‘ইয়ং-বেঙ্গল’ বা বাংলার ‘রেনেসাঁস’

উনিশ শতকের গোড়ায় শহর কলকাতায় কিছু নতুন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন কিছু উদ্দীপ্ত মানুষ। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্কৃতি গবেষক ও ঐতিহাসিক উনিশ শতকের এইসব সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নায়কদের চিহ্নিত করেছেন ‘ইয়ং-বেঙ্গল’, ‘ডিরোজিয়ান’, ‘রেনেসাঁস যুগের পুরোধা’ ইত্যাদি বিশেষণে। এঁরা ইউরোপের সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, বেশভূষা, খাদ্যাভ্যাস, পানাভ্যাস ইত্যাদির দ্বারা অতিমাত্রায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। বঙ্গীয় রেনেসাঁস প্রবক্তা হিসেবে পরিচিতদের যেটি প্রধান ও স্থায়ী-কৃতি, তা হল ত্রুটি এবং অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশের ক্ষেত্রে এক বিশাল উল্লম্ফন। যদিও এইসব সাহিত্যের ক্ষেত্রে বৌদ্ধিক দুর্বলতা ছিল। প্রবন্ধ সাহিত্য ছিল বেশিটাই রম্যরচনা অথবা জিজ্ঞাসাবিহীন ভাষা। উপন্যাসে ও প্রবন্ধে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিবেশের যুক্তিযুক্ত, বাস্তববোধ-সম্পন্ন কোনও প্রতিফলন ছিল ভীষণ রকম অনুপস্থিত ।

এই বঙ্গীয় রেনেসাঁসের যুগের মহানায়কদের প্রভাবে উনিশ শতকে বাঙালি শিক্ষিত সমাজের কিছু মানুষ অতি স্পর্শকাতর বিভিন্ন অন্ধ-সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্রিয় হয়েছিলেন। সতীদাহ, বাল্য-বিবাহ, কুলীনপ্রথা, জাতিভেদ, ইত্যাদির বিপক্ষে এবং বিধবা-বিবাহের পক্ষে এই সময়ই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, যা ছিল অবশ্যই এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এরই পাশাপাশি এঁরা অনেকে গো-মাংস ভক্ষণ, মদ্যপান, স্নানাহ্নিক না সেরে খাদ্যগ্রহণ, ইউরোপীয় বেশভূষা ধারণ ইত্যাদির মধ্য দিয়েও সমাজের অভ্যস্ত জড়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তাঁদের এই প্রতিবাদের এই আন্দোলনের ফলে আমাদের সমাজ-জীবনে কিছুটা গতিশীলতা নিশ্চয়ই এসেছিল, দেখা দিয়েছিল সাংস্কৃতিক জগতে কিছুটা প্রগতির হাওয়া। এই সময় বঙ্গীয় রেনেসাঁস আন্দোলনের পুরোধা রামমোহন খ্রিস্ট ধর্মের সঙ্গে হিন্দু-ধর্মের মেলবন্ধন ঘটিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একেশ্বরবাদী নিরাকার প্রভুর তত্ত্ব, ঈশ্বর তত্ত্ব।

ইউরোপের রেনেসাঁস নিয়ে ছোট্ট একটু আলোচনা সেরে না নিলে বঙ্গীয় রেনেসাঁস নিয়ে একটা ভোঁতা চিন্তা, অস্বচ্ছ ধারণা থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা অতি প্রবল।

যে ঘটনার নির্দেশক হিসেবে ‘রেনেসাঁস’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল, তার স্থান ও উৎস ছিল ইউরোপে। কনস্টান্টিনোেপাল-এর পতনের (১৪৫৩ সাল) পর গ্রিক উদ্বাস্তুদের ইতালিতে আগমন এবং তৎপরবর্তীকালে একই সময়ে ইতালিতে বহু জিজ্ঞাসু, যুক্তিনিষ্ঠ, মৌলিক প্রতিভাবান ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে।

সমাজের প্রগতি নির্ভর করে জ্ঞানের

প্রগতির উপর অর্থাৎ সংস্কৃতির

প্রগতির উপর।

মধ্যযুগে চার্চ ও রাষ্ট্রশক্তির অত্যাচারে ইউরোপীয় সমাজ ছিল অজ্ঞানতার তমসায় আচ্ছন্ন। প্রতিভাবানদের জ্ঞান-চর্চা, তাদের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটে সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে; অর্থাৎ বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সমাজ ও সংস্কৃতির এই বিরাট উত্তরণ বা উল্লম্ফনকেই অভিহিত করা হয় ‘রেনেসাঁস’ নামে । তারপর ইতালির রেনেসাঁসের হাওয়া ছড়িয়ে পড়ে ইতালি থেকে ফ্রান্সে এবং পরবর্তীকালে ইউরোপের আরও বহু দেশে।

ইউরোপের এই ‘রেনেসাঁস’ ছিল সামন্তপ্রথার বিরুদ্ধে শিল্পপতি,

ব্যবসায়ী ও বণিকশ্রেণির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আর্থ-সামাজিক

ও সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ পাল্টাবার আন্দোলন।

এই আন্দোলন শুধু শহরে সীমাবদ্ধ থাকেনি,

ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে গ্রামে।

এখন আর রেনেসাঁস শব্দটির প্রয়োগ শুধুমাত্র ইউরোপের ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ নেই। আমেরিকা, জাপান, চিন, আফ্রিকা, ভারত ইত্যাদি দেশের ক্ষেত্রে নতুন যুগকে, বিশাল প্রগতিকে চিহ্নিত করতে এই ‘রেনেসাঁস’ শব্দটিকেই ব্যবহার করছেন বুদ্ধিজীবীরা, ঐতিহাসিকরা।

এ-বার আমারা বিশ্লেষণ করে দেখব, ইউরোপের তুলনীয় কোনও রেনেসাঁস আমাদের দেশে হয়েছিল কি না; অথবা যা হয়েছিল তা নিছকই সমাজের উপরতলার কিছু ইংরেজি-শিক্ষিত মানুষের সীমাবদ্ধ প্রয়াস কি না ।

উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁসের সঠিক মূল্যায়ন করতে চাইলে এই সময়কার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থাকে জানতেই হবে। নতুবা পরবর্তী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার প্রগতি সত্যিই কতটা হয়েছিল, তার হদিশ পাব কী করে?

ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসকদের সহযোগী ছিল ভারতীয় বণিক সম্প্রদায় এবং জমিদারশ্রেণি। এক সময় কলকাতা ছিল ইংরেজ শাসকদের রাজধানী। এই সময়কার বাঙালি ব্যবসায়ী ও বণিক সম্প্রদায় মোটেই স্বাধীন বা স্ব-নির্ভর ছিল না। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের উপরই নির্ভরশীল। তার উপর জমিদারশ্রেণিও ছিল নিজ স্বার্থেই একান্তভাবে ব্রিটিশ-শাসনের সমর্থক। ব্রিটিশ সরকার যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন করে, তার ফলে এই বন্দোবস্ত মতো সরকারকে নির্দিষ্ট রাজস্ব দেওয়ার বিনিময়ে জমিদাররা পেল জমির উপর নিঃশর্ত মালিকানাস্বত্ব। জমিদার হল কৃষকদের জমির মালিক। কৃষকরা এর ফলে পুরোপুরি ভাবে জমিদারের ইচ্ছের উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হল। জমিদারের ইচ্ছের উপর রইল কৃষককে চাষ করতে দেওয়ার বা উচ্ছেদ করার অধিকার। জমিদার ঠিক করে দিত কৃষক কতটা খাজনা দিতে বাধ্য থাকবে। খাজনা দিতে না পারলে কৃষককে আটকে রাখবার, তার অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার এবং তাকে জমি থেকে উৎখাত করার অধিকার জমিদারদের দিল ব্রিটিশ সরকার।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারত ছিল একটি বিশাল উৎপাদনকারী দেশ এবং একই সঙ্গে কৃষি-ভিত্তিক দেশ। ভারতের তাঁতবস্ত্র এই সময় এশিয়া ও ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করা হত। এ-ছাড়াও যেত সিল্ক, লবণ, সোরা ও মশলা। এই সময় দেশে বেকার যেমন কেউ ছিল না, তেমনই ছিল না কোনও ভূমিহীন কৃষক। এই কথাগুলো কোনও অতীত সুখ কল্পনার আবেগে লেখা নয়। এ-সবই ঐতিহাসিক সত্য। অতুলচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত “Studies in Bengali Renaissance’ গ্রন্থে প্রকাশিত এন. কে. সিন্হা লিখিত ‘Economic Background of the country’-তেও আমার এই কথাগুলোরই সমর্থন মিলবে।

কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত শুরু হতেই শুরু হয়ে গেল দেশীয় শিল্প-বাণিজ্যের দ্রুত অধঃপতন। এবং মাত্র বছর পঁচিশের মধ্যেই বাঙালির শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়াল। দেশীয় শিল্প ধ্বংস করে দেশীয় বাজারকে প্রায় পুরোপুরি গ্রাস করল ব্রিটিশ শিল্প-দ্রব্য। ব্রিটিশ সরকার এমনভাবে বাণিজ্যিক নীতি ও আইন তৈরি করতে লাগল, যার ফলে ভারতে তৈরি হতে লাগল ব্রিটিশ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচা মাল। ব্রিটিশ সরকার সচেষ্ট হল তাদের দেশে উৎপন্ন দ্রব্যের বাজার হিসেবে ভারতবর্ষকে দখল করতে।

এই সময়কার বাঙালি অগ্রণী শিল্পোদ্যোগী এবং রেনেসাঁস-এর অন্যতম পুরোধা দ্বাকানাথ ঠাকুর গভীর হতাশা থেকে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ব্রিটিশরা এ-দেশীয়দের যা কিছু ছিল সবই কেড়ে নিয়েছে। এখন এদেশীয়দের জীবন, স্বাধীনতা, সম্পত্তি এবং সবকিছুই নির্ভর করছে ব্রিটিশ সরকারের করুণার উপর।

এরপর তিনিও ব্যবসা গুটিয়ে তাঁর প্রায় সমস্ত অর্থই নিয়োজিত করেন জমিদারি কিনতে। এ-ভাবে বহু ধনীরাই তাদের অর্থ নিয়োজিত করেছিল জমিদারি কিনতে। ফলে ব্রিটিশদের শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল উৎপাদনকারী ও বিক্রেতা দেশীয় ব্যবসায়ী ও বণিক সম্প্রদায়, ব্রিটিশদের সঙ্গে ব্যবসা করতে আগ্রহী ব্যবসায়ী ও বণিক সম্প্রদায় এবং বাঙালি জমিদারদের স্বার্থে তাদের পালক ও পোষক ব্রিটিশ রাজ্যের স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। ফলে দেশীয় বণিক শ্রেণি ও জমিদার শ্রেণি ব্রিটিশ সরকারের অস্তিত্ব ও শ্রীবৃদ্ধির মধ্যেই নিজেদের স্বার্থ রক্ষার রক্ষাকবচকে আবিষ্কার করল।

বঙ্গীয় জমিদার সম্প্রদায়, জমিদারি রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত কর্মচারী, শহরের বণিক সম্প্রদায় এবং শিক্ষিত উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় সকলের স্বার্থ সেই সময়কার আর্থ-সামাজিক পরিবেশের প্রভাবে ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিল। ফলে এই সব দেশীয় সম্প্রদায় এ-দেশে ব্রিটিশ শাসনের সমর্থক ও সহযোগী হয়ে পড়েছিল। একইভাবে ব্রিটিশ সরকারও ভারতে তাদের ঔপনিবেশিক শোষণকে কায়েম রাখতে এবং আরও তীব্রতর করতে তাদের সমর্থক ও সহযোগী সম্প্রদায়কে পালন ও পুষ্ট করতে অতি মাত্রায় সচেষ্ট ছিল। ফলে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে বাস্তবিক পক্ষেই অসম্ভব ছিল জমিদারতন্ত্র, সামন্ততন্ত্রের ভিত্তিকে ধ্বংস করে এদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্পের উন্নতির জন্য তাদের পুঁজি বিনিয়োগে চাপ সৃষ্টি করা।

বাংলার রেনেসাঁস আন্দোলনের প্রাণ-পুরুষদের অধিকাংশই ছিলেন ইংরেজদের সহযোগী অথবা ইংরেজ-সহযোগীদের সন্তান। অর্থাৎ সে সময়কার ইয়ং-বেঙ্গলদের অধিকাংশই ছিলেন ইংরেজদের অনুগ্রহধন্য। এইসব বুদ্ধিজীবীদের একটা বিশাল সীমাবদ্ধতা ছিল এই যে তাঁরা প্রগতিকে ব্রিটিশ প্রগতির সমর্থক হিসেবে গণ্য করেছেন এবং ব্রিটিশরা যে আমাদের দেশে আধা-ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণ চালিয়ে গেছে, সে-কথা বার-বারই সজ্ঞানে এড়িয়ে গেছেন।

একটি ঔপনিবেশিক দেশে ঔপনিবেশিক প্রভুর বিরোধিতা করাটাই

কোনও আন্দোলনের পক্ষে বা ব্যক্তির পক্ষে প্রগতিশীল

হিসাবে চিহ্নিত করার মাপকাঠি হওয়া উচিত।

ঔপনিবেশিক প্রভুর দালালি করাটা, সহযোগিতা করাটা কোনওভাবেই প্রগতিশীল বলে বিবেচিত হতেই পারে না, বরং, তাদের দেশদ্রোহী, ঔপনিবেশিক শক্তির দালাল বলেই চিহ্নিত করা উচিত।

শহরবাসী, বণিকশ্রেণি, শিক্ষিত উচ্চমধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, ভূস্বামী শ্রেণির একটি অংশ যাঁরা নিজেদের সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে তথাকথিত ‘রেনেসাঁস’ আন্দোলনকে ‘রেনেসাঁস’ ছাপ মেরে দিয়েছিল ‘প্রগতিবাদী’, ‘নবজাগরণের প্রতিভূ’ ইত্যাদি বলে প্রচার চালিয়েছিল সাধারণ মানুষের মগজ-ধোলাই করে তদের প্রভাবিত করতে, ‘প্রগতি’ ও ‘ব্রিটিশ সমর্থন’কে সমার্থক হিসেবে মাথায় ঢোকাতে।

ইয়ং-বেঙ্গলদের দ্বিতীয় সীমাবদ্ধতা হল এই তথাকথিত রেনেসাঁসের প্রধান চরিত্রগুলোর অধিকাংশই জনগণের ব্যাপক অংশের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলেন।

তৃতীয় সীমাবদ্ধতা হল ওঁদের আন্দোলন ছিল শহরকেন্দ্রিক। গ্রামে এর কোনও প্রভাব দেখা যায়নি।

চতুর্থ সীমাবদ্ধতা হল, রেনেসাঁসের সঙ্গে সম্পর্কিত বেশিরভাগ সমাজ-সংস্কারই তৎকালীন বাঙালি মুসলমান ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে ছিল অর্থহীন। ইসলাম ধর্মে সতীদাহ নেই, বিধবা বিবাহ আছে, মুসলমানরা গো-মাংস খান। অবিভক্ত বাংলার অর্ধেকের বেশি মানুষ যেহেতু মুসলমান, তাই এ-কথা তো অবশ্যই সত্য যে বেশিরভাগ বাঙালিদের (মুসলমানদের) কাছে এ-সবের কোনও প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। এ-কথাও নির্মম সত্য যে, এইসব সংস্কারের দ্বারা আবদ্ধ না থাকাটাই সমাজ-অগ্রগতির সূচক নয়। তারই জ্বলন্ত উদাহরণ ভারতের মুসলিম সমাজ। মুসলিম সমাজে সতীদাহ প্রথা চিরকালই অনুপস্থিত, বিধবা-বিবাহ প্রচলিত, কনের পূর্ণ সম্মতিতে বিয়ে দিতে হয় বলে একটা চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারে রয়েছে, অপ্রাপ্তবয়স্কার বিয়ে ইসলামি মতে হতে পারে না। কিন্তু ভারতের মুসলিম সমাজে অপ্রাপ্তবয়স্কার বিয়ে হয়, এবং এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র হিন্দু প্রতিবেশীদের প্রভাবে। গো-মাংস মুসলমানেরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। অর্থাৎ যে কয়টি বিষয় ঘিরে বাংলার রেনেসাঁস যুগের সমাজ সংস্কারের ঝোঁক দেখা গেছে, তার প্রায় সব কটি সংস্কারেরই ঊর্ধ্বে ছিল বাংলার মুসলমান সমাজ। কিন্তু তাতে বাংলার মুসলমান সমাজের অগ্রগতি লক্ষিত হয়েছে কি? শোষণ মুক্তি ঘটেছে কি? না, ঘটেনি। বাংলার মুসলমানদের সংখ্যাগুরু অংশই ছিল হিন্দু সংখ্যাগুরু অংশের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে পিছিয়ে পড়া, বেশি শোষিত।

