চরম দুর্নীতি

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের একটি বড় অংশ এবং তাদের তল্পিবাহকরা মুক্তিযুদ্ধের সুযোগে চরম দূর্নীতিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে।

শুধুমাত্র বগুড়ার ষ্টেট ব্যাংক থেকে লুট করা হয়েছিল ৫৬ কোটি টাকার উপর। এ সমস্ত লুটপাটের সাথে জড়িত ছিলেন রাজনৈতিক নেতারা এবং আমলাদের একটা অংশ। কোটি কোটি টাকা নিয়ে বিদেশের মাটিতে বসে ছিনিমিনি খেলার ন্যাক্কারজনক ইতিহাসের কোন জবাব আওয়ামী লীগ সরকার প্রবাসে কিংবা স্বাধীনতার পর জনগণের কাছে কাছে দেয়ার দেয়ার কোন প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেনি। মনগড়া হিসাবের ফিরিস্তি দিয়ে লুটপাটের কলঙ্ক মোছা যায় না৷ সংগ্রামকালের লুটপাটের সম্পদে রাতারাতি রাজনৈতিক নেতারা, তাদের পরিবার-পরিজনরা এবং চিহ্নিত কিছু আমলা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিলেন। বাড়ি, গাড়ী, সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন ঐ সমস্ত অসৎ ব্যক্তিরা। সেই সমস্ত রহস্য সময়ের সাথে ক্রমান্বয়ে জনগণের সম্মুখে পরিষ্কার হয়ে উঠছিল। সংগ্রামকালের এক পর্যায়ে ক্ষুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা একবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন যে মুক্তিযুদ্ধ এগিয়ে নেয়ার জন্য সর্বপ্রথম এ সমস্ত অসৎ ব্যক্তিদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে ফেলা দরকার। এ ব্যাপারে কর্নেল ওসমানীর সাথে কথাও হয়েছিল। তাকে বোঝানো হয়েছিল এ সমস্ত অসৎ নেতৃত্বের অধিনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হওয়ায় বিশ্ব পরিসরে সংগ্রামের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। শুধু তাই নয় তাদের পার্থিব লোভ-লালসা এবং চারিত্রিক দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে প্রয়োজনে সম্পূর্ণ জাতিকেই ব্ল্যাকমেইল করা সম্ভব হবে অতি সহজেই। সব শুনে তিনি বলেছিলেন, “অভিযোগ যুক্তি সম্পন্ন কিন্তু তবুও বিদেশের মাটিতে নিজেদের মাঝে কাটাকাটি শুরু করলে মূল উদ্দ্যেশ্য থেকে আমরা দূরে সরে যাব। অবশ্যই এ সমস্ত অসৎ ব্যক্তিদের শাস্তি পেতে হবে, কিন্তু সেটা দেয়া হবে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্যে গণআদালতে।” তার কথা মেনে নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে গণআদালত তো দূরের কথা কোন কোর্ট-আদালতেও ঐ সমস্ত অপরাধিদের বিচার হয়নি। কারণ এ সমস্ত অসৎ কার্যক্রমের সাথে প্রশাসনের প্রায় সব রুই-কাতলাই জড়িত ছিলেন। রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে উঠে তখন অবস্থা বেসামাল হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অবস্থাও হয়েছিল ঠিক তাই। লুটপাট, চুরি-চামারির বিচারের পরিবর্তে এ সমস্ত জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপের মাত্রা গিয়েছিল অনেক বেড়ে। কর্নেল ওসমানীর কথা শুধু কথা হয়েই থেকে যায়। স্বাধীনতার লগ্ন থেকেই কোন ব্যাপারেই ন্যায়সঙ্গত কোন বিচার পায়নি জাতি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠির কাছ থেকে, শুধু পেয়েছে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, প্রতারণা ও বঞ্চনা।

লুটপাট সমিতির কার্যকলাপে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের তথা সমস্ত বাঙ্গালী জাতির ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছিল তার কয়েকটি বিবরণ নিচে দেয়া হলঃ-

লুটপাট সমিতির সদস্যরা তখন কোলকাতার অভিজাত পাড়াগুলোতে এবং বিশেষ করে পার্ক স্ট্রিটের হোটেল, বার এবং রেস্তোরাগুলোতে তাদের বেহিসাবী খরচার জন্য ‘জয় বাংলার শেঠ’ বলে পরিচিত। যেখানেই তারা যান মুক্তহস্তে বেশুমার খরচ করেন। থাকেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিংবা  হোটেলে। সন্ধ্যার পর হোটেল গ্র্যান্ড, প্রিন্সেস, ম্যাগস, ট্রিংকাস, ব্লু ফক্স, মলিন রু্য, হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি বার রেষ্টুরেন্টগুলো জয়বাংলার শেঠদের ভীড়ে জমে উঠে। দামি পানীয় ও খাবারের সাথে সাথে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের আমেজে রঙ্গীন হয়ে উঠে তাদের আয়েশী জীবন। বয়- বাবুর্চিরাও তাদের আগমনে ভীষণ খুশি হন। এমনই একজন নেতা তার দলবল নিয়ে প্রত্যেক দিন হোটেল গ্র্যান্ডের বারে মদ্যপান করতেন। তিনি বগুড়া ব্যাংক লুটের টাকার একটা বিরাট অংশ কব্জা করেছেন কোনভাবে। তার কাছে রয়েছে প্রায় চার কোটি টাকা। একদিন মধ্যরাতে তিনি হোটেল বারে গিয়ে মদ পরিবেশন করার জন্য বারম্যানদের হুকুম দেন। বারম্যানরা কাচুমাচু হয়ে তাকে জবাব দেয় সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় বার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জবাব শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন বাঙ্গালী শেঠ। টলমল অবস্থায় চিৎকার করে বলতে থাকেন, তিনি হোটেলটাই পুরো কিনে নিতে চান। বেসামাল কিন্তু শাসালো খদ্দের, তাই বারম্যানরা চুপ করে সবকিছু হজম করে যাচ্ছিল। শেঠ আবোল-তাবোল বকে পরে একজন বারম্যানকে হুকুম দেন, কাল বার খোলার সময় থেকে বন্ধ করার আগ পর্যন্ত তিনি ও তার সঙ্গীগণ ছাড়া অন্য কাউকে মদ পরিবেশন করা যাবে না। তারাই শুধু থাকবেন বারে। তার হুকুম শুনে বারম্যান ম্যানেজারকে ডেকে পাঠায়। ম্যানেজার এলে শেঠ তাকে প্রশ্ন করেন,

– রোজ আপনাদের বারের সেল কত টাকা?

ম্যানেজার একটা অংক তাকে জানায়। শেঠ তখন তাকে তার সিদ্ধান্তেরর কথা জানিয়ে বলেন পুরোদিনের সেলের টাকাই তিনি পরিশোধ করবেন। পুরো টাকার মদ ওরা খেয়ে শেষ করতে না পারলে বাকি মদ যেন তার বাথরুমের টাবে ভরে দেবার ব্যবস্থা করা হয়। তিনি তাতে গোসল করবেন। ম্যানেজার তার কথা শুনে ’থ হয়ে গিয়ে মাতালের প্রলাপ মনে করে কোন রকমে সেখান থেকে কেটে পড়েন।

আর একদিন আর একজন জয়বাংলার শেঠ তার পুত্রের প্রথমবারের মত জুতো পরার দিনটি উৎযাপন করার জন্য ব্লু ফক্স রেষ্টুরেন্টে প্রায় ১০০ জনের একটি শানদার পার্টি দেন। এছাড়া অনেক শেঠরা দিল্লী এবং বোম্বেতে গিয়ে বাড়িঘর কিনতে থাকেন। অনেকে আবার ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রিতেও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তাদের এ সমস্ত কির্তিকলাপের ওপর শহীদ জহির রায়হান একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার এ অভিপ্রায়ে অনেকেই ভীষণ অসন্তুষ্ট ছিলেন তার উপর। অনেকে তার এ ঔদ্ধত্বে ক্ষেপেও গিয়েছিলেন। তার রহস্যজনক মৃত্যুর পেছনে এটাও একটা কারণ হতে পারে। কোন এক নায়িকার জন্মদিনে তখনকার দিনে তার এক গুণমুগ্ধ ভক্ত তাকে ৯ লক্ষ টাকা দামের হীরের নেকলেস্ উপহার দিয়েছিলেন।

দরগা রোডের বিশু বাবুর বাড়িতে থাকতেন মন্ত্রী পরিষদের পরিবারবর্গ। প্রবাসী সরকারের টাকার প্রায় সবটাই কালো কালো ট্রাঙ্কে ভরে রাখা হয়েছিল বিশু বাবুর বাড়িতে এবং ৩নং সোহরাওর্য়াদী এ্যাভেনিউ এর তিন তলার ছাদের দু’টো কামরায়। সেখানে থাকতেন অর্থসচিব জনাব সামসুজ্জামান এবং তার পরিবার ও রাফি আক্তার ডলি। এ টাকার কোন হিসাব ছিল না। কোলকাতার বড় বাজারের মারোয়াড়ীদের সাহায্যে এগুলোর এক্সচেঞ্জ করা হত। এ কাজের দালালী করেও অনেকে কোটিপতি হয়ে উঠেন রাতারাতি। মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগ নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক হলেও তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা লোভ সংবরণ করতে না পেরে অসৎ হয়ে উঠেন।

কোন এক সেক্টর কমান্ডার এক পাকিস্তানী সিএসপি অফিসারের অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে বেয়োনেটের আঘাতে মেরে তার গা থেকে সোনার অলংকার খুলে নিয়েছিলেন; এমন ঘটনাও ঘটেছে। এ ধরণের কিছু ব্যক্তি নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করেছেন আজ অব্দি। কিন্ত তারা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের কলংক। তাদের অপকর্মের জন্য সাধারণভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক কলংকের ভাগী হতে হয়েছে। যুব শিবির, শরনার্থী শিবিরগুলোতে বরাদ্দকৃত রিলিফ সামগ্রী নিয়েও কেলেংকারী হয়েছে অনেক। ভারতের মাটিতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল প্রায় ১ কোটি শরনার্থী। তাদের জন্য সারাবিশ্ব থেকে রিলিফ সামগ্রী, যানবাহন ভারতীয় সরকারের প্রযত্নে প্রচুর এসেছিল। কিন্তু তার কতটুকুইবা দেয়া হয়েছিল শরনার্থীদের প্রয়োজন মেটাতে! এ সমস্ত রিলিফ সামগ্রী বিতরণের দায়িত্ব ছিল যৌথভাবে ভারত ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের। বগুড়ার ষ্টেট ব্যাংক ছাড়াও মোটা অংকের টাকা নিয়ে আসা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পাবনার ট্রেজারি থেকে। সে টাকারও কোন সুষ্ঠ হিসাব পাওয়া যায়নি।

 

কোলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রাণকেন্দ্রগুলো

মুক্তিযুদ্ধ কিংবা বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন খবর কিংবা তথ্য জানার জন্য ঐ সমস্ত প্রাণ কেন্দ্রগুলোই ছিল মূল উৎস।

ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত ৩নং সোহরাওয়ার্দী এ্যাভেনিউ জনাব আর আই চৌধুরির সরকারি বাসভবন হলেও তখন ঐ বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন প্রায় সমাজের ভিআইপি এবং ভিভিআইপি-দের প্রায় ১৭টি পরিবার। তাই সোহরাওয়ার্দী এ্যাভেনিউ সেই সময় হয়ে উঠেছিল দেশের এলিট শ্রেণীর আশ্রয়স্থল। এদের মধ্যে ছিলেন রাজনৈতিক নেতা, নামিদামী শীর্ষস্থানীয় আমলা, ব্যবসায়ী, পুলিশ, আর্মি এবং প্রচার মাধ্যমের লোকজন। উল্লেখযোগ্য হলেন বেগম সাজেদা চৌধুরি এবং তার স্বামী জনাব গোলাম আকবর চৌধুরি এবং পরিবার, জনাব মুস্তাকিম চৌধুরি এবং তার স্ত্রী এ্যানাথালা এবং পরিবার, রাফি আকতার ডলি, জনাব আসাদুজ্জামান এবং পরিবার, জনাব আলি আকবর খান, জনাব কামাল সিদ্দীকি, জনাব খসরুজ্জামান এবং তার স্ত্রী লুসি খালা, জনাব মামুনুর রশিদ এবং তার স্ত্রী রাকা, জনাব আব্দুল খালেক এবং তার পরিবার, জনাব ওয়ালীউর রহমান এবং ব্রজেন দাস। এদের অবস্থানের ফলেই এই বাড়িটি হয়ে উঠেছিল খবরা- খবরের বিশেষ প্রধান কেন্দ্র। অন্যান্য কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ছিল থিয়েটার রোড ছাড়াও ১৯নং সার্কাস এ্যাভেনিউ এর বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং দূতাবাস, প্রিন্সেপ স্ট্রিটের বামপন্থীদের আড্ডা, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, সিইইনসির হেডকোয়াটার্স, বাংলাদেশ থেকে আগত তরুণদের আড্ডা শিয়ালদাহ এবং বাংলাদেশ বেতার।

এ সমস্ত জায়গাগুলো রাতদিন চব্বিশ ঘন্টাই লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকতো এবং সব ধরনের খবরা-খবর এবং গুজব নিয়ে সবাই মেতে থাকতো। বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামকালে কোথায় কি ঘটেছে, গুজব কি রটেছে তার সবকিছুই জানা সম্ভব হতো ঐ সমস্ত জায়গাগুলো থেকে।

 

অন্যরা কি করছিল?

অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের কর্মকান্ড ছিল খুবই সীমিত। অস্থায়ী সরকার এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তারা ছিল অবাঞ্ছিত।

মাওলানা ভাসানী বাংলাদেশ থেকে আসামে পালিয়ে আসার পর থেকেই ভারতীয় সরকারের প্রটেকটিভ কাষ্টডিতে আটক হয়ে থাকেন। মজলুম নেতাকে নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত ছিল ভারত সরকার। প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে তিনি যাতে কোন প্রকার নেতৃত্ব দিতে না পারেন তার জন্য অতি সতর্কতার সাথে এ ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভারত সরকার এবং আওয়ামী লীগ কখনো মাওলানাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। তার সাথে তার দলীয় নেতা ও কর্মীদেরকেও কোন প্রকার যোগাযোগ রক্ষা করতে দেয়া হয়নি পুরো নয়টি মাস। ভাসানী, ন্যাপের কর্মী ও যুবনেতারা অল্পদিনেই বুঝতে পেরেছিলেন আওয়ামী লীগ প্রবাসী সরকার এবং ভারতীয় সরকারের কাছে তারা খুব একটা গ্রহণযোগ্য নন। মাওলানা ভাসানী এবং প্রগতিশীল যুব নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগ নেতাদের দলীয় সরকারের পরিবর্তে সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠনের আবেদন জানিয়ে ছিলেন। কিন্তু তাদের সে আবেদনে আওয়ামী লীগ কিংবা ভারতীয় সরকার কেউই সাড়া দেয়নি বরং আওয়ামী লীগ প্রবাসী সরকার যুদ্ধকালীন অবস্থায় প্রয়োজনমত মাওলানাকে ব্যবহার করার চেষ্টাই করেছে। কিন্তু মাওলানা ভাসানী সে ফাদে পা দেননি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জনাব মশিউর রহমান যাদুমিয়া একবার কোলকাতায় এসেছিলেন। কোলকাতায় তিনি তার দলীয় প্রধান মাওলানা ভাসানীর সাথে সাক্ষাৎ করতে ব্যর্থ হন। তবে তিনি তার দলীয় যুব ও ছাত্রনেতাদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে মত বিনিময়কালে তিনি বুঝতে পারেন ভারতের মাটিতে বসে তিনি কিংবা তার দলীয় কর্মীরা স্বাধীনতার যুদ্ধে তেমন বিশেষ কোন ভূমিকা রাখতে পারবেন না। তারা ভারত সরকারের কাছ থেকে কোনরূপ সাহায্যও পাবেন না, তাই তিনি দেশের অভ্যন্তরে গিয়ে গেরিলাযুদ্ধ সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সেরূপ নির্দেশ কর্মীদের দিয়ে বাংলাদেশে ফিরে যান। কোলকাতায় অবস্থানকালে ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ সর্বক্ষণ তাকে নজরে রাখে। আওয়ামী সরকারও তার আগমনকে সন্দেহের চোখে দেখেছিল। তার চলে যাবার পর মেনন, জাফর, রনোরা সম্মিলিতভাবে স্বীয় উদ্যোগে তাদের কর্মীদের মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। বামপন্থী দলগুলোর বেশিরভাগ নেতারা বিশেষ করে চীনপন্থী দলগুলোর নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা সংগ্রামের যথার্থ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হন। তারা এ সংগ্রামকে ‘কুকুরে কুকুরে লড়াই’ বলে ভুলভাবে আক্ষায়িত করে জাতীয় সংগ্রামকে উপেক্ষা করে শ্রেণী সংগ্রামের লাইন চলিয়ে যাবার প্রচেষ্টা করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তবে তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক নেতা তাদের ভুল বুঝতে পেরে পরবর্তিকালে স্বাধীনতার জন্য পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের ভেতরে থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার ভুল মূল্যায়নের জন্য প্রগতিশীল এবং বামপন্থীরা স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হন। তাদের এই দুর্বলতা এবং ভূল পরবর্তিকালে অনেকেই স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আজো অনেক পিছিয়ে আছে। তার জন্য আমাদের প্রগতিশীল ও বামপন্থী রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা অনেকাংশে দায়ী। ভারতের মস্কোপন্থীরা যেভাবে ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের লেজুড়বৃত্তি করে আসছিল ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের তথাকথিত মস্কোপন্থীরা সংগ্রামের সময় পুরোপুরিভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেছিল। প্রভুদের ইঙ্গিতে তাদের নিয়ে বিশ্ববাসীকে দেখাবার জন্য তথাকথিত পাঁচটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ৮ সদস্যের একটি উপদেষ্টা কমিটিও গঠন করেছিল প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার।

