এই যেস এতকিছু আলোচনা করলাম, এর পরেও ভিড় করে আসে নানা প্রশ্ন। এইসব প্রশ্নকারীদের মোটামুটি কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। একঃ আন্তরিকভাবেই জিজ্ঞাসু। দুইঃ আত্মার অমরত্ব অলীক বুঝেও অধ্যাত্মবাদীদের নানা কূট প্রশ্নের মুখোমুখি হলে তার উত্তর কি হওয়া উচিৎ- জানতে আগ্রহী। তিনঃ আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী, অথবা আত্মার অমরত্ব প্রচারে আগ্রহী। তাই এঁরা আত্মার মরণশীলতা বিষয়ক বিভিন্ন যুক্তি (যে’সব যুক্তি ইতিপূর্বে আপনাদের সামনে হাজির করেছি) হাজির করার পর, সেই যুক্তিগুলোকে খন্ডন করা অসাধ্য বুঝে সে বিষয়ে নীরবতা দেখিয়ে, অন্য প্রসঙ্গ তোলেন। উদ্দেশ্য- কূটপ্রশ্নে উত্তরদাতাকে অস্বস্তিতে ফেকে আত্মার মরণশীলতা বিষয়ে এ’যাবত দেওয়া যুক্তিগুলোকে শ্রোতাদের কাছে নড়বড়ে করে দেওয়া। চারঃ সবটা না জেনেই সবজান্তা হওয়াটাই লক্ষ্য। এরা জানতে চায় যতটুকু, জানাতে চায় তার চেয়ে বেশি। ফলে শ্রোতাদের সামনে জাহির করার মানসে পূর্বযুক্তি বোঝার চেষ্টা না করে, পূর্বযুক্তিকে খন্ডন করার চেষ্টা না করে, সবটা না জেনেই বিদ্যে জাহির করতে ব্যস্ত। এঁরা বিবেকানন্দ না পড়েই বিবেকানন্দের রচনা নিয়ে বেজায় তর্ক করতে ভালবাসেন। এরা অধ্যাত্মবাদের সংজ্ঞাটাও না জেনে অধ্যাত্মবাদ নিয়ে ভাসাভাসা বক্তব্যের ধোঁয়াশা তৈরি করেন। আসলে এরা যা করেন, তা হল অজ্ঞতা জাহিরের ভাঁড়ামো। পাঁচঃ ‘বাঙ্গালি কাঁকড়া’ জাতীয় প্রাণী। ‘বাঙ্গালি কাঁকড়া’র গল্পটা অনেকেরই জানা। সকলের জানা নেই ভেবে ছোট্ট করে বলছি। প্লেন তখন আকাশে। এয়ার হোস্টেস হঠাত ‘হাউ-মাউ’ করে চিৎকার সহযোগে লাফিয়ে উঠলেন। কি হয়েছে? চিৎকার শুনে সহকর্মী এয়ার হোস্টেস ও স্টুয়ার্ডরা দৌড়ে এলেন। ভীত বিড়ালাক্ষী সুন্দরী কাঁপা-কাঁপা তর্জনী তুলে দেখালেন একটা মুখ খোলা বড়সড় টিনের পাত্র। সেদিকে তাকিয়ে সমস্বরে সকলেই চিৎকার করে উঠলেন। পাত্র বোঝাই এক গাদা কাঁকড়া। কাঁকড়াগুলো খড়খড় আওয়াজ তুলে যেভাবে ওপরে উঠে আসছে, তাতে যে কোনও সময়…। আতঙ্কের কারণ বুঝে কাঁকড়ার মালিক বললেন, “কিছু ভয় নেই ম্যাডাম। এরা কেউই টপকে আসতে পারবে না। এ’সবই বাঙ্গালি কাঁকড়া। দেখছেন না, একটা উঠলেই বাঁকিরা কেমন টেনে নামাচ্ছে।” এরা কখনো কুমার শানুর সঙ্গে গান শেখা নীতিশ দত্ত। শানুর গলা স্কেলে পর্যন্ত থাকে না, কপালগুনে করে খাচ্ছে- বলে নিজের ঈর্ষাকে প্রকাশ করেন। এরা কেউ মফস্বল শহরের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা ও সেই সঙ্গে শখের জ্যোতিষী পারুল ভট্টাচার্য। উত্তর কলকাতার গা ছুঁয়ে থাকা শহরতলিতে কলেজে যেতে যেতে প্রায়শই এক বাসযাত্রীকে দেখছেন। সেই সাধারণ বাসযাত্রী আজ তারই পরিচিত অনেকের চোখে অসাধারণ হয়ে ওঠায় পারুল বলেন- “তোরা কেন যে ওঁকে এতো পাত্তা দিস বুঝি না।” আসলে পারুলই বোঝার চেষ্টাই করেননি কেন ঐ বাসযাত্রীর প্রবন্ধের বই ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীও রেফারেন্স বই হিসেবে তাঁর বইকে স্থান দেয়।

