‘অশেষ দাতা ও অপরিসীম দয়ালু আল্লাহ্ তা’আলার নামে’
বিসমিল্লাহর বিশ্লেষণ
সাহাবায়ে কিরাম বিসমিল্লাহ্ দিয়া আল্লাহ্ তা’আলার কিতাব আল-কুরআনুল করীম শুরু করিয়াছেন। বিশেষজ্ঞদের সর্বসম্মত অভিমত এই যে, উহা সূরা নামলের একটি আয়াত। তবে উহা সূরাগুলির শুরুতে অবস্থিত আয়াত বা আয়াতের অংশ কিনা তাহাতে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আলিমদের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে।
একদল বলেন, উহা সূরা বারাআত ভিন্ন অন্য সকল সূরার প্রত্যেকটির পূর্বে অবস্থিত একটি পূর্ণ আয়াত। এই মতের পরিপোষক হইলেন হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ), হযরত ইব্ উমর (রাঃ), হযরত ইব্ন জুবায়র (রাঃ), হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ), ‘আতা, তাউস, সাঈদ ইব্ন জাবির, মাকহূল, যুহরী, আবদুল্লাহ ইব্ন মুবারক, ইমাম শাফেঈ। এক রিওয়ায়েত অনুযায়ী ইমাম আহমদ, ইসহাক ইব্ন রাহবিয়াহ্, আবূ উবায়দ আল-কাসিম ইব্ন সাল্লাম প্রমুখ।
ইমাম মালিক ও ইমাম আবূ হানীফা এবং তাঁহাদের শিষ্যবৃন্দ বলেন, উহা কোন সূরারই পূর্বে অবস্থিত আয়াত বা আয়াতাংশ নহে। তাহাদের মতে ‘বিসমিল্লাহ্’ কুরআন মজীদের কোন আয়াত নহে। সূরার প্রারম্ভে শুধুমাত্র বরকত হাসিলের জন্য উহা সংযোজিত হইয়াছে।
ইমাম শাফেঈর একটি অভিমত এই যে, উহা সূরা ফাতিহার শুরুতে অবস্থিত একটি আয়াত। তবে অন্য কোন সূরার পূর্বে অবস্থিত ‘বিসমিল্লাহ্’ সেই সূরার আয়াত নহে।’
ইমাম শাফেঈর অপর এক মতে উহা প্রত্যেক সূরার পূর্বে অবস্থিত সেই সূরার একটি আয়াতাংশ। অবশ্য তাঁহার এই শেষোক্ত অভিমত দুইটি আদৌ তাঁহার কিনা তাহা নিশ্চিত নহে।
দাউদ জাহেরী বলেন, উহা প্রত্যেক সূরার প্রারম্ভে অবস্থিত একটি স্বতন্ত্র আয়াত। তবে কোন সূরার অংশ নহে। ইমাম আহমদ হইতেও অনুরূপ একটি অভিমত বর্ণিত হইয়াছে ৷ আবূল হাসান কারখী হইতেও আবূ বকর রাযী অনুরূপ অভিমত উদ্ধৃত করিয়াছেন। আবূ বকর রাযী ও আবূল হাসান কারখী উভয়ই ইমাম আবূ হানীফার শীর্ষস্থানীয় শিষ্য ছিলেন। অন্যত্র এইসব ব্যাপার বিশদভাবে আলোচিত হইবে। এতক্ষণে ‘বিসমিল্লাহ’ শরীফের সূরা ফাতিহার আয়াত হওয়া প্রসঙ্গে উপরোক্ত আলোচনা করা হইল।
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে সহীহ সনদে ইমাম আবূ দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট بسم الله الرحمن الرحيم আয়াতটি নাযিল হইলেই তিনি বুঝিতেন, ‘একটি সূরা শেষ হইল এবং আরেকটি সূরা শুরু হইতেছে।’
হাকিম আবূ আবদুল্লাহ্ নিশাপুরীও স্বীয় সংকলন গ্রন্থ মুস্তাদরাকে উপরোক্ত হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। সাঈদ ইব্ন জুবায়র হইতেও উহা حدييث مرسل এখনও (বিচ্ছিন্ন) হিসাবে বর্ণিত হইয়াছে। হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) হইতে ইব্ন খুযায়মা তাঁহার ‘সহীহ’ নামক সংকলন গ্রন্থে বর্ণনা করেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) নামাযে সূরা ফাতিহার পূর্বে بسم الله الرحمن الرحيم পাঠ করিতেন।
হাদীসটি উম্মে সালামা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ইব্ন আবূ মালীকাহ, ইব্ন জুরায়জ, উমর ইব্ন হারূন বলখী প্রমুখ রাবী বর্ণনা করেন। অবশ্য উমর ইব্ন হারুন বলখী একজন দুর্বল রাবী। তবে ইমাম দারা কুতনী হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ)-এর মাধ্যমে স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী হিসাবে অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত আলী (কঃ), হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ হইতেও অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হইয়াছে।
উপরোল্লিখিত বিভিন্ন অভিমতের ভিত্তিতে বিভিন্ন ফকীহ সরব নামাযে বিসমিল্লাহ্ সরবে বা নীরবে পাঠ করা সম্পর্কে বিভিন্ন মত ব্যক্ত করিয়াছেন।
যাঁহারা উহাকে সূরা ফাতিহার অংশ কিংবা যে কোন সূরার পূর্বে অবস্থিত স্বতন্ত্র আয়াত বলেন না, তাঁহারা উহাকে সরবে পড়িতে নিষেধ করেন। যাঁহারা উহাকে সূরা ফাতিহা ও অন্যান্য সূরার পূর্বে অবস্থিত স্বতন্ত্র আয়াত বলেন, তাঁহারাও অনুরূপ মত ব্যক্ত করিয়াছেন। যাঁহারা বলেন, উহা সূরাসমূহের পূর্বে অবস্থিত উহাদের আয়াত বা আয়াতাংশ, তাঁহাদের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে।
ইমাম শাফেঈর মাযহাব এই যে, সরব নামাযে উহাকে সূরা ফাতিহা ও অন্যান্য সূরার সহিত সরবে পড়িতে হইবে। ইহা বিপুল সংখ্যক সাহাবা, তাবেঈ ও বিভিন্ন ইমামের মাযহাব ও বটে। হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ), হযরত ইবন উমর (রাঃ), হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) এবং হযরত মু’আবিয়া (রাঃ) উহা সরবে পড়িতেন। ইমাম ইব্ন আবদুল বার ও ইমাম বায়হাকী বর্ণনা করিয়াছেন যে, হযরত উমর (রাঃ) ও হযরত আলী (কঃ) উহা সরবে পড়িতেন। খতীব বর্ণনা করেন, খোলাফায়ে রাশেদীন উহা সরবে পড়িতেন। অবশ্য খতীবের বর্ণিত রিওয়ায়েতের কোন সমর্থন মিলে না। নিম্নোক্ত তাবেঈগণ উহা সরবে পড়িতেনঃ
সাঈদ ইব্ন জুবায়র, ইকরামা, আবূ কুলাবাহ, যুহরী, ‘আলী ইব্ন হাসান, মুহাম্মদ ইব্ন আলী ইব্ন হাসান, সাঈদ ইব্ন মুসাইয়্যাব, ‘আতা, তাউস, মুজাহিদ, সালেম, মুহাম্মদ ইব্ন কা’ব আল করযী, উবায়দ, আবূ বকর ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন আমর ইব্ন হাযম, আবূ ওয়ায়েল, ইব্ন সীরীন, মুহাম্মদ ইব্ন মুনকাদির, আলী ইব্ন আবদুল্লাহ্ ইব্ন আব্বাস, মুহাম্মদ ইব্ন আলী ইব্ন আবদুল্লাহ্ ইব্ন আব্বাস, নাফে’ [ইবন উমর (রা)-এর গোলাম], যায়দ ইব্ন আসলাম, উমর ইব্ন আবদুল আযীয, আযরাক ইন কায়স, হাবীব ইব্ন আবূ ছাবিত, শাছা’, মাকহুল এবং আব্দুল্লাহ ইব্ন মা’কাল।
উপরোল্লিখিত ব্যক্তিগণের পক্ষ হইতে উপস্থিত যুক্তি ও প্রমাণ এই যে, বিসমিল্লাহ যেহেতু সূরা ফাতিহা ও অন্যান্য সূরার অংশ, তাই সরব নামাযে সূরার অন্যান্য আয়াতের মতই উহা সরবে পড়িতে হইবে।
এতদ্ব্যতীত ইমাম নাসাঈ তাঁহার সুনান সংকলনে, ইব্ন খুযায়মা ও ইব্ন হাব্বান তাঁহাদের স্ব-স্ব ‘সহীহ’ সংকলনে এবং হাকিম তাঁহার মুস্তাদরাকে বর্ণনা করেনঃ
‘একদা হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) নামাযে সরবে বিসমিল্লাহ পড়িলেন। তারপর নামায শেষে বলিলেন, নবী করীম (সাঃ)-এর নামাযের সহিত আমার নামাযেরই অধিকতর সাদৃশ্য রহিয়াছে।’
ইমাম দারা কুতনী, ইমাম বায়হাকী ও খতীব প্রমুখ উহাকে সহীহ হাদীস বলিয়াছেন। ইমাম আবূ দাউদ ও ইমাম তিরমিযী হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ ‘নবী করীম (সাঃ) بسم الله الرحمن الرحيم দিয়া নামায আরম্ভ করিতেন।’
ইমাম তিরমিযী বলেন, উক্ত হাদীসের সনদ দুর্বল। হাকিম তাঁহার মুস্তাদরাক সংকলনে বর্ণনা করেনঃ
‘হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (সাঃ) নামাযে সরবে বিসমিল্লাহ্ পড়িতেন।’ হাকিম উক্ত হাদীসকে ‘সহীহ হাদীস’ বলিয়াছেন। ইমাম বুখারী বর্ণনা করেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ)-এর কিরাআত সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হইয়া হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (সাঃ) মদ্দের সহিত উহা টানিয়া টানিয়া পড়িতেন। তিনি মদ্দের সহিত ‘বিসমিল্লাহির মদ্দের সহিত ‘রাহমানির’ ও মদ্দের সহিত ‘রহীম’ পড়িতেন।’
হযরত উম্মে সালমা, (রাঃ) হইতে ইমাম আহমদ স্বীয় মুসনাদে, ইমাম আবূ দাউদ স্বীয় সুনানে ও হাকিম স্বীয় মুস্তাদরাকে বর্ণনা করেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) ওয়াকফ (বিরতি) সহ কিরাআত পড়িতেন। তিনি (বিরতি চিহ্নে থামিয়া থামিয়া) এইরূপে পড়িতেনঃ
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ – اَلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ – الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ –
مالِكِ يَوْمِ الدِّين –
ইমাম দারা কুতনী উহাকে ‘সহীহ হাদীস’ বলিয়াছেন। হযরত আনাস (রাঃ) হইতে হাকিম স্বীয় মুস্তাদরাকে এবং ইমাম আবূ আবদুল্লাহ শাফেঈ স্বীয় গ্রন্থে বর্ণনা করেনঃ
‘একদা হযরত মু’আবিয়া (রাঃ) মদীনা শরীফে নামায আদায় করিতে গিয়া উহাতে بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ পড়িলেন না। উপস্থিত মুহাজির সাহাবাবৃন্দ উক্ত কার্যের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করিলেন। দ্বিতীয়বার তিনি বিসমিল্লাহ সহ নামায আদায় করিলেন।
