হিন্দু উপাসনা ধর্মে বিশ্বাসীদের অনেকের কাছেই ‘বেদ’ মানে যেন ‘শেষ কথা’ ৷ ‘বেদবাক্য’ শব্দটার উৎপত্তি এই থেকে। শিক্ষার সুযোগ পাওয়া অনেক মানুষও বিশ্বাস করেন বেদে বিজ্ঞানের সব কথা লেখা আছে। বিদেশের বিজ্ঞানীরা নতুন কী করেছে? বেদ থেকেই তো সব টুকে মেরেছে। রসায়ন-বিজ্ঞান থেকে চিকিৎসা-বিজ্ঞান, সবেরই শেষ কথা বলে গেছে বেদ।
‘সংহতি’ একটি বইয়ের নাম। লেখক প্রভাতকুমার ভট্টাচার্য। অন্য পরিচয়- বর্ধমান শহরের সিংদরজায় তাঁর পঞ্চমুণ্ডির আসন। আসনে বসেন, তন্ত্র সাধনা করেন। বইটিতে লেখা রয়েছে, বৈদিক যুগে ক্ষেপণাস্ত্র থেকে ক্লোনিং সবই ছিল। ক্লোনিং নিয়ে একটি বাক্যের উদ্ধৃতি তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না। “ভগবৎ চণ্ডীতে উল্লেখ্য রক্তবীজ উপাখ্যান হতে এটাও ধারণা করা যায় যে সেই যুগের মানুষ ক্লোনিং পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে একটি মানুষের শুধুমাত্র এক ফোঁটা রক্ত হতেই অনুরূপ একটি সম্পূর্ণ মানুষ তৈরি করতে পারত।”
বিজ্ঞান-বিরোধী এই বইটি প্রসঙ্গে একজন লেখক লিখিতভাবে জানিয়েছেন, বইটি “অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা ইত্যাদির উচ্ছেদে সাহায্য করবে।” লেখকের মতামত বইটিতে ছাপা হয়েছে। গভীর পরিতাপ ও শঙ্কার বিষয় এই যে, লেখকের নাম ডা. ভবানীপ্রসাদ সাহু ।
আর এক চিকিৎসক গৌতম সাহা, এম. বি. বি. এন. (ক্যাল) ‘সংহতি’ প্রসঙ্গে একই ধরনের প্রশংসা করে লিখেছেন, “অনেক পৌরাণিক কাহিনী ও শাস্ত্রীয় বিধির আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা ছড়ানো রয়েছে পরিচ্ছদে পরিচ্ছদে !” এইসব ডাক্তারদের এমন শিক্ষার জন্যেই কি আমরা আমজনতা এক একটা ডাক্তার তৈরি করার খরচ যোগাই!
বৈদিক সাহিত্য নিয়ে এমন আজগুবি, ছেলেমানুষী লেখা বইয়ের সংখ্যা কম নয়। এই বঙ্গের সবচেয়ে নামী পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকাতেও বৈদিকযুগ নিয়ে, বৈদিক সাহিত্য নিয়ে ছেলেমানুষী বোকাবোকা লেখা আজ পর্যন্ত কম প্রকাশিত হয়নি। আসুন বরং দেখি বেদে কী আছে? বৈদিক সাহিত্য-ই বা কী?
বেদ—চারটি। ঋক, সাম, যজু, অথর্ব।
ঋকবেদ—এতে আছে দেবতাদের উদ্দেশে রচিত নানা স্তোত্র। ঋকবেদের পাঁচটি শাখার নাম আমরা জানতে পেরেছি। (১) শাকল (২) বাঙ্কল (৩) আশ্বলায়ন (৪) সাংখ্যায়ন (৫) মাণ্ডুক। বর্তমানে ঋকবেদের শাকল শাখাটিই শুধু টিকে আছে । এখন যে ঋক্বেদ পাচ্ছি, তাতে আছে ১০২৮টি সূক্ত বা অধ্যায়। ১০২৮টি সূক্তে দশ হাজারের উপর শ্লোক রয়েছে। শ্লোকগুলোতে দেবতার গুণগান ও তাঁদের করুণাভিক্ষা করা হয়েছে। এই দেবতারা তিন শ্রেণীর। স্বর্গের দেবতা, যাঁদের মধ্যে প্রধান মিত্র, পুষা, বিষ্ণু, ঊষা, আদিত্যগণ। আকাশের দেবতা, যথা ইন্দ্র, রুদ্র, বায়ু, পর্জন্য ও মরুদ্গণ। পৃথিবীর দেবতা, যথা অগ্নি, সোম পৃথিবী ইত্যাদি। ঋকবেদের একটি বৈশিষ্ট্য হল, প্রাকৃতিক শক্তিগুলোকে যেমন দেবত্ব আরোপ করেছিল, তেমনই মানবত্ব আরোপেরও প্রয়াস ছিল।
