শ্লোকঃ ১২

শ্রেয়ো হি জ্ঞানমভ্যাসাজজ্ঞানাদ্ধ্যানং বিশিষ্যতে ।

ধ্যানাৎ কর্মফলত্যাগস্ত্যাগাচ্ছান্তিরনন্তরম্ ॥ ১২ ৷৷

শ্রেয়ঃ- শ্রেষ্ঠ; হি—অবশ্যই; জ্ঞানম্—জ্ঞান; অভ্যাসাৎ- অভ্যাস অপেক্ষা; জ্ঞানাৎ—জ্ঞান অপেক্ষা, ধ্যানম্ — ধ্যান, বিশিষ্যতে — শ্রেষ্ঠ; ধ্যানাৎ ধ্যান থেকে; কর্মফলত্যাগঃ—কর্মফল ত্যাগ; ত্যগাত্—এই প্রকার ত্যাগ থেকে, শান্তিঃ শান্তি; অনন্তরম্—তারপর

গীতার গান

ভক্তিযোগে অসমর্থ যেবা অভ্যাসই ভাল ।

তাহাতে যে অসমর্থ জ্ঞানেতে সুফল ॥

তাহাতেও অসমর্থ আত্মচিন্তা শ্রেয় ৷

তাহাতেও অসমর্থ কর্মযোগ শ্রেয় ৷।

কাম্য কর্মে সুখ নাই ত্যাগই উত্তম ।

ত্যাগই শান্তির মূল তাতে নাহি ভ্ৰম ৷।

অনুবাদঃ তুমি যদি এই প্রকার অভ্যাস করতে সক্ষম না হও, তা হলে জ্ঞানের অনুশীলন কর। জ্ঞান থেকে ধ্যান শ্রেষ্ঠ এবং ধ্যান থেকে কর্মফল ত্যাগ শ্রেষ্ঠ, কেন না এই প্রকার কর্মফল ত্যাগে শান্তি লাভ হয়।

তাৎপর্যঃ পূর্ববর্তী শ্লোকে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভক্তি দুই রকমের — বৈধীভক্তির পন্থা ও পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রতি আসক্তি জনিত প্রেমভক্তির পন্থা। যাঁরা ভক্তিযোগের বিধি-নিয়মগুলি আচরণ করতে অসমর্থ, তাদের পক্ষে জ্ঞানের অনুশীলন করাই শ্রেয়, কারণ জ্ঞানের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত হতে পারেন। জ্ঞানের প্রভাবেই তাঁরা ধীরে ধীরে ধ্যানের স্তরে উন্নীত হতে পারেন। এবং ধ্যানের প্রভাবে ধীরে ধীরে পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে জানতে পারেন। কতকগুলি পন্থা আছে যা অনুশীলন করার ফলে পরমেশ্বর ভগবানকে নির্বিশেষ নিরাকার বলে মনে হয় এবং সেই প্রকার ধ্যানের পন্থা প্রয়োজন হয় তখনই, যখন কেউ ভক্তিযোগ অনুশীলন করতে অসমর্থ হন। যদি কেউ এভাবে ধ্যান করতে সক্ষম না হন, তা হলে বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্রদের জন্য নির্দিষ্ট বর্ণাশ্রম ধর্ম অনুশীলন করা যেতে পারে। সেই সম্বন্ধে ভগবদ্‌গীতার শেষ অধ্যায়ে বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই কর্মফল ত্যাগ করতে হয়। অর্থাৎ, কোন সৎ উদ্দেশ্যে কর্মফল নিবেদন করতে হয়।