নামাযে সরবে বিসমিল্লাহ্ পড়ার সপক্ষে উপরোক্ত হাদীস ও আছারই যথেষ্ট। উক্ত অভিমতের বিশুদ্ধতা প্রমাণের জন্য আরও হাদীস ও আছারের উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। উহার বিরোধী অসমর্থিত হাদীস ও রিওয়ায়েতের পর্যালোচনা, সেইগুলির সনদের দুর্বলতা ও সবলতা ইত্যাদি আলোচনার স্থান ইহা নহে। অন্যত্র তাহা আলোচনা করা হইবে।
আরেকদল ফকীহ ও বিশেষজ্ঞের অভিমত এই যে, মুসল্লীরা নামাযে বিসমিল্লাহ্ নীরবে পড়িবে। ইহা খোলাফায়ে রাশেদীন, হযরত আবদুল্লাহ ইব্ন মুগাফ্ফাল (রাঃ), বিপুল সংখ্যক তাবেঈ এবং পরবর্তী যুগের ফকীহ ইমাম আবূ হানীফা, সুফিয়ান ছাওরী ও ইমাম আহমদের অভিমত।
ইমাম মালিক বলেন, মুসল্লীরা সরবে কি নীরবে কোনভাবেই বিসমিল্লাহ্ পড়িবে না। ইমাম মালিকের সমর্থকগণ তাঁহার অভিমতের সপক্ষে নিম্নলিখিত রিওয়ায়েত পেশ করেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেনঃ ‘নবী করীম (সাঃ) তকবীর বলিয়া নামায আরম্ভ করিতেন। الْحْمْد لله رب الْمَالَميُْنْ বলিয়া কিরাআত আরম্ভ করিতেন।’
ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেনঃ ‘হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি নবী করীম (সাঃ), হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ), হযরত উমর (রাঃ) ও হযরত উসমান (রাঃ)-এর পিছনে নামায পড়িয়াছি। তাঁহারা ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ দ্বারা (কিরাআত) শুরু করিতেন।’ ইমাম মুসলিমের বর্ণনায় ইহাও রহিয়াছে যে, তাঁহারা কিরাআতের পূর্বে বা পরে বিসমিল্লাহ্ পড়িতেন না।’
হযরত আবদুল্লাহ ইব্ন মুগাফ্ফাল (রাঃ) হইতেও ‘সুনান’ সংকলনে অনুরূপ রিওয়ায়েত বর্ণিত হইয়াছে ।
উপরে ভিন্ন ভিন্ন মতের সপক্ষে বিভিন্ন রিওয়ায়েত পেশ করা হইল। উপরোক্ত অভিমতসমূহের মধ্যকার পার্থক্য খুবই সামান্য। কারণ, এই ব্যাপারে সকলেই একমত যে, সরবে কি নীরবে বিসমিল্লাহ্ পাঠকারী সকলের নামাযই শুদ্ধ হইবে। সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা’আলার উদ্দেশ্যে নিবেদিত ও সকল অনুগ্রহ তাঁহারই তরফ হইতে সমাগত।
বিসমিল্লাহর ফযীলত
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে তাউস, ওয়াহাব আল-জুনদী, সালাম ইব্ন ওয়াহাব আল-জুনদী, যায়দ ইব্ন মুবারক সানআনী, জা’ফর ইব্ন মুসাফির, আবূ হাতিম, আল্লামা ইমাম আবিদ আবূ মুহাম্মদ আবদুর রহমান ইব্ন আবূ হাতিম স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে বর্ণনা করেনঃ
‘একদা হযরত উসমান (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট بسماللّه الرحمن الرحيم সম্পর্কে প্রশ্ন করিলে তিনি বলেন, “উহা আল্লাহ্ তা’আলার একটি নাম। চোখের পুতুল ও উহার শ্বেতাংশ যেরূপ পরস্পর সন্নিহিত ও ঘনিষ্ঠ, আল্লাহ্ তা’আলার শ্রেষ্ঠতম নাম ও বিসমিল্লাহ সেরূপ পরস্পর সন্নিহিত ও ঘনিষ্ঠ।”
আবূ বকর ইব্ন মারদুবিয়্যাও উপরোক্ত হাদীসটি উহার অন্যতম রাবী যায়দ ইব্ন মুবারক হইতে উহার ঊর্ধ্বতন সনদাংশ সহ ও পরবর্তী স্তরে ধারাবাহিকভাবে আলী ইব্ন মুবারক ও সুলায়মান ইব্ন আহমদের সনদে বর্ণনা করেন।
হযরত আবূ সাঈদ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আতিয়্যা, মুসআব, ইসমাঈল ইব্ন ইয়াহিয়া, ইসমাঈল ইব্ন আইয়াশ এবং পরবর্তী স্তরে ভিন্ন ভিন্ন দুইটি সূত্রে হাফিজ ইব্ন মারদুবিয়্যা বর্ণনা করেনঃ
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘হযরত ঈসা (আঃ)-এর মাতা তাঁহাকে শিক্ষকের নিকট অর্পণঃ করিলেন যাহাতে শিক্ষক তাঁহাকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদান করেন। শিক্ষক তাঁহাকে বলিলেন ‘লিখ’। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কি লিখিব? শিক্ষক বলিলেন, লিখঃ بسماللّه الرحمن الرحيم তিনি প্রশ্ন করিলেন, বিসমিল্লাহ্ অর্থ ও তাৎপর্য কি? তিনি বলিলেন الباء অক্ষরের তাৎপর্য হইতেছে بهاء (মহান মর্যাদা), السين অক্ষরের তাৎপর্য হইতেছে شناء (নূর বা জ্যোতি), الميم অক্ষরের তাৎপর্য হইতেছে مملكة (সার্বভৌম ক্ষমতা), الله শব্দের অর্থ হইতেছে (সকল প্রভুর প্রভু), الرحمن শব্দের অর্থ হইতেছে, দুনিয়া ও আখিরাতের করুণাদাতা এবং الر حيم শব্দের অর্থ হইতেছে, আখিরাতে কৃপা বর্ষণকারী।
হযরত আবূ সাঈদ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আতিয়্যা, মুসআব ও ইবন মাসউদ, জনৈক অজ্ঞাতনামা বর্ণনাকারী, ইব্ন আবূ মালীকাহ, ইসমাঈল ইব্ন ইয়াহিয়া, ইসমাঈল, ই আইয়াশ, ইবরাহীম ইব্ন আ’লা ওরফে ইব্ন রিবরীক প্রমুখ বর্ণনাকারীর সূত্রে ইব্ন জারীরও উপরোক্ত রিওয়ায়েত উদ্ধৃত করেন। তবে উপরোক্ত রিওয়ায়েত অন্য কোন সনদে বর্ণিত হয় নাই। হয়ত উহা নবী করীম (সাঃ) ভিন্ন অন্য কাহারও উক্তি। ইহাও হইতে পারে যে, উহা ইসরাঈলীদের মনগড়া কাহিনী। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ। ইব্ন জুয়াইবির অনুরূপ একটি কাহিনী যিহাক হইতে তাহার নিজস্ব উক্তি হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন।
আবূ বুরাইদার পিতা হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ বুরাইদা সুলাইমান ইব্ন বুরাইদা অথবা আবদুল করীম আবূ উমাইয়া, ইয়াযীদ ইব্ন খালিদ প্রমুখ রাবীর সনদে ইব্ন মারদুবিয়্যা বর্ণনা করেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলেন, আমার প্রতি এমন একটি আয়াত নাযিল হইয়াছে যাহা সুলায়মান (আ) ও আমি ভিন্ন অন্য কোন নবীর প্রতি নাযিল হয় নাই। উহা হইতেছে, بسماللّه الرحمن الرحيم
হযরত জাবির ই আবদুল্লাহ্ হইতে ধারাবাহিকভাবে আতা ইব্ন আবূ রিহাহ, উমর ইব্ন যর, মু’আফী ইব্ন ইমরান, আবদুল করীম কবীর ইবন মু’আফী ইব্ন ইমরান ও ইমাম ইবন মারদুবিয়্যা বর্ণনা করেনঃ
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ নাযিল হইবার পর মেঘ পূর্বদিকে সরিয়া গেল, বায়ু প্রবাহ বন্ধ হইয়া গেল, সমুদ্র তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল, চতুষ্পদ প্রাণীসমূহ উৎকর্ণ হইল, অগ্নিপিণ্ড নিক্ষিপ্ত হইয়া আকাশ শয়তানমুক্ত হইল এবং আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় মর্যাদা ও পরাক্রমের শপথ করিয়া বলিলেন- তাঁহার এই নাম যাহাতে উৎকীর্ণ হইবে তাহাতেই তিনি বরকত দিবেন।
হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ওয়ায়েল, আ’মাশ ও ওয়াকী বর্ণনা করেনঃ
‘যদি কেহ জাহান্নামের ঊনিশ দারোগার হাত হইতে আল্লাহর রহমতে মুক্তি পাইতে চায় তাহা হইলে সে যেন بسماللّه الرحمن الرحيم পাঠ করে। আল্লাহ্ তা’আলা উহার এক এক অক্ষরকে তাহার এক এক দারোগার হাত হইতে রক্ষাকারী বানাইবেন।’
ইবন আতিয়্যা এবং কুরতুবীও উক্ত বর্ণনা উদ্ধৃত করিয়াছেন। ইবন আতিয়্যা উহার তাৎপর্যও বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি উহার সমর্থনে নিম্নোক্ত হাদীস পেশ করিয়াছেনঃ
‘একদা এক ব্যক্তি رينا ولك الخمد حمدا كثيرا طيبا مباركا দোয়াটি পাঠ করিলে নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, আমি দেখিতে পাইলাম যে, ত্রিশোর্ধ সংখ্যক ফিরিশতা উহা লইয়া দ্রুত যাইতেছেন।’
উক্ত দোয়ায় ত্রিশোর্ধ সংখ্যক অক্ষর রহিয়াছে বলিয়াই উহার নেকীবাহক ফেরেশতার সংখ্যাও ত্রিশোর্ধ ছিল। ইবন আতিয়্যা হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর উক্ত অভিমতের সমর্থনে এইরূপ আরও হাদীস পেশ করিয়াছেন।
নবী করীম (সাঃ) এর সওয়ারীতে তাঁহার পশ্চাতে উপবেশনকারী জনৈক সাহাবা হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ তামীমা, ‘আসিম, শু’বা, মুহাম্মদ ইব্ন জা’ফর ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করেনঃ
‘সওয়ারী সহচর বলেন, একদিন নবী করীম (সাঃ) সহ তাঁহার সওয়ারী হোঁচট খাইল। আমি বলিয়া উঠিলাম, শয়তান গোল্লায় যাউক। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন, শয়তান গোল্লায় যাউক কথাটি বলিও না। উহা বলিলে শয়তান গর্বে ফুলিয়া ওঠে এবং ভাবে ‘আমিই তাহাকে নিজ ক্ষমতায় ফেলিয়া দিয়াছি।’ পক্ষান্তরে যদি ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ কর তাহা হইলে সে দুঃখ ও সংকোচে ক্ষুদ্র মক্ষিকার মত হইয়া যাইবে।
আবুল মালীহ ইবন উসামা ইবন উমায়র হইতে ধারাবাহিকভাবে তামীমা হাজিমী, খালিদ হাজ্জা প্রমুখ রাবীর সনদে ইমাম নাসাঈ তাঁহার ‘আল ইয়াওমু ওয়াল লায়লা’ গ্রন্থে এবং ইব্ন মারদুবিয়্যা তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে বর্ণনা করেনঃ
“একদিন আমি নবী করীম (সাঃ)-এর সওয়ারীতে তাঁহার পশ্চাতে উপবিষ্ট ছিলাম।’ অতঃপর রাবী উপরোক্ত ঘটনা উল্লেখের পর বলেন, ‘নবী করীম (সাঃ) আমাকে বলিলেন, এইরূপ বলিও না, উহাতে শয়তান ফুলিয়া উঠিয়া ঘরের মত (বিশাল বস্তু) হইয়া যাইবে। বরং ‘বিসমিল্লাহ্’ বলিও। উহাতে সে মক্ষিকার মত হইয়া যাইবে।”