সামবেদ—সামবেদকে বলা যায় ঋবেদ-এ রচিত স্তোত্রগুলোর স্বরলিপির গ্রন্থ। এতে স্তোত্রগুলোর গায়নবিধি ও আবৃত্তিবিধি তুলে ধরা হয়েছে। সামবেদের মোট তিনটি শাখা। (১) কৌথুম (২) রাণায়নীয় (৩) জৈমিনীয় বা তালবকার। সামবেদের কৌথুম শাখাই বেশি প্রচলিত। সাম শব্দের অর্থ হল গান। সামবেদের ঋক্ বা স্তবকগুলোকে ‘যোনি’ আখ্যা দেওয়া হয়। যজ্ঞবেদিকেও ‘যোনি’ আখ্যা দেওয়া হয়। পুরুষ ও প্রকৃতিতত্ত্ব এবং জাদুবিশ্বাসের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ‘যোনি শব্দটির ব্যবহার যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
যজুর্বেদ—এতে আছে নানা যাগ-যজ্ঞের বিস্তৃত নিয়মাবলী, পদ্ধতি ও অনুশাসন। যজুর্বেদ দু’ভাগে বিভক্ত। (১) শুক্ল, (২) কৃষ্ণ। শুক্ল যজুর্বেদের একটিমাত্র শাখাই আমরা পেয়েছি। শাখাটির নাম—বাজসনেয়। কৃষ্ণ-যজুর্বেদের চারটি শাখা । (১) কাঠক-সংহিতা, (২) কপিষ্টল-কঠ-সংহিতা, (৩) তৈত্তিরীয় সংহিতা বা আপস্তম্ব সংহিতা (৪) মৈত্রায়ণী সংহিতা। যজুর্বেদের মন্ত্রগুলো স্থানবিশেষে শ্লোকে ও স্থান বিশেষে গদ্যে রচিত।
অথর্ববেদ—প্রাচীনত্বে ঋকবেদের প্রায় সমকালীন। অথর্ববেদের প্রাচীন নাম ‘অথর্বঙ্গিরস’। অথর্ববেদের দুটি শাখার খোঁজ আমরা পেয়েছি। (১) শৌনক, (২) পৈপ্পলাদ। অথর্ববেদে আছে—তুকতাক, ঝাড়ফুঁক, মারণ-উচ্চাটন, গৃহবন্ধন, গ্রামবন্ধন, বশীকরণ ইত্যাদির প্রয়োগ পদ্ধতি। অথর্ববেদে আছে নারীর সুপ্রসবের জন্য মন্ত্র, জ্বর সারাবার, মন্ত্র, হৃদরোগ ও কুষ্ঠ সারাবার মন্ত্র, শত্রুনাশ, দস্যুনাশ, দীর্ঘায়ুলাভের মন্ত্র, বিবাদে জয়ের মন্ত্র, ক্রিমিরোগের শান্তি-মন্ত্র, শত্রুসেনা সম্মোহন পদ্ধতি, যক্ষ্মানাশ মন্ত্র, শত্রুপত্নীকে বন্ধ্যা করার মন্ত্র ইত্যাদি। পাশাপাশি অথর্ববেদে বিভিন্ন রোগ সারাতে নানা রকম গাছ-গাছড়া ও ধাতুর ব্যবহারের কথা আমরা পেলাম, পেলাম রসায়ন শাস্ত্র। এই বেদে আছে রোগ চালান করে দেওয়ার জন্য রোগটির কাছে, অথবা অপদেবতা বা দেবতার কাছে প্রার্থনা। অথর্ববেদ ‘যোগ-দর্শন’ বা ‘তন্ত্র দর্শন-এর মুল উৎস, যা আগাপাশতলা কুসংস্কার ও প্রান্ত বিশ্বাস বই কিছুই নয়। ঋক্, সাম, যজু ও শেষ পর্যন্ত মোটাদাগের কুসংস্কারই।
বেদের ব্যাখ্যা দিতে তৈরি হয়েছিল ব্রাহ্মণ গ্রন্থসমূহ। এইসব গ্রন্থে আছে নানা যজ্ঞের কথা এবং যজ্ঞকে মহাজাগতিক শক্তি হিসেবে গণ্য করার কথা।
উপনিষদ
বেদের যুগ ছিল উচ্চবর্ণদের সুবর্ণ যুগ। ‘খাও-পিও-মৌজ কর’। কাজ করবে শুভ্র দাসেরা। কৃষি প্রধান সমাজ ব্যবস্থায় বেগার শ্রম দিতেন দাস-দাসীরা। প্রতিটি উৎপাদন কণা তুলে নিত উচ্চবর্ণের দাস প্রভুরা। শ্রেষ্ঠীদের ব্যবসায় রক্ত ঝরিয়ে আয় করতেন দাসরা। কিন্তু সেই আয়ের একটি কড়িতেও তাঁদের অধিকার ছিল না। কাজের কোনও বাঁধা-ধরা সময় নেই। দাস-দাসীদের চব্বিশ ঘণ্টাই ছিল কাজের সময়। যে কোনও সময় ডাক পড়লেই হল। দাসপ্রভুরা দয়া করে উচ্ছিষ্ট অন্ন, ছিন্ন বস্ত্র ও শোয়ার জন্য খড়ের আঁটি দিয়ে দাসেদের যত দিন পারা যায়, নিংড়ে নেওয়ার জন্য বাঁচিয়ে রাখতো। উচ্চবর্ণের লোকদের কাজের মধ্যে কাজ ছিল লাম্পট্য—মনুসংহিতা ও আর্য-সাহিত্যই তার প্রমাণ
