শ্লোকঃ ১৬
অনপেক্ষঃ শুচির্দক্ষ উদাসীনো গতব্যথঃ ।
সর্বারম্ভপরিত্যাগী যো মদ্ভক্তঃ সমে প্রিয়ঃ ॥ ১৬ ॥
অনপেক্ষঃ- নিরপেক্ষ, শুচিঃ —শুচি; দক্ষঃ— নিপুণ, উদাসীনঃ—উদাসীন; গতব্যথঃ —উদ্বেগশূনা; সর্বারম্ভ — সমস্ত কর্ম প্রচেষ্টার; পরিত্যাগী — ফলত্যাগী: যঃ- যিনি ; মদ্ভক্তঃ—আমার ভক্ত; সঃ – তিনি; মে— আমার; প্রিয়ঃ—প্রিয়।
গীতার গান
লোক ব্যবহারে ভক্ত সদা নিরপেক্ষ ।
উদাসীন গতব্যথ শুচি আর দক্ষ ॥
শুচি হয় মোর ভক্ত ব্রহ্ম সে স্বভাবে
জাতি বুদ্ধি নাহি কর ভক্ত সে বৈষ্ণবে ॥
অনুবাদঃ যিনি নিরপেক্ষ, শুচি, দক্ষ, উদাসীন, উদ্বেগশূন্য এবং সমস্ত কর্মের ফলতানী তিনি আমার প্রিয় ভক্ত।
তাৎপর্যঃ ভক্তকে টাকা-পয়সা দান করা যেতে পারে, কিন্তু তিনি কখনও সেগুলি পাবার জন্য সংগ্রাম করেন না। ভগবানের কৃপায় যদি আপনা থেকেই তাঁর কাছে টাকা- পয়সা আসে, তাতে তিনি বিচলিত হন না। ভক্ত স্বাভাবিকভাবেই দিনে দুবার স্নান করেন এবং ভগবানের সেবার জন্য খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠেন। তাই, তিনি স্বভাবতই অন্তরে ও বাইরে অত্যন্ত নির্মল। ভক্ত সর্বদাই সুদক্ষ, কারণ জীবনের সমস্ত কর্মের যথার্থ উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণভাবে অবগত এবং প্রামাণিক শাস্ত্র সম্বন্ধে সর্বতোভাবে নিঃসন্দেহ। ভক্ত কখনই কোন বিশেষ দলের পক্ষ অবলম্বন করেন না; তাই তিনি সর্বদাই উদাসীন। তিনি সর্বোপাধি বিনিমুক্ত, তাই তিনি কখনই ক্লেশ ভোগ করেন না। তিনি জানেন যে, তাঁর দেহটি একটি উপাধিমাত্র। তাই কখনও যদি দেহের কোন রকম যাতনা হয়, তাতে তিনি অবিচলিত থাকেন। শুদ্ধ ভক্ত এমন কিছুর প্রয়াস করেন না, যা কৃষ্ণভক্তির প্রতিকূল। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একটি বড় বাড়ি তৈরি করতে হলে অনেক শক্তি নিয়োগ করতে হয়। কিন্তু ভক্ত কখনও এই ধরনের কাজে উদ্যোগী হন না, যদি তা তাঁর ভগবদ্ভক্তির উন্নতির সহায়ক না হয়। তিনি ভগবানের জন্য মন্দির তৈরি করতে পারেন এবং সেই জন্য সমস্ত রকমের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা মাথা পেতে গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের জন্য বড় বাড়ি তৈরি করার কাজে প্রয়াসী হন না।
শ্লোকঃ ১৭
যো ন হৃাষ্যতি ন দ্বেষ্টি ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি।
শুভাশুভ পরিত্যাগী ভক্তিমান্ যঃ স মে প্রিয়ঃ ॥ ১৭ ॥
