শ্লোকঃ ৯
অথ চিত্তং সমাধাতুং ন শক্লোষি ময়ি স্থিরম্ ।
অভ্যাসযোগেন ততো মামিচ্ছাপ্তুং ধনঞ্জয় ॥ ৯॥
অর্থ—আর যদি; চিত্তম্মন; সমাধাতু — স্থাপন করতে, ন–না; শক্লোযি- সক্ষম হও, ময়ি—আমাতে; স্থিরম্ — স্থিরভাবে, অভ্যাস—অভ্যাস, যোগেন — যোগের দ্বারা ততঃ—তা হলে; মাম্—আমাকে, ‘ইচ্ছা—ইচ্ছা কর; আপ্তম্—প্রাপ্ত হতে; ধনঞ্জয়— হে অর্জুন।
গীতার গান
যদি সে সহজভাবে হও অসমর্থ ।
অভ্যাস যোগেতে কর লাভ পরমাত্র ।।
বিধিমার্গে রাগমার্গে যেবা মোরে চায় ৷
অচিরাৎ সে অভ্যাসে লোক মোরে পায় ৷।
অনুবাদঃ হে ধনঞ্জয় ! যদি তুমি স্থিরভাবে আমাতে চিত্ত সমাহিত করতে সক্ষম না হও, তা হলে অভ্যাস যোগের দ্বারা আমাকে প্রাপ্ত হতে ইচ্ছা কর।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে ভক্তিযোগের দুটি ক্রমোন্নতির কথা বলা হয়েছে। তার প্রথমটি তাঁদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যাঁরা অপ্রাকৃত প্রেমে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরক্ত হয়েছেন। আর অপরটি হচ্ছে যাঁরা অপ্রকৃত প্রেমে ভগবানের প্রতি আসক্ত হতে পারেননি। এই দ্বিতীয় স্তরের ভক্তদের জন্য নানা রকম বিধি-নিষেধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা অনুশীলন করার ফলে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আসক্তির স্তরে উন্নীত হওয়া যায়।
ভক্তিযোগ হচ্ছে ইন্দ্রিয়গুলিকে নির্মল করার পন্থা। ভবসংসারে বর্তমান সময়ে ইন্দ্রিয়তর্পণে নিরত থাকার ফলে মায়াবদ্ধ জীবের ইন্দ্রিয়গুলি সর্বদা কলুষিত হয়ে থাকে। কিন্তু ভক্তিযোগ অনুশীলন করার ফলে এই সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলি নির্মল হতে থাকে এবং অবশেষে তা যখন পূর্ণরূপে নির্মল হয়, তখন তারা সরাসরিভাবে পরমেশ্বর ভগবানের সংস্পর্শে আসে। মায়াবদ্ধ বিষয়াসক্ত জীবনে আমি কোন না কোন মালিকের চাকরি করতে পারি, কিন্তু সেই দাসত্ব ভালবাসার নয়। আমি কেবল মাত্র কিছু টাকা পাওয়ার জন্য সেই চাকরি করি এবং সেই মালিকও আমাকে ভালবাসে না, আমার কাছ থেকে কাজ আদায় করে আমাকে মাহিনা দেয়। সুতরাং, সেখানে ভালবাসার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। কিন্তু পারমার্থিক জীবনের চরম পরিণতি হচ্ছে সেই নির্মল দিব্য প্রেমের স্তরে উন্নীত হওয়া। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি দিয়ে ভগবানের সেবা করার মাধ্যমেই সেই প্রেমভক্তির স্তর লাভ করা যায়।
সকলের হৃদয়ে এই ভগবৎ-প্রেম সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে এবং সেখানে ভগবৎ- প্রেম বিভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়, কিন্তু জড়-জাগতিক সঙ্গের প্রভাবে তা কলুষিত। এখন জড় বিষয়ের প্রভাব থেকে আমাদের হৃদয়কে নির্মল করতে হবে এবং তা হলে যে কৃষ্ণপ্রেম আমাদের হৃদয়ে সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, তা পুনরুজ্জীবিত হবে। সেটিই হচ্ছে ভক্তিযোগের পূর্ণ পন্থা।
