শহিদুল ইসলাম

মানুষ কখনই কোনো প্রশ্ন বা ব্যাখ্যা ছাড়া জীবনকে মেনে নেয়নি । এটাই মানুষের স্বভাব । প্রাচীনকাল থেকেই, বিশেষ করে গ্রিক সভ্যতার শুরুর কাল থেকে, মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনাবলী নিয়ে ঔৎসুক্য প্রকাশ করে এসেছে । ‘আমি কি’, ‘কোথা থেকে এসেছি’, ‘কোথায় চলেছি’, ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করছে কে?’, ‘বস্তুর প্রকৃত সত্তা কি?’, ‘জীবন মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য কি?’ ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে এসেছে মানুষ সেই আদিকাল থেকেই । ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান যুগে যুগে এসব প্রশ্নের যুৎসই উত্তর দেবার চেষ্টা করেছে । সে সব প্রশ্ন স্থান-কাল ঐতিহাসিকতার সীমানায় আবদ্ধ ছিল । উত্তরও । মধ্যযুগের দার্শনিকরাও তাদের যুগের ভাবাদর্শের মধ্যেই এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন । তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চার্চের মৌলিক মতাদর্শগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা । নতুন কোনো চিন্তার অনুসন্ধান করা সে সময় ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার । মধ্যযুগের এক হাজার বছর দর্শন ও বিজ্ঞান ধর্মতত্ত্বের ক্রীতদাস ছিল বললে ভুল বলা হয় না । মধ্য ও আধুনিক যুগের সীমানায় দাঁড়িয়ে জিওর্দানো ব্রুনো তার সীমাহীন জ্ঞানানুশীলনের জন্য ক্যাথলিক ধর্ম আদালতের রায়ে আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ।

জিওর্দানো ব্রুনো সময়ের অনেক আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । তিনি এমন এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেন যখন মধ্যযুগ শেষ হয়েও হয়নি, মধ্যযুগের ধর্মীয় ও দার্শনিক প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং আধুনিক যুগের যুক্তিবাদ শুরুর সন্ধিক্ষণে তার জন্ম হয়। ১৫৪৮ সালে ইতালির ভিসুভিয়াস পর্বতমালার অদূরে ছোট্ট একটি শহর নোলায় তার জন্ম । ইউরোপের দীর্ঘ অন্ধকার যুগের শেষে এই ইতালিতেই ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে রেনেসাঁর যাত্রা শুরু হয় এবং পরবর্তী দুশো বছর তা ইতালি এবং সমগ্র ইউরোপের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, ধর্মীয় এবং সেই সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক ও শিল্পকলায় অভূতপূর্ব জোয়ার নিয়ে আসে। সে রেনেসাঁর সুতিকাগার ইতালিতে জন্মগ্রহণ করে জিওর্দানো ব্রুনোকে শুধু জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার জন্য মাত্র ৫২ বছর বয়সে পরম ক্ষমতাশালী চার্চের এক ঘৃণ্য বিচারের রায়ে জীবন্ত পুড়ে মরতে হয়েছিল । সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম বছরে তার সে আত্মত্যাগ রেনেসাঁর সব অর্জনকে যেন ব্যঙ্গ করে । ১৫৫০ সালে রেনেসাঁ আন্দোলনের তীব্রতা হ্রাস পেতে থাকে । রিফর্মেশন বিরোধী এক প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলনে সমগ্র ইউরোপ তখন কাঁপছে । ব্রুনো সেই সময় তার দর্শন ও বিজ্ঞান প্রচার করেছিলেন । তখন দর্শন ও বিজ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটেনি । দর্শনচ্যুত বিজ্ঞান কিংবা বলা যায় বিজ্ঞানচ্যুত দর্শনের এক অন্ধকারময় সময়ে ব্রুনো তার বিপ্লবী মতবাদ নিয়ে অবতীর্ণ হন ।

