সৃষ্টির আদিতে কিছুই ছিল না ইহসংসারে – এক শূন্য ছাড়া। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে ‘শূন্য’ থেকেই সবকিছুর উৎপত্তি। অর্থাৎ ‘নাই’তেই ‘আছে’র জন্ম। ধাঁধাঁর মতো লাগছে তো? ধাঁধাই বটে, কিন্তু মিথ্যে নয়। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যার মহাপণ্ডিতদের দৃঢ় বিশ্বাস যে তার সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রকৃতির মাঝেই প্রতীয়মান শুধু নয়, বহুলাংশে দৃশ্যমানও।

এই ;শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইটি সেই আধুনিক বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্যপ্রমাণগুলোর গ্রন্থিত রূপ। এই বইটির লেখকদের একজন পেশাগত জীবনে গণিতবিদ, এবং অন্যজন পেশায় প্রকৌশলী এবং পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে জনপ্রিয় ধারার লেখালিখির সাথে জড়িত। শূন্য নিয়ে দুজনেরই আগ্রহ অসীম। বাংলা ব্লগে, পত্রপত্রিকায় এবং অন্যত্র বহু প্রবন্ধ আমরা লিখেছি শূন্যের মায়াবী রহস্য নিয়ে। আমাদের একজন গণিতবিদের চোখ দিয়ে শূন্যতাকে দেখেছে, অন্যজন পদার্থবিজ্ঞানের চোখ দিয়ে। এই বইটি আমাদের দুই শ্যেনদৃষ্টির সম্মিলন।

হ্যাঁ, শূন্য নিয়ে বরাবরই আমাদের দুর্বিনীত কৌতূহল। শূন্য যেন আমাদের দিয়েছে অসীমকে জানার প্রেরণা। আসলে শূন্য আর অসীম একইসাথে পরস্পরের প্রতিচ্ছবি ও প্রতিপক্ষ। দুয়ে মিলে রচনা করেছে সংসারের গূঢ়তম রহস্যের আধার।  প্রাচীন গ্রিক দর্শনে এরা সৃষ্টি করেছিল বিতর্ক এবং সংশয়, ভারতীয় চিন্তায় আধ্যাত্মবাদ ও দৈবাত্মার দ্বৈতসত্ত্বাবোধ, এবং সেই বোধেরই ফলে গঙ্গার কল্যাণবহ সলিল ধারার মতো জন্ম নিয়েছে গণিতের ‘শূন্য’। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও আর শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি যে গণিতকে ‘প্রকৃতির ভাষা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, তা এমনি এমনি নয়। গণিতের পাশাপাশি বইয়ে এসেছে পদার্থবিজ্ঞানের শূন্যতার ধারনাও। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের চোখে শূন্যতাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। কোয়ান্টাম জগতের শূন্যতা এখনো আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জন্য এক মূর্তিমান রহস্যের আঁধার, বিশ্বব্রহ্মান্ডের উৎপত্তি রহস্য উদ্ঘাটনের স্বপ্নের জীয়নকাঠি। তাই শূন্য ব্যাপারটা চির-পুরাতন হয়েও যেন চিরনবীন। স্টিফেন হকিং, স্টিফেন ওয়েনবার্গ, অ্যালেন গুথ, আদ্রে লিন্ডে, আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিন, লরেন্স ক্রাউস সহ মূলধারার প্রায় সকল পদার্থবিজ্ঞানী আজ মনে করেন, আমাদের এই মহাবিশ্ব একটি ‘কোয়ান্টাম ঘটনা’ হিসেবেই এক সময় আত্মপ্রকাশ করেছিল কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে একেবারে ‘শূন্য’ থেকে। পশ্চিমে বিগত কয়েক বছরে এই ধারণার ওপর গবেষণাপত্র তো বটেই, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় ধারার বিজ্ঞানের বইও প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো লিখেছেন এ বিষয়টি নিয়ে হাতে-কলমে কাজ করা প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে এম.আই.টির অধ্যাপক অ্যালেন গুথের ‘The Inflationary Universe’, রুশ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিনের ‘Many Worlds in One’, বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-ম্লোডিনোর ‘The Grand Desaign’, বিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউসের ‘Universe from Nothing’ বইগুলো উল্লেখযোগ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলায় এই বহুল আলোচিত ধারণাটির ওপর কোনও পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ এর আগে প্রকাশিত হয়নি। আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের এই ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইটি সেই অভাব অনেকাংশে পূরণ করবে।

