ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার কিভাবে পরিচয় হল আগে বলে নিই। কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার এগজামিনার হয়ে পাড়াগাঁ ধরনের এক শহরে গিয়েছি (শহর এবং কলেজের নাম বলার প্রয়োজন দেখছি না। মূল গল্পের সঙ্গে এদের সম্পর্ক নেই। নামগুলি প্রকাশ করতেও কিছু অসুবিধা আছে)। এই অঞ্চলে আমি কখনো আসিনি। পরিত্যক্ত এক রাজবাড়িতে কলেজ বানানো হয়েছে। গাছ-গাছড়ায় চারদিক আচ্ছন্ন। বিশাল কম্পাউন্ড। কিন্তু লোকজন নেই, পরীক্ষার জন্যে কলেজ ছুটি হয়ে গেছে। খাঁ খাঁ করছে চারদিক, আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম।
একটা সময় ছিল যখন এগজামিনারদের আলাদা খাতিরযত্ন ছিল। কলেজের প্রিন্সিপাল নিজের বাসায় রাখতেন। সকাল-বিকাল নানান ধরনের খাবার। জাল ফেলে পাকা রুই ধরা হতো। যত্নের চূড়ান্ত যাকে বলে। এখন সেই দিন নেই। কেউ পাত্তাই দেয় না। বিরক্ত চোখে তাকায়।
আমার জায়গা হল কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির পাশে একটা খালি কামরায়। প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, আপনাকে হোস্টেলেই রাখতে পারতাম। কিন্তু বুঝতেই পারছেন চারদিকে থাকবে ছাত্র। আপনি অস্বস্তি বোধ করবেন। ছাত্ররা তো আর আগের মতো নেই। মদটদ খায়। একবার বাজে মেয়ে নিয়ে এসে নানা কীর্তি করেছে। বিশ্রী ব্যাপার। তবে আপনার খাওয়াদাওয়ার কোনো অসুবিধা হবে না। আমার বাসা থেকে খাবার যাবে।
থাকার ঘর দেখে চমকে উঠলাম। আগে বোধহয় স্টোররুম ছিল। একটামাত্র জানালা। রেলের টিকিট দেয়ার জানালার মতো ছোট। ঘরভরতি মাকড়সার ঝুল। দুটি বিশাল কুৎসিত মাকড়সা পেটে ডিম নিয়ে বসে আছে। এই নিরীহ প্রাণীটিকে আমি অসম্ভব ভয় পাই। এদের ছায়া দেখলেও আমার গাঁ ঠান্ডা হয়ে আসে। ঝাড়ুদারকে পাঁচটা টাকা দিলাম মাকড়সার ঝুল পরিষ্কার করার জন্যে। সে কি করল কে জানে! ঘর যেমন ছিল তেমনি রইল। দুটির জায়গায় এখন দেখছি তিনটি মাকড়সা। তৃতীয়টির গায়ের রং কালো। চোখ জ্বলজ্বল করছে।
সন্ধ্যাবেলা হারিস নামের একজন লোক একটা হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। অথচ দিনের বেলায় ইলেকট্রিসিটি আছে দেখেছি। হারিস বলল- রাত দশটার পর আমি কারেন্ট দিয়ে করব কি?
সন্ধ্যার পর এলেন কেমিস্ট্রির ডেমনেসট্রেটর সিরাজউদ্দিন। এঁর সঙ্গে আমার সকালে একবার দেখা হয়েছে। তখন বোধহয় তেমন মনোযোগ দিয়ে দেখিনি। মুখভর্তি আরনেস্ট হেমিংওয়ের মতো চাপদাঁড়ি। মাথায় টুপি। চোখে সুরমা। গাঁ থেকে আতরের গন্ধ বেরুচ্ছে। বেঁটেখাটো একজন মানুষ। বয়স পঞ্চাশের মতো হলেও চমৎকার স্বাস্থ্য। এই গরমেও গায়ে ঘিয়া রঙ্গের একটা চাদর। তিনি কথা বলেন খুব সুন্দর করে।
‘স্যার কেমন আছে?’
‘ভালোই আছি।‘
‘আপনার খুব তকলিফ হল স্যার।‘
‘না, তকলিফ আর কি?’
‘আগে এগজামিনার সাহেবরা এলে প্রিন্সিপাল স্যারের বাসায় থাকতেন। কিন্তু ওঁর এক ছেলের মাথায় দোষ আছে। প্রিন্সিপাল স্যার এখন আর কাউকে বাসায় রাখেন না। ছেলেটা বড় ঝামেলা করে।‘
আমি বললাম, আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
সিরাজউদিন সাহেব ক্ষীণকন্ঠে বললেন, স্যার, ভেতরে এসে একটু বসব?
‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আসুন গল্প করি।‘
সিরাজউদ্দিন সাহেব বসতে বসতে বললেন, এখানে ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের একটা ডাকবাংলো আছে। আপনাকে সেখানে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে রেভিনিউর সি.ও. তাঁর ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন। কোয়ার্টারের খুব অভাব।
‘বুঝতে পারছি। এই নিয়ে আপনি ভাববেন না। দিনের বেলাটা তো কলেজেই কাটবে। রাতে এসে শুধু ঘুমানো। বইপত্র নিয়ে এসেছি, সময় কাটানো কোনো সমস্যা না।
সিরাজউদ্দিন সাহেব ইতস্তত করে বললেন, রাতে ঘর থেকে বেরুতে হলে একটু শব্দ-টব্দ করে তারপর বেরুবেন। খুব সাপের উপদ্রব।
‘তা-ই নাকি?’