বিসমিল্লাহ্ বরকত ও প্রভাবেই শয়তানের এই দশা ঘটে। এই কারণেই প্রত্যেক কথা ও কার্যের পূর্বে বিসমিল্লাহ্ বলা মুস্তাহাব। নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘বিসমিল্লাহ্ ব্যতীত কোন কাজ শুরু হইলে উহা বরকতশূন্য থাকে।’ পায়খানায় যাওয়ার সময়ও বিসমিল্লাহ্ বলা মুস্তাহাব। অনুরূপ মর্মে একটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। ওযূ করার সময় বিসমিল্লাহ্ বলা মুস্তাহাব।
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) এবং হযরত আবূ সাঈদ ইব্ন যায়দ (রাঃ) হইতে মুসনাদে আহমদ ও সুনান সংকলনে বর্ণিত হইয়াছেঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, لا وضوء لمن لم يذكر اسم اللّه غليه অর্থাৎ “যে ব্যক্তি আল্লাহ্র নাম না লইয়া ওযূ করে তাহার ওযূ হয় না।”
উক্ত হাদীস حديث حسن (বিশেষ বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য)।
কোন কোন ফকীহ বলেন, স্মরণে থাকিলে ওযূ করার আগে বিসমিল্লাহ বলা ওয়াজিব। কেহ কেহ আবার বলেন, স্মরণ থাকুক আর না থাকুক, ওযূ করার প্রাক্কালে বিসমিল্লাহ্ বলা ওয়াজিব।
ইমাম শাফেঈ সহ একদল ফকীহর মতে যবেহ করার পূর্বে বিসমিল্লাহ্ বলা মুস্তাহাব। আরেক দল বলেন, স্মরণে থাকিলে যবেহের পূর্বে বিসমিল্লাহ্ বলা ওয়াজিব। অন্যদল বলেন, স্মরণ থাকুক বা না থাকুক, যবেহ করার আগে উহা বলা ওয়াজিব। এই সম্পর্কে ইন্শাআল্লাহ্ যথাস্থানে সবিস্তারে আলোচনা করিব।
ইমাম রাযী তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে বিসমিল্লাহ্ ফযীলতের কতিপয় হাদীস উধৃত করিয়াছেন। তন্মধ্যে একটি হাদীস এইঃ
‘হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- যখন তুমি স্বীয় স্ত্রীর সহিত যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হও, তখন আল্লাহ্ নাম উচ্চারণ করিও। যদি তোমার ঔরসে কোন সন্তান জন্ম নেয়, তাহা হইলে তাহার নিজের ও বংশধরদের নিঃশ্বাসের সমসংখ্যক নেকী তোমাকে প্রদান করা হইবে।’
ইমাম রাযীর উর্ধ্বত উক্ত হাদীস ভিত্তিহীন। আমি (ইব্ন কাছীর) নির্ভরযোগ্য কি অনির্ভরযোগ্য কোন হাদীস গ্রন্থে উক্ত হাদীস দেখি নাই।
আহারের পূর্বেও বিসমিল্লাহ্ বলা মুস্তাহাব। মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছেঃ
‘নবী করীম (সাঃ) স্বীয় পালক পুত্র (হযরত উম্মে সালামা (রাঃ)-এর পূর্ব স্বামীর সন্তান) উমর ইব্ন আবূ সালামাকে একদিন বলেন, আল্লাহ্র নাম লইয়া খাও, ডান হাতে খাও এবং যে খাদ্য তোমার দিকে থাকে তাহা হইতে খাও।’
একদল ফকীহর মতে আহারের পূর্বে বিসমিল্লাহ্ বলা ওয়াজিব।’ স্ত্রী সহবাসের পূর্বেও বিসমিল্লাহ্ বলা মুস্তাহাব। হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হইয়াছেঃ
নবী করীম (সাঃ) বুলিয়াছেন, যদি কেহ স্ত্রী সংগমের পূর্বে বলেঃ
يسنم الله الهم َيْبْنَا الشيْطَانَ وَجَمّبٍ الشيْطانَ ما ردْكْعَتَا
(আল্লাহর নামে আরম্ভ করিতেছি। হে আল্লাহ্ শয়তানকে আমাদের নিকট হইতে এবং আমাদিগকে যাহা দান করিবে তাহা হইতে দূরে রাখ) -, তাহা হইলে আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদিগকে কোন সন্তান দিলে শয়তান কখনও তাহার কোন ক্ষতি করিতে পারিবে না।’
يسم الله বাক্যাংশটি কোন্ উহ্য শব্দের সহিত সম্পৃক্ত সে সম্বন্ধে ব্যাকরণবিদদের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। একদল ব্যাকরণবিদ বলেন, উহা একটি উহ্য অসমাপিকা ক্রিয়ার সহিত সংযুক্ত। আরেকদল উহাকে একটি উহ্য সমাপিকা ক্রিয়ার সহিত সম্পৃক্ত করেন। উপরোক্ত আলোচনায় বুঝা যায়, মতভেদ খুবই সামান্য। কারণ, উভয় দলের মতের ভিত্তিতে يسم الله -এর সহিত সমাপিকা কি অসমাপিকা ক্রিয়া যাহাই যোগ করা হউক না কেন, বাক্যের অর্থে তেমন কোন তারতম্য হয় না।
অবশ্য প্রত্যেক দলের মতের সমর্থনে কুরআন মজীদে দলীল রহিয়াছে। যাহারা বলেন يسم الله এর পূর্ণরূপ হইতেছে وقَالَ ارْكَبُوا بِسمِ اللهِ مَجْرهَا وَمُرْسَاهَا إِنَّ رَبِّي لَغَفُورٌ
(অনন্তর সে (নূহ) বলিল, তোমরা উহাতে চড়, আল্লাহর নামে উহার গতি ও স্থিতি। নিশ্চয় আমার প্রভু ক্ষমাশীল, করুণাময়।)
আরেকদল বলেন, بسم الله -এর পূর্ণরূপ হইতেছে ايدا بسم الله (আল্লাহর নামে আরম্ভ কর।) অথবা ابتدات بسم الله
(আল্লাহর নামে আমি আরম্ভ করিলাম)। ক্ষেত্রভেদে কখনও অনুজ্ঞাবোধক, কখনও বা সংবাদ জ্ঞাপক বাক্য হইবে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ اقثرااباسم رَبك الذئْ خَلْقَ (তোমার সৃষ্টিকর্তা প্রভুর নামে পড়।
মূলত উভয় মতই সঠিক ও শুদ্ধ। কারণ, সমাপিকা ক্রিয়ার জন্য অসমাপিকা ক্রিয়া অপরিহার্য। অতএব সমাপিকা বা অসমাপিকা যে কোন প্রকারের ক্রিয়ার সহিত উহা সম্পৃক্ত হইতে পারে। যে কাজ আরম্ভ করা হইবে তাহার প্রকৃতি ও প্রয়োজন অনুযায়ী সমাপিকা বা অসমাপিকা ক্রিয়া উহ্য মানিতে হইবে। উহা দাঁড়ানো, বসা, খাওয়া, পান করা, কিরাআত পড়া, ওযূ করা, নামায পড়া ইত্যাকার যে কোন ক্রিয়া হইতে পারে। এই সকল ক্রিয়া যাহাতে বরকতময় ও সুসম্পন্ন হয় এবং আল্লাহ্র নিকট কবুল হয় তজ্জন্যই যে কোন ক্রিয়া আল্লাহ্র নামে শুরু করা উচিত ও বিধেয়। আল্লাহ্ অধিকতর জ্ঞানের অধিকারী।
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে যিহাক, আবূ রওক ও বাশার ইন আম্মারা প্রমুখ রাবীর সনদে ইমাম ইব্ন জারীর ও ইমাম ইব্ন আবূ হাতিম বর্ণনা করেনঃ “নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট হযরত জিবরাঈল (আঃ) সর্বপ্রথম এই বাণী লইয়া অবতীর্ণ হন, (হে মুহাম্মদ) বলুন, اعوذ باللّه من الشيطان الرجيم অতঃপর বলুন بسم الله الرحمن الرحيم
রাবী বলেন, হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর উদ্দেশ্য ছিল, নবী করীম (সা) যেন তিলাওয়াত, উঠা, বসা, এক কথায় সকল কাজই আল্লাহর নামে আরম্ভ করেন।
أسم -এর তাৎপর্য
কোন বস্তুর أسم (নাম) এবং উহার مسمّى (সত্তা) এই দুইয়ের সম্পর্কের প্রকৃতি নিরূপণ লইয়া বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। একদল বলেন, নাম ও সত্তা এক ও অভিন্ন । আবৃ উবায়দা, সিবওয়াই (ব্যাকরণবিদ), বাকিল্লানী ও ইব্ন ফুরক এই অভিমত ব্যক্ত করেন।
ইমাম রাযী (ইবনুল খতীব অর-রী) বলেন, বস্তুর নাম ও সত্তা অভিন্ন বটে, কিন্তু নাম ও নামকরণ (تسميه) এক নহে। পক্ষান্তরে মুতাষিলা সম্প্রদায় বলে বস্তুর নাম ও নামকরণ অভিন্ন বটে, কিন্তু নাম ও সত্তা এক নহে।
আমার (ইব্ন কাছীর) মতে ইহাই গ্রহণযোগ্য যে, বস্তুর أسم উহার مسمّى নহে, تسميه ও নহে أسم -ই। অর্থাৎ নাম আদৌ সত্তা নহে, নামকরণও নহে, নাম নামই (অন্য কিছু) একত্রীকৃত কিছু অক্ষর-ও কতিপয় স্বরের সমাহার যে কোন বস্তুসত্তা নহে, তাহা সহজেই অনুমেয়। যদি কেহ বলেন, বস্তুর নামের তাৎপর্য হইতেছে, ইহার সত্তা তাহা অবশ্যই বিতর্কাতীত। তাই তাহা আলোচনায় সময়ক্ষেপণ নিষ্প্রয়োজন।
ইমাম রাযী প্রমাণ করিতে চাহেন যে, নাম ও সত্তা পৃথক ও স্বতন্ত্র । তিনি যুক্তি দেখান যে, কোন কোন ক্ষেত্রে নামের অস্তিত্ব মিলে, কিন্তু উহার সত্তার অস্তিত্ব থাকে না। যেমন المعدوم (অস্তিত্বহীন বস্তু) নামটি। পৃথিবীতে ‘অস্তিত্বহীন বস্তু’ নামটি বিদ্যমান বটে, কিন্তু উহার কোন সত্তার অস্তিত্ব নাই। কোন কোন ক্ষেত্রে আবার একই বস্তুর একাধিক নাম থাকে। যেমন সমার্থক শব্দাবলী। কোন কোন ক্ষেত্রে আবার একই নামের একাধিক সত্তা বিদ্যমান। যেমন একাধিক অর্থবোধক শব্দাবলী। এই সকল বিষয় দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বস্তুর নাম ও উহার সত্তা সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বতন্ত্র। তাহা ছাড়া বস্তুর নাম হইল দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতাবিহীন
عرض (বিষয়)। সুতরাং উহা কোন পদার্থই নহে। পক্ষান্তরে সত্তা হইতেছে সম্ভাব্য অথবা ও গভীরবিহীন (زات)। উহা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতার কোন এক বা একাধিক গুণের অধিকারী।
নাম ও সত্তার পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্যের পক্ষে আরও প্রমাণ রহিয়াছে। মূলত নাম ও সত্তা এক হইলে ‘আগুন’ ও বরফ’ এই নাম দুইটি মুখে উচ্চারণ করা মাত্র উচ্চারণকারী উহার উষ্ণতা ও শৈত্য অনুভব করিত। অন্যান্য নামের বেলায়ও এই কথা প্রযোজ্য।
আরও প্রমাণ রহিয়াছে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وللّه الأسْمَاءٌ الحسنى فَارْعُودُ بها ‘আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নাম রহিয়াছে। তোমরা সেইসব নামে তাঁহাকে ডাক।’
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, আল্লাহ্ তা’আলার নিরানব্বইটি নাম রহিয়াছে।