বইটি লেখার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য আমাদের- বাংলাভাষী কিশোর ও তরুণদের মধ্যে আগ্রহ ও কৌতূহল সংক্রমিত করা। আজকের দিনের ছেলেমেয়েদের অনেকেই গণিত অলিম্পিয়াড কিংবা পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াড অংশ নিয়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জল করছে, কিংবা ভবিষ্যতেও করবে। অনেকেই হয়তো বড় হয়ে পদার্থবিজ্ঞান কিংবা গণিত নিয়ে পড়াশোনা করবে। ধারণা করি তারা ‘শূন্য’ কে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে শিখবে আমাদের এ বইটি পড়ার পর। ‘গণিত’ অথবা ‘বিজ্ঞান’ কোনো ভীতিকর জন্তুর নাম নয়- এরা জীবনের প্রতিটি আনাচে-কানাচে বন্ধুর মতো, প্রিয়জনের মতো, প্রতিক্ষণে উপস্থিত।

তবে বইটি কেবল শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা ভাবলে বিরাট ভুল হবে। বইটিতে ঘটানো হয়েছে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে আধুনিক ধারণাগুলোর সমাবেশ। সে ধারণাগুলোর অনেকগুলোতেই রয়েছে জটিল গাণিতিক বিমূর্ততা। সেগুলো সাধারণ পাঠকদের জন্য জনবোধ্য ভাষায় প্রকাশ করা অনেকাংশেই দুরুহ। তার পরও আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের সাধ্যমতো। আমরা মনে করি বইটি সকল বয়সের পাঠকদেরই তৃপ্ত করবে যারা গণিত ও বিজ্ঞান ভালোবাসেন। বিশেষ করে যারা দর্শন, গণিত ও বিজ্ঞানের প্রান্তিক সমস্যাগুলো নিয়ে উৎসাহী; আর এ নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীদের কাজের হদিস পেতে আগ্রহী, তারা এই বইটিতে ভাবনার অনেক নতুন উপকরণ খুঁজে পাবেন।

আমাদের বইয়ের বেশ কিছু অংশ মুক্তমনা ব্লগে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধগুলো প্রকাশের সময় আমরা পাঠকদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। তাদের প্রতিক্রিয়াগুলো পান্ডুলিপির সংশোধন ও মানোন্নয়নে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। মুক্তমনা ছাড়াও বিডিনিউজ২৪ এবং ‘জিরো টু ইনফিনিটি’ পত্রিকায় বইটির কিছু কিছু অংশ প্রকাশিত হয়েছে। ফেসবুকে অনেক সময়ই ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইটির পেজটিকে ঘিরে চলেছে নিরন্তর আলোচনা। অনেকেই ইমেইল করে বা ম্যাসেজ দিয়ে বইটি প্রকাশের তাগাদা দিয়েছেন। বিশেষ করে আমেরিকা প্রবাসী জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও সুলেখক ড. দীপেন ভট্টাচার্যের কথা আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয়। তিনি পুরো পান্ডুলিপি গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন, জায়গায় জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীর প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁরই মূল্যবান সংযোজন ও পরামর্শগুলো বইটিকে প্রায় নিখুঁত করে তুলতে সাহায্য করেছে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ এসেছে অস্ট্রেলিয়া নিবাসী পদার্থবিদ ড. প্রদীপ দেবের কাছ থেকেও। তাঁদের মূল্যবান পরামর্শ বইটির মান বৃদ্ধি করেছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ফ্লোরিডা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইরতিশাদ আহমদ এবং উদীয়মান লেখক রায়হান আবীরের মূল্যবান অভিমতগুলোও প্রণিধানযোগ্য। ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ গ্রন্থের লেখক বন্যা আহমেদও পান্ডুলিপির মানোন্নয়নের ব্যাপারে নিরলস ভাবে সাহায্য করেছেন। পান্ডুলিপিতে থেকে যাওয়া বহু জটিল বাক্য ভেঙ্গে-চুরে সহজ করে দিয়েছেন। তার এ সংশোধনগুলো বইটিকে দিয়েছে বাড়তি গতিময়তা। তাদের সকলের কাছেই আমরা ঋণী।