 

অস্থায়ী সরকার জোনাল এডমিনিষ্ট্রেটর নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়

এমএনএ, এমপিএ এবং আমলারা সুরক্ষিত স্বর্গ কোলকাতা ছাড়তে নারাজ হলেন। তাই পরিকল্পনাও গেল ভেস্তে।

প্রবাসী সরকার মুক্তিযুদ্ধের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের জন্য মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য বহু মিটিং এবং আলোচনার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এবং মুজিবনগরে অবস্থিত আমলাদের নিতে হবে। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা মুক্ত এলাকায় এমএনএ, এমপিএ এবং কোলকাতাবাসী আমলাদের অধিকাংশই যেতে রাজি হননি। ফলে তাদের সব দায়িত্বই বহন করতে হয়েছিল সেক্টর এবং সাব-সেক্টর কমান্ডারদের। মাঝেমধ্যে কোলকাতার মুজিবনগর থেকে নামি- দামী নেতারা বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে আসতেন মুক্তিযোদ্ধাদের মটিভেশন লেকচার দেয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্ত এ ধরণের মিশনে এসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের ভীষণ বেকায়দায় পড়তে হত। মুক্তিযোদ্ধাদের ফেস করতে পারতেন না তারা। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বলতেন, “গালভরা কথার ফুলঝুড়ি শোনানোর দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন আমরা যুদ্ধ করছি জানবাজী রেখে। আমাদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদপত্রের কি ব্যবস্থা করে এসেছেন সেটাই আমরা জানতে চাই। আমাদের সমস্যার অন্ত নেই। সমস্যার সমাধান যদি করতে না পারেন তবে অন্ততঃপক্ষে আমাদের সাথে থেকে সে সমস্ত সমস্যার ভাগীদার তো হতে পারেন। আর তা যদি সম্ভব না হয় তবে শুধু ছবি তোলার জন্য আর বক্তৃতা দেয়ার জন্য এসে আমাদের সময় নষ্ট করার কোন প্রয়োজন নেই। আপনারাও এ বৃথা কষ্ট না করে মুজিবনগরে বসে থাকুন। দেশ স্বাধীন হলে দেখা হবে। ” মুক্তিযোদ্ধাদের এ ধরণের বক্তব্য শুনে মুজিবনগরের আওয়ামী সরকার এবং ভারত সরকার একইভাবে শংকিত হয়ে উঠে। মুক্তিযোদ্ধা ও কমান্ডারদের আনুগত্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠে তারা।

 

ভবিতব্য সত্যি হলো

বিবিসির একটি সাংবাদিকের দল মাসিমপুর সামরিক হাসপাতালে আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে।

জুলাই মাসের শেষার্ধে লাঠিটিলার যুদ্ধে আমি দ্বিতীয়বারের মত আহত হই মর্টারের গোলা ও মেশিনগানের গুলিতে। চিকিৎসার জন্য আমাকে শীলচরের মাসিমপুর সিএমএইচ এ নিয়ে যাওয়া হয়। আহত অবস্থাতেও আমাকে হাসপাতাল কক্ষ থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়। আমার ঘরটাতেই স্থাপন করি ছোট খাট একটি op’s room। এ ব্যাপারে আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেন ব্রিগেডিয়ার ভট্টকে, কর্নেল বাগচী, মেজর দাসগুপ্ত ও ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী। আমি যখন আহত অবস্থায় হাসপাতালে তখন বিবিসি লন্ডন থেকে সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দল এ এলেন আমাদের সিলেট সেক্টরে। তারা আমার সাথে আলাপ করতে চান। আমার আপত্তি নেই জেনে তারা এলেন আমার হাসপাতালের রুমে। ঘরে আমি তখন শয্যাশায়ী। পরিচয়পর্ব শেষে তাদের একজন চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে বললেন,

– এতো দেখছি একটা ছোটখাটো op’s room. অসুস্থ অবস্থায় এ সমস্ত ম্যাপ, ওয়্যারলেস সেট প্রভৃতি নিয়ে আপনি কি করেন?

– আমি আহত হয়ে কিছুদিনের জন্য এখানে শয্যাশায়ী হয়ে আছি বলে যুদ্ধতো বন্ধ হয়ে যায়নি। যুদ্ধ চলছে এবং চলবে। সেক্ষেত্রে সাধ্যমত যতটুকু সম্ভব দায়িত্ব বিছানায় শুয়েও আমি পালন করে যাবার চেষ্টা করছি।

প্রশ্ন করলেন আর একজন,

– শুনেছি আপনি আরো দু’জন অফিসারের সাথে পাকিস্তান থেকে সর্বপ্রথম পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগদান করেছেন। আপনার আপন-পরিজনদের সবাইতো বাংলাদেশে রয়েছেন। তাদের উপর পাক বাহিনীর তরফ থেকে প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা হতে পারে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?

– আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জাতীয় সংগ্রাম। এ সংগ্রামে অবদান রাখার পবিত্র দায়িত্ব পালন করার জন্যই আমরা পালিয়ে এসেছি। আজ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবার থেকেই সদস্যরা এসে যোগদান করেছেন মুক্তিযুদ্ধে। দেশকে শত্রুর কবল থেকে স্বাধীন করার জন্যে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন তারা। তাদের এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের পরিবার- পরিজনদের ভাগ্যে যা ঘটবে আমার আত্মীয়-স্বজনদের ভাগ্যেও ঠিক তাই ঘটবে। অতএব, এ নিয়ে আমার চিন্তা করার কিছু নেই। আপনজনদের শত্রুর পাশবিক নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে দেশকে স্বাধীন করতে হবে তাইতো আমরা মরণপন যুদ্ধ করে যাচ্ছি দেশকে শত্রুমুক্ত করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আজাদী লাভ করার লক্ষ্যে। স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপোষ নেই। দেশকে স্বাধীন করে ছাড়বোই ইনশাল্লাহ্।

আমার জবাব শুনে তাদের একজন মন্তব্য করেছিলেন,

– আপনাদের মত সন্তান যে দেশ জন্ম দিয়েছে তার স্বাধীনতা পৃথিবীর কোন শক্তিই রোধ করতে পারবে না।

ভদ্রলোকের কথাগুলো আজও মনে আশার আলো যোগায়, ভবিষ্যত সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে উঠি। ১২ কোটি জাগ্রত বাংলাদেশী দাসত্বের সব শৃঙ্খল ভেঙ্গে চুর্নবিচুর্ন করে দেবে নিশ্চয়ই। স্বাধীন মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে সব চক্রান্তের জাল ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়াবেই একদিন। আমার সাথে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকারটি পরে বিবিসি থেকে প্রচারিত হয়েছিল। າ প্রচারণা থেকেই আমার আত্মীয়-স্বজনরা সর্বপ্রথম জানতে পারেন, আমি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছি।

অবিস্মরণীয় বিবাহ

বিবাহ পূর্ব নির্ধারিত বিষয় হলেও আমাদের বিয়েটা ছিল অস্বাভাবিক এবং ঐতিহাসিক বেশ কিছুদিন যাবত কোলকাতার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। আমার আহত হওয়ার খবরটা নিম্মীকে জানাইনি ইচ্ছে করেই। বেচারী অযথা চিন্তিত হয়ে পড়বে খবরটা শুনে। কিন্তু আমি না জানালেও থিয়েটার রোড থেকে খবরটা অতি সহজেই ওর কানে পৌঁছাতে পারে। শুয়ে শুয়ে এ সমস্তই ভাবছিলাম। কিছুক্ষণ আগে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাদের, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বাবু ও আতিক এসেছিল। ওদের সাথে অপারেশনাল এবং অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ কিছু বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর তারা ইনসট্রাকশনস্ নিয়ে ফিরে গেছে। একান্ত অবসর খুব কমই পাওয়া যায়। কেউ না কেউ আসছেই। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সমস্যা। বেশ ব্যস্ততার মধ্যেই আমার সময় কেটে যায়। ডাক্তার-নার্সরা অনেক সময় লোকজনদের আসা-যাওয়ার ভীড় দেখে আমাকে এসে উপদেশ দেন বিশ্রাম নেবার জন্য। হাসিমুখে তাদের আন্তরিকতার প্রতিদান দেয়া ছাড়া আমার পক্ষে আর কিছুই করা সম্ভব হয় না। মিসেস ভট্টকে প্রতিদিন খাবার পাঠাচ্ছেন হাসপাতালে। তার স্নেহের ঋনে আবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে সারাজীবন। হঠাৎ একাকীত্ব যেন আমায় পেয়ে বসল৷ মনটাও কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। নিম্মীকেই বিশেষ করে মনে পড়ছিল। স্মৃতিমধুর অতীত মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল। কিছুক্ষণের জন্য তলিয়ে গিয়েছিলাম অতীত স্মৃতিমন্থনে। হঠাৎ দেখলাম দরজায় তিনজন এসে দাড়িয়েছে। মাহবুব ও ফারুক দু’জনেই আমার প্রিয় গেরিলা কমান্ডার। কিন্তু তাদের সাথে তৃতীয় ব্যক্তিকে দেখে চমকে উঠলাম ! নিজের চোখকেই ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না! কাছে আসতেই পরিষ্কার হয়ে গেল সব। বাপ্পিই বটে !

– একি ! তুই এখানে? আশ্চর্য হয়ে গিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম।

– থাক থাক উঠতে হবে না।

বলে বাপ্পি এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। উষ্ণ আবেগে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম দু’জনেই দু’জনকে জড়িয়ে ধরে। ইতিমধ্যে মাহবুব বাপ্পিকে শয্যার পাশে একটা চেয়ার টেনে দিয়ে বসতে বলল।

– কিরে বাপ্পি ! তুই এখানে এলি কি করে? পথ চিনলি কি করে? জানলিই বা কি করে আমি এখানে আছি?

– আগে বল আহত হবার কথা তুই আমাদের কেন জানাসনি? পাল্টা প্রশ্ন বাপ্পির।

– কেন জানাইনি সেটা সত্যিই কি বুঝতে পারছিস না?

– আমরা উদ্বিগ্ন হতাম ঠিকই বিশেষ করে নিম্মী। কিন্তু তবুও খবরটা তোর জানানো উচিত ছিল। তার যুক্তি মেনে নিলাম। ঝগড়া করে লাভ নেই, আমার ভুল হয়েছে মেনে নিলাম ।

– কিন্তু তুই হঠাৎ করে এখানে কেন?

– তোর আহত হবার খবর নূর ভাই এবং সালাহ্উদ্দিন ভাই নিজেরা বাসায় এসে আমাদের জানান। খবরটা জানিয়ে ওরা অবশ্য নিম্মীকে বোঝাতে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি যে তুই ভালোই আছিস। ভয়ের কোন কারণ নেই। কিন্তু তাদের সে সান্ত্বনা বাণী নিম্মী পুরোপুরি মেনে নিতে পারছিল না কোন মতেই। তার একই সন্দেহ ওঁরা তার কাছে আসল অবস্থা লুকোচ্ছেন। নিম্মীর সে কি কান্না! সাথে সাথে খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিল। ওর অবস্থা দেখে আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না। ওকে বললাম, ‘ঠিক আছে আমি নিজেই যাচ্ছি শীলচরে ডালিমের অবস্থা দেখে আসতে।’ কিন্তু বাধ সাধলেন বাবা-মা৷ তারা বললেন, ‘ক্যানাডা যাবার সবকিছুই ঠিক হয়ে গেছে। এ অবস্থায় শীলচর যাবার প্রশ্নই উঠে না।

– ওহ ! তুই আর নিম্মী ক্যানাডা যাচ্ছিস বুঝি? কিছুটা অবাক হলাম আমি।

– হ্যাঁ। আমাদের দু’জনের মতের বিরুদ্ধেই বাবা আমাদের গামু কাক্কুর কাছে পাঠাবার সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন। মা দিব্যি দিয়েছেন আমরা না গেলে তিনি আত্মহত্যা করবেন।

এ অবস্থায় আমাদের কি আর করার আছে বল? কিন্তু নিম্মী কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছে না। এর জন্য ওর উপর বাবা-মা ভীষণ খ্যাপা। মারধরও তাকে খেতে হচ্ছে বেধুম। ওর এক কথা, তোকে এ অবস্থায় রেখে সে কোলকাতার বাইরে এক পাও নড়বে না। প্রয়োজনে সেও আত্মহত্যাই করবে তবুও ক্যানাডা যাবে না কিছুতেই। এ বিষয় নিয়ে বাড়িতে এখন অশান্তির ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সবদিক সামলাতে পারছি না কিছুতেই। বিশেষ করে নিম্মীর যে অবস্থা, কোন একটা অঘটন ঘটে যাওয়া অসম্ভব কিছুই নয়। অবস্থা দেখে আমিও বাবাকে মুখের উপর বলে ফেললাম, ‘ডালিমকে না দেখে ক্যানাডায় আমিও যাব না।’ আমার দৃঢ়তায় অবশেষে বাবা-মা রাজি হলেন আমাকে আসতে দিতে। আমার আসার অনুমতি পাওয়াতে নিম্মী বেচারীও কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে। ওকে কথা দিয়ে এসেছি তোর যথাযথ ব্যবস্থা করেই আমি ফিরব। প্রয়োজন হলে কোলকাতায়ও নিয়ে যাব তোকে। তারপর ট্রেনে করে শীলচর। শীলচর ষ্টেশনে নেমে মুক্তিযোদ্ধাদের সদর দফতর খুজে পেতে এতটুকু বেগ পেতে হয়নি আমার। ওখান থেকে মাহবুব ও ফারুককে সঙ্গে দিয়ে দেয়া হল। তারাই পথ দেখিয়ে নিয়ে এল এখানে। মজার কথা কি জানিস! শীলচর পৌঁছে সবচেয়ে অবাক হয়ে গেয়েছিলাম এটা দেখে যে বাপ্পি নামটার মাধ্যমে আমি এখানে বহুলভাবে পরিচিত।

– হ্যাঁ। মাহবুব, ফারুক দু’জনেই আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন। ওরা ছাড়াও আরও অনেকেই তোদের ব্যাপারে সবকিছুই জানে। কথার ফাঁকে নার্স চা-নাস্তা রেখে গিয়েছিল। বাপ্পিকে বললাম,

– আমার বা দিকের এত বড় ব্যান্ডেজ দেখে ঘাবড়াসনে। ব্যান্ডেজের তুলনায় ক্ষত অনেক ছোট। কাধে মাত্র তিনটি এলএমজি বুলেট আর তালুতে মর্টার শেলের সিপ্রন্টার লেগেছে এই যা। ডাক্তাররা বলেছেন, নন ষ্টপ ব্লিডিং এর মধ্যেও ৯০ মাইল গাড়িতে করে হাসপাতালে জীবিত অবস্থায় যখন পৌঁছতে পেরিছি তখন এ যাত্রায় মরার ফাঁরা কেটে গেছে। এখনতো বহাল তবিয়তেই রয়েছি। দেখতে পাচ্ছিস না কেমন op’s room সাজিয়ে বসেছি? কোন অসুবিধে নেই।

