শ্লোকঃ ৫
ক্লেশোঽধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্ ।
অব্যক্তা হি গতিদুঃখং দেহৰম্ভিরবাপ্যতে ।। ৫ ।।
ক্লেশঃ– ক্লেশ, অধিকতরঃ – অধিকতর তেষাম্ — তাদের; অব্যক্ত – অব্যক্ত; আসক্ত — আসক্ত, চেতসাম্—যাদের মন; অব্যক্তা — অব্যক্ত, হি— অবশ্যই, গতিঃ- গতি; দুঃখম্ — দুঃখময়; দেহবডিঃ— দেহাভিমানী জীব দ্বারা; অবাপাতে—লাভ হয়।
গীতার গান
কিন্তু এইমাত্র ভেদ জান উভয়ের মধ্যে।
ভক্ত পায় অতি শীঘ্র আর কষ্টে সিদ্ধ ।।
অব্যক্ত আসক্ত সেই বহু ক্লেশ তার ।
অব্যক্ত যে গতি দুঃখ দেহীর অপার ।।
অনুবাদঃ যাদের মন ভগবানের অব্যক্ত নির্বিশেষ রূপের প্রতি আসক্ত, তাদের ক্লেশ অধিকতর। কারণ, অব্যক্তের উপাসনার ফলে দেহধারী জীবদের কেবল দুঃখই লাভ হয়।
তাৎপর্যঃ যে সমস্ত অধ্যাত্মবাদীরা ভগবানের অচিন্তা, অব্যক্ত ও নির্বিশেষ তত্ত্ব জানবার প্রয়াসী, তাদের বলা হ: জ্ঞানযোগী এবং যাঁরা সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ভক্তিযুক্ত চিত্তে ভগবানের সেবা করেন, তাঁদের বলা হয় ভক্তিযোগী। এখন, এখানে জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের মধ্যে যে পার্থক্য তা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। জ্ঞানযোগের পন্থা যদিও পরিণামে একই লক্ষ্যে গিয়ে উপনীত হয়, তবুও তা অত্যন্ত ক্লেশসাপেক্ষ। কিন্তু ভক্তিযোগের পন্থা, সরাসরিভাবে ভগবানের সেবা করার যে পন্থা, তা অত্যন্ত সহজ এবং তা হচ্ছে দেহধারী জীবের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। অনাদিকাল ধরে আত্মা দেহের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। সে যে তার দেহ নয়, সেই ধারণা করাও তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। তাই, ভক্তিযোগী গ্রীকৃষ্ণের অর্চা- বিগ্রহের অর্চনা করার পন্থা অবলম্বন করেন, কারণ তাতে একটি সবিশেষ রূপের ধারণা মনের মধ্যে বদ্ধমূল হয়। আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, মন্দিরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অর্চা-বিগ্রহের যে পূজা, তা মূর্তিপূজা নয়। বৈদিক শাসে সগুণ ও নির্গুণ উপাসনার উল্লেখ পাওয়া যায়। মন্দিরে ভগবানের জীনিগ্রহের যে উপাসনা তা সদ্গুণ উপাসনা, কেন না জড় গুণাবলীর দ্বারা ভগবান প্রকাশিত হয়েছেন। কিন্তু ভগবানের রূপ যদিও পাথর, কাঠ অথবা তৈলচিত্র আদি জড় গুণের দ্বারা প্রকাশিত হয়, প্রকৃতপক্ষে তা জড় নয়। সেটিই হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের অপ্রাকৃত তত্ব।
সেই সম্বন্ধে একটি স্কুল উদাহরণ এখানে দেওয়া যায়। যেমন, রাস্তার পাশে আমরা ডাকবাক্স দেখতে পাই এবং সেই বাক্সে আমরা যদি চিঠিপত্র ফেলি, তা হলে সেগুলি স্বাভাবিকভাবে তাদের গন্তব্যস্থলে অনায়াসে পৌঁছে যাবে। কি যে কোন একটি পুরানো বাক্সে অথবা ডাকবাক্সের অনুকরণে তৈরি কোন বাক্স, যা পোস্ট অফিসের অনুমোদিত নয়, তাতে চিঠি ফেললে কোন কাজ হবে না। তেমনই, মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত ভগবানের শ্রীমূর্তি হচ্ছেন ভগবানের অনুমোদিত প্রতিনিধি, যাকে বলা হয় অর্চাবিগ্রহ। এই অর্চাবিগ্রহ হচ্ছেন ভগবানের অবতার। ভগবান সেই রূপের মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করেন। ভগবান সর্বশক্তিমান, তাই তিনি তাঁর অর্চা-বিগ্রহরূপ অবতারের মাধ্যমে তাঁর ভক্তের সেবা গ্রহণ করতে পারেন। জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ মানুষদের সুবিধার জন্য তিনি এই বন্দোবস্ত করে রেখেছেন।