‘জী স্যার। এখন সাপের সময়। গরমে অতিষ্ট হয়ে গর্ত থেকে বের হয়। হাওয়া খায়।‘
আমার গা হিম হয়ে গেল। এ তো মহাযন্ত্রণা! প্রায় দুশো গজ দূরে ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে বাথরুম। আমার আবার রাতে কয়েকবার বাথরুমে যেতে হয়।
‘তবে স্যার ঘরের মধ্যে কোনো ভয় নেই। চারদিকে কার্বলিক অ্যাসিড দিয়ে দিয়েছি। সাপ আসবে না।‘
‘না এলেই ভালো।‘
‘যদি স্যার আপনি অনুমতি দেন পা উঠিয়ে বসি।‘
‘বসুন বসুন। যেভাবে আপনার আরাম হয় সেভাবেই বসুন।‘
ভদ্রলোক পা উঠিয়ে বসলেন এবং একের পর এক সাপের গল্প শুরু করলেন। সেইসব গল্পও অতি বিচিত্র। রাতে ঘুম ভেঙ্গেছে, হঠাত তার মনে হল নাভির উপর চাপ পড়ছে। চোখ মেললেন। ঘরে চাঁদের আলো। সেই আলোয় লক্ষ করলেন একটা সাপ কুন্ডলী পাকিয়ে তাঁর নাভির উপর শুয়ে ঘুমুচ্ছে, আসল সাপ – শঙ্খচূড়।
একসময় আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, সাপের গল্প আর শুনতে ইচ্ছা করছে না। দয়া করে অন্য গল্প বলুন।
ভদ্রলোক সম্ভবত সাপের গল্প ছাড়া অন্য কোনো গল্প জানেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুরু করলেন সাপের সঙ্গমদৃশ্যের বর্ণনা। চৈত্রমাসের এক জ্যোৎস্নায় তিনি এই দৃশ্য দেখেছেন। বর্ণনা শুনে আমার গা ঘিনঘিন করতে লাগল। সিরাজউদ্দিন সাহেব বললেন, সাপ যে-জায়গায় এইসব করে তার মাটি কবচে ভরে কোমরে রাখলে পুরুষত্ব বাড়ে।
বিজ্ঞানের একজন শিক্ষকের মুখে কি অদ্ভুত কথা! আমি ঠাট্টা করে বললাম, আপনি সেখানকার মাটি কিছু সংগ্রহ করলেন?
তিনি আমার ঠাট্টা বুঝতে পারলেন না। সরল ভঙ্গিতে বললেন, জী না স্যার।
লোকটি নির্বোধ। নির্বোধ মানুষের সঙ্গে আমার কথা বলতে ভালো লাগে না। কিন্তু এই লোক উঠছে না। সাপ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য সে আমাকে দেবে বলে বোধহয় তৈরি হয়েই এসেছে। মুক্তি পাবার জন্যে একসময় বলেই ফেললাম, সারাদিনের জার্নিতে টায়ার্ড হয়ে এসেছি। যদি কিছু মনে না করেন বাতিটাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ব।
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, কি বলছেন স্যার? ভাত না খেয়ে ঘুমাবেন? ভাত তো এখনো আসেনি। দেরি হবে। আমি প্রিন্সিপাল সাহেবের বাসা থেকে খোঁজ নিয়ে তারপর আপনার কাছে এসেছি। আমি যাওয়ার পর রান্না চড়িয়েছে। গোশত রান্না হচ্ছে।
‘তা-ই নাকি?’
‘জী। আপনি গরু খান তো?’
‘জী, খাই।‘
‘এখানে কসাইখানা নাই। মাঝে মাঝে গরু কাটা হয়। আজ হাটবার। তাই গরু কাটা হয়েছে। প্রিন্সিপাল সাহেব দুই ভাগ নিয়েছেন।‘
‘ও আচ্ছা।‘
‘পচিশ টাকা করে ভাগ।‘
‘তা-ই বুঝি?’
‘প্রিন্সিপাল স্যারের স্ত্রীর রান্না খুব ভালো।‘
‘তা-ই নাকি?’
‘জী। তবে আজ রান্না করছে তাঁর ছেলের বউ। যে-ছেলেটা পাগল – তার বউ।‘
‘ও আচ্ছা।‘
‘বিরাট অশান্তি চলছে প্রিন্সিপাল স্যারের বাড়িতে। ছেলে বটি নিয়ে তার মাকে কোপ দিতে গেছে। বউ গিয়ে মাঝখানে পড়ল। এখন ছেলেকে বেঁধে রেখেছে। এই জন্যেই রান্নায় দেরি হচ্ছে।‘
‘কোনো হোটেল গিয়ে খেয়ে এলেই হতো। এদের দুঃসময়ে…’
‘কী যে বলেন স্যার! আপনি আমাদের মেহমান না? তা ছাড়া ভদ্রলোকের খাওয়ার মতো হোটেল এই জায়গায় নাই। নিতান্তই গণ্ডগ্রাম। হঠাত সাবডিবিশন হয়ে গেল। ভালো একটা চায়ের দোকান পর্যন্ত নাই।‘
রাত সাড়ে দশটায় খাবার এল। দুটো প্লেট, সিরাজউদ্দিন সাহেবও আমার সঙ্গে খেতে বসলেন। হাত ধুতে ধুতে বললেন, প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে আপনার সঙ্গে খেতে বলেছেন। আপনি হচ্ছেন আমাদের মেহমান। আপনি একা একা খাবেন, তা কি হয়!
প্রিন্সিপাল সাহেবের ছেলের বউ অনেক কিছু রান্না করেছে। অসাধারণ রান্না। সামান্য সব জিনিসও রান্নার গুণে অপূর্ব হয়েছে। মেয়েটার জন্যে আমার কষ্ট হতে লাগল। বেচারি হয়তো চোখের জল ফেলতে ফেলতে রেঁধেছে। আজ রাতে হয়তো কিছু খাবেও না।
‘সিরাজউদ্দিন সাহেব!’
‘জী স্যার?’