বাপ্পির ছলছল চোখ দেখে অনেকটা বাধ্য হয়েই ওকে আশ্বস্ত করার জন্য কথাগুলো বলতে হল আমার। আমার কথায় বাপ্পির উদ্বিগ্নতা কতটুকু এল ঠিক বুঝতে পারলাম না। অল্পক্ষণ সে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল,

– এখানে হাসপাতালে হাসপাতালে তোর পড়ে থাকা চলবে না। উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য তোকে কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন৷ ৷

– ঠিক বলেছেন বাপ্পি ভাই। ডাক্তাররাও তাই বলছেন। কোলকাতায় গিয়ে স্পেশালিষ্ট এর আন্ডারে চিকিৎসা করানো উচিত বলে তারাও মনে করছেন। কিন্তু হক ভাই কিছুতেই সেক্টর ছেড়ে যেতে রাজি নন। তিনি চলে গেলে আমাদের এখানে অনেক অসুবিধা হবে এটা ঠিক। কিন্তু কোলকাতায় গিয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা করিয়ে সম্পুর্ন সুস্থ হয়ে তিনি আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন সেটাই আমরা সবাই চাই। তিনি সম্পুর্ন সুস্থ হয়ে ফিরে এলে তার সাময়িক অনুপস্থিতির ঘাটতি অনায়াসে পুষিয়ে নিতে পারব সুদে-আসলে। মাহবুব বাপ্পির কথায় সায় দিয়ে বলে উঠল।

– হক ভাইকে যে করেই হোক আপনাকে কোলকাতায় নিয়ে যেতেই হবে। এখানে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে তার অবস্থার চরম অবনতিও ঘটতে পারে। এর জন্য কিছু সময়ের জন্য তাকে কোলকাতায় অবশ্যই যেতে হবে। ফারুকও তার যুক্তিকে সমর্থন জানিয়ে বলল।

বাপ্পির জেদ ও সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের যুক্তির কাছে আমার কোন কথাই টিকল না৷ সবার কাছে বিদায় নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই বাপ্পি আমাকে নিয়ে কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হল। বাই রোড আমরা গৌহাটি এলাম। সঙ্গে এল আমার প্রিয় গেরিলা কমান্ডাররা। গৌহাটি থেকে প্লেনে কোলকাতায়। সবাইকে ছেড়ে আসতে ভীষণ খারাপ লাগছিল। ওরা সবাই অশ্রুসিক্ত আবেগে বিদায় দিয়েছিল আমাদের। কথা দিয়েছিলাম, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা সেরে ফিরে আসব।

কোলকাতায় ফিরে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন তখন হেডকোয়াটার্সে গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছে। ক্যাপ্টেন নূরুল ইসলাম শিশু স্বাস্থ্যগত কারণে সেক্টর থেকে হেডকোয়াটার্সে ষ্টাফ অফিসার হিসেবে যোগদান করেছেন। তিনি নাকি সেক্টরে অসম্ভবভাবে স্নায়ু দুর্বলতা এবং মানসিক রোগে ভুগছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা কিছুতেই নাকি তার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। মেজর মঈনুল ইসলামকে যুদ্ধক্ষেত্রে কাপুরুষতা ও ভুল নেতৃত্বের জন্য কমান্ড থেকে অব্যাহতি দিয়ে হেডকোয়াটার্সে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তিনি কিছুদিন যাবত হেডকোয়াটার্সেই অবস্থান করছেন।

যুদ্ধকালীন সময়ে কোলকাতায় বেশকিছু পরিবারের সাথে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে মিত্রী মাসী, ডঃ গনী এবং তার পরিবার, অরূপ দা ও পারুমিতা বৌদি, জনাব আইয়ূব ও তার স্ত্রী গৌরিদী, প্রিতিশ নন্দী ও তার স্ত্রী রীনা, ইন্দু প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অসীম ভালোবাসা ও সহানুভূতি পেয়েছিলাম। তারা সবাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিভিন্নভাবে প্রচুর অবদান রেখেছিলেন। যুদ্ধের বিবরণ ও অগ্রগতি সম্পর্কে আমাদের কাছ থেকে শুনতে তারা সর্বদাই বিশেষভাবে উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনা তাদের সবার মধ্যেই ধরা পড়ত প্রকটভাবে। কিন্তু যখনই তাদের বলেছি, “স্বায়ত্ব শাসনের দাবি জানিয়ে ব্যর্থ হয়ে স্বাধীনতার জন্য আমরাতো সংগ্রাম করে যাচ্ছি, কিন্তু পশ্চিম বাংলার আপনারা নিশ্চুপ হয়ে কেন্দ্রিয় শোষণ এবং জাতীয় নির্যাতন সহ্য করছেন কেন? পুরো বাঙ্গালী জাতির মুক্তির জন্য আপনাদের কি কিছুই করার নেই?” এ ধরণের আলোচনায় সর্বদাই তারা পাশ কাটিয়ে যেতেন অথবা থাকতেন চুপ করে। কখনও যুক্তি দেবার চেষ্টা করতেন বাংলাদেশের সাথে তাদের অবস্থাকে তুলনা করা ঠিক নয়। বেশ অস্বস্থিকর অবস্থায় পড়ে যেতেন তারা এ ধরণের বিতর্কে। তাই আমরাও এ সমস্ত ব্যাপারে তেমন বিশেষ উচ্চবাচ্য করতাম না৷ সময় সময় আমরা এ ধরণের কথাও তাদের বলেছি, “বাংলাদেশের সংগ্রামের ছত্রছায়ায় কংগ্রেস সরকার সিআরপি এবং বিএসএফ বাহিনীর মাধ্যমে অসংখ্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, যুবক মেরে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার অঞ্চলে।” এ ধরণের বক্তব্যকে অস্বীকার করতে পারতেন না তারা। কিন্তু সব সত্যকেই কেমন জানি নেতিবাচকভাবে মেনে নিয়ে চুপ করে থাকতেন। তাদের এই চুপ করে থাকার রহস্য আজও মাঝেমধ্যে আমাকে ভাবিয়ে তোলে।

থিয়েটার রোডেই আমার থাকার ব্যবস্থা হল। তখনকার দিনে প্রখ্যাত বোন স্পেশালিষ্ট ডঃ মুরালী মুখার্জীর সাথে আমার চিকিৎসার ব্যাপারে পারুমিতা বৌদি ইতিমধ্যেই আলাপ করেছেন। আমার ক্ষত পরীক্ষা করে তিনি বললেন, “গান পাউডার এবং বুলেট ইনজ্যুরির ফলে খারাপ ধরণের ইনফেকশন দেখা দিয়েছে। ইনফেকশনটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে গ্যাংরিনে টার্ন নিতে পারে। প্রথমে চেষ্টা করতে হবে ইনফেকশন বন্ধ করার।” ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু কিছুই করার নেই। বাস্তবতাকে মেনে নিতেই হবে। তিনি ঔষধ, ইনজেকশন লিখে দিলেন এক সপ্তাহের জন্য। বৌদি আমাকে মনোবল জোগানোর জন্য বললেন, “কোন চিন্তা করবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে ৷ ” বেশিরভাগ সময় আমাকে শুয়েই থাকতে হয়। বাপ্পির সাথে নিম্মী এসে আমাকে দেখে গেছে। রোজ তার পক্ষে আসা সম্ভব নয়। সুযোগমত ও টেলিফোন করে আমাকে। বাপ্পির মাধ্যমে ভালোমন্দ খাবার পাঠায় প্রায়ই।

একদিন বাপ্পি এল। ভীষণ গম্ভীর ভাব। বুঝলাম বাসায় কিছু একটা ঘটেছে। ঠিক তাই। ক্যানাডা যাওয়া নিয়ে ঝড় বয়ে গেছে বাসায়। কথা কাটাকাটি তারপর বেধম প্রহার। বাপ্পি বলল, “বাসার অবস্থা সঙ্গিন হয়ে উঠেছে। এর একটা আশু সমাধান প্রয়োজন। তা না হলে যে কোন অঘটন ঘটিয়ে বসতে পারে নিম্মী। তার মত কোমল প্রকৃতির মেয়েও ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে। ওকে কিছুতেই ক্যানাডায় পাঠাতে পারবে না বাবা-মা৷ মানসিক চাপে ক্রমান্বয়ে তার শারীরিক অবনতিও ঘটছে। রীতিমত অসুস্থ হয়ে পড়ছে সে। এ অবস্থায় সব চাপ সহ্য করা কতদিন সম্ভব হবে তার পক্ষে?” সব শুনে ভীষণ চিন্তায় পড়লাম। কি করে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব? কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। নূর এবং সালাহ্উদ্দিনের সাথে পরামর্শ করা যেতে পারে। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলাম ওদের সাথে। তারা বলল, “সব দিক রক্ষা করার জন্য আমাদের বিয়ে হয়ে যাওয়া দরকার। একমাত্র বিয়ে হলেই নিম্মীর ক্যানাডা যাওয়া বন্ধ হতে পারে। একমাত্র তখনই ওর পক্ষে আমাকে সার্বক্ষণিক সঙ্গ দেয়া সম্ভব৷” কিন্তু এ অবস্থায় বিয়ের জন্য তার বাবা-মা রাজি হবেন কি? নূর ও সালাহ্উদ্দিন একদিন আমার তরফ থেকে প্রস্তাব নিয়ে গেল নিম্মীদের বাসায়। প্রস্তাবে ওর বাবা-মা রাজি হলেন না। ওদের যুক্তি যেখানে সবকিছুই আজ অনিশ্চিত সেখানে কি করে তারা মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে রাজি হন? হতাশ হয়ে ফিরে এল নূর এবং সালাহ্উদ্দিন। ওদের কোন যুক্তিই তাঁরা গ্রহণ করলেন না। অবস্থার আরো অবনতি ঘটতে থাকে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হবার পর। নিম্মী আমাকে পরিস্কার লিখে জানাল, “যেভাবেই হোক না কেন তাকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতেই হবে। তা না হলে সে আত্মহত্যা করবে কিন্তু তবুও ক্যানাডায় আমাকে এ অবস্থায় ফেলে রেখে সে কিছুতেই যাবে না।” কি অসম্ভব দৃঢ়তা! দুঃশ্চিন্তায় অধীর হয়ে অনেক ভেবেচিন্তে স্থির করলাম বিয়েই করব। নূর, সালাহউদ্দিন ওরাও আমার সিদ্ধান্তে একমত হল। এ ব্যাপারে গৌরিদী, গনী নানা, মিসেস জামানের সাথে আলাপ করে তাদের পরামর্শ চাইলাম। তারাও অভিমত প্রকাশ করলেন, “বিয়েই একমাত্র পথ।” নিম্মীকে পত্র মারফত জানিয়ে দিলাম, “আমরা কিছু একটা করছি। কিন্তু তাকে সুস্থ এবং স্থির থাকতে হবে।”

বিয়ে তো হবে। কিন্তু নিম্মীকে কি করে ৩নং সোহরাওয়ার্দী এ্যাভেনিউ থেকে বের করে আনা যায়। বাড়িটা তখন একটি বিশেষ নিরাপত্তাধীন দুর্গই বটে। সমস্ত VIP-V.VIP’রা বাস করছেন সেখানে। তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রায় ৩০-৪০ জন পুলিশ সার্বক্ষণিকভাবে পাহারায় মোতায়েন রয়েছে। তার উপর নিম্মীর উপর রয়েছে কড়া নজর। বাড়ির বাইরে যাওয়া ওর জন্য নিষিদ্ধ। সর্বোপরি সে শারীরিকভাবে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে। সবাই মিলে তাকে বের করে আনার একটা পরিকল্পনা আঁটা হল।

