দ্বাদশ অধ্যায়

ভক্তিযোগ

শ্লোকঃ ১

অর্জুন উবাচ

এবং সততযুক্তা যে ভক্তাস্ত্বাং পর্যুপাসতে ।

যে চাপ্যক্ষরমব্যক্তং তেষাং কে যোগবিত্তমাঃ ।। ১ ।।

অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন, এব— এভাবেই; সতত — সর্বদা, মুক্তাঃ- নিযুক্ত: যে—যে সমস্ত; ভক্তাঃ— ভক্তেরা; ত্বাম্—তোমার; পর্যুপাসতে— যথাযথভাবে আরাধনা করেন; যে—যাঁরা, চ–ও, অপি—পুনরায়, অক্ষরম— ইলিয়াতীত। অব্যক্তম্—অব্যক্ত; তেষাম—তাঁদের মধ্যে; কে কারা, যোগবিত্তমাঃ – যোগীশ্রেষ্ঠ।

গীতার গান

অর্জুন কহিলেনঃ

যে শুদ্ধ ভক্ত সে কৃষ্ণ তোমাতে সতত ।

অনন্য ভক্তির দ্বারা হয়ে থাকে যুক্ত ॥

আর যে অব্যক্তবাদী অব্যক্ত অক্ষরে ।

নিষ্কাম করম করি সদা চিন্তা করে ॥

তার মধ্যে কেবা উত্তম যোগবিৎ হয়।

জানিবার ইচ্ছা মোর করহ নিশ্চয় ॥

অনুবাদঃ অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন—এভাবেই নিরন্তর ভক্তিযুক্ত হয়ে যে সমস্ত ভক্তেরা যথাযথভাবে তোমার আরাধনা করেন এবং যাঁরা ইন্দ্রিয়াতীত অব্যক্ত ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাঁদের মধ্যে কারা শ্রেষ্ঠ যোগী।

তাৎপর্যঃ ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ সবিশেষ তত্ত্ব, নির্বিশেষ-তত্ত্ব ও বিশ্বরূপ-তত্ত্ব সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন এবং সব রকমের ভক্ত ও যোগীদের কথা বর্ণনা করেছেন। সাধারণত, পরমার্থবাদীদের দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। তাঁরা হচ্ছেন নির্বিশেষবাদী ও সবিশেষবাদী। সবিশেষবাদী ভক্তেরা তাঁদের সমস্ত শক্তি দিয়ে ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হন। নির্বিশেষবাদীরা সরাসরিভাবে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিযুক্ত হন না। তাঁরা নির্বিশেষ ব্রহ্ম, যা অব্যক্ত তার ধ্যানে মগ্ন হওয়ার চেষ্টা করেন।

এই অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই যে, পরমতত্ত্ব উপলব্ধি করার যে সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়া আছে, তার মধ্যে ভক্তিযোগই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। যদি কেউ পরমেশ্বর ভগবানের সান্নিধ্য লাভের প্রয়াসী হন, তা হলে তাঁকে ভক্তিযোগের পন্থা অবলম্বন করতেই হবে।

ভক্তিযোগে প্রত্যক্ষভাবে যাঁরা ভগবানের সেবা করেন, তাঁদের বলা হয় সবিশেষবাদী। নির্বিশেষ ব্রহ্মের ধ্যানে যাঁরা নিযুক্ত তাদের বলা হয় নির্বিশেষবাদী। অর্জুন এখানে জিজ্ঞেস করছেন, এদের মধ্যে কোনটি শ্রেয়? পরমতত্ত্ব উপলব্ধি করবার ভিন্ন ভিন্ন পন্থা আছে। কিন্তু এই অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে, ভক্তিযোগ অথবা ভক্তির মাধ্যমে তাঁর সেবা করাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। ভগবানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার এটি হচ্ছে সবচেয়ে সহজ ও প্রত্যক্ষ পন্থা।

ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে ভগবান আমাদের বুঝিয়েছেন যে, জড় দেহটি জীবের স্বরূপ নয়। জীবের স্বরূপ হচ্ছে চিলিঙ্গ । আর পরমতত্ত্ব হচ্ছেন বিভুচৈতন্য। সপ্তম অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ জীবকে ভগবানের বিভিন্ন অংশ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, সেই বিভুচেতনা ভগবানের প্রতি তার চেতনাকে নিবদ্ধ করাই হচ্ছে জীবের ধর্ম। তারপর অষ্টম অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, মৃত্যুর সময় যিনি শ্রীকৃষ্ণকে চিন্তা করেন, তিনি তৎক্ষণাৎ অপ্রাকৃত জগতে শ্রীকৃষ্ণের বামে উত্তীর্ণ হন। আর ষষ্ঠ অধ্যায়ের শেষে ভগবান স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, সমস্ত যোগীদের মধ্যে যিনি তাঁর অন্তরে নিরস্তর শ্রীকৃষ্ণের কথা চিন্তা করেন, তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী। সুতরাং, প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক অধ্যায়ের উপসংহারে বলা হয়েছে যে, সবিশেষ কৃষ্ণরূপের প্রতি সকলের আসত হওয়া উচিত, কেন না সেটিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ পারমার্থিক উপলব্ধি।

তবুও কিছু লোক আছে, যারা শ্রীকৃষ্ণের সবিশেষ রূপের প্রতি আসক্ত নয়। তারা এই বিষয়ে এমনই প্রচণ্ডভাবে আগ্রহহীন যে, ভগবদ্গীতার ভাষা রচনা কালেও তারা পাঠকমহলকে কৃষ্ণবিমুখ করতে চায় এবং নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতির দিকে তাদের সমস্ত ভক্তি পরিচালিত করে থাকে। যে পরমতত্ত্ব অব্যক্ত ও ইন্দ্রিয়াতীত, সেই নির্বিশেষ রূপের ধ্যানে মনোনিবেশ করতেই তারা পছন্দ করে।

বাস্তবিকপক্ষে, পরমার্থবাদীরা দুই রকমের হয়ে থাকেন। এখন অর্জুন জানতে চাইছেন, এই দুই রকমের পরমার্থবাদীদের মধ্যে কোন্ পন্থাটি সহজতর এবং কোনটি শ্রেয়তম। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, তিনি তাঁর নিজের অবস্থাটি বাচাই করে নিচ্ছেন, কারণ তিনি শ্রীকৃষ্ণের সবিশেষ রূপের প্রতি আসক্তযুক্ত। নির্বিশেষ ব্রহ্মের প্রতি তিনি আকৃষ্ট নন। তিনি জানতে চাইছেন যে, তাঁর অবস্থা নিরাপদ কি না । এই জড় জগতেই হোক বা চিৎ-জগতেই হোক, ভগবানের নির্বিশেষ প্রকাশ ধ্যানের পক্ষে একটি সমস্যাস্বরূপ। প্রকৃতপক্ষে, কেউই পরম-তত্ত্বের নির্বিশেষ রূপ সম্বন্ধে যথাযথভাবে চিন্তা করতে পারে না। তাই অর্জুন বলতে চাইছেন, “এভাবে সময় নষ্ট করে কি লাভ?” একাদশ অধ্যায়ে অর্জুন উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, শ্রীকৃষ্ণের সবিশেষ রূপের প্রতি আসক্ত থাকাই হচ্ছে উত্তম, কারণ তা হলে অনায়াসে তাঁর অন্য সমস্ত রূপ সম্বন্ধে অবগত হওয়া যায় এবং তাতে কৃষ্ণপ্রেমে কোন বিঘ্ন ঘটে না। শ্রীকৃষ্ণের কাছে অর্জুনের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তরে ভগবান স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিলেন, পরম-তত্ত্বের নির্বিশেষ ও সবিশেষ ধারণার মধ্যে পার্থক্য কোথায়।