আধুনিক ভারতে নিরাকার ঈশ্বর তত্ত্ব বা একেশ্বরবাদী ঈশ্বর তত্ত্ব পুনঃপ্রবর্তন করেন রামমোহন নন, মুসলমানগণ ।

পঞ্চমত, রেনেসাঁস আন্দোলনের বিরাজমান হিন্দুধর্মীয় পক্ষপাতিত্ব মুসলমান চেতনাকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। এর ফলে ভারতে যে হিন্দু-মুসলিম ধর্মকে ভিত্তি করে দ্বিজাতিতত্ত্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, তাতে শোষিত মানুষদের একত্রিত সংগ্রাম চেতনা যেমন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল, তেমন এই বিভেদ ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষে অতি সহায়ক হয়ে উঠেছিল।

মুসলমানদের কাছে অগ্রহণযোগ্য রূপে হিন্দু দেবীর আদলে ভারতমাতার রূপ কল্পনা করে বঙ্কিমচন্দ্র দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষবৃক্ষকে পুষ্ট করতে সাহায্যই করেছিলেন।

রামমোহনের চিন্তায়-চেতনায় যে মুসলিম বিরোধী মানসিকতা স্থান পেয়েছিল তারই স্ফুরণ দেখতে পাই ১৮০৪ সালে প্রকাশিত তাঁর লিখিত এক প্রবন্ধে, যেখানে তিনি বলছেন, “ইসলামধর্মীরা ব্রাহ্মণজাতির অনেক ক্ষতি করেছে ও তাদের ওপর অনেক নির্যাতন করেছে।” (রামমোহন রচনাবলী, হরফ প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ১২৭ )

বাংলার রেনেসাঁস আন্দোলনের নায়করা প্রত্যেকেই মনে করতেন, ‘জাতি ও ধর্ম সমার্থক’। কাজেই জাতির উন্নতি ও মুক্তি বলতে তাঁরা বুঝতেন নিজেদের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উন্নতি ও মুক্তি ।

ষষ্ঠত, একগাদা তথাকথিত বুদ্ধিজীবী যতই প্রচারে রামমোহনকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক’ বলে সোচ্চার হোন না কেন এবং রেনেসাঁস ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করেছিল’ বলে স্বীকৃতি দিন না কেন এ সবই যে বুদ্ধিজীবীদের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দৃষ্টিভঙ্গির ফল, নিরিখে মূল্যায়নে বসলে এই সত্য বার বারই বেরিয়ে আসবে।

রামমোহন যে একনিষ্ঠ ব্রিটিশ শাসনের সমর্থক ছিলেন, এই সত্যকে রেনেসাঁসের সমর্থক প্রতিটি বুদ্ধিজীবীই স্বীকার করেন বা বলতে পারা যায়, রামমোহনের জীবনচর্যার বিভিন্ন পর্যায়ে, লেখায়, বক্তব্যে এত বেশি বেশি করে তাঁর ব্রিটিশ শাসন অনুরাগের প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে যে, রামমোহনের সবচেয়ে বড় সমর্থককেও তা স্বীকার করতেই হয়। বাস্তবিক পক্ষে বিদেশি শাসনের অধীনে

রামমোহনের এই জাতীয়তাবাদের মূল কথা ছিল-ব্রিটিশ

শাসনের উপর জাতির একান্ত নির্ভরতা, ব্রিটিশ

স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থ হিসেবে গ্রহণ করা।

পরাধীন ভারতে রামমোহনীয় এই জাতীয়তাবোধে ছিল না কোনও রকম বিপ্লবী সত্তা। এমন মেকি জাতীয়তাবোধ থেকে জন্ম নেওয়া পরবর্তী জাতীয়তাবাদী নেতারা তাই ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পথে না গিয়ে গিয়েছিলেন দর কষাকষির মধ্য দিয়ে আপসে স্বাধীনতা পাওয়ার পথে। এ কোনও বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্য নয়, নয় অজ্ঞাতাজনিত বাচাল-কথা, এই কথাগুলো ঐতিহাসিক সত্য। রেনেসাঁস-উদ্ভূত এই বিকৃত জাতীয়তাবাদ ছিল বিত্তবান বণিক, জমিদার ও শিক্ষিত সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষাকারী। এমন জাতীয়তাবোধের ফসল হিসেবেই ১৮৪৩ সালে ধনী ব্যবসায়ী, জমিদার ও শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটি’। ১৮৫১ সালে এই সোসাইটি মিশে গেল ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’-এর সঙ্গে। ১৮৭৫ সালে সুরেন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’। ১৮৮৩ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সর্বভারতীয় সম্মেলন হল কলকাতায়। সম্মেলন সভাপতি আনন্দমোহন বসু একে আখ্যা দিলেন ‘ভারতের জাতীয় পার্লামেন্ট’ বলে। এই তথাকথিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরিণতিতেই ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হল ‘ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’। এইসময় অর্থনৈতিক সংকট যেভাবে দ্রুত বেড়ে চলেছিল এবং সেই সংকটের পরিণতিতে যেভাবে দ্রুত জনক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছিল তাতে ব্রিটিশ সরকার যথেষ্টই চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। সেই সময়কার ব্রিটিশ ভাইসরয় ডাফরিন গণবিক্ষোভকে প্রশমিত করতে ব্রিটিশ সরকারের সাংবিধানিক গণ্ডিতে আবদ্ধ এক আন্দোলনে আটকে রাখতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সৃষ্টিতে মদত দিলেন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি ডবলিউ. সি. ব্যানার্জি তাঁর লেখা ‘Introduction to Indian Politics’ গ্রন্থে দ্বিধাহীন ভাষায় স্বীকার করেছেন কংগ্রেস ‘ডাফরিনেরই অবদান’।

বাংলার রেনেসাঁসের নায়করা যে ব্রিটিশ শাসনের পূর্ণ সমর্থক ছিলেন, এই বাস্তব সত্যটি আজ বাংলার রেনেসাঁসকে ‘মহান’ বলে সিলমোহর দেগে দেওয়া বুদ্ধিজীবীরাও স্বীকার করেন। এইসব রেনেসাঁসপন্থীরা নিজেদের বক্তব্যের সমর্থনে যে যুক্তি হাজির করেন, তা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মোটামুটি একই রকম। বক্তব্যের মূল সুর হল : ব্রিটিশ শাসনের আগে ভারতবর্ষের সমাজ প্রগতির গতি ছিল রুদ্ধ, অনড়। উন্নততর সভ্যতার ধারক ও বাহক হিসেবে ব্রিটিশরা ভারতকে নিজেদের অধীনে রাখার ফলে ভারতের প্রাচীন সমাজের অচলতা সচল গতি পেয়েছিল। ব্রিটিশ-শাসনে ভারতীয় সমাজ-প্রগতির বাস্তব ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

অশোক রুদ্র ১৯৮১ তে ‘Frontier’ পত্রিকায় ‘Reassessment of the 19th century’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, বাংলার রেনেসাঁস আন্দোলনের নায়করা সঠিকভাবেই আমাদের পুরোনো সামাজিক অবস্থাকে ভারতীয় সমাজের অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বলে চিহ্নিত করেছিলেন, এবং এই বাধাকে অপসারণের জন্যেই তাঁরা ব্রিটিশ-শাসনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।