যঃ- যিনি ন-না; হৃষ্যতি – আনন্দিত হন; ন–না, দ্বেষ্টি—জে করেন: ন না, শোচতি শোক করেন; ন–না; কাঙ্ক্ষতি – আকাঙ্ক্ষা করেন। ৩৬-৩৬, অশুভ-অশুভ, পরিত্যাগী — পরিত্যাগী, ভক্তিমান্ — ভক্তিযুক্ত; ঃ – যিনি; সঃ- তিনি; মে— আমার প্রিয়ঃ- প্রিয়।
গীতার গান
জড় কার্যে হর্ষ দুঃখ যে জনের নাই ৷
ত্যজিয়াছে যে আকাঙ্ক্ষা চিন্তা যার নাই ॥
শুভাশুভ পরিত্যাগী যেবা ভক্তিমান ।
আমার সে প্রিয় ভক্ত তাহাকে সম্মান ॥
অনুবাদঃ যিনি প্রিয় বস্তুর প্রাপ্তিতে হৃষ্ট হন না এবং অপ্রিয় বস্তুর প্রাপ্তিতে দ্বেষ করেন না, যিনি প্রিয় বস্তুর বিয়োগে শোক করেন না, অপ্রাপ্ত ইষ্ট বস্তু আকাঙ্ক্ষা করেন না এবং শুভ ও অশুভ সমস্ত কর্ম পরিত্যাগ করেছেন এবং যিনি ভক্তিযুক্ত, ভিনি আমার প্রিয় ভক্ত।
তাৎপর্যঃ শুদ্ধ ভক্ত বৈষয়িক লাভ ও ক্ষতিতে উৎফুন্ন অথবা বিমর্ষ হন না। তিনি পুত্র অথবা শিষ্য লাভের আকাঙ্ক্ষা করেন না এবং তা না পেলে তিনি দুঃখিতও হন না। তাঁর প্রিয় বস্তু হারিয়ে গেলে তিনি অনুতাপ করেন না। তেমনই, তাঁর ঈন্সিত বস্তু না পেলে তিনি বিমর্ষ হন না। তিনি সব রকম শুভ-অশুভ, পাপ-পুণ্য আদি জড় কর্মের ঊর্ধ্বে। পরমেশ্বর ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তিনি সব রকম বিপদ বরণ করতে প্রস্তুত। কোন কিছুই তাঁর ভগবদ্ভক্তি সাধনের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় না। এই ধরনের ভক্ত শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয়।
শ্লোকঃ ১৮-১৯
সমঃ শত্রৌ চ মিত্রে চ তথা মানাপমানয়োঃ
শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু সমঃ সঙ্গবিবর্জিতঃ ॥ ১৮ ॥
তুল্যনিন্দাস্তুতিমৌনী সন্তুষ্টো যেন কেনচিৎ ।
অনিকেত স্থিরমতিমির্ভক্তিমান্মো প্রিয়ো নরঃ ॥ ১৯ ॥
সমঃ—সম ভাবাপন্ন; শত্রৌ – শত্রুর প্রতি; চ–ও, মিত্রে — মিত্রের প্রতি; চ—ও; তথা—তেমন: মান—সম্মানে; অপমানয়োঃ – অপমানে; শীত—শীতে; উষ্ণ — গরমে; সুখ—সুখ; দুঃখে দুঃখে; সমঃ – সমভাবাপন্ন; সঙ্গবিবর্জিতঃ—কুসঙ্গ- বর্জিত; তুল্য—সমবুদ্ধি; নিন্দা – নিন্দা; স্তুতিঃ – স্তুতিতে; মৌনী – সংযতবাক্; সন্তুষ্টঃ— পরিতুষ্ট; যেন কেনচিৎ যৎকিঞ্চিৎ লাভে অনিকেতঃ — গৃহাসক্তিশূন্য; স্থির — স্থির: মতিঃ বুদ্ধি; ভক্তিমান্ — ভক্তিযুক্ত; মে – আমার, প্রিয়:-প্রিয়; নরঃ –মানুষ।
গীতার গান
শত্রু মিত্র অপমান কিংবা নিজ মান ।
জড়মুক্ত মোর ভক্ত মানয়ে সমান ॥
শীত, গ্রীষ্ম, সুখ, দুঃখ এক যেবা মানে ।
সঙ্গমুক্ত সেই ভক্ত স্থিত আত্মজ্ঞানে ৷৷
