যেখানে ধর্মগ্রন্থ থেকে ধর্মগুরু

বেদ, উপনিষদ, গীতা’কে অভ্রান্ত মনে করে অনেকেই সাধারণভাবে এগুলোর থেকে কোনও একটি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করে বলেন – … ‘তে আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে যে কথা লেখা হয়েছে, তা কি আপনি মানেন? যদি মানেন, তবে আত্মার অমরত্বের কথা কেন মানবেন না?

উত্তরটাও এ’সব ক্ষেত্রে অতি সহজ সরল। আত্মা বিষয়ে বেদ, গীতা ও উপনিষদে রয়েছে পরস্পরবিরোধী বহু সংজ্ঞা। তাদের কোন সংজ্ঞা আপনি সত্যি বলে ধরবেন?  যাই হোক- একদল যারা আত্মাকে মন বলে মনে করেন, তাঁদের বলি- মনকে আত্মা বললে সেই আত্মাকে মানব না কেন? তবে মন যেহেতু দেহবহির্ভূত কোনও কিছু নয়, মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষেরই কাজ-কর্মের ফল, তাই মৃত্যুতেই মনের অস্তিত্বেরও মৃত্যু ঘটে। আর একদল, যারা মনের স্রষ্টা মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষকে আত্মা বললে সেই আত্মার অস্তিত্ব মানব না কেন? সেই সঙ্গে এ’কথাও মানি মৃত্যুর পর মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষেরও মৃত্যু ঘটে।

বিভিন্ন প্রশ্নে বার-বার উঠে এসেছে ‘মরণের পারে’ বইটির কথা। লেখক- স্বামী অভেদানন্দ। তাঁর বইয়ের ২৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- বিশেষ এক ধরনের সূক্ষ্ম যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে, যে যন্ত্রটির সাহায্যে মৃত্যুর পর দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়া বাষ্পতুল্য আত্মা বা মনকে ওজন করা সম্ভব। দেখা আত্মার ‘ওজন প্রায় অর্ধেক আউন্স বা এক আউন্সের তিনভাগ’।

“এক আউন্সের তিনভাগ” বলতে সম্ভবত চারভাগের তিনভাগ বোঝাতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথাটাই হল এই-আত্মার ওজন নেওয়ার যন্ত্র যদি আবিষ্কৃত হয়েই থাকে, তাহলে তো ল্যাঠাই চুকে যায়। এর পরেও আত্মার অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করে কোন যুক্তিবাদী? কোন বিজ্ঞানমনস্ক?

পরিপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে বলছি, বিজ্ঞান কিন্তু এমন কোনও যন্ত্রের অস্তিত্বের কথা আজও জানে না। স্বামী অভেদানন্দও জানাননি যন্ত্রটির নাম। এ’বিষয়ে পরামনোবিজ্ঞানীরাও রা কাড়েননি। অথচ বাস্তবিকই এমন জব্বর আবিষ্কারের খবর শোনার পর আমার অন্তত জানতে ইচ্ছে করে আত্মা অর্থাৎ মনের ওজন মাপা সূক্ষ্ম যন্ত্রটির নাম, আবিষ্কারকের নাম, কত সালে যন্ত্রটি আবিষ্কৃত হয়েছিল, আবিষ্কারক কোন দেশের নাগরিক ছিলেন ইত্যাদি বহু প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু উত্তর কে দেবেন? কোনও পরামনোবিজ্ঞানী? না, ‘মরণের পারে’ গ্রন্থটির প্রকাশক- শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ? যুক্তিবাদীদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে অধ্যাত্মবাদীদের চর্ম জয় প্রতিষ্ঠা করতে আত্মার ওজন মাপা যন্ত্রটি নিয়ে এগিয়ে আসছেন না কেন ভাববাদী ও অধ্যাত্মবাদী শিবিরের নেতারা? সত্যিই এ এক পরম বিস্ময়। এ বিষয়ে যারা প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা ভাববাদী শিবিরে চাপ সৃষ্টি করুন না- আত্মার ওজন যন্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসতে। চাপ দিলেই বুঝতে পারবেন ওঁদের দাবি কত আসার কত মিথ্যাচারিতায় ভরা।

