দর্শনের ইতিহাসে মূল দ্বন্দ্ব ভাববাদ বা বিশ্বাসবাদ বনাম বস্তুবাদ বা যুক্তিবাদ। ভাববাদের সঙ্গে যুক্তিবাদের দ্বন্দ্বই অন্ধ-বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তির লড়াই।
ভাববাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কিত বিশ্বাসবাদ, শাস্ত্র-বিশ্বাস, ধর্ম-বিশ্বাস, গুরু-বিশ্বাস, আধ্যাত্মবাদ। ‘শাস্ত্র’ বলতে শুধু বেদ-উপনিষদ নামে ‘শ্রুতি’ নয়, ‘ধর্মশাস্ত্র’ (প্রাচীন আইন গ্রন্থ) নামে ‘স্মৃতি’ও। ভাববাদীদের কাছে শাস্ত্রবাক্যই প্রমাণ।
বস্তুবাদ বা যুক্তিবাদে এমন অন্ধ-বিশ্বাসের কোনও স্থান নেই। যুক্তিবাদ সিদ্ধান্তে পৌঁছোয় যুক্তির পথ ধরে, পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পথ ধরে।
ভাববাদী মনুর বিধান হল, বেদকে ‘শ্রুতি’ এবং ‘ধর্মশাস্ত্রকে’ স্মৃতি বলে মানবে। বেদ ও ধর্মশাস্ত্রই হল হিন্দু ধর্মের মূল। এ-নিয়ে কোনও বিতর্ক করা চলবে না। কোনও তার্কিক দ্বিজ যদি তর্কবিদ্যার সাহায্য নিয়ে ‘শ্রুতি ও স্মৃতি’র অবমাননা করে তাহলে সাধু ব্যক্তিরা তাকে সমাজ থেকে বের করে দেবে। বেদ-নিন্দুকেরা নাস্তিক। (২/১০-১৬)
‘মনুর বিধান’ যে বলা হল, সেই মনু কে? হিন্দু ভাববাদীদের বিশ্বাস মনু কোনও রমণীর গর্ভজাত নন, ব্রক্ষ্মা তাঁর দেহ থেকে তৈরি করলেন একটি নারী- নাম শতরূপা ও মনুকে শতরূপার সঙ্গে ব্যভিচারের ফলে মনুর জন্ম। পরে মনু তাঁর মাতা শতরূপাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। মনু ব্রক্ষ্মার দেহ থেকে উদ্ভূত, এই হেতু তাঁর আর এক নাম ‘স্বয়ম্ভূ’ মনু। মনু’র স্ত্রী শতরূপা থেকে ছেলে প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ, কন্যা আকুতি, দেবহুতি ও প্রসূতির জন্ম। এঁদের ছেলে-মেয়েদের থেকেই না কি মানুষ বা মানবজাতির এই আদি মন স্বয়ম্ভূর মনুর পর আরও ১৩ জন মনু সৃষ্টি করেন ব্রক্ষ্মা। তাঁরা হলেন (১) স্বরোচিষ (২) উত্তম, (৩) তামস, (৪) রৈবতঃ, (৫) চক্ষুস, (৬) বৈবস্বত, (৭) সাবর্ণি, (৮) রোচ্য, (৯) ভৌত্যঃ (১০) মেরুসবর্ণি, (১১) ঋভু, (১২) ঋতুধামা ও (১৩) বিষ্ককসেন।
এই চোদ্দজন মনু-ই হিন্দু-ধর্মশাস্ত্র বা হিন্দু-ধর্মীয় আইনের স্রষ্টা। এই ধর্মীয় আইন ‘মনু সংহিতা’ রচনা করেন। ‘মনু সংহিতা’ বেদ পরবর্তীকালে রচিত এবং কয়েকশো বছর ধরে রচিত। আইনকর্তা মনুরা এমন শাসনব্যবস্থা কায়েক করতে চেয়েছিলেন। যার প্রধান শর্ত হল ‘অন্ধ-বিশ্বাস’। শ্রমিক ও শোষিতদের অভ্যুত্থান সম্ভাবনা রোধ করতে এবং তাদেরকে দাবিয়ে রাখতে মনু তৈরি করেছিলেন বিশেষ দর্শন-মতাদর্শগত শক্তি।
মনুও কিন্তু যুক্তিবাদীদের যুক্তিবাদীদের যুক্তিতর্কের আক্রমণের কথা ভেবে শঙ্কিত ছিলেন। যুক্তিবাদী চিন্তাধারা ব্যাপকতা পেলে, সাধারণের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেলে, প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ভিতই টলে যেতে পারে- যে সমাজব্যবস্থায় একদল শুধুই খাটবে আর একদল ভোগ করবে সেই খাটনির ফল।