প্রথম কলকাতা দর্শন বছর বারো বয়সে। সেদিন ছিল ছট্‌ পুজো। অর্থাৎ সূর্যের পুজো। তাসার বাজনা, হিজড়েদের নাচ, দণ্ডিকাটা মেয়ে বউ আর কাঁদি কাঁদি কলা নিয়ে গঙ্গায় ছট্‌ পুজোর মিছিল যাচ্ছিল একের পর এক। গঙ্গাকে দেবী ভাবার মত মন ছিল না, সুর্যকে দেবতা? বাঙালি বলেই বোধহয় গোটা ব্যাপারটাই কেমন বোকা বোকা লাগছিল। কারণ, বাঙালিদের ছট পুজো নেই। থাকলে বোধহয় এমনটা মনে হত না।

সকালে বড়বাজারে ষাঁড়েদের গরম গরম গাদাগুচ্ছের জিলিপি আর কচুরি খাওয়াতে দেখলাম মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের। “ঘাস বা বিচুলির বদলে জিলিপি কচুরি খাওয়াচ্ছে কেন ওরা?” আমার প্রশ্নের জবাবে ছোটমামা জানালেন, “ওরা গরুকে ভগবতী মনে করে। ষাঁড়কে ভগবান। তাই খাইয়ে পুণ্যি করছে।” অবাক হয়েছিলাম !

চিড়িয়াখানায় কুমিরের চৌবাচ্চায় অবাঙালি কিছু দর্শক প্রণাম করে পয়সা ছুড়ে দিচ্ছিলেন। জানলাম, এসব নাকি মকরকে প্রণাম করে প্রণামী দেওয়া, পুণ্যলাভের আশায়। অবাক হয়েছি!

আদ্রায় কেটেছে আংশিক শৈশব। ওখানে সাপের দেবী মনসার পুজো হতো খুব ধুমধাম করে। দুর্গা ঠাকুরের মত বিশাল মূর্তি। দু-পাশে জয়া-বিজয়া। কোনও কোনও পুজো প্যান্ডেলের বাড়তি আকর্ষণ ছিল চাঁদ সওদাগরের মনসা পুজোর মূর্তি। বিসর্জনের দিন দিঘির ঘাট ঘিরে মণিহারি দোকান, মুরগি লড়াই, জুয়া, তাড়ির পসরা। ঝাঁকা ঝাঁকা সাপ নিয়ে সাপুড়েদের ভিড়। ভভক তাড়ির গন্ধ, গ্রাম্য-সানাই, মাদল, ধামসার উন্মাদনা—মন নাচত। মনসা পুজো ছোট্ট থেকে জীবনের সঙ্গে এতটাই মিশে গিয়েছিল যে, সাপের পুজো দেখে মাথায় কোনও প্রশ্ন আসেনি। আদ্রার জীবনে সাপের কামড় থেকে বাঁচতে শোয়ার সময় বালিশে তিনটে টোকা মেরে একটা মন্ত্র আওড়াতাম, “আস্তিকেশ্বর মণি মাতা ভগ্নি বাসুকি তথা/জরৎকার মুনি পত্নী/মনসাদেবী নমস্তুতে।” সে সময় ভাবতাম, এই মন্ত্রের শক্তিতে সাপ কিছুতেই কামড়াবে না। তার অনেক বছর পরে জেনেছি বৈদিক যুগের মুনি-ঋষিরাও মনে করতেন, ঠিক মন্ত্র পড়ে যজ্ঞ করলে ফল মিলবেই। দেবতাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে মন্ত্রশক্তির কাছে অতি তুচ্ছ।

বাবা ট্রান্সফার হলেন খড়্গপুরে। খড়্গপুরে জলের অভাব ছিল। গুরুর অভাব ছিল না। বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠী ও ভাষাগোষ্ঠীর মানুষরা তাঁদের প্রদেশ থেকে গুরু আমদানি করতেন। এই উপলক্ষে প্রবাসী জীবনে নিজেদের গোষ্ঠীর মানুষজনদের হয়তো বেশি করে কাছে পেতেন। আর আমি ছিলাম একটু বেশি রকম গুরু-নেওটা। মুচিদের দৃষ্টি যেমন জুতোর দিকে, আমার ছিল গুরুদের দিকে। যে কোনও পাড়ায় নতুন গুরু এলেই খবর পৌঁছে যেত। গুরুদের কেউ নিরাকার একেশ্বরবাদী, আল্লাকে শুধু মানেন। কেউ বা শ্বেতাম্বর নিরীশ্বরবাদী জৈন, মুখে কাপড় বেঁধে রাখেন পোকাদের বাঁচিয়ে রাখতে। কেউ বা দিগম্বর জৈন, ঈশ্বর মানেন না। আবার কেউ বা ছত্রিশ কোটি দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। কেউ রাধে-শ্যাম, তো কেউ সীয়ারামের ভক্ত। কেউ নিরামিষভোজী পরম বৈষ্ণব তো কেউ বা চরম শাক্ত, নিত্য মদ্য- মাংস সেবায় লাগান। কেউ লিঙ্গের পূজারি কেউ বা যোনির। কেউ দেহ-মিলনে পরম ব্রহ্ম খুঁজে পান। কেউ বা মন্ত্র শক্তিকে দেবতার উপরে স্থান দেন। কেউ সূর্যের উপাসক। কেউ আগুনের পূজারি। কেউ বা পিশাচ সিদ্ধ প্রেত পুজারি তান্ত্রিক । কেউ বা গো-মাতাতে নিবেদিত প্রাণ।

এঁরা সকলেই দাবি করতেন—তিনিই একমাত্র খাঁটি। আমি এক ভগবান সন্ধানী পাগল, গিয়ে পড়েছিলাম ভগবানের জঙ্গলে। যতই পথ খুঁজে বেড়াতে চাইতাম, ততই হারিয়ে যেতাম ভগবানের গভীর জঙ্গলে।

error: Content is protected !!