‘প্রিন্সিপাল সাহেবের ছেলের বউকে বলবেন, আমি এত ভালো রান্না খুব কম খেয়েছি। দ্রৌপদী এরচে ভালো রাঁধত বলে আমার মনে হয় না।‘
‘জী স্যার, বলব। তবে প্রিন্সিপাল স্যারের স্ত্রীর রান্নার কাছে এ কিছুই না। আছেন তো কিছুদিন নিজেই বুঝবেন।‘
প্রিন্সিপাল সাহেবকে বেশ বিচক্ষণ বলে মনে হল। তিনি একটা টর্চলাইট পাঠিয়েছেন। ক্লাস্কভর্তি চা পাঠিয়েছেন। পান সুপারি জর্দাও আছে কৌটায়।
খাওয়াদাওয়ার পর সিরাজউদ্দিন সাহেব অনেক্ষন বসে রিলেন। চা খেলেন, পান খেলেন, দীর্ঘ একটা সাপের গল্প বললেন। বিদায় নিলেন রাত এগারোটার পর। যে-লোকটি ক্রমাগত সাপের কথা বলছে তার দেখলাম তেমন ভয়টয় নেই। টর্চ বা লাঠি ছাড়াই দিব্যি হনহন করে চলছে।
আমি দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসলাম। নতুন জায়গায় চট করে ঘুম আসবে না। শুয়ে শুয়ে হালকা ধরনের কিছু বই পড়া যায়। হারিকেনের এই আলোয় সেটা সম্ভব হবে না। আমি সিগারেট ধরিয়ে সুটকেস খুললাম বই বের করব। ঠিক তখন একটা কান্ড হল। প্রচন্ড ভয় লাগল। অথচ ভয়ের কোনোই কারণ ঘতেনি। তবু আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। যেন বন্ধ দরজার ওপাশেই অশরীরী কিছু দাঁড়িয়ে আছে। যেন এক্ষুনি সেই অশরীরী অতিথি ভয়ংকর কিছু করবে। নিজের অজান্তেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম – কে, কে? আর তখন শুনলাম থপ থপ শব্দে একজন কেউ যেন দূরে চলে যাচ্ছে। ছোট্ট একটা কাশির শব্দও শুনলাম।
ভয়টা যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনি হঠাৎ চলে গেল। আমি খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। চাঁদের আলোয় চারদিক থৈথৈ করছে। কোথাও কেউ নেই। হঠাৎ এই অস্বাভাবিক ভয় আমাকে অভিভূত করল কেন? এখনও গা ঘামে ভেজা। হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে। আমি শারীরিকভাবে পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। হালকা বাতাস দিচ্ছে, বেশ লাগছে দাঁড়িয়ে থাকতে। লুঙ্গিপরা খালি গায়ের একটি লোক বিড়ি টানতে টানতে আসছে। আমাকে দেখেই বিড়ি লুকিয়ে ফেলে বলল, আদাব স্যার।
‘আদাব। তুমি কে?’
‘আমার নাম কালিপদ। আমি কলেজের দারোয়ান।‘
‘তুমি কিছুক্ষণ আগে কি এইখানেই ছিলে?’
‘জী স্যার। লাইব্রেরি ঘরের সামনে বসে ছিলাম।‘
‘কাউকে যেতে দেখেছ?’
‘আজ্ঞে না। কেন স্যার? কি হইছে?’
‘না, এমনি।‘
কিছুক্ষনের মধ্যেই ইলেক্ট্রিসিটি চলে এল। আমি নিশ্চিন্ত মনে বই নিয়ে শুতে গেলাম। স্টিফান কিংয়ের লেখা ভৌতিক উপন্যাস। দারুণ রগরগে ব্যাপার। একবার পড়তে শুরু করলে ছাড়তে ইচ্ছা করে না। ভয়-ভয় লাগে আবার পড়তেও ইচ্ছা করে। পুরোপুরি ঘুমুতে গেলাম একটার দিকে। বারবার মনে হতে লাগল কিছুক্ষণ আগে এই অস্বাভাবিক ভয়টা কেন পেলাম? রহস্যটা কি?
আমি খুব একটা সাহসী মানুষ এরকম দাবি করি না। কিন্তু অকারণে এত ভয় পাবার মতো মানুষও আমি নই। একা একা বহু রাত কাটিয়েছি।
সে-রাতে আমার ভালো ঘুম হল না।
দিনের বেলাটা খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। একুশজন ছেলে পরীক্ষা দেবে। জোগাড়যন্ত্র কিছুই নেই। ল্যাবরেটরির অবস্থা শোচনীয়। একটামাত্র ‘ব্যালেন্স’ তাও ঠিকমতো কাজ করছে না। প্রয়োজনীয় কেমিক্যালসও নেই। সে নিয়ে কারো মাথাব্যথাও নেই। কেমিস্ট্রির দুজন টিচার। ওঁরা নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছেন। একজন আমাকে বলে গেলেন, কলেজের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। ক্লাস-টেলাসও তেম্ন হয়নি। একটু দেখেশুনে নেবেন স্যার। পাস মার্কটা দিয়ে দেবেন।
আমি হেঁসে বললাম, কি করে দেব বলুন। দেবার তো একটা পথ লাগবে। এরা তো মনে হচ্ছে প্র্যাকটিক্যাল কাজ কিছুই করেনি।
কী করে করবে বলেন। স্ট্রাইক-ফ্রাইক লেগেই আছে। জিনিসপত্রও কিছু নেই।
একমাত্র সিরাজউদ্দিন সাহেবকে দেখলাম ব্যবস্থা করার জন্য ছুটাছুটি করছেন। চেষ্টা করছেন কীভাবে ছাত্রদের খানিকটা সাহায্য করা যায়। একুশজন ছাত্রছাত্রির কেউ তাঁকে এক মুহূর্তের জন্যে চোখের আড়াল করতে রাজি নয়। একটি মেয়ে সল্ট অ্যানালিসিসে কিছুই না পেয়ে তাদের স্বভাবমতো কাঁদতে শুরু করেছে। সিরাজউদ্দিন সাহেব তাকে একটা ধমক দিলেন, খবরদার কাঁদবি না। কাঁদলে চড় খাবি। গোঁড়া থেকে কর। ড্রাই টেস্টগুলি আগে কর। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে করবি।
এগজামিনারদের একটা দায়িত্ব হচ্ছে লক্ষ রাখা যেন ছাত্ররা তাদের নিজেদের কাজগুলি নিজেরাই করে। কিন্তু সবসময় দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয় না। দেখেও না-দেখার ভান করতে হয়। এখন যেমন করছি। ছাত্রদের জন্যে আমার খানিকটা মমতাও লাগছে। যন্ত্রপাতি নেই, কেমিক্যালস নেই, স্যারদের কোনো আগ্রহ নেই, ছেলেরা করবে কি?