অশোক রুদ্রর বক্তব্য মেনে নিলে বিগত দু-তিন শতক ধরে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসক ছিল, তাকেও তবে সমর্থন জানাতেই হয়। কারণ এই ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশই পুরোনো সমাজে অগ্রগতি আনতে সাহায্য করেছে। ব্রিটিশ শাসনকে সমর্থনই যদি প্রগতিশীলতার লক্ষণ হয়, তবে ব্রিটিশ শাসনের আরও বড় সমর্থক ও সহায়ক বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর, উমিচাঁদ, জগৎ শেঠরা নিশ্চয়ই অশোক রুদ্রের চোখে আরও বড় প্রগতিশীল ছিলেন।

মানিক মুখোপাধ্যায় ‘পথিকৃৎ’ পত্রিকায় ’৮৪ তে লেখা ‘ভারতীয় রেনেসাঁ’ ও রামমোহন’ প্রবন্ধে মত প্রকাশ করেছেন, ব্রিটিশ-শাসনে যখন ভারত ছিল, তখন ব্রিটিশ বাণিজ্যিক পুঁজির একটা প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল। ওরা চেয়েছিল এ-দেশের রাজা-জমিদার ইত্যাদি সামন্তপ্রভুদের নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটিয়ে পরিবর্তে ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে তাদের পুঁজিকে আকর্ষিত করতে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশের স্বার্থেই সমাজ-প্রগতিকে গতিশীল করতে। সমাজ-প্রগতির জন্যেও ব্রিটিশ-শাসকদের কাছে জরুরি হয়ে পড়েছিল সামন্ততন্ত্রের উচ্ছেদের। ফলে ব্রিটিশ-বাণিজ্যিক পুঁজি এবং ভারতীয় বাণিজ্যিক পুঁজি ভারতীয় সমাজের অগ্রগতির প্রধান বাধা ভারতীয় সামন্ত প্রভুদের শাসনতন্ত্রের উচ্ছেদের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এই সময় ব্রিটিশ পুঁজিবাদের প্রতি সমর্থনকে তাই বলতে হবে প্রগতিশীল

মানিক মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রগতিশীল বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবী কী করে এমন নিপাট মিথ্যে লিখলেন? তাঁর কি এই ঐতিহাসিক সত্যটুকু জানা নেই— ব্রিটিশ সরকার রাজা-জমিদার ইত্যাদি সামন্ত প্রভুদের নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে দিতে চায়নি, বরং গড়ে তুলতেই চেয়েছিল? চাওয়ার কারণ, উপনিবেশ রক্ষার স্বার্থে বিশাল সেনাবাহিনী ইংলন্ড থেকে না এনে এখানকার রাজা-জমিদারদের মতো সামন্তপ্রভুদের ব্রিটিশ সমর্থক করে তাদেরকেই উপনিবেশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত করা। আমার এই বক্তব্যের সমর্থনে লর্ড বেনটিঙ্ক-এর বক্তব্য থেকে আর কে মুখার্জির উদ্ধৃতি তুলে দেওয়া ‘Rise and Fall of the East India Company’ বইটির ২৩৮ পৃষ্ঠা থেকে দুটি মাত্র লাইন হাজির করছি। কর্নওয়ালিশের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’-এর প্রায় চল্লিশ বছর পর লর্ড বেনটিঙ্ক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্রিটিশ শাসনের স্বার্থে ভারতে কতটা প্রয়োজনীয় ছিল সে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, “ব্যাপক গণবিক্ষোভ বা বিপ্লবের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার প্রশ্নে এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এক বিশাল সুবিধা রয়েছে। এই বন্দোবস্তের ফলে যে বিপুল সংখ্যক জমিদার তৈরি হয়েছে, তারা নিজ স্বার্থেই ব্রিটিশ প্রাধান্য বজার রাখতে উৎসাহী, ব্যাপক জনগণের উপরও তাদের সম্পূর্ণ আধিপত্য রয়েছে।”

উপরের কথাগুলো থেকে এবং পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে পাঠক-পাঠিকাদের কাছে নিশ্চয়ই স্পষ্টতর হয়েছে, ব্রিটিশ সরকার যেমন সামন্তপ্রভুদের উচ্ছেদ চায়নি, তেমনই চায়নি দেশীয় পুঁজিকে ব্যবসা-বাণিজ্যে আকর্ষিত করতে। ফলে, ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশের স্বার্থে সমাজকে গতিশীল করতে ব্রিটিশ সরকার সচেষ্ট হয়েছিল—এই কুযুক্তিও কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।

ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সুদীর্ঘ সময়ের অভিভাবক রজনীপা দত্ত তাঁর ‘India Today’ গ্রন্থের ২৮২ পৃষ্ঠায় ব্রিটিশ সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক রামমোহন রায়কে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক’ বলে চিহ্নিত করেছেন।

জানি না রজনীপামের দৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদের অর্থ কী? ‘জাতীয়’ কথার অর্থ জাতি সম্বন্ধীয়। রামমোহন কোন জাতি সম্বন্ধীয় উপলব্ধি থেকে ব্রিটিশ প্রভুত্ব এবং ভারতের জনগণের পরাধীনতাকে সোচ্চারে সমর্থন জানিয়ে ছিলেন? তিনি ধনীজাতীয় মানুষ সম্পর্কিত উপলব্ধি থেকে, ধনীজাতীয় মানুষদের স্বার্থ চিন্তা থেকে বৈদেশিক প্রভুত্বকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন বলেই ‘ধনী’ ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদের জনক’ ছিলেন—এই কথাটি বলতে রজনীপামের দ্বিধা কেন? আর কবে এইসব বুদ্ধিজীবীরা স্পষ্ট ভাষায় ‘গোলাপ’কে ‘গোলাপ’, আর ‘কোদাল’কৈ ‘কোদাল’ বলবেন?

ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার, মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী নরহরি কবিরাজ মার্কসবাদীদের একদা অভিভাবক রজনীপাম দত্ত, বুদ্ধিজীবী শিবনারায়ণ রায়, অশোক রুদ্র ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে উনিশ শতকের রেনেসাঁসকেই সমর্থন করেছেন। যদুনাথ তো রেনেসাঁসকে “The greatest gift of English” বলেই ঘোষণা করেছেন। তাঁদের এমনতর স্বীকৃতির মধ্যে যুক্তির কোনও স্থান ছিল না । যুক্তির নিরিখে এইসব বিখ্যাতদের বক্তব্য নিতান্তই অসার হয়ে পড়ে।

রেনেসাঁসের সময় থেকে আজ পর্যন্ত বঙ্গীয় রেনেসাঁস যুগের পুরোধা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, বিবেকানন্দ, কেশব সেন, ডিরোজিও প্রমুখ ঊনবিংশ শতকের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতাদের যে মূল্যায়ন হয়ে আসছে তার মধ্যে যুক্তিবিচার বাস্তবিকই স্থান পায়নি। ব্যক্তিপূজার ফলে এঁরা অনেকেই আজ এমনই এক কিংবদন্তি জগতের মহানায়কের রূপ পেয়েছেন যে এঁদের সীমাবদ্ধতা, নেতিবাচক দিক, ভ্রান্ত-চিন্তা, এমনকী, দেশের জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার মতো দিকগুলোর প্রতিও বর্তমানের মূল্যায়নকারীরা কিছু বলতে ভয় পান। ফলে জনসমর্থন সচেতন এইসব সমালোচকদের কৃপায় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এইসব নায়ক চরিত্রগুলোর মূল্যায়ন হয়ে দাঁড়িয়েছে ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত । রেনেসাঁস যুগের নায়কেরা কেউই তাঁদের সীমাবদ্ধতার গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে এসে বাস্তবিকই ‘মহান’ হয়ে উঠতে পারেননি। বাস্তবপক্ষে তাঁদের এই সীমাবদ্ধতার জন্যই তাঁদের অসাধারণ গুণাবলি ব্যাপক নিপীড়িত জনগণের মুক্তির পথে কোনও ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করেনি। তাঁদের এই রেনেসাঁস নামক সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল স্পষ্টতই সংখ্যালঘু কিছু মানুষের জন্য তাদেরই মধ্যে সীমাবদ্ধ এক খণ্ডিত ও আধুনিকতার প্রহসনে আবদ্ধ আন্দোলন।

 

‘প্রগতি লেখক সংঘ’