ব্রুনো হত্যা প্রমাণ করে যে তখনও সমাজের ওপর গির্জার দাপট কমেনি । ধর্মনিরপেক্ষ শাসকের শক্তি তখনও তেমন বৃদ্ধি পায়নি । সামন্তবাদী অর্থনীতির ভাঙন শুরু হলেও সমাজের ওপর তার সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ তখনও রীতিমত বহাল রয়েছে । পুঁজিবাদ কেবল উঁকিঝুঁকি মারছে । শিল্পবিপ্লব তখনও বহুদূরে । গির্জার সঙ্গে রাজার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তখনও নিরসন হয়নি । আর রাজার সঙ্গে পার্লামেন্টের দ্বন্দ্ব তখনও জমে ওঠেনি । সময়ের সাথে সাথে শেষের দুই দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে ওঠে বলা যায় সমগ্র মধ্যযুগ ধরেই গির্জা ও সেক্যুলার শাসকের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই চলে আসছিল । পোপ ইনোসেন্ট ৩য় (১১৯৮-১২১৬)র সময়ে চার্চ ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করে । কিন্তু তা অল্পকাল স্থায়ী হয়। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বে গির্জার পরাজয় ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র । গির্জা তার ক্ষমতা সংরক্ষণে মরিয়া হয়ে ওঠে । ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত রোমান ক্যাথলিক চার্চ মানুষের চিন্তা ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় । ইহজাগতিকতা এবং প্রটেস্টান্ট ধর্মের বিস্তার রোধে মরিয়া হয়ে ওঠে। ১৫৪২ সালে খ্রিস্টীয় ধর্ম আদালত (Inquisition) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৫৬৪ সালে Council of Trent সর্বপ্রথম নিষিদ্ধ বই-এর তালিকা প্রকাশ করে । প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার শক্তি পরস্পর সহঅবস্থান করে। অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিক্রিয়ার শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয় । ব্রুনোর ওপর যখন অত্যাচার নির্যাতন চালানো হয়, সেই ষোড়শ শতাব্দীর শেষ নাগাদ পশ্চিম ইউরোপ কিছুটা হলেও মধ্যযুগীয় বিশ্বছবি থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয় । অধিকাংশ সাধারণ মানুষ মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনার মধ্যে নাক ডুবিয়ে থাকলেও মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে একটি পরিবর্তনের রেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে । বিশ্বাসের স্থানটি ক্রমশ গ্রহণ করতে থাকে যুক্তি । আবেগ, মিথ এবং অতিপ্রাকৃতের স্থান দখল করে যুক্তি । মানুষ তার নিজের ওপর আস্থা ফিরে পায় । নবোত্থিত বিজ্ঞানের প্রভাব অবহেলা করতে পারে না পশ্চিম ইউরোপ । সেই সঙ্গে ধীর অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলে পুঁজিবাদী অর্থনীতি । বংশ পরিচয় নয়, মেধা, মনন ও পরিশ্রমের দ্বারা সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে সাধারণ ঘরের মানুষ ।

কোপারনিকাস, গ্যালিলিও ও নিউটনের নতুন বিশ্বছবি ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় এরিস্টটলের মধ্যযুগীয় বিশ্বছবিটাকে । সেই নবোত্থিত বিজ্ঞানের অণুপ্রেরণায় দর্শন ধর্মতত্ত্বের শক্ত রশি ছিড়ে বের হয়ে আসতে সমর্থ হয় । অনেকেই অ-খ্রিস্টান হয়ে পড়েন, অনেকে আবার ধর্মবিরোধী । যুক্তিহীন বিশ্বাস নয়, অনুভূতিপ্রসূত যুক্তিই হয়ে ওঠে তাদের হাতের প্রধান হাতিয়ার । অভিজ্ঞতা ও যুক্তি দিয়েই তারা ওপরের প্রশ্নগুলোর সমাধান চান। কোন প্রাচীন বা ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব তারা আর মানতে রাজি নন । ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার গুরুত্ব অনুভূত হতে থাকে। আল কেমিস্টরা হাতে কলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারাই ব্যবহার করতো । কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ছিল, বিজ্ঞান চেতনাবিরোধী । লক্ষ্য ভুল হলে যা হয়, তাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তবে তাদের সে অপচেষ্টার সুতিকাগার থেকে রসায়ন জন্মগ্রহণ করে । ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সম্ভবত রোজার বেকন (১২১৪-১২৯২) সর্বপ্রথম যুক্তি ও হাতে কলমে পরীক্ষা নিরীক্ষার ওপর জোর দেন এবং এরিস্টটলের অপবিজ্ঞানকে সাংঘাতিক ভাষায় আক্রমণ করেন । তিনি এরিস্টটলের সমস্ত বই পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন । তিনিই প্রথম সামন্ত বাদী অর্থনীতির ভাবাদর্শ ও জীবনাচরণের অমানবিকতার কথা বলেন । চারিত্রিক সঙ্গতি না থাকলেও তার দৃষ্টিভঙ্গিটি ছিল বস্তুতান্ত্রিক । এরিস্টটলীয় ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অধ্যাপনার পদ থেকে সরিয়ে দেয় এবং গির্জা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাকে বন্দি করা হয়। জিওর্দানো ব্রুনোর হত্যার ২০ বছর পর ফ্রান্সিস বেকন (১৫১৬-১৬২৫) তার বিখ্যাত বই ‘নোভাস অর্গানাম ‘ প্রকাশ করেন । সেই বইতে তিনি স্কলাসটিসিজম নামের বিজ্ঞান বিরোধী দর্শনকে আক্রমণ করেন এবং আধুনিক আরোহী পদ্ধতির সাহায্যে বিজ্ঞানের বন্ধ দরজা খুলে দেন । ঐ বইতে বেকন পরিষ্কার ভাষায় ধর্মের বিজ্ঞান বিরোধী চরিত্রের উন্মোচন করেন এবং ধর্ম-সংস্থার হাতে বিজ্ঞানীদের অত্যাচার-নির্যাতনের কথাও উল্লেখ করেন । কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি যে মাত্র ২০ বছর আগে ক্যাথলিক চার্চ যে ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিল, সে কথার কোন উল্লেখ নেই উক্ত গ্রন্থে ।