সংক্ষেপে বলা যায় যে, জীবনের পরম উদ্দেশ্য, ভগবানের সমীপবর্তী হবার দুটি পন্থা আছে—তার একটি হচ্ছে ক্রমিক উন্নতি সাধন এবং অপরটি হচ্ছে সরাসরি পন্থা। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিযোগ হচ্ছে সরাসরি পন্থা এবং অপরটি হচ্ছে কর্মফল ত্যাগের পা। এভাবেই কর্মফল ত্যাগ করার ফলে জ্ঞানের স্তরে উন্নীত হওয়া যায়, তার পরে ধ্যানের স্তরে, তার পরে পরমাত্মা উপলব্ধির স্তরে এবং সব শেষে পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে উপলব্ধির স্তরে। এখন, কেউ ধাপে ধাপে এগোতে পারেন, অথবা সরাসরি পন্থা গ্রহণ করতে পারে। সরাসরি পন্থাটি গ্রহণ করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই ক্রমিক উন্নতির পন্থা গ্রহণ করাই মঙ্গলজনক। কিন্তু এখানে আমাদের বুঝতে হবে যে, ভগবান অর্জুনকে পরোক্ষ পন্থাটি গ্রহণ করার নির্দেশ দেননি, কারণ তিনি ইতিপূর্বেই পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি প্রেমভক্তির স্তরে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু যাঁরা প্রেমভক্তিতে যুক্ত হয়ে ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হতে পারেননি, তাঁদের জন্যই কেবল এভাবে বৈরাগ্য, জ্ঞান, ধ্যান, ব্রহ্ম-উপলি পরমাত্মা-উপলব্ধি আদির মাধ্যমে ক্রমিক উন্নতির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে ভগবদ্গীতায় প্রত্যক্ষ পন্থার উপরই জোর দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেককে উপদেশ দেওয়া হয়েছে যে, সকালেই যেন এই সরাসরি পন্থা অবলম্বন করে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে সর্বতোভাবে আত্মনিবেদন করেন।

শ্লোকঃ ১৩-১৪

অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাং মৈত্রঃ করুণ এব চ ।

নির্মমো নিরহঙ্কারঃ সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী ॥ ১৩ ।৷

সন্তুষ্টঃ সততং যোগী যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয়ঃ ৷

ময্যপিতমনোবুদ্ধির্যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ ॥ ১৪॥

অম্বেষ্টা— দ্বেষবর্জিত, সর্বভূতানাম্ — সমস্ত জীবের প্রতি, মৈত্রঃ বন্ধু ভাবাপন্ন; করুণঃ—কৃপালু; এব—অবশ্যই: চ–ও; নির্মম:- মমতাশূন্য, নিরহঙ্কারঃ — অহঙ্কার রহিত; সম—সমভাবাপন্ন; দুঃখ–দুঃখে; সুখঃ-সুখে; ক্ষমী — ক্ষমাশীল; সন্তুষ্টঃ — পরিতুষ্ট, সততম্—সর্বদা, যোগী — ভক্তিযোগে যুক্ত; যতাত্মা – সংযত স্বভাব, দৃঢ়নিশ্চয়ঃ—দৃঢ় সংকল্পযুক্ত; ময়ি —আমাতে; অর্পিত–অর্পিত, মনঃ —মন; বুদ্ধিঃ বুদ্ধি; যঃ– যিনি, মস্তকঃ – আমার ভক্ত; সঃ—তিনি, মে – আমার; প্রিয়ঃ- প্রিয়।

গীতার গান

আমার যে ভক্ত সর্বগুণের আধার ।

সকলের মিত্র হয় হিংসা নাহি তার ॥

ভক্ত নহে, হিংসার পাত্র ভক্ত সে করুণ ৷

জীবের দুর্দশা হেরি সদা দুঃখী মন ৷৷

দেহে আত্ম বুদ্ধি ভ্ৰম ভক্তের সে নাই ।

নির্মমোনিরহঙ্কার দুঃখের বালাই ।।

সর্বত সন্তুষ্ট যোগী সে দৃঢ় নিশ্চয় ৷

যত্নশীল নিজ কার্যে আমাতে বিলয় ৷।

তার কার্য মন প্রাণ আমাতে নিযুক্ত ।

আমার সে প্রিয় ভক্ত সর্বদাই মুক্ত ৷।

অনুবাদঃ যিনি সমস্ত জীবের প্রতি দ্বেষশূন্য, বন্ধুভাবাপন্ন, কৃপালু, মমতবুদ্ধিশূন্য, নিরহঙ্কার, সুখে ও দুঃখে সমভাবাপন্ন, ক্ষমাশীল, সর্বদা সন্তুষ্ট, সর্বদা ভক্তিযোগে যুক্ত, সংযত স্বভাব, দৃঢ় সংকল্পযুক্ত এবং যাঁর মন ও বুদ্ধি সর্বদা আমাতে অর্পিত, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত ।