১৯৩৫ সালের শেষাশেষি লন্ডনের কিছু প্রবাসী ভারতীয় ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও লেখক মার্কসবাদী ধ্যান-ধারণার সংস্পর্শে এসে প্রগতি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘প্রগতি লেখক সংঘ’। ‘প্রগতি লেখক সংঘ’র প্রথম ইস্তাহারে স্বাক্ষর করেছিলেন সজ্জাদ জহির, মুলুকরাজ আনন্দ, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে হীরেন মুখার্জি, রাজা রাও, মহম্মদ আশ্রফ, ইকবাল সিং, ভবানী ভট্টাচার্য, প্রমোদরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ। ইস্তাহার মুসাবিদার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সে-সময়কার প্রবাসী ভারতীয় ছাত্রদের ‘ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড’ জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষের ওপর।

ইস্তাহারটিতে যা বলা হয়েছিল তারই কিছুটা হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের করা বাংলা তর্জমা থেকে তুলে দিচ্ছিঃ

“সনাতনী সংস্কৃতিতে ভাঙন ধরার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সাহিত্যে আটপৌরে জীবনের বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়ার আত্মঘাতী প্রবণতা দেখা দিয়েছে, আমাদের নূতন সাহিত্য প্রত্যক্ষ ও প্রাকৃতিককে ছেড়ে অপ্রত্যক্ষ ও অধ্যাত্মিকের দিকে ধাবিত হয়েছে। পৃথিবীর মাটি পরিত্যাগ করে কল্পলোকের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। ফলে তার রচনাভঙ্গি অন্ধ নিয়মানুগত্যের বিষম জ্বালে জড়িয়ে পড়েছে। তার ভাবসম্প হয়েছে রিক্ত ও বিকারগ্রস্ত।”

“আমাদের সমাজ যে নবরূপ ধরেছে তাকে সাহিত্যে প্রতিফলিত করা এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করে প্রগতিকামী মননধারাকে বেগবান করা— এই আমাদের লেখকদের কর্তব্য।….’

“…যা কিছু আমাদের নিশ্চেষ্টতা, অকর্মণ্যতা, যুক্তিহীনতার দিকে টানে, তাকে আমরা প্রগতিবিরোধী বলে প্রত্যাখ্যান করি। যা কিছু আমাদের বিচার-বুদ্ধিকে উদ্‌বুদ্ধ করে, সমাজব্যবস্থাকে যুক্তিসঙ্গতভাবে পরীক্ষা করে, আমাদের কর্মিষ্ঠ, শৃঙ্খলাপুষ্ট সমাজের রূপান্তরক্ষম করে, তাকে আমরা প্রগতিশীল বলে গ্রহণ করব।”

এই ইস্তাহারের ওপর ভিত্তি করেই ১৯৩৬-এ লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে কংগ্রেস দলের মণ্ডপেই ‘সারা ভারত প্রগতি লেখক সংঘ – এর প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক মুনশি প্রেমচন্দ। উদ্বোধনী ভাষণ দিলেন সরোজিনী নাইডু। সম্মেলনে উৎসাহ জোগালেন জওহরলাল নেহরু। ’৩৬ সালের এই সর্বভারতীয় সাধারণ সম্মেলনে সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হলেন সজ্জাদ জহির। তিনি ছিলেন উত্তরপ্রদেশের অতি ধনী পরিবারের সন্তান। বাবা, ইংরেজ সরকার বাহাদুর কর্তৃক ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত জহির হাসান । সজ্জাদ-এর এক ভাই হুসেন জহির ছিলেন কংগ্রেস নেতা, আর এক ভাই আলি জহির ছিলেন মুসলিম লিগ নেতা। সজ্জাদ পরিবার ও নেহরু পরিবার ছিলেন হরিহরাত্মা ।

সজ্জাদ-এর নেতা পরিচয় দেওয়ার উদ্দেশ্য তাঁর ব্যক্তিগত সমালোচনা নয়; দৃষ্টান্ত টেনে শুধু বলতে—সংঘের নেতৃত্বে এমন ধরনের উচ্চশিক্ষিত উচ্চবিত্তের ভিড় ছিল যথেষ্ট।

বিশ্ব-সাহিত্যের দিক্‌পাল স্বনামধন্য লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির মৃত্যুকে উপলক্ষ করে ১৯৩৬-এর ১১ জুলাই অ্যালবার্ট হলের কমিটি রুমে একটি শোকসভার আয়োজন করা হয়েছিল। এই শোকসভার আহ্বায়ক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, খগেন্দ্রনাথ সেন, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার (সম্পাদক, আনন্দবাজার), ডঃ ধীরেন্দ্রনাথ সেন (সম্পাদক, অ্যাডভান্স)। গোর্কির এই শোকসভাতেই আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘ’ গঠনের কথা ঘোষিত হয় । সভাপতি নির্বাচিত হন ডঃ নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী ।

১৯৩৭-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাণী নিয়ে প্রগতি লেখক সংঘ প্রকাশ করেছিল ‘প্রগতি’ নমের সংকলন। সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন হীরেন মুখার্জি ও সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, সংকলনটিতে যাঁদের রচনা স্থান পেয়েছিল তাঁদের মধ্যে ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন, বিধায়ক ভট্টাচার্য প্রভৃতি। ভূমিকায় নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত লিখেছিলেনঃ “মানবের মানবত্বকে আকস্মিক ধ্বংসের মুখ হইতে রক্ষা করিতে হইলে সব মানবের সংহত চেষ্টা প্রয়োজন। যাহার বাহুতে বল আছে, চিত্তে আছে যার ধীশক্তি ও ভাবুকতা, কণ্ঠে আছে যার বাগ্মিতা, লেখনী যার শক্তিমান—সকলের সমবেত চেষ্টা আজ প্রয়োজন – মানবের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও প্রগতিকে দৃপ্ত শক্তির মূর্ত অকল্যাণের হস্তে আসন্ন ধ্বংস হইতে রক্ষা করিবার।”

১৯৩৮-এর ডিসেম্বরে কলকাতার আশুতোষ কলেজ হলে অনুষ্ঠিত হল নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘের দ্বিতীয় সম্মেলন। সংগঠক ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, হীরেন মুখার্জি প্রমুখ। সারা ভারত থেকে ওই সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন মার্কসবাদী ও অমার্কসবাদী বহু খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী।

চল্লিশের দশকের শুরুতে প্রগতি সংস্কৃতির শিবিরের ভিতরে ও বাইরে শুরু হল মতবাদ ও মতাদর্শের লড়াই। একদিকে বিনয় ঘোষ, অরুণ মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, সরোজ দত্ত, অনিল কাঞ্জিলাল। অন্য দিকে বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেন, অমিয় চক্রবর্তী, হীরেন মুখার্জি প্রমুখ। বিনয় ঘোষরা সমালোচনা এবং আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে চাইলেন প্রগতি সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের দুর্বলতা দূর করতে। তাঁদের মতে মেকি কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে যে কাজটি সংঘ করে চলেছে তাকে বলা যেতে পারে— বিভিন্ন মতের শিল্পী-সাহিত্যিকদের দলে ভিড়িয়ে দল বাড়াবার নির্লজ্জ প্রচেষ্টা মাত্র। নেতৃত্ব সংঘের শিল্পী সাহিত্যিকদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে একমুখী করতে পারেনি, অর্থাৎ নিপীড়িত মানুষদের সংগ্রামের প্রেরণা সৃষ্টি করতে পারেনি; পারেনি নিপীড়িত মানুষদের চেতনাকে যুক্তিবাদের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।

বাইরের লড়াইটা হয়েছিল একটু অন্য ধরনের। উচ্চবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত ও অনর্গল ইংরেজদের মতন ইংরেজি বলতে পারার সুবাদে অনেকেই তখন সংঘের নেতা হয়ে বসেছেন, কমিউনিস্ট পার্টিতে বিশেষ মর্যাদা পেতে শুরু করেছেন। এইসব উচ্চমার্গের নেতারা যখন ‘মজদুর হাম হ্যায়’ গানে গলা মেলালেন, তখন শ্রমিক শ্রেণি এঁদের ‘হিরো’ হিসাবে ধরে নিলেও এঁদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারলেন না।