একজন সৈনিক জিওভ্যানী ব্রুনোর ঘরে জন্মগ্রহণ করলেও সত্যি কথা বলতে কি ব্রুনোর কোনো পরিবার ছিল না, জন্মস্থান ছিল না, ধর্ম ছিল না । এই বিশাল পৃথিবীতে তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ-একা । ভবঘুরের মত প্রাণ হাতে করে ইউরোপের দেশে দেশে তাকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে । তবুও আশ্চর্যের কথা এই যে ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে যাজক-ঐতিহ্যের দ্বারা নিপীড়িত নিঃসঙ্গ ব্রুনো তৎকালীন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে একজন প্রকৃত দার্শনিকের মত পৃথিবীকে বিচার করতে বসেছিলেন । এটি আশ্চর্যের এই জন্য যে মাত্র বিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা এই ধরনের চিন্তায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন । তাই বলছিলাম ব্রুনো তার সময়ের অনেক আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যখন তার দর্শন শোনার কান তৈরি হয়নি । বিশ্বাস করার মন তো তৈরিই হয়নি ।

আধুনিক অর্থে ব্রুনোই ছিলেন প্রথম সর্বপ্রাণবাদী । সর্বেশ্বরবাদ মনে করে পৃথিবীর সবকিছুর প্রাণ আছে । ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান । তাই ঈশ্বরকে খোঁজার জন্য কোন উপাসনালয়ের প্রয়োজন নেই। তিনি খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করেছিলেন । প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার বস্তুবাদ ও স্টয়িক মতবাদের পুনরুত্থান ঘটান । তার সঙ্গে অনন্ত অসীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধারণা সংযুক্ত করেন ।

তের বছর থেকে পরবর্তী দশ বছর তিনি নেপলসের সেন্ট ডোমিনিকান স্কুলে লেখাপড়া করেছিলেন। বিখ্যাত স্কুল সেটি। সেন্ট থমাস এ্যাকুইনাস ছিলেন ডোমিনিকান গোত্রের একজন মানুষ । তিনি সেই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন । ব্রুনো এ্যাকুইনাসের প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি এবং কিছুকালের মধ্যে ব্রুনো একজন ডোমিনিকান ধর্মযাজক হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সেই সঙ্গে তিনি জিওর্দানো নামটি গ্রহণ করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্কুলের সবাই তার অসাধারণ মেধা ও স্মরণশক্তির পরিচয় পান । তিনি একজন স্পষ্টভাষী, মুক্তমনের মানুষ ছিলেন । কিন্তু বাকসংযম করতে জানতেন না । যা সত্যি মনে করতেন, অনায়াসে তা প্রকাশ করতে পিছপা হতেন না। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজেকে বিপদের জালে জড়িয়ে ফেলেন। প্রমাণ হয়ে যায় যে এই বালক ডোমিনিকান সম্প্রদায়ের উপযুক্ত নন। সেকালের ছাত্রদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার ছিল না। শিক্ষক ছাত্রদের যা শেখান, ছাত্রদের সেটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হত । ছাত্র অবস্থায় যা তাকে শেখানো হতো, শিক্ষক হয়েও তার মধ্যে খুব ডুবে থাকাই ছিল, সেকালের শিক্ষা ব্যবস্থার অঙ্গ । শিক্ষকরা ছিলেন পুরাতন জ্ঞানের সংরক্ষক । নতুনের প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। ছাত্ররা ছিল তাদের শ্রোতা । শিক্ষকদের জ্ঞানের প্রশংসা করাই ছিল একজন ভাল ছাত্রের সদগুণ । নতুন কোন কথা বলা, কোন রকম সন্দেহ প্রকাশ ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ । সৃজনশীলতা ছিল মাহপাপ । তারা পরিশ্রম করবে, পরীক্ষা দেবে এবং ফলের জন্য অপেক্ষা করবে। শিক্ষা ছিল এরকম একরৈখিক ব্যাপার । কিন্তু ব্রুনোর চরিত্রে সেরকম সদগুণ ছিল না । নতুনের প্রতি তার আগ্রহ ছিল মজ্জাগত । মাঝে মধ্যে বেয়াড়া ধরনের প্রশ্ন করে শিক্ষকদের বেকায়দায় ফেলে দিতেন । তাই অচিরেই তিনি বিপদগ্রস্ত হলেন । প্রচলিত ধর্মকে তিনি যুক্তির অস্ত্র দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করতেন । ফলে শিগগিরই তিনি ধর্ম আদালতের নজরে পড়েন । ১৫৭৬ সালে বিচার এড়াতে তিনি নেপলস ত্যাগ করে রোমে যান । সেখানেও নিস্তার নেই । বিচারের ভয়ে সত্বর রোম ত্যাগ করেন । এই সময় তিনি ডোমিনিকান ধর্মমত পরিত্যাগ করেন । ১৫৭৯ সালে তিনি জেনেভায় যান । সেখানে কেলীভন একটি প্রটেস্টান্ট রিপাবলিক স্থাপন করেছিলেন । তিনি কেলভিন ধর্মমতে দীক্ষা গ্রহণ করেন । কিন্তু বেশিদিন তিনি তা ধরে থাকতে পারেন না । আবারও তিনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন । একটি প্রবন্ধে তিনি জনৈক কেলভিনপন্থী দর্শনের অধ্যাপককে আক্রমণ করেন এবং তার একটি বক্তৃতায় ২০টি ভুল শনাক্ত করেন । ফলে তাকে কিছুদিন কারাভোগ করতে হয় । ভুল স্বীকার করে তিনি মুক্তি পান ।