এই ‘বাঙ্গালি কাঁকড়া’ মার্কা প্রাণীরা গুরুত্ব দেয় কে কথাটা বলছে তার উপর। এরা যুক্তির বিরোধীতা করতে পারে সহকর্মী হওয়ার সুবাদে, পড়শি হওয়ার সুবাদে, আত্মীয় হওয়ার সুবাদে। ঈর্ষাকাতরতা থেকে উঠে আসে এদের গোটা বিরোধীতা, এদের সমস্ত কূটপ্রশ্ন।

আসুন এ’বার খোলা মনে দেখা যাক মোটামুটিভাবে কি কি ধরনের প্রশ্ন তুলে থাকেন।

এঁদের অনেকেই দাবী করেন, নিজে প্ল্যানচেটের আসরে আত্মা আনায় অংশ নিয়েছেন। কখনো বা দাবি করেন ওঁর বাবা-কাকা জাতীয় শ্রদ্ধেয় আপনজন প্ল্যানচেটে আত্মা এনেছিলেন। কখনো বা এঁরা দাবি করেন, ভূতে ভর হওয়া মানুষকে অদ্ভুত সব কান্ড ঘটাতে দেখেছেন তিনি নিজে, অথবা তাঁর বিশ্বস্ত কোন আপনজন। এঁরা উল্লেখ করেন রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট-চর্চা প্রসঙ্গে। এঁরা আত্মার অমরত্বের প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেন বেদ, উপনিষদ, গীতা ইত্যাদি গ্রন্থের কথা ছাড়াও কিছু কিছু বইয়ের কিছু কিছু কথা। বইগুলোর লেখক প্রধাণত অভেদানন্দ, নিগূঢ়ানন্দ ও ডাঃ মরিস রলিংস। এই প্রশ্নকর্তাদের কেউ কেউ বলেন ও চিঠি লেখেন, আমি যেন নিগূড়ানন্দের সঙ্গে দেখা করে আত্মা বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শুনি। আজকের ডাকে যে-সব চিঠি এসেছে তারই মধ্য থেকে একটা চিঠির একটু অংশ তুলে দিচ্ছি। পত্রলেখক শ্রীশৈলেনচন্দ্র ঘোষ। নিবাসঃ গৌরবাজার, বর্ধমান। তিনি লিখেছেন, “নিগূঢ়ানন্দের বইগুলো পড়লে বুঝবেন উনি সাধনার সর্বশেষ স্তরে পৌঁছেছেন। আমরা যাকে শ্রেষ্ঠ সাধক বা অবতার বলি, উনি তাই। আপনি আত্মা ও ভূতের অস্তিত্ব, দূরশ্রবন, দূরদর্শন, অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি, যোগে ভূমিত্যাগ, অলৌকিক ক্ষমতায় রোগমুক্তি ইত্যাদি সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, নিগূঢ়ানন্দ বর্তমান কালেরই মানুষ। আপনি দয়া করে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে আপনার সন্দেহের নিরসন ঘটবেই, এই বিশ্বাস রাখি।” আর একদল আছেন, যারা বলেন- “কে এলোরে, রামকৃষ্ণ, অরবিন্দ, বিবেকানন্দ, বেদ, গীতা, বাইবেল, কোরান সবাই ভুল বলছে, আর উনি ঠিক বলার ঠাকুরদাদা। অধ্যাত্মবাদ বোঝা অতই সোজা ! জীবন কেটে যাবে রে !”

error: Content is protected !!