আমি যখন ফাইভ-সিক্সে পড়ি তখন বাজারে প্রথম কোকাকোলা, ফান্টা আসা শুরু হলো। তারপর এল 7up। এর আগে সোডা ওয়াটার পাওয়া যেত। বোতলের মুখ মার্বেল দিয়ে বন্ধ থাকত। বোতল ভালোমতো ঝাঁকালে কার্বন ডাই অক্সাইডের চাপে বন্দুকের গুলির মত মার্বেল ছুটে যেত। বড়ই মজার খেলা।
যাই হোক, প্রথমদিন 7up খেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। এর নাম সেভেন আপ কেন? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। কারণটা কী? শৈশবে কৌতূহল সহজে যায় না। যাকে পাই তাকেই জিজ্ঞেস করি। কেউ বলতে পারে না। ওপরের ক্লাসের এক বড় ভাই বললেন, এটা খেলে সাতবার ঢেঁকুর ওঠে। কাজেই সেভেন আপ নাম। এরপর থেকে পয়সা জমাতে পারলেই সেভেন আপ কিনি। খেয়ে ঢেঁকুর ওঠে। তিনটা, বড়জোর চারটা ঢেঁকুর ওঠে। এর বেশি না।
কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই সেভেন আপ নামকরণের তাৎপর্য জানতে পেরেছি। পাঠকদের জানাচ্ছি। এই জ্ঞানে তাদের কোনো উপকার হবার কথা না। তারপরেও জানা রইল।
সাত এসেছে সাত আউন্স থেকে। প্রথম যে 7Up-এর বোতল ছাড়া হয়েছিল তাতে সাত আউন্স পানীয় ধরত। Up হলো বুদবুদ কোন দিকে উঠবে তার নির্দেশনা।
শৈশবের একটি কৌতুহল মিটল জীবনের শেষ দিকে। আমার কাছে ব্যাপারটা গুরুরুপূর্ণ। আমরা অসংখ্য অমীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে বড় হই। একসময় অমীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে কবরে চলে যাই।
সম্প্রতি আমার হাতে দুটা বই এসেছে। একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর, লেখক আইজাক অ্যাসিমভ। নাম Book of Facts। অন্যটির নাম The Book of Useless Information। লেখক নোয়েল বোথাম। দুটি বইতেই মজার মজার সব তথ্য।
উদাহরণ দেই। জীবন্ত কবর দিয়ে দেওয়া হবে এই ধরনের ভীতি নাকি কিছু মানুষের মধ্যে কাজ করে। এই ভীতির নাম Taphephobia। এই ভীতির কথা আমি প্রথম আমার মার কাছে শুনলাম। তিনি এক সন্ধ্যায় মাগরেবের নামাজের পর আমাকে ডেকে বললেন, প্রায়ই একটা কথা ভেবে আমার খুবই ভয় লাগে।
আমি বললাম, কী নিয়ে ভয় লাগে?
মা বললেন, তোরা যদি আমাকে মৃত মনে করে জীবন্ত কবর দিয়ে ফেলিস। হঠাৎ অন্ধকার কবরে জ্ঞান ফিরল। তখন আমি করব কী? এরকম ঘটনা যে ঘটে না, তা তো না। ডেডবডি নিয়ে যাচ্ছে তখন হঠাৎ ডেডবডি নড়ে উঠল।
আমি বললাম, এই বিষয়টা নিয়ে কী করা যায় তা আমরা পারিবারিক মিটিং বসিয়ে ঠিক করব। আপনি এ নিয়ে একেবারেই চিন্তা করবেন না।
Book of Useless Information পড়ে দেখি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের এই ভীতি ছিল। প্রবলভাবেই ছিল। তিনি উইল করে গিয়েছিলেন যে মৃত্যুর পরে পরেই তাকে কবর দেওয়া যাবে না। তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে। দেখতে হবে তিনি আসলেই মারা গেছেন কিনা।
বইটি থেকে কিছু মজার তথ্য জানাচ্ছি।
প্রাণীজগৎ
ক. পৃথিবীর ৮০ ভাগ প্রাণীর পা ছয়টি।
খ. ব্যাঙ তরল খাদ্য এবং নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস তাদের চামড়া দিয়ে নেয়। মুখে না।