শ্লোকঃ ২

শ্রীভগবানুবাচ

ময্যাবেশ্য মনো যে মাং নিত্যযুক্তা উপাসতে ।

শ্রদ্ধয়া পরয়োপেতাস্তে মে যুক্ততমা মতাঃ ৷৷ ২ ৷৷

শ্রীভগবান্ উবাচ— পরমেশ্বর ভগবান বললেন, ময়ি —আমাতে, আবেশ্য-নির্দিষ্ট করে; মনঃ—মন; যে- যাঁরা, মাম্ আমাকে; নিত্য—সর্বদা; যুক্তাঃ- নিযুক্ত হয়ে উপাসতে—উপাসনা করেন, শ্রদ্ধয়া — শ্রদ্ধা সহকারে, পরয়া অপ্রাকৃত, উপেতাঃ —যুক্ত হয়ে; তে—তাঁরা, যে – আমার; যুক্ততমাঃ— সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী; মতাঃ — মতে।

গীতার গান

শ্রীভগবান কহিলেনঃ

আমার স্বরূপ এই যার মন সদা ।

আবিষ্ট হইয়া থাকে উপাসনা হৃদা ॥

শ্রদ্ধার সহিত করে প্রাণ ভক্তিময় ।

উত্তম যোগীর শ্রেষ্ঠ কহিনু নিশ্চয় ॥

অনুবাদঃ শ্রীভগবান বললেন—যাঁরা তাঁদের মনকে আমার সবিশেষ রূপে নিবিষ্ট করেন এবং অপ্রাকৃত শ্রদ্ধা সহকারে নিরন্তর আমার উপাসনা করেন, আমার মতে তাঁরাই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।

তাৎপর্যঃ অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্টভাবে বলছেন যে, যাঁর মন তাঁর সবিশেষ রূপে আবিষ্ট এবং শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে যিনি তাঁর উপাসনা করেন, তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী। এভাবেই যিনি কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়েছেন, তিনি আর কখনও জাগতিক কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হন না, কারণ শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি সাধনের জন্যই সব কিছু তখন করা হয়। শুদ্ধ ভক্ত সর্বদাই ভগবানের সেবায় যুক্ত। কখনও তিনি ভগবানের নাম কীর্তন করেন, কখনও তিনি ভগবানের কথা শ্রবণ করেন অথবা শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধীয় গ্রন্থ পাঠ করেন, কখনও বা তিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রসাদ রন্ধন করেন, কখনও বা তিনি বাজারে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের জন্য কোন কিছু খরিদ করেন, কখনও তিনি মন্দির অথবা বাসন পরিষ্কার করেন—অর্থাৎ, কৃষ্ণসেবায় কর্ম না করে তিনি এক মুহূর্তও নষ্ট করেন না। এই ধরনের কর্মই হচ্ছে পূর্ণ সমাধি।