‘মরণের পারে’ গ্রন্থে প্রকাশিত বিদেহী আত্মার নানা ছবি অনেকেরই মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। ওইসব ছবিই বইটির বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি লিখিতভাবেও একথা জানিয়েছেন আত্মার আলোকচিত্র বা ফটোগ্রাফ নেওয়া যায়। (মরণের পারে, পৃষ্ঠা- ২৮)।

এমন আজগুবি কথার পরিপ্রেক্ষিতে সত্যকে প্রকাশ করতে হলে বলতেই হয়- স্বামীজী এমন কথা লিখেছেন হয় অজ্ঞতা থেকে, নয় তো মিথ্যের দ্বারা আত্মার অমরত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে বিদেহী আত্মা’র ছবি তুলতে কি বিশেষ কোনও ক্যামেরার প্রয়োজন হয়? আত্মার ছবি তোলা যায়, এমন ক্যামেরার নাম কি? স্বামীজী অবশ্য এই বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করেছেন। গ্রন্থটি খুব কম করেও চল্লিশ বছর আগে লেখা আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে একটু ভাল ধরনের ক্যামেরার লেন্সও এমন কিছু শক্তিশালী ছিল না, যার ফলে ক্যামেরার লেন্সে কুয়াশাময় আত্মা ধরা পড়ে, তা সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। ক্যামেরায় ভূতের ছবি তোলার গপ্পো আড্ডায় বা মজলিসে বলা যায়, অথবা ধর্মের মোড়কে বইতে লিখে ফেলা যায় সহজেই, কিন্তু কোনও দিনই সত্য বলে প্রমাণ করা যায় না। সত্য নয় বলেই সত্য প্রমাণ করা যায় না।

‘মরণের পারে’ বইয়ে প্রকাশিত ছবির চেয়ে বেশি ভৌতিক, বেশি জীবন্ত ছবি তুলতে কোন ভূতের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজনে হয় অতি সাধারণ কৌশলের, যা ছবি তোলার প্রথম পাঠ শেষ করা ফটোগ্রাফারদের অজানা নয়। ‘ডবল এক্সপোজার’, ‘সুপার ইমপোজ’ বা কাঁচের সাহায্যে রিফ্লেক্স পদ্ধতিতে আলোর প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণের দ্বারা বছর তিরিশ-পয়তিরিশ আগে আমার মত ছবি তোলায় আনাড়িও অনেক অদ্ভুতুরে ছবি তুলেছে। ঐ একই পদ্ধতিতে ‘মরণের পারে’র চেয়েও ভূতুরে ছবি তোলা তখনো সম্ভব ছিল, এখনও সম্ভব। তবে এখন ছবির কলাকৌশল এতই বেড়েছে যে ‘হরর’ ছবি দেখতে বসে অনেকেই স্থান-কাল ভুলে এয়ারকন্ডিশনড হলে বসেও আতঙ্কে ঘেমে ওঠেন।

স্বামী অভেদানন্দের ‘মরণের পারে’ গ্রন্থটি যে আত্মা নিয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনা, এ কথা গ্রন্থটির প্রথম পৃষ্ঠাতেই বিজ্ঞাপিত। এই আত্মাসংক্রান্ত বিজ্ঞান সম্মত গবেষণার আকর গ্রন্থটির একটা অংশ নিয়ে আলোচনা করে ‘মরণের পারে’ নিয়ে এই পর্যায়ের আলোচনায় ইতি টানতে চাইছি।

বিদেহী আত্মা কিভাবে আবার দেহ ধারণ করে, সে বিষয়ে স্বামী অভেদানন্দ তাঁর ‘গবেষণালব্ধ’ এবং ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী’ থেকে বলছেন, ‘মন’ বা ‘আত্মা’ “আকাশের মধ্য দিয়ে বায়ুতে প্রব্রেশ করে, বায়ু থেকে মেঘ, সেখান থেকে বৃষ্টি বিন্দুর সঙ্গে তারা পড়ে ধরণীতে, তারপর খাদ্যের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করে আবার তারা জন্ম নেয়।“ (মরণের পারে ; পৃষ্ঠা- ৩৮)