দুপুরবেলা প্রিন্সিপাল সাহেব দেখতে এলেন পরীক্ষা কেমন হচ্ছে। ভদ্রলোককে মনে হয় বিপর্যস্ত। কিছুক্ষণ মুখ কুঁচকে রেখে বললেন, দেন, সবকটিকে ফেল করিয়ে দেন। ঝামেলা চুকে যাক।
কোনো প্রিন্সিপালকে এরকম কথা বলতে শুনিনি। আমি হেঁসে ফেললাম। প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, রাতে অসুবিধা হয়নি তো?
‘জী না, হয়নি।‘
‘সিরাজউদ্দিনকে আপনার খোঁজখবর রাখতে বলেছি। কোনোকিছু দরকার হলেই তাকে বলবেন। সংকোচ করবেন না।‘
‘না করব না।‘
‘সাপের গল্প বলে মাথা খারাপ করিয়ে দেবে। পাত্তা দেবেন না। এখানে সাপের উপদ্রব একেবারেই নেই।‘
‘তা-ই নাকি?’
‘আপনাকে ভয় খাইয়ে দিয়েছে বোধহয়? আমাকেও দিয়েছিল। প্রথম যখন আসি, এমন অবস্থা, ঘর থেকে বেরুবার আগে হারিকেন, লাঠি এইসব নিয়ে বের হতাম। হা হা হা।‘
প্রিন্সিপাল সাহেব বেশিক্ষণ দাঁড়ালেন না। আগামীকাল সন্ধ্যায় চা খাবার দাওয়াত দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলে গেলেন।
পাঁচটায় পরীক্ষা শেষ হবার কথা। শেষ হল রাত ন’টায়। সিরাজউদ্দিন সাহেবের বিধ্বস্ত অবস্থা। আমি হাঁসতে হাঁসতে বললাম, পরীক্ষা তো আপনার ছাত্ররা দেয়নি, দিয়েছেন আপনি। মনে হচ্ছে ভালোই দিয়েছেন।
আমার সঙ্গেই তিনি ঘরে ফিরলেন। খাওয়াদাওয়া করে নিজের জায়গায় ফিরে যাবেন। অতিরিক্ত ক্লান্ত থাকার জন্যেই বোধহয় আর সাপের গল্প শুরু হল না। নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে তিনি উঠে পড়লেন।
‘স্যার যাই। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েন। রাতবিরাতে ফেরুবার সময় একটু খেয়াল রাখবেন। শব্দ করে পা ফেলবেন। সাপেরই এখন সিজন।‘
‘খুব খেয়াল রাখব।‘
আমি দরজা বন্ধ কের বিছানায় এসে বসামাত্র ঠিক আগের মতো হল। তীব্র একটা ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল, থরথর করে হাত-পা কাঁপছে। নিশ্বাস নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাব। দরজার কড়ায় টন করে একটা শব্দ হল। যেন কেউ কড়া নাড়তে গিয়েও কড়া নাড়ল না। ঠিক তখন ভয়টা চলে গেল। আমি পুরোপুরি স্বাভাবিক। জগ থেকে ঢেলে এক গ্লাস পানি খেলাম। গলা উঁচিয়ে ডাকলাম – কালিপদ, কালিপদ! কেউ সাড়া দিল না। আজ বোধহয় ডিউটি দিচ্ছে না।
বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে এনে বসলাম। সিগারেট ধরালাম। আকাশে অল্প মেঘ। মাঝে মাঝে মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আবার ভেসে উঠছে। অপূর্ব আলোআঁধারি। ঢাকা শহরে বসে এই দৃশ্য ভাবাই যায় না। তবে বড় বেশি নির্জন। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। কিন্তু সেই ঝিঁঝিঁর ডাকও ম্যাজিকের মতো হঠাৎ করে থেমে যাচ্ছে। সেই সময়টা বেশ অদ্ভুদ মনে হয়। সবাই যেন বিরাট কোনো ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করছে। বইপত্র পড়ে আমার ধারণা হয়েছিল শিয়াল বোধহয় প্রহরে প্রহরে ডাকে। এই ধারণাও দেখলাম সত্যি না। সারাক্ষণই শিয়াল ডাকছে। সেই ডাকের মধ্যে একটা দারুন ব্যাপার আছে, শুনতে ভালো লাগে।
ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে নিয়ে আবার এসে বসলাম বারান্দায়। আর তখন দেখলাম কালিপদ আসছে। তার হাতে একগাদা এঁটো বাসনকোসন। সম্ভবত পুকুরে ধোবে।
‘এই কালিপদ!’
‘আদাব স্যার।‘
‘একটু শুনে যাও তো!’
কালিপদ এগিয়ে এসে মাথা নুইয়ে প্রণাম করল। হিন্দুদের প্রণামের এই ভঙ্গিটি বেশ সুন্দর।
‘রাত দুপুরে ধুতে যাচ্ছ নাকি?’
‘হ স্যার।‘
‘আচ্ছা, তুমি কি সিরাজউদ্দিন সাহেবের বাসা চেন?’
‘আজ্ঞে চিনি।‘
‘কতদূর?’
‘দুই মাইলের উপরে হইব।‘
‘কালিপদ, তুমি একটা কাজ করতে পারবে?’
‘ নিশ্চয় পারব স্যার, বলেন।‘
‘তুমি কি আমাকে ওঁর বাসায় নিয়ে যেতে পারবে?’
কালিপদ অবাক হয়ে বলল, এখন?
‘হ্যাঁ এখন। তুমি তোমার কাজ সেরে আসো, তারপর যাব।‘
‘আমি উনারে ডাইকা নিয়ে আসি?’
‘না ডেকে আনতে হবে না।। আমিই যাব। তোমার কোন অসুবিধা আছে?’
