প্রধানমন্ত্রী পদের প্রতিযোগিতায় পরাজিত করার জন্য বিড়লা, হিন্দুজা, আম্বানিদের মত বিশাল শিল্পপতিদের দোরে দোরে ঘুরেছেন। নিজের দলের সাংসদদের সমর্থন আদায় করতে নাকি প্রত্যেক সমর্থক সাংসদকে ৫০ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পিছু হটেছেন শ্রীশরদ পাওয়ারের শিবির, যাতে সামিল হয়েছিলেন কির্লোস্কার, বাজাজ, নুসলি ওয়াদিয়া, গুলাবচাঁদ প্রমুখ শিল্পগোষ্ঠী। শ্রীনরসিমহার পক্ষে সিংহভাগ সাংসদদের সমর্থন নিশ্চিত করতে শ্রীনরসিমহার সমর্থক শিল্পগোষ্ঠিই নাকি অর্থ জুগিয়েছেন। এ-সবই এই বইটির পাঠকদের কাছে পুরোন খবর হয়ে গেছে। কারণ এই খবর তামাম ভারতবর্ষের বহু পত্র-পত্রিকাতেই বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল ৯১-এর ২০, ২১, ২২ জুন। শ্রীনরসিমহা সত্যিই যদি জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করতেন, তবে নিশ্চয়ই তাঁর নিত্যকার দুপুরের ভাত-ঘুমকে নির্বাসনে পাঠিয়ে শ্রীশরদকে রুখতে শিল্পপতিদের কাছে হত্যে দিয়ে পড়তেন না, পাওয়ার দখলের জন্য প্রাণকে বাজি রেখে লড়াই চালাতেন না। জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিশ্বাস করে, ভাগ্যকে বিশ্বাস করে শরীরকে বিশ্রাম দেওয়ার রুটিনই বজায় রাখতেন। ভাগ্য যখন পূর্বনির্ধারিত, তখন যে কোনও প্রচেষ্টাই তো অর্থহীন। প্রধানমন্ত্রী হওয়া যদি ভাগ্যে নির্ধারিত, তখন যে কোনও প্রচেষ্টাই তো অর্থহীন। প্রধানমন্ত্রী হওয়া যদি ভাগ্যে নির্ধারিতই থাকে, তবে কে তাকে খন্ডাবে? এতো অমোঘ অব্যর্থ। আর ভাগ্যে যদি প্রধানমন্ত্রী হওয়া লেখা না থাকে, তবে কোনও চেষ্টাতেই তা হবে না। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বঞ্ছিত হলে সে বঞ্ছনার কারণ অবশ্যই ভাগ্য; যে ভাগ্য জন্মকালীন গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান অনুযায়ী নির্ধারিত হয়ে গেছে।
মহা-বিস্ময় জাগে যখন দেখি সুপণ্ডিত, ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ শ্রীনরসিমহা রাও কথা ও কাজে দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছেন। সমস্ত প্রচার মাধ্যমগুলোর সাহায্যে জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি, নিজের ভাগ্যের লিখনের প্রতি সামান্যতম বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা না রেখে নিজের অধিকার ছিনিয়ে নিতে সংগ্রাম চালিয়েছেন।
কেন এই দ্বিচারিতা? তবে কি ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ শ্রীরাও চান তাঁর শাসনকালে বঞ্ছিত মানুষগুলো তাদের প্রতিটি বঞ্ছনার জন্য নিজ-ভাগ্যকেই দায়ী করুক? তাই কি ডংকা বাজিয়ে জ্যোতিষবিশ্বাসের পক্ষে তাঁর প্রচার? তাঁর এই স্ববিরোধী চরিত্রের কথা দেশবাসীরা যদি তোলে তিনি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁদের উদ্দেশ্যে কি বলবেন? তখন কি উপদেশ দেবেন, “হে দরিদ্র-ভারতবাসী, হে মূর্খ-ভারতবাসী, আমি যা বলি তাই কর, যা করি তা কর না।“