স্বামী অভেদানন্দ আরও বলেছেন, পিতামাতা এই দেহ গঠনের সহায়ক মাত্র, তাছাড়া আর কিছু নয়। তাদের সাহায্যেই প্রাকৃতিক নিয়মকে রক্ষা করে দেহ গঠনে সমর্থ হয় সূক্ষ্মশরীর। পিতামাতা আত্মাকে সৃষ্টি করেন না। তা সম্পূর্ণ অসম্ভব। যতক্ষণ পর্যন্ত না আত্মা। পিতামাতার অভ্যন্তরে আবির্ভূত হয় এবং প্রাণীবীজটিকে লালন করে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের জন্ম অসম্ভাব্যই থাকে।“ (ঐ গ্রন্থেরই পৃষ্ঠা-৬২)।

স্বামী অভেদানন্দ মানুষের জন্ম বিষয়ে যে ধারণা তাঁর অন্ধ ভক্ত ও পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন, তা হল, (১) বিদেহী আত্মা আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে এবং খাদ্যের সঙ্গে যখন মানব দেহে প্রবেশ করে তখনই সম্ভব হয় নতুন জন্মের। অর্থাৎ নতুন জন্মের জন্য সঙ্গম অপ্রয়োজনীয়। অর্থাৎ শারীরবিজ্ঞান পড়ে এতদিন আমরা ভুলই জেনেছি যে- সঙ্গমের ফলে নিক্ষিপ্ত পুরুষের শুক্রকীট নারীর জরায়ুর মধ্যে প্রবেশ করে জরায়ুর ভিতর দিয়ে সাঁতার কেটে ফ্যালোপিয়ন টিউবের মধ্যে ঢুকে ওভামের সঙ্গে মিলিত হয়, অথবা টেস্টটিউব শিশুর ক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবে নিষিক্ত হয় এবং তার ফলেই গর্ভসঞ্চার হয়। (২) নতুন মানুষ জন্ম নেবে কি না তা সম্পূর্ণই নির্ভর করে বিদেহী আত্মার ইচ্ছের উপর, সুস্থ-সবল জন্মদানে সক্ষম নারী-পুরুষের দেহ মিলনের সাহায্যে কখনোই নতুন কোনও জন্ম দিতে পারে না কোনও আধুনিক প্রযুক্তিও।

এমন তত্ত্বকে মানলে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সমস্ত রকম ওষুধপত্তর ও সাজ-সরঞ্জামই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।

আরও একটি প্রশ্নের প্রায়ই মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। প্রশ্নটা হল- বিজ্ঞানীরা আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে পরীক্ষা চালাতে একবার মৃত্যুপথযাত্রী একটি মানুষকে নিশ্ছিদ্র বন্ধ কাছের বাক্সে রেখেছিলেন। ঐ বাক্সে হাওয়া ঢোকা বা বেরিয়ে যাওয়ার সমস্ত পথই ছিল বন্ধ। এই অবস্থায় বাক্সবন্দি লোকটির যখন মৃত্যু হল, তখনই বাক্সের কাচ গিয়েছিল ফেটে। সাধারণভাবে আপনা থেকে কাচ ভেঙ্গে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই ; তবু ভেঙ্গে গেল। কাঁচের এই ভেঙ্গে যাওয়া আত্মার শারীরিক অস্তিত্ব বা স্থুল আয়তনিক-অস্তিত্বই প্রমাণ করে। দেহ থেকে আত্মা বেরিয়ে আসায় বন্ধ বাক্সের বাতাসে বাড়তি চাপের সৃষ্টি হয়েছিল। এই বাড়তি চাপই কাচ ভাঙ্গার কারণ। এ’ছাড়া কাচ ভাঙ্গার আর কোনও কারণ থাকতে পারে না।

এমন প্রশ্ন শোনার পর অনেক পাল্টা প্রশ্নই করা যেতে পারে। যেমন- মৃত্যু পথযাত্রীর শ্বাস-প্রশ্বাস চালাবার ব্যবস্থা ছিল কি না? থাকলে সেটা ঠিক কি ধরনের ব্যবস্থা? কারণ এ’ক্ষেত্রে বাড়তি বায়ু প্রবেশ ও নির্গমনের সম্ভাবনা থেকে যেতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার কোনও বাড়তি ব্যবস্থা না থাকলে তা শুধুমাত্র অমানবিকই নয়, বে-আইনিও। এমন বেআইনি কাজে শামিল হওয়া ব্যক্তিদের হত্যার অপরাধে আসামীর কাঠগোড়ায় দাঁড় করানো যায়।