‘আজ্ঞে না, অসুবিধা নাই। আমি আসতাছি।
সিরাজউদ্দিনের বাসায় যাবার ব্যাপারটা যে আমি ঝোঁকের মাথায় করলাম তা না। আমার নিশ্চিত ধারণা হয়েছে যে সিরাজউদ্দিনের সঙ্গে আমার হঠাৎ ভয় পাবার একটা সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক বের করতে না পারলে আজ রাতেও আমার ঘুম হবে না। আধিভৌতিক কোন ব্যাপারেই আমার বিশ্বাস নেই। কার্যকারণ সম্পর্ক ছাড়া এ-পৃথিবীতে কিছুই ঘটে না। বস্তুজগতের প্রতিটি বস্তুকেই নিউটনের গতিসূত্র মানতে হয়।
ডালভাঙ্গা ক্রোশ বলে একটা কথা বইপত্রে পড়েছি। আজ রাতে সেটা বাস্তবে জানা গেল। হাঁটছি তো হাঁটছিই। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করছি, কালিপদ আর কতদূর? সে তার উত্তরে ফোঁৎ জাতীয় একটা শব্দ করছে। লোকটি কথা কম বলে, কথাবার্তা হ্যাঁ না-র মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিংবা কে জানে গ্রামট্রামের দিকে হয়তো চলতি অবস্থায় কথা কম বলার নিয়ম। তার উপর লক্ষ করলাম লোকটি একটু ভীতু টাইপের, কোন শব্দ হতেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমি যখন বলছি – কি হল কালিপদ? তখন আবার হাঁটা শুরু করছে। আমি আগেও দেখেছি দারোয়ানরা সবসময় ভীতু ধরণের হয়।
একসময় আমরা ছোটখাটো একটা নদীর ধারে চলে এলাম। বর্ষাকালে এর চেহারা রমরমা থাকলেও থাকতে পারে, এখন দেখাচ্ছে সরু ফিতার মতো। পায়ের পাতাও হয়তো ভিজবে না।
‘কালিপদ, নদীর নাম কি?’
‘বিরুই নদী।‘
‘বিরুই চালের কথা শুনেছি, এই নামে যে নদীও আছে কে জানত! নদী পার হতে হবে?’
‘আজ্ঞে না।‘
‘এসে পড়েছি নাকি?’
‘হ।‘
সে হ বলেও থামছে না। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে না কোথাও থামবে। মনে হচ্ছে এটা আমাদের অনন্ত যাত্রা। সিরাজউদ্দিনের সঙ্গে কথাবার্তা কি বলব কিছুই ঠিক করিনি। আগে থেকে ঠিকঠাক করে গেলে কোনো লাভ হয় না। আসল কথা বলবার সময় ঠিক করে রাখা কথা একটাও মনে আসে না। কতবার এরকম হয়েছে। যৌবনে জরি নামের একজন কিশোরীর সঙ্গে বেশ ভালো পরিচয় ছিল। খুব সাহসী মেয়ে। সে নিজ থেকেই একবার আমাকে খবর পাঠাল আমি যেন সন্ধ্যাবেলায় তাদের ছাদে অপেক্ষা করি। সারাদিন ভাবলাম ছাদের নির্জনতায় কিসব কথা বলব। কতটুকু আবেগ থাকবে। কোন পর্যায়ে হাতে হাত রাখব। বাস্তবে তার কিছুই হল না। প্রচন্ড ঝগড়া বেধে গেল। জরি কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ছোটলোক। আমি কড়া গলায় বললাম, আমি ছোটলোক না, ছোটলোক হচ্ছ তুমি। শুধু তুমি একা না, তোমার বাড়ির সবাই ছোটলোক। এবং তোমার বড় মামা একটা ইতর। আবেগ ভালোবাসার একটি কথাও দুজনের কেউ বললাম না।
‘স্যার, এই বাড়ি।‘
আমি থমকে দাঁড়ালাম। ছোট্ট একটা টিনের ঘর। কলাগাছ দিয়ে ঘেরা। খড়-পোড়ানো গন্ধ আসছে। পরিষ্কার ঝকঝকে উঠান। উঠানে দাঁড়াতেই কুকুর ডাকতে লাগল। চোর ভেবেছে বোধহয়। ভেতর থেকে সিরাজউদ্দিন চ্যাঁচাল, কে কে? কালিপদ বলল, দরজাটা খুলেন। আমি কালিপদ। দরজা সঙ্গে সঙ্গে খুলল না। হারিকেন জ্বালানো হল। তাতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। সিরাজউদ্দিন একটি লুঙ্গি পরে খালিগায়ে বের হয়ে এল। চোখ কপালে তুলে বলল, স্যার আপনি?
‘দেখতে এলাম আপনাকে।‘
‘কেন?’
‘কোনো কারণ নেই। ঘুম আসছিল না, ভাবলাম দেখি রাতের বেলা গ্রাম কেমন দেখা যায়। আপনি বোধহয় শুয়ে পড়েছিলেন? ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?’
‘জী।‘
‘খুব লজ্জিত, কিছু মনে করবেন না।‘
‘আসেন, ভেতরে এসে বসেন।‘
সিরাজউদ্দিন সাহেবের বিস্ময় এখনও কাটেনি। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, কোনো ঝামেলা হয়েছে স্যার?
‘ না না, ঝামেলা কি হবে? বেড়াতে এসেছি। একটু অসময়ে চলে এলাম এই আর কি!’
‘না না, ঝামেলা কি হবে? বেড়াতে এসেহি। একটু অসময়ে চলে এলাম এই আর কি!’
‘স্যার, একটু চা করি?’
‘অসুবিধা না হলে করেন।‘
‘না না, কোনো অসুবিধা নাই। কোনো অসুবিধা নাই।‘
সিরাজউদ্দিন সাহেব ছুটাছুটি শুরু করলেন। উঠোনে চুলা জ্বালানো হল। কালিপদ দেখলাম টাকা নিয়ে আবার ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। হয়তো চা বা চিনি নেই, আনতে গেছে। এই রাতদুপুরে কোথায় এসব পাবে কে জানে!
‘সিরাজউদ্দিন সাহেব!’
‘জী স্যার?’
‘লোকজন দেখছি না যে? আপনি একাই থাকেন নাকি?’
‘বিয়েশাদি তো করি নাই।‘
‘করেননি কেন?’
‘ভাগ্যে ছিল না। কষ্টের সংসার ছিল। নিজেই খেতে পেতাম না।‘
‘এখন তো বোধহয় অবস্থা সেরকম না।‘
‘জী এখন মাশাআল্লাহ সামলে উঠেছি। কিছু জমিজমাও করেছি।‘
‘তা-ই নাকি?’
‘অতি অল্প। ধানি জমি।‘
‘একা একা থাকেন ভয় লাগে না?’