শারীরিক ও মানসিকভাবে চূড়ান্ত অত্যাচারিত শূদ্র-দাসেদের মধ্যে ক্ষোভ অবশ্যই ছিল, যেমনটি ছিল আর প্রতিটি দেশের দাসেদের ক্ষেত্রে। তবে সে সময় অন্যান্য দেশের দাসদের সঙ্গে আমাদের দেশের শূদ্র-দাসদের পার্থক্য ছিল দুটি। (এক) অন্যান্য দেশে যুদ্ধ-বন্দি ও বন্দিকালে হওয়া সন্তান দাস হতেন। এ-দেশে বর্ণ বিভাজনের মধ্য দিয়ে ধর্ম দাস সৃষ্টি করেছিল। (দুই) অন্যান্য দেশে দাস প্রভুদের তুলনায় দাসরা ছিলেন সংখ্যালঘু। আমাদের ভারতবর্ষে শূদ্র দাসরা সংখ্যায় ছিলেন দাস- প্রভুদের তুলনায় বহুগুণ। এদেশের শূদ্র-দাসদের মধ্যে যে একটা ক্ষোভ ছিল, তারই প্রমাণ, সনাতন হিন্দু ধর্ম ছেড়ে শুদ্রদের ব্যাপক হারে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ।
বেদ ও মনুর অনুশাসনের প্রতি শুদ্রদের অনাগ্রহ, সন্দেহ, ক্ষোভ দেখে আর্য শাসক ও পুরোহিতগোষ্ঠী বিপদের গন্ধ পেলেন। ধোঁয়া থেকে আগুন সৃষ্টি হওয়ার আগেই ধোঁয়ার উৎপত্তিতে জল ঢেলে দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলেন।
এমনই এক প্রয়োজনীয় মুহূর্তে উচ্চবর্ণদের এই সংকটে উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় হাজির হলেন পাঞ্চালের রাজা জৈবলি ও ব্রাহ্মণ উদ্দালক আরুণি ( গৌতম)। তাঁরা তৈরি করলেন ছান্দোগ্য উপনিষদ (৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে)। ‘উপনিষদ’ শব্দের অর্থ হল—‘গুরু কর্তৃক শিষ্যের নিকট বর্ণিত রহস্য।’ ছান্দোগ্য উপনিষদে জৈবলি ও আরুণি নিয়ে এলেন এক নতুন মতবাদ, ‘জন্মান্তরবাদ’। পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম হিসেবে সনাতন হিন্দু উপাসনা ধর্মে যুক্ত হল ‘জন্মান্তর’ বিশ্বাস। ভারতবর্ষের হিন্দু উচ্চবর্ণরা পেল এক অসাধারণ কার্যকর অহিংস অস্ত্র। শিক্ষার সুযোগ পাওয়া উচ্চবর্ণের মানুষরা শূদ্র দাসদের কানে দিল ‘অব্যর্থ সত্যবাণী’—ঈশ্বরের বিধান মেনে এই জন্মের প্রভুদের প্রফুল্ল চিত্তে সেবা করলে, প্রভুর সম্পদে লোভ না করলে, কোনও ঈষা পোষণ না করলে, পরের জন্মে সে জন্মাবে উচ্চবর্ণে। আর, এ জন্মে জীবনের এই যে কষ্ট ভোগ, তা পূর্বজন্মেরই ‘কর্মফল’ মাত্র। শূদ্র উপনিষদের এই ‘জন্মান্তরবাদ’ ও কর্মফল ভারতবর্ষের দাস শ্রমিকদের মাথায় ‘সার্থকভাবে’ ঢোকানো গিয়েছিল। এই দেশের জনসমষ্টির বেশিরভাগই ছিলেন দাস। সংখ্যাধিক্যের এই সুবিধে থাকা সত্ত্বেও দাসেরা বিদ্রোহ করেননি। কারণ, আগামী জন্মে আবার দাস হতে চাননি। পরিবর্তে পূর্বজন্মের কর্মফলকে মনে নিয়ে দাস- প্রভুদের খুশি রেখে আগামী জন্মের সুখের জীবনকে সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। আমরা
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দাস-বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে দেখেছি।
কিন্তু আমাদের দেশে জ্বলতে দেখিনি। এই মহান দেশে
দাস-বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে দেয়নি
জন্মান্তরবাদের জলকামান।
শুধু কি তাই? উপনিষদ মৃত্যুর পর মানুষকে স্বর্গসুখের ভয়ংকর মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়ে অত্যাচারিত, শোষিত মানুষদের প্রতারিত করেছে।
বেদ তৈরি করেছিল স্থূল কুসংস্কার। উপনিষদ তৈরি করেছিল সূক্ষ্ম কুসংস্কার, যা বেদের কুসংস্কারের চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী। এই আপাত নিরীহ সূক্ষ্ম কুসংস্কারই আজও দুঃখপীড়িত মানুষদের ক্ষোভে জল ঢেলে চলেছে।