কিন্তু সবচেয়ে বড় কথাটি হল, এ’তো নেহাৎই এক প্রচলিত গল্প কথা। এমন কোনও পরীক্ষা কিছু বৈজ্ঞানিকদের দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল, এমন কথা বার মত কোনও কারণ ঘটেনি। না, আজ পর্যন্ত কোনও ভাববাদী বা অধ্যাত্মবাদী শিবির থেকেও এ ধরনের কোনও স্পষ্ট বক্তব্য হাজির করা হয়নি। যারা এই ধরনের প্রশ্ন হাজির করেন, তাঁরাও যা বলেন, সবই ভাসা ভাসা। কখনোই বলতে পারেন না এমন গবেষণায় যুক্ত থাকা বৈজ্ঞানিকদের নাম, গবেষণা চালাবার স্থান, সময় ইত্যাদি। তাই এই নিয়ে এরপরও কেউ গা-জোয়ারি তর্ক তুলতে চাইলে বিনয় ও দৃঢ়তার সঙ্গেই আমরা বলি, “বেশ তো, আপনারা আপনাদের বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ করুন, তখন শুধু আমরা কেন তাবৎ দুনিয়াই আত্মার অস্তিত্ব মেনে নেবে।“

অভেদানন্দের পরেই যার নাম ইদানিং নানা প্রশ্নে আমাদের সামনে আসে, তিনি হলেন নিগূঢ়ানন্দ। তাঁর ‘জাতিস্মর’ বইটির কথা তুলে অনেকেই প্রশ্ন করেন- বইটির ১২ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, টেপরেকর্ডে পরলোকগত আত্মার কন্ঠস্বর ধরার কথা। এই বক্তব্যকে কি মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেবেন?

ব্যাপারটা সত্যি না হলে তো মিথ্যেই হয়। বিশ্বাসীদের প্রতি একটি অনুরোধ- তাঁরা নিগূঢ়ানন্দকে তাঁর বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করতে বাধ্য করুন না। আমরা এই বিষয়ে সত্যানুসন্ধানে সমস্ত রকম ভাবে নিগূঢ়ানন্দের সঙ্গে সহযোগিতা করব, কথা দিচ্ছি। তিনি তাঁর দাবি প্রমাণ করতে পারলে খাঁটি যুক্তিবাদী মানসিকতার পরিচয় দিয়ে আমরা অধ্যাত্মবাদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করা থেকে বিরত থাকব এবং অধ্যাত্মবাদের পক্ষে প্রচারকেই যুক্তিবাদী সমিতির লক্ষ্য করে নেব।

নিগূঢ়ানন্দ সাধনার কোন স্তরে পৌঁছেছেন, এ বিষয়ে তাঁর দাবিগুলো প্রাথমিক স্তরে নেড়েচেড়ে দেখি- আসুন।

যোগে শূন্যে ভাসা বা ভূমিত্যাগ নিয়ে নিগূঢ়ানন্দ কি বলেছেন দেখুনঃ বইটির নাম “আত্মার রহস্য সন্ধান।“

“মানুষের মধ্যে একটি অদ্ভুত চৌম্বক ক্ষেত্র আছে যাকে বলে কুল অর্থাৎ শক্তির কুন্ড অর্থাৎ গর্ত। এই কুল কুন্ড মানুষের দেহের লিঙ্গমূল ও গুহ্যদ্বারের মাঝখানে অবস্থিত। এই কুন্ডের মধ্যে আছে অদ্ভুত একটি চৌম্বকক্ষেত্র … এই চৌম্বকক্ষেত্রের শক্তি বেড়ে যায় শ্বাস-প্রশ্বাসের বিশেষভাবে ব্যবহারের ফলে।“ বিশেষ ব্যবহার কি? “দেহকুন্ড (গুহ্যদ্বার ও লিঙ্গমূলের মাঝখানে অবস্থিত একটি স্থানে) কার্বন জাতীয় কোন রাসায়নিক পদার্থ আছে” … শ্বাস নিয়ন্ত্রণের ফলে অর্থাৎ কমাবার ফলে “কুন্ডস্থ তাপ দেহের ঊর্ধ্বদিকে উঠতে আরম্ভ করে… মেরুদন্ডের গাঁটে গাঁটে ঊর্ধ্বগতি-শক্তির আঘাত যতই বেশি পড়তে থাকে ততই দেহটি কেঁপে ওঠে। তখন সারা দেহে অদ্ভুত শিহরণ হয়। পথ পরিষ্কার হয়ে গেলে সে তখন মস্তিষ্কে উঠে গিয়ে এমন চাপ সৃষ্টি করে যে, মস্তিষ্ককে ফুটবলের ব্লাডারের মত ফুলিয়ে তুলতে চায়… মস্তিষ্কে এই শক্তি বায়ুর সংমিশ্রণে এমন এক গ্যাসীয় অবস্থার সৃষ্টি করে যে দেহের ভার বোধটাই যেন কম বোধ হয়। দেহ শুদ্ধোই তখন উপরে উঠে যায়। তখনই যোগে যাকে ভূমিত্যাগ বলে সেই অবস্থা অর্থাৎ levitation হয়।“ (পৃষ্ঠা ৮৭-৮৮)