মিসেস জামান, নায়লা, লুবনা ও গৌরিদী যাবেন নিম্মীদের বাসায়। নায়লা, লুবনা নিম্মীর বন্ধু বিধায় মিসেস জামানের সাথেও নিম্মীদের পূর্ব পরিচিতি আছে। নায়লা, লুবনা এবং মিসেস জামান বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক দল গঠনের জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়ে কাজ করছিলেন সেটা তখন প্রায় সর্ব মহলেই জানা। নিম্মী খ্যাতিমান ক্ল্যাসিকাল নৃত্য শিল্পী তাই সেও যাতে দলে যোগদান করে সেই অনুরোধ জানাবার উছিলায় যাবেন তারা। ঠিক হল কথার ফাকে নায়লা ও লুবনা নিম্মীকে যে করেই হোক কোনমতে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসবে। বাইরে নূরেরা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় থাকবে। এরপর গাড়ি করে সোজা মৈত্রী মাসীর বাড়ি। বিয়ে সেখানেই হবে। গনী নানা বিয়ের কাজী, রেজিষ্ট্রার এসব কিছুর দায়িত্ব নিবেন। সালাহ্উদ্দিনকে আনুসাঙ্গিক অন্যসব ব্যবস্থার ভার দেয়া হল। পরিকল্পনার ব্যাপারে অবগত থাকলেন থিয়েটার রোড হেডকোয়াটার্সের গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার, ক্যাপ্টেন চৌধুরী। এছাড়া অন্য কাউকে কিছু বলা হল না। বিয়ের দিন ধার্য্য হল ১৬ই আগষ্ট সকাল দশটার দিকে। নায়লারা গিয়ে উপস্থিত হল ৩নং সোহরাওয়ার্দী এ্যাভেনিউতে। প্ল্যানমত আলাপের এক ফাকে নায়লা এবং লুবনা বসার ঘর থেকে গিয়ে হাজির হল নিম্মীর ঘরে। সেখানে পৌঁছে নিম্মীকে লায়লা বলল, “এক্ষুণি চলো আমাদের সাথে। আজ তোমার বিয়ে।” প্রথমটায় হতচকিত হয়ে গিয়েছিল নিম্মী। কিন্তু মুহুর্তেই বুঝে নিল সবকিছু। অসীম সাহসের পরিচয় দিয়ে এক কাপড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রস্তুত হয়ে উঠে দাড়াল নিম্মী। যে কোন কুমারী মেয়ের পক্ষে এ ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা একটি অসম্ভব দুরহ্ কাজ। নিম্মীর ভালোবাসার একনিষ্ঠতা এবং গভীরতাই সেদিন শক্তি যুগিয়েছিল অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে। শারীরিক অসুস্থতা এবং স্নায়ু দুর্বলতার জন্যে বেচারী হাটতেও পারছিল না ঠিকমত। নায়লা ও লুবনা ওকে দু’দিক থেকে ধরে প্রায় বহন করে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে কোনমতে অতি কষ্টে নামিয়ে নিয়ে এল গেটের বাইরে। সেখান থেকে সোজা মৈত্রী মাসীর বাসায় নূর নিয়ে এল সবাইকে। ওখানে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। সব বন্দোবস্ত প্ল্যানমত ইতিমধ্যে করা হয়েছে। সালাহ্উদ্দিন নিম্মীর জন্য বিশ-পচিশ টাকা দামের দু’টো শাড়ি এবং আমার জন্য দশ টাকা দামের একটা পাঞ্জাবী কিনে নিয়ে এসেছে। সেগুলো পড়েই আমাদের বিয়ে হল। সালাহ্উদ্দিন হল নিম্মীর উকিল বাপ। সাক্ষী হয়ে রইলেন গনী নানা, গৌরিদী, নূর এবং মিসেস জামান। বিয়ের পর উপস্থিত মুরুব্বীরা এবং মৈত্রী মাসী আমাদের আর্শীবাদ করলেন। বিয়ের দলিল রেজিষ্ট্রি করতে দু-তিন দিন সময় লাগবে। এ সময়টা লুকিয়ে থাকতে হবে আমাদের। কারণ নিম্মীর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে বিয়ে করার পরিপ্রেক্ষিতে যে অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে তার মোকাবেলা করার জন্য বিয়ের দলিলটা অপরিহার্য। গৌরিদীই ঠিক করে ফেললেন তার পরিচিত এক ধনী ব্যবসায়ীর পার্ক ষ্টিট্রের একটা গেষ্ট হাউস। ছোট্ট কিন্তু সাজানো গেষ্ট হাউস। সেখানেই হবে আমাদের বাসর এবং মধুচন্দ্রিমা। আমাদের গোপন আস্তানার খবর বিয়েতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ছাড়া আর কাউকে জানানো হবে না। সেদিন সন্ধ্যায় আমাদের চলে যেতে হল গেষ্ট হাউসে। নায়লা, গৌরিদী, নূর এবং সালাহ্উদ্দিন আমাদের পৌঁছে দিল। রজনীগন্ধা ও বেলী ফুল দিয়ে নায়লা, লুবনারা সুন্দর করে রুচিসম্মতভাবে সাজিয়ে দিয়েছিল আমাদের বাসর ঘর। ওরা চলে যাবার পর হঠাৎ করে আমরা দু’জন ভীষণ একলা হয়ে গেলাম। সারাদিনের ঘটনাবলী এত দ্রুত ঘটেছে যার ফলে চিন্তা-ভাবনার কোন অবকাশই আমরা পাইনি এতক্ষণ একটা ঘোরের মাঝেই কেটে গেছে পুরো দিনটা। ফ্ল্যাটের নির্জন পরিবেশে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহের গুরুত্ব উপলদ্ধি করে কেদে উঠল নিম্মী৷ অতি স্বাভাবিক কারণেই ভেঙ্গে পড়ল সে। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, “সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ধৈর্য্য ধরতে হবে। সময় সব সমস্যার সমাধান করে দেবে ইনশাল্লাহ্।” বেচারী ভীষণভাবে কাদঁতে কাদঁতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অতীত ও ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম এক সময় পরদিন সকালেই নূর এসে জানাল, আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। নিম্মীর বাবা অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করেছেন, “আমি তার মেয়েকে জোর করে অপহরণ করে নিয়ে গেছি বাসা থেকে।” প্রধানমন্ত্রী গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত সালাহ্উদ্দিনকে ডেকে হুকুম দিয়েছেন যে করেই হোক আমার এবং নিম্মীর খোঁজ করে তাকে বের করতেই হবে কোথায় আছি আমরা। প্রয়োজনে অপহরণকারী আর্মি অফিসারের কাছ থেকে নিম্মীকে উদ্ধার করার জন্য ভারতীয় পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগের সহায়তাও গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বিয়ের দলিল রেজিষ্ট্রি হয়ে হাতে না আসা পর্যন্ত কিছুই কাউকে বলার উপায় নেই। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন কর্নেল ওসমানীও। ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করে অন্যায়ভাবে জোর করে ভদ্রলোকের মেয়েকে যে অপহরণ করতে পারে তার কঠোর সাজা হওয়া উচিত। একই সাথে তিনি ভীষণভাবে দুঃখিতও হয়েছেন। নূরকে বলেছেন, “ডালিমের মত যোগ্য অফিসার কি করে এ ধরণের কাজ করতে পারে সেটা তিনি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেন না।” নূর আমাদের সাবধান করে দিয়ে বলল, “স্যার আপনারা ঘরের বাহিরে যাবেন না দলিল হাতে না পাওয়া পর্যন্ত। গনী নানা চেষ্টা করছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দলিল রেজিষ্ট্রি করার। দলিলটা হয়ে গেলেই সবাইকে বুঝিয়ে ব্যাপারটার আপোষ মীমাংসা করার উদ্যোগ নেয়া হবে।” একবার স্থির করেছিলাম বাপ্পিকে একটা ফোন করে সব কিছু জানিয়ে ওকে বলি আমরা ভালোই আছি। কিন্তু নূরের কথায় সেটা করা সম্ভব হল না। ১৯ তারিখে আমাদের হাতে দলিল পৌঁছে গেল। সেদিনই সমস্ত ব্যাপারটা সালাহউদ্দিন, নূর এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার, কর্নেল ওসমানী এবং তাজুদ্দিনকে বুঝিয়ে বললেন। সমস্ত কিছু বিস্তারিত জানবার পর জনাব তাজুদ্দিনকে সবাই অনুরোধ জানালেন ব্যাপারটার একটা মীমাংসা করে দেবার জন্য। জনাব তাজুদ্দিন সেদিনই নিম্মীর বাবাকে এবং আমাদের ডেকে পাঠালেন থিয়েটার রোডে। নিম্মীর বাবার পৌঁছার আগেই আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম। জনাব ওসমানী এবং জনাব তাজুদ্দিনকে সালাম করলাম দু’জনে, তারা আর্শীবাদ করলেন। জনাব তাজুদ্দিন বললেন যা হবার তা হয়ে গেছে। জনাব চৌধুরীকে তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি এলে তার কাছে মাফ চাইতে হবে আমাদের দু’জনকেই। এতেই কাজ হবে। কারণ জনাব চৌধুরী শক্ত অফিসার হলেও মনটা তার শিশুর মতই সরল এবং কোমল।

অল্পক্ষণ পর জনাব চৌধুরী ও বাপ্পি এসে পৌঁছালো। নূর তাদের অর্ভ্যথনা করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে এল। সেখানে কর্নেল ওসমানীও উপস্থিত ছিলেন। আমাদেরকেও হাজির করানো হল আসামীর মত। ঘরে ঢুকতেই জনাব তাজুদ্দিন গর্জে উঠলেন, “কি করেছ তোমরা? এত বড় দুঃসাহস হল কি করে? আমি মর্মাহত হয়েছি তোমাদের ছেলেমানুষী কার্যকলাপে। বিয়ে-শাদী বাচ্চাদের পুতুল খেলা নয়। মুরুব্বীদের আর্শীবাদ ছাড়া কেউ কোনদিন সুখী হতে পারে না৷ জলদি তোমরা বাবার কাছে মাফ চাও।” এরপর নিম্মীর বাবাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, “চৌধুরী সাহেব ওরা আপনারই সন্তান। ভুল করে ফেলেছে না বুঝে। ওদের আপনি ক্ষমা করে আর্শীবাদ করুন।” প্রধানমন্ত্রীর কথা শেষ হতেই আমরা বাবার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। নিম্মী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ওতেই মোক্ষম কাজ হল। মোমের মত গলে গেলেন চাচা মানে নিম্মীর বাবা। নিম্মীকে জড়িয়ে ধরে তিনিও কাঁদতে লাগলেন। আমাকেও টেনে তুলে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। নূর, সালাহ্উদ্দিন ওরা সব তৈরিই ছিল। মিষ্টির প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকল ব্যায়ারা। এক আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হল থিয়েটার রোডে। চাচার কাছ থেকে জানতে পারলাম খালাম্মা মানে নিম্মীর মা ভীষণভাবে আঘাত পেয়েছেন নিম্মীর বাড়ি ছেড়ে চলে এসে বিয়ে করায়। তিনি ভীষণ জেদি এবং তীব্র অভিমানী। তার রাগ না কমলে বাড়িতে আমাদের যাওয়া ঠিক হবে না৷ এতে হিতে বিপরীত হবারই সম্ভাবনা। ঠিক হল আরো কিছুদিন আমাদের গেষ্ট হাউজেই থাকতে হবে। বাপ্পিকে সমস্ত ঘটনা থেকে বাদ রাখা হয়েছিল বলে সে ভীষণভাবে অভিমান করেছিল আমাদের উপর। অতি কষ্টে তার মান ভাঙ্গাতে হয়েছিল আমাদের দু’জনকে। বাবা চলে যাবার পর জনাব তাজুদ্দিন বলেছিলেন, “দু’জনে দু’জনকে পছন্দ করে দুঃসাহসিকভাবে বিয়ে করেছ; এখন থেকে তোমরা দু’জনেই হবে দু’জনের অবলম্বন। দুঃখ কর না সময়মতো সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের বিয়েও হয়েছিল ঠিক তোমাদের মত করেই সবার অমতে। আমি আর্শীবাদ করছি তোমরা চিরসুখী হও।”

তাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে আসতেই নূর, সালাহউদ্দিনরা সব আমাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় পুরো থিয়েটার রোড মাতিয়ে তুলল। কর্নেল ওসমানীও এসে যোগ দিলেন আমাদের সাথে। সবাই সেদিন একসাথে রাতের খাওয়া খেলাম। বিশেষ খাবারের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল সেদিন। বিদেশের মাটিতে জীবনের একটি বিশেষ গুরুত্বপর্ণ সন্ধিক্ষণে সেদিন জনাব তাজুদ্দিন, কর্নেল ওসমানী, গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার, ক্যাপ্টেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিন, লেফটেন্যান্ট নূর, মৈত্রী মাসী, গৌরিদী, গনী নানা, মিসেস জামান, নায়লা, লুবনা, জনাব আইয়ূব, প্রীতিশ নন্দী, রীণা, ইন্দু, ডঃ মুখার্জী, অরুপদা এবং ওদের মত অন্য সবার কাছ থেকে যে উষ্ণ আন্তরিকতা এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এবং সহযোগিতা পেয়েছিলাম সেটা জীবনে কখনোই ভোলা যাবে না। আমরা দু’জনেই তাদের কাছে চিরঋনী হয়ে থাকব সারাজীবন।

এ ক’দিনের টেনশনে ঠিকমত ঔষধপত্র খাওয়া হয়নি ফলে চিকিৎসা বিঘ্নিত হয়েছে। তার পরিণামে হাতের ব্যাথা হঠাৎ করে বেড়ে গেল। ব্যান্ডেজের নিচ থেকে পচাঁ দুর্গন্ধ বেরুতে লাগল। তাড়াতাড়ি ডঃ মুখার্জীর ওখানে আমাকে আবার নিয়ে যাওয়া হল। ব্যান্ডেজ খুলে হাতের ক্ষতের অবস্থা দেখে তার মুখ কালো হয়ে গেল। তিনি বললেন, “ঠিকমত চিকিৎসা না হওয়ায় এবং ঔষধপত্র না খাওয়ায় হাতে গ্যাংরিন শুরু হয়েছে। এ পচঁনকে রোধ করতে হলে অবিলম্বে অপারেশন করতে হবে। তা না হলে পুরো হাতটাকেই কেটে ফেলতে হতে পারে।” ডাক্তারের কথা শুনে সবাই ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেলেন।

আমিও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত। আমি হাসপাতালে ভর্তি হলে নিম্নী একা একা ফ্ল্যাটে কি করে থাকবে! আবার সাহায্যের মুক্ত হাত বাড়িয়ে দিলেন ডঃ গনী, “নিম্মী আমার মেয়ে। ও আমার বাসায় থাকবে। তুমি এ নিয়ে চিন্তা কর না। আজই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাও।” গনী নানার কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। পারুমিতা বৌদি আমার ভর্তির সব ব্যবস্থা করে দিলেন পিজি হাসপাতালে। আমার অপারেশন করলেন ডঃ মুখার্জী। গ্যাংরিন রোধ করার জন্য বা হাতের বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু কিছু অংশ কেটে ফেলে দিতে হয়েছে তবু আল্লাহ্র রহমতে বা হাতটা বাচাঁনো সম্ভব হয়েছে। ডঃ মুখার্জী অপারেশন শেষে মন্তব্য করেছিলেন আর কয়েকটা দিন দেরি হলে পুরো বা হাতটাই কেটে ফেলতে হত। পরিবারের সবচেয়ে আদরের নিম্মীকে দেখে কষ্ট হয়। আমি বুঝতে পারি ভেতরে ভেতরে তার অন্তরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বাড়িঘর, একান্ত আপনজন সবাই থাকতেও আজ ও ভীষণ একা। একটু আশ্রয়ের জন্য আজ তাকে এখানে-ওখানে থাকতে হচ্ছে রিফিউজির মত। তার উপর আমার শারীরিক অবস্থা নিয়ে ও বিশেষভাবে চিন্তিত। বাপ্পির কাছ থেকে জানতে পারলাম আমাদের চিন্তায় চাচা ভেঙ্গে পড়েছেন; তিনি আমাদের এই মুহুর্তেই বাসায় নিয়ে যেতে চান কিন্তু খালাম্মার মানসিক অবস্থার কথা ভেবে তার কাছে কথাটা কিছুতেই উঠাতে পারছেন না জনাব চৌধুরী। অত্যন্ত স্নেহবৎসল খালাম্মা। তিনি নিম্মীর উপর যে অভিমান করেছেন সেটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ নিম্মী তার খুব আদরের আর সেই নিম্মীই এ ধরণের একটা কাজ করে বসবে সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না খালাম্মা। তার বিশ্বাসের অবমাননা করেছে নিম্মী এটাই তার ক্ষোভের প্রধান কারণ৷ সবকিছু মিলিয়ে বাসায় একটা অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর সবটুকু চাপ পড়ছে নিম্মীর মনের উপর। বেচারী সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত; কিন্তু বাইরে তার কোন প্রকাশ নেই পাছে আমি মনে কষ্ট পাই এ কারণে। শুধু আমার জন্যই বেচারী জান আমার মুখ বুজে সবকিছুই মেনে নিয়ে স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ওর ত্যাগ, সহনশীলতা এবং ভালোবাসার গভীরতা উপলব্ধি করে নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হচ্ছিল। ভাবছিলাম, ওর এই অসহায় অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। অত্যন্ত স্বার্থপর মনে হচ্ছিল নিজেকে। মনেমনে ঠিক করলাম যেভাবেই হোক না কেন তাকে এই করুণ অবস্থা থেকে উদ্ধার আমাকেই করতে হবে। সপ্তাহখানেক হাসপাতালে থাকতে হল। হাসপাতাল থেকে চলে আসার পর একদিন নিম্মীকে সঙ্গে নিয়ে সোজা গিয়ে উপস্থিত হলাম নিম্মীদের বাসায়। চাচা, বাপ্পি, মানু আমাদের আনন্দে জড়িয়ে ধরল। আমি বাপ্পিকে জিজ্ঞেস করলাম, “খালাম্মা কোথায়?” বাপ্পি জানাল আজকাল তিনি বেশিরভাগ সময় তার নিজের ঘরেই কাটান, বের হন না খুব একটা। কারো সাথেই তেমন কোন কথাবার্তা বলেন না প্রয়োজন ছাড়া। সবশুনে আমি সোজা চলে গেলাম তার ঘরে। তিনি বিছানায় শুয়ে ছিলেন। আমাকে দেখে ভূত দেখার মতই চমকে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি এগিয়ে গিয়ে তাকে একহাতেই জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে ধরে বললাম,

– খালাম্মা আমাদের মাফ করেন। মাফ আপনাকে করতেই হবে। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন।

নিজেকে সামলে নিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন,

– আরে পাগল ছেলে কি করছ! হাতে ব্যথা পাবে যে !

