ভারতবর্ষের প্রাক-বৈদিক উপাসনা-ধর্ম ছিল মূলত লিঙ্গ ও যোনির পুজো এবং নারী-পুরুষ মিলনসর্বস্ব যোগ ও তন্ত্র-সাধনা। আমরা আগেই আলোচনা করেছি, এইসব দেহ-সর্বস্ব সাধনা এসেছিল উর্বরতামূলক জাদু-বিশ্বাস থেকে।
মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য লিঙ্গ ও যোনির মূর্তি। পাওয়া গিয়েছে যোগভঙ্গিতে বসা দেবতা-মূর্তি। যোগ সাধনা যে প্রাক্ বৈদিক যুগে ছিল এইসব যোগী-মূর্তি দেখে তা অনুমান করতে অসুবিধে হয় না। তন্ত্রের প্রবেশ যোগের হাত ধরেই।
হরপ্পা সভ্যতার আনুমানিক সময় ২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই সময়ের শীলগুলোতে বিভিন্ন ক্ষোদিত মূর্তির সঙ্গে লিপিও খোদিত ছিল। এমন শীল পাওয়া গেছে হাজার দু’য়েক। লিপিগুলোর পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি। তবে এ’বিষয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেছে, হরপ্পার যুগে লিপি বা বর্ণমালা ছিল।
আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আর্যভাষী জনগোষ্ঠীর একাধিক শাখা ইরান থেকে আফগানিস্তান ও ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। ইন্দো- ইয়োরোপীয় জনগোষ্ঠীর শাখা ইরানে বসবাস শুরু করেছিল। এরাই আর্যভাষী। এদের
অন্তত দু’টি শাখার একটি ঢুকেছিল খাইবার গিরিপথ দিয়ে কাবুল উপত্যকায় । অন্য শাখাটি ঢুকেছিল হিন্দুকুশ পর্বতমালার গিরিপথ দিয়ে ভারতবর্ষে।
‘আর্য’ আসলে কোনও জাতিগোষ্ঠীর নাম নয়। একটি গোষ্ঠী-ভাষার
নাম। আর্য শব্দটি আমরা ভুল ভাবে ব্যবহার করছি বলে
মনে করেন রোমিলা থাপার থেকে ইরফান
হাবিবের মত পণ্ডিত ঐতিহাসিকরা।
আর্যভাষীরা লোহার ব্যবহার জানতো। ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করতো। যাযাবর জাতি হিসেবে পশুপালন ও মৃগয়া দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতো। কৃষি জানতো না। লিপি বা বর্ণমালা ছিল অজানা। তাই আর্যভাষীদের সাহিত্য ছিল ‘শ্রুতি’। অর্থাৎ একজন গুরু বেদ বা অন্যান্য বৈদিক সাহিত্যের মন্ত্র বা স্তোত্র বা সূত্ত আবৃত্তি করতেন, ছাত্রকুল সমস্বরে তাই পাঠ করতেন। বৈদিকযুগের উচ্চবর্ণের মানুষরা সম্ভবত ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লিপি আবিষ্কার করেছিলেন। হরপ্পা যুগের পরবর্তীতে ভারতে প্রথম লিপি যা পাওয়া যায়, তা ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। ওইসব লিপি পড়ে মনে হয় ৫০০ খ্রিস্টাব্দে লিপি ছিল।
মনু ছিলেন বৈদিক যুগের অর্থাৎ আর্য ভাষাগোষ্ঠীদের ধর্মীয় আইন গ্রন্থের প্রথম প্রণেতা। মনুস্মৃতির টীকাকার কুল্লুকভট্ট বলেছেন—শ্রুতি দু’রকমের। (১) তান্ত্রিক, (২) বৈদিক। তান্ত্রিক ধারাটি ছিল নারী-পুরুষের দৈহিক মিলনের মধ্য দিয়ে ব্ৰহ্মকে জানার প্রক্রিয়া। এরা লিঙ্গ ও যোনির পুজো করতো।
বৈদিক ধারাতে যদিও বহু দেবতা ছিলেন, তাঁদের সন্তুষ্ট করতে নানা প্ৰাৰ্থনা : মন্ত্র যেমন ছিল, তেমনই যাগ-যজ্ঞের প্রচলন ছিল। ঠিক-ঠাক ভাবে যজ্ঞ করলে অভিষ্ট ফল পাওয়া যেত। এ’ক্ষেত্রে দেবতাদের ভূমিকা ছিল গৌণ। এটাই ছিল বৈদিক ধর্মের মূল ধারা