এতো গেল যোগের গ্যাসে মাথা ব্লাডারের মত ফুলে গ্যাস বেলুনটি হয়ে শরীরটাকে শূন্যে তুলে রাখার যোগ সম্মত তাত্ত্বিক আলোচনা। তা এমন তাত্ত্বিক আলোচনাতেই কি আমাদের তৃপ্ত থাকতে হবে? প্রয়োগের ব্যাপারটা আমাদের একবার দেখার সুযোগ করে দিলে আমরা তামাম দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যুক্তিবাদীরা। যোগে মাথা ফুলে ব্লাডার হওয়ার তত্ত্বের প্রচারে আন্তরিকতার সঙ্গেই নেমে পড়তে পারি।

যারাই আমাদের চিঠি দিয়ে বা মুখে বলেন নিগূঢ়ানন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে, তাঁদেরই অনুরোধ করি, এমন এক যোগী যখন জীবিত এবং হাতের কাছেই রয়েছেন, তখন আন্তরিকভাবে চেষ্টা করুন না কেন, যাতে নিগূঢ়ানন্দ যোগে ভূমিত্যাগ করে আমাদের দেখান।

ঐ বইটির ১১১ পৃষ্ঠায় লেখক আরও একটি সাংঘাতিক দাবি করেছেন। তিনি তাঁর কাছে যোগশিক্ষা করেন এমন অনেকের প্রসঙ্গে বলেছেন, “সূক্ষ্ম দেহে ভিন্ন ব্যক্তি বা স্থান দর্শনের হুবহু বর্ণনাও তাঁরা দিতে পারেন। বর্তমানে লেখকের ব্যক্তিগত এমন অভিজ্ঞতা আছে।“

শিষ্যদের ক্ষমতা থাকলে গুরুর থাকবে, এতো জানা কথাই। সঙ্গে নতুন করে জানলাম মনের আবার দর্শন ইন্দ্রিয় আছে এবং মনের চোখ না থাকলেও দেখার ক্ষমতা আছে। চক্ষুহীনদের দেখার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যোগের সাহায্যে নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকার সচেষ্ট হতে পারেন, বিশেষত দু-একজন উদ্যমী মন্ত্রী যখন হাতের কাছেই আছেন। এবং পরবর্তীকালে কেন্দ্র ও তারও পরবর্তীকালে পৃথিবীর অন্যান্য দেশও যোগের প্রয়োগে তৎপর হতে পারেন, অন্ধত্ব নির্মূলের জন্যেই হতে পারেন।

আত্মা দেখতে পায়- জানলাম। কিন্তু কিভাবে বিভিন্ন স্থানে আত্মা যায়?

এ বিষয়েও বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিগূড়ানন্দ, “সূক্ষ্ম সত্তা (আত্মা) যদি কুলকুন্ডলিনীর এড়িয়ে- রকেটের মত পার্থিব মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অনায়াসে অতিক্রম করে- ভিন্ন বিশ্বে, বা আমাদেরই বিশ্বের নতুন কোন সোউর জগতের আকাশে গিয়ে ভাসমান হতে পারে।“ (ঐ বইয়ের পৃষ্ঠা- ৯১)