– আমি আপনাকে নামাবো না যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমাদের ক্ষমা না করছেন। দৃঢ়তার সাথেই বললাম আমি।

উষ্ণতায় জমা বরফ গলে গেল নিমিষে। মাতৃস্নেহের আকুলতায় তিনি আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে

ধরলেন। তার চোখ বেয়ে ঝরছে অশ্রুধারা।

ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

– নিম্মী কোথায়? বললাম,

কোথায়? বললাম,

– বসার ঘরে।

– আমাকে নিয়ে চলো।

বললেন আমার অতিপ্রিয় খালাম্মা। তাকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে এলাম ড্রইং রুমে। আমাদের দেখে সবাই অবাক। কি করে অসম্ভবকে সম্ভব করলাম সেটাই সবার চোখে প্রশ্ন হয়ে ফুটে উঠেছিল। নিম্মী প্রায় পাগলের মত দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। আদরের নিম্মীকে বুকে ধরে আবেগের আতিশয্যে নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না খালাম্মা। সব বাধ ভেঙ্গে গেল। মান অভিমান রাগ সব ভেসে গেল অশ্রুর বন্যায়। দু’জনেরই সেকি কান্না ! আমরা সব নিশ্চুপ দাড়িয়ে থেকে মা ও মেয়ের অভুতপূর্ব মিলন দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম। সেদিনই গনী নানার বাড়ি থেকে চলে আসতে হল আমাদের।

 

ছোট ভাই স্বপন এবং বাল্যবন্ধু কাজি কামালুদ্দিনের সাক্ষাত পেলাম

একদিন সকালে ধর্মনগর থেকে ক্যাপ্টেন খায়রুল আনাম আমায় জানালো,“স্বপন ও বদি অফিসার্স কোর্সে যোগদানের জন্য তারা মুর্তী যাবার পথে ধর্মনগর পৌছেছে। ওরা আমার খোঁজ করছে।” আমি ওদের পাঠিয়ে দিতে বললাম।

হঠাৎ একদিন ধর্মনগর থেকে বন্ধু ক্যাপ্টেন আনাম আমাকে জানাল আমার ছোটভাই স্বপন এবং একান্ত বন্ধু কাজি কামালুদ্দিন মুর্তীর পথে এসে পৌঁছে আমার খোঁজ করছে। তাকে অনুরোধ জানালাম ওদের আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে। কয়েকদিনের মধ্যেই ওরা এসে পৌঁছল। স্বপনকে এভাবে কাছে পাবো সেটা ভাবতেও পারিনি। ওদের কাছে পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলাম। আত্মীয়- পরিজনদের সব খবরা-খবরই পেলাম তাদের কাছ থেকে। শুনলাম ঢাকা শহরে ওদের দুঃসাহসিক গেরিলা অভিযানের লোমহর্ষক কাহিনী ।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই স্বপন, বদি, কাজি, জুয়েল, রুমী, আলম, আজাদ, সাচো বর্ডার পেরিয়ে ২নং সেক্টরের মেলাঘর ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়ে ঢাকায় ফিরে গিয়ে গেরিলা তৎপরতায় কাঁপিয়ে তোলে ঢাকা শহর। পর্যায়ক্রমে তাদের সাথে যোগ দেয় চুল্লু, ফাজলে, মোক্তার, হ্যারিস, তৈয়ব আলী, উলফাৎ, সামাদ, ফতেহ আলী, মেওয়া, জিয়া, ভুলু, সাইদ এবং আরো অনেকেই। ওদের উপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ঢাকায় অবস্থান করে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করার যাতে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, তাদের ঐ ধরণের গেরিলা তৎপরতায় এটাও প্রমাণিত হবে যে, পুরো বাংলাদেশ খানসেনাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে যে সরকারি প্রচারণা চালানো হচ্ছে সেটাও সত্যি নয়। জুরাইন, গুলবাগ পাওয়ার-ষ্টেশন, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার-ষ্টেশন, ধোলাইখাল, যাত্রাবাড়ি, গ্রীন রোড, ইন্টারকন, ফার্মগেট, ধানমন্ডির ২নং সড়ক প্রভৃতি জায়গায় একটার পর একটা দুঃসাহসিক সফল অভিযান চালিয়ে খানসেনাদের নাস্তনাবুদ করে তুলেছিল ওরা। ওদের প্রতিটি মাথার জন্য ২০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল পাকিস্তানের সামরিক সরকার। এতে কোন ফল হয়নি। খানসেনাদের সব সতর্কতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তাদের নাকের ডগার উপর দিয়ে জানবাজ মুক্তি পাগল দামাল ছেলেগুলো অসীম সাহসিকতার সাথে করে যাচ্ছিল একেকটা দুঃসাহসিক অভিযান। খানসেনাদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল বিচ্ছুরা (খান সেনারা গেরিলাদের ‘বিচ্ছু’ কিংবা ‘মুক্তি’ বলে সম্বোধন করত)। ওদের তৎপরতায় আশার আলো দেখতে পেয়েছিল ঢাকাবাসী। ওদের জন্য দোয়া করতো সবাই। অনেকে নানাভাবে সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বেচ্ছায় বিপদের ঝুঁকি নিয়েও।

কিন্তু জাতীয় ইতিহাসে ‘মীরজাফর’ থেকেছে সর্ব যুগেই। তাদের বেঈমানীর ফলে অপুরণীয় ক্ষতি হয়েছে জাতির ইতিহাসের বিভিন্ন মোড়ে। তেমনই এক মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় স্বপন-বদি- কাজিদের ভাগ্যে নেমে আসে এক চরম বিপর্যয়৷ পলাশীর বিশ্বাসঘাতকতার তুলনায় এই বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম কোন অংশেই কম নয়। ২৯শে আগষ্ট ১৯৭১ সাল। ঐ দিন সকালে ধানমন্ডির ২৮নং রোডের একটি বাসায় ওদের এক ঘনিষ্ট বন্ধু ও সহযোগী ফরিদের সাথে দেখা করতে যায় বদি পূর্ব কথামত। ফরিদ বর্তমান আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা জনাব জিল্লুর রহমানের শ্যালক তথা আইভি রহমানের ভাই। তারই বিশ্বাসঘাতকতায় দুপুর ১২টার দিকে ফরিদদের বাসা থেকে হঠাৎ রেইড করে বদিকে ধরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় খান সেনারা। ফরিদদের বাসায় পৌঁছানোর অল্পক্ষণের মধ্যেই ধরা পড়ে বদি। এ থেকে বোঝা যায় আগাম খবর পেয়েই খানসেনারা বদিকে ধরার জন্য ওৎ পেতে বসেছিল। তারপর শুরু হয় Chain Reaction. সামাদ ধরা পরে বিকেল চারটার দিকে। আজাদের বাড়ি রেইড করা হয় রাত ১২টায়। ঐ বাসায় সে রাতে ছিল জুয়েল, বাশার, কাজি, আজাদ, আজাদের খালাতো ভাই, দুলাভাই এবং আরো কয়েকজন আত্মীয়। সবাইকেই ধরে নিয়ে যায় পাক-আর্মি। রেইড চলাকালে আচমকা তদারককারী এক ক্যাপ্টেনের উপর ঝঁপিয়ে পরে তার হাতের ষ্টেনগান ছিনিয়ে নিয়ে এলোপাতাড়ি গুলী ছুঁড়তে ছুঁড়তে সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যেতে পেরেছিল একমাত্র কাজি। আলমদের বাসাতেও রেইড করা হয় রাত ১২টার পর। সেখানে ধরা পরে আলমের ফুপা আব্দুর রাজ্জাক এবং তার ছেলে মিজানুর রহমান। আলম বাসায় না থাকায় ধরা পরার হাত থেকে সে যাত্রায় বেঁচে যায়। আজাদদের বাসা আলমদের বাসার কাছাকাছি। রাত প্রায় দেড়টার সময় সম্পূর্ণ দিগম্বর অবস্থায় কাজি গিয়ে পৌঁছে আলমদের বাসায়। ভাগ্যক্রমে খানসেনারা ততক্ষণে ঐ এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। কাজিকে সম্পুর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠেছিল আলমদের বাসার সবাই। আলমের ছোটবোন তাড়াতাড়ি একটা লুঙ্গি কাজির হাতে দিয়ে তক্ষুণি দূরে পালিয়ে যেতে অনুরোধ জানায়। খান সেনারা এখানেও এসেছিল জানতে পেরে কাজি কাপড়টা পরে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। হাটখোলায় শাহাদাত চৌধুরী মানে সাচোদের বাড়ি থেকে ধরা পড়েন সেজো দুলাভাই বেলায়েত চৌধুরী রাত দু’টো পর। চুল্লুর বড়ভাই জনাব এম সাদেক সিএসপি একজন পদস্থ সরকারি অফিসার। রাত ১২:৩০–১টার দিকে তার সরকারি বাসভবন এ্যালিফেন্ট রোডের ১নং টেনামেন্ট হাউজ থেকে চুল্লুকে ধরে নিয়ে যায় পাক-আর্মি। মধ্যরাতে রেইড করা হয় রুমীদের বাড়ি। বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় রুমী, রুমীর বাবা জনাব শরিফ, ছোট ভাই জামী, মাসুম এবং হাফিজকে। আমাদের বাসায় ক্যাপ্টেন কাইযূমের নেতৃত্বে রেইড করা হয় ১:৩০-২টার দিকে। চুল্লুদের বাসায় যে রেইডিং পার্টি গিয়েছিল তারাই চুল্লুকে চোখ বাধা অবস্থায় সাথে করে আমাদের বাসায় নিয়ে আসে। চোখ বাধা অবস্থায় চুলু প্ৰথমে বুঝতে পারেনি তাকে কোথায় আনা হয়েছে। আচমকা একজন খানসেনা বলে উঠল, “স্বপন ভাগ গিয়া।” আব্বার গলাও শুনতে পায় চুল্লু। মেয়েদের কান্না থেকে বুঝতে পারে আমার বোনেরা (মহুয়া, কেয়া, সঙ্গীতা) কান্নাকাটি করছে। দৈবক্রমে স্বপন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় আব্বা জনাব শামছুল হক, মোস্তাফিজ মামা, বাড়ির কাজের ছেলে সামু এবং হাশেমকে। আলতাফ মাহমুদের বাসায় আর্মি যায় ভোর ৪-৫টার দিকে। সামাদকে সঙ্গে নিয়ে আর্মি গিয়েছিল ঐ বাড়িতে। আলভী ঐ রাত্রে সেই বাড়িতেই ছিল। নাম লুকিয়ে উর্দূতে নিজের নাম আব্দুল বারাক বলায় আলভী ধরা খাওয়া থেকে বেঁচে যায়। খান সেনারা ধরে নিয়ে যায় আলতাফ মাহমুদ, তার চার শ্যালক, রসুল এবং নাসেরকে।

এভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ঢাকায় গেরিলাদের সবচেয়ে কার্যকরী এবং সফল দলটি বিশ্বাসঘাতকতার চক্রান্তের ফলে বিলুপ্ত হয়ে যায়। পালাবার পর কাজি ও স্বপনের দেখা হয় তাদের ব্যেইস ক্যাম্প ধোলাইখালে। সেখান থেকে মেলাঘর। সেখানে তাদের দু’জনকেই সিলেক্ট করা হয় Officer’s Training Course এর জন্য। কিন্তু দু’জনেরই কোন ইচ্ছে ছিল না Officer’s Course 1 যোগ দেবার। তারা অনেক অনুরোধ জানিয়েছিল মেজর খালেদ মোশাররফ এবং ক্যাপ্টেন হায়দারকে তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আবার ঢাকায় পাঠাবার জন্য। তারা চাইছিল ফিরে গিয়ে বন্দী সাথীদের মুক্ত করতে। জীবন গেলেও ক্ষতি নেই তবু একটা শেষ চেষ্টা করে দেখতে চায় তারা। নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস ছিল তাদের। যদি মেজর খালেদ এবং ক্যাপ্টেন শিশুর পরিবারদেরকে পাক বাহিনীর সুরক্ষিত দুর্গ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এ বন্দী অবস্থা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পেরে থাকে তারা তবে তাদের পক্ষে বদি-জুয়েল- রুমীদেরকে ছাড়িয়ে আনাটা অসম্ভব হবে কেন? তাদের আবেগ, অনুভূতি, সহমর্মিতা মেজর খালেদের মনকে স্পর্শ করলেও ঠিক সেইক্ষণে তাদের ফেরত পাঠানো কোনক্রমেই ফলপ্রসু হবে না ভেবেই তাদেরকে Officer’s Course এ পাঠাবার সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন মেজর খালেদ একজন অভিজ্ঞ কমান্ডার হিসেবে। আমার কাছে পৌঁছেও তারা একই প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আমিও মেজর খালেদের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে তাদের Officer’s Course-এ যোগদান করাটাই যুক্তিসঙ্গত হবে বলে মতপ্রকাশ করি। অগত্যা অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুর্তীতে চলে যায় Course-এ জয়েন করার জন্য।

ভারতীয় নীলনকশা এবং মুজিব নগর সরকার

আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন ক্ষমতার লড়াই এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে ভারতীয় সরকার এবং গোয়েন্দা সংস্থা “র” “ডিভাইড এন্ড রুল” নীতি প্রয়োগ করে প্রধানমন্ত্রী এবং সর্বাধিনায়ক দু’জনকেই হেয় করে তোলা হয়।

তাজুদ্দিনের হঠাৎ করে প্রবাসী সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা আওয়ামী লীগের অনেকেই পছন্দ করেনি। তাদের মধ্যে ছিলেন যুব ও ছাত্রনেতাদের অনেকেই। অনেক সাংসদ এবং আওয়ামী লীগের নেতারাও এর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ বিরোধিতা করেছিলেন। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, শাহ্জাহান সিরাজ, নুরে আলম সিদ্দিকী এবং আব্দুল কুদ্দুস মাখন প্ৰমুখ যুব ও ছাত্রনেতারা সবাই প্রকাশ্যে তাজুদ্দিনের এ পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন। তাদের পরোক্ষভাবে মদদ যোগাচ্ছিলেন জনাব আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ আবদুল আজিজ, মনসুর আলী, জনাব নজরুল ইসলাম প্রমুখ। জনাব তাজুদ্দিনের প্রধানমন্ত্রীত্বের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে জেনারেল অরোরার মন্তব্য, “আওয়ামী লীগের যুবনেতারা তাকে পছন্দ করত না।” (বাংলাদেশের যুদ্ধের স্মৃতিচারন শিরোনামে নিখিল চক্রবর্ত্তীকে দেয়া জেনারেল অরোরার সাক্ষাৎকার।)

সাধারণভাবে যুবনেতাদের অনেকেই সেদিন ভেবেছিলেন শেখ মুজিব আর জীবিত নেই। মুজিবর রহমানের অবর্তমানে তাজুদ্দিন তাদের প্রভাবকে তেমন একটা মেনে চলবেন না। শেখ মুজিব কাছে থাকলে এ সমস্ত যুব এবং ছাত্রনেতারা স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের কর্তৃত্ব অতি সহজেই স্থাপন করতে সক্ষম হতেন। কিন্তু তাজুদ্দিন তাদের সাথে অন্য সুরে কথা বলছেন। তাদের হাতে ক্রিয়াণক হয়ে সংগ্রামের সব নেতৃত্ব তাদের হাতে ছেড়ে দিতে তিনি অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। তাদের সংগ্রামী ভূমিকাকেও ছোট করে দেখছেন জনাব তাজুদ্দিন। সরকার পরিচালনায় যুব ও ছাত্রনেতাদের মতামত তিনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলেছেন। তাজুদ্দিনের ধৃষ্টতার শেষ নেই। তিনি সরকার প্রধান থাকার কারণে তাদের সুযোগ-সুবিধাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রহমানের আত্মীয়-স্বজনকেও যথাযথ মর্যাদা দান না করে তাদের উপেক্ষা করেছেন। তাদের উপেক্ষা করা, পরোক্ষভাবে শেখ মুজিবকেই উপেক্ষা করার সমতুল্য। অতএব, যে কোন মূল্যে তাজুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে অপসারন করতে হবে। মেতে উঠলেন তারা এক ক্ষমতা লাভের চক্রান্তে। পরিকল্পনা অনুযায়ী শেখ মনি ও সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে কয়েকজন যুব ও ছাত্রনেতা দিল্লী গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে তাকে জানান যে তারা শেখ মুজিবর রহমানের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন। পাক বাহিনীর হাতে শেখ মুজিবের গ্রেফতারের পেছনে জনাব তাজুদ্দিনের হাত রয়েছে। গ্রেফতারের আগে শেখ মুজিব তাদের সে কথা জানিয়ে তাদেরকে ভারত সরকারের সহায়তায় স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিচালনা করার নির্দেশ দিয়ে যান। জনাব তাজুদ্দিনের উপর বাংলাদেশ থেকে আগত বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ জাতীয় এবং প্রাদেশিক সাংসদদের সমর্থনও নেই। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীত্ব করার কোন অধিকার নেই তাজুদ্দিন সাহেবের। তাদের বক্তব্যের সমর্থনে তারা মুজিবর রহমানের ভগ্নিপতি জনাব আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের একটি চিঠি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে প্রদান করেন এবং শেখ মুজিবের জেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালকে তার সম্মুখে উপস্থিত করেন। তারা শ্রীমতি গান্ধীকে এ কথা বলেও হুঁশিয়ার করে দেন যে তাজুদ্দিন যদি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকেন তবে ভারতের স্বার্থও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কারণ জনাব তাজুদ্দিন শেখ মুজিবের নীতি আদর্শ কিছুতেই বাস্তবায়িত করবেন না। এই পরিপ্রেক্ষিতে দু’পক্ষের স্বার্থে তাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ থেকে আগত মুজিব ভক্ত এবং তাদের অনুগত তরুণদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করার জন্য তারা শ্রীমতি গান্ধীর কাছে আবেদন জানান। তারা বলেন, শুধুমাত্র এ ধরণের শক্তি গড়ে তোলার মাধ্যমেই স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ এবং বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের মধ্যে অর্থবহ সম্পর্ক বজিয়ে রাখা সম্ভব। তা না হলে অচিরেই ভারত বিদ্বেষীদের চক্রান্তের শিকারে পরিণত হবে আওয়ামী লীগ সরকার। তাদের এ অনুরোধ সাগ্রহে গ্রহণ করেন শ্রীমতি গান্ধী। সুদূর প্রসারী নীল নকশার কথা চিন্তা করেই Devide and Rule নীতির প্রয়োগের জন্য বিএলএফ পরবর্তিতে নাম বদলিয়ে মুজিব বাহিনীর সৃষ্টি করে সেকেন্ড ফ্রন্ট খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছিল বিএলএফ ওরফে মুজিব বাহিনী।