ভক্তিযোগ অনুশীলন করতে হলে সদ্গুরুর তত্ত্বাবধানে কতকগুলি বিধিবিধান পালন করা কর্তব্য—খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা, স্নান করে মন্দিরে গিয়ে আরতি করা, হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করা, তারপর ফুল তুলে ভগবানের শ্রীচরণে তা নিবেদন করা, ভোগ রান্না করে তা ভগবানকে নিবেদন করা, প্রসাদ গ্রহণ করা ইত্যাদি। নানা রকমের বিধিনিয়ম আছে যেগুলি অনুশীলন করতে হয়। আর নিরন্তর শুদ্ধ ভক্তের কাছ থেকে শ্রীমদ্ভাগবত ও ভগবদ্গীতা শ্রবণ করতে হয়। এই পন্থা অনুশীলন করার ফলে যে কেউ প্রেমভক্তির স্তরে উন্নীত হতে পারে এবং তার ফলে অবশ্যই চিন্ময় ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করতে পারা যায়। সদ্গুরুর তত্ত্বাবধানে বিধিবদ্ধভাবে ভক্তিযোগ অনুশীলন করলে অবশ্যই ভগবৎ-প্রেম লাভ করা যায়।
শ্লোকঃ ১০
অভ্যাসেঽপ্যসমর্থোহসি মৎকর্মপরমো ভব ।
মদর্থমপি কর্মাণি কুর্বন্ সিদ্ধিমবাপ্স্যসি ॥ ১০॥
অভ্যাসে—অভ্যাস করতে; অপি—এমন কি যদি; অসমর্থঃ –অসমর্থ, অসি—হও; মৎকর্ম আমার কর্ম, পরমঃ – পরায়ণ, ভব—হও; মদর্থম্ — আমার জন্য; অগি— ও; কর্মাণি—কর্ম: কুর্বন্—করে; সিদ্ধিম্ — সিদ্ধি; অবাশ্যসি – লাভ করবে।
গীতার গান
অভ্যাসেও অসমর্থ যদি তুমি হও ।
আমার লাগিয়া কর্মে সদাযুক্ত রও ॥
আমার সন্তোষ জন্য যেবা কার্য হয় ।
জানিও সেসব মোরে প্রাপ্তির উপায় ॥
অনুবাদঃ যদি তুমি এমন কি অভ্যাস করতেও অসমর্থ হও, তা হলে আমার প্রতি কর্ম পরায়ণ হও। আমার জন্য কর্ম করেও তুমি সিদ্ধি লাভ করবে।
তাৎপর্যঃ যিনি সদগুরুর তত্ত্বাবধানে বৈধীভক্তি অনুশীলন করতে সমর্থ নন, তিনি কেবল মাত্র ভগবানের জন্য কর্ম করার মাধ্যমে সিদ্ধি লাভ করতে পারেন। এই কর্ম কিভাবে সাধন করা যায়, তা ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায়ের ৫৫তম শ্লোকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারে সকলকেই সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত। বছ ভক্ত কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারে নিযুক্ত আছেন এবং তারা নানা রকম সাহায্যের আবশ্যকতা বোধ করে থাকেন। সুতরাং, কেউ যদি সরাসরিভাবে ভক্তিযোগের বিধি-নিয়মগুলি পালন না করতে পারেন, তিনি অদ্ভুত ভগবানের বাণী প্রচারে সহায়তা করতে পারেন। প্রতিটি প্রচেষ্টাতেই জায়গা-জমি, অর্থ, সংগঠন ও শ্রমের প্রয়োজন হয়। ঠিক যেমন ব্যবসা করবার জন্য জায়গার দরকার হয়, মূলধনের প্রয়োজন হয়, শ্রমের প্রয়োজন হয় এবং তা প্রসারের জন্য সংগঠনের প্রয়োজন হয়, তেমনই শ্রীকৃষ্ণের সেবাতেও এগুলির প্রয়োজন আছে। পার্থক্যটি হচ্ছে যে, বৈষয়িক কর্মগুলি সাধিত হয় কেবল ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য, কিন্তু সেই একই কর্ম যখন শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য অনুষ্ঠিত হয়, তখন তা পারমার্থিক কর্মে পরিণত হয়। যদি কারও যথেষ্ট টাকা থাকে, তা হলে তিনি কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের জন্য মন্দির অথবা অফিস তৈরি করতে সাহায্য করতে পারেন। কিংবা তিনি গ্রন্থাদি প্রকাশনায় সাহায্য করতে পারেন। ভগবানের সেবার জন্য নানা রকম কাজ করবার সুযোগ রয়েছে, তবে সেই কাজগুলি করতে উৎসাহী হতে হবে। কেউ যদি তার কর্মের ফল সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ না করতে পারেন, তা হলেও তিনি অন্তত তার কিছু অংশ ভগবানের বাণী প্রচারের কাজে দান করতে পারেন। ভগবানের বাণী বা কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের কাজে স্বেচ্ছাকৃতভাবে সেবা করার ফলে ক্রমান্বয়ে ভগবৎ-প্রেমের উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হওয়া যায়, যার ফলে জীবনের পূর্ণতা প্রাপ্তি হয়।
