যেনো এক পৌরাণিক পৃথিবীতে আছি, এমন মনে হয় আজকাল; আছি যেনো টলেমিরও অনেক আগের এক পুরাণাচ্ছন্ন পৃথিবীতে, যাকে ঘিরে ঘুরছে সূর্যতারা, যেনো স্থির হয়ে আছে পৃথিবী, বিশ্বের কেন্দ্র, তাকে ঘিরে আছে সাত আসমান, স্ফটিকের গোলকের পর গোলক; শেষে তারার গোলকের পর আছে সর্বশক্তিমান পৌরাণিক বিধাতারা, তাদের দেবদূতেরা। আবার হয়ে উঠেছি আমরা এক বদ্ধ বিশ্বের অধিবাসী, এমন অন্ধকার নেমেছে। সাধারণ মানুষ জানেই না সূর্য নামের মাঝারি একটি তারাকে ঘিরে ঘুরছে পৃথিবী ও আরো আটটি গ্রহ; রয়েছে নক্ষত্রপুঞ্জের পর নক্ষত্রপুঞ্জ- অসংখ্য তারার দ্বীপপুঞ্জ; কিন্তু যারা জানে, পড়েছে পৃথিবী ঘোরে সূর্যকে ঘিরে, তারাও আজ তা ভুলতে বসেছে। এখন শিক্ষিতদেরও যদি জিজ্ঞেস করি- আপনার কী মনে হয়, পৃথিবী কি ঘোরে?- সম্ভবত শতকরা পঞ্চাশজন বলবেন ঘোরে না, বিশজন বলবেন তাঁরা নিশ্চিত নন, দশজন বলবেন ঘোরে, এবং বিশজন ক্রুদ্ধ হয়ে আক্রমণ করবেন প্রশ্নকারীকে- কেননা প্রশ্নটিই আপত্তিকর । যাঁরা বইয়ে পড়েছেন পৃথিবী ঘোরে, তাঁদের অধিকাংশই এখন কথাটি বিশ্বাস করেন না; বা মনে করেন কথাটি বিজ্ঞানের নয়, পবিত্র বইয়ের। পৌরাণিক জগতে ফিরে যাচ্ছি আমরা, পৌরাণিক রহস্যে ভ’রে ফেলছি সব কিছু, আমাদের ঘিরে দুলছে পৌরাণিক পর্দা। বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ শতাব্দীটিতে চারপাশ হয়ে উঠছে মননশীলতাবিরোধী, প্রশংসিত হচ্ছে কুসংস্কার, আক্রান্ত হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্কতা । বিজ্ঞান এখন এগিয়েছে অনেক দূর; মানুষ বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো ব্যবহার করছে উল্লাসে, আর দিকে দিকে দমন করছে বিজ্ঞানমনস্কতা। বিজ্ঞান যাঁদের পেশা বঙ্গে, তাঁদেরও অধিকাংশ জীবনে পৌরাণিক; বিজ্ঞানের আলোর বদলে পুরাণের অন্ধকারে থাকতেই তাঁরা পছন্দ করেন। মহাবিশ্ব আজ খুবই পরিচিত এলাকা; গত কয়েক শতকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বকে নিজেদের পল্লীর মতোই উদ্ঘাটন করেছেন । মহাবিশ্ব চমকপ্রদ এলাকা বৈজ্ঞানিকভাবে, মহাবিশ্বকে জানার অর্থ হচ্ছে বিস্ময়ের পর বিস্ময়ের মুখোমুখি হওয়া, কিন্তু এখানে নেই কোনো পৌরাণিক রহস্য । আমরাও আছি মহাবিশ্বেই, ঘুরছি আকাশমণ্ডলে । মহাবিশ্ব আমার প্রিয় বিষয়, কিন্তু এ-সম্পর্কে বই লিখবো ভাবি নি; লিখতে হলো আনন্দ থেকে, এবং একটি বাসনা থেকে- হয়তো এ-বই কিছুটা দূর করবে পৌরাণিক রহস্যের অন্ধকার । দ্বিতীয় সংস্করণে খুব সামান্যই, একটি-দুটি শব্দ, বদল করা হলো, এবং শুদ্ধ ক’রে দেয়া হলো কয়েকটি মুদ্রণপ্রমাদ।
হুমায়ুন আজাদ
১৪ই ফুলার রোড
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা
২ চৈত্র ১৪০৬ : ১৫ মার্চ ২০০০
“মহাবিশ্ব” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