গ. ছোট্ট একটা ব্যাঙ হজম করতে একটা সাপের ৫২ ঘণ্টা সময় লাগে।
ঘ. মানুষদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি গরিলাদের ক্ষেত্রেও কাজ করে।
ঙ. একটা জোকের মস্তিষ্কের সংখ্যা হলো বত্রিশ।
চ. পোলিও রোগের ধরন বুঝার জন্যে ত্রিশ হাজার বাঁদরের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়েছিল।
খাবারদাবার
ক. আদি কোকাকোলার রঙ ছিল সবুজ।
খ. কেচাপ (Ketchup) এর জন্ম চীন দেশে।
গ. পটেটো চিপস প্রথম তৈরি হয় আমেরিকার লুসিয়ানাতে, ১৮৫৩ সনে।
ঘ. পৃথিবীর সবচেয়ে ঝাল মরিচের নাম Habanero।
পাঠক কি হাই তুলতে শুরু করেছেন? আমার বড় সমস্যা হলো আমার যা ভালো লাগে তা সবাইকে জানাতে ইচ্ছা করে। একটা সময় ছিল প্রতি পূর্ণিমায় একদল বন্ধুবান্ধব নিয়ে নুহাশ পল্লীতে পূর্ণিমা দেখতে যেতাম। বন্ধুরা যে হা করে পূর্ণিমা দেখত তা-না। তারা তাস খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত। আকাশে চাঁদ উঠেছে কি না তারচেয়ে ডিনারে কী আয়োজন হয়েছে–এই সংবাদ সংগ্রহে তাদের উৎসাহী বলে মনে হতো।
আকাশের তারা দেখার জন্যে আমার কাছে খুব দামি দুটা টেলিস্কোপ আছে। এর একটি পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে তাল রেখে নিজেও ঘুরে যেন Focus নষ্ট না হয়। এখন পর্যন্ত আমার কোনো বন্ধুকে বলতে শুনি নি যে, আজ আকাশের তারা দেখা যাক!
অ্যাসিমভের বুক অব ফ্যাক্ট দেখে আমার মনে পড়ল কলেজজীবনের কথা। তখন মোটা একটা চামড়ায় বাঁধানো খাতা কিনেছিলাম। খাতা ভর্তি করে ছিলাম নানান ধরনের তথ্য দিয়ে। খাতাটা এখন সঙ্গে থাকলে কাজে আসত। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার লাইব্রেরির সমস্ত বইপত্রের সঙ্গে খাতাটাও হারিয়ে গেছে। খাতায় টুকে রাখা একটি তথ্য দেখি নোয়েল বোথাম সাহেবের বইতেও আছে। তথ্যটা হলো—
Twinkle Twinkle Liltle Star
How I Wonder What You are…
এই নার্সারি রাইমটি সঙ্গীতের মাস্টার মোৎসার্ট পাঁচ বছর বয়সে রচনা করেছিলেন।
সব বাদ দিয়ে এই তথ্যটি মনে রাখার একটা কারণও আছে। কারণটা হলো লাল কালির একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে আমি লিখেছিলাম, তথ্যটি বিশ্বাসযোগ্য না। মোৎসার্ট ছিলেন জার্মান। পাঁচ বছর বয়সে তাঁর ইংরেজি জানার কথা না।
নোয়েল বোথাম সাহেবের বইটিই বা অগ্রাহ্য করি কীভাবে? বইটি Time পত্রিকার Best seller list-এ অনেকদিন ছিল।
বোথাম সাহেব ঢাকার একটি তথ্যও বইতে দিয়েছেন। তিনি অবশ্যি ঢাকাকে India-র একটি শহর ধরে নিয়েছেন। বইয়ে লেখা Decca, India,
তথ্যটা হলো—
ঢাকা শহরের ভিক্ষুকরা কনভেনশন করে সিদ্ধান্ত নেয় পনেরো পয়সার নিচে তারা ভিক্ষা নেবে না।
বোথাম সাহেবের বইয়ের সর্বশেষ তথ্যটি আমার পছন্দ হয়েছে। তিনি বলছেন, যত Statistics প্রকাশিত হয় তার ৯৭ ভাগই বানানো।
কথা হচ্ছে তার নিজের বইটিও Statistics-এ ভর্তি। তাহলে কি…
“কাঠপেন্সিল” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