শ্লোকঃ ৩-৪

যে ত্বক্ষরমনির্দেশ্যমব্যক্তং পর্যুপাসতে ।

সর্বত্রগমচিন্ত্যং চ কূটস্থমচলং ধ্রুম্ ॥ ৩ ॥

সংনিয়ম্যেন্দ্রিয়গ্রামং সর্বত্র সমবুদ্ধয়ঃ ৷

তে প্রাপ্নুবন্তি মামেব সর্বভূতহিতে রতাঃ ।৷ ৪ ॥

যে—যারা; তু—কিন্তু; অক্ষরম্—ইন্দ্রিয় অনুভূতির অতীত যা অনির্দেশ্যম অনির্বচনীয়; অব্যক্তদ্—অব্যক্ত; পর্যুগাসতে—উপাসনা করেন; সর্বত্রগর্—সর্বব্যাপী; অচিন্ত্যস্—অচিন্ত্য; চ—ও; কূটস্থ — অপরিবর্তনীয়; অচলম্—অচল; ধ্রুকা- শাশ্বত; সংনিয়মা—সংযত করে, ইন্দ্রিয়গ্রাম — সমস্ত ইন্দ্রিয়: সর্বত্র — সর্বত্র সমবুদ্ধয়ঃ—সমভাবাপন্ন; তে—তাঁরা, প্রাগুবত্তি প্রাপ্ত হন; মাম্ আমাকে: এব অবশ্যই, সর্বভূতহিতে— সমস্ত জীবের কল্যাণে; রতাঃ—রত হয়ে।

গীতার গান

অক্ষর অব্যক্তসক্ত নির্দিষ্টভাব ।

ইন্দ্রিয় সংযম করি হিতৈষী স্বভাব ॥

সর্বব্যাপী অচিন্তা যে কূটস্থ অচল ৷

ধ্রুব নির্বিশেষ সত্ত্বে থাকিয়া অটল ৷।

সমবুদ্ধি হয়ে সব করে উপাসনা ।

সে আমাকে প্রাপ্ত হয় করিয়া সাধনা ॥

অনুবাদঃ যাঁরা সমস্ত ইন্দ্রিয় সংযত করে, সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন হয়ে। এবং সর্বভূতের কল্যাণে রত হয়ে আমার অক্ষর, অনির্দেশ্য, অব্যক্ত, সর্বগ্রন্থ, অচিন্তা, কূটত্ব, অচল, ধ্রুব ও নির্বিশেষ স্বরূপকে উপাসনা করেন, তাঁরা অবশেষে আমাকেই প্রাপ্ত হন।

তাৎপর্যঃ যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করেন না, কিন্তু পরোক্ষ পন্থায় সেই একই উদ্দেশ্য সাধন করার চেষ্টা করেন, তাঁরাও পরিণামে সেই পরম লক্ষ্য শ্রীকৃষ্ণকে প্রাপ্ত হন। সেই বিষয়ে বলা হয়েছে, “বহু জন্ম-জন্মান্তরের পর জ্ঞানী যখন জানতে পারে যে, বাসুদেবই হচ্ছেন সব কিছুর পরম কারণ, তখন সে আমার চরণে প্রগত্তি করে।” বহু জন্মের পরে কোন মানুষ যখন পূর্ণজ্ঞান লাভ করেন, তখন তিনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মনিবেদন করেন। এই শ্লোকগুলিতে যে পন্থার বর্ণনা করা হয়েছে, সেই অনুসারে কেউ যদি ভগবানের দিকে অগ্রসর হতে চান, তা হলে তাঁকে ইন্দ্রিয় দমন করতে হবে, সকলের প্রতি সেবাপরায়ণ হতে হবে এবং সমস্ত প্রাণীর কল্যাণ সাধনে ব্রতী হতে হবে। এই শ্লোকের সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, আমাদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিকে অগ্রসর হতে হবে, তা না হলে কখনই পূর্ণ উপলব্ধি হবে না। প্রায়ই দেখা যায় যে, অনেক কৃচ্ছ্রসাধন করার পরই কেবল শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শরণাগতি আসে। স্বতন্ত্র আত্মার অন্তস্তলে পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে হলে দর্শন, শ্রবণ, আস্বাদন আদি সব রকমের ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াকলাপ থেকে নিবৃত্ত হতে হয়। তখন উপলব্ধি করা যায় যে, পরমাত্মা সর্বত্রই বিরাজমান। এই উপলব্ধির ফলে আর কারও প্রতি হিংসাভাব থাকে না। তখন আর মানুষে ও পশুতে ভেদবুদ্ধি থাকে না। কারণ, তখন কেবল আত্মারই দর্শন হয়, বাইরের আবরণটিকে তখন আর দেখা যায় না। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে এই নির্বিশেষ উপলব্ধি অত্যন্ত দুষ্কর।

error: Content is protected !!