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্ তা’আলার একাধিক নাম রহিয়াছে । অথচ এই সকল নামের সত্তা শুধু একটিই। উহা হইতেছে আল্লাহ্ তা’আলার زات বা সত্তা। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
فسبح باسّم رَبك الْعَظيْمِ (তোমার মহান প্রভুর নামের মাহাত্ম্য বর্ণনা কর।)
উপরোক্ত আয়াতদ্বয় এবং অনুরূপ অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় নামসমূহকে নিজের সহিত সম্পৃক্ত করিয়াছেন। একটি জিনিস অন্য একটি জিনিসের সহিত সম্পর্কযুক্ত হইলে জিনিস দুইটির স্বাতন্ত্র্য বহাল থাকে। সুতরাং আল্লাহ্ তা’আলার নাম ও সত্তা অভিন্ন নহে। ইহা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কোন বস্তু বা ব্যক্তির নাম ও সত্তা এক ও অভিন্ন নহে।
আল্লাহ্ তা’আলা আরও বলিয়াছেনঃ فادعوه بها (অনন্তর তোমরা সেইসব নামে তাঁহাকে ডাক)। যাহাকে ডাকা হয় এবং যাহা দ্বারা ডাকা হয়, এই দুই ব্যাপার এক নহে। অতএব আল্লাহ্ তা’আলার নাম ও সত্তা অভিন্ন নহে। ইহা দ্বারা নাম ও সত্তার স্বাতন্ত্র্য প্রমাণিত হয়।
পক্ষান্তরে যাহারা বলেন যে, নাম ও সত্তা এক ও অভিন্ন, তাহারা নিম্নোক্ত আয়াতকে নিজেদের স্বপক্ষে পেশ করেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
تَبَارك اسم ريك ذُوا الجَلال وَالاكْرَام “তোমার প্রভুর পরাক্রমশালী মহা সম্মানিত নাম বরকতময়।”
এখানে আল্লাহ্ তা’আলা নিজকে বরকতময় আখ্যায়িত করিয়াছেন। আল্লাহ্ তা’আলার সত্তাই হইতেছে বরকতময়। অতএব তাঁহার নাম ও সত্তা উভয়ই এক। ইহা দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, কোন বস্তু বা ব্যক্তির নাম ও সত্তা এক ও অভিন্ন।
উপরোক্ত যুক্তির উত্তর এই যে, আল্লাহ্ তা’আলার সত্তা ও নাম উভয়ই বরকতময়। আল্লাহ্ তা’আলার সত্তার বরকতের কারণেই তাঁহার নামও বরকতময়। তাঁহার সত্তা গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত বলিয়া তাঁহার নামও গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত। এই কারণেই উপরোক্ত আয়াতে তিনি তাঁহার নামকে বরকতময় বলিয়াছেন।
নাম ও সত্তাকে যাহারা অভিন্ন বলেন, তাহাদের অপর যুক্তি হুইল এই যে, কেহ যদি তাহার স্ত্রী যয়নাব সম্বন্ধে বলে, ‘যয়নাবকে তালাক দিলাম’ তাহা হইলে তাহার স্ত্রী যয়নাব তালাক প্রাপ্তা হইয়া যায়। নাম ও সত্তা যদি অভিন্ন না হইত এবং তাহা যদি পরস্পর স্বতন্ত্র হইত, তাহা হইলে এরূপ ক্ষেত্রে যয়নাব তালাকপ্রাপ্তা হইত না। কারণ লোকটা যয়নাবের সত্তাকে নহে, বরং ‘যয়নাব’ নামকে তালাক দিয়াছে।
উপরোক্ত যুক্তির উত্তর এই যে, ‘লোকটির কথায় যয়নাব নাম্নী সত্তা তালাকপ্রাপ্তা হইয়া যায় ৷’
ইমাম রাযী আরেকটি কথা বলিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, ‘নাম ও নামকরণ’ এই দুইটি এক নহে। কোন সত্তাকে বুঝাইবার জন্য নির্ধারিত প্রতীক হইল ‘নাম’। পক্ষান্তরে ‘নামকরণ’ হইল সেই প্রতীককে নির্ধারিত বস্তুর সহিত সংযোগ কার্য।
الله শব্দের গঠন প্রকৃতি ও তাৎপর্য
الله শব্দটি মহাবিশ্বের একমাত্র মহান প্রতিপালক মহাপ্রভুর নাম। কেহ কেহ বলেন, উহাই الاسم الاعظم (ইসমে আজম)। কারণ, আল্লাহ শব্দের মধ্যে সকল গুণের সমাবেশ ঘটিয়াছে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
هو الله الذى لا إله الأهو – عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ – هُوَ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ اللهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلاَمُ الْمُؤْمِنُ ال الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ سُبْحَانَ اللهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ – هُوَ اللهُ الْخَالِقِ الْبَارِنِي الْمُصَوّر
لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى – يُسَبِّحُ لَه مَا فِي السَّمَوتِ وَالْاَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ .
(আল্লাহ্ হইতেছেন সেই সত্তা যিনি ভিন্ন অন্য কোন প্রভু নাই। তিনি দৃশ্য-অদৃশ্য সর্ববিষয়ে পরিজ্ঞাত। তিনি পরম করুণাময়, অতিশয় দয়ালু। আল্লাহ্ হইতেছেন সেই সত্তা যিনি ভিন্ন অন্য কোন প্রভু নাই। তিনি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, পবিত্র, শান্তিদাতা, আশ্রয়দাতা, রক্ষক, মহাপরাক্রমশালী, মহাক্ষমতাবান, সর্বোন্নত মর্যাদার অধিকারী। মানুষ তাঁহার সহিত যাহাদিগকে অংশীদার বানায় তাহাদের হইতে তিনি পূর্ণমাত্রায় পবিত্র। আল্লাহ্ হইতেছেন সৃষ্টিকর্তা, উদ্ভাবক, শ্রেষ্ঠতম রূপদাতা, তাঁহার সুন্দর সুন্দর গুণবাচক নাম রহিয়াছে। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সকল কিছুই তাঁহার পবিত্রতা-মাহাত্ম্য বর্ণনা করিতেছে। তিনি মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।)
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা উল্লেখিত অন্যান্য সকল গুণকে الله -এর সহিত সংশ্লিষ্ট করিয়া দেখাইয়াছেন। অনুরূপভাবে অন্যত্র বলিয়াছেনঃ
وللّه الأسماء الحسنى فادعوه بها (আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নাম রহিয়াছে, তোমরা সেইসব নামে তাঁহাকে ডাক।)
তিনি আরও বলেনঃ
قل ادعو اللّه أو ادعوا الرحمن اياما تدعوا فله الاسماء الحسنئى “তুমি বলিয়া দাও, আল্লাহকে ডাক, অথবা রহমানকে ডাক, যাহাকেই ডাক না কেন, তাঁহার (আল্লাহ্) সুন্দর সুন্দর নাম রহিয়াছে।”
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত রহিয়াছেঃ ‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, আল্লাহ্ তা’আলার নিরানব্বইটি নাম রহিয়াছে। যে ব্যক্তি উহা আয়ত্ত করিবে সে জান্নাতে যাইবে।’
ইমাম তিরমিযী এবং ইমাম ইব্ন মাজাহ কর্তৃক বর্ণিত রিওয়ায়েতেও আল্লাহ্ তা’আলার নামের সংখ্যার উল্লেখ রহিয়াছে। অবশ্য উভয় রিওয়ায়েতে নামের সংখ্যার বিষয়ে বিভিন্নতা রহিয়াছে। ইমাম রাযী স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে জনৈক বর্ণনাকারী হইতে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ্ তা’আলার পাঁচ হাজার নাম রহিয়াছে। এক হাজার নাম আল-কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর ভিতরে, এক হাজার নাম তাওরাত কিতাবে, এক হাজার নাম ইঞ্জীল কিতাবে এবং এক হাজার নাম যবূর কিতাবে উল্লেখ করা হইয়াছে। অন্য এক হাজার নাম লওহে মাহফুজে লিখিত রহিয়াছে।
‘আল্লাহ্’ একটি অনন্য নাম। মহাবিশ্বে একক মহান প্রতিপালক প্রভু ভিন্ন অন্য কেহ উক্ত নামে অভিহিত নহে। এই কারণেই আরবী ভাষায় উহার সম-ধাতুজ কোন সমাপিকা ক্রিয়া পরিদৃষ্ট হয় না। তাই একদল বিশেষজ্ঞ বলেন যে, উহা اسبم جامد যাহা গঠনগত দিক দিয়া একক শব্দ।(১) ইমাম কুরতুবী এই মতের সমর্থক বিপুল সংখ্যাক বিশেষজ্ঞের নাম উল্লেখ করিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে ইমাম শাফেঈ, খাত্তাবী, ইমামুল হারামাইন, ইমাম গায্যালী প্রমুখ সুবিজ্ঞ ব্যক্তিগণ রহিয়াছেন।
প্রসিদ্ধ ব্যাকরণবিদ খলীল ও সিবওয়াই বলেনঃ الله শব্দের অন্তর্গত আলিফ ও লাম উহার অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রমাণ স্বরূপ খাত্তাবী এই উদাহরণ পেশ করেন যে, সম্বোধনে আমরা يا اللّه বলিয়া থাকি; কিন্তু يا الرحمن বলি না। ইহাতে বুঝা যায়, উহার أل অক্ষরদ্বয় উহার অবিচ্ছেদ্য অংশ ৷ তাহা না হইলে উহাতে أل বহাল রাখিয়া সম্বোধন অব্যয় স্থাপন করা হইত না।
কেহ কেহ বলেন, الله শব্দটি اسم مشتق যাহা অন্য শব্দ হইতে গঠিত শব্দ। এই অভিমতের প্রবক্তাগণ কবি রূবাহ ইব্ন আজ্জাজের নিম্নোক্ত কবিতাংশকে নিজেদের অভিমতের পক্ষে উপস্থাপন করেনঃ
لله در الفانيات المده – سبحن واسترجعنا من تألهي
‘প্রশংসাকারিণী গায়িকাগণ কতই না সৌভাগ্যবতী। কারণ, তাহারা আল্লাহ্ তা’আলার পবিত্রতা ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করিয়াছে এবং মা’বূদ বনিয়া যাওয়া হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে।’
এখানে কবি تأله শব্দটি ব্যবহার করিয়াছেন। উহা ا – ل – ه এই তিনটি আরবী অক্ষর দ্বারা গঠিত একটি مصدر উহার আরেক রূপ হইতেছে الاهة । যাহার সমাপিকা ক্রিয়ার রূপ হইতেছে اله يأله (আলাহা-য়্যা’লুহু)। আল্লাহ্ শব্দের মূল অক্ষরও ا – ل – ه ইহাতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ্ শব্দের ধাতু হইতে সমাপিকা ক্রিয়া ও অসমাপিকা ক্রিয়া তৈরী হয়। অতএব উহা اسم مشتق
অনুরূপভাবে হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) সম্বন্ধে বর্ণিত হইয়াছে যে, তিনি এইরূপ পড়িতেনঃ
أَيْدْرٌ مُوسى وَقُوْمَهُ ليُفْسدوا الآرْض وَيذَرك وَالآهَتَك “আপনি কি মূসা ও তাহার গোত্রকে এমন সুযোগ দিবেন যাহাতে তাহারা পৃথিবীতে বিশৃংখলা ঘটায় এবং আপনাকে আর আপনার দাসত্বকে ত্যাগ করে?”