মার্কস-লেনিন-এঙ্গেলস্-এঁরা কেউই শ্রমিক শ্রেণির মানুষ

ছিলেন না, যেমন পৃথিবীর বহু বিপ্লবী চরিত্রই শ্রমিক-

কৃষকদের সংগ্রামে নিবেদিত-প্রাণ ছিলেন বলেই,

নিপীড়িত মানুষদের জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে

নিজেদের জীবনকে যুক্ত করার মধ্য দিয়েই

সংগ্রামী শ্রমিক-কৃষকদের বিশ্বাসযোগ্যতা,

ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন।

ভারতে তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতৃত্বে যে-সব ‘বুদ্ধিজীবী’ ও ‘বিলেত-ফেরত’দের প্রাধান্য ছিল, তাঁদের কাজকর্ম শ্রমিক-কৃষকদের আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের জীবনকে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে ‘শ্রেণিচ্যুত’ হতে হয়নি, এইসব নেতারা মুখে ‘শ্রেণিচ্যুতি’র প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই প্রতিশ্রুতি পালন করতে কোনও দিনই সচেষ্ট হননি। নিপীড়িত মানুষদের জীবনে নিজেদের জীবন যুক্ত করার পরিবর্তে মুখ আর কলমকে কাজে লাগিয়ে যে-টুকু করেছিলেন, তাতে এঁদের পুরো ব্যাপারটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘শৌখিন মজদুরি’। ফলে সংঘের সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ার আহ্বান নেহাতই রসিকতায় পরিণত হল। চল্লিশ দশকের শুরুতেই প্রগতি লেখক সংঘের কাজকর্ম কার্যত হল স্তব্ধ।

 

ভারতীয় গণনাট্য সংঘ
( Indian People’s Theatre Association)

১৯৪৩ সালের কথা, তখন জাপান বিরোধী যুদ্ধের প্রয়োজনে ভারতবর্ষ থেকে কিছু ব্রিটিশ বৈমানিককে চিনে যাতায়াত করতে হত। এই বৈমানিকদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট-পার্টির সভ্য। এঁরা প্রথম ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির হাতে তুলে দেন ইয়েনান ফোরামে শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে মাও সেতুঙ্-এর ভাষণের কপি। কমিউনিস্ট পার্টি তা সাইক্লো করে বিভিন্ন প্রদেশের প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেয়। মাও-এর এই ভাষণ পড়ে অনুপ্রাণিত হলেন বহু কর্মী। ভাষণে বলা হয়েছিল—শুধু মাত্র সেনাবাহিনীর সাহায্যে কখনওই বিপ্লব সফল হতে পারে না, বিপ্লব সফল করতে গেলে আর একটি বাহিনীর প্রয়োজন, আর তা হল- সাংস্কৃতিক বাহিনী, যারা নিপীড়িত মানুষদের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

ভারতের কমিউনিস্ট নেতৃত্ব শ্রেণি সংগ্রামকে, নিপীড়িত মানুষদের সংগ্রামকে কখনওই সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রসারিত করতে চাইতেন না, তাই পলিটব্যুরোতে বা কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোনও দিনই ‘সংস্কৃতি আন্দোলন’ বিষয়ক আলোচনা স্থান পায়নি। নেতৃত্ব ভাবতেন— যে কোনওভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা একবার দখল করতে পারলেই ঝপাৎ করে মানুষের চরিত্রগুলোও পাল্টে যাবে। (তা যে কত বড় ভ্রান্ত চিন্তা তারই প্রমাণ মেলে সোভিয়েত রাশিয়া ও পূর্ব-ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর হাল হকিকত দেখে।)

মাও সেতুঙ-এর ইয়েনান ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হাতে পাওয়া সত্ত্বেও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো এ-বিষয়ে কোনও আলোচনা চালাবার বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করলেন না। এই নেতৃত্ব ‘সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ বা ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’-এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়ে ছিলেন। তাঁরা ‘সংস্কৃতি’ শব্দের প্রকৃত অর্থ এবং ব্যাপকতা বুঝতেও ছিলেন অক্ষম। এমন অবুঝ নেতাদের চোখে ‘সংস্কৃতি’ বলতে ধরা পড়ত নিছকই গান-বাজনা-নাটক। আরএই সংস্কৃতিকে তাঁরা ব্যবহার করতেন স্রেফ মিটিং-এ লোক জমাতে অথবা চাঁদা তোলার প্রয়োজনে।

১৯৪৩ সালে গণনাট্য সংঘ গড়ে উঠল নাটক, গান ও নাচের মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল চিন্তাধারাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করে তাকে আরও শক্তিশালী করতে। ‘৪৩-এর ২৫ মে বোম্বাইতে প্রথম নিখিল ভারত গণনাট্য সম্মেলনের প্রথম প্রস্তাবে ঘোষণা রাখা হয়েছিল—“এই আন্দোলনের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণকে উদ্দীপিত করে তোলা, যাতে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ শক্তিগুলির বিরুদ্ধে দুনিয়ার প্রগতিশীল শক্তিগুলির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাহস ও দৃঢ়সংকল্পের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন।”

গণনাট্য সংঘ অর্থাৎ আই পি. টি. এ-র এক নম্বর বুলেটিন প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৩-এর জুলাই মাসে, শিরোনাম ছিল ‘Historical Back- ground’ অর্থাৎ ‘ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট’। তেরোটি অনুচ্ছেদে বিভক্ত ইংরেজিতে রচিত এই বুলেটিনে বলা হয়েছিল ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা, ধ্রুপদী শিল্পকলা ও লোককলার ক্ষেত্রে অবক্ষয়ের লক্ষণের কথা। বলা হয়েছিল—সমাজ বিন্যাসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কী ভাবে শিল্পকলা সামঞ্জস্যহীন হয়ে যাচ্ছে তার কথা, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতার কথা। তেমনই নাট্য-প্রসঙ্গও এসেছে, এসেছে শিল্প-সাহিত্যিকদের দায়িত্ববোধের কথা। অন্ধ্র, মালাবার, বাংলা এবং বোম্বাইয়ের খেটে-খাওয়া মানুষদের প্রাণমাতানো গানের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছিল—দেশের চিরায়ত নৃত্যশৈলী আর মন্দির বা রাজসভার মধ্যে আটকে থাকবে না, তা সংগ্রামী মানুষের ভাবকে প্রকাশ করবে। এর থেকেই সৃষ্টি হবে নতুন নাট্যকলার।

এল দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধ। যুদ্ধের বারুদের গন্ধে, মানুষের তৈরি দুর্ভিক্ষ, প্রতিবাদহীন মৃত্যু— আমাদের দেশের মানুষ এইসব বীভৎস অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। হিটলার এক সময় সোভিয়েত আক্রমণ করলেন। ভারতীয় কমিউনিস্টরা সোভিয়েতের মিত্র-পক্ষ ব্রিটিশ শক্তিকে সাহায্য করতে সচেষ্ট হল ব্রিটিশদের যুদ্ধ চালাবার প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে আমাদের দেশে দেখা দিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সে-দিন বাংলার যে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ অনাহারে প্রতিবাদহীন ভাবে মৃত্যুকে মেনে নিল, তার জন্য প্রধান দায়ী ব্রিটিশ রাজশক্তির দিকে আঙুল না তুলে কমিউনিস্টরা দায়ী করল শুধু মজুতদার-কালোবাজারিদের। সে সময় ভ্রান্ত রাজনীতির ফসল হিসাবে হাজির হল ‘নবান্ন’ নাটক। নাটক হিসেবে যত সার্থকই হোক, অভিনেতা- অভিনেত্রীদের অভিনয় দক্ষতা যতই তুঙ্গে উঠুক নাটকের বক্তব্যে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের সুরের পরিবর্তে আমরা দেখলাম নিপীড়িত মানুষদের ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ভারতবর্ষে ঘটে গেল নাবিক বিদ্রোহ। নাবিকদের প্রতিনিধিরা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে সাহায্য চাইতে পলিটব্যুরোর সদস্যরা নাবিকদের হতাশ করে গান্ধী ও জিন্নার কাছে পাঠালেন। বম্বের সেই নৌ-বিদ্রোহ ইতিহাস তৈরি করেছিল ঠিকই, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিল।