সুতরাং, ভক্তের পক্ষে সরাসরিভাবে অনতিবিলম্বে ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করতে কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু যাঁরা অধ্যাত্ম উপলব্ধির নির্বিশেষবাদের পন্থা অবলম্বন করেন, তাঁদের সেই পথ অত্যন্ত কষ্টসাপেক্ষ। তাদের উপনিষদ আদি বৈদিক গ্রন্থের মাধ্যমে পরমেশ্বরের অব্যক্ত রূপ উপলব্ধি করতে হয়, তাদের সেই ভাষা শিক্ষা করতে হয়, অতীন্দ্রিয় অনুভুতিগুলি উপলব্ধি করতে হয় এবং এই সবগুলিই সমাভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হয়। কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে এই পন্থা অবলম্বন করা খুব সহজ নয়। কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত যে মানুষ সদৃশুরুর দ্বারা পরিচালিত হয়ে ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করছেন, তিনি কেবলমাত্র ভক্তিভরে ভগবানের শ্রীবিগ্রহকে প্রণাম করে, ভগবানের লীলা শ্রবণ করে এবং ভগবানকে নিবেদিত প্রসাদ গ্রহণ করে অনায়াসে পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে উপলব্ধি করতে পারেন। নির্বিশেষবাদীরা যে অনর্থক ক্লেশদায়ক পন্থা অবলম্বন করেন, তাতে পরিণামে যে তাঁদের পরম তত্ত্বের চরম উপলব্ধি না-ও হতে পারে, সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সবিশেষবাদীরা কোন রকম বিপদের ঝুঁকি না নিয়ে, কোন রকম ক্লেশ অথবা দুঃখ স্বীকার না করে পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীচরণারবিন্দের সান্নিধ্য লাভ করেন। শ্রীমদ্ভাগবতে এই ধরনের একটি শ্লোক আছে, তাতে বলা হয়েছে যে, পরম পুরুষোত্তম ভগবানের শ্রীচরণে আত্মনিবেদন করাই যদি পরম উদ্দেশ্য হয় (এই আত্মনিবেদনের পন্থাকে বলা হয় ভক্তি), তা হলে তা না করে কোটি ব্রহ্ম আর কোটি ব্রহ্ম নয়, এই তত্ত্ব জানবার জন্য গারাটি জীবন নষ্ট করলে তার ফল অবশ্যই ক্লেশদায়ক হয়। তাই, অধ্যাত্ম উপলব্ধির এই ক্লেশদায়ক পন্থা গ্রহণ না করতে এখানে উপদেশ দেওয়া হয়েছে, কারণ তার পরিণতি অনিশ্চিত।
জীব হচ্ছে নিত্য, স্বতন্ত্র আত্মা এবং সে যদি ব্রহ্মে লীন হয়ে যেতে চায়, তা হলে সে তার স্বরূপের সৎ ও চিৎ প্রবৃত্তির উপলব্ধি করতে পারে, কিন্তু আনন্দময় প্রবৃত্তির উপলব্ধি হয় না। জ্ঞানযোগের পথে বিশেষভাবে অগ্রণী এই প্রকার অধ্যাত্মবিৎ কোন ভক্তের কৃপায় ভক্তিযোগের পথে আসতে পারেন। সেই সময়, নির্বিশেষবাদের দীর্ঘ সাধনা তার ভক্তিযোগের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তিনি তখন তাঁর পূর্বার্জিত ধারণাগুলি ত্যাগ করতে পারেন না। তাই, দেহধারী জীবের পক্ষে নির্বিশেষ ব্রহ্মের উপাসনা সর্ব অবস্থাতেই ক্লেশদায়ক, তার অনুশীলন ক্লেশদায়ক এবং তার উপলব্ধিও ক্লেশদায়ক। প্রতিটি জীবেরই আংশিক স্বাতন্ত্র্য্য আছে এবং আমাদের নিশ্চিতভাবে জানা উচিত যে, এই নির্বিশেষ ব্রহ্ম-উপলব্ধি