আত্মা যখন পন্যগ্রহে পর্যন্ত রকেটের মত চলে যেতে পারে, তখন এই গ্রহের যে কোনও জায়গায় প্লেনের গতি প্রয়োগ করলেই যযে পৌঁছে যাবে এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে? যোগীর বিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে আত্মা নিয়ে যেতে একটা হিরো হোন্ডা বা সুজুকি’র স্পিড তুললেই যথেষ্ট।

এরপরও যুক্তিবাদীরা বলতে পারেন, তাত্ত্বিক ব্যাপারটা না হয় হল। কিন্তু প্রয়োগের ব্যাপারটা? নিগূঢ়ানন্দ যদি বাস্তবিকই আত্মাকে উড়িয়ে ভিন্নস্থানে নিয়ে কিছু বর্ণনা দিতে রাজি থাকেন, তবে অধ্যাত্মবাদের জয়জয়কারে নিজেদের নিয়োগ করতে যে সানন্দে রাজি- এ’কথা নিশ্চয়ই উল্লেখ করার প্রয়োজন ছিল না। হে নিগূড়ানন্দ ভক্তবৃন্দ, আপনারা একবার নিগূঢ়ানন্দকে রাজি করিয়ে ফেলুন। সাংবাদিক সম্মেলন ডাকার দায়-দায়িত্ব আমরা বহন করতে এক পায়ে খাড়া।

নিগূঢ়ানন্দকে রাজি করাবার দায়িত্ব আমাদেরই যদি নিতে বলেন, তবে বলি- আমাদের অনুরোধ-টনুরোধকে উনি পাত্তাই দিচ্ছেন না। আমাদের এক ফিচেল সদস্য রজত পাত্রের কথায়- এই কয়েক বছর আগে যুক্তিবাদীদের পাল্লায় পড়ে মহেশ যোগীর শিষ্যরা যোগে শূন্যে ভাসা দেখাতে গিয়ে যেভাবে ন্যাজে গোবরে হয়েছেন, তা কি আর কোনও বাবার অজানা আছে? এমন জানার পর কোন বাবার এমন বুকের পাটা হবে, যিনি তত্ত্ব ছেড়ে প্রয়োগও দেখাতে যাবেন !

আসলে মুশকিল হয়েছে কি- যে বাবাই আমাদের কাছে ক্ষমতা দেখাতে এগিয়ে এসেছেন, তাঁরই বুজরুকি এমনভাবে বেবাক ফাঁস হয়েছে যে চতুর বাবারা এখন তাদের দাবি-টাবিগুলো লেখা-পত্তর ও তত্ত্বকথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান।

হ্যাঁ, আর একটা বড় খবরই উল্লেখ করতে বেমালুম ভুলে যাচ্ছিলাম। লেখক নিগুঢ়ানন্দ তাঁর ওই গ্রন্থেরই ১২৩ পৃষ্ঠায় জানিয়েছেন, আত্মার পক্ষে “পার্থিব সূক্ষ্মস্তরগুলোর অভিকর্ষ এড়িয়ে ভিন্ন গ্রহে উপস্থিত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।“ তিনি ওই পৃষ্ঠাতেই আরও জানিয়েছেন লেখক “ভিন্নগ্রহে বিভিন্ন মাত্রায় জীব দর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন।“

মহাকাশ গবেষণায় ফি বছর হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ না করে, গ্যালাক্সিতে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রাণান্তকর পরিশ্রমে নিজেদের শরীরপাত না করে নিগূঢ়ানন্দের সাহায্য নিলেই তো পারেন।

সাহায্য না নেওয়ার একটা গুরুতর কারণ হতে পারে নিগুঢ়ানন্দের লেখা জনপ্রিয় আত্মা ও জাতিস্মর বিষয়ক বইগুলোই। তাতে অদ্ভুতুরে পাগলামির নিদর্শনের ছড়াছড়ি। যেমন- প্রতিটি অণু-পরমাণুর মধ্যেই রয়েছে চেতনা বা মন (আত্মার রহস্যসন্ধান ; পৃষ্ঠা ৮৫)। ঐ গ্রন্থের ৯৮ পৃষ্ঠায় তিনি স্বামী অভেদানন্দের মতই নিজের অজ্ঞানতার পরিচয় দিয়ে ‘এক্টোপ্লাজম’কেই আত্মা ঠাউরেছেন। নিগূঢ়ানন্দের জ্ঞানের গূঢ় তত্ত্ব আরও প্রকাশিত হয়ে পড়ে যখন দেখি তিনি বলেন, “পি. সি.সরকার সকলের ঘড়ির কাঁটার সময় কমিয়ে দিতে পারেন কি করে? এ-বিষয়টি তাঁকেই জিজ্ঞাস্য। অধিমনোবিজ্ঞানে একে বলে সম্মোহন বা P K (psycho Kinesis)” (জাতিস্মর, নিগূঢ়ানন্দ, পৃষ্ঠা- ৮৫)