শোষিত মানুষদের মহাশত্রু হিসেবে আমরা অবশ্যই চিহ্নিত করতে পারি ‘কুখ্যাত ত্রয়ী’ জৈবলি, উদ্দালক আরুণি ও আরুণি শিষ্য যাজ্ঞবাল্ক্য-কে। সবচেয়ে, দুঃখ ও শঙ্কার ব্যাপারে এই যে, বর্তমান ভারতের বহু তথাকথিত বিদ্বান, পণ্ডিত ও দার্শনিক এই ‘কুখ্যাত ত্রয়ী’-কে দর্শনের প্রথম প্রদর্শক সর্বজ্ঞ বলে মনে করেন এবং প্রচার করেন। জানি না, তাঁদের এই প্রচারের পিছনে কতটা অজ্ঞতা, কতটা ‘ইগো’ ও কতটা শ্রেণীস্বার্থ কাজ করে। কিন্তু যেটাই কাজ করুক, এটা খুবই দুঃখের যে, তাঁরা শিক্ষার সুযোগ পাওয়ার পরও (যেখানে আজও ভারতের প্রচুর মানুষ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণে শিক্ষালাভের সুযোগ পায় না) অশিক্ষিতের মত হাস্যকর বক্তব্য বুক ফুলিয়ে প্রচার করেন। শঙ্কার কারণ এই যে, এইসব তথাকথিত শিক্ষিতদের অজ্ঞতা অথবা উদ্দেশ্যমূলক প্রচারের সঙ্গে পরিচিত হওয়া আমজনতার অনেকেই বিভ্রান্ত হবেন। বিভ্রান্ত হওয়ার কারণ স্পষ্টতই ডিগ্রির তমার প্রতি আমজনতার মোহাবিষ্টতা।
উপনিষদ-এর নিষ্ঠুরতা
উপনিষদ কি পরিমাণ নিষ্ঠুর অথবা নির্বোধ, তারই প্রমাণ হিে কয়েকটা লাইন এখানে তুলে দিলাম।
আগেই বলেছি, উপনিষদ হল—শিষ্যকে বলা গুরুর উপদেশাবলী। প্রকৃত চোর ধরার জন্য অব্যর্থ পদ্ধতি হিসেবে গুরু শিষ্যকে যে পদ্ধতি প্রয়োগ করতে বলছেন তা এইরকম; “সৌম্য? একবার শান্তিরক্ষক চুরির অভিযোগে এক ব্যক্তিকে ধরে আনল। তাকে আদেশ করা হল, ‘মন্ত্রপুত তপ্ত কুঠার স্পর্শ করো।’ সে যদি সত্যি অপরাধী হয়, এবং মিথ্যা দ্বারা অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করে, তবে সে তপ্ত কুঠারে দগ্ধ হবে। যদি সে নির্দোষ হয়, তবে কুঠারের অগ্নি তাকে পোড়াবে না। অপরাধী হলে মৃত্যুমুখে পতিত হবে। নির্দোষ হলে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬/১৬/১-২)।”
একটা সময় কোনও শূদ্রকে হত্যা করতে হলে তাঁর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ এনে এই ধরনের পরীক্ষার ফাঁদে ফেলা হত। সম্পত্তির মালিক উচ্চবর্ণদের জন্য এই তপ্ত কুঠারের পরীক্ষা নেওয়া হত না। এই পরীক্ষা শুধুমাত্র শূদ্র দাসেদের বেলাতেই প্রয়োগ করা হত। ভাবুন তো ওই ‘কুখ্যাত ত্ৰয়ী’ বে-পসন্দ মানুষ হত্যার জন্য ধর্মের নামে কী ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর ফাঁদ পেতেছিল?
উপনিষদ-এর বিভাজন এবং…
উপনিষদ-এর তেরটি ভাগ আছে। অর্থাৎ, উপনিষদ তেরটি। এগুলো ৭০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১০০ খ্রিস্টপূর্বে রচিত। তেরটির নাম (১) ঈশ (২) ছান্দোগ্য (৩) বৃহদারণ্যক (৪) ঐতরেয় (৫) তৈত্তিরীয় (৬) প্রশ্ন (৭) কেন (৮) কঠ (৯) মুণ্ডক (১০) মাণ্ডুক্য (১১) কৌষীতকি (১২) মৈত্রী (১৩) শ্বেতাশ্বতর।
উপনিষদগুলো বাগাড়ম্বর, হাস্যকর ও বিজ্ঞান-বিরোধী নানা তথ্যের
জঞ্জাল। জগৎ ও জীবন সৃষ্টির এক আজগুবি তথ্য দিয়ে বলা
হয়েছে, “আমি থেকে যেমন স্ফুলিঙ্গের উদ্ভব, তেমনই
এই আত্মা থেকে উদ্ভব হয় প্রাণ, লোক, দেব এবং
বস্তুসমূহের।” (বৃহদারণ্যক, ২/১/১০)
এই ‘আমি’ কে? আত্মা ।