এ তথ্যগুলোও জনাব ওসমানীকে জানাই আমরা। তিনি সেগুলো জনাব তাজুদ্দিনকে জানান। প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন নাকি এ সমস্ত প্রশ্ন নিয়ে দিল্লীতে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং এর প্রতিবিধানের দাবি জানান। কিন্তু জনাব হাকসার, ডিপিধর, ‘র’ এর রমানাথ রাও এবং জেনারেল ওবান সিং এ ব্যাপারে তাজুদ্দিনকে এড়িয়ে গিয়ে নিরব থাকেন। ফিরে এসে কর্নেল ওসমানীকে সে কথাই বলেছিলেন জনাব তাজুদ্দিন। আমরা পরে কর্নেল ওসমানীর কাছ থেকে তার ব্যাখ্যা জানতে পারি। পরবর্তী পর্যায়ে মুজিব বাহিনীকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ফোর্সেস হেডকোয়টার্স এর নিয়ন্ত্রণে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন কর্নেল ওসমানী। কিন্তু তার কোন চেষ্টাই ফলপ্রসু হয়নি। নিতান্ত অপারগ হয়েই কর্নেল ওসমানীকে বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনী সৃষ্টি করার ভারতীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়।

ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সহায়তায় ক্যাপ্টেন জলিলের ফোর্ট উইলিয়ামের পূর্বাঞ্চলীয় হেডকোয়াটার্সের কর্মকর্তাদের সাথে গোপন যোগাযোগ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠল৷ ভারতীয় সরকার শুধুমাত্র প্রবাসী সরকার এবং মুক্তি বাহিনীর সদর দপ্তরের মাধ্যমেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক গতিধারাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল তা নয়, তারা ক্ষমতাধর কমান্ডারদের সাথেও সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল। অত্যন্ত চতুরতার সাথে তারা তাজুদ্দিনের প্রবাসী সরকারের মধ্যে অর্ন্তদ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে তাকেও দুর্বল করে চাপের মুখে রাখছিল যাতে তিনি তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে বাধ্য হন। অপরদিকে মুজিবনগর সরকার ও মুক্তিযোদ্ধের সর্বাধিনায়ক জনাব ওসমানীর মধ্যেও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে কর্নেল ওসমানীর ক্ষমতা সীমিত করে রাখা হচিছল একইভাবে। কর্নেল ওসমানীকে সাইড ট্র্যাক করে প্রবাসী সরকার ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এ ধরণের কার্যকলাপে কর্নেল ওসমানী অতি যুক্তিসঙ্গত কারণেই ভীষণভাবে অপমানিত বোধ করছিলেন। তার বক্তব্য ছিল পরিষ্কার।

ভারত বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের বক্তব্য অনুযায়ী মানবিক কারণে সাহায্য দিতে সম্মত হয়েছে সেটার জন্য বাঙ্গালী জাতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামটা পূর্ব বাংলার ৮ কোটি বাঙ্গালীর নিজস্ব সংগ্রাম। এ সংগ্রাম তাদেরই সংগঠিত করতে হবে। যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে তাদেরকেই অর্জন করতে হবে জাতীয় স্বাধীনতা, সংগ্রামের নেতৃত্ব ও সব দায়িত্বও থাকতে হবে মুক্তিফৌজ কমান্ড ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধিনে। জনাব ওসমানী নীতির এ প্রশ্নে কখনোই আপোষ করেননি। এ বিষয় নিয়ে তৎকালীন প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বের সাথে অনেক বির্তক হয়েছে তার। কিন্তু তার এ নীতির প্রতি সমর্থন দেননি আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতৃত্ব ও গণপরিষদ সদস্যরা। তারা তখন নিজ নিজ ক্ষমতার বলয় তৈরি করতে ব্যস্ত। তাদের প্রায় সবার মাঝেই এক ধরণের উদ্ভট চিন্তা কাজ করছিল। শুধু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই নয় অনেক আমলা এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের সুবিধাবাদী নেতৃত্বের মাঝেও সেই একই চিন্তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছিল। তাদের ধারণা ছিল মুক্তিযুদ্ধ যে কারণেই হোক শুরু হয়ে গেছে। প্রতিরোধ সংগ্রামকালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব অঞ্চল থেকে কোটি কোটি টাকা ও সম্পদ লুন্ঠন করে নিয়ে হিজরত করে চলে আসা হয়েছে নিরাপদ আশ্রয় ভারতে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বলতে লজ্জা লাগলেও বলতে হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা অনেক বুদ্ধিজীবি ও হোমরা-চোমরা পদস্থ ব্যক্তিরাও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ মুক্তি সংগ্রামকে দেখতেন অত্যন্ত নেতিবাচক দৃষ্টিতে। তারা মনে করতেন বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধারা কখনই পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে দেশ স্বাধীন করতে সক্ষম হবে না। পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করতে সরাসরি ভারতীয় সেনা বাহিনীর হস-ক্ষেপ অবশ্যই অতি প্রয়োজনীয়। রক্তক্ষয়ী দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার ইচ্ছা অথবা যোগ্যতা তাদের অনেকেরই ছিল না। যুদ্ধের ঝুঁকি এবং কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতেও তারা ছিলেন নারাজ। এতে করেই তাড়াতাড়ি ‘হজ্জ’ শেষ করে প্রবাসী জীবনের কষ্ট থেকে রেহাই পেয়ে দেশে ফিরে লুটপাটের কালো টাকার আয়েশী জীবন খুব তাড়াতাড়ি আবার শুরু করতে পারা যাবে একমাত্র ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মাধ্যমেই। ভারতে হজ্জ্ব করার স্ট্যাম্প যখন একবার নিতে সক্ষম হয়েছেন তারা তখন দেশে ফেরার পর তাদের রাজ কায়েম করার পথে বাধা কোথায়? তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশটাকে স্বাধীন করে দেবার জন্য তাদের একাংশ গোড়া থেকেই ভারত সরকারের বিভিন্ন মহলে জোর লবিং শুরু করে দিয়েছিলেন।

সমস্ত প্রবাসী সরকারের মধ্যে শুধুমাত্র দু’জন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ ধরণের উদ্যোগের বিরোধিতা দৃঢ়তার সাথে করে গিয়েছিলেন। তাদের একজন হলেন কর্নেল ওসমানী এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ। এই দুইজন ছাড়া সিনিয়র রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রায় সবাই এবং আমলাদের উচ্চপদস্থ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনেকেই ভারতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পক্ষপাতিত্ব করছিলেন। পরবর্তিকালে সিজরিয়ন অপারেশন এর মাধ্যমে বাংলাদেশের Premature birth এর জন্য মূলতঃ এরাও দায়ী ছিলেন অনেকাংশে। কিন্তু বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা, আমলাতন্ত্রের তরুণ সদস্যরা এভাবে অপরের কৃপায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার উদ্যোগের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এ নিয়ে প্রবীণদের সাথে তরুণদের দ্বন্দ্ব ক্রমশঃই বেড়ে উঠছিল প্রতিদিন।

 

ভারত সরকারের স্বীকৃতি এবং সামরিক হস্তক্ষেপ

সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির পরই ভারত বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টিও ছিল সুচিন্তিত।

এ ঘটনার পর আওয়ামী লীগের অর্ন্তদ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। ভারত সরকার চিন্তিত হয়ে পড়ল এবং বাংলাদেশ সমস্যার একটা আশু সমাধানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। মুক্তি সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হলে অবস্থা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে সেটাই ছিল তাদের মূল আশংকা। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জনাব তাজুদ্দিন প্রবাসী সরকারের তরফ থেকে ভারত সরকারকে বোঝালেন – দু’পক্ষের স্বার্থ রক্ষার্থে বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে অনতিবিলম্বে ভারতীয় সামরিক অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে ফেলতে হবে। ভারত সরকার তাজুদ্দিন সরকারের আবেদনে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও হঠাৎ করে তখনি এককভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হল না। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ঠিক করলেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে পরাশক্তিধর দেশগুলোর মনোভাব জানার পরই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশে এক ঝটিকা সফরে বেরিয়ে পড়লেন। সবখানেই তিনি নেতৃবৃন্দের সাথে বাংলাদেশ সমস্যা এবং ভারতের অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করলেন। বর্বর শ্বেতসন্ত্রাসের ফলে আগত শরণার্থীদের মানবিক কারণে ভারতের মাটিতে আশ্রয় দেয়ার জন্য নেতারা ভারত সরকারের প্রশংসা করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতারা বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তানের একটি অভ্যন্তরীন সমস্যা হিসাবেই আখ্যায়িত করেন এবং পরিষ্কারভাবে ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়ে দেন- এই সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে সরাসরিভাবে ভারতীয় যেকোন সামরিক পদক্ষেপ তাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠবে। শরণার্থীদের কষ্ট লাঘবের জন্য এবং ভারতের উপর যে অর্থনৈতিক চাপের সৃষ্টি হয়েছে সেটা কমানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আর্থিক এবং সামগ্রিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সব নেতারাই।

রিলিফের সামগ্রী নিয়েও পরে ঘটেছে অনেক কেলেংকারী। বিপুল পরিমাণের রিলিফ-সামগ্রীর কতটুকু পেয়েছিল শরণার্থীরা তার জবাব একমাত্র দিতে পারে তৎকালীন প্রবাসী সরকারের কর্ণধাররাই। আমার জানামতে প্রাপ্ত রিলিফ-সামগ্রীর একটা ক্ষুদ্র অংশই ভারত এবং প্রবাসী সরকারের উদ্যোগে বিতরণ করা হয়েছিল শরণার্থীদের মাঝে। রিলিফ-সামগ্রীর সিংহভাগই বেমালুম হজম করে নিয়েছিল ভারত সরকার।

বিদেশ সফর থেকে শ্রীমতি গান্ধী বুঝতে পারেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনরূপ সামরিক অভিযান চালালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো তাকে সমর্থন করবে না। পক্ষান্তরে এশীয় পরাশক্তি গণচীন হয়তো বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে যেতে পারে পাকিস্তানের পক্ষে এ ধরণের সংঘাতে। সে ক্ষেত্রে ভারতের একক আগ্রাসন ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্যই সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ব প্রস্তাবিত ‘নিরাপত্তা এবং বন্ধুত্ব’ চুক্তি সই করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন শ্রীমতি গান্ধী ও তার সরকার। ঐ চুক্তি সাক্ষরের ফলে ভারতীয় জনগণ কতটুকু উপকৃত হয়েছে জানি না তবে পাকিস্তানকে দুর্বল ও দ্বিখন্ডিত করতে এবং সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে বাংলাদেশ কায়েম করে সেখানে একটা পুতুল সরকার স্থাপন করার ভারতীয় স্বপ্নের বাস্তাবায়নে ঐ চুক্তি বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল নিঃসন্দেহে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি দেয় ভারত সরকার। প্রতিদানে ভারতের সাথে জাতীয় স্বার্থবিরোধী ২৫বছর মেয়াদের এক চুক্তি সই করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। রহস্যজনক কোন কারণবশতঃ আজ পর্যন্ত সেই চুক্তির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হয়েছে দেশের জনগণের কাছ থেকে। মুজিবনগর সরকার এবং আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ সাংসদ ঐ চুক্তিকে সমর্থন করে। বিরোধিতা করেছিলেন মাত্র দু’জন। কর্নেল ওসমানী এবং খন্দোকার মোশতাক আহমদ।

মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগই এ ধরণের চুক্তির ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে তাজুদ্দিন সরকার তাজুদ্দিন সরকার এক অসম এক অসম চুক্তির নাগপাশে আবদ্ধ করলেন বাংলাদেশের ভবিষ্যতকে। ভারতের সাথে দীর্ঘ ২৫ বৎসরের এ অসমচুক্তি জাতীয় ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। এ চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার পর বাংলাদেশে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ তথা পাক-ভারত যুদ্ধ প্রায় অবধারিত হয়ে ওঠে। মুক্তি বাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ বরাবরই মুক্তি সংগ্রামে ভারতীয় সেনা বাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে আসছিলেন। তাদের প্রত্যাশা ছিল দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীন হবে বাংলাদেশ। এতে দু’টো বিশেষ উপকার হত। দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মাধ্যমে গড়ে উঠতো নিবেদিত প্রাণ-ত্যাগী-পরিক্ষীত নেতৃত্ব এবং একইভাবে সুযোগ পাওয়া যেত নিখাদ সোনার মত বলিষ্ঠ জাতীয় চরিত্র গড়ে তোলার। কিন্তু নীল নকশার প্রণয়নকারীরা বাঙ্গালী জাতিকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে অতি চতুরতার সাথে। খাল কেটে কুমির আনার সব ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত করে ফেললো মুজিবনগর সরকার। দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা পরিষ্কার বুঝতে পারলেন তাদের ভবিষ্যত সংগ্রাম হবে দুমুখী। একদিকে তাদের যুদ্ধ করতে হবে হানাদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে অন্যদিকে তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে ‘মিত্র বাহিনীর আধিপত্যবাদী চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে জাতীয় স্বাধীনতা হেফাজত রাখার জন্য।

চুক্তি ও স্বীকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে কোলকাতাভিত্তিক আওয়ামী সরকার ও তাদের দোসররা সবাই দিন গুনতে লাগল কবে ভারতীয় বাহিনী আগ্রাসন চালিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করে দেবে আর তারা ফিরে গিয়ে রাজত্ব করবে, উপভোগ করবে অসৎ উপায়ে লুটপাট করে অর্জিত ধনসম্পদ। ভারতীয় সরকারের স্বীকৃতি পাবার জন্য শুধু দাসখতই লিখে দেয়া হয়েছিল তাই নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রও প্রণীত হবে ভারতীয় শাসনতন্ত্রের মূল চার নীতি (জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ) এর উপর ভিত্তি করে; সেই অঙ্গীকারও করেছিল মুজিবনগর সরকার।

আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কর্নেল ওসমানী এবং মুক্তিযোদ্ধারা প্রবাসী সরকারকে রাজি করাতে পারেনি যে, আমাদের নিজেদের ত্যাগের মাধ্যমেই দেশকে স্বাধীন করতে হবে। আমাদের সংগ্রাম নিজেদেরকেই চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে বিজয় অব্দি। এর ফলেই অস্বাভাবিকভাবে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে একটি অপরিপক্ক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাবার ক্ষেত্র সৃষ্টি করলো প্রবাসী সরকার। মৈত্রি চুক্তি সই হবার পর এবং প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি দেবার পর আওয়ামী লীগ প্রবাসী সরকার ও নেতারা দিন গুনতে লাগলেন ভারতীয় আগ্রাসী আক্রমনের।

 

তথাকথিত মিত্রবাহিনীর কালো ছায়ার আচ্ছাদনে ঢাকা পড়ে যায় মুক্তিফৌজ এবং জনগণের বীরগাঁথা, আত্মত্যাগ এবং সাহসিকতা

যৌথ কমান্ড স্থাপিত হলো কিন্তু মুক্তি ফৌজের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীকে সব ব্যাপারেই পাশ কাটিয়ে চলার নীতি গ্রহণ করা হয়।

