মে মাসের শেষের দিকে আমি তখন ৮নং সেক্টর এবং ৯নং সেক্টরে গেরিলা এ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করছি। রিক্রুটমেন্টের জন্য কৃষ্ণনগর থেকে টাকি পর্যন্ত সমস্ত ইয়ুথ ক্যাম্প ও শরনার্থী ক্যাম্পগুলো থেকে মুক্তিযোদ্ধা বাছাই করার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছি ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে।

একদিন কৃষ্ণনগর থেকে কাজ সেরে বনগাঁ ফিরে আসছিলাম। বয়রা পৌঁছতেই সন্ধ্যা হয়ে এল । ভাবলাম, রাতটা হুদাভাই মানে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার সাথেই কাটাব। বয়রা ক্যাম্পে পৌঁছলাম সন্ধ্যার পর। হঠাৎ করে বিনা নোটিশে আমাকে দেখে হুদাভাই বেশ আশ্চর্য্য হলেন,

-কি ব্যাপার! হঠাৎ করে তুমি এখানে?

কৃষ্ণনগর থেকে ফিরছিলাম; ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে যাই ।

-ভালোই হলো, তুমি এসেছ। আজ রাতে একটা ভিষণ ইন্টারেষ্টিং অপারেশনে পাঠাচ্ছি একটা ফাইটিং পেট্রল – মাছলিয়ায়। খবর পেয়েছি খানসেনাদের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার আজ রাতে মাছলিয়ায় অবস্থান করবে। ব্যাটাকে জ্যান্ত ধরে আনব ভাবছি। বেশ রোমাঞ্ছিত হয়ে উঠেছিলাম হুদাভাই এর সিদ্ধান্ত শুনে। বললাম,

-হুদাভাই আপনার আপত্তি না থাকলে আমিই লিড করবো এই অপারেশন। হুদাভাই বললেন,

-বেশ তো, যাও ওদের সাথে। ওরা তোমাকে পেলে ভিষণ খুশি হবে। They will be in high moral.

রাতের খাওয়া শেষে ফাইনাল প্ল্যানটা দেখালেন ক্যাপ্টেন হুদা। বর্ডার থেকে প্রায় ৬ মাইল দূরে অবস্থিত মাছলিয়া হাই স্কুল ৷ সেখানেই রাত কাটাবেন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ৷ Troops-দের advanced position পরিদর্শনে এসেছেন কমান্ডার। মোক্ষম সুযোগ। এটা হাতছাড়া করা যায় না; তাই এ সিদ্ধান্ত। ৫০জন বাছাই করা মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল গঠন করে গাইডকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ।

আকাশে সেদিন খন্ড খন্ড মেঘ। একফালি চাঁদ। বিস্তৃত ধানক্ষেত। মাঝে মাঝে তালগাছ আর কাটা বাবলার ঝোপ। এর মাঝ দিয়েই গাইড আমাদের নিয়ে চলেছে। কিছু কথা কিছু ব্যখা সিঙ্গেল ফাইল ফর্মেশনে এগিয়ে চলছি আমরা। আমার আগে গাইড আর সবাই আমার পিছে। ধানক্ষেতের আল ভেঙ্গে চলেছি আমরা। রাত তিনটায় টার্গেটে পৌছানোর কথা । পথে গ্রামগুলোর পাশ কাটিয়ে চলেছিলাম আমরা। মাছলিয়ায় পৌছানোর আগে পথে কোন বাঁধা নেই। শত্রুপক্ষের কোন অবস্থানও নেই গোয়েন্দাদের খবর অনুযায়ী। তাই আমরা বেশ রিলাক্সড মুডেই হেটে চলেছিলাম নিঝুম প্রকৃতির নিঃস্তব্দতা ও মৃদু হাওয়ার পরশ উপভোগ করতে করতে। প্রতি এক ঘন্টা হাটার পর পনের মিনিট বিশ্রাম । আবার চলা। এভাবে প্রায় মাইল চারেক পেরিয়ে এসেছি। সারাটা পথই পেরিয়ে এসেছি নির্বিঘ্নে। কোন অসুবিধাই হয়নি। গভীর রাত। চারিদিকে এক অদ্ভুত নিরবতা। যতদূর চোখ যায় কেবলই বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। মাঝে মধ্যে সেই একই বাবলার ঝোপ অথবা একগুচ্ছ তালগাছ দাড়িয়ে। মৃদুমন্দ বাতাসে তালগাছের পাতায় সরসর শব্দ আর রাতের নিঃস্তব্দতায় শোনা যাচ্ছে একটানা ঝিঁ ঝিঁ-র ডাক। মাঝে মধ্যে আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে দু’একটা পাখি। মাঠের মধ্যে কয়েকগুচ্ছ ঘর-বসতি নিয়ে ছোট ছোট গ্রাম বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে। ম্লান চাঁদের আলোয় চারিদিকে আলো আধারের লুকোচুরি। রাতের কুহেলিকা ভেদ করে আমরা নিশির ডাকে যেন হেটে চলেছি মোহগ্রস্তের মত।