আর এক জায়গায় সৃষ্টির বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, “আত্মাই প্রথম পুরুষ চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করে তিনি নিজেকে ব্যতীত দ্বিতীয় কাউকে দেখতে পেলেন না। তিনি উচ্চারণ করলেন ‘সোহং’ (আমিই একমাত্র)। অতঃপর তাঁর নাম হল “অহং’ ‘যা আমরা নিজেদের নামোচ্চারণের আগে বোধ করি। …. তিনি আতঙ্কিত হলেন, আজও তাই নিঃসঙ্গ ব্যক্তিকে আতঙ্ক গ্রাস করে।… তিনি দ্বিতীয় সত্তাকে কামনা করলেন নিজ আত্মা ও শরীরকে দ্বিধাবিভক্ত করলেন, সৃষ্টি হল পতি ও পত্নী….।” (বৃহদারণ্যক, ১/৪/১-৪)
আবার ছান্দোগ্যতে সৃষ্টি বর্ণনায় আমরা পাচ্ছি, “সৃষ্টি প্রথমে এক অদ্বিতীয় ভাবরূপেই ছিল, তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে চাইলেন, তাই অগ্নি তথা তেজ উৎপন্ন করলেন। তেজ ইচ্ছা করলেন এবং জল সৃষ্টি হল। জল থেকে সৃষ্টি করলেন অন্ন।” (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬/২/১-৪)
ছান্দোগ্যতে আমরা পরলোক তত্ত্বে পিত্যান’ ও ‘দেবযান’-এর পরিচয় পেয়েছি। পিতৃযান তত্ত্বে দেওয়া আছে মৃতের আত্মা বা চেতনা মৃত্যুর পর কোথায় কোথায় কত দিন করে অবস্থান করে। তারপর চন্দ্রলোকে যায়। সেখান থেকে মেয়াদ শেষে আবার আত্মা ফিরে আসে। ফেরাটা এইরকম—চন্দ্রলোক, আকাশ, পিতৃলোক, দক্ষিণায়ন মাস, কৃষ্ণপক্ষ, রাত্রি, তারপর কায়াহীন এবং সব শেষে স্ত্রী-যোনিতে।
দেবযান-এ যেতে পারলে আত্মাকে আর ফিরতে হয় না। দেবযানের যাত্রী আত্মাকে প্রথম যেতে হয় আলোর দেবতার কাছে। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে যেতে হয় দিনের দেবতা, শুক্লপক্ষের দেবতা, বর্ষার দেবতা, আদিত্য, চন্দ্র, বিদ্যুতের দেবতার কাছে। এখান থেকে আত্মাকে নিয়ে যাওয়া হয় ব্রহ্মার কাছে। এ-বার যাত্রা শেষ।
পৃথিবীর বাইরে যেমন আকাশ আছে, শরীরের ভিতর তেমনই না কি আকাশ আছে। আছে অগ্নি, বায়ু, চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী এবং জ্যোতির্মণ্ডল। এ-সবই আছে শরীরে মধ্যে একটি ছোটে কমলা রঙের ঘরে বা হৃদয়ে।
হৃদয়াকাশে একত্রিত এই দ্যুলোক-ভূলোককে স্মরণের মধ্যেই তাই ব্রহ্ম উপাসনা করা যায়। হৃদয়কে বা মনকে ব্রহ্ম জেনেই উপাসনা করার উপদেশ রয়েছে ছান্দোগ্যতে।
ঐতরেয় উপনিষদ-এ আবার এসেছে সৃষ্টিতত্ত্ব। বলা হয়েছে, “প্রথমে একমাত্র এই আত্মাই জীবিত ছিল। আত্মা মনে মনে ইচ্ছা করলেন “লোকপাল সৃষ্টি করব। জল থেকেই এক পুরুষকে তুলে তিনি তার দেহে কম্পন সৃষ্টি করে তাকে তপ্ত করলেন। তপ্ত করার পর তার মুখ বিকশিত হল। মুখ থেকে নির্গত হল বাণী, তা থেকে অগ্নি সৃষ্টি হল। নাসারন্ধ্র থেকে নির্গত হল নিঃশ্বাস, নিঃশ্বাস থেকে প্রাণ, প্রাণ থেকে বায়ু। চক্ষু থেকে সৃষ্টি হল দৃষ্টিশক্তি, তা থেকে সূর্য। কর্ণযুগল থেকে হল শ্রবণক্ষমতা, শ্রুতি থেকে দিশা। ত্বক থেকে রোম, রোম থেকে ওষধি বনস্পতি । হৃদপিণ্ড স্ফুরিত হলো, তা থেকে সৃষ্টি হলো মন থেকে চন্দ্র।” (ঐতরেয় উপনিষদ, ১/১-৩)
আমরা উপনিষদ পড়ে জানলাম, প্রাণ সৃষ্টির রহস্য, যা বিবর্তনবাদের
উল্টো দিকে চলেছে। আমরা জানলাম, প্ৰাণ থেকেই
সূর্য, চন্দ্রর সৃষ্টি রহস্য, যা মহাকাশ
বিজ্ঞানের উল্টোপথের পথিক।
আমরা জানলাম, বায়ু, অগ্নির সৃষ্টি রহস্য! তারপরও হিন্দু দার্শনিকরা কেন যে আজও নিজেদের যুক্তি বিচারকে নির্ভুল প্রমাণ করতে ভুলে ভরা উপনিষদের দোহাই পাড়েন, সেটাই রহস্য? আর একটা মজার কথা হল, উপনিষদ আবার নিজেদের জাহির করতে বেদের দোহাই পাড়ে।