এত অলৌকিক ক্ষমতা, এত জ্ঞান, বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের সবকিছু জানার পর ঘড়ির গণসম্মোহনের প্রচলিত একটা আষাঢ়ে গল্প বিভিন্ন সময়ে যে সব ভারতীয় জাদুকরদের ঘিরে চালু হয়েছিল, তাদের মধ্যে আছেন জাদুকর গণপতি, রাজা বোস, রয়-দি-মিসটিক এবং পি. সি. সরকার। পৃথিবীতে প্রথম যাকে নিয়ে এই আষাঢ়ে গল্পের শুরু, তাঁর নাম হাউয়ার্ড থাসর্টন ; আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জাদুকর। এই ধরনের জাদু বা গণসম্মোহন শুধুমাত্র গল্পেই সম্ভব। সম্মোহন ও জাদুর বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা বা জ্ঞান থাকার দরুন এ’কথা বলছি। নিগূঢ়ানন্দের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভুল সম্মোহনকে PK (Psycho Kinesis)র সঙ্গে এক করে দেখা। Pk হল পরামনোবিজ্ঞানের এক অদ্ভুতুরে বিষয়। পরামনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন বস্তুর উপর মানুষের ইচ্ছাশক্তি ক্রিয়াশীল হতে পারে।

যেমন ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে পানীয় জলকে মদে পরিণত করা, বৃষ্টি থামিয়ে দেওয়া, বৃষ্টি নামানো, সমুদ্রের জলকে দু’পাশে সরিয়ে পথ করে নেওয়া ইত্যাদি। এই ধরনের তথাকথিত ক্ষমতাই পরামনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় Pk । এবং এ’কথাও অবশ্যই মনে রাখতে হবে পরামনোবিজ্ঞান অবিজ্ঞানের বিষয়, বিজ্ঞানের নয়।

সম্মোহন হল সঞ্চারিত ধারণার ফলে মস্তিষ্কস্নায়ুকোষের এক ধরনের বিশেষ প্রতিক্রিয়া। এবং এই প্রতিক্রিয়া মনোবিজ্ঞানের বিষয়, অর্থাৎ বিজ্ঞানের বিষয়, পরামনোবিজ্ঞানের বিষয় নয়।

নিগূঢ়ানন্দ লিখেছেন, “উড়ি গেলারের কাছে যান, তাকিয়ে থেকে তিনি ধাতব দন্ড বাঁকিয়ে দিতে পারেন। অধিমনোবিজ্ঞানীরা একে বলেছেন- Pk । লেখকের কাছে যোগ শিখেছেন এমন এক আমেরিকান মহিলা মিসেস রেনে’ও এই ক্ষমতার অধিকারিণী”। (জাতিস্মর, নিগূঢ়ানন্দ, পৃষ্ঠা- ৮৬)