সে সময় গণনাট্য সংঘ নৌ-বিদ্রোহের উপর ব্যালে নৃত্য হাজির করল। গানে সেদিন ধ্বনিত হল রক্তের ঋণ রক্তে শোধার শপথ। বোম্বের সরকার ওই ব্যালে নৃত্যের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন।

১৯৪৯-এর ১৬ আগস্ট, শুরু হল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এই দাঙ্গা ভারতের শোধিত শ্রেণিদের ধর্মের ভিত্তিতে খণ্ডিত করল। গণনাট্য সংঘ উদারনৈতিক মানবিকতার কাঁদুনি মিশিয়ে নামাল নাচ-গান-ছায়া-নাটক। ছায়া-নাটক ‘শহিদের ডাক’ আঙ্গিকে অভিনয়ে অসাধারণ হলেও শৃঙ্খলিত মানুষদের চেতনা মুক্তির ক্ষেত্রে এই নাটকের অবদান ছিল এক বিরাট শূন্য।

১৯৪৯-এর ফেব্রুয়ারিতে গণনাট্য সংঘের ষষ্ঠ সম্মেলন ছিল খুবই তাৎপর্যময়। এই সম্মেলনে মাও সেতুঙ-এর ইয়েনান ফোরামে রাখা বক্তব্য—“শিল্পকলা কার জন্য’ বিশেষ ভাবে নাড়া দিল। সম্মেলনে গর্বিত ঘোষণা রাখা হল—“আমাদের মূল দর্শক সংগ্রামী জনতা”। একই সঙ্গে এই সম্মেলনেই প্রকাশিত হল আন্দোলনের এক বিশাল দুর্বলতা – সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং সামন্তবাদ বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন (অবশ্যই সামগ্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন এই আন্দোলন ছিল না) গড়ে তুলতে, জনগণকে বাস্তবিকই নাড়া দিতে জনগণ এবং জনগণের উপর প্রভাব-বিস্তারকারী প্রগতিশীল মানুষদের আন্দোলনে শামিল করার জন্য একটা গণতান্ত্রিক ‘ফ্রন্ট’ বা সাংস্কৃতিক বাহিনী গড়ার বাস্তবিক প্রয়োজন অনুধাবনে গণনাট্য সংঘের নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছিল। নেতৃত্ব নিজ-সংগঠনের হাতে রেখে ‘ফ্রন্ট’ গড়ে সংগঠনের বাইরের প্রগতিশীলদের সংগঠনের মূল স্রোতে কাজে লাগিয়ে আন্দোলনকে সমাজের ব্যাপকতর অংশে ছড়িয়ে দিতে পারলে তবেই আন্দোলন সার্থক রূপ নিতে পারে, নতুবা আন্দোলন একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে বা শুধুমাত্র ‘কমিটেড’ লোকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। সমাজ বিজ্ঞানের এই সত্য অজানা থাকার দরুন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে গণতান্ত্রিক ‘ফ্রন্ট’ গড়ে তোলার কোনও কর্মসূচি এই ষষ্ঠ সম্মেলনেও রাখা হল না। সম্মেলনে বলা হল-‘যে সব শ্রেণি সমাজতন্ত্র গড়ে তোলে কেবল তাদের সংগ্রামের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠতে পারে সমাজতান্ত্রিক শিল্প।”

নেতৃত্বের ভুলে সমাজ বিজ্ঞানের নিয়ম মতোই দেখা গেল সমাজতন্ত্রী সংস্কৃতি গড়ার আহ্বান রাখায় গণনাট্য আন্দোলন ক্রমশ জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল।

১৯৫৩ সালে বোম্বাইতে গণনাট্য সংঘের সপ্তম সম্মেলনে ঘোষণা পত্রে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সুস্থ-সংস্কৃতি গড়ে তোলার আহবান জানানো হল ভাসাভাসা ভাবে। এরই পাশাপাশি ঘোষিত হল বিশ্বশান্তির কথা, ‘সংগীত-নাটক আকাদেমি’কে স্বাগতম জানাবার কথা। ধনিকের অর্থে গদিতে বসা সরকার যারা কিনা শোষণের স্বার্থেই, গরিবদের মগজ ধোলাইয়ের স্বার্থেই অপসংস্কৃতির ধারক-বাহক, তাদের কাছেই গণনাট্য সংঘ আবেদন করল অর্থ সাহায্যের। তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক অজয় ঘোষ নেতৃস্থানীয় পার্টির শিল্পী-সাহিত্যিকদের এক ঘরোয়া সমাবেশে স্পষ্ট ভাষায় জানালেন গণনাট্য সংঘকে বুর্জোয়া ভাবাদর্শের সঙ্গে সংঘাতহীন সহাবস্থানের নীতি মেনে চলতে হবে। যেটুকু সুস্থ নাটক-সংগীতের মাধ্যমে সংস্কৃতির কলা বিভাগকে উন্নত করার প্রয়াস গণনাট্য সংঘ নিয়েছিল, তাকে কবরে পাঠাল অজয় ঘোষের আপসকামী শোধনবাদী চিন্তা।

অজয় ঘোষের চিন্তাধারায় ১৯৫৮ সালের অষ্টম সম্মেলন পর্যন্ত চলল গণনাট্য সংঘ। দিল্লির অষ্টম সম্মেলনে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশিষ্ট প্রতিনিধি এবং সংগীত-নাটক আকাদেমির আমলাদের বিপুল উপস্থিতি ছিল অতি লক্ষণীয়। সম্মেলনে প্রস্তাব নেওয়া হলো, ‘সংগীত-নাটক আকাদেমিকে অনুরোধ করা হোক, তারা যেন শিল্পের স্বার্থ সাধনের জন্য আমাদের সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে এবং আমাদের বিভিন্ন শাখা ও শিল্পীদের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতা করে আমাদের প্রস্তাবিত সাহায্য গ্রহণ করে।’

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘New Age’-এ পি. সি. যোশী প্ৰচণ্ড উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে লিখলেন : ‘গণনাট্য সংঘ সংগীত-নাটক আকাদেমির স্বীকৃতি লাভ করেছে।’ আরও লিখলেন, ‘এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গণনাট্য সংঘ নিজেকে সম্প্রসারিত করতে পেরেছে।’ এ কি দলের কলেবর বৃদ্ধির স্বার্থে আদর্শ বিসর্জন, না কি স্বার্থবুদ্ধি নেতাদের এ-ভাবে আপসকামী ও হুজুরদের স্বার্থরক্ষাকারীতে রূপান্তরিত করেছে?

এল ১৯৬২ সাল। চিনের বিরুদ্ধে উগ্র জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তুলতে সর্বশক্তি নিয়োগ করল রাষ্ট্রশক্তি। সমস্ত প্রচার মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগাল জাত্যভিমানের ঝড় তুলতে। আর অমনি ঝাঁকে ঝাঁকে কমিউনিস্ট ও কমিউনিস্ট-ঘেঁষা শিল্পী-সাহিত্যিকেরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন ‘দেশপ্রেমিক’ প্ৰমাণ কবে অনুকূল স্রোতে গা ভাসাতে। গণনাট্যের লড়াকু লোকসংগীত শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী গানের কথা পাল্টে ফেলে রাতারাতি নেমে পড়লেন দেশপ্রেমের জোয়ার আনতে। ভূপেন হাজারিকা তাঁর ‘ভারত সীমানায়’ গানের কথাই পাল্টে দিয়ে কমিউনিস্ট অপবাদ কাটিয়ে ‘দেশপ্রেমিক’ হয়ে গেলেন। গানের কথা ছিল, ‘চিনের জনতার জয়ধ্বনি শুনি’। এ-জায়গায় তিনি নতুন করে কথা বসালেন, ‘গাঁয়ের সীমানায় নিশীথ রাত্রির পদধ্বনি শুনি’। গণনাট্য সংঘের বিশিষ্ট সংগঠক অভিনেত্রী নিবেদিতা দাস চিন-বিরোধী নাটক মঞ্চস্থ করলেন—পাছে পুলিশ তাঁকে চিনপন্থী বলে ঝামেলা করে। মহারাষ্ট্রের বিশিষ্ট গণনাট্য সংগীতকার ওমর শেখও রাতারাতি ভোল পাল্টালেন। ডিগবাজি খাওয়ার ব্যাপারে কমিউনিস্ট কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কমিউনিস্টদরদী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় কেউই পিছিয়ে রইলেন না। গণনাট্য সংঘের পশ্চিমবঙ্গের সভাপতি নাট্যকার দিগীন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সীমান্তের ডাক’ নামে চিন-বিরোধী একটা নাটকই রচনা করে ফেললেন। এমন ডিগবাজিকারদের সংখ্যা এতই বিপুল যে তাঁদের নামের ফিরিস্তি দিয়েই একটা গোটা বই লিখে ফেলা যায়। তবে এ-কথা বাস্তব সত্য যে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের বড় অংশ‍ই ডিগবাজির খেলায় অংশ নিয়েছিলেন। এমন এক হুড়োহুড়ি পড়ে যাওয়া আত্মবিক্রির মধ্যে দিয়ে গণনাট্য সংঘের নাটক-গান ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নতুন সংস্কৃতি গড়ার আংশিক চেষ্টাটুকুও বিশাল ধাক্কা খেয়েছিল।