তাৎপর্যঃ শুদ্ধ ভক্তির বর্ণনার পর, এই শোক দুটিতে ভগবান আবার শুদ্ধ ভক্তের অপ্রাকৃত গুণাবলীর বর্ণনা করেছেন। শুদ্ধ ভক্ত কোন অবস্থাতেই বিচলিত হন না। তিনি কারও প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ নন, এমন কি তিনি তাঁর শত্রুর প্রতিও শত্রুতা করেন না; তিনি মনে করেন, “আমার পূর্বকৃত কর্মের দোষে এই লোকটি আমার প্রতি শত্রুবৎ আচরণ করছে। তাই, কোন রকম প্রতিবাদ না করে নীরবে সেই কষ্ট সহ্য করাই শ্রেয়।” শ্রীমদ্ভাগবতে (১০/১৪/৮) বলা হয়েছে—ততেহনুকম্পাং সূসমীক্ষমাণা ভুঞ্জান এবাত্মকৃতং বিপাকম্। ভক্ত যখনই কোন দুঃখকষ্ট ভোগ করেন, তখন তিনি মনে করেন যে, এটি তার প্রতি ভগবানেরই কৃপা। তিনি মনে করেন, “আমার পূর্বকৃত অপকর্মের ফলস্বরূপ আমার দুঃখের বোঝা আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবানের কৃপার ফলে আমার সেই দুঃখের ভার লাঘব হয়ে গেছে। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের কৃপায় আমি কেবল অল্প একটু কষ্ট পাচ্ছি।” তাই, নানা দুঃখ-দুর্দশা সত্ত্বেও তিনি সর্বদাই শান্ত নীরব ও সহনশীল। ভগবদ্ভক্ত সকলের প্রতি করুণা প্রদর্শন করেন, এমন কি তাঁর শত্রুর প্রতিও। নির্মম বলতে বোঝায় যে, ভক্ত দেহ সম্পর্কিত দুঃখ-যন্ত্রণাকে তত গুরুত্ব দেন না, কারণ তিনি ভালভাবে জানেন যে, জড় দেহটি তিনি নন। তিনি তাঁর জড় দেহটিকে তাঁর স্বরূপ বলে মোটেই মনে করেন না। তাই, তিনি সর্বতোভাবে অহঙ্কারমুক্ত এবং দুঃখ ও সুখ উভয় অবস্থাতেই সমভাবাপন্ন। তিনি সহিষ্ণু এবং পরমেশ্বর ভগবানের কৃপায় তিনি যা পান, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন। অত্যধিক কষ্ট স্বীকার করে কোন কিছু পাওয়ার জন্য তিনি অধিক প্রয়াস করেন না। তাই তিনি সর্বদাই উৎফুল্ল। তিনিই হচ্ছেন যথার্থ যোগী, কারণ তিনি তাঁর গুরুদেবের আদেশ শিরোধার্য করে তা পালন করতে স্থিরসংকল্প এবং যেহেতু তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি সংযত, তাই তিনি দৃঢ়সংকল্প। তিনি কখনই কুতর্কের দ্বারা প্রভাবিত হন না, কারণ ভগবদ্ভক্তির প্রতি তাঁর দৃঢ় নিষ্ঠা থেকে কেউই তাঁকে বিচলিত করতে পারে না। তিনি সর্বতোভাবে সচেতন যে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন শাশ্বত চিরন্তন ভগবান। তাই, কেউ তাঁকে বিচলিত করতে পারে না। তাঁর এই সমস্ত গুণাবলী থাকার জন্য তিনি পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীচরণে নিজের সমস্ত মন ও বুদ্ধি সর্বতোভাবে অর্পণ করতে পারেন। এই প্রকার উন্নতমানের ভগবদ্ভক্তি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুর্লভ। কিন্তু ভগবদ্ভক্ত ভক্তিযোগের বিধি-নিষেধ পালন করে সেই স্তরে অধিষ্ঠিত হন। অধিকন্তু, ভগবান বলেছেন যে, এই ধরনের ভক্ত তাঁর অতি প্রিয়, কারণ পূর্ণ কৃষ্ণভাবনাময় তাঁর সমস্ত কার্যকলাপের প্রতি ভগবান সর্বদাই সন্তুষ্ট।