১৫৮১ সালে তিনি প্যারিসে পলায়ন করেন । সেখানে তখন ক্যাথলিক ও হুগোনটদের মধ্যে ধর্মীয় যুদ্ধ চলছে। তার ধর্মবিশ্বাসের কারণে সেখানে তিনি শিক্ষকতার কোন কাজ পেলেন না । বিভিন্ন বিষয়ে তিনি সেখানকার বিদ্বৎসমাজের সামনে বক্তৃতা দেন । প্রথম দিকে তিনি কিছু সাহনুভূতিশীল বন্ধুও পেয়ে যান । তার গুণপনা, বিশেষ করে তার অসাধারণ স্মরণশক্তির কথা, রাজা তৃতীয় হেনরির কানে পৌঁছায় । ব্রুনোর নতুন দর্শনের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। ব্রুনো কি আসলেই জাদুকর নাকি মায়াবী কিছু, তা জানার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন । ব্রুনো তার প্রখর স্মরণশক্তির জন্য যাদুকর বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। রাজা তাকে ডেকে পাঠান । ব্রুনো তাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে ম্যাজিক নয়, তার সিসটেম সুসংগঠিত জ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত । অল্পকালের জন্য হলেও ব্রুনো ফ্রান্সের রাজার আশীর্বাদ লাভ করেন । ১৫৮৩-১৫৮৫ এই দুই বছর তিনি লন্ডনে ফরাসি রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে বাস করেন । এই সময়ে ১৫৮৪ সালে তার দুখানা বিখ্যাত গ্রন্থ প্রকাশিত হয় : The Ash Wednesday Supper 4 On the Infinity, Universe and World- এ বই দুখানি তো বটেই, তার প্রায় ২০টি বই বেশ সাড়া জাগায় । দ্বিতীয় বইটিতে তিনি আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মত আরও অসংখ্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্বের কথা বলেন এবং বলেন তাদের প্রত্যেকটিতে মানুষের মত বুদ্ধিমান প্রাণীর বাস আছে । তার এ মত সরাসরি বাইবেলের জেনেসিস পর্বের বিরোধী । তাই চার্চ তা মানতে রাজি ছিল না। ঐ বছর তার আরও একখানা বই প্রকাশিত হয়। On Cause, Principle and Unity— এই তিনখানা বইতে ব্রুনো তার বিশ্বতত্ত্ব স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন । তা ছিল ধর্মীয় ও এরিস্টটলীয় বিশ্বতত্ত্বের সম্পূর্ণ বিরোধী । শেষ বইতে তিনি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মত বলেন, ‘The entire globe, this star, not being subject to death and dissolution and annihilation being impossible anywhere in Nature, from time to time renews itself by changing and altering all its parts. There is no absolute up or down, as Aristotle taught; no absolute position in space; but the position of a body is relative to that of other bodies. Everywhere there is incessant relative change in position throughout the universe, and the observer is always at the center of things.’ এভাবে ব্রুনো গতির আপেক্ষিকতা তত্ত্বের আভাষ দেন ।

কোপারনিকাস শুধু সৌর জগতের কেন্দ্রে পৃথিবীর জায়গায় সূর্যকে স্থাপন করে এক বিপ-ব সাধন করেছিলেন । কোপারনিকাস অনন্ত বিশ্বজগতের কথা ভাবেননি, তার ভাবনা ছিল সৌরজগতকে ঘিরে । কিন্তু ব্রুনো কপারনিকাসের কল্পিত সীমিত বিশ্বের মডেলটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং অসীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্বের কথা বলেছিলেন, একাধিক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধারণাও তিনি করেছিলেন । পরবর্তী বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা ব্রুনোর কল্পনাকে সত্যি বলে প্রমাণ করে । হাজার হাজার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব আজ আর অনুমানের ব্যাপার নয় । তাই জার্মান দার্শনিক আর্নেস্ট ক্যাসির বলেন, ‘ব্রুনোর সিদ্ধান্ত মানুষের স্বাধীনতার পথে প্রথম ও চূড়ান্ত পদক্ষেপ । মানুষ কেবল আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে রাজি নয় । … অনন্ত ও অসংখ্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধারণা মানুষের দৃষ্টির সীমানাকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে । বরং তা মানুষের চিন্তার স্বাধীনতার জন্য এক বিরাট উদ্দীপক সিদ্ধান্ত । (আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, অভিজিৎ রায়, পৃ. ১৩৭)