সময় এগিয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে, অপসংস্কৃতির জোয়ারে সুস্থ সংস্কৃতিকে পিছু হটতে হয়েছে—জায়গা করে দিতে। সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে শাসন ক্ষমতা দখল করতে সংসদীয় কমিউনিস্টরা যেন-তেন-প্রকারেণ নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতার মধুপানকেই জীবনের একমাত্র কাম্য করে নিয়েছে। ফলে গণনাট্য সংঘের এখন প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভোটবাক্সকে স্ফীত করতে গান ও নাটক লেখা।

বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণিতে পরিণত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে, বিচ্যুত নেতাদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে এবং জনগণকে ভোগসর্বস্ব চিন্তা থেকে রক্ষা করতে, ভাববাদী চিন্তা থেকে বাঁচাতে একান্তভাবেই যুক্তিবাদী, আদর্শবাদী চিন্তার এক বাতাবরণ সৃষ্টির প্রয়োজন। এই যুক্তিবাদী, আদর্শবাদী চিন্তার বাতাবরণ সৃষ্টির যে প্রক্রিয়া, তাই তো সাংস্কৃতিক আন্দোলন ।

এমন একটা লাগাতার সাংস্কৃতিক আন্দোলন না থাকলে নেতারা বিশেষ সুবিধাভোগী হয়ে উঠতেই পারে। আখের গোছানো, স্বজন পোষণ ইত্যাদি দুর্নীতি ঘাড়ে চাপতেই পারে, যা পূর্ব ইউরোপের মার্ক্সবাদী দেশগুলোর নেতাদের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছিল।

সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলে মানুষের চিন্তাকে একমুখী

করে তোলা সম্ভব, মানুষকে মোটিভেট করা সম্ভব—

এটা আজ প্রমাণিত সত্য। এই সত্যের মুখোমুখি

দাঁড়িয়ে আমরা অবশ্যই বলতে পারি-বিপ্লবের

আগে, বিপ্লব কালে এবং বিপ্লব পরবর্তী

পর্যায়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের

ভূমিকা অপরিসীম।

সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মাও সে তুং-ও এই পরম সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন। ইয়েনানে শিল্পী সাহিত্যিকদের আলোচনা সভায় মাও সে তুং এই বাস্তব সত্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ঘোষণা করেছিলেন- সামরিক বাহিনী এবং সাংস্কৃতিক বাহিনী— এই দুই শক্তিশালী বাহিনীর সাহায্য ছাড়া রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে জয়লাভ করা সম্ভব নয়।

গত কয়েক দশকের ইতিহাসের দিকে নজর দিলে দেখতে পাব, কোনও শ্রেণি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের যে পর্যায়ে তার সামরিক বাহিনীকে ময়দানে নামায়, তার বহু আগেই ময়দানে নামায় তার সাংস্কৃতিক বাহিনীকে। ক্ষমতা দখলে উদ্যোগী শ্রেণি তাদের শ্রেণিস্বার্থে জনগণের চিন্তাকে আচ্ছন্ন রাখতে, পরিচালিত করতেই এমনটা করে।

এতক্ষণের আলোচনা থেকে যে সারাংশ উঠে আসে, তা হল একটি সফল বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার পরও সেই বিপ্লবকে সার্থক করে তুলতে, ধরে রাখতে লাগাতার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরিমণ্ডল বজায় রাখা ও উন্নতি করার কাজ চালিয়েই যেতে হয়, যাতে শত্রুবাহিনী আবার ক্ষমতা না দখল করতে পারে; যাতে আবার এক নতুন সুবিধাভোগী শোষকশ্রেণি না গড়ে ওঠে। অর্থাৎ সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের পর প্রত্যক্ষ যুদ্ধ থেকে বিশ্রাম নিলেও সাংস্কৃতিক বাহিনীর কোনও পর্যায়েই বিশ্রাম নেওয়ার সময় থাকে না। বর্তমানের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সাংস্কৃতিক বাহিনীর রণনীতি, কৌশল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও অত্যন্ত জটিল। এই সাংস্কৃতিক বাহিনী জনগণের মধ্যে মতাদর্শগত চেতনা গড়ে তুলতে ব্যর্থ-হলে বিপ্লব ব্যর্থ হতে বাধ্য। কোনও শক্তিশালীতম বাহিনীরও সাধ্য নেই এই ব্যর্থতাকে সাফল্যে রূপ দেওয়ার। অতি স্পষ্ট ও স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রতিটি সমাজ সচেতন, শোষিতের মুক্তিকামী মানুষদের বুঝে নিতে হবে বিপ্লবকে সফল করতে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে আংশিক যুদ্ধ চালালে চলবে না। চালাতে হবে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক সামগ্রিক যুদ্ধ। আমাদের এ-বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে—অপসংস্কৃতির বর্তমান রূপ জনসাধারণের ভাবনা-চিন্তার জগৎকে পঙ্গু করে দেওয়ার কাজই করে চলেছে অতি সংগঠিত ও পরিকল্পিতভাবে। এই বিষয়ে সংস্কৃতিক কর্মীদের স্বচ্ছতার অভাব থাকলে তাঁদের সংগ্রাম কখনোই চূড়ান্ত জয় ছিনিয়ে আনতে পারবে না। এ-কথাও অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এই সংগ্রাম শুধু-অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-মূলক সংগ্রাম নয়, একটা নতুন সংস্কৃতি গড়ারও সংগ্রাম। পরিণতিতে নতুন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে উঠে আসবে নতুন নেতৃত্ব, যে নেতৃত্বে থাকবে সমাজ পরিবর্তনের, হুজুর-মজুর সম্পর্ক অবসানের অঙ্গীকার ।

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ বিভ্রান্তির সংস্কৃতিঃ বাঁচাও তাহারে মারিয়া

অধ্যায়ঃ দুই

♦ অপসংস্কৃতি ও সুস্থ সংস্কৃতিঃ পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হোক সুচেতনার পথে

অধ্যায়ঃ তিন

♦ সাংস্কৃতিক বিপ্লবঃ পৃথিবীর পথে হাজার বছর হাঁটা

অধ্যায়ঃ চার

♦ ভারতবর্ষে সাংস্কৃতিক আন্দোলনঃ কেউ কথা রাখেনি

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ নকশালবাড়ির সংগ্রামে উব্ধুদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলন

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ যুক্তিবাদী আন্দোলন, সার্বিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনঃ এসো আমরা আগুনে হাত রেখে প্রেমের গান গাই

অধ্যায়ঃ সাত

♦ ‘যুক্তিবাদ’ একটা সম্পূর্ণ দর্শন, একটা বস্তুবাদী বিশ্ব-নিরীক্ষণ পদ্ধতিঃ কুয়াশা কাটে, কাটে নেশা, আকাশের ঘষা-সূর্য স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়

অধ্যায়ঃ আট

♦ যুক্তির পথচলাঃ লোভের অন্ধকারে ঢোকে না দিনের আলো

অধ্যায়ঃ নয়

♦ অতি ব্যবহৃত কিছু শব্দঃ সিন্দুকেতে মন ভরেছে ভেতরে তার কি আছে কেই বা রাখে খোঁজ?

“সংস্কৃতিঃ সংঘর্ষ ও নির্মাণ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!