১
আমি জানি তুমি কেন চাহনা ক’ ফিরে ।
গৃহকোণ ছাড়ি আসিয়াছ আজ দেবতার মন্দিরে।
পুতুল লইয়া কাটিয়াছে বেলা
আপনারে ল’য়ে শুধু হেলা-ফেলা,
জানিতে না, আছে হৃদয়ের খেলা আকুল নয়ন-নীরে,
এত বড় দায় নয়নে নয়নে নিমেষের চাওয়া কি রে?
আমি জানি তুমি কেন চাহনাক ফিরে ॥
২
আমি জানি তুমি কেন চাহনা ক’ ফিরে।
জানিতে না, আঁখি আঁখিতে হারায় ডুবে যায় বাণী ধীরে।
তুমি ছাড়া আর ছিলনাক কেহ,
ছিল না বাহির ছিল শুধু গেহ,
কাজল ছিল গো জল ছিল না ও উজল আঁখির-তীরে।
সে দিনো চলিতে ছলনা বাজেনি ও-চরণ মঞ্জীরে !
আমি জানি তুমি কেন চাহনাক ফিরে ॥
৩
আমি জানি তুমি কেন কহনা ক’ কথা।
সে দিনো তোমার বনপথে যেতে পায়ে জড়াত না লতা ।
সেদিনো বেভুল তুলিয়াছ ফুল
ফুল বিধিতে গো বিধেনি আঙুল,
মালার সাথে যে হৃদও শুকায় জানিতে না সে বারতা।
জানিতে না, কাঁদে মুখর মুখের আড়ালে নিসঙ্গতা !
আমি জানি তুমি কেন কহনা ক’ কথা ॥
৪
আমি জানি তব কপটতা, চতুরালি !
তুমি জানিতে না, ও কপোলে থাকে ডালিম দানার লালী !
জানিতে না ভীরু রমণীর মন
মধুকর-ভারে লতার মতন,
কেঁপে মরে কথা কণ্ঠে জড়ায়ে নিষেধ করে গো খালি ।
আঁখি যত চায় তত লজ্জায় লজ্জা পাড়ে গো গালি !
আমি জানি তব কপটতা চতুরালি !
৫
আমি জানি, ভীরু, কিসের এ বিস্ময় !
জানিতে না কভু নিজেরে হেরিয়া নিজেরি করে যে ভয়।
পুরুষ পুরুষ―শুনেছিলে নাম,
দেখেছ পাথর কর নি প্রণাম,
প্রণাম ক’রেছ লুব্ধ দু’কর চেয়েছে চরণ ছোঁয়,
জানিতে না, হিয়া পাথর পরশি পরশ-পাথরও হয় !
আমি জানি ভীরু, কিসের এ বিস্ময় ॥
৬
কিসের তোমার শঙ্কা এ, আমি জানি ।
পরাণের ক্ষুধা দেহের দু’তীরে করিতেছে কানাকানি।
বিকচ বুকের বকুল-গন্ধ
পাড়ি রাখিতে পারে না বন্ধ,
যত আপনারে লুকাইতে চাও তত হয় জানাজানি,
অপাঙ্গে আজ ভিড় করেছে গো লুকানো যতেক বাণী ।
কিসের তোমার শঙ্কা এ, আমি জানি ॥
৭
আমি জানি, কেন বলিতে পার না খুলি’।
গোপনে তোমায় আবেদন তার জানায়েছে বুলবুলি ।
যে কথা শুনিতে মনে ছিল সাধ
কেমনে সে পেল তারি সংবাদ?
সেই কথা বঁধু তেমনি করিয়া বলিল নয়ন তুলি !
কে জানিত এত যাদু-মাখা তার ও কঠিন অঙ্গুলি।
আমি জানি কেন বলিতে পার না খুলি ॥
৮
আমি জানি তুমি কেন যে নিরাভরণা,
ব্যথার পরশে হয়েছে তোমার সকল অঙ্গ সোনা ।
মাটির দেবীরে পরায় ভূষণ,
সোনার সোনায় কিবা প্ৰয়োজন?
দেহ-কূল ছাড়ি নেমেছ মনের অকূল নিরঞ্জনা ।
বেদনা আজিকে রূপেরে তোমার করিতেছে বন্দনা ।
আমি জানি তুমি কেন যে নিরাভরণা ॥
৯
আমি জানি, ওরা বুঝিতে পারে না তোরে ।
নিশীথে ঘুমালে কুমারী বালিকা, বধূ জাগিয়াছে ভোরে !
ওরা সাঁতরিয়া ফিরিতেছে ফেনা,
শুক্তি যে ডোবে –বুঝিতে পারে না !
মুক্তা ফলেছে –আঁখির ঝিনুক ডুবেছে আঁখির লোরে।
বোঝা কত ভার হ’লে –হৃদয়ের ভরাডুবি হয়, ওরে,
অভাগিনী-নারী, বুঝিবি কেমন ক’রে ॥
“চক্রবাক” কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