এর কিছু আগে ১৫৮২ সালে তার দুখানা বই প্রকাশিত হয় । Shadows of Idea এবং Art of Memory. এই বই দুখানাতে তিনি মানুষের ধারণা বা আদর্শকে সত্যের ছায়া বলে মনে করেন । একই বছরে তার Brief Architecture of the Art of Lully নামে আরো একটি বই প্রকাশিত হয় । লুলি নামের প্রধান চরিত্রটি গির্জার ধর্মমত মানুষের বিচার বুদ্ধি দিয়ে প্রমাণ করতে চায় । কিন্তু ব্রুনো প্রমাণ করেন যে এই ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার কোনো অর্থ হয় না । খ্রিস্টধর্মকে তিনি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে মনে করেন । তিনি মনে করেন যে ধর্ম সম্পূর্ণ দর্শনবিরোধী । খ্রিস্টধর্মী অন্যসব ধর্মের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে । তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে, ধর্মের ভিত্তি হল অন্ধ বিশ্বাস । তথাকথিত প্রত্যাদেশের কোনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই ।

তিনি যে অসীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রস্তাবনা করেন সেখানে ঈশ্বরের ধারণার কোনো জায়গা রাখেননি । তিনি ধারণাই করতে পারতেন না যে, ঈশ্বর এবং প্রকৃতির কোনো আলাদা সত্তা আছে এবং পৃথকভাবে তারা অস্তিত্ববান । বাইবেলের জেনেসিস পর্ব, ক্যাথলিক চার্চ, এমন কি এরিস্টটল তেমনিই শিক্ষা দেয় । এটা ব্রুনো মানতে পারেননি। তার কাছে মেরীর কৌমার্য এবং যিশুর ক্রুসবিদ্ধের ব্যাপারটি অর্থহীন । তিনি বাইবেলকে অশিক্ষিতের জন্য একখানা বই ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেননি । তিনি চার্চের শিক্ষাকে অনর্থক মনে করেন এবং মনে করেন যে তা মানুষের অজ্ঞতাকে উসকে দেয় । ব্রুনো লেখেন ‘Everything however men may deem it assured and evident, proves, when it is brought under discussion to be no less doubtful than are extravagant and absurd beliefs (John J. Kessler, Ph.D. Ch. E-Internet)। তিনি Libertes Philosophica নামে একটি শব্দবন্ধের প্রচলন করেন যার অর্থ হল চিন্তার স্বাধীনতা, স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা এবং যদি ইচ্ছা কর দর্শন সৃষ্টির স্বাধীনতা । তার চতুর্থ বইয়ের নাম The Incantation of circe, সিরসি-র যাদু। সিরসি হচ্ছে হোমারের সেই যাদুকর যে মানুষকে পশুতে রূপান্তর করে এবং সেই পশুর সঙ্গে তাদেরই ভুলভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা করে । ব্রুনোর এই বইটা প্রমাণ করে যে তিনি ভাবানুষঙ্গ নিয়ে চিন্তা করতেন এবং ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান ও তার পদ্ধতি নিয়ে অবিরাম প্রশ্ন উত্থাপন করতেন ।

৩৪ বছর বয়সে ১৫৮২ সালে তিনি The Chandler নামে একটি নাটক লেখেন । নাটকের থিম এরকম : একজন মোমবাতি প্রস্তুতকারক চর্বি ও তৈলজ পদার্থ দিয়ে মোমবাতি তৈরি করে এবং সেগুলো বিক্রি করার সময় উচ্চস্বরে বলতেন, Behold in the candle borne by this Chandler, to whom I give birth that which shall clarify certain shadows of ideas… I need not instruct you of my belief. Time gives all and takes all away, everything changes but nothing perishes… with this philosophy my spirit grows, my mind expands, whereof however obscure the night may be, I await the daybreak and they who dwell in day look for night … Rejoice, therefore, and keep whole if you can and return love for love (John J Kessler Ph.D. Ch. E. Internet).

ব্রুনো প্রায় এককভাবে কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পক্ষে প্রচারাভিযান চালিয়ে যান। তখন প্রায় সবাই তার কথায় হাসাহাসি করতো- ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতো । কোপারনিকাসের তত্ত্ব তখন প্রায় কেউই বিশ্বাস করতো না কারণ তা এরিস্টটলের বিশ্বতত্ত্বের সঙ্গে মেলে না । ১৫৮২ থেকে ১৫৯২ সালের মধ্যে ইউরোপে এমন একজন শিক্ষক খুঁজে পাওয়া যেত না, যিনি সক্রিয় ও খোলাখুলিভাবে কোপারনিকাসের বিশ্বতত্ত্বের পক্ষে কথা বলতেন । একমাত্র ব্রুনো ছাড়া । গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২) কখনও ব্রুনোর সঙ্গে দেখা করেননি এবং তিনি তার কোনো লেখায় ব্রুনোর নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেননি। কেপলার (১৫৭১- ১৬৩০) ও গ্যালিলিও উভয়েই ব্রুনোকে খুব একটা পছন্দ করতেন না ।

ইংলন্ডের রানী এলিজাবেথের সঙ্গে তার একবার দেখা হয়েছিল । তিনি তার গুণকীর্তনে খুবই বাড়াবাড়ি করেছিলেন। রানীকে তিনি অপেরা গায়িকা, প্রোটেস্টান্ট শাসক, পুতপবিত্র, স্বর্গীয় ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করেছিলেন এবং তাকে His Most Christian Majesty এবং পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের প্রধান বলে সম্বোধন করেছিলেন । তার এই উচ্ছ্বাসময় উক্তি তার বিচারের সময় তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল । তাকে একজন নাস্তিক এবং ধর্মদ্রোহী বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল । রানী এলিজাবেথও ব্রুনো সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন না । তিনি তাকে একজন জংলি, বিপ-বী, রাষ্ট্রদ্রোহী ও ভয়ঙ্কর মানুষ বলে মনে করতেন । ব্রুনো ইংরেজদের কবর্ষ মানুষ বলে মনে করতেন ।