নিগূঢ়ানন্দজীর অবস্থাটা পেঁয়াজের মত, যতই ছাড়াচ্ছি একের পর এক শুধু বিস্ময়ের খোসা। উরি গেলারের তাকিয়ে থেকে ধাতুর চামচ বাঁকাবার রহস্য আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগেই উন্মোচিত হয়েছে আমার কলমে। উরি চামচের হাতল তৈরি করতেন দুটি ভিন্ন ধাতুর পাতলা পাত জুড়ে। গ্যালভানাইজ করে দুই ধাতুর জোড়াকে দেওয়া হত ঢেকে। তারপর খুব কাছ থেকে চামচের হাতলে ফেলা হত তীব্র আলো। আলোর উত্তাপে হাতল গরম হত। উত্তাপে দুটি ধাতুর পাতের প্রসারণ হত ভিন্ন রকমের। ফলে হাতল যেত বেঁকে। হে ভূত-ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড চষে ফেলা নিগূঢ়ানন্দ, উরির চামচ বাঁকাবার গূঢ় রহস্যটাই আপনি জানতেন না? বিজ্ঞানের এই কৌশলকে, উরির এই বুজরুকিকে আপনি P K বলে দিব্বি চালিয়ে দিচ্ছিলেন ! আপনার এক শিষ্য উরির মত তাকিয়ে ধাতু বাঁকাবার অধিকারী বলে জানিয়েছেন, তা তিনিও কি উরির মতই দু’ধাতু পাতের-কারবারী? হে আমেরিকান শিষ্যার গুরু, আমাদের প্রতি একবার কৃপা করে তাকিয়ে একটা চামচ কি পেরেক বাঁকিয়ে দিন। আপনার প্রতি একবার কৃপা করে তাকিয়ে একটা চামচ কি পেরেক বাঁকিয়ে দেখিয়ে দিন। আপনার এমন ক্ষমতা চাক্ষুস করে আমরা ধন্য হই। তারপর আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে রকেট গতি প্রাপ্ত হয়ে মহাবিশ্বে আপনার মাহাত্ম্য প্রচারে ঘুরে বেড়াই।

নিগূঢ়ানন্দজী, সম্মোহন নিয়ে আরও একটা মারাত্মক জ্ঞানের প্রমাণ আপনি রেখেছেন। আপনি লিখেছেন, “টেলিপ্যাথিতে সম্মোহনকারী তাঁর নিজের বিশ্বাস রোগীর মধ্যে ঢুকিয়ে দেন।“ (জাতিস্মর গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৫৩)

ধুর মশাই, এমন উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে ওঁচা ‘মাল’ নামিয়ে জনগণকে চিরকাল বোকা বানিয়ে রাখা যাবে ভেবেছেন নাকি? লেখার আগে একটা জানার চেষ্টা তো করবেন। জানেন যা, জানবার চেষ্টা তার চেয়ে এতই বেশি যে বারবার ল্যাজে গোবরে হওয়া ছাড়া কোনও গতি নেই।

নিগূঢ়ানন্দজী, অধিমনোবিজ্ঞানী বা পরামনোবিজ্ঞান, যে নামেই ডাকুন, ওই তথাকথিত বিজ্ঞানটি মনে করে চিন্তার সময় মস্তিষ্ক থেকে রেডিও ওয়েভের মতো এক ধরনের তরঙ্গ প্রেরক যন্ত্রের সাহায্যে এই তরঙ্গকে ধরে প্রেরকের চিন্তার হদিস পাওয়া কঠিন হলেও অসম্ভব বা অবাস্তব নয়।

এতো গেল পরামনোবিজ্ঞানী নামধারী বিজ্ঞান-বিরোধী অধ্যাত্মবাদীদের ধারণা। কিন্তু তাঁদের ধারণা অনুযায়ী চিন্তা তরঙ্গের অস্তিত্ব আজ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি। পরামনোবিজ্ঞানীরাও চিন্তা তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারেননি, যেমনটি প্রমাণ করা যায় শব্দ বা আলোক তরঙ্গের ক্ষেত্রে। শব্দ বা আলোক তরঙ্গ নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক, গতি ও মাত্রায় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, এটা প্রমাণিত। রেডিও এবং টেলিভিশন এই শব্দ তরঙ্গ ও আলোক তরঙ্গকে ধরে শব্দ ও দৃশ্যকে আমাদের সামনে হাজির করে। অস্তিত্বহীন চিন্তাতরঙ্গ ধরা নেহাতই অবাস্তব কল্পনা এবং এই অবাস্তব কল্পনার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা টেলিপ্যাথিও একটা কল্পনা বা বিরাট ধাপ্পা ! (টেলিপ্যাথির পৃথিবী বিখ্যাত বহু বুজরুকির রহস্য উন্মোচিত হয়েছে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থের প্রথম খন্ডে)।

আর ‘সম্মোহন’ ব্যাপারটা … ; না, সে এক বিশাল অধ্যায় নিয়ে তাহলে বসতে হয়। ‘সম্মোহন’ বিষয়ে বিস্তৃত জানতে উৎসাহী পাঠক-পাঠিকারা পড়তে পারেন ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থের প্রথম খন্ড।

error: Content is protected !!