বৈদিক যুগের ঋষি বা জাদুপুরোহিতরা শুরুতে যোগ সাধনা বা তন্ত্র সাধনাকে মোটেই ভালোভাবে নেয়নি। বরং এইসব ধর্মীয় বিশ্বাসকে তাদের নিয়ে আসা ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরোধী বা শত্রু বলে মনে করেছিল। বৈদিক সাহিত্য কৌষীতকি উপনিষদে (৩,১) আমরা তার পরিচয় পাচ্ছি। সেখানে দেবরাজ ইন্দ্র যোগীদের নেকড়ের মুখে ছুড়ে ফেলছেন। নেকড়েরা যোগীদের ছিঁড়ে খাচ্ছে। আমরা ঋকবেদে পাচ্ছি, লিঙ্গ ওযোনি-উপাসকদের নগর ধ্বংস করছেন ইন্দ্র। যোগীদের শাস্তি দিতে ছুড়ে ফেলছেন নেকড়ের মুখে।
ঋকবেদের আনুমানিক রচনাকাল ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে। অন্যান্য বৈদিক সাহিত্য ঋগ্বেদের পরে রচিত। রামায়ণ, মহাভারতের ঘটনাবলীর সময়কাল ১০০০ থেকে ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। মহাভারতের অনুসাশনপর্বে দেখতে পাচ্ছি—কৃষ্ণের কাছে অভিমন্যু এই বলে শিবের প্রশংসা করছেন যে, শিবই একমাত্র দেবতা যার লিঙ্গ সর্বত্র পূজিত হয়। এ’থেকে আমরা বুঝতে পারি যে,
বৈদিক মানুষরা যে’সব দেব-পূজায় বিশ্বাস নিয়ে সিন্ধু অঞ্চলে পা রেখেছিল,
সময়ের সঙ্গে তাতে অনুপ্রবেশ ঘটেছিল প্রাক্-বৈদিক যুগের মানুষদের
ধর্মীয় বিশ্বাসের। অনুপ্রবেশের শুরুতে প্রাচীনপন্থী বৈদিকদের
সঙ্গে নব্য-বৈদিকদের দ্বন্দ্ব অবধারিতভাবে এসেছিল। কিন্তু
শেষ পর্যন্ত প্রাক-আর্য-যুগের লিঙ্গ যোনির পুজো
ও যোগ-তন্ত্র ইত্যাদি বৈদিক ধর্মীয়
বিশ্বাসে ঢুকে পড়েছিল।
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ৫ম খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
অধ্যায়ঃ এক
ধর্মঃ সংজ্ঞায় গোলমাল
অধ্যায়ঃ দুই
উপাসনা ধর্মঃ প্রাচীন মত
♦ উপাসনা- ধর্মের (religion) উৎপত্তি
♦ একঃ দৈব-প্রত্যাদেশ বা অপৌরুষেয় প্রত্যাদেশ
♦ দুইঃ ঈশ্বরে বিশ্বাস; সহজাত প্রবৃত্তি
♦ তিনঃ ধর্মীয় আচরণ বাদে ঈশ্বর বিশ্বাস
♦ আধুনিক নাস্তিক্যবাদ ‘মার্কসবাদ’
অধ্যায়ঃ তিন
‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ নাস্তিক্যবাদের সঙ্গে বাড়তি কিছু
♦ ‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ চির নতুন
♦ তোমার আমার দুই চেতনার ভালো-খারাপ
♦ মারাদোনার পায়ের জাদু ও যুক্তিবাদ
♦ প্রেমের রহস্যময়তা ও যুক্তিবাদ
♦ ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস’, ‘বিজ্ঞানের বিশ্বাস’ : আকাশ-পাতাল
অধ্যায়ঃ চার
উপাসনা ধর্মঃ আধুনিক মত
♦ উপাসনা-ধর্ম : নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিতে
অধ্যায়ঃ পাঁচ
ভারতবর্ষের জাদু সংস্কৃতি
♦ আদিম উপজাতি, আধুনিক উপজাতিঃ একই কথা
♦ ধর্মীয় জাদু বিশ্বাস ও ম্যাজিক শোঃ দুই পৃথিবী
অধ্যায়ঃ ছয়
তন্ত্রের প্রথম ধাপ যোগ, তারপর…
অধ্যায়ঃ সাত
বৈদিক সাহিত্য, জাদু-বিশ্বাস, যজ্ঞে যৌনাচার
♦ সত্য খোঁজে মুক্তমন, হিসেব কষে ভন্ড
♦ বৈদিক সাহিত্যের গপ্পো ও দুই ডাক্তার
♦ বৈদিক সাহিত্যে জাদু-বিশ্বাস, যজ্ঞের নামে যৌনাচার
অধ্যায়ঃ আট
হিন্দু উপাসনা-ধর্মে তন্ত্র
অধ্যায়ঃ নয়
শক্তিধর্মে তন্ত্র
অধ্যায়ঃ দশ
রেইকি গ্রাণ্ডমাষ্টার, ফেং শুই ক্ষমতার দাবিদার, জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের প্রতি