ইতোমধ্যে ধর্মসংস্কার আন্দোলনে প্রোটেস্টান্ট ধর্মের বিজয় সূচিত হয়েছে । ইংলন্ড তখন ক্যাথলিক ধর্ম ও রোমের বিরুদ্ধে সোচ্চার । ব্রুনো এতে আশাবাদী হয়ে ওঠেন । ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ইংলন্ডে যান । অনেক আশায় আবার বুক বেঁধে ব্রুনো আক্সফোর্ডে দর্শনের অধ্যাপক পদের জন্য দরখাস্ত করেন। কিন্তু অক্সফোর্ড তখনও প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের মত নির্জীব এরিস্টটলবাদের হাতে বন্দি । ব্রুনো সেখানে কোপারনিকাসের নতুন বিশ্বতত্ত্বের সমর্থনে বক্তৃতা প্ৰদান করেন । কিন্তু অক্সফোর্ডে তখন সাধারণভাবে কোপারনিকাসের সে তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি । সেখানে তখনও সূর্যই পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে । সেই সঙ্গে তিনি এরিস্টটলের বিশ্বছবিটাকে উচ্চকণ্ঠে আক্রমণ করেন । ব্রুনো ভীমরুলের চাকে আঘাত করেন। তার সেই বক্তৃতা তীব্র বাদানুবাদের সৃষ্টি করে। চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত হন তিনি এবং অক্সফোর্ড ছাড়তে বাধ্য হন । লন্ডনে এসে ফরাসী রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন ।

১৫৮৫ সালের আগে তিনি আর প্যারিসে ফিরে আসেননি । প্যারিসে এসে পুনরায় তিনি বিপদের মধ্যে পড়েন । কেমব্রাই কলেজে বক্তৃতায় তিনি এরিস্টটলকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন এবং কোপারনিকাসের তত্ত্বের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জ্ঞাপন করেন । ফলে শ্রোতারা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তাকে কেবল ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেই তারা ক্ষান্ত হননি, শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত করা হয় । দেশ ছেড়ে পালাতে তাকে বাধ্য করা হয় । তিনি পালান কিন্তু তিনি তার মতাদর্শ পরিত্যাগ করেন না । ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে ঘুরে বেড়ান। পাঁচ বছর তিনি মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ান । মাঝে মধ্যে মাবুব, মেইনজ, উইটেনবার্গ, প্রাগ, হেমেস্টেড, ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং জুরিখ প্রভৃতি স্থানে কিছুদিনের জন্য অবস্থান করেন । এসব প্রোটেস্টান্ট দেশ। এর মধ্যে তিনি ল্যাটিন ভাষায় দর্শন, বিশ্বতত্ত্ব, পদার্থবিজ্ঞান, ম্যাজিক এবং স্মৃতিবিজ্ঞানের উপর বেশ ক’টি বই লেখেন ।