নভেম্বর মাসে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় ব্যাপকভাবে। বর্ডারে সম্মুখ সংঘর্ষের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ভারত সরকার ইতিমধ্যে ভারতীয় সেনা বাহিনীকে পাক বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনে বাংলাদেশের সীমানার ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি প্রদান করেছে। গঠন করা হয়েছে মুক্তিফৌজ ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড। যৌথ কমান্ড গঠিত হবার পর ভারতীয় কমান্ডারদের প্রচন্ড প্রভাবে কর্নেল ওসমানী এবং তার হেডকোয়াটার্স প্রকৃত অর্থে অকেজো হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ আক্রমণের পরিকল্পনা এককভাবে ভারতীয় বাহিনীর ইষ্টান কমান্ডই প্রণয়ন করার দায়িত্ব গ্রহণ করে কর্নেল ওসমানীকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যুদ্ধের আভাস পেয়ে জনাব ভুট্টোকে তার বিশেষ দূত হিসেবে চীনে পাঠালেন ভারতীয় যেকোন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন আদায় করার জন্য। কিন্তু পিকিংএ গণচীনের নেতৃবৃন্দ জনাব ভুট্টোকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন, “পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপকে গণচীন পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করার হীন চক্রান্ত হিসাবেই দেখবে এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সাথে যেকোন সামরিক সংঘাতে নীতিগতভাবে তারা পাকিস্তানের পক্ষেই থাকবে।” একইসাথে জনাব ভুট্টোর মাধ্যমে তারা পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যথাশীঘ্র সম্ভব পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছানুযায়ী বর্তমান সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য। তাদের Considered Opinion ছিল বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র একটি যুক্তিসঙ্গত এবং গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমেই পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায়ে রাখা সম্ভব। বল প্রয়োগ করে এই সমস্যার সমাধান কখনও সম্ভব হবে না। চীনা নেতৃবৃন্দের উক্তি থেকে দু’টো বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠে।

প্রথমতঃ গণচীন একদিকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার নিরসনের জন্য পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠিকে বাঙ্গালীদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান পেশ করার যুক্তিসঙ্গত পরামর্শ দেন।

দ্বিতীয়তঃ পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার কোন সমাধান করতে ব্যর্থ হলে সেই সুযোগে উপমহাদেশে ভারতীয় সমপ্রসারনবাদের নগ্ন থাবা বিস্তার করার চক্রান্তের ব্যাপারেও তারা বন্ধুরাষ্ট্র পাকিস্তানকে হুঁশিয়ার করে দেন। কিন্তু দেশে ফিরে জনাব ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও সামরিক জান্তার কাছে চীনা নেতৃবৃন্দের বন্ধুসুলভ এবং যুক্তিসম্পন্ন অভিমতের অপব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, “ভারতের সাথে সামরিক সংঘর্ষে চীন পাকিস্তানকে সার্বিকভাবে সাহায্য করবে। প্রয়োজনে গণচীন প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করতে দ্বিধাবোধ করবে না এ ধরণের আভাসই নাকি তিনি পেয়েছিলেন চীনা নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে একান্ত বৈঠকে।

পক্ষান্তরে ভারতীয় সরকার বুঝতে পেরেছিল গণচীন বাংলাদেশের ব্যাপারে একটি রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে। তাছাড়া সদ্য সমাপ্ত রুশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে পাক-ভারত যুদ্ধে গণচীনের প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পরার সম্ভাবনা খুবই কম বলেও ধারণা পোষণ করছিল ভারত সরকার। এ ধরণের চিন্তা-ভাবনার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি ছিল। এ অবস্থায় ঝটিকা অভিযান চালিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে সেখানে তাদের পছন্দের সরকার কায়েম করতে পারা যাবে সহজেই। এ ধরণের বিশ্লেষনের পরই যুদ্ধ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ভারত সরকার। যুদ্ধের জন্য অতি প্রয়োজনীয় আনুসাঙ্গিক সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেই সামরিক আগ্রাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারত সরকার।

এবারের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট অতীতের পাক-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষাপট থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বর্তমান অবস্থায় বিশ্ব জনমত সামরিক জান্তার শ্বেতসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশীদের স্বাধীনতার পক্ষে মানবাধিকার এবং শরনার্থীর প্রশ্নে সারা বিশ্বের সহানুভূতিও ভারতের পক্ষে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা গণচীন যদি Geo-Strategic কারণে কোন পদক্ষেপ নেবার চেষ্টা করে তবে তাদের পরম শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিক্রিয়ায় ‘মৈত্রী চুক্তির’ আচ্ছাদনে নিশ্চুপ বসে না থেকে ভারতের পক্ষ নেবে নিশ্চিতভাবে ফলে বেধে যাবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বর্তমানে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটা বিশ্বযুদ্ধ শুরু করার দায়-দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিতে চাইবে কিনা যুক্তরাষ্ট্র অথবা গণচীন সে বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা পূর্ব পাকিস্তানের ৮কোটি জনগণ আজ পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। মুক্তি বাহিনীর দেশব্যাপী প্রচন্ড তৎপরতায় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাক বাহিনীর অবস্থান সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত এবং যেকোন যুদ্ধের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাক্টর সৈনিকদের মনোবলও সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। খান সেনারা সার্বিকভাবে শুধু দুর্বল হয়ে পড়েছিল তাই নয়; তাদের Strategic Locations, Line Of Communication, Defensive Positions, Supply Points, Re-Enforcement Capabilities, Battle Tactics, Logistic Support Line এ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় বিষয়ে সব খবরা-খবরই এখন রয়েছে ভারতীয় বাহিনীর নখদর্পনে। এসব খবর সংগ্রহ করা হয়েছে মুক্তি বাহিনীর ইনটেলিজেন্স ইউনিট এবং সেক্টরগুলোর নিজস্ব গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারনের বিরোধিতার মুখে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমাদের জবরদখল আজ অযৌক্তিক হয়ে পড়েছে। শত্রুপক্ষের অবস্থা বর্তমানে Totally Untenable. প্রয়োজন শুধু সুযোগমত আক্রমণের ধাক্কা তাহলেই কেল্লা ফতে হবে। সুযোগ এসে গেল। ৩রা ডিসেম্বর বিকেল ৫:৪৫ মিনিটে আকস্মিকভাবে Pakistan Air Force Pre-Emptive Stick করে বসলো ভারতের বিভিন্ন জায়গায় স্ট্রাটেজিক টার্গেটগুলোর উপর। একইসাথে আঘাত হানা হল শীণগর, অভিন্তিপুর, পাঠানকোট, উত্তরলাই, যোধপুর, আম্বালা এবং আগ্রা বিমান ঘাটির উপর।

ঠিক সেই সময়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কোলকাতায় এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। বিমান হামলার খবর তাকে দেয়ামাত্র তিনি মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঐ জনসভাতেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক পাল্টা আক্রমণের ঘোষণা দিলেন। কোলকাতা থেকে সেদিন সন্ধ্যায় দিল্লী ফেরার আগেই ইষ্টান কমান্ডের এঙঈ GOC (General Officer Commanding) Genarel Arora -কে দিল্লীর সেনাসদর থেকে হুকুম দেয়া হল পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক হামলা চালাবার জন্য। জেনারেল অরোরার অধিনে দেয়া হল ৩টি স্বয়ংসম্পূর্ণ আর্মি কোর। ২য়, ৩৩শ এবং ৪র্থ কোর। এছাড়াও দেয়া হল ‘কম্যুনিকেশন জোন হেডকোয়াটার্স’ আরো একটি ভ্রাম্যমান আর্মি ইউনিট। এছাড়া ২ কোরের অধিনে দেয়া হয়েছিল অতিরিক্ত একটি মিডিয়াম আর্মাড রেজিমেন্ট এবং একটি লাইট আর্মাড রেজিমেন্ট। এই কোরের কমান্ডার ছিলেন Lt. Gen T.N.Raina হেডকোয়াটার্স কৃষ্ণনগর। এই কোরের অধিনে দেয়া হয়েছিল অতিরিক্ত আরো একটি মিডিয়াম আর্টিলারী রেজিমেন্ট ও একটি ইঞ্জিনিয়ারস এর ব্রিজিং ইউনিট।

৩৩ কোরের কমান্ডার ছিলেন Lt. Gen M. L. Thapa. হেডকোয়াটার্স শিলিগুরী। এই কোরের অধিনে দেয়া হয়েছিল অতিরিক্ত একটি লাইট আর্মাড রেজিমেন্ট, একটি মিডিয়াম আর্টিলারী রেজিমেন্ট এবং একটি ইঞ্জিনিয়ারস এর ব্রিজিং ইউনিট।

১০১ কম্যুনিকেশন জোনের কমান্ডার ছিলেন প্রথমদিকে Lt. Gen. Gill পরে Lt. Gen.Nagra – কে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। হেডকোয়াটার্স গৌহাটি। এই ফর্মেশনের ৪র্থ কোরের হেডকোয়াটার্স ছিল আগরতলায়। কোর কমান্ডার ছিলেন Lt. Gen. Sagat Singh. এই কোরের অধিনে অতিরিক্তভাবে দেয়া হয় একটি মিডিয়াম আর্টিলারী রেজিমেন্ট এবং দু’টো লাইট আর্মাড রেজিমেন্ট। সব মিলিয়ে পূর্ব রনাঙ্গনে ভারতীয় সৈন্যসংখ্যা ছিল ৫ লক্ষেরও বেশি। তার সাথে ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণের রণসম্ভার। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত প্রায় ১ লক্ষ খানসেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এ ধরণের বিশাল বাহিনী মোতায়ন করার প্রয়োজন ছিল না। এই বিশাল সৈন্য সমাবেশ ঘটানো হয়েছিল গণচীনের তরফ থেকে যদি কোন সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হয় তার মোকাবেলা করার লক্ষ্যেই।

যাই হোক, প্রয়োজনীয় Air 3 Naval Cover এবং প্রায় দুই লক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বিশাল ভারতীয় বাহিনী একই সময়ে সব সেক্টর থেকে আক্রমণ চালালো। সব সেক্টরেই ভারতীয় বাহিনীর অগ্রসর হওয়ার জন্য রাস্তা করে ব্রিজহেড তৈরী করে দিচ্ছিল মুক্তিবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধারাই। ঐ সমস্ত ব্রিজহেড তৈরী করা সম্ভব হয়েছিল বলেই অতি সহজেই শত্রুপক্ষের ডিফেন্স ভেদ করে ঢাকা অভিমুখে তরিৎ গতিতে এগিয়ে যেতে পেরেছিল ভারতীয় মিত্র বাহিনী। যুদ্ধের এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে কর্নেল ওসমানীকে সম্পূর্ণরূপে পাশ কাটিয়ে চলেছিল ভারতীয় সেনাকমান্ড। ভারতীয় সেনা বাহিনীর স্ট্রাটেজি ছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শত্রুপক্ষের ডিফেন্স লাইন ভেদ করে তাদের Withdrawal এর পথ Cut Off করে তাদেরকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে পরাজিত করে ঢাকা অবরোধ করা এবং পাক বাহিনীকে সারেন্ডার করতে বাধ্য করা। বাংলাদেশে অবস্থিত পাক বাহিনী তাদের চেয়ে সংখ্যায় ৬-৭গুন বড় ভারতীয় বাহিনী এবং মুক্তিফৌজের প্রচন্ড আক্রমণের মুখে মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধে অতি করুণ অবস্থায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের জনগণের অসহযোগিতা এবং মুক্তি বাহিনীর দুঃসাহসিক গেরিলা তৎপরতা পাক বাহিনীর যুদ্ধস্পৃহা এবং মনোবল একদম নষ্ট করে দিয়েছিল। অন্য সব কারণের মধ্যে এটাই ছিল প্রধান কারণ যার জন্য পাকবাহিনীকে অতি অল্পসময়ের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল। এভাবেই ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের ফলে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ।

১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে মুক্তিফৌজের কমান্ডার-ইন-চীফ এবং যৌথ কমান্ডের প্রধান কর্নেল ওসমানীর আমন্ত্রণে মিত্র বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল অরোরা স্বাধীন বাংলাদেশে আসবেন এবং যৌথ কমান্ডের তরফ থেকে Instrument Of Surrender এ যৌথ কমান্ডের শীর্ষ ব্যক্তি কর্নেল ওসমানীই সাক্ষর করবেন সেটাই ছিল সমগ্র জাতির প্রত্যাশা৷ কিন্তু ঘটনা ঘটে ঠিক তার বিপরীত। Instrument Of Surrender এ যৌথ কমান্ডের তরফ থেকে সাক্ষর দান করার সৌভাগ্য লাভ করলেন জেনারেল অরোরা। শুধু তাই নয় অদৃশ্য অঙ্গুলী হেলনে মুক্তিফৌজের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীকে ১৬ই ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক Surrender Ceremony -তে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য থেকেও বঞ্চিত করা হল। কেন তাকে তার ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত করে সেদিন জেনারেল অরোরাকে সমগ্র জাতি এবং বিশ্ব পরিসরে বিজয়ী শক্তির একচ্ছত্র অধিকর্তা হিসেবে জাহির করা হল সে রহস্যের উদ্ঘাটন আজঅব্দি হয়নি। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিশদ বিশ্লেষণের দাবিদার। এ থেকে জানা যাবে ভারতীয় নীল নকশা এবং প্রবাসী সরকারের নতজানু নীতির অনেক কিছুই।

কর্নেল ওসমানী চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিফৌজের সর্বাধিনায়ক হিসেবে তিনিই অভিনন্দন জানাবেন মিত্র বাহিনীর জুনিয়র পার্টনার জেনারেল অরোরাকে। এতে করে বিশ্ব পরিসরে এটাই প্রমাণিত হবে মূলতঃ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচেষ্টাতেই স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ, ভারতীয় বাহিনী সহায়ক শক্তি হিসেবে সাহায্য করেছে মাত্র। কিন্তু ভারতীয় সরকার তার সেই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। উল্টো ভারত সরকার দাবি জানায় Instrument Of Surrender- এ সাক্ষর করবে ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়ক। উদ্দেশ্য পরিষ্কার- বিশ্ববাসী জানুক পাক-ভারত যুদ্ধে ভারতের বিজয়ের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের দান। দুর্বল চিত্তের নতজানু প্রবাসী সরকার ভারতের সেই অযৌক্তিক দাবি মেনে নেয়। কিন্তু প্রচন্ড আত্মসম্মানবোধের অধিকারী আপোষহীন বঙ্গবীর কর্নেল ওসমানী নীতির প্রশ্নে অটল থেকে এ অন্যায়ের প্রতিবাদে নিজেকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন।

১৬ই ডিসেম্বর ঢাকা শহরে দেশবাসী দেখেছে ভারতীয় সেনা বাহিনীকে বিজয়ীর বেশে। তাদের ঘিরে ছিল বিএলএফ, মুজিব বাহিনী এবং রাতারাতি গজিয়ে উঠা “Sixteen Division” এর সদস্যরা। কারণ সত্যিকারের মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের ঢাকা কিংবা দেশের বড়বড় শহরগুলোতে ঢুকতে দেয়া হয়নি নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ভারতীয় বাহিনীর প্রাধান্য জাহির করার জন্যই এ আদেশ জারি করা হয়েছিল। প্রকৃত মুক্তিফৌজের যোদ্ধারা ঢাকা এবং অন্যান্য শহরগুলোতে আসার অনুমতি পান ১৬ই ডিসেম্বরের অনেক পরে। এ ধরণের চক্রান্তের ফলে বিশাল ভারতীয় সেনা বাহিনীর আগমনে বাধাগ্রস্থ হয়ে শুকিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের নিজস্ব ধারা। কালো ছায়ার আধাঁরে ঢাকা পরে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, আত্মত্যাগ। হারিয়ে গেল অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত তাদের জয়গাথাঁ। আচমকা হোচট খেয়ে মুখথুবড়ে পড়ল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন হয়ে উঠল সুদূরপরাহত। ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে জাতি স্বাধীনতার সঠিক মূল্য অনুধাবন করার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হল। এজন্যই আজঅব্দি ক্ষমতাবলয়ে যারা অবস্থান করছেন সে সমস্ত বুদ্ধিজীবি, সামরিক-বেসামরিক আমলা এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে অতি কম দামে স্বাধীনতা এবং জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেবার ন্যাক্কারজনক প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। কিন্ত মুক্তিযুদ্ধকে যদি তার নিজস্ব ধারায় বয়ে যেতে দেয়া হত তবে দখলদার বাহিনীর পাশবিক নৃশংসতার শিকার হতে হত আরো অনেককেই, রক্তাহুতি দিতে হত প্রতিটি পরিবারকে। এভাবে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের প্রত্যেকের কাছেই হয়ে উঠতো এক অমূল্যধন। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কষ্টার্জিত সেই পবিত্র স্বাধীনতাকে যেকোন ষড়যন্ত্র অঙ্কুরেই নস্যাৎ করে দিত পরীক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা এবং ত্যাগী-সচেতন জনতা। দুর্ভাগ্য তৎকালীন দুর্বল রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরম বিশ্বাসঘাতকতায় খাঁদহীন বলিষ্ঠ জাতীয় চরিত্র গঠন করার নূন্যতম সময় ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম আমরা।