‘অর্থাৎ লোকেরা ফিরআউনের দাসত্ব করিত এবং সে কাহারও দাসত্ব করিত না। হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ)- এর কিরাআত অনুযায়ী আয়াতে الاهة অসমাপিকা ক্রিয়াটি ব্যবহৃত হইয়াছে। পূর্বেই বলা হইয়াছে উহা আল্লাহ শব্দের সমধাতুজাত অসমাপিকা ক্রিয়া।
মূজাহিদও اللّه শব্দকে اسم مشحق বলিয়াছেন। উক্ত অভিমতের পক্ষে কেহ কেহ নিম্নের আয়াত পেশ করেনঃ
وهو الله فى السّمطؤت وفى الأرأض (তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সর্বত্রই আল্লাহ্’।)
উপরোক্ত মর্মে আল্লাহ্ তা’আলা আরও বলিতেছেনঃ
وهر الّذىْ فى السّماء الَهُ وفى الأرض اله “তিনি সেই সত্ত্বা যিনি গগনমণ্ডলীতেও প্রভু,পৃথিবীতেও প্রভু।”
প্রথম আয়াতে ‘আল্লাহ্’ শব্দটি দ্বিতীয় আয়াতে ‘ইলাহ’ শব্দের মতই اسم مشتق রূপে ব্যবহৃত হইয়াছে। কারণ, উহার সহিত ‘ফিস্ সামাওয়াতি’ ও ‘ফিল্ আরদি’ স্থানবাচক শব্দদ্বয় সম্পৃক্ত হইয়াছে। ইহা اسم مشتق -এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
প্রসিদ্ধ ব্যাকরণবিদ সিবওয়াই বিখ্যাত ব্যাকরণবেত্তা খলীল হইতে বর্ণনা করিয়াছেনঃ الله শব্দটি পূর্বে اله ছিল উহা فعال ওযনে গঠিত শব্দ ছিল। প্রথম অক্ষর أ (হামযাহ) বিলুপ্ত হইয়া ‘তদস্থলে ال যুক্ত হইয়াছে। সিবওয়াই উহার নজীর হিসাবে দেখান যে, الناس শব্দটি পূর্বে اناس ছিল এবং প্রথম অক্ষর (হামযাহ) বিলুপ্ত হইয়া তদস্থলে ال স্থাপিত হইয়াছে।
কেহ কেহ্ বলেন; الله শব্দটি পূর্বে لاه ছিল। অধিকতর অর্থ প্রকাশার্থে উহাতে ال সংযুক্ত হইয়াছে। সিবওয়াইরও এই মত। নিম্নোক্ত পংক্তিতে উহার ব্যবহার দেখা যায়ঃ
لاه ابن عمك لا افضلت فى حسب ـ عنى ولا انت دیانی فتخزونی
‘তোমার চাচাত ভাই (কবি নিজে) একজন, উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। আমার উপর না তোমার বংশগত মর্যাদার প্রাধান্য রহিয়াছে, না কোনরূপ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। তাই তুমি আমাকে অপমান করিতে পার না।’
খ্যাতনামা ব্যাকরণবিদ কাসাঈ ও ফাররা বলেন, الله শব্দটি পূর্বে الا له ছিল। মধ্যাক্ষর (হামযাহ) বিলুপ্ত করিয়া প্রথম ل কে দ্বিতীয় ل এর সহিত مدغم (যুক্ত) করা হইয়াছে। ফলে الا له শব্দটি الله শব্দে পরিণত হইয়াছে। যেমন لكنا هو اللّه ربى আয়াতের অন্তর্গত لكنا শব্দটি পূর্বে لكن انا ছিল। দ্বিতীয় শব্দের আদ্যাক্ষরটি ن এর সহিত مدغهم (যুক্ত) করা হইয়াছে। এইরূপে لكن انا শব্দটি لكنا হইয়াছে। উল্লেখ্য, হাসান উহাকে পূর্বরূপেই পড়িতেন।
الله শব্দের অর্থ বর্ণনা প্রসঙ্গে ইমাম কুরতুবী বলেন, لله শব্দটি و له শব্দ হইতে গঠিত হইয়াছে। و له অর্থ হইল সে হয়রান পেরেশান হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে। শব্দমূল হইল الموله অর্থাৎ হতবুদ্ধি হওয়া, বুদ্ধি বিভ্রাট ঘটা। যেমন رجل واله ও إمرأة ولهى ار مولوهة অর্থ যথাক্রমে মরু প্রান্তরে পরিত্যক্ত হতবুদ্ধি পুরুষ ও মহিলা। যেহেতু আল্লাহ্ তা’আলার গুণাবলীর কুল কিনারা পাইবার বিষয়ে তিনি মানুষ ও তাহার চিন্তা শক্তিকে হয়রান করিয়া দেন, তাই তাঁহার নাম الله হইয়াছে।
উপরোক্ত বিশ্লেষণ অনুসারে الله শব্দটি পূর্বে الوله ছিল, و অক্ষরটিকে বিলুপ্ত করিয়া তদস্থলে أ বসানো হইয়াছে। যেমন وشاج হইতে اشاح ও وسادة হইতে اسادة হইয়াছে। উক্ত শব্দদ্বয়ের و অক্ষরকে বিলুপ্ত করিয়া তদস্থলে أ বসানো হইয়াছে।
ইমাম রাযী বলেন, কাহারও কাহারও মতে الله শব্দটি اله ক্রিয়া হইতে গঠিত হইয়াছে الهت الى فلان আমি অমুকের নিকট গিয়া শান্তি লাভ করিয়াছি, কিংবা আমি অমুকের নিকট বসবাস করিয়াছি অথবা আমি অমুকের নিকট স্থিতি লাভ করিয়াছি। আল্লাহ্ তা’আলা সচ্চিনানন্দ সত্তা, সকল গুণের পূর্ণ রূপের তিনি একক অধিকারী । মানুষের আত্মা এবং তাহার বুদ্ধি-অনুভূতি সেই সর্বগুণাকার পরম সত্তার স্বরূপ উপলব্ধি ও তাহার স্মরণ ভিন্ন অন্য কিছুতেই শান্তি ও তৃপ্তি লাভ করিতে পারে না। তাই তাঁহার নাম الله হইয়াছে। নিম্নের আয়াতে ইহার সমর্থন মিলে।
آلا بكر الله تطمئن القلوب ‘শুনিয়া রাখ, আল্লাহর স্মরণেই অন্তরসমূহ প্রশান্তি লাভ করে।’
ইমাম রাযী আরও বলিয়াছেন, কেহ কেহ বলেন, الله শব্দটি لاه – يلوه ক্রিয়া হইতে গঠিত হইয়াছে। لاه অর্থ সে লুক্কায়িত রহিয়াছে। যেহেতু আল্লাহর পূর্ণ স্বরূপের উপলব্ধি দৃষ্টির নাগালের বাহিরে অবস্থিত, তাই তাঁহার নাম الله হইয়াছে।
ইমাম রাযী আরও বলিয়াছেন- কেহ কেহ বলেন, الله শব্দ اله ক্রিয়া হইতে গঠিত হইয়াছে। اله الفصيل أو لع يامه অর্থ শাবক উহার মাতার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে কিংবা শাবক উহার মাতাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছে।’ যেহেতু বান্দা সর্বাবস্থায় বিনয় ও কান্নাকাটির সহিত আল্লাহ্ তা’আলার আশ্রয়ে ছুটিয়া যায় এবং তাঁহাকে আঁকড়াইয়া ধরে, তাই তাঁহার নাম الله হইয়াছে।
ইমাম রাযী আরও বলিয়াছেন, কেহ কেহ বলেন, الله শব্দটি اله ক্রিয়া হইতে গঠিত হইয়াছে। اله الرجل يأله অর্থ লোকটি তাহার উপর আপতিত বিপদে ভীত হইয়া পড়িয়াছে, অতঃপর অমুক তাহাকে আশ্রয় প্রদান করিয়াছে। এখানে দেখা যাইতেছে اله ক্রিয়াটি ‘বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির ভীত হওয়া’ ও ‘বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে আশ্রয় প্রদান করা’ এই দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয়। আল্লাহ্ তা’আলাই সকল সৃষ্টিকে যাবতীয় বিপদ হইতে আশ্রয় প্রদান করেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেনঃ
وهو يجير ولايجار عليه
‘নিশ্চয় তিনি আশ্রয় প্রদান করেন এবং তাঁহার অমতে কেহ কাহাকেও আশ্রয় প্রদান করিতে পারে না।’ তেমনি সকল দান ও নি’আমাত আল্লাহ তা’আলার তরফ হইতে আসে। এ সম্বন্ধে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وما بِكُمْ من تُّخّمّة فُمِنّ الله অনন্তর তোমাদের নিকট বর্তমান সকল নি’আমাতই আল্লাহ্ তা’আলার তরফ হইতে আসে।’ আল্লাহ্ তা’আলাই সকল সৃষ্টিকে রিযিক দান করেন। তাই তিনি বলেনঃ
وهو يطعم وَلايْطْعمٌ ‘তিনিই খোরাক দেন এবং তাঁহাকে কেহ খোরাক দেয় না।’
সকল বস্তু ও ঘটনার স্রষ্টা আল্লাহ্ তা’আলা। তিনি বলেনঃ
قل كل من عثْد الله ‘বল, সবই আল্লাহ্ তরফ হইতে হয়।’
এক কথায় আল্লাহ্ তা’আলাই সকল সৃষ্টিকে বিপদে-বিপাকে আশ্রয় দেন এবং সর্বাবস্থায় প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান করেন। তাই তাঁহার নাম الله হইয়াছে।
ইমাম রাযীর ব্যক্তিগত অভিমত এই যে, الله শব্দটি নিশ্চিতরূপে اسم غير مشتق যাহা অন্য কোন শব্দ হইতে গঠিত নহে। প্রসিদ্ধ ব্যকারণবিদ খলীল ও সিবওয়াই এবং অধিকাংশ ফকীহ ও ফিকাহর নীতি নির্ধারক বিশেষজ্ঞদের অভিমত উহাই। ইমাম রাযী উক্ত অভিমতের সপক্ষে অনেক প্রমাণ উপস্থাপন করিয়াছেন। নিম্নে উহার কয়েকটি প্রমাণ পেশ করিতেছি।
এক- الله শব্দটি اسم مشتق হইলে উক্ত শব্দে নিহিত অর্থ ও তাৎপর্যের অধিকারী সকল বস্তু বা ব্যক্তি الله নামে অভিহিত হইতে পারে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে মহাবিশ্বের মহান প্রতিপালক প্রভু ভিন্ন অন্য কেহ উক্ত নামে অভিহিত নহে, হইতে পারে না।
দুই- আল্লাহ্ তা’আলার অন্যান্য নাম الله নামের গুণবাচক নাম হিসাবে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। যেমন আমরা বলি, আল্লাহ্ তা’আলা الرحمن তিনি না তিনি الرحيم তিনি الملك তিনি القدوس ইত্যাদি। ইহাতে প্রমাণিত হয় الله শব্দটি اسم مشتق নহে।
তিন- আল্লাহ্ তা’আলা ভিন্ন অন্য কেহ الله নামে অভিহিত নহে। আল্লাহ্ তা’আলা স্বয়ং বলেনঃ
هل تَعَلّم له سمي তুমি কি তাঁহার নামসম্পন্ন অন্য কাহাকেও জান?