আমরা দুজন লেখক বয়সের বিচারে প্রায় ভিন্ন দুই জগতের অধিবাসী। আমাদের সময়, সমাজ, অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে লেখার ধরন পর্যন্ত বহু কিছুতেই ভিন্নতা আছে, ভিন্নতা আছে আমাদের উপস্থাপনের পদ্ধতিতেও। কাজেই দুই লেখকের লেখাকে এক সূত্রে গাঁথার প্রয়াস কষ্টসাধ্য হতে বাধ্য। তারপরও এটা সম্ভবপর হয়েছে সম্ভবত এই কারণে যে বয়স, দেশ ও কালের সীমারেখাকে অতিক্রম করে আমরা দুই লেখক চিন্তায়-চেতনায় খুব কাছাকাছি। মুক্তবুদ্ধি, বৈজ্ঞানিক চেতনা, যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদকে আমরা এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে মূলমন্ত্র মনে করি। আমরা দুজনেই চাই আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা কার্ল স্যাগান, স্টিফেন হকিং, আইনস্টাইন কিংবা জামাল নজরুল ইসলামের চোখ দিয়ে বিশ্বকে দেখুক, চন্দ্রপৃষ্ঠে কোনো অপমানবের ‘অলৌকিক মুখ’ দর্শন করে, কিংবা পুরনো ধর্মগ্রন্থের বাণীতে ‘আধুনিক বিজ্ঞান’ খুঁজে নয়। পেশাগত জীবনের পাশাপাশি জীবনের বড় একটা অংশ আমরা দুজনেই নিবেদন করেছি লেখালেখির জগতে, চেষ্টা করে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থাকতে। সে হিসেবে আমাদের লেখায় অমিলের চেয়ে মিলই বেশি। তার পরও যে সমস্ত জায়গায় পুরোপুরি ‘মিলিয়ে দেয়া’ সম্ভব হয়নি, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ব্যাপার চলে এসেছে, সেখানে সঠিক লেখককে সনাক্ত করতে বন্ধনীর মধ্যে নামের আদ্যক্ষর ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন মিজান রহমানের ক্ষেত্রে (মী.র), এবং অভিজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে (অ.রা)।

আমাদের বইটি উৎপত্তি ও অস্তিত্বের সাম্প্রতিকতম ধারণা নিয়ে। এই যে আমাদের চারিদিকের প্রকৃতি – চাঁদ, তারা, সূর্য, পৃথিবী, গাছপালা, পশুপাখি, মানুষজন – এই সবকিছু এল কোথা থেকে? এই ধরনের প্রশ্ন প্রতিটি যুগে বিজ্ঞানী, দার্শনিক থেকে শুরু করে কবি-সাহিত্যিকেরা করে গেছেন। এই ধরনের প্রশ্নের ধাক্কায় জীবনের কখনো না কখনো আমরা সবাই কমবেশি আলোড়িত হয়েছি। কেননা, এ প্রশ্নগুলো আসলে আমাদের অস্তিত্বের একদম গোড়ার প্রশ্ন।

আমরা আশা করছি, আমাদের এই বইটি থেকে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের দেওয়া সর্বশেষ উত্তর খুঁজে পাবেন পাঠকেরা। আমাদের বইটি পড়ে কারো ভালো লাগলে আমরা নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করব। কিন্তু বইয়ের কোথাও ভুলভ্রান্তি থাকলে সেই দায়ভার একান্তই আমাদের।

অধ্যাপক মীজান রহমান

ড. অভিজিৎ রায়

ফেব্রুয়ারি ২০১৪

♦ ড. মিজান রহমান

♦ অভিজিৎ রায়

♦ ভূমিকা

♦ শূন্য অধ্যায়ঃ অশূন্য মতামত

♦ প্রথম অধ্যায়ঃ কিছু না

♦ দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ শূণ্যের ভীতি

♦ তৃতীয় অধ্যায়ঃ পশ্চিমে নয়, পুবের দিকে

♦ চতুর্থ অধ্যায়ঃ শূন্য এল ইউরোপে

♦ পঞ্চম অধ্যায়ঃ প্রকৃতির শূন্যবিদ্বেষ ?

♦ ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ বিজ্ঞানে শূন্যের আভাস

♦ সপ্তম অধ্যায়ঃ আইনস্টাইনের বিশ্ব

♦ অষ্টম অধ্যায়ঃ শূন্যতার শক্তি

♦ নবম অধ্যায়ঃ মহাবিস্ফোরণের কথা

♦ দশম অধ্যায়ঃ বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল?

♦ একাদশ অধ্যায়ঃ কোয়ান্টাম শূন্যতা ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি

♦ দ্বাদশ অধ্যায়ঃ হিগস কণার খোঁজে

♦ ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি

♦ চতুর্দশ অধ্যায়ঃ অনন্ত মহাবিশ্বের সন্ধান শূন্য ও অসীমের মেলবন্ধন

♦ পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ অন্তিম প্রশ্নের মুখোমুখি: কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?

“শূন্য থেকে মহাবিশ্ব” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒অভিযোগ বা মন্তব্য⇐

error: Content is protected !!