আমাদের চিন্ময় সত্তার আনন্দময় প্রবৃত্তির বিরোধী। এই পন্থা গ্রহণ করা উচিত নয়। কারণ প্রতিটি স্বতন্ত্র জীবের পক্ষে কৃষ্ণভাবনাময় পন্থা, যার ফলে সে সর্বতোভাবে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত হতে পারে, সেটিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পন্থা। এই ভগবদ্ভক্তিকে যদি কেউ অবহেলা করে, তা হলে তার ভগবৎ-বিমুখ নাস্তিকে পরিণত হবার সম্ভাবনা থাকে। অতএব অব্যক্ত, অচিন্তা, ইন্দ্রিয়ানুভূতির ঊর্ধ্বে মনযে তাম্বের কথা এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে, সেই নির্বিশেষ ব্রহ্ম-উপলব্ধির প্রতি, বিশেষ করে এই কলিযুগে আকৃষ্ট হওয়া উচিত নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তা করতে নিষেধ করছেন।
শ্লোকঃ ৬-৭
যে তু সর্বাণি কর্মাণি ময়ি সংন্যস্য মৎপরাঃ ।
অনন্যেনৈব যোগেন মাং ধ্যায়ন্ত উপাসতে ।৷ ৬ ।৷
তেষামহ্ং সমুদ্ধর্তা মৃত্যুসংসারসাগরাৎ ।
ভবামি ন চিরাৎ পার্থ ময্যাবেশিতচেতসাম ॥ ৭ ॥
কর্মাণি – কর্ম, মরি—আমাতে, সংলাস্য-যে—যাঁরা, তু—কিন্তু; সর্বাণি — সমস্ত; ত্যাগ করে; মৎপরাঃ- মপরায়ণ হয়ে; অনন্যেন— অবিচলিতভাবে এব—অবশ্যই যোগেন—ভক্তিযোগ দ্বারা; মাম্ – আমাকে; ধ্যায়ঃ- ধ্যান করে। উপাসতে- উপাসনা করেন; তেষাম্—তাঁদের: অহম্—আমি: সমুদ্ধর্তা উদ্ধারকারী মৃত্যু- মৃত্যুর; সংসার—সংসার; সাগরাৎ— সাগর থেকে, ভবামি হই ন চিরাৎ অচিরেই পার্থ—হে পৃথাপুত্ৰ, ময়ি —আমাতে, আবেশিত — আবিষ্ট, চেতসাম্—চি ।
গীতার গান
যে আমার সম্বন্ধেতে সব কর্ম করে ।
আমার স্বরূপ এই নিত্য ধ্যান করে ॥
জীবন যে মোরে সঁপি আমাতে আসত ।
অনন্য যে ভাব ভক্তি তাহে অনুরক্ত ॥
সে ভক্তকে মৃত্যুরূপ এ সংসার হতে ।
উদ্ধার করিব শীঘ্র জান ভাল মতে ॥
অনুবাদঃ যারা সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পণ করে, মৎপরায়ণ হয়ে অনন্য ভক্তিযোগের দ্বারা আমার ধ্যান করে উপাসনা করেন, হে পার্থ! আমাতে আবিষ্টচিত্ত সেই সম ভক্তদের আমি মৃত্যুময় সংসার-সাগর থেকে অচিরেই উদ্ধার করি।
তাৎপর্যঃ এখানে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, ভগবস্তুতেরা অত্যন্ত ভাগ্যবান, কেন না ভগবানের কৃপায় তাঁর অনায়াসে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করেন। শুদ্ধ ভক্তির প্রভাবে ভক্ত উপলব্ধি করতে পারেন যে, ভগবান হচ্ছেন মহান এবং প্রতিটি স্বতন্ত্র জীবাত্মাই হচ্ছে তাঁর অধীন। প্রতিটি জীবের কর্তব্য ভগবানের সেবা করা, কিন্তু সে যদি তা না করে, তা হলে তাকে মায়ার দাসত্ব করতে হয়।
পূর্বে বলা হয়েছে, কেবলমাত্র ভক্তিযুক্ত সেবার মাধ্যমেই পরমেশ্বর ভগবানকে হৃদয়ঙ্গম করা যায়। তাই আমাদের পূর্ণরূপে আত্মোৎসর্গ করতে হবে। শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মে আশ্রয় লাভ করতে হলে আমাদের মনকে সর্বতোভাবে শ্রীকৃষ্ণে নিবদ্ধ করতে হবে। কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণের জন্য আমাদের সমস্ত কর্ম করতে হবে। যে কাজকর্মই আমরা করি না কেন তাতে কিছু যায় আসে না, কিন্তু সেই কাজ কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণের জন্যই করা উচিত। সেটিই হচ্ছে ভক্তিযোগের