উপনিষদের প্রতিটি বিভাগই এই ধরনের বিজ্ঞান বিরোধী, ভাষায় ঠাসা। একই সঙ্গে ঠাসা কুসংস্কারে।
‘গীতা’ উচ্চবর্ণের স্বার্থগন্ধী
ভগবদ্গীতা নিয়ে যাঁরা গদ্গদ, তাঁরা উপনিষদ ও গীতা পড়লে দ্বিধাহীনভাবে বুঝতে পারবেন, কৃষ্ণ অর্জুনের জন্য উপনিষদরূপী গাভী থেকে গীতামৃত দোহন করেছিলেন।
বৈদিক যুগে বেদ পাঠ করা তো দূরের কথা, শোনাও ছিল শূদ্রদের পক্ষে ভয়ংকর রকমের অপরাধ। পরবর্তীকালে বেদ ও উপনিষদের কিছু কথা উচ্চবর্ণের স্বার্থে শূদ্রদের মাথায় ঢোকাবার প্রয়োজনেই তৈরি করা হল ‘গীতা’। এই গীতা পাঠ করা বা পাঠ শোনা শূদ্রদের পক্ষে অপরাধের বদলে পুণ্যকর্ম বলে ঘোষিত হল।
শ্রীকৃষ্ণের দেওয়া উপদেশের নামে শূদ্রদের মাথায় আত্মা সংক্রান্ত
নানা ভুল ধারণার পাশাপাশি আরও একটা ভুল ধারণা
গুঁজে দেওয়া হল—কাজ করে যাও,
ফলের আশা করো না।
গীতা পুরোপুরিভাবেই উচ্চবর্ণদের পক্ষে স্বার্থরক্ষাকারী উপদেশে ভরপুর।
পুরাণ
পুরাণ অনুসারে ব্যাসদেব শ্রীকৃষ্ণের অংশ। তিনি ভিন্ন ভিন্ন ব্যাসরূপে আবির্ভূত হয়ে পুরাণ গ্রন্থগুলো রচনা করেছিলেন।
পুরাণের দুটি ভাগ। (১) মহাপুরাণ, (২) উপপুরাণ। মহাপুরাণের সংখ্যা ১৮টি (১) ব্রহ্মপুরাণ—সর্বপ্রথম এই পুরাণ রচিত হয়েছিল বলে একে ‘আদি পুরাণ’ বলা হয়। প্রথমাংশে আছে সৃষ্টি-প্রক্রিয়া, দেব ও অসুরদের জন্ম, সূর্যবংশ ও চন্দ্রবংশের বিবরণ। দ্বিতীয় অংশে আছে স্বর্গ-মর্ত-পাতাল ও নরকের বর্ণনা। রয়েছে শ্রীকৃষ্ণ চরিত। শেষ হয়েছে যোগ শাস্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে।
(২) পদ্মপুরাণ—পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত। সৃষ্টি খণ্ড, ভূমি খণ্ড, স্বর্গ খণ্ড, পাতাল খণ্ড ও উত্তর খণ্ড। প্রধান আলোচ্যের মধ্যে আছে—গোমাহাত্ম্য, বৃত্রবধ কাহিনী, পৃথুচরিত, বেণ-রাজার কাহিনী, নহুষ ও যযাতির কাহিনী, ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি, তীর্থ বিবরণ, কাশী-গয়া-প্রয়াগের মাহাত্ম্যকীর্তন, অগস্তের কথা, জগন্নাথের বিবরণ, দধীচি উপাখ্যান, কৃষ্ণের নিত্যলীলা, শিব মাহাত্ম্য, গঙ্গা মাহাত্ম্য, ব্রত মাহাত্ম্য, ভাগবত মাহাত্ম্য, মৎস্য-অবতার উপাখ্যান।
(৩) বিষ্ণুপুরাণ—ছয় ভাগে বিভক্ত। (১) বিষ্ণু-লক্ষ্মীর উৎপত্তি, ধ্রুবচরিত, প্রহ্লাদচরিত। (২) পৃথিবী, সপ্তদ্বীপ, সাত সমুদ্র (৩) ব্যাসের করা বেদ-বিভাগ ও চার বেদের আবার শাখা বিভাগ, আশ্রমধর্ম। (৪) সূর্যবংশ, চন্দ্রবংশ ও অন্যান্য প্রধান রাজবংশের বর্ণনা। (৫) কৃষ্ণচরিত, বৃন্দাবনলীলা, রাসলীলা, (৬) বিষ্ণুভক্তি, যোগ নিয়ে আলোচনা।
(৪) বায়ুপুরাণ—চারটি ভাগ। (১) ব্রহ্মাণ্ড ও জীবের সৃষ্টি। (২) ঋষিদের বংশপরিচয়, শৈব আখ্যান, (৩) জীব-জন্তু, সূর্যবংশ ও চন্দ্রবংশের বিবরণ, (৪) যোগশাস্ত্র ও শিবমাহাত্ম্য।
(৫) ভাগবতপুরাণ—এই পুরাণের আর এক নাম ‘শ্রীমদ্ভাগবত’। এতে রয়েছে, সৃষ্টিতত্ত্ব, মায়াবাদ, ব্রহ্মার সৃষ্টিকাহিনী, বরাহবতার কাহিনী, কপিলাবতার কাহিনী, বেণ- রাজ-চরিত, ধ্রুব-চরিত, সূর্যবংশ ও চন্দ্রবংশের পরিচয়, শ্রীকৃষ্ণচরিত, মথুরা ও বৃন্দাবনলীলা, যদুবংশ ধ্বংসের কাহিনী, শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু কাহিনী।