‘ভয় লাগবে কেন?’
সিরাজউদ্দিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমি খানিকটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। ভয়ের ব্যাপারটা নিয়েই আমি আলাপ করতে চাই। কিন্তু কিভাবে সেটা করা যায়? আমি ইতস্তত করে বললাম, আপনি ভূত বিশ্বাস করেন?
জী না। এইসব হচ্ছে কুসংস্কার। এই গ্রামেই একটা রেন্ট্রি গাছ আছে। লোকে নানান কথা বলে। কী কী নাকি দেখে। আমি কোনোদিনই দেখি নাই। রাতবিরাতে কত যাওয়া-আসা করেছি।
চা তৈরি হয়েছে। চিনি ছিল না। খেজুর রসের চা। চমৎকার পায়েস পায়েস গন্ধ। কাপে চুমুক দিতে সিরাজউদ্দিন বললেন, তবে জিন বলে একটা জিনিস আছে।
আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম, আপনি বিশ্বাস করেন?
‘করব না কেন? কোরান শরিফে পরিষ্কার লেখা জিন এবং ইনসান। হাশরের দিনে মানুষের যেমন বিচার হবে, জিনেরও হবে।‘
‘আপনি জিন দেখেছেন কখনো?’
‘জী না। সাধারণ লোকে দেখে না।‘
আই দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম। সিরাজউদ্দিন লোকটি আসলেই সাধারণ। কোনোরকম বিশেষত্ব নেই। আমার হঠাৎ ভয়ের সঙ্গে এই লোকটিকে কিছুতেই জড়ানো যাচ্ছে না। সরাসরি এই প্রসঙ্গটা আনাও মুশকিল। তবু একবার বললাম, আপনি চলে আসার পর ঐ রাতে কেমন যেন হঠাৎ করে ভয় পাই।
সিরাজউদ্দিন সাহেব সঙ্গে সঙ্গে উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, সাপ জিনিসটা তো ভয়েরই। ভয় পাওয়াটা ভালো। তাহলে সাবধানে চলাফেরা করবেন। অসাবধান হলেই সর্বনাশ। রাতে বের হলে টর্চলাইটটা সঙ্গে রাখবেন। শব্দ করে পা ফেলবেন।
বিদায় নিতে রাত একটা বেজে গেল। সিরাজউদ্দিন আমার সমস্ত আপত্তি অগ্রাহ্য করে এগিয়ে দিতে এলেন। তিনি এলেন বিরুই নদী পর্যন্ত। চাঁদের আলো আছে। চারদিক স্পষ্ট দেখা যায়। তবু তিনি জোর করে কালিপদের হাতে একটা হারিকেন ধরিয়ে দিয়ে উল্টোদিকে রওনা হলেন। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। যতক্ষণ তাঁকে দেখা যায় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। যেই মুহূর্তে তিনি বাঁশবনের আড়ালে পড়লেন ঠিক সেই মুহূর্তে আবার সেই রকম হল। অন্ধ যুক্তিহীন ভয়। যেন ভয়ংকর অশুভ একটা কিছু আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে ছুটে আসছে। সেই অশুভ জিনিসটাকে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু আমি রক্তের প্রতি কণিকায় তাকে অনুভব করছি। এর ক্ষমতা অসাধারণ। এ অন্য জগতের কেউ। এ-জগতে তাকে কেউ জানে না। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় কাঁপিয়ে দিয়ে ভয়টা চলে গেল। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে লক্ষ করলাম আমি মাটিতে বসে আছি। কালিপদ আমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলছে, কি হইল স্যার? কী হইল?
‘কিছু হয়নি। মাথাটা কেমন যেন করল।‘
‘মাথা ধুইবেন স্যার? নদীর পানি দিয়া…।‘
‘মাথা ধুতে হবে না। চলো রওনা দিই।‘
বলেও রওনা দিতে পারলাম না। ভয় একেবারেই নেই কিন্তু শরীর অবসন্ন। অসম্ভব ঘুম পাচ্ছে।
‘কালিপদ!’
‘যে আজ্ঞে?’
‘একটু আগে তোমার কি কোনো ভয়টয় লেগেছে?’
‘জে না।‘
‘ও আচ্ছা! চলো আস্তে আস্তে হাঁটি।‘
কালিপদ বারবার মাথা ঘুরিয়ে আমাকে দেখছে। পাগল ভাবছে কি না কে জানে! ভাবলেও তাকে দোষ দেয়া যায় না। যে-লোক মাঝরাত্রিতে বেড়াতে বের হয়, অকারণে ভয় পেয়ে আধমরা হয়ে যায় সে আর যা-ই হোক খুব সুস্থ নয়।
পরের দিনটা আমার খুব খারাপ কাটল। কিছুতেই মন বসাতে পারি না। ভাইভা শুরু হয়েছে। ছাত্রদের প্রশ্নের জবাবগুলিও ঠিকমতো শুনছি না। বি.এস-সি পরীক্ষা দিতে এসে একজন দেখি সোডিয়াম ক্লোরাইডের ফরমুলাতে দুটি ক্লোরিন অ্যাটম দেখাচ্ছে। প্রচন্ড রাগ হবার কথা। রাগও হচ্ছে না। পাস নম্বর দিয়ে বিদায় করে দিচ্ছি। কেমিস্ট্রির হেড বললেন, আপনার কি শরীর খারাপ?
আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, হ্যাঁ, কিছুতেই মন বসছে না। খুব টায়ার্ড লাগছে।
‘রাতে ঘুম কেমন হয়েছে?’
‘ঘুম ভালোই হয়েছে।‘
‘যদি হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাস করেন তাহলে এক ডোজ ওষুধ দিতে পারি।‘
আমি বিরক্ত স্বরে বললাম, আপনি কি হোমিওপ্যাথিও করেন?
‘জী। ছোটখাটো একটা ডিসপেনসারি আছে। রুগীটুগি ভালোই হয়।‘
মফস্বল কলেজের টিচারদের এই এক জিনিস। একটিমাত্র পেশায় তাঁরা খুশি নন। প্রত্যেকের দ্বিতীয় কোনো পেশা আছে। কোন পেশাটি প্রধান বোঝা মুশকিল।
‘কী স্যার, হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাস আছে?’
