শ্লোকঃ ২০

যে তু ধর্মামৃতমিদং যথোক্তং পর্যুপাসতে ।

শ্রদ্দধানা মৎপরমা ভক্তাস্তেহতীব যে প্রিয়াঃ ।৷ ২০ ॥

যে—যাঁরা, তু—কিন্তু; ধর্ম—ধর্ম, অমৃতম্ — অমৃতের, ইদস্—এই, যথা— যেমন, উক্তম্——- কথিত, পর্যুপাসতে— পূর্ণরূপে উপাসনা করেন; শ্রদধানাঃ— শ্রদ্ধাবান : মৎপরমাঃ মৎপরায়ণ, ভক্তাঃ— ভক্তগণ; তে— -সেই সকল; অতীব — অত্যন্ত; মে— আমার; প্রিয়াঃ- প্রিয়।

গীতার গান

এই শুদ্ধ ভক্তি যেবা করিবে সাধনা ৷

অমৃত সে ধর্ম জান জড় বিলক্ষণা ॥

তাহাতে যে শ্রদ্ধাযুক্ত অনুকূল প্রাণ ।

অত্যন্ত সে প্রিয় ভক্ত আমার সমান ॥

অনুবাদঃ যাঁরা আমার দ্বারা কথিত এই ধর্মামৃতের উপাসনা করেন, সেই সকল শ্রদ্ধাবান মৎপরায়ণ ভক্তগণ আমার অত্যন্ত প্রিয় ।

তাৎপর্যঃ এই অধ্যায়ে ২য় শ্লোক থেকে শেষ পর্যন্ত— ময্যাবেশ্য মনো যে মাম্ (আমাতে মনোনিবেশ করে) থেকে যে ভূ ধর্মামৃতমিদম্ (এই অমৃতময় ধর্ম) পর্যন্ত পরমেশ্বর ভগবান তাঁর সমীপবর্তী হবার জন্য অপ্রাকৃত সেবার পন্থা বিশ্লেষণ করেছেন। পন্থাগুলি ভগবানের অত্যন্ত প্রিয় এবং কোন ব্যক্তি যখন সেগুলির মাধ্যমে নিয়োজিত হন, ভগবান তখন তা গ্রহণ করেন। অর্জুন ভগবানকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, নির্বিশেষ ব্রহ্মোপলব্ধির পন্থা অবলম্বন করেছেন যে নির্বিশেষবাদী এবং অনন্য ভক্তি সহকারে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সেবা করেছেন যে ভক্ত, এই দুজনের মধ্যে কে শ্রেয়। তার উত্তরে ভগবান তাঁকে স্পষ্টভাবে উত্তর দিলেন যে, ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করাটাই হচ্ছে পারমার্থিক উপলব্ধির সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা। সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। পক্ষান্তরে বলা যায়, এই অধ্যায়ে নির্ধারণ করা হয়েছে যে, সাধুসঙ্গের প্রভাবে অনন্য ভক্তিতে ভগবানের সেবা করার প্রতি আসক্তি জন্মায় এবং তার ফলে সদৃশুরু লাভ হয় এবং তাঁর কাছ থেকে শ্রবণ, কীর্তন করা শুরু হয় এবং তখন দৃঢ় বিশ্বাস, আসক্তি ও ভক্তি সহকারে বেধীভক্তির অনুশীলন সম্ভব হয়। এভাবেই ভগবানের অপ্রাকৃত সেবায় নিযুক্ত হতে হয়। এই অধ্যায়ে এই পন্থা অবলম্বন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আত্ম-উপলব্ধির জন্য, পরম পুরুষোত্তম ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় লাভের জন্য ভক্তিযোগই যে পরম পন্থা, সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। পরম-তত্ত্বের নির্বিশেষ উপলব্ধি করার যে পন্থা এই অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে, তা কেবল আত্ম-উপলব্ধি লাভের পথে একান্ত প্রয়োজনীয় আত্ম-সমর্পণের সময় পর্যন্তই অনুশীলনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, যতক্ষণ পর্যন্ত শুদ্ধ ভক্তের সঙ্গ লাভের সুযোগ না পাওয়া যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতির ধ্যান করা লাভজনক হতে পারে, কিন্তু ভগবানের সবিশেষ রূপের ভক্তিযুক্ত সেবাই হচ্ছে পরম প্রাপ্তি। পরমেশ্বরের নির্বিশেষ অব্যক্ত রূপের উপাসনায় কর্মফল ভোগের আশা পরিত্যাগ করে ধ্যান করতে হয় এবং জড় ও চেতনের পার্থক্য নিরূপণ করার জ্ঞান অর্জন করতে হয়। শুদ্ধ ভক্তের সঙ্গ লাভ না করা পর্যন্ত এই পন্থার প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে, কেউ যদি সরাসরিভাবে অনন্য ভক্তিতে ভগবানের সেবা করার সৌভাগ্য অর্জন করেন, তা হলে তাকে আর ক্রমোন্নতির মাধ্যমে পরমার্থ সাধনের পথে এগোতে হয় না। ভগবদ্গীতার মধ্য ভাগের ছয়টি অধ্যায়ে ভগবদ্ভক্তি সম্বন্ধে যা বর্ণনা করা হয়েছে, তা অত্যন্ত সহজসাধ্য। এই পন্থায় দেহ ধারণ করার জন্য ভাড় বস্তু-বিষয়ক দুশ্চিন্তা করতে হয় না, কারণ ভগবানের কৃপায় সব কিছু আপনা থেকেই সম্পাদিত হয়ে যায়।

ভক্তিবেদান্ত কহে শ্রীগীতার গান ৷

শুনে যদি শুদ্ধ ভক্ত কৃষ্ণগত প্ৰাণ ৷৷

ইতি—’ভক্তিযোগ’ নামক শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।

error: Content is protected !!