(৬) নারদীয় পুরাণ—এই পুরাণে রয়েছে বিষ্ণুস্তুতি, বৈষ্ণবধর্ম, হরিভক্তি ইত্যাদি। (৭) মার্কণ্ডেয়পুরাণ—জৈমিনীর প্রশ্নসমূহ ও মার্কণ্ড মুনির দেওয়া উত্তর নিয়ে এই পুরাণের শুরু। এ ছাড়া আছে বশিষ্ট মুনি ও বিশ্বামিত্রের কলহ কাহিনী, চণ্ডী, দুর্গা ও শ্রীকৃষ্ণের কাহিনী, হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী, মদালসা-কাহিনী, রুদ্রের জন্ম, পুররবার কাহিনী ও যোগ।
(৮) অগ্নিপুরাণ—অগ্নি কর্তৃক ব্রহ্ম জ্ঞান দেওয়াই এই পুরাণের মূল উদ্দেশ্য । সঙ্গে আছে শিব মাহাত্ম্য প্রচার। আছে বিষ্ণু পূজার নিয়ম, শালগ্রাম লক্ষণ ও পূজা পদ্ধতি, শ্রাদ্ধবিধি, তীর্থ মাহাত্ম্য, প্রায়শ্চিত্তবিধি, গায়ত্রী-অর্থ, ধনুর্বিদ্যা, পশুচিকিৎসা ইত্যাদি।
(৯) ভবিষ্যপুরাণ—এতে আছে সৃষ্টি, চতুবর্ণের সংস্কার ও আশ্রমধর্ম, কৃষ্ণ, শাম্ব বশিষ্ট, নারদ, ব্যাস ও সূর্যের মাহাত্ম্য বর্ণনা।
(১০) ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ—চার খণ্ডে আছে ব্রহ্মা, প্রকৃতি, গণেশ ও কৃষ্ণ মাহাত্ম্য ৷ এ’ছাড়াও আছে স্বহা, স্বধা, সুরথ, কার্তবীর্য, সাবিত্রী-সত্যবান, পরশুরাম ইত্যাদির কাহিনী।
(১১) লিঙ্গপুরাণ—এতে রয়েছে, লিঙ্গের উৎপত্তি (শিবের), লিঙ্গ পূজা, লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা পদ্ধতি, শিবের ব্রত, কাশী মাহাত্ম্য, শিবের সহস্র নাম, দক্ষযজ্ঞ, মদনভষ্ম, শিব-পার্বতীর বিয়ে, শিবের নৃত্য, শিব মাহাত্ম্য, শিব পূজাবিধি ইত্যাদি। এ’ছাড়াও আছে বরাহচরিত, নৃসিংহচরিত, অভিমন্যু-উপাখ্যান।
(১২) বরাহপুরাণ—এতে রয়েছে বিষ্ণুর বরাহ অবতার হওয়ার কাহিনী। এছাড়াও রয়েছে শ্রাদ্ধবিধি, ব্রতবিধি, গৌরীর উৎপত্তি, মহিষাসুর বধের জন্য তিন প্রধান দেবতার শক্তি থেকে দেবীর উৎপত্তি ও দেবী মাহাত্ম্য ইত্যাদি।
(১৩) স্কন্ধপুরাণ—এতে রয়েছে সাতটি খণ্ড। (১) মহেশ্বরখণ্ড, (২) বৈষ্ণবখণ্ড, (৩) ব্ৰহ্মখণ্ড, (৪) কাশীখণ্ড, (৫) অবন্তীখণ্ড, (৬) নাগরখণ্ড, (৭) প্রভাসখণ্ড ।
(১৪) বামনপুরাণ—বিষ্ণুর বামন হয়ে বলি রাজার সঙ্গে ছলনা কাহিনী-ই প্রধান। এ’ছাড়া আছে, মহিষাসুর বধ কাহিনী, দক্ষযজ্ঞ, মদনভস্ম, শিব-উমার বিয়ে ও তীর্থ- মাহাত্ম্য বর্ণনা।
(১৫) কূর্মপুরাণ – বিষ্ণুর কূর্ম অবতার হওয়ার কাহিনী-ই প্রধান। এছাড়া আছে ভৃগুবংশচরিত, পার্বতীর সহস্র নাম, ব্যাসগীতা, ঈশ্বরগীতা, তীর্থ-মাহাত্ম্য, বর্ণপ্রথা জাতিসংকর নিয়ে আলোচনা।
(১৬) মৎস্যপুরাণ—প্রধান বিষয় বিষ্ণুর মৎস্য অবতার হওয়া। মনুর সঙ্গে মৎস্যাবতারের কথোপকথন ইত্যাদি।
(১৭) গরুড়পুরাণ—বিনতার গর্ভে গরুড়ের জন্ম-কাহিনী, বিষ্ণুর সহস্র নাম, যম, শ্রাদ্ধ, মৃত্যুর পরে যা ঘটে তার বর্ণনা। এতে দীক্ষাবিধি, প্রায়শ্চিত্তবিধি ও আয়ুর্বেদের কথা আছে।
(১৮) ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ—চারটি খণ্ডে বিভক্ত। (১) প্রক্রিয়াপাদ, (২) অনুষঙ্গপাদ (৩) উপাদঘাত, (৪) উপসংহারপাদ। এতে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি কাহিনী, যুগভেদ, রাজবংশ পরিচয় ও ভারতবর্ষসহ বিভিন্ন দ্বীপের বর্ণনা রয়েছে।
এইসব পুরাণ ছাড়া ১৮টি উপপুরাণ আছে। উপপুরাণের নাম : (১) সনৎকুমার, (২) নর-সিংহ, (৩) নারদীয়, (৪) শিব, (৫) দুর্বাসা, (৬) কপিল, (৭) মানব, (৮) ঐষনস, (৯) বরুণ, (১০) কালিকা, (১১) শাম্ব, (১২) নন্দী, (১৩) সৌর, (১৪) পরাশর, (১৫) আদিত্য, (১৬) মহেশ্বর, (১৭) ভাগবত, (১৮) বশিষ্ঠ।