‘জী না, ভূতপ্রেত এবং হোমিওপ্যাথি এই তিন জিনিস আমি বিশ্বাস করি না। আপনি কিছু মনে করবেন না।‘
ভদ্রলোক মুখ কালো করে বললেন, হোমিওপ্যাথি বিশ্বাস করেন না কেন? এটা তো হাইলি সাইন্টিফিক ব্যাপার। হ্যানিম্যান সাহেবের কথাই ধরেন। উনি নিজে একজন পাস-করা ডাক্তার ছিলেন।
হোমিওপ্যাথির বিরুদ্ধে আমি একগাদা কথা বলতে পারতাম। টু হান্ড্রেড পাওয়ারের একটি ওষুধে যে আসলে কোনো ওষুধই থাকে না সেটা মোলার কনসাইট্রেশন এবং অ্যাবাগেড্রো নাম্বার দিয়ে সহজেই প্রমাণ করা যেত। তর্কের ক্ষেত্রে সব সময় তাই করি। আজ ইচ্ছা করছে না। পাঁচটা বাজতেই উঠে পড়লাম। পরীক্ষা তখনো ছলছে – চলতে থাকুক। আমি বললাম, আপনারা ভাইভা শেষ করে দিন, আমি ঘরে চলে যাব।
‘প্রিন্সিপাল সাহেবের বাসায় আপনার না চা খাওয়ার কথা?’
ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে পড়ায় মেজাজ আরো খারাপ হল। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। তবু যেতে হবে।
প্রিন্সিপাল সাহেবও দাওয়াতের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। আমাকে দেখে অনেক্ষণ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, ও আচ্ছা আচ্ছা। আসুন আসুন। চা খেতে বলেছিলাম তা-ই না? কিচ্ছু মনে নেই। আসুন বারান্দায় বসি। নানান ঝামেলায় আছি ভাই।
তিনি আমাকে বসিয়ে রেখে ভিতরে চলে গেলেন। অনেক্ষণ তাঁর কোন সারা পাওয়া গেল না। দরজার ধরে পাঁচ-ছ’বার বয়সের মিষ্টি চেহারার একটি মেয়ে কৌতূহলী চোখে আমাকে দেখছে। এক সঙ্গে দু-একটা কথা বলা উচিত কিন্তু ইচ্ছে করছে না। বাড়ির ভেতর থেকে হিংস্র পশুর গর্জনের মতো গর্জন কানে আসছে। একটি মেয়েও কাঁদছে। কখনো কখনো কান্না থেমে যাচ্ছে আবার শুরু হচ্ছে। এইরকম অবস্থায় চায়ের জন্যে অপেক্ষা করাটাও অপরাধ।
‘অনেক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। ছেলেটা বড় ঝামেলা করছে। শুনেছেন বোধহয়?’
‘জী শুনেছি।‘
‘ভালো খবর কেউ কখনো শোনে না, কিন্তু এইসব খবর সবাই শুনে ফেলে। নিতান্ত অপরিচিত লোকও এসে গায়ে পড়ে বিচিত্র সব চিকিৎসার কথা বলে।‘
আমি চুপ করে রইলাম। প্রিন্সিপাল সাহেব তিক্ত গলায় বললেন, সেই জাতীয় চিকিৎসা এখন হচ্ছে। সাত নদীর পানিতে গোসল। ঠান্ডায় গোসল দিয়ে নিউমোনিয়া বাধাবে।
‘ডাক্তারি চিকিৎসা করাচ্ছেন না?’
‘তাও আছে। বৈজ্ঞানিক-অবৈজ্ঞানিক সব রকম চিকিৎসাই চলছে। কোনোটাই কাজে লাগছে না।‘
‘অসুখটা শুরু হল কিভাবে?’
প্রিন্সিপাল সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। এই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে হয়তো তাঁর ইচ্ছে করছে না। চা চলে এল। শুধু চা নয়। মিষ্টি, শিঙ্গাড়া, কচুরি।
‘নিন চা নিন। খিদে না থাকলে এই খাবারগুলি খাবেন না, সবই দোকানের কেনা। এদিকে আবার খুব ডায়রিয়া হচ্ছে।‘
চা-টা চমৎকার। এক চুমুক দিয়েই মাথাধরাটা অনেকখানি সেরে গেল। প্রিন্সিপাল সাহেব অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, কি করে অসুখটা শুরু হল সত্যি জানতে চান?
‘বলতে ইচ্ছে না করলে থাক।‘
‘না না শুনুন। গত বছর গরমের সময় আমার এই ছেলে তার বউকে নিয়ে এখানে আসে। আমি অনেকদিন থেকেই আসতে বলছিলাম, ছুটি পায় না আসতে পারে না। ব্যাংকের চাকরি ছুটিছাটা কম। সাত দিনের ছুটি নিয়েন এসেছে। আমি এখানে এসেছি দু’বছর আগে। ছেলে প্রথম এল। আমরাও খুব খুশি।
রাত্রিবেলা বেশ গল্পগুজব করছি। সিরাজউদ্দিন এসেছে। সাপের গল্পটল্প করছে। রাত দশটার দিকে সিরাজউদ্দিন চলে যেতেই ছেলে যেন কেমন হয়ে গেল। থরথর করে কাঁপছে। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে। কোনোমতে বলল, তার নাকি অসম্ভব ভয় লাগছে। তখন কিছু বুঝতে পারিনি, এখন বুঝছি ঐ রাতেই তার পাগলামির প্রথম শুরু।
প্রিন্সিপাল সাহেব চুপ করে রইলেন। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে শুনছি। আমার শরীর দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। পিপাসায় বুক শুকিয়ে কাঠ। প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, কয়েকদিন পর আবার এরকম হল। সেও রাতের বেলা। কলেজের কিছু প্রফেসরকে খেতে বলেছিলাম। তাঁরা খাওয়াদাওয়া করে চলে যাবার পর আবার আমার ছেলে ঐরকম করতে লাগল।
আমি ক্ষীণস্বরে বললাম, সিরাজউদ্দিন সাহেবেরও দাওয়াত ছিল?