ইহাতেও প্রমাণিত হয়; আল্লাহ্ শব্দটি ইসমে মুশতাক নহে। ইমাম রাযী বলেনঃ النّهالعزيز الحميد (মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রশংসিত সত্তা আল্লাহ্) আয়াতাংশের অন্তর্গত الله শব্দটিকে কেহ কেহ اعر اب الجر (সম্বন্ধকারকের) বিভক্তি দিয়া পড়েন। সেই ভিত্তিতে তাহারা বলে, এখানে الله শব্দটি পূর্ববর্তী শব্দের বিশেষণ হইয়াছে। ইহা اسم مشتق -এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সুতরাং আল্লাহ্ শব্দটি اسم مشتق বটে। ইমাম রাযী বলেন, ইহা ঠিক নহে। কারণ, এখানে الله শব্দটি বিশেষণ নহে; বরং عطف البيان (পূর্ববর্তী শব্দের পরিচায়ক সংযোজিত শব্দ)। সুতরাং এই আয়াতাংশ দ্বারা الله শব্দের এই اسم مشتق হওয়া প্রমাণিত হয় না।
আমার (ইব্ন কাছীর) মতে الله শব্দের أسم جامد হইবার পক্ষে ইমাম রাযীর উপস্থাপিত প্রমাণসমূহ সবল নহে। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ।
ইমাম রাযী বলিয়াছেন- কেহ কেহ বলেন الله শব্দটি আরবী নহে, হিব্রু শব্দ। তিনি এই মতকে দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য বলেন। আমার (ইব্ন কাছীর) মতেও উহা দুর্বল ও বর্জনীয় বটে।
ইমাম রাযী বলেনঃ জগতে দুই শ্রেণীর মানুষ রহিয়াছে। এক শ্রেণীর মানুষ আল্লাহ্ তা’আলার মা’রিফাত ও পরিচয়ের মহাসমুদ্রে পৌঁছিয়া তথায় বিচরণ ও পরিভ্রমণ করিয়া বেড়ান। তাঁহারা আল্লাহ্ নূর ও জ্যোতির জগতে মহা সুখে ঘুরিয়া বেড়ান। আরেক শ্রেণীর লোক আল্লাহ্ তা’আলার মা’রিফাত হইতে বঞ্চিত থাকিয়া বিভ্রান্তির অন্ধকারে হয়রান পেরেশান অবস্থায় ঘুরিয়া বেড়ায়। এই দুই শ্রেণীর মানুষ আধ্যাত্মিক জগতের দুই মেরুতে অবস্থান করিলেও একটি বিষয়ে তাহাদের মধ্যে মিল ও সাদৃশ্য রহিয়াছে। উহা এই যে, উভয় শ্রেণীই আধ্যাত্মিক জগতে ঘূর্ণায়মান ও পরিক্রমশীল রহিয়াছে। তবে এক শ্রেণীর জন্য সেই পরিক্রমা ও ঘুর্ণন সুখকর; আরেক শ্রেণীর জন্য দুঃখজনক। ইমাম রাযীর মতে উপরোক্ত কারণে و له ক্রিয়া হইতে الله নামটি সৃষ্টি হওয়াও যুক্তিযুক্ত।
ব্যাকরণবেত্তা খলীল ইব্ন আহমদ বলেন, الله শব্দটি اله ক্রিয়া হইতে সৃষ্টি হইয়াছে ৷ কারণ, সকল সৃষ্টি তাঁহার নিকট আশ্রয় গ্রহণ করিয়া থাকে।
কেহ কেহ বলেন, الله শব্দটি لاه। ক্রিয়া হইতে সৃষ্টি হইয়াছে ৷ لاه অর্থ সে উচ্চ মর্যাদা লাভ করিয়াছে বা সে উপরে উঠিয়াছে। لاهت الشمس -এ অর্থ সূর্য উপরে উঠিয়াছে। যেহেতু আল্লাহ্ তা’আলা সর্বগুণে সর্বক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আছেন, তাই তাঁহার নাম আল্লাহ্ হইয়াছে। .
কেহ কেহ বলেন, الله শব্দটি اله ক্রিয়া হইতে গঠিত হইয়াছে। اله الرجل অর্থ লোকটি অমুককে প্রভু বানাইয়াছে কিংবা লোকটি দাসত্ব করিয়াছে অথবা লোকটি অনুগত হইয়াছে। তেমনি تأله الر جل এ অর্থ লোকটি কুরবানী করিয়াছে কিংবা লোকটি ইবাদত করিয়াছে অথবা লোকটি ত্যাগ স্বীকার করিয়াছে। যেহেতু আল্লাহ্ তা’আলা সকল সৃষ্টির দাসত্ব, আনুগত্য, ইবাদত ও কুরবানী পাইবার যোগ্য, তাই তাঁহার নাম আল্লাহ্ হইয়াছে।
ইব্ন আব্বাস (রাঃ) পড়িতেনঃ
ويذْرك و الأهَنَكَ তাঁহার পাঠ অনুসারে উক্ত আয়াতাংশে যে الاهة উহা اله (সে ইবাদত করিয়াছে) সমাপিকা ক্রিয়াটির অসমাপিকা রূপ। ‘আল্লাহ্’ শব্দটি পূর্বে ‘আল্ ইলাহ’ ছিল ইহার শব্দমূল ا – ل – ه (হামযাহ-লাম-হা)। আদ্যাক্ষর হামযাহ্ বিলুপ্ত করিয়া অতিরিক্ত ا ل এর ل বর্ণটি শব্দমূলের দ্বিতীয় বর্ণ ل এর সহিত সংযুক্ত (مدغم) করা হইয়াছে। ফলে الاله শব্দটি اله হইয়াছে। অতঃপর সম্মানার্থে দ্বিত্বপ্রাপ্ত লাম বর্ণের পূর্বে অতিরিক্ত লাম বসাইয়া الله করা হইয়াছে।
الرحمن الرحيم -এর তাৎপর্য
الرحمن ও الرحيم শব্দদ্বয় رحمة (সদয় হওয়া, কৃপাকারী) শব্দ হইতে গঠিত হইয়াছে। উভয় শব্দই اسم فاعل مبالفه (আধিক্যবোধক বিশেষ্য বা বিশেষণ)। তবে الرحمن হইতে ব্যাপকতর আধিক্য প্রকাশ পায়। ইমাম ইবন জারীরের একটি উক্তি দ্বারা বুঝা যায়, বিশেষজ্ঞদের সর্বসম্মত অভিমত এই যে, উভয় শব্দই اسم فاعل مبالفة শ্রেণীভুক্ত এবং প্রথমটিতে দ্বিতীয়টি অপেক্ষা অধিকতর ব্যাপক অর্থ রহিয়াছে। অন্য এক বিশেষজ্ঞও স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে অনুরূপ মন্তব্য করিয়াছেন।
ইতিপূর্বে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত ঈসা (আঃ) বলিয়াছেন, الرحمن অর্থ ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতে অতিশয় করুণা বর্ষণকারী এবং الرحيم অর্থ হইতেছে পরকালে অশেষ করুণা বর্ষণকারী।
কেহ কেহ বলেনঃ আলোচ্য শব্দদ্বয় اسم جامذ কারণ, উহা اسم مشتق হইলে উহার সহিত তৈল (কৃপাপ্রাপ্ত) ব্যক্তিরও উল্লেখ ঘটিত। অবশ্য ব্যক্তিদের উল্লেখ ঘটিয়াছে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَكَانَ بِالْمُؤْمِنِيْنَ رَحِيْمًا এই আয়াতাংশে رحيم এর مرحوم হইল মু’মিনীন।
ইবনুল আম্বারী তাঁহার الزاهر গ্রন্থে বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ মুবার্রাদের এই বক্তব্য উদ্ধৃত করেন যে, الرحمن আরবী শব্দ নহে; হিব্রু শব্দ।
আবূ ইসহাক আয্ যাজ্জাজ স্বীয় ‘মাআনিল কুরআন’ গ্রন্থে উল্লেখ করিয়াছেনঃ ‘আহমদ ইব্ন ইয়াহিয়া বলেন, الرحيم শব্দটি আরবী এবং المرحمن শব্দটি হিব্রু। তাই আল্লাহ্ তা’আলা উভয় শব্দ একত্রে প্রয়োগ করিয়াছেন।’ অতঃপর আবূ ইসহাক মন্তব্য করেন, উক্ত অভিমত গ্রহণযোগ্য নহে।
ইমাম কুরতুবী বলেন, আলোচ্য শব্দদ্বয় যে اسم مشتق শ্রেণীভুক্ত ইমাম তিরমিযী (রঃ) কর্তৃক বর্ণিত ও তৎকর্তৃক সহীহ আখ্যায়িত নিম্নোক্ত হাদীসই তাহার প্রমাণঃ
হযরত আবদুর রহমান ইব্ন ‘আওফ (রাঃ) বলেন, আমি নবী (সাঃ)-কে বলিতে শুনিয়াছি, আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, ‘আমার নাম المرحمن (করুণাময়), আমি الرحم (জরায়ু) সৃষ্টি করিয়াছি এবং উহা হইতে আমার একটি নাম গঠন করিয়াছি। যে ব্যক্তি الرحم -এর সম্পর্ক (রক্ত-সম্পর্ক) অক্ষুণ্ণ ও অবিচ্ছিন্ন রাখিবে, আমি তাহার সহিত অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখিব পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি উহা ছিন্ন করিবে, আমি তাহার সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিব।’
ইমাম কুরতুবী বলেন, উপরোক্ত হাদীস দ্বারা সন্দেহাতীত রূপে প্রমাণিত হয় যে, আলোচ্য শব্দদ্বয় اسم مشتق শ্রেণীভুক্ত। অতএব এ সম্বন্ধে ভিন্নমত পোষণ করা অযৌক্তিক ও নিরর্থক। তিনি আরও বলেন, আরবরা যে المرحمن নামটি তাহাদের কাছে অপরিচিত বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছিল, উহা শব্দটির আরবী শব্দ না হওয়ার ব্যাপার নহে, বরং আল্লাহ্ তা’আলার المرحمن নাম হওয়ার ব্যাপারটি। আল্লাহ্র গুণবাচক নামসমূহ সম্পর্কে তাহাদের সম্যক জ্ঞান ছিল না। এই ব্যাপারে তাহারা ছিল অজ্ঞ ও মূর্খ। ইমাম কুরতুবী আরও বলেনঃ الرحمن ও الرحيم এই উভয় শব্দের অর্থ একই। যেমন ند مأن (সহচর, বন্ধু) ও نديم (সহচর, বন্ধু) উভয় শব্দের একই অর্থ।
কেহ কেহ বলেন, فعلان ও فعيل এই দুই ওযনের শব্দ একই অর্থে ব্যবহৃত হয় না। প্রথমোক্ত ওযনের শব্দ শুধু ক্রিয়ার আধিক্যমূলক কর্তৃবাচক বোধক اسم فاعل مبالفه হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন رجل غضبان (অতিশয় রাগান্বিত ব্যক্তি)। পক্ষান্তরে শেষোক্ত ওযনের শব্দ কখনও কর্তৃবাচ্যে বিশেষ্য বা বিশেষণ (اسم فاعل) এবং কখনও কর্মবাচ্যে বিশেষ্য বা বিশেষণ (اسم مفعول) হয়।
আবূ আলী ফারেসী বলেন, الر حمن শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। উহার অর্থ মু’মিন-কাফির সকলের প্রতি করুণা বর্ষণকারী । উহা আল্লাহ্ তা’আলার সার্বজনীন ও সর্বশ্রেণীর করুণার পরিচায়ক। পক্ষান্তরে الرحيم শব্দ শুধু মু’মিনের প্রতি করুণা বর্ষণ অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
وكَان بالمؤمنين رَحَيْمًا ‘অনন্তর তিনি মু’মিনদের প্রতি কৃপাপরায়ণ।
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলেন, আলোচ্য শব্দদ্বয় কৃপামূলক দুইটি শব্দ (وقيقان) উহাদের একটি অপরটি অপেক্ষা অধিকতর কৃপামূলক (ارق)।