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সংবিধানের অধিনে জেনারেল ইয়াহিয়ার সরকারের LFO (Legal Frame Work) এর আওতায় পাকিস্তানের অখন্ডতা বজিয়ে রাখার ওয়াদা করে নির্বাচন করেন শেখ মুজিব এবং তার দল আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকার প্রধান হবার জন্যই জনগণ তাকে সে নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যাবার পর জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর যোগসাজশে ২৫-২৬শে মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙ্গালী জাতির উপর শ্বেত সন্ত্রাস চালিয়ে অস্ত্রের জোরে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচন হয়ে পড়ে অর্থহীন। বাংলাদেশের আপামর জনগণ পাকিস্তানী আচমকা হামলা ও শ্বেত সন্ত্রাসের বিরোধিতায় এবং দেশকে স্বাধীন করার জন্য স্বতঃস্ফুর্তভাবে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবেই ১৯৭০ সালের নির্বাচন তার গ্রহণযোগ্যতা হারায়। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা যখন মরণপন করে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন শেখ মুজিবর রহমান বন্দী হয়ে চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। আওয়ামী নেতৃবৃন্দ ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচান৷ সশস্ত্ৰ সংগ্রামের কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না বলেই তাদের দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যেতে হয়। এরপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফলে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিজয়ের পিছনে রয়েছে সমগ্র জাতির অবদান। সেক্ষেত্রে এই জাতীয় সংগ্রামের নেতৃত্বের একমাত্র দাবিদার হয়ে কোন যৌক্তিকতায় আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দলীয়ভাবে কব্জা করে নিল তার জবাব অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে দেশপ্রেমিক ঐতিহাসিকদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য।

১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনে জনাব এ কে খন্দোকার ও মাঈদুল হাসানের মধ্যে প্রায় চার ঘন্টা দীর্ঘ এক আলাপ হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত সম্পর্কের মূল্যায়নের জন্য সেই আলোচনার সারাংশ এখানে লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। যুদ্ধকালে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের ডেপুটি চীফ অফ ষ্টাফ এবং জনাব মাঈদুল হাসান ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর নীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রে একজন পরামর্শদাতা। তাদের কথোপকথন থেকে বোঝা যায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কর্নেল ওসমানীকে বাইপাস করে মূলতঃ যোগাযোগ রক্ষা করতেন জনাব তাজুদ্দিন এবং খন্দোকার সাহেবের সাথে। যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে বেশিরভাগ আলোচনাও হত গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার সাহেবের সাথেই। জেনারেল অরোরা, ব্রিগেডিয়ার জ্যাকব, ব্রিগেডিয়ার গুপ্তই ছিলেন মূলতঃ তাদের counter part.

জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে বীর বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধারা যে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেন তার যথার্থ মূল্য ভারত কখনোই দিতে চায়নি। এ নিয়ে মুক্তি ফৌজের কমান্ডারদের সাথে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দ্বন্দ্ব শুরু হয় প্রথম থেকেই। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনার জন্য মুজিবনগরে ৮নং থিয়েটার রোড) কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে একটি হেডকোয়টার্স স্থাপন করা হলেও জনাব ওসমানীর কর্মক্ষমতা ছিল সীমিত। জুলাই মাস অব্দি মুক্তিযুদ্ধ কমান্ডাররা হেডকোয়াটার্স এর কাছ থেকে তেমন কোন সাহায্যই পাননি সংগ্রাম পরিচালনা করার জন্য। বিভিন্ন সেক্টরে কমান্ডাররা সম্পূর্ণভাবে নিজেদের উদ্যোগেই মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ প্রসঙ্গে এভিএম খন্দোকার বলেন, “আমি যখন কোলকাতায় গিয়ে পৌছলাম তখন দেখলাম যে, হেডকোয়াটার্সের সাথে সেক্টর কিংবা সাব-সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই এবং এ পর্যায়ে ভারত আমাদের সংগ্রামে তেমন কোন সাহায্যই দেয়নি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে কোন সঠিক নীতিও গড়ে তুলতে পারেনি তারা। তবে তারা তখন চাচ্ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের ইস্যুটা জিইয়ে থাক। ভারতীয় নীতি নির্ধারকরা চাচ্ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের ধারাবাহিকতা এবং গতি-প্রকৃতি থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সংগ্রামীদের বুঝে নিয়ে তারা তাদের নীতি চুড়ান্ত করবেন। চুড়ান্ত নীতি নির্ধারন করার সময় পর্যন্ত সমস্ত বিষয়টাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন তারা। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এবং সেনা বাহিনীর এ ধরণের মানসিকতার ফলে ভারতীয় সেনা বাহিনী এবং মুক্তি বাহিনীর মধ্যে বৈরীভাব এবং রেষারেষি পরবর্তিকালে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে উঠা বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর মধ্যে যে ভারত বিরোধী মনোভাব দেখা যায় সেটা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই crystallize করে।” এ প্রসঙ্গে জনাব খন্দোকার আরও বলেন, “মুক্তিফৌজ এবং ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে বিরোধ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লগ্ন থেকেই দাঁনা বেধে উঠেছিল বিভিন্ন কারণে। ঐ সেন্টিমেন্ট, আবেগ-অনুভূতি বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন Disappointment এর মধ্য দিয়ে ক্রমশঃ আরো বেড়েছে।” মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সাহায্য ও সহযোগিতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার বলেছেন, “মে, জুন, জুলাই, আগষ্ট পর্যন্ত ভারতের Involvement ছিল অতি সামান্য। যা ছিল তা মোটামুটিভাবে মুক্তি বাহিনীর জন্য কিছু যৎসামান্য হালকা অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ সরবরাহ, কিছু লজিস্টিক সাপোর্ট এর বেশি কিছুই নয়। মুক্তিফৌজ কমান্ডারদের মূলতঃ শত্রুপক্ষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধ সম্ভারের উপর নির্ভর করেই চালিয়ে যেতে হচ্ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম।

মুক্তিফৌজ সেক্টর কমান্ডারদের জুলাই মাসের কনফারেন্সের কথা আগেই বলা হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, দুই লক্ষ মুক্তিযোদ্ধাকে ট্রেনিং দিয়ে গেরিলা হিসেবে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠানো হবে। এ প্রসঙ্গে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকারের বক্তব্য প্রাণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “সেক্টর কমান্ডারদের মিটিং এর পর একদিন জেনারেল অরোরা এলেন। মিটিং হল। কর্নেল ওসমানীর সাথে সেই মিটিং আমিও উপস্থিত ছিলাম। মিটিং আলোচনার মূল বিষয় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে। কতজনকে ট্রেনিং দেওয়া হবে, কোথায় কোথায় ট্রেনিং দেওয়া হবে, কিভাবে ট্রেনিং দেওয়া হবে, কি করে রিক্রুটমেন্ট করা হবে, কতদিন ট্রেনিং দেওয়া হবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। জেনারেল অরোরা প্রস্তাব দিলেন পাঁচ হাজার গেরিলা ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করলেই হবে। শুনে কর্নেল ওসমানী এবং আমি দু’জনেই অবাক হয়ে গেলাম। আমি বলেই ফেললাম এত অল্প সংখ্যক গেরিলা দিয়ে কি হবে? জবাবে জেনারেল অরোরা বললেন, “These are the people who will go inside, bleed the enemy and all those things.” কর্নেল ওসমানী জেনারেল অরোরাকে দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলেন তার দুই লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা দরকার। সেক্টর কমান্ডারদের সদ্য সমাপ্ত কনফারেন্সে সেটাই সিদ্ধান্ত হয়েছে। যাই হোক ট্রেনিং শুরু হল। ট্রেনিং শেষ করে গেরিলারা ফিরে আসল। কিন্তু তারপর একটা বিরাট সমস্যা দেখা দিল। এ সমস্যাটার জন্য পুরোপুরি দায়ী ভারত সরকার।

ট্রেনিং এর পর ভারতীয় আর্মি সম্পূর্ণভাবে তাদের নিজেদের অধিনে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। এতে ভীষণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া হল। ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলাদের বিভিন্ন সেক্টর থেকে রিক্রুট করা হয়েছিল। ট্রেনিং-এর পর তারা নিজ নিজ সেক্টরে ফিরে গিয়ে তাদের প্রিয় সেক্টর কমান্ডারদের অধিনে যুদ্ধ করবে এটাই ছিল তাদের আশা। ভারতীয় সেনা কমান্ডারদের অধিনে যুদ্ধ করতে তারা রাজি হল না। ভারতীয় বাহিনী ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলাদের তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দেশের ভেতরে তাদের কমান্ডের আওতায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সেটা আমাদের হেডকোয়াটার্সকেও জানতে দেয়া হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু কিছু জায়গায় জোর করে ইন্ডিয়ান কমান্ডাররা গেরিলাদের পাঠায় মূলতঃ লুটপাট করে নিয়ে আসার জন্য। যুক্তি হিসেবে তাদের বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ চালাতে হাতিয়ার এর সাথে টাকা-পয়সারও প্রয়োজন রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা এ ধরণের অমানবিক অপারেশন এবং ইন্ডিয়ান আর্মির অধিনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে তাদের নিজ নিজ সেক্টরে পালিয়ে যায়। এর ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া even at a later date was very bad did not like the way Indian Army wanted them to be used. অল্প সময়ের মধ্যেই সব সেক্টরে এ সম্পর্কে তিক্ততা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর মাঝে অবিশ্বাসের জন্ম হয়। খবর জানাজানি হয়ে যাবার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সেক্টর কমান্ডারদের দাবি অনুযায়ী আমাদের হেডকোয়াটার্স থেকে চাপ দেয়া হল, “আমাদের এই ট্রেইন্ড গেরিলাদের বাংলাদেশী কমান্ডারদের হাতে না দিলে This will be a disaster and catastrophe. বাংলাদেশের প্রশিক্ষিত গেরিলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশী সেক্টর কমান্ডারদের হাতে দিতেই হবে।” এ সম্পর্কে ভারতীয় মিলিটারী হাইকমান্ডের প্রথম থেকেই প্রচুর reluctance থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অনিচ্ছাসত্ত্বে নেহায়েত নিরূপায় হয়েই আমাদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে অবশ্য মুক্তিফৌজদের কাউন্টার ফোর্স হিসেবে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী (‘র’) এবং সেনা বাহিনীর মিলিত চেষ্টায় গঠিত হয়েছিল বিএলএফ। সে এক অন্য অধ্যায়।

ভারতীয় নেতৃত্বের এ ধরণের মনোভাবের দু’টো কারণ হতে পারে। প্রথমত: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফিল্ড কমান্ডারস এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভারত সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করেনি। তাই তারা সবসময় মনে করত এদের উপর নির্ভর করা যায় না। দ্বিতীয়ত: তাদের মনে এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল যে শেষ পর্যন্ত তাদের সরাসরি যুদ্ধের বিজয় ফল হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করবে বাংলাদেশ। তাই পাক বাহিনীকে দুর্বল করার জন্য গেরিলা বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে তাদের শুধু ব্যবহার করতে হবে সীমিত লক্ষ্যে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের বৃহৎ অংশ এবং সদস্যরা চেয়েছিলেন দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম পরিচালনা করে নিজেদের প্রচেষ্টায় তারা স্বাধীন করবেন তাদের মাতৃভূমি। কিন্তু তেমনটি হয়নি। আমার মনে হয় এখানেই মুক্তি বাহিনী এবং ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ও সেনা বাহিনীর মধ্যে একটা Credibility Gap হয়ে গেছে। আমাদের সামরিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ছিল পরিষ্কার, ‘আমরা আমাদের দেশকে স্বাধীন করব। বন্ধুরাষ্ট্র ভারত মুক্তিকামী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করলে আমরা অবশ্যই সে সাহায্যকে অভিনন্দন জানাব। কিন্তু necessarily this is our struggle and we have to fight it ourselves. তাছাড়া শুধু ভারত কেন? পৃথিবীর যে কোন দেশ আমাদের সংগ্রামে সাহায্য করতে চাইলে আমরা তা সানন্দে গ্রহণ করব। মোটকথা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশ্নে ভারত ও আমাদের মধ্যে approach of mutual confidence ছিল না বা কখনো গড়ে উঠেনি because of their overall policy. একথাও সত্য যুদ্ধক্ষেত্রের অনেক সেক্টরে ইন্ডিয়ান কমান্ডারদের কার্যকলাপে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টিও হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। সত্যিকথা বলতে গেলে ৯ই আগষ্ট রুশ-ভারত চুক্তি সই হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের চেষ্টায়। ৯ই আগষ্টের পরই ভারত সরাসরিভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করা শুরু করে এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে ইন্ডিয়ান আর্মি really really started taking closer interest.”

মাঈদুল হাসান এ পর্যায়ে জিজ্ঞেস করেন, “ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশ বোধ হয় স্বাধীনতা পেত না, কি বলেন?” খন্দোকার সাহেব মাঈদুল হাসান সাহেবের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, “যদিও মুজিবনগরের অনেকে এমনকি আমাদের মন্ত্রীসভার অনেকেই হতাশা বোধ করতেন, সংসদ সদস্যদের অনেকেই ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগ নিয়ে ফিরে যাবার চিন্তা-ভাবনাও করছিলেন। মুক্তি বাহিনীর তৎপরতায় আস্থাহীন হয়ে হতাশা বোধ করতেন। দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের কথা শুনলেই আতঁকে উঠতেন। ভাবতেন কি হচ্ছে! দেশে বোধ হয় আর ফিরে যাওয়া যাবে না। এ ধরণের পরিস্থিতিতেও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম, মুক্তিফৌজের গেরিলা তৎপরতা বেড়ে গেলে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাবে বলে যুক্তির অবতারণা করে যারা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের গতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিলেন তাদের সে যুক্তি ছিল সম্পূর্ণ ভুল এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পক্ষান্তরে আমরা যদি আমাদের সংগ্রামের তীব্রতা প্রথম থেকেই বাডাতে সক্ষম হতাম তবে আমাদের প্রচন্ড গেরিলা তৎপরতার মুখে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীকে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আত্মসমর্পন করতে হত মুক্তি ফৌজের কাছে। কারণ They had no chance to fight. Their moral was completely shattered and the losses would have been unacceptable to them. (সংবাদ ২৬শে মার্চ ১৯৯০)।

জনাব মাঈদুল হাসান জবাবে বলেছিলেন, “আপনার চিন্তা-ভাবনায় যুক্তি থাকলেও ভারতীয়রা ভেবেছিলেন অন্যরকম। তারা চেয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে ছোট করে দেখাতে এবং বিশ্ব পরিসরে পাক-ভারত যুদ্ধের ফল হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করতে। এতে ভারত এক ঢিলে দুই পাখি বধ করতে সক্ষম হয়।

প্রথমতঃ ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের প্রতিশোধ নিয়ে নিজেকে উপমহাদেশের প্রধান সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় ভারত।

দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ রাখার যৌক্তিকতা অর্জন করে।

♦ পাকিস্তানের রাজনীতির পরিণাম – স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং আমাদের সিদ্ধান্ত

♦ কোলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ

♦ ভারতীয় নীলনকশা এবং মুজিব নগর সরকার

♦ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হল ; আদর্শিক দেউলিয়াপনা, কোন্দল ও ভাঙ্গন

♦ ৭১ এর চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আওয়ামী কুশাসন এবং প্রতিরোধ

♦ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী এবং মুজিব সরকার

♦ আওয়ামী দুঃশাসন এবং দুর্নীতির মুখোমুখি সামরিক বাহিনী

♦ বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে বাকশালী স্বৈরশাসন কায়েম

♦ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ১৫ই আগষ্টের মহান বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান

♦ প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত, মোশতাক সরকার এবং সেনা পরিষদ

♦ ৩রা নভেম্বরের ব্যর্থ ক্যু’দাতা এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার সফল বিপ্লব

♦ রাষ্ট্রদূত লেঃ কর্নেল (অবঃ) শরিফুল হক ডালিম বীর উত্তম

“আমি মেজর ডালিম বলছি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒অভিযোগ বা মন্তব্য⇐

error: Content is protected !!