এইসব পুরাণ ও উপপুরাণে পুরুষ দেবতা ও মুনি-ঋষিদের মাহাত্ম্যই প্রাধান্য পেয়েছে। দেবীরা প্রায় নেই বললেই চলে। বৈদিক সাহিত্যের এই ধারা থেকেও বুঝতে অসুবিধে হয় না—সে’সময়ের সমাজ ছিল পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক।
বিভিন্ন পুরাণে বলা হয়েছে চারটি যুগের কথা। যুগগুলো হলো (১) সত্য, (২) ত্রেতা, (৩) দ্বাপর, (৪) কলি। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী ‘চিন্তাবিদ’ বা ‘দার্শনিক’রা
এই যুগ-ভাগে বিশ্বাস করেন। টেলিভিশনের ‘ধর্ম চ্যানেল’ ও ‘তন্ত্র চ্যানেল’ খুললে- ই হাতে-গরম প্রমাণ পাবেন। পুরাণ অনুসারে সত্যযুগের স্থায়িত্ব কাল ১৭ লক্ষ ২৮ হাজার বছর। ত্রেতা যুগ টিকে ছিল ১২ লক্ষ ৯৬ হাজার বছর। দ্বাপর যুগ চলেছিল ৮ লক্ষ ৬৪ হাজার বছর। মনুষ্য সভ্যতা এই তিন যুগ অতিক্রম করে বর্তমানে কলিযুগে অবস্থান করছে। কলিযুগ স্থায়ী হবে ৪ লক্ষ ৩২ হাজার বছর।
কলিযুগের মানব সভ্যতা কত বছর অতিক্রম করেছে—তা জানেন শুধু তান্ত্রিক, ধর্মগুরু, ভাববাদী-দার্শনিক ইত্যাদিরা ?
মানব সভ্যতা সত্য, ক্রেতা, দ্বাপর এই তিন যুগে মোট ৩৮ লক্ষ
৮৮ হাজার বছর অতিক্রম করে এসেছে এমনটা যাঁরা
ভাবেন, তাঁদের ‘বোকা’ বললেন
বোকাদের-ই অসম্মান করা হয়।
পুরাণগুলোর যে রূপ বর্তমানে আমরা দেখি, সেগুলো রচিত হয়েছিল গুপ্ত যুগে । মতামত আমায় নয়, রোমিলা থাপারের মত কিছু ঐতিহাসিকের।
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ৫ম খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
অধ্যায়ঃ এক
ধর্মঃ সংজ্ঞায় গোলমাল
অধ্যায়ঃ দুই
উপাসনা ধর্মঃ প্রাচীন মত
♦ উপাসনা- ধর্মের (religion) উৎপত্তি
♦ একঃ দৈব-প্রত্যাদেশ বা অপৌরুষেয় প্রত্যাদেশ
♦ দুইঃ ঈশ্বরে বিশ্বাস; সহজাত প্রবৃত্তি
♦ তিনঃ ধর্মীয় আচরণ বাদে ঈশ্বর বিশ্বাস
♦ আধুনিক নাস্তিক্যবাদ ‘মার্কসবাদ’
অধ্যায়ঃ তিন
‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ নাস্তিক্যবাদের সঙ্গে বাড়তি কিছু
♦ ‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ চির নতুন
♦ তোমার আমার দুই চেতনার ভালো-খারাপ
♦ মারাদোনার পায়ের জাদু ও যুক্তিবাদ
♦ প্রেমের রহস্যময়তা ও যুক্তিবাদ
♦ ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস’, ‘বিজ্ঞানের বিশ্বাস’ : আকাশ-পাতাল
অধ্যায়ঃ চার
উপাসনা ধর্মঃ আধুনিক মত
♦ উপাসনা-ধর্ম : নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিতে
অধ্যায়ঃ পাঁচ
ভারতবর্ষের জাদু সংস্কৃতি
♦ আদিম উপজাতি, আধুনিক উপজাতিঃ একই কথা
♦ ধর্মীয় জাদু বিশ্বাস ও ম্যাজিক শোঃ দুই পৃথিবী
অধ্যায়ঃ ছয়
তন্ত্রের প্রথম ধাপ যোগ, তারপর…
অধ্যায়ঃ সাত
বৈদিক সাহিত্য, জাদু-বিশ্বাস, যজ্ঞে যৌনাচার
♦ সত্য খোঁজে মুক্তমন, হিসেব কষে ভন্ড
♦ বৈদিক সাহিত্যের গপ্পো ও দুই ডাক্তার
♦ বৈদিক সাহিত্যে জাদু-বিশ্বাস, যজ্ঞের নামে যৌনাচার
অধ্যায়ঃ আট
হিন্দু উপাসনা-ধর্মে তন্ত্র
অধ্যায়ঃ নয়
শক্তিধর্মে তন্ত্র
অধ্যায়ঃ দশ
রেইকি গ্রাণ্ডমাষ্টার, ফেং শুই ক্ষমতার দাবিদার, জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের প্রতি