খাত্তাবী প্রমুখ বিশেষজ্ঞ সম্বন্ধে বর্ণিত হইয়াছে যে, তাহারা হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণিত উক্ত ارق শব্দের প্রয়োগের যথার্থতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেন, হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) সম্ভবত এরূপ স্থলে ارق শব্দ প্রয়োগ করেন নাই; বরং তিনি أرفق শব্দ প্রয়োগ করিয়াছেন। নিম্নোক্ত হাদীসেও অনুরূপ স্থলে। শব্দের সমধাতুজাত শব্দ প্ৰযুক্ত হইয়াছেঃ
নবী করীম (সাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ্ তা’আলার নাম رفيق (বিনম্র)। তিনি সকল কাজে رفق (বিনয়) পছন্দ করেন। তিনি কঠোরতায় যাহা দান করেন না, বিনয়ে তাহা দান করেন।’
ইব্ন মুবারক বলেন, الرحمن শব্দের অর্থে এরূপ কৃপাপরায়ণকে বুঝায় যাহার নিকট কৃপা প্রার্থনা করিলে তিনি কৃপা প্রদর্শন করেন। পক্ষান্তরে الرحيم শব্দের দ্বারা এরূপ কৃপাপরায়ণকে বুঝায় কৃপা প্রার্থনা না করিলে যিনি অসন্তুষ্ট হন। আল্লাহ্ তা’আলার নিকট কৃপা প্রার্থনা না করিলে যে তিনি অসন্তুষ্ট হন, হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ সালেহ ফারেসী প্রমুখ রাবীর সনদে ইমাম তিরমিযী ও ইমাম ইব্ন মাজাহ কর্তৃক বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসে তাহা বিবৃত হইয়াছেঃ
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট প্রার্থনা করে না; তিনি তাহার প্রতি অসন্তুষ্ট হন।’
জনৈক কবি বলেনঃ
الله يغضب ان تركت سؤاله – وبنى ادم حين يسئل يغضب
“আল্লাহ্ তা’আলার নিকট তুমি না চাহিলে তিনি অসন্তুষ্ট হন আর মানুষের নিকট চাহিলে সে অসন্তুষ্ট হয়।”
আযরামী হইতে ধারাবাহিকভাবে উসমান ইবন যুফার, আস্ সুরী ইবন ইয়াহিয়! তামিমী এবং ইমাম ইবন জারীর বর্ণনা করিয়াছেনঃ আযরামী বলেন, الرحمن হইলেন সকল সৃষ্টির প্রতি কৃপাপরায়ণ। পক্ষান্তরে الرحيم হইলেন মু’মিনদের প্রতি কৃপাপরায়ণ। বিশেষজ্ঞগণ উপরোক্ত বিশ্লেষণের সমর্থনে আল্লাহ্ তা’আলার নিম্নোক্ত আয়াত পেশ করেনঃ
شم استوى على العرش الرحمن ‘অতঃপর ‘রহমান’ পূর্ণ পরাক্রমে আরশে অধিষ্ঠিত হইয়াছেন ৷’
অন্যত্র আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
الرحمن على الْعَرّش استوى ‘রহমান’ পূর্ণ পরাক্রমে আরশে অধিষ্ঠিত হইয়াছেন ৷’
উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ الرحمن শব্দের সহিত الاستوى (পূর্ণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া) শব্দ উল্লেখ করিয়া এই বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করিয়াছেন যে, الرحمن হিসেবে তাঁহার অনুগ্রহ সকল সৃষ্টিকে ঘিরিয়া রহিয়াছে। পক্ষান্তরে অন্যত্র তিনি বলিয়াছেনঃ
وكان بالمؤمنين رَحَيمًا ‘তিনি মু’মিনদের প্রতি রহীম (কৃপাপরায়ণ)।’ এখানে আল্লাহ্ তা’আলা الرحيم শব্দের সহিত শুধু মু’মিনদের উল্লেখ করিয়া এই বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করিয়াছেন যে, الرحيم হিসাবে তাঁহার রহমত শুধু মু’মিনদের প্রতি অবতীর্ণ হয় ৷
উপরোল্লিখিত দ্বিবিধ প্রয়োগ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, الرحمن শব্দ الرحيم হইতে অধিকতর مبالغه বা আধিক্যবোধক। কারণ الرحمن হইলেন দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে সকল সৃষ্টির প্রতি অত্যন্ত কৃপাপরায়ণ। পক্ষান্তরে الرحيم শুধু মু’মিনদের প্রতি কৃপাপরায়ণ।
তবে হাদীস দ্বারা প্রমাণিত দোয়ায় রহিয়াছেঃ
رحمن الدنيا والآخرة ورحيمها
‘দুনিয়া ও আখিরাত উভলোকের রহমান ও উহার রহীম।’ الرحمن নামটি শুধু আল্লাহ্ তা’আলারই নাম। সৃষ্টির কেহই উক্ত নামে আখ্যায়িত নহে।
এ সম্বন্ধে স্বয়ং আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
قُلِ ادْعُوا اللهَ أو ادْعُوا الرَّحْمَنَ أَيَّامًا تَدْعُوا فَلَهُ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى
বল, তোমরা আল্লাহ্ নামে ডাক আর আর রহমান নামে ডাক, যে নামেই ডাক না কেন, অনন্তর তাঁহার সুন্দর সুন্দর নাম রহিয়াছে।’
তিনি আরও বলেনঃ
. وَاسْتُهُ مَنْ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رُّسُلِنَا أَجَعَلْنَا مِنْ دُونِ الرَّحْمَنِ أَلِهَةً يعبدون –
‘তোমার পূর্বে আমি যে সকল রাসূল পাঠাইয়াছি তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখ, আমি কি আর-রহমানের পরিবর্তে অন্য মা’বূদগুলি নিযুক্ত করিয়াছি?’
মিথ্যাবাদীকুল শিরোমণি মুসাইলামা নিজকে ইয়ামামা অঞ্চলের ‘আর-রহমান’ আখ্যায়িত করার ঔদ্ধত্য প্রকাশ করিয়াছিল ! আল্লাহ্ তা’আলা তাহাকে ‘কায্যাব’ নামে কুখ্যাত করিয়াছেন। মানুষ তাহাকে ‘মুসায়লামাতুল কায্যাব’ নামে স্মরণ করিয়া থাকে। আরবে তাহার নাম সর্বত্র মিথ্যাবাদীর উপমায় প্রবাদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
কেহ কেহ আবার বলেন, الرحيم শব্দটি الرحمن শব্দ হইতে আধিক্যবোধক শব্দ। কারণ الرحمن শব্দের তাকীদ (التاكيد) হিসাবে الرحيم শব্দ সংযুক্ত হইয়াছে। ইহা সুপরিজ্ঞাত ব্যাপার যে, দুইটি বিষয়ের মধ্য হইতে একটি যদি অপরটির তাকীদের জন্য আসে, তাহা হইলে তাকীদের জন্য ব্যবহৃত বিষয়টি অধিকতর শক্তিশালী হইয়া থাকে।
মূলত উক্ত অভিমত ভ্ৰান্ত। প্রকৃতপক্ষে الرحيم শব্দটি الرحمن শব্দটির শক্তি বৃদ্ধির জন্য তাকীদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়নি। বরং উহা صفت (গুণবাচক শব্দ) হিসাবে ব্যবহৃত হইয়াছে। صفت গুণ موصوقف (গুণান্বিত) একে অপরের চাইতে অধিকতর শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজনীয় নহে।
الله শুধু মহা বিশ্বের মহান প্রভুর নাম। সৃষ্টির কেহই এই নামে অভিহিত নহে।
بسم الله الرحْمن الرَحِيْم বাক্যে আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় নামসমূহের মধ্য হইতে সর্বপ্রথম উক্ত নাম ব্যবহার করিয়াছেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহাকে ভিন্ন অন্য কাহাকেও الرحمن নামে অভিহিত করিতে নিষেধ করিয়াছেন। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
قل ادعوا الله أو ادعوا الرحمن أناما تَدعوا قله الأسماء الحسية (ইহাতে বুঝা যায়, الله নামের মত الرحمن নামেও শুধুমাত্র তিনিই অভিহিত হইতেন।)
মুসাইলামাতুল কাযযাব الرحمن নামে অভিহিত করিলেও তাহার অনুসারী পথভ্রষ্ট ব্যক্তিগণ ভিন্ন অন্য কেহই উহা স্বীকার করে নাই। بسم الله الرحْمن الرحيّم বাক্যে আল্লাহ্ তা’আলা الله নামের অব্যবহিত পরেই الرحمن নামটি উল্লেখ করিয়াছেন।
الرحيم আল্লাহ্ পাক ছাড়া অন্য কাহাকেও অভিহিত করা যাইতে পারে। যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رءوف رحيم –
‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য হইতে একজন রাসূল আগমন করিয়াছে। তোমাদের অনভিপ্রেত বিষয়গুলি সেই রাসূলের নিকট কষ্টদায়ক হইয়া থাকে। সে তোমাদের অত্যন্ত অভিলাষী, মু’মিনদের প্রতি সে বড়ই স্নেহপরায়ণ ও দয়ালু (রহীম)।
তেমনি আল্লাহ্ তা’আলার অন্যান্য নামেও তিনি ভিন্ন অন্য কেহ অভিহিত হইতে পারে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
إِنَّا خَلَقْنَا الإِنْسَانَ مِنْ نُّطْفَةٍ أَمْشَاجِ نَبْتَلِيْهِ – فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا
“নিশ্চয় আমি মানুষকে পরীক্ষা করিবার জন্য (নর-নারীর) মিশ্র শুক্র হইতে সৃষ্টি করিয়াছি এবং তাহাকে سميم (শ্রবণকারী) ও بصير (দর্শনকারী) বানাইয়াছি।
বিসমিল্লাহর ভিতর আর-রহমান নামের পরেই আল্লাহ্ তা আলা “আর-রহীম’ নামটি উল্লেখ করিয়াছেন। সারকথা এই যে, আল্লাহ্ পাকের নামসমূহ দুই প্রকারে বিভক্ত। এক প্রকারের নাম শুধু তাঁহার জন্যই নির্দিষ্ট। অন্য কেহ এই নামে অভিহিত হইতে পারে না। যেমন আল্লাহ্, আর-রহমান, আল্-খালিক, আর্-রাযিক প্রভৃতি নাম। আরেক প্রকারের নামের প্রয়োগক্ষেত্র ব্যাপক। এই প্রকারের নামে অন্য কেহও অভিহিত হইতে পারে। বলাবাহুল্য যে, শেষোক্ত নামসমূহ হইতে প্রথমোক্ত নামসমূহ অধিকতর খ্যাত ও মর্যাদাসম্পন্ন। আল্লাহ্ তা’আলার একাধিক নাম। ব্যবহারের ক্ষেত্রে নামের খ্যাতি ও মর্যাদার ভিত্তিতে উহার বিন্যাস বাঞ্ছনীয়। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ বাক্যটিতে প্রথমে ‘আল্লাহ্, তারপর ‘আর-রহমান’ ও শেষে ‘আর-রহীম’ নামটি উল্লেখ করিয়াছেন।
এখানে প্রশ্ন দেখা দেয় যে, الر حمن নামে যেহেতু الرحيم হইতে গুণের আধিক্য বিদ্যমান, তথাপি الرحيم নামটি উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল কিসে? ইহার ভিতরে কি অন্য কোন রহস্য লুক্কায়িত রহিয়াছে?