শ্লোকঃ ১৫

যস্মান্নোদ্বিজতে লোকো লোকান্নোদ্বিজতে চ যঃ ।

হর্ষামর্ষভয়োদ্বেগৈর্মুক্তো যঃ স চ মে প্রিয়ঃ ॥ ১৫ ॥

যস্মাৎ—যাঁর থেকে; ন–না; উদ্ভিজতে — উদ্বেগ প্রাপ্ত হয়; লোকঃ- লোক; লোকাৎ—লোক থেকে, ন–না, উদ্বিজতে উদ্বেগ প্রাপ্ত হন; চ– :– – যিনি; হর্ষ – হর্ষ, অম— ক্রোধ; ভয় – ভয়; উদ্বেগৈঃ — উদ্বেগ থেকে; মুক্তঃ — মুক্ত; যঃ —যিনি: সঃ—তিনি; চ–ও; মে – আমার, প্রিয়ঃ— অত্যন্ত প্রিয়।

গীতার গান

তার দ্বারা কোন লোক দুঃখ নাহি পায় ।

কাহাকেও মনে প্রাণে দুঃখ নাহি দেয় ॥

হর্ষামষভয়োদ্বেগ এসবে সে মুক্ত ।

অতএব মোর ভক্ত অতি প্রিয়যুক্ত ॥

অনুবাদঃ যাঁর থেকে কেউ উদ্বেগ প্রাপ্ত হয় না। যিনি কারও দ্বারা উদ্বেগ প্রাপ্ত হন না এবং যিনি হর্ষ, ক্রোধ, ভয় ও উদ্বেগ থেকে মুক্ত, তিনি আমার অত্যন্ত প্রিয়।

তাৎপর্যঃ ভক্তের আরও কয়েকটি গুণের কথা এখানে বর্ণনা করা হচ্ছে। ভক্ত কখনই কারও দুঃখ, উৎকণ্ঠা, ভয় অথবা অসন্তোষের কারণ হন না। যেহেতু ভক্ত সকলের প্রতিই কৃপা পরায়ণ, তাই তিনি কখনই এমন কোন কাজ করেন না, যার ফলে কারও উদ্বেগের সৃষ্টি হতে পারে। তেমনই, কেউ যদি ভক্তকে উৎকণ্ঠিত করতে চায়, তাতে তিনি কোন মতেই বিচলিত হন না। ভগবানেরই কৃপার ফলে তিনি এমনভাবে অভ্যস্ত যে, কোন রকম বাহ্যিক গোলযোগের দ্বারা তিনি বিচলিত হন না। প্রকৃতপক্ষে, ভক্ত যেহেতু সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত এবং শ্রীকৃষ্ণের ভাবনায় মগ্ন থাকেন, তাই জড় জগতের কোন অবস্থাই তাঁকে বিচলিত করতে পারে না। বৈষয়িক মানুষ সাধারণত ইন্দ্রিয়সুখ ও দেহসুখের সম্ভাবনায় অত্যন্ত আনন্দিত হন, কিন্তু তিনি যখন দেখেন যে, অন্যের কাছে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের এমন সমস্ত সামগ্রী রয়েছে, তা তাঁর কাছে নেই, তখন তিনি খুব বিমর্ষ হন এবং পরশ্রীকাতর হয়ে ওঠেন। যখন তিনি দেখেন তাঁর শত্রুর আক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে, তখন তিনি ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং তাঁর জীবনে যখন ব্যর্থতা আসে, তখন তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু কৃষ্ণভুক্ত সর্বদাই এই সমস্ত উপদ্রব থেকে মুক্ত, তাই তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয়।

error: Content is protected !!