‘হ্যাঁ ছিল। কলেজ স্টাফের সবাইকে বলেছিলাম।‘
‘তারপর কি হল বলুন।‘
‘আর বলার কিছু নেই। রোজই ওরকম হতে লাগল।‘
‘কখন হতো?’
‘রাত দশটা সাড়ে দশটা।‘
আমি কোনো কথা না বলে পরপর দুটো সিগারেট শেষ করলাম। চা খাওয়া হয়ে গিয়েছে, এখন আমার চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু যেতে পারছি না। আমি নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললাম, সিরাজউদ্দিন সাহেব কি প্রায়ই আসে নাকি এখানে?
‘আসে। আমার ছোটছেলেটাকে প্রায়ভেট পড়ায়। সিনসিয়ার লোক। রোজ সাতটার সময় আসে, রাত দশটা সাড়ে দশটার আগে যায় না।‘
‘আমি কি আপনার ছেলেটাকে একটু দেখতে পারি?’
তিনি বেশ অবাক হলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে। আমি তাঁর সঙ্গে গেলাম। না গেলেই ভালো করতাম। সাতাশ আটাশ বছরের একটা ছেলে। দড়ি দিয়ে বাঁধা। কী যে অসহায় লাগছে। ছেলেটি আমার দিকে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, একে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করান।
‘ঢাকাতেই তো ছিল। কোনোরকম উন্নতি হয় না। টাকার শ্রাদ্ধ। এখানে বরঞ্চ ভালো আছে। সিরাজউদ্দিনের সঙ্গে বেশ খাতির। সে এলে শান্ত থাকে। প্রায় স্বাভাবিক আচরণ করে।‘
‘তা-ই নাকি?’
‘জী। কয়েকদিন ধরে সিরাজ আসছে না। আপনাকে নিয়ে ব্যস্ত। তাই ছেলেটার উগ্র স্বভাব হয়ে গেছে। গত পরশু বটি নিয়ে তার মাকে কাটতে গিয়েছিল।‘
‘সিরাজউদ্দিন সাহেবের সাথে কথাটথা বলে?’
‘না, কথাটথা কিছু না। চুপচাপ থাকে, ও এলে খুশি হয় এইটা বুঝি। মুচকি মুচকি হাঁসে। সিরাজউদ্দিন গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে একেবারে শান্ত হয়ে যায়।‘
আমি তাকিয়ে আছি ছেলেটির দিকে। সে গোঙ্গানির মতো একটা চাপা শব্দ করছে। মুখ থেকে অনবরত লালা বেরুচ্ছে। মুখ ঈষৎ হাঁ হয়ে আছে। একটু আগেই তাকে অসহায় লাগছিল, এখন সেরকম লাগছে না। বরং কেমন যেন ভয়ংকর লাগছে।
আমি ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বললাম, প্রিন্সিপাল সাহেব, আমাকে আজ রাতেই ঢাকা চলে যেতে হচ্ছে।
‘কী বললেন?’
‘আমি কিছুতেই থাকতে পারছি না। কেন পারছি না সেই কারণও আপনার কাছে ব্যাখ্যাআ করতে পারছি না। কোনদিন পারবো বলেও মনে হয় না।‘
‘আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।‘
‘আপনি পরীক্ষা কয়েকদিন পিছিয়ে দিন। নতুন এগজামিনার এসে বাকিটা শেষ করবে।‘
‘অসম্ভব কথা আপনি বলছেন।‘
‘তা বলছি। কিন্তু আমাকে যেতেই হবে।‘
সেই রাতেই আমি ঢাকা চলে আসি। এই অস্বাভাবিক ঘটনাটি স্মৃতি থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলি। নিজেকে বোঝাই যে সমস্তটাই ছিল উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা। গ্রামে নির্জনতা কোনো-না-কোনোভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছিল।
এই ঘটনার প্রায় চার বছর পর সিরাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা। আমি তাঁকে চিনতে পারিনি। তিনি বায়তুল মোকাররমের ফুটপাত থেকে উলেন সোয়েটার কিনছিলেন। তিনি আমাকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন।
‘স্যার, আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি সিরাজ।‘
‘চিনতে পেরেছি।‘
‘ঐ বার স্যার কাউকে কিছু না বলে হুট করে চলে এলেন। পরীক্ষা এক মাস পিছিয়ে গেল। কী দুর্দশা ছাত্রদের। গরিবের ছেলেপুলে।‘
আমি কঠিন স্বরে বললাম, আপনারা সবাই ভালো তো?
‘জী ভালো।‘
‘প্রিন্সিপাল সাহেব, উনি ভালো আছেন?’
‘উনার খবরটা জানি না। ছেলেটা মারা যাওয়ার পর চাকরী ছেড়ে দিয়ে জামালপুরে চলে গেলেন।‘
‘ছেলেটা মারা গেছে বুঝি?’
‘জী, বড়ই দুঃখের কথা। পাগল মানুষ বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথায় চলে গেল। নানান জায়গায় খোঁজাখুঁজি। তিন দিন পর নদীতে লাশ ভেসে উঠেছে। আমিই খুঁজে পাই। আমার বাড়ির পাশের ঘাটে গিয়ে লেগেছিল।‘
‘তা-ই বুঝি?’
‘জী স্যার। খুবই আফসোসের কথা।‘
‘এখন কি নতুন প্রিন্সিপাল এসেছেন?’
‘জী, খুবই ভালো লোক। প্রায়ই যাই উনার বাসায়। আমাকে খুব আদর করেন। উনার সঙ্গে গল্পগুজব করি।‘
‘খুবই ভালো কথা।‘
‘তবে স্যার অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন? নতুন প্রিন্সিপাল সাহেবের স্ত্রী মাঝে মাঝে বিনা কারণে ভয় পেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করেন। অবিকল আগের প্রিন্সিপাল সাহেবের ছেলের মতো অবস্থা। মনে হয় বাড়িটার একটা দোষ আছে।‘
আমি কঠিন চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সিরাজউদ্দিন বলল, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে বড় ভালো লাগছে স্যার। আপনার কথা আমার প্রায়ই মনে হয়।
সিরাজউদ্দিন হাসল। তার হাসিতে শিশুর সারল্য। চোখ দুটি মমতায় আর্দ্র।
“ছায়াসঙ্গী” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