যদি তিনি জার্মানিতে থাকতেন তাহলে হয়তো ভয়ের কিছু ছিল না । কিন্তু ১৫৯১ সালে ভেনিস থেকে তিনি এক রহস্যময় আমন্ত্রণ পান । জুয়ানে মোসেনিগো নামের এক যুবক স্মৃতিবিজ্ঞান শেখার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানান । ভেনিস তখন ইতালির একটি স্বাধীন প্রদেশ। তিনি ভেবেছিলেন রোমের প্রসারিত হাত হয়তো সেখানে পৌঁছাবে না । তিনি ভেনিসে গেলেন । তার ছাত্র তখন তাকে সেখানকার ধর্ম আদালতের হাতে তুলে দিল । ব্রুনো ভেনিসের ধর্ম আদালতে বিচারের সম্মুখীন হলেন । তার গুণধর ছাত্রটি তার বিরুদ্ধে অভিযোগের এক দীর্ঘ তালিকা প্রদান করেন । অভিযোগের তালিকায় বলা হয়েছিল যে ব্রুনো হযরত মুসাকে একজন বড় যাদুকর হিসেবে বিবেচনা করতেন । তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে গল্প করেছিলেন, বাইবেলে যে কল্পকাহিনী ছাপানো আছে, তা গাঁজাখুরে গল্প ছাড়া কিছু নয় । যিশুও একজন যাদুকর ছিলেন এবং তিনি একজন জঘন্য ব্যক্তি । ব্রুনো নাকি বলতেন তিনি যিশুর চাইতেও ভাল ম্যাজিক দেখাতে পারেন । যিশুর পুনরুত্থান ও তার virgin birth নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করতেন । নরক বলে কিছু আছে বলে তিনি মনে করতেন না । তাই মৃত্যুর পর মানুষকে কোনো শাস্তি পেতে হবে না । ঈশ্বর বলে আলাদা কিছুর অস্তিত্ব তিনি স্বীকার করতেন না । কারণ সর্বশক্তিমান ঈশ্বর থাকলে এমন অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ পৃথিবীর সৃষ্টি হত না । প্রার্থনা, সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন, ছবি কোন কিছুই কোন উপকারে আসে না । যাজকরা সবাই গাধা । কোন ধর্মই তাকে খুশি করতে পারে না । মোসেনিগো তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তাহলে আপনি কোন ধর্ম বিশ্বাস করেন?’ উত্তরে এরিস্টটলের একটি উক্তি উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘যা প্রত্যেকটি আইন ও প্রত্যেকটি বিশ্বাসের শত্রু’, বলে উচ্চস্বরে হেসে উঠেছিলেন। ভেনিসের আদালতের সামনে নতজানু হয়ে তিনি ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন এবং তার এ সমস্ত ধর্মতত্ত্ব ও বিশ্বতত্ত্ব অস্বীকার করেছিলেন। এর মধ্যে তিনি কোনো অন্যায় দেখেননি । মৃত্যুকে তিনি পরিহার করতে চেয়েছিলেন আরও কিছু কাজ করার সুযোগ পাওয়ার জন্য। তিনি তার নতুন দর্শনের আলোকে ধর্মের একটি নতুন সম্প্রদায় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। মুক্ত হলে তিনি জার্মানি বা ইংলন্ডে চলে যেতেন এবং তার ধর্মমতের পক্ষে প্রচার চালাতেন । কিছু অনুসারী তৈরির চেষ্টা চালাতেন ব্রুনো ভেবেছিলেন তিনি মুক্তি পাবেন । কিন্তু রোমের উচ্চ আদালত সে সুযোগ তাকে দেয়নি। প্রধান ধর্ম বিচারক কার্ডিনাল সান্তাসেভেরিনা ব্রুনোকে রোমের ধর্ম আদালতে হস্তান্তর করার নির্দেশ দেয় । ভেনিস সরকার প্রথমে বাধা দিলেও ব্রুনোকে রোমের ধর্ম আদালতের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয় ।

১৫৯৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তাকে রোমে আনা হয়। সাত বছর সেখানে তাকে কারারুদ্ধ করে রাখা হয় । তাকে লেখাপড়ার কোন সরঞ্জাম দেয়া হয়নি। ব্রুনোর বিরুদ্ধে আটটি অভিযোগ উত্থাপন করা হয় । সেগুলো যে কি, তা কোন দিনই জানা যাবে না । কারণ তার ফাইলটি লুকিয়ে রাখা হয় । পরে নেপোলিয়নের হাতে পড়ে তা ধ্বংস হয় । ১৫৯৯ সালে তার বিচার শুরু হয় ।

১৬০০ সালের ২৫ জানুয়ারি পোপ ক্লিমেন্ট ৬ষ্ঠ তাকে ধর্মনিরপেক্ষ শাসকের হাতে বিচারের ভার অর্পণ করেন । ব্রুনো এবারে কিন্তু ক্ষমা চান না । তিনি বলেন যে তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন না । কারণ তিনি এমন কিছু লেখেননি বা বলেননি যা প্রত্যাহারযোগ্য । ৮ই ফেব্রুয়ারি বিচারের রায় পাঠ করা হয় । সে রায়ে ব্রুনোকে অনুতাপশূন্য, গোঁয়ার, দুর্দম, একগুঁয়ে এবং ধর্মহীন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় । তাকে গির্জা থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং যাজকীয় ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয় । সেন্ট পিটার গির্জার আঙ্গিনায় জনসম্মুখে তার বই আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং সেসব বইগুলোকে নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় । তার সে বইগুলো আজও নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায় রয়েছে । বিচারের রায় শুনে ব্রুনো বলেছিলেন, ‘Perhaps you who pronounce my sentence are in greater fear than I who receive it.’

১৬ ফেব্রুয়ারি ব্রুনোকে Caupo dei Fiori তে আনা হয় । তাকে ক্লান্ত ও ভগ্নহৃদয় দেখাচ্ছিল । শেষ মুহূর্তেও চার্চ তাকে একা ছেড়ে দেয়নি, একদল যাজক তাকে ঘিরে থাকে এবং তার বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে থাকে । আগুন লাগাবার ঠিক আগ মুহূর্তে চুমু খাওয়ার জন্য তাকে একটি ক্রুশ দেয়া হয় । রাগে তিনি মুখ ঘুরিয়ে নেন । বলেন, ‘আমি স্বইচ্ছায় মৃত্যুবরণ করছি ।’ তিনি মনে করেন চিতার আগুনের লেলিহান শিখার ওপর চেয়ে তার আত্মা স্বর্গে পৌঁছে যাবে । তাকে উলঙ্গ করে একটি খুঁটির সঙ্গে বাধা হল । তারপর আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয় । সক্রেটিসের পর আর একজন পণ্ডিতকে জ্ঞানচর্চার, ভিন্নমত পোষণ করার জন্য এবং কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বকে সমর্থন করার জন্য আত্মাহুতি দিতে হল ।