শ্লোকঃ ১১
অথৈত দপ্যশক্তোহসি কর্তুং মদযোগমাশ্রিতঃ।
সর্বকর্মফলত্যাগং ততঃ কুরু যাত্মবান্ ॥ ১১॥
অথ—আর যদি এতং—এই অর্পি—ও; অশক্তঃ – অক্ষম, অসিহত, কর্তম— করতে; যৎ—আমাতে, যোগম্—সর্বকর্ম অর্পণরূপ যোগ; আশ্রিতঃ– আশ্রয় করে, সর্বকর্ম— সমস্ত কর্মের ফল – ফল, ত্যাগম্— ত্যাগ; ততঃ– তবে, কুরু—কর, যতাত্মবান্—সংযতচিত্তে।
গীতার গান
তাহাতেও যদি তব শক্তির অভাব ।
ভক্তিযোগ আশ্রয়েতে বিরুদ্ধ স্বভাব ॥
তবে সে বৈদিক কর্ম ত্যজি কর্মফল ।
অবশ্য সাধিবে তুমি যত্নেতে প্রবল ॥
অনুবাদঃ আর যদি তাও করতে অক্ষম হও, তবে আমাতে সমস্ত কর্ম অর্পণ করে সংযতচিত্তে কর্মের ফল ত্যাগ কর।
তাৎপর্যঃ এমনও হতে পারে যে, সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় অথবা অন্য কোন রকম প্রতিবন্ধকের ফলে কেউ কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের কাজে সহায়তা করতে অসমর্থ। এমনও হতে পারে যে, সরাসরিভাবে কেউ যদি কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের কাজে যুক্ত হন, তা হলে তাঁর পরিবারের কাছ থেকে নানা রকম ওজর আপত্তি আসতে পারে অথবা নানা রকমের বাধাবিপত্তিও দেখা দিতে পারে। কারও যদিও এই রকমের সমস্যা থাকে, তাঁর প্রতি উপদেশ দেওয়া হচ্ছে যে, তার কর্মের সঞ্চিত ফল কোন সৎ উদ্দেশ্যে তিনি অর্পণ করতে পারেন। বৈদিক শাস্ত্রে এই ধরনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেখানে নানা রকম যজ্ঞবিধির বর্ণনা করা হয়েছে এবং সেখানে বিশেষ পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠানের উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে পূর্বকৃত কর্মের ফল অর্পণ করা যায়। এভাবেই ধীরে ধীরে দিব্যজ্ঞান লাভের স্তরে উন্নীত হওয়া যায়। অনেক সময় দেখা যায় যে, কৃষ্ণভাবনাময় কার্যকলাপে নিরুৎসাহী লোকেরা হাসপাতাল অথবা অন্য কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের জন্য দান করে থাকেন। এভাবেই তাঁরা বহু কষ্টে উপার্জিত অর্থ দান করার মাধ্যমে তাঁদের কর্মের ফল দান করে থাকেন। এই পন্থাকেও এখানে অনুমোদন করা হয়েছে, কারণ এভাবেই কর্মফল দান করার মাধ্যমে চিত্ত ক্রমশ নির্মল হতে থাকে এবং চিত্ত নির্মল হলে কৃষ্ণভাবনার অমৃত উপলব্ধি করা যায়। কৃষ্ণভাবনামৃত অবশ্য অন্য কোন প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল নয়। কারণ কৃষ্ণভাবনামৃতই চিত্তকে নির্মূল করতে পারে। কিন্তু কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণের পথে যদি কোন প্রতিবন্ধক দেখা দেয়, তা হলে কর্মফল ত্যাগ করার পন্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। সেই সূত্রে সমাজসেবা, সম্প্রদায়- সেবা, জাতির সেবা, দেশের জন্য ত্যাগধর্ম আদি গ্রহণ করা যেতে পারে, যাতে এভাবেই কর্মফল ত্যাগ করার পরিণামে কোন এক সময়ে শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তির স্তরে উন্নীত হওয়া যেতে পারে। ভগবদ্গীতায় (১৮/৪৬) বলা হয়েছে, যতঃ প্রবৃত্তির্ভূতানাম্—কেউ যদি সর্ব কারণের পরম কারণ যে শ্রীকৃষ্ণ তা উপলব্ধি না করে, পরম কারণের উদ্দেশ্যে কোন কিছু অর্পণ করতে মনস্থ করে থাকেন, তা হলে সেই কর্ম অর্পণের মাধ্যমে তিনি ধীরে ধীরে এক সময় জানতে পারবেন যে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সর্ব কারণের পরম কারণ।