বেদ রচিত হয়েছিল ১৫০০ থেকে ১০০০ খৃষ্টপূর্বে। সে-যুগের ঋষিরা বেদকে লিপিবদ্ধ না করে কন্ঠস্থ করে রাখতেন। বিপুল সংখ্যক শ্লোকগুলো তাঁরা যে অসাধারণ স্মৃতির মাধ্যমে বিশুদ্ধ উচ্চারণে, সুর ও ছন্দ বজায় রেখে কন্ঠস্থ রেখেছিলেন, তা বাস্তবিকই অতি-বিস্ময়কর।

প্রাচীন যুগে স্মৃতির সাহায্যেই গুরু শিক্ষাদান করতেন। শিষ্যরাও তা স্মৃতিতেই ধরে রাখতেন এবং পরবর্তীকালে স্মৃতিকে কাজে লাগিয়েই শিক্ষা দিতেন। স্বভাবতই সে যুগের পণ্ডিত ও শিক্ষাগুরুদের স্মৃতি হয়ে উঠেছিল অসাধারণ। তাঁদেরই কিছু কিছু প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থিত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ (recessive) জিন বিবর্তন পরম্পরায় বাহিত হয়ে বহু প্রজন্ম পরে কোনও ব্যক্তির মধ্যে এসে থাকতে পারে। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জিন ঋষিরা পেয়েছিলেন কোন পূর্বপুরুষের থেকে? আসলে এঁরা শ্লোকগুলো স্মৃতিতে ধরে রাখতে তীব্রভাবে আগ্রহী ছিলেন এবং প্রয়োজনে স্মৃতিতে ধরে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন।

এত দীর্ঘ সময় কি জিন প্রচ্ছন্নভাবে নিজ বৈশিষ্ট্যকে বজায় রাখতে সক্ষম? এই প্রশ্নের উত্তরে এই তত্ত্বে বিশ্বাসী মনোবিজ্ঞানীরা উদাহরণ হাজির করেন- অনেক শিশু জন্মায় মনুষ্যেতর প্রাণীর অঙ্গ নিয়ে- যেমন ছোট্ট ‘লেজ’ একটি দৃষ্টান্ত। তাঁদের মতে মনুষ্যেতর যে প্রাণীটি অতীতে ছিল, তারই প্রচ্ছন্ন জিনের বর্তমান উপস্থিতিই এর জন্য দায়ী।

একান্ত প্রয়োজনে ঋষিরা বা গুরুরা শাস্ত্রকে স্মৃতিতে ধরে রাখতেন; তেমন উদাহরণ এ যুগে আমাদের দেশে বিরল হলেও অসম্ভব নয়। বিদেশে প্রচুর উদাহরণ তো আছেই। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে তুমুল আলোড়ন তুলেছে কর্ণাটকের যুবক রাজেন শ্রীনিভাসন মহাদেবন। অংক শাস্ত্রে ‘পাই’ π এর অর্থ বৃত্তের পরিধিকে ব্যাস দ্বারা ভাগের ফল। এই ফল প্রায় ২২÷৭ এবং মোটামুটি ধরে নেওয়া হয় সংখ্যাটা ৩.১৪। কারণ দশমিকের পর সংখ্যার শেষ নেই। ৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫……… এভাবে চলতেই থাকবে। রাজন ১৯৮১ সালে ৫ জুলাই গিনিস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড-এর নেওয়া পরীক্ষায় দশমিকের পর ৩১, ৮১১ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো একের পর এক বলে গেছে নির্ভুল ভাবে স্মৃতি থেকে। সময় লেগেছিল ৩ ঘণ্টা ৫৯ মিনিট। প্রতি মিনিটে রাজন বলেছিল গড়ে ১৫৬.৭টি করে সংখ্যা। কি অসম্ভব দ্রুতগতিতে বলেছিল, ভাবতে অবাক হতে হয়। এখানেই রাজনের এই অনন্যসাধারণ স্মৃতি-শক্তির কার্য-কারণ জানতে আমেরিকান বিজ্ঞানীরা ১ লক্ষ ৫৭ হাজার ডলারের গবেষণা প্রকল্পে হাতে দিয়েছেন।

রাজেন শ্রীনিবাসন মহাদেবন

রাজন-বিস্ময় এখানেও শেষ নয়। ‘গীতা’ রাজনের মুখস্ত। স্মৃতি থেকে বলে যেতে পারে ব্র্যাডমানের লেখা ‘ফেরারওয়েল টু ক্রিকেট’ বইটির প্রতিটি লাইন, ভারতীয় রেলওয়ের ‘টাইম টেবিল’ ওর কন্ঠস্ত দূরত্ব, ভাড়া ও অন্যান্য তথ্য সবই স্মৃতি থেকে যখন তখন আহরণ করতে পারে।

বিদেশের প্রচুর উদাহরণ থেকে একটি দিই। জাপানের হিদোয়াকি টোমোওরি ১৯৮৭ সালে রাজনের গিনিস রেকর্ড ভেঙ্গে বলেছে দশমিকের পর ৪০ হাজার পর্যন্ত সংখ্যা। রাজনও ছাড়ার পাত্র নয়। প্রস্তুত হচ্ছে ১ লক্ষ সংখ্যা পর্যন্ত বলে রেকর্ডকে নিরাপদে রাখতে।

পানিহাটির এক পণ্ডিতের অসাধারণ স্মৃতির কথা আজও কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে। পণ্ডিতের নাম জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। তখন ইংরেজ আমল। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন একদিন নিত্যকার মত গেছেন গঙ্গা স্নানে। ঘাটে তখন দুই সাহেবের মধ্যে তুমুল ঝগড়া আর হাতাহাতি চলছে। কয়েক দিনের মধ্যে দুই সাহেবের লড়াই গড়ালো আদালতের কাঠগড়ায়। সাক্ষ্য দিতে পণ্ডিতের ডাক পড়ে। পণ্ডিত সাক্ষ্য দিতে গিয়ে দু’জনের হুবহু ইংরেজি কথোপকথন তুলে ধরেন বিচারকের সামনে। বাদী-বিবাদী দু-জনেই পণ্ডিতের বক্তব্যের সত্যতা মেনে নিলেন। বিচারক পণ্ডিতের স্মৃতিশক্তির পরিচয় পেয়ে অবাক। বললেন, “আপনি এতদিন আগের দু’জনের প্রতিটি কথা কি করে মনে রাখলেন? সত্যিই আপনার অসাধারণ স্মৃতি।“

পণ্ডিত তো সাহেবের ইংরেজি বুঝতে না পেরে এদিক-ওদিক মাথা নেড়ে পেশকারকে জিজ্ঞেস করলেন, “সাহেব কি বলছেন?”

পণ্ডিতকে পেশকার বললেন, “সে কি, আপনি ইংরেজি জানেন না?”

পণ্ডিত জানালেন, “না।“

“তাহলে দু-সাহেবের এত ঝগড়ার কথা মনে রাখলেন কি করে?”

পণ্ডিতের সরল জবাব, “সে তো শুনেছিলাম, তাই মনে ছিল।“

পেশকারের কাছে পণ্ডিতের কথা শুনে বিচারক তো আরও অবাক। এমন আশ্চর্য স্মৃতিও মানুষের হয়।

error: Content is protected !!