যে শিল্পপতি, ধনীদের দেওয়া সহস্র কোটি টাকা ব্যয় করে শ্রীরাওয়ের দল ক্ষমতায় এসেছে, যে শিল্পপতিদের পছন্দের মানুষ হিসেবে শ্রীরাও নেতা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও কিছু করার চিন্তা নিশ্চয়ই শ্রীরাও এবং তাঁর দলের সরকারের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। ১৯৯০-এর নভেম্বরে চন্দ্রশেখর যখন প্রধানমন্ত্রী হন এবারের চেয়েও বেশি টাকার খেল হয়েছিল। সে-বারও কিংমেকার শিল্পগোষ্ঠীরাই চন্দ্রশেখরকে পছন্দ করেছিলেন বলেই চন্দ্রশেখর প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। শিল্পপতিরা নিশ্চয়ই তাঁদেরই কৃপা করবে, তাঁদের পিছনেই অর্থ ঢালবে, শাসনক্ষমতায় বসাবে, যারা শিল্পপতিদের একান্তই বিশ্বস্ত। অতএব এইসব শাসকগোষ্ঠী ধনকুবেরদের যে বিরোধীতা করতে পারে না, করার সাধ্য নেই এ-কথা অতি স্পষ্টভাবে বুঝে নিতে হবে।
সংসদীয় নির্বাচনে কোনও রাজনৈতিক দল শাসনক্ষমতা দখলের দিকে এগোতে চাইলে, লোকসভায় বা বিধানসভায় উল্লেখযোগ্য আসন পেয়ে দাপট বজায় রাখতে চাইলে সেই রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে বিপুল অর্থ ঢালতেই হবে। বর্তমানে নির্বাচন মানেই এক রাজসূয় যজ্ঞ। বিশাল প্রচার ব্যয়, রিগিং, বুথদখল, ছাপ্পা ভোট এ-সব নিয়েই এখনকার নির্বাচন। এ এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরজন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও মাসলম্যানদের পিছনেও বইয়ে
দিয়ে হয় অর্থের স্রোত। এই শত-সহস্র কোটি টাকা গরীব খেটে খাওয়া মানুষদের এক-টাকা দু-টাকা বা পাঁচ-টাকা চাঁদায় তোলা যায় না। তোলা হয়ও না। নির্বাচনী ব্যয়ের শতকরা ৯৯ ভাগেরও বেশি টাকা যোগায় ধনকুবেররা। বিনিময়ে তারা এইসব দলগুলোর কাছ থেকে পায় স্বস্তিতে শোষণ চালাবার গ্যারান্টি। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পায় স্বস্তিতে শোষণ চালাবার গ্যারান্টি। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো কৌশল হিসেবে খেটে খাওয়া মানুষদের কাছ থেকে নির্বাচনী তহবিলের জন্য চাঁদা আদায় করে দেখাতে চায় “মোরা তোমাদেরই লোক।“
এইসব রাজনৈতিক দলের নেতারা যখন মাঠে ময়দানে, পত্র-পত্রিকায়, বেতারে, দূরদর্শনে, গরীবি হটানোর কথা বলেন, শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের কথা বলেন, মেহনতি মানুষের হাতিয়ার বলে নিজেদের ঘোষণা করেন, তখন কিন্তু এইসব তর্জন গর্জনে শোষকশ্রেণীর সুখনিদ্রায় সামান্যতম ব্যঘাত ঘটে না। শোষকশ্রেণী জানে তাদের কৃপাধন্য, তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের এইসব বজ্রনির্ঘোষ স্রেফ ছেলে ভুলোন ছড়া; সংখ্যাগুরু শোষিত মানুষকে ভুলিয়ে রাখার এ এক কৌশল। হুজুরের দল চায় এ-ভাবেই তাদের ক্রীড়নক রাজনৈতিক দলগুলো শোষিতদের অপমানজনের মুখোশ পরে শোষিতদের বিভ্রান্ত করুক, যাতে তাদের সম্মিলিত ক্ষোভ দানা বেঁধে বিস্ফোরিত হতে না পারে। এই সমাজ-ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে শোষণ কায়েম রাখার স্বার্থেই শোষণকারীদের দালাল রাজনৈতিক দলগুলো শোষিত সাধারণ মানুষদের মগজ ধোলাই করে নানা ভাবে।
বর্তমানে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে শোষকশ্রেণীর দালালির অধিকার লাভের প্রতিযোগিতা।
ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই চায় মানুষ অদৃষ্টবাদী হোক, বিশ্বাস করুক পূর্বজন্মের কর্মফলে, ঘুরপাক খাক নানা সংস্কারের অন্ধকারে। এমন বিশ্বাসগুলো শোষিত মানুষগুলোর মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পারলে শোষিত মানুষ তাদের প্রতিটি বঞ্ছনার জন্য দায়ী করবে নিজের ভাগ্যকে, কর্মফলকে, ঈশ্বরের কৃপা না পাওয়াকে। শোষিত মানুষগুলোর চিন্তা চেতনা যদি স্বচ্ছতা পায়, ওরা যদি অন্ধ-সংস্কার ও বিশ্বাসের দেওয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে, তবে তো ওদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে প্রতিটি বঞ্ছনার পিছনেই রয়েছে এই সমাজেরই কিছু মানুষ, এই সমাজেরই কিছু নিয়ম-কানুন ব্যবস্থা বা অব্যবস্থা, দুর্নীতি ও শোষণ। শোষিত মানুষ যদি বুঝতেই পারে তাদের বঞ্ছনার কারণের মূলে ভাগ্য, কর্মফল বা ঈশ্বরের কৃপাহীনতা দায়ী নয়, দায়ী সমাজের বর্তমান ব্যবস্থা, তখন তাঁরা বঞ্ছনামুক্ত হতে একদিন নিশ্চয়ই এই সমাজ ব্যবস্থা, তখন তাঁরা বঞ্ছনামুক্ত হতে একদিন নিশ্চয়ই এই সমাজ ব্যবস্থাকেই পাল্টাতে চাইবে। সমাজের মূল ধরে টান দেবে। এতে শোষকশ্রেণী ও তাদের কৃপাধন্য দালালদের অস্তিত্বই যে বিপন্ন হয়ে পড়বে। এটা খুব ভালোমত জানে এবং বোঝে বলেই শোষকশ্রেণী ও তাদের দালালদের নানা পরিকল্পনা প্রতিনিয়তই চলছে। চলছে নানা ভাবে মগজ ধোলাইয়ের পদ্ধতি।
কিছু কথা
♦ শোষণ ব্যবস্থাকে কায়েম রাখতেই মগজ ধোলাই চলছে
♦ দেশপ্রেম নিয়ে ভুল ধারনা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে
♦ গণতন্ত্র যেখানে বর্বর রসিকতা
♦ জনসেবা নিয়ে স্বচ্ছতা থাকা অতি প্রয়োজনীয়
♦ যুক্তিবাদের আগ্রাসন প্রতিরোধে কাগুজে যুক্তিবাদীর সৃষ্টি
♦ যুক্তিবাদবিরোধী অমোঘ অস্ত্র ‘ধর্ম’
♦ যুক্তিবাদী আন্দোলন নিয়ে প্রহসন কতদিন চলবে?
♦ আন্দোলনে জোয়ার আনতে একটু সচেতনতা, আন্তরিকতা
অধ্যায়ঃ এক
♦ পত্র-পত্রিকায় সাড়া জাগানো কিছু ভবিষ্যদ্বাণী প্রসঙ্গে
অধ্যায়ঃ দুই- অশিক্ষা, পদে পদে অনিশ্চয়তা এবং পরিবেশ মানুষকে ভাগ্য নির্ভর করে
♦ অদৃষ্টবাদ যেখানে অশিক্ষা থেকে উঠে আসে
♦ অনিশ্চয়তা আনে ভাগ্য নির্ভরতা
♦ পরিবেশ আমাদের জ্যোতিষ বিশ্বাসী করেছে
♦ মানব জীবনে দোষ-গুণ প্রকাশে পরিবেশের প্রভাব
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
♦ জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্রের পার্থক্য
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦জ্যোতিষশাস্ত্রের বিচার পদ্ধতি
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
♦ জ্যোতিষীরা জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষে যে-সব যুক্তি হাজির করেন
অধ্যায়ঃ আট
♦ জ্যোতিষশাস্ত্রের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের যুক্তি
অধ্যায়ঃ নয়
♦ মানব শরীরে রত্ন ও ধাতুর প্রভাব
অধ্যায়ঃ দশ
♦ জ্যোতিষচর্চা প্রথম যেদিন নাড়া খেল
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ কিভাবে বার-বার মেলান যায় জ্যোতিষ না পড়েই
অধ্যায়ঃ বারো
♦ জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের প্রতি চ্যালেঞ্জ
২য় পর্বঃ কিছু কথা
অধ্যায়- একঃ নস্ট্রাডামুসের সঙ্গে পরিচয়
♦ নস্ট্রাডামুসের ‘আশ্চর্য’ ভবিষ্যদ্বাণী কতটা ‘আশ্চর্যজনক’?
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
অধ্যায়ঃ নয়
অধ্যায়ঃ দশ
অধ্যায়ঃ এগারো
অধ্যায়ঃ বারো
♦ এ-দেশের পত্র-পত্রিকায় নস্ট্রাডামুস নিয়ে গাল-গপ্পো বা গুল-গপ্পো
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ৩য় খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