ব্রুনোকে হত্যা করার দায় থেকে চার্চ কখনও নিজেকে মুক্ত করতে পারে না । কোপারনিকাসের De revolutionbus প্রকাশিত হওয়ায় (১৫৪৩) ক্যাথলিক চার্চ ততটা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। কারণ সম্ভবত এই যে তার সে তত্ত্ব কেবল জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বিদ্বৎসমাজের আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । কিন্তু ব্রুনোর সমর্থনজ্ঞাপন এবং তার সে তত্ত্বের পক্ষে প্রচারাভিযান চালানোর পরই বইটি নিষিদ্ধ করা হয় ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে, প্রকাশের পর ৭৩ বছর পরে । আঠার শতক পর্যন্ত সে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল । কিন্তু জিওর্দানো ব্রুনোর বইগুলো (প্রায় ২০টি) আজও ক্যাথলিক চার্চের নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায় রয়েছে। ১৯৭৯ সালের ১০ নভেম্বর আইনস্টাইনের জন্মশতবার্ষিকীতে ধর্মযাজকীয় বিজ্ঞান একাডেমীর বিজ্ঞানীদের এক সমাবেশে পোপ ২য় জন পল যে মন্তব্য করেছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য । বলেছিলেন,

‘মাননীয় সভাপতি, আপনি আপনার ভাষণে সত্যিই বলেছেন যে গ্যালিলিও ও আইনস্টাইন একটি যুগকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তোলে। গ্যালিলিওর বিশালত্ব সকলের জানা, আইনস্টাইনের বিশালতার মতই । কিন্তু শেষোক্ত ব্যক্তির বিপরীতে যাকে আজ আমরা সম্মানিত করছি কার্ডিনালদের কলেজের সামনে, প্রথম ব্যক্তিটিকে সীমাহীন কষ্ট দুঃখ ভোগ করতে হয়েছে চার্চের মানুষ ও সংগঠনের হাতে । আর এ সত্য আমরা চাপা দিতে পারি না ।’ (আলো হাতে আঁধারের যাত্রী, অভিজিৎ রায় পৃ. ৩২) । ১৯৯২ সালের ৩১ অক্টোবর রোমান ক্যাথলিক চার্চ অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বীকার করেছেন যে কোপারনিকাসের তত্ত্ব সমর্থন করে গ্যালিলিও সঠিক কাজ করেছিলেন, ব্রুনোর প্রতি এরকম কোনো স্বীকারোক্তি চার্চ আজ পর্যন্ত করেনি । (আলো হাতে আঁধারের যাত্রী, অভিজিৎ রায়, পৃ. ৩৩) বরং ব্রুনোর প্রতি ক্যাথলিক চার্চ যে এখনও অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে তা এনসাইক্লোপোডিয়ার সর্বশেষ সংখ্যায় ব্রুনো সম্পর্কে মন্তব্যে প্রকাশ পায় ৷ সেখানে ব্রুনোকে চপলমতি ও অস্থিতিশীল চরিত্রের অধিকারী একজন জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । ব্রুনোর ধর্ম সম্পর্কে ধারণাগুলোকে ভ্রান্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেজন্য চার্চের রক্ষণশীল অঙ্গ ‘ইনকুইজিশনে’র হাতে দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দি ও নির্যাতন ভোগ করার কথা বলা হলেও চার্চ কর্তৃপক্ষ যে তাকে জীবন্ত দগ্ধ করে হত্যা করে তার জন্য কোন অনুশোচনার অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়নি । (আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, অভিজিৎ রায়, পৃ. ৩৩)।

তাই আসুন ব্রুনোর হত্যাকাণ্ডের চারশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের এই ক্ষুদ্র স্মরণসভা থেকে আমরা আওয়াজ তুলি যে গ্যালিলিওর মত ব্রুনোর প্রতিও যে ক্যাথলিক চার্চ অমানবিক অপরাধ করেছিল আজ চার্চকে তা স্বীকার করতে হবে এবং তার জন্য সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে । সেই সঙ্গে তার সকল বই এর ওপর থেকে ধর্মীয় আদালতের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে ।

 

সহায়ক প্রবন্ধ ও গ্রন্থসমূহ

1. Giordano Bruno (1548-1600 ) : Christan Bartholmess- Internet.

2. John J. Kessler Ph. D. Ch. E: Giordano Bruno : The Forgotten Philosopher – Internet.

3. অভিজিৎ রায়, ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’, অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৫ ।

4. H. Butterfield: The Origins of Modern Science, 1300-1800, G Bell and Sons Ltd. London, 1968.

5. শিশির কুমার ভট্টাচার্য, ‘মানুষ ও মহাবিশ্ব’, সময় প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০০৪ ।

6. Edward McNall Burns, Philip Lee Ralph, Robert E. Lerner et. al. ‘Wrold Civilization’, Special Indian Edition, 1991.

7. M. Rosenthal & P. Yudin, ‘A Dictionary of Philosophy, Progress Publishers, Moscow, 1967.

8. Jostein Gaarder, ‘Sophies World’, Berkley Books, New York, 1996.

9. সরদার ফজলুল করিম, ‘দর্শন কোষ’, বাংলা একাডেমি, ঢাকা ১৯৭৩ ৷

error: Content is protected !!