মানদণ্ড। পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সন্তোষ বিধান করা ছাড়া ভক্ত আর কিছুই কামনা করেন না। তাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য শ্রীকৃষ্ণকে আনন্দ দান করা এবং সেই জন্য তিনি সব কিছু ত্যাগ করতে পারেন— যেমনটি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন করেছিলেন। এই পন্থাটি অত্যন্ত সরল। আমরা আমাদের বৃত্তিগত কাজকর্ম করে যেতে পারি এবং সেই সঙ্গে হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে / হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে—এই মহামন্ত্র কীর্তন করতে পারি। এই অপ্রাকৃত কীর্তন ভক্তকে পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি আকৃষ্ট করে।
ভগবান এখানে প্রতিজ্ঞা করছেন যে, যে শুদ্ধ ভক্ত এভাবেই তাঁর সেবায় নিযুক্ত হয়েছেন, তাঁকে তিনি অচিরেই ভবসমুদ্র থেকে উদ্ধার করবেন। যাঁরা যোগসিদ্ধি লাভ করেছো, তাঁরা ইচ্ছা অনুসারে তাঁদের ঈন্সিত লোকে স্থানান্তরিত করতে পারেন এবং অন্যেরা নানাভাবে এই সমস্ত পন্থার সুযোগ নিয়ে থাকেন। কিন্তু ভগবান এখানে স্পষ্টভাবে বলছেন যে, তাঁর ভক্তকে তিনি নিজেই তাঁর কাছে নিয়ে যান। অপ্রাকৃত জগতে প্রবেশ করবার জন্য ভক্তকে নানা রকম সিদ্ধি লাভের অপেক্ষা করতে হয় না। বরাহ পুরাণে বলা হয়েছে–
নয়ামি পরমং স্থানমর্চিরাদিগতিং বিনা ।
গরুড়স্কন্ধমারোপ্য যথেচ্ছমনিবারিতঃ ॥
অর্থাৎ, অপ্রাকৃত লোকে প্রবেশ করবার জন্য ভক্তকে অষ্টাঙ্গ যোগের অনুশীলন করতে হয় না। পরমেশ্বর ভগবান তাঁকে নিজেই অপ্রাকৃত জগতে নিয়ে যান। এখানে তিনি সুস্পষ্টভাবে নিজেকে ত্রাণকর্তা রূপে বর্ণনা করেছেন। শিশুকে যেমন তার বাবা-মা সর্বতোভাবে লালন পালন করেন এবং তার ফলে সে নিরাপদে থাকে, ঠিক তেমনই ভক্তকে যোগানুশীলনের মাধ্যমে অন্যান্য গ্রহলোকে যাবার জন্য কোনও রকম চেষ্টা করার প্রয়োজন হয় না। পক্ষান্তরে, পরমেশ্বর ভগবান তাঁর মহান কৃপাবলে তাঁর বাহন গরুড়ের পিঠে চড়ে তৎক্ষণাৎ তাঁর ভক্তের কাছে উপস্থিত হন এবং তাঁকে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত করেন। মাঝ সমুদ্রে পতিত হয়েছে যে মানুষ, সে যতই দক্ষ সাঁতারু হোক না কেন, শত চেষ্টা করেও সে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। কিন্তু কেউ যদি এসে তাকে সেই সমুদ্র থেকে তুলে নেয়, তা হলে সে অনায়াসেই রক্ষা পেতে পারে। তেমনই, ভগবানও তাঁর ভক্তকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করেন। আমাদের কেবল ভক্তিযুক্ত ভগবৎ-সেবায় নিযুক্ত হয়ে কৃষ্ণভাবনার অতি সরল পন্থা অনুশীলন করতে হবে। যে কোন বুদ্ধিমান মানুষের কর্তব্য অন্য সমস্ত পন্থা পরিত্যাগ করে ভগবদ্ভক্তির এই পন্থাটির প্রতি সর্বদাই অধিক গুরুত্ব প্রদান করা। নারায়ণীয়তে এর যথার্থতা প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে
যা বৈ সাধনসম্পত্তি পুরুষার্থচতুষ্টয়ে ।
তয়া বিনা তদাপ্নোতি নরো নারায়ণাশ্রয়ঃ ॥
এই শ্লোকের তাৎপর্য হচ্ছে যে, সকাম কর্মের বিভিন্ন পন্থায় ব্রতী না হয়ে অথবা মনোধর্ম-প্রসূত জ্ঞানের অনুশীলন না করে, ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করলেই সব রকমের ধর্মাচরণ—দান, ধ্যান, যজ্ঞ, তপশ্চর্যা, যোগ আদির সমস্ত ফল প্রাপ্ত হওয়া যায়। সেটিই হচ্ছে ভক্তিযোগের বিশেষত্ব।
কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণের দিবানাম সমন্বিত মহামন্ত্র— হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে—কীর্তন করার ফলে ভগবদ্ভক্ত অনায়াসে পরম লক্ষ্যে উপনীত হতে পারেন, যা অন্য কোন ধর্ম আচরণের মাধ্যমে প্রাপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। ভগবদ্গীতার উপসংহারে অষ্টাদশ অধ্যায়ে পরম উপদেশ দান করে ভগবান বলেছেন—
সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।
আত্মজ্ঞান লাভের জন্য সমস্ত প্রক্রিয়াগুলি বর্জন করে কেবলমাত্র কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করতে হবে। তা হলেই জীবনের পরম উদ্দেশ্য সাধিত হবে। তখন অতীত জীবনের পাপময় কর্মের জন্য চিন্তা করার কোন প্রয়োজন নেই, কারণ ভগবান আমাদের সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করবেন। সুতরাং, আর অন্য কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আত্মজ্ঞান লাভ করে মুক্তি লাভের ব্যর্থ প্রয়াস করার কোন প্রয়োজন নেই। পরম সর্বশক্তিমান ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দে আশ্রয় গ্রহণ করা সকলেরই কর্তব্য। সেটিই হচ্ছে জীবনের পরম পূর্ণতা।
শ্লোকঃ ৮
ময্যেব মন আধৎস্ব ময়ি বুদ্ধিং নিবেশয় ।
নিবসিষ্যসি ময্যেব অত ঊর্ধ্বং ন সংশয়ঃ ॥ ৮॥
ময়ি —আমাতে; এব—অবশ্যই; মনঃ—মন; আধস্থ — স্থির কর; ময়ি —আমাতে; বুদ্ধিম্ — বুদ্ধি; নিবেশয়— অর্পণ কর, নিবসিষ্যসি – বাস করবে; ময়ি- নিকটে : এর—অবশ্যই; অতঃ ঊর্ধ্বম্—তার ফলে; ন—নেই; সংশয়ঃ—সন্দেহ।
গীতার গান
অতএব তুমি এই দ্বিভুজ স্বরূপে ৷
এ মন বুদ্ধি স্থির কর ভগবৎ স্বরূপে ।।
আমার এ নিত্যরূপে নিত্যযুক্ত হলে ।
অবশ্য পাইবে প্রেম সর্বশ্রেষ্ঠ ফলে ।।
ঊর্ধ্বগতি সেই জান না কর সংশয়।
সর্বোচ্চ ফল তাহা কহিনু নিশ্চয় ৷।
অনুবাদঃ অতএব আমাতেই তুমি মন সমাহিত কর এবং আমাতেই বুদ্ধি অর্পণ কর। তার ফলে ভুমি সর্বদাই আমার নিকটে বাস করবে, সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই।
তাৎপর্যঃ যিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্তিযুক্ত সেবায় রত, তিনি ভগবানের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত হয়ে জীবন ধারণ করেন। তিনি যে প্রথম থেকেই অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত, সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। ভক্ত জড়-জাগতিক স্তরে জীবন যাপন করেন না—তাঁর জীবন কৃষ্ণভাবনাময়। ভগবানের নাম স্বয়ং ভগবান থেকে অভিন্ন। তাই, ভক্ত যখন হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তি ভক্তের জিহ্বায় নর্তন করেন। ভক্ত যখন শ্রীকৃষ্ণকে ভোগ নিবেদন করেন, শ্রীকৃষ্ণ তখন সেই ভোগ সরাসরিভাবে গ্রহণ করেন এবং শ্রীকৃষ্ণের সেই উচ্ছিষ্ট প্রসাদ খেয়ে ভক্ত কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ওঠেন। ভগবানের সেবায় ব্রতী না হলে সেটি যে কি করে সম্ভব হয়, তা বুঝতে পারা যায় না, যদিও ভগবদ্গীতা ও অন্যান্য বৈদিক শাস্ত্রে এই পদ্ধতির বর্ণনা করা হয়েছে।