তুল্য নিন্দা স্তুতি আর সন্তুষ্ট গম্ভীর ।
নিকেতন তার নাই মতি তার স্থির ॥
সেই মোর প্রিয় ভক্ত সেই ভক্তিমান ।
ভক্তের লক্ষণ যত করিনু ব্যাখ্যান ॥
অনুবাদঃ যিনি শত্রু ও মিত্রের প্রতি সমবুদ্ধি, যিনি সম্মানে ও অপমানে, শীতে ও গরমে, সুখে ও দুঃখে এবং নিন্দা ও স্তুতিতে সমভাবাপন্ন, যিনি কুসঙ্গ-বর্জিত, সংযতবাক্ সংকিঞ্চিৎ লাভে সন্তুষ্ট, গৃহাসক্তিশূন্য এবং যিনি স্থিরবুদ্ধি ও আমার প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত, সেই রকম ব্যক্তি আমার অত্যন্ত প্রিয়।
তাৎপর্যঃ ভক্ত সর্বদাই সব রকম অসৎসঙ্গ থেকে মুক্ত থাকেন। কখনও কখনও কেউ প্রশংসিত হয় এবং কেউ নিন্দিত হয়; সেটিই হচ্ছে মানব সমাজের স্বভাব। কিন্তু ভক্ত সর্বদাই কৃত্রিম প্রশংসা ও নিন্দা, সুখ অথবা দুঃখ থেকে মুক্ত থাকেন। তিনি অত্যন্ত সহিষ্ণু। তিনি কৃষ্ণকথা ছাড়া আর কোন কথাই বলেন না। তাই তাঁকে বলা হয় যৌন। মৌন শব্দের অর্থ এই নয় যে, কারও কথা বলা উচিত নয়; মৌন শব্দের অর্থ হচ্ছে বাজে কথা না বলা। প্রয়োজনীয় কথাই কেবল মানুষের বলা উচিত এবং ভক্তের কাছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কথা হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের জনা কথা বলা। ভক্ত সর্ব অবস্থাতেই সুখী। তাঁর ভাগ্যে কখনও অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার জুটতে পারে, কখনও না-ও জুটতে পারে, কিন্তু তিনি সর্ব অবস্থাতেই সন্তুষ্ট। তাঁর বাসস্থানের কোন সুযোগ-সুবিধার জন্য তিনি কখনও যত্ন করেন না। তিনি কখনও গাছের নীচে থাকতে পারেন, কখনও আবার বিরাট প্রাসাদোপম অট্টালিকাতেও থাকতে পারেন। কিন্তু তিনি কোন কিছুর প্রতি আকৃষ্ট নন। তিনি হচ্ছেন অবিচলিত, কারণ তিনি সত্যসংকল্প ও জ্ঞানী। ভক্তের গুণাবলীর বর্ণনায় মাঝে মাঝে পুনরুক্তি দেখা দিতে পারে। কিন্তু এই সমস্ত সদ্গুণ ব্যতীত কখনই যে শুদ্ধ ভক্ত হওয়া যায় না, সেটি বুঝিয়ে দেবার জন্যই তা করা হয়েছে। হরাবভক্তসা কুতো মহদ্গুণাঃ – যে ভক্ত নয়, তার কোন সদগুণ নেই। যিনি ভক্তরূপে পরিচিত হতে চান, তাঁর পক্ষে এই সমস্ত সদগুণগুলি অর্জন করা একান্ত কর্তব্য, তবে এর জন্য তাঁকে বাহ্যিক প্রয়াস করতে হয় না। কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন হওয়ার ফলে এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার ফলে, আপনা থেকেই তাঁর মধ্যে এই সমস্ত গুণগুলির বিকাশ হয়।