আতা খোরাসানী হইতে ইমাম ইব্ন জারীর উক্ত প্রশ্নের নিম্নরূপ জবাব বর্ণনা করিয়াছেনঃ ‘আল্লাহ্ তা’আলার কোন সৃষ্টির জন্য الر حمن নাম গ্রহণ করা নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কোন কোন সৃষ্টি উক্ত নাম গ্রহণ করিয়াছে ৷ তাই আল্লাহ্ তা’আলা এখানে ‘আর-রহমান’ নামের পরে ‘আর-রহীম’ নাম উল্লেখ করিয়া দ্বৈত ব্যবহারের মাধ্যমে নামটিকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করিয়াছেন। এখন এই নামে আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য আর কাহাকেও বুঝাইবে না এবং অন্যের জন্য এই বিশিষ্ট নাম ব্যবহারের দ্বার রুদ্ধ হইল।’ আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
কেহ কেহ বলেন, আল্লাহ্ তা’আলার এই ‘আর-রহমান’ নামটি আরবদের নিকট অপরিচিত ছিল। এই কারণেই তিনি বলিয়াছেনঃ
قُلِ ادْعُوا اللَّهَ أَوِ ادْعُوا الرَّحْمَنَ أَيَّامًا تَدْعُوا فَلَهُ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى –
হুদায়বিয়ার সন্ধিপত্র লিপিবদ্ধ করিবার কালে নবী করীম (সাঃ) যখন হযরত আলী (রাঃ)-কে বলিলেন লিখঃ
بِسمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
তখন কাফির আরবরা বলিয়া উঠিল, আমরা ‘আর-রহমান’ চিনি না, ‘আর-রহীম’ও চিনি না। নিম্নোক্ত আয়াতও কাফিরদের এই অজ্ঞতার সাক্ষ্য দেয়ঃ
واذًَا قيّل لَهُمُ اسْجِّدوا للحن قَالُوًا ما الِرَخْدُنٌ أَنْسْجُدٌ لما تَأْمّرتَا وزادهم نفوراً
“অতঃপর যখন অহাদের বলা হয়, তোমরা ‘আর-রহমান’-কে সিজদা কর, তখন তাহারা বলে, ‘আর-রহমান’ কি বস্তু? তুমি যাহাকে সিজদা করিতে বলিবে আমরা কি তাহাকেই সিজদা করিব? অনন্তর তাহাদের বিদ্বেষ আরও বাড়িয়া যায়।”
কোন কোন বর্ণনায় আছে কাফিররা বলিত, আর রহমান বলিতে আমরা তো শুধু ইয়ামামার আর-রহমানকে জানি।
আরবদের নিকট الرحمن নামের এই অপরিচিতির কারণে বিসমিল্লাহ শরীফে উহার সহিত الرحيم নাম জুড়িয়া দেওয়া হয়। তবে আরবদের নিকট الرحمن নামটি অপরিচিত ছিল এই তথ্যটি সঠিক বলিয়া মানা যায় না। মূলত উক্ত নাম তাহাদের অবিদিত ছিল না। অবশ্যই তাহারা উহা জানিত। তথাপি সত্যের প্রতি বিদ্বেষের কারণে তাহারা না জানার ভান করিত। জাহেলী যুগের কবিতায় তাহারা আল্লাহকে আর-রহমান নামে আখ্যায়িত করিত ইমাম ইব্ন জারীর বলেন, জাহেলী যুগের জনৈক কবির নিম্ন পংক্তিতে উহার প্রমাণ মিলেঃ
الا ضريت تلك الفتاة هجينها الا قضب الرحمن ربى يفينها
“সেই যুবতী কেন সেই হীনমনা লোকটিকে মারিল না? আমার প্রতিপালক প্ৰভু ‘আর-রহমান’ তাহার দক্ষিণ হস্ত কেন কর্তন করিলেন না?” অনুরূপ সালামা ইব্ন জুন্দুব নামক জাহেলী যুগের জনৈক কবির রচনায় দেখিতে পাইঃ
عجلتم علينا ان عجلنا عليكم – وما يشاء الرحمن يعقد ويطلق
“আমরা তোমাদের উপরে যেরূপ ত্বরিত হামলা করিয়াছি, তেমনি তোমরাও আমাদের উপরে ত্বরিত হামলা করিয়াছ। অবশ্য ‘আর-রহমানের’ ইচ্ছায়-ই দৃঢ়তা বা শৈথিল্য ঘটিয়া থাকে।”
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে যাহ্হাক, আবূ রওক, বিশার ইব্ আম্মারা, উসমান ইব্ন সাঈদ, আবূ কুরাইব এবং ইমাম ইবন জারীর বর্ণনা করেনঃ
আসা শব্দটি الرحمن শব্দটি الفعلان ওযনে সৃষ্ট। উহা الرحمة শব্দ হইতে সংগঠিত। আরবী ভাষায় উহার প্রচলন রহিয়াছে। الرحيم - الرحمن শব্দদ্বয়ের অর্থ হইতেছে, “তিনি যাহার প্রতি কৃপা প্রদর্শন ও রহমত বর্ষণ করিতে চাহেন, তাহার প্রতি অতিশয় কৃপাপরায়ণ ও রহমত বর্ষণকারী। তেমনি তিনি যাহার প্রতি কঠোর ও শক্ত ব্যবহার করিতে চাহেন, তাহার প্রতি অতি কঠোর ও শক্ত। আল্লাহ্ তা’আলার প্রতিটি নামের তাৎপর্য অনুরূপ হইবে।”
হযরত হাসান হইতে ধারাবাহিকভাবে ‘আওফ, হাম্মাদ ইব্ন মাস’আদা, মুহাম্মদ ইব্ন বিশার ও ইমাম ইব্ন জারীর বর্ণনা করেনঃ
হযরত হাসান বলিয়াছেন, ‘আল্লাহ্ তা’আলা ভিন্ন অন্য কাহাকেও الرحمن নামে অভিহিত করা নিষিদ্ধ।
হযরত হাসান হইতে ধারাবাহিকভাবে আবুল আশহাব, যায়দ ইব্ন হাব্বাব, আবূ সাঈদ ইয়াহিয়া ইব্ সাঈদ আল কাত্তান এবং ইমাম ইব্ন হাতিম বর্ণনা করেনঃ
‘আর-রহমান’ নাম ধারণ করা কোন মানুষের জন্য বৈধ নহে। আল্লাহ্ তা’আলা উক্ত নাম শুধু নিজের জন্য নির্দিষ্ট করিয়া রাখিয়াছেন।’
হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
“নবী করীম (সাঃ) কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত অংশ নিম্নে বর্ণিত নিয়মে ‘প্রত্যেক আয়াতের শেষ ও শুরুর বর্ণকে পৃথক রাখিয়া তিলাওয়াত করিতেন।
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ- الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ – الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ- مالك يوم الدين –
এখানে তিনি বিসমিল্লাহ শরীফের শেষ মীমকে আলহামদু শব্দের হামযাহ হইতে পৃথক করিয়া তিলাওয়াত করিতেন।
একদল কিরাআত বিশেষজ্ঞ উপরোক্ত নিয়মেই পড়েন। আরেক দল কিরআত বিশেষজ্ঞ الر حيم শব্দের ‘মীম’ শব্দকে الحمد শব্দের হামযাহর সহিত মিলাইয়া পড়েন। তাহার দুইটি অস্বরান্তিক ব্যঞ্জন বর্ণের পরস্পর সন্নিহিত হইবার কারণে ‘মীম’ বর্ণটিকে ‘যের’ দিয়া পড়েন। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের অভিমত ইহাই। কূফাবাসীর মাধ্যমে ব্যাকরণ শাস্ত্রবিদ ‘কাসাঈ’ বর্ণনা করিয়াছেন যে, কোন কোন আরব বিশেষজ্ঞ বিসমিল্লাহ শরীফের শেষ ‘মীম’কে যবর দিয়া এবং ‘আলহামদু’ শব্দের হামযাহকে উহ্য করিয়া পড়েন। তাহারা ‘মীম’ বর্ণকে ‘সাকিন’ করিয়া হামযাহ বর্ণের যবরকে সেখানে স্থানান্তরিত করেন। যেমনঃ الم- أللّه لآاله- الا هر
এখানে الله শব্দের হামযার যবরকে الم আয়াতের মীমে স্থানান্তরিত করিয়া উক্তরূপে পড়া হয়।
ইবন আতিয়্যা অবশ্য বলিয়াছেন, আমার জানা মতে কেহ উক্ত আয়াত দুইটি উপরোক্ত নিয়মে পড়েন নাই।