বাবলার একটা ঝোপ পেরুতেই হঠাৎ আমার সন্ধানী দৃষ্টি ২৫/৩০গজ দূরে গিয়ে আটকে গেল কয়েকটি কালো ছায়াতে। মানুষের অবয়ব বলে মনে হচ্ছে! একইসাথে শুনতে পেলাম কোদাল, বেলচে দিয়ে মাটি খোড়ার শব্দ। থমকে দাড়ালাম। সামনের গাইডকে স্পর্শ করে থামিয়ে দিলাম। সাংকেতিক ইশারায় দলের অন্য সবাইও দাড়িয়ে পড়ল মুহুর্তে। ঠিকই বুঝেছি। মানুষের অবয়বই বটে। খানসেনাদের একটি দল ডিফেন্স তৈরি করছে। স্ট্রেচ খোদার শব্দই ভেসে আসছে অল্পদূরের ব্যাবধান থেকে।

আমরা থমকে দাড়াতেই অস্ত্র কর্ক করার শব্দ হল। ওরাও হয়তো আমাদের দেখে থাকবে। মুহুর্তে দাড়িয়েই হিপ পজিশন থেকে আমি আমার ষ্টেনগানের ট্রিগার টিপলাম । কট করে একটা আওয়াজ হল কিন্তু আমার ষ্টেনগানে ফায়ার হল না। Faulty Magagine. ম্যাগজিনে গুলি ঠিকমত ভরা হয়নি সেকারণেই ফায়ার হল না। ষ্টেনের ম্যাগজিন বদলি করছিলাম তরিৎ গতিতে হঠাৎ এলএমজি-র একটা বার্ষ্ট ফায়ার হল বিপক্ষের তরফ থেকে। একঝলক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। একটি বুলেট এসে আমার ডান কব্জিতে বাঁধা ষ্টিলব্যান্ডের ভারী Omega ঘড়িটাতে লেগে মাঝ আঙ্গুলটা ভেঙ্গে বেরিয়ে গেল । ঘড়িটার বেল্ট ছিড়ে যাওয়ায় ছিটকে পড়ে গেল কোথাও। ততক্ষণে আমার ঠিক পেছনে হাওয়ালদার হাই পাল্টা গুলি ছুড়ে ধরাশায়ী করে দিয়েছে খানসেনাদের দু’জনকেই। সবাই আমরা তখন ধানক্ষেতের আলের কভার নিয়ে গুলি ছুড়ে চলছি। ওদের তরফ থেকেও গুলি বৃষ্টি ছুটে আসছে আমাদের দিকে। গোলাগুলির মধ্যেই হাইকে নির্দেশ দিলাম চারজনকে সঙ্গে নিয়ে ফ্ল্যাং দিয়ে ক্রল করে এগিয়ে গিয়ে গ্রেনেড চার্জ করতে।

আমাদের ফায়ারিং কভারে ওরা ওদের দায়িত্ব সম্পন্ন করার জন্য ক্রলিং করে এগিয়ে গেল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পরপর অনেকগুলো গ্রেনেডের বিষ্ফোরণ ঘটল। সাথে সাথে আমরা সবাই লাইং পজিশন থেকে উঠে চার্জ করলাম শত্রুপক্ষের উপর । হাতাহাতি লড়াই; দু’পক্ষ থেকেই ফায়ারিং বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে দু’একটা বিক্ষিপ্ত ফায়ারিং এর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আমাদের অতর্কিত হামলায় সেখানেই প্রায় ১৫ জন খানসেনা নিহত হয়েছিল। দু’জনকে জ্যান্ত বন্দি করা হয়েছিল। আমি ছাড়া আমাদের আর কারোরই কোন ক্ষতি হয়নি। অবস্থা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনার পর বুঝতে পেরেছিলাম খানসেনাদের একটি প্লাটুন রাতের অন্ধকারে মেইন পজিশন থেকে এগিয়ে এসে নতুন ডিফেন্স তৈরি করছিল এ্যাডভান্স পজিশন হিসেবে। এ মুভমেন্ট সম্পর্কে আমাদের কোন খবরই ছিল না।

এই অপ্রত্যাশিত আচমকা সংঘর্ষের ফলে মাছলিয়া অপারেশন বাদ দিয়ে বাধ্য হয়েই আমাদের ফিরে আসতে হয়। গ্রামবাসীদের সাহায্যে একটি গরু গাড়িতে মৃত খানসেনাদের লাশ ও বন্দিদের সাথে নিয়ে ফিরে এসেছিলাম আমরা। ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে জ্যান্ত ধরে আনতে না পারলেও সেদিনের অপারেশনের সাফল্যে আমরা সবাই সন্তুষ্ট হয়েই ফিরছিলাম বিজয়ী হয়ে। এ যাত্রায় অলৌকিকভাবেই রক্ষা পেয়েছিলাম যমরাজের হাত থেকে। মাত্র ২৫/৩০ গজের স্বল্প ব্যাবধান থেকে ফায়ার করা শত্র পক্ষের ৭.৬২ চাইনিজ এলএমজি-র বুলেটটি যদি হাতঘড়ির ষ্টিলব্যান্ড-এ না লেগে একটু এদিক ওদিক হতো তবে সে বুলেট আমার ফুসফুস ভেদ করে বেরিয়ে যেত । নিতান্ত আপনজনের মত আমার প্রিয় ওমেগা ঘড়িটি তার জীবন দিয়ে যেন আমার প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়ে গেল সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ্তা’য়ালার নির